“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৬
(নূর নাফিসা)
.
.
সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে মেহেদী। নাহিদা তখন কিচেনে ছিলো। সেখান থেকে মেহেদীর গলা শুনে হাতের কাজ সেড়ে একটু পর রুমে এসেছে। মেহেদী হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে মাত্র। নাহিদা খাট থেকে ব্লেজার হাতে নিতে নিতে বললো,
– ভাত খাবে এখন?
মেহেদী তাকে দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে বললো,
– আরে, রাখো রাখো! আমার কাজ আমি নিজেই করে নিতে পারবো! তুমি বরং যেটাতে লাভ হবে সেটা করো। তা বলো শুনি, আশিকার দিনক্ষণ কেমন কাটছে আশিকের সঙ্গে?
– মানে!
– মানে আবার কি! আশিক ভাইয়ের সাথে তোমার দিন কেমন কাটলো সেটাই জানতে চাইলাম আরকি!
– কি বলছো এসব! আর তুমি এমন বিহেভই করছো কেন আমার সাথে!
– এসব ফালতু নাটক বাদ দাও। ওপেন রিলেশনে আবার এতো লুকোচুরির কি আছে! এসব অনেক আগে থেকেই আমার জানা! শুধু চিনতে ভুল করেছিলাম তোমাকে!
নাহিদার চোখে পানি চিকচিক করছে! মেহেদীর কথায় সে সন্দেহের অবকাশ দেখতে পাচ্ছে! তাই বললো,
– তুমি কি বলতে চাইছো ক্লিয়ার বলো। তোমার কথা আমার মাথায় আটছে না!
– তা কেন আটবে! ধরা পড়ে গেলে আঠালো জিনিসও মাথায় আটে না।
– মেহেদী, তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। শুধু শুধু এমন আচরণ না করে আমার অপরাধটা কি সেটা তো একবার বলো!
– ভুল! তোমার ওই আশিক ভাই ভুল? তোমাদের সম্পর্ক ভুল? আশিকের আইডি থেকে মেসেঞ্জারের মেসেজগুলো ভুল? এনগেজড হওয়ার পরও নিজ চোখে দেখা দুজন গা ঘেঁষে ভার্সিটির ছাদে সময় কাটাও সেসব ভুল! নিজেকে কাক মনে করো? তোমার চোখ বন্ধ মানেই সবার চোখ বন্ধ? তুমি ছিলো তিন তলা ভবনে আর আমি চার তলা ভবনের ছাদে! তবে এতে আমার কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না। তখন যদি পালিয়ে যেতে না, আমার খুব ভালো হতো! আমি বরং খুশির ঠেলায় বন্ধুদের ট্রিট দিতাম! কিন্তু কতটা জঘন্য তুমি, একবার ভেবে দেখো! ওদিকে একজনকে ফিক্সড রেখে এদিকে আমাকে ফাসিয়ে তারপর এখন লাথিঝাটা দিচ্ছো! কিসের লোভ ছিল বলোতো আমাকে একটু? টাকার জন্য? বাহ! কি প্রেম, কি মহব্বত! কি সুন্দর ভালোবাসার ছন্দ! ছন্দে ছন্দে বাজে প্রেমের আনন্দ! আমি তো আর ছন্দে প্রকাশ করতে পারি না আমাকে! তা, এতো লুকোচুরির প্রয়োজন কি, চলে যাও না একেবারে। কেউ বাধা দিবে না তোমাকে। বলো তোমার আশিককে এসে নিয়ে যেতে।
– মেহেদী!
– শাট…..আপ! ওই নোংরা মুখে আমার নাম উচ্চারণ করবে না! তুমি ভার্সিটিতে তার সাথে ঘুরে বেড়াতে পারো আর আমি চোখে পড়লেই ডিস্টার্বড হয়ে যাও! বিশ্বাস করো, তোমার খোজ করতে আমি মোটেও যাইনি। রায়ান বলেছিলো ভার্সিটিতে সাইফুদ্দিন স্যার এসেছে তাই কেবল স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আর তুমি! ছি! ক্লাস মিস করে প্রেমিক নিয়ে ঘুরাঘুরি! সাথে আবার ছোট বোনের হাসব্যান্ড! বাবার অসুস্থার অজুহাতে দু’জন একসাথে হসপিটালেও রাত কাটিয়েছো আবার বলছো ভুল ভাবছি আমি! কে জানে আর কি কি করেছো! আমি তো আর বউয়ের গোয়েন্দা নয়! বলতে গেলে চোখ বন্ধ করেই চলাফেরা আমার! তবুও চোখে আটকে যাও! ডিজগাস্টিং!
মেহেদী তোয়াল ঢিল মেরে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। যেন এমন একটা মুহুর্ত খুজছিলো তার রাগ গুলো প্রকাশ করার! আর এদিকে নাহিদা ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো! তার আচরণ ও কথাবার্তায় নাহিদা পুরোপুরি শকড! কি বলে গেলো মাথার খোলস ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে যেন খুব কষ্ট হচ্ছে! এতোটা সন্দেহ নিয়ে বসে আছে সে! এতোটা সন্দেহ কি করে করতে পারে তাকে! বাবা হসপিটালে ছিলো সেখানে কি এক বারের জন্যও আশিকের ব্যাপারে ভেবেছে সে! তার তো মাথায়ও ছিলো না তখন কে আছে হসপিটালে! তাছাড়া আশিক তো কেবল পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো। নিরুপায় থাকাকালীন সাহায্য গ্রহণও কি পাপ! যার ফলে মেহেদী তাকে নিয়ে এতো সন্দেহে আছে! কতটা ভয়াবহ ছিলো তখন তাদের পরিবারের অবস্থা, তা কি তার জানা নেই! আর ভার্সিটি! সে তো নাফিসার সাথে দেখা করতে ও কোচিং সম্পর্কে জানতে গিয়েছিলো! ভাবতেও পারেনি আশিক কিংবা মেহেদী কারো সাথে দেখা হবে! আর মেসেজ! সে কি ইনবক্স চেক করেছে!
নাহিদা চোখ মুছে দ্রুত উঠে তার ফোন হাতে নিলো। আশিকের আইডি চেক করে দেখলো বিয়েরও কত আগে সেই যে মাঝেমধ্যে ছন্দ লিখে পাঠাতো তা ছাড়া আর কোনো মেসেজ নেই। ওসব দেখে মেহেদী কি করে সন্দেহ করতে পারে! আশিকের সাথে তো তার কোনো যোগাযোগই নেই! বিয়ের পূর্বের কথা জানে তবুও তো এতোদিন সব ভালো ছিলো, এখন হঠাৎ এমন সন্দেহের উৎপত্তি কেন হচ্ছে! না, এভাবে চলবে না। এই আশিক নিয়ে মেহেদীর ভুল ভাঙাতে হবে! ছোটখাটো বিষয় থেকে বড় ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। তারচেয়ে ভালো আগে থেকেই সবটা মিটমাট করে ক্লিয়ার করা। তাকে সবটা খুলে বলতে হবে যে, আশিকের সাথে তার কখনোই তেমন কোনো সম্পর্ক ছিলো না৷ সে কেবল ফ্রেন্ড ও ফ্যামিলির দিক থেকে রিলেটেড ছিলো। এর বাইরে কিছুই না।
নাহিদা চোখ মুছে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো মেহেদীর খোজে। কিন্তু তাকে বাসায় পেল না! সে তখন বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে। নাহিদা কাজকর্ম সেড়ে মেহেদীর অপেক্ষায় আছে। মেহেদী বাড়ি ফিরলেই আগে তার ভুল ভাঙাবে। তারপর বাকিসব। সন্ধ্যা থেকে সে একবারের জন্যও বই হাতে নেয়নি। ভেবেছে শুধু, মেহেদী তাকে বুঝবে কি-না। কিন্তু তাকে যে বুঝতেই হবে। এভাবে সুশৃঙ্খল জীবনের সূচনায় বিশৃঙ্খলতা আনার কোনো মানেই হয় না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তাকে বুঝানোর।
সেকেন্ড কাটে, মিনিট কাটে, কাটে ঘন্টার পর ঘন্টা!
কিন্তু প্রহর যে কাটে না, আনচান করছে শুধু হৃদপিন্ডটা!
ডিনারের সময় হয়ে এলে নাহিদা কল করলো। ফোন সুইচ অফ! রাত এগারোটা বেজে যায়, জহিরুল ইসলাম কলের পরে কল করে ফোন সুইচ অফ! চিন্তায় পড়ে যায় বাড়ির স্বজন, তিনজন! জহিরুল ইসলাম তার ফ্রেন্ডদের কাছে কল করার জন্য প্রস্তুত হতেই কলিং বেল বেজে উঠলো। নাহিদা হাতমুখ ধোয়ার জন্য বাথরুমে ছিলো তখন। বেলের শব্দ শুনে সে যতদ্রুত সম্ভব বের হয়ে এসেছে দেখার জন্য যে, মেহেদী এসেছে কিনা! তোয়াল হাতে নিয়ে আলতো ভাবে মুখ মুছে যখনই দরজার দিকে আসতে যাবে তখনই মেহেদী হেলেদুলে গান গাইতে গাইতে রুমে এলো, “আমি এমন একটা তুমি চাই, এমন একটা তুমি চাই! যে তুমিতে আমি ছাড়া অন্য কেহ নাই!”
মেহেদীকে দেখে নাহিদার ভেতরটা ধুক করে উঠলো! তাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না! সে কি স্বাভাবিক নেই! তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেহেদী শার্ট খুলতে খুলতে বললো,
– ওই, আমার দিকে তাকাও কেন? হুম? ওই চোখ দিয়ে তোমার আশিককে দেখো, কেমন?
নাহিদা তার দিকে এগিয়ে এসে মেহেদীকে তার দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করলে মেহেদী তার হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে বললো,
– ডন্ট টাচ মি এগেইন! ডন্ট টাচ!
তাকে দেখার পর নাহিদা যা সন্দেহ করেছিলো তা-ই হয়েছে! মেহেদী আজ মদ্যপান করে এসেছে! সে বিস্ময়ের সাথে বললো,
– ড্রিংকস করেছো তুমি!
– ড্রিংকস!
মেহেদী তার দিকে এগিয়ে এসে নাহিদার দুই গাল একহাতে চেপে ধরে নাকে নাক লাগিয়ে বললো,
– দেখোতো আমি ড্রিংকস করেছি কিনা?
বিশ্রী গন্ধে যেন নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে! নাহিদা শরীরের সর্বস্ব দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো তাকে! মেহেদী টাল সামলাতে না পেরে খাটের ধারে ফ্লোরে পড়ে গেছে! খাটে ভর করে সে আবার উঠতে উঠতে বললো,
– তুমি কি জানো, তুমি অনেক বাজে হয়ে গেছো! হার্ট ফুটো করে এখন আবার আমাকে মারতেও শিখে গেছো! হোয়াট এভার, নট ইন্টারেস্ট উইথ ইউ।
মেহেদী শার্ট খুলে ফ্লোরেই ফেলে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অত:পর ফোন ফেসের সামনে রেখে ভিডিও কল করলো। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো জেনিফা নামের সেই মেয়েটি! মেহেদীকে দেখার পরপরই মেয়েটি চিৎকার করে বললো,
– হোয়াট এ সারপ্রাইজ ডিয়ার! তুমি কি ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছো!
– না, তোমার সাথে ড্রিম আউটে যাবো।
– যাহ, অনেক দুষ্ট হয়ে গেছো! আর অনেক পচাও! তুমি জানো কত মিস করি তোমাকে! একটা বার কলও করো না! আমি কল করেও পাইনা তোমাকে! এই তুমি আমাকে ব্লক করেছো না?
– না, তো! নিউ সিম নিয়েছি। তাইতো নিউ সিমে কল করলাম!
– দেখেছো, কত্ত বাজে তোমার ফ্রেন্ডস! কতবার বলেছি তোমার এক্টিভ নম্বর দিতে, কেউ দিলো না! সবাই বলে মেহেদীর সাথে ঝগড়া তাই সবাইকে নাকি ব্লক করেছো!
ভেতরটা ভেঙেচূড়ে মুচড়ে যাচ্ছে রুমে স্থীরভাবে দাড়িয়ে থাকা নাহিদার! এটা কি করে করতে পারলো সে! সে তো বলেছিলো আর কখনো স্পর্শ করবে না! তাহলে আজ আবার কেন মদ্যপান করলো! তার কথার কি কোনো মূল্য নেই! ঘরে স্ত্রী রেখে আবার বাইরের একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে ভিডিও চ্যাট করছে! আর সইছে না প্রান! নাহিদা মুখ চেপে ধরে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! সেখানে এসেও সে স্তব্ধ! জহিরুল ইসলাম বসে আছে চেয়ারে আর মেহেরুন টেবিলে কনুই ভর করে মাথা চেপে রেখেছে! নাহিদা চোখ মুছে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো তাদের কাছে। জহিরুল ইসলাম খুব শান্ত গলায় বললো,
– আরও কখনো কি মাতাল অবস্থায় দেখেছো তাকে?
নাহিদা নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো,
– ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে গেলে প্রায়ই খায়! বিয়ের রাতেও নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাসায় এসেছে, বাবা। এরপর আমি অনেক বুঝিয়ে নিষেধ করেছিলাম, মেনেছিলোও। এতোদিন পর আজ আবার হঠাৎ!
– বিয়ের দিন মাতাল অবস্থায় ফিরলে জানাওনি কেন কাউকে?
নাহিদা নিশ্চুপ হয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো জবাব নেই তার মুখে! জহিরুল ইসলামের গলা শান্ত থাকলেও তিনি একটুও স্বাভাবিক নেই সেটা নাহিদাও বুঝতে পারছে! তিনি যতটাই শান্ত গলায় কথা বলছেন ঠিক ততটাই ভয়ঙ্কর হয়ে আছেন! নাহিদার কান্না আসছে খুব! জহিরুল ইসলাম যাওয়ার অনুমতি দিলে নাহিদা দৌড়ে মেহতাজের রুমে চলে গেলো! দরজা লাগিয়ে সে ধপাস করে খাটে এসে পড়লো আর বালিশে মুখ চেপে কান্না করতে লাগলো! প্রচুর কাদছে যদিও বালিশে চাপা পড়ে শব্দ খুবই কম শোনা যাচ্ছে। ভাবতেও পারেনি মেহেদী আজ তার দেয়া কথা ভঙ্গ করবে! ভেবেছিলো সে ফিরলেই সবটা গুছিয়ে বলে ক্লিয়ার করে নিবে সন্দেহ। শুরু থেকে সবটা সাজিয়েও রেখেছিলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না! এখন বলেই বা আর কি হবে! ধ্বংস করে দিয়েছে লোকটা! জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর পরিকল্পনায় ব্যঘাত সৃষ্টি করে সব ধ্বংস করে দিয়েছে। তাকে নিয়ে জীবনের যে নবখোয়াব দেখেছিলো, শুরুতেই সবটা বিলীন করে দিয়েছে। পিতামাতাকেও বড্ড আঘাত করে ফেলেছে। এর ক্ষমা হয় না। হবেও না!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৭
(নূর নাফিসা)
.
.
আলো ফুরিয়ে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে,
এ যে রাতের অন্ধকার নয়!
ঘর আলো, মন কালো,
কালোতেই হয়ে গেছে, রঙিন জীবন ক্ষয়!
হলো রে হলো আজ, সমস্ত ধ্বংসের জয়!
দুনিয়া বড়ই আযব, তবুও মিছে নয়!
সারারাত কান্না করে কাটিয়ে দিলো নাহিদা! একটা মুহুর্তের জন্যও চোখে ঘুম নামেনি! আর না হয়েছে শান্ত মন! রাতের অন্ধকার কেটে গেছে কিন্তু মনে ঘনিয়ে এসেছে তা বহুগুণ! ফজরের নামাজ পড়ে সে বেরিয়েছে রুম থেকে। এমনিতেই বাড়ি নিরব থাকে তার মাঝেও আজ স্তব্ধতা ছেয়ে গেছে চার দেয়ালের অভ্যন্তরে! কোনো অচেতন প্রাণীরও সাড়াশব্দ নেই! কি করে থাকবে! এখানে যাদের অবস্থান, তারা সবাই চেতন!
মেহেরুন গালে হাত রেখে সোফায় বসে ছিলো। জহিরুল ইসলামকে ঘরে দেখা যায়নি। মেহেদী এলোমেলোভাবে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। অতিরিক্ত কোনো শব্দ না করে চুপচাপ ঘর ঝাড়ু দিলো নাহিদা। অতপর মেহেরুনের কাছে এসে বললো,
– মা, রান্না কি বসাবো?
– রুটি বানাবো তোর বাবার জন্য।
মেহেরুনের মুখও দেখার মতো না। কেউ ঘুমায়নি এই একটা রাত, অথচ সে ঘুমাচ্ছে শান্তিতে! কে জানে শান্তি পেয়েছিলো নাকি মাঝরাতে মাথা ব্যথায় ছটফট করেছে! ভাবতে ভাবতে নাহিদা চুপচাপ সব ব্যবস্থা করে এখন রুটি বেলছে। হঠাৎই দুইটা থাপ্পড়ের শব্দ পেলো সাথে জহিরুল ইসলামের রাগান্বিত কন্ঠ! নাহিদা দৌড়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো! বুকের ভেতরটা তার ধুকপুক করে কাপছে! জহিরুল ইসলাম মেহেদীকে থাপ্পড় দিয়েছে। বাবার সামনে দাড়ানো মেহেদীর দৃষ্টি এখন নিচের দিকে স্থীর! জহিরুল ইসলাম ধাধানো কণ্ঠে বললো,
– ছি! আজ এই প্রথম মন থেকে সত্যিটা বলছি। ঘৃণা লাগছে তোর মতো একটা জানোয়ারকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিতে! এমন দিন দেখার আগে আল্লাহ দুনিয়া থেকে নিয়ে গেলো না কেন আমাকে! লজ্জা লাগছে ভাবতে যে, আমি তোর জন্মদাতা! ছি! জীবনের সকল প্রচেষ্টা যার জন্য সে নাকি এমন পিশাচ হয়! ছাপ্পান্ন বছর বয়সে আজও পর্যন্ত স্পর্শ করে দেখলাম না কোনো মাদক! আর সেই আমার ছেলে নাকি ফ্রেন্ডশিপ করে মাদকের সাথে! দিনের পর দিন, রাতের পর রাত এক হয়ে যায় তার কথা ভেবে! আর সে-ই ছেলে আমার মদ্যপান করে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায়! এ আমার ছেলে কিছুতেই হতে পারে না! এক কাজ করবি বাবা? কাটারি দিয়ে আমাকে খুন করে তারপর সারাদিন বসে বসে মদ্যপান কর! এই বাড়ি গাড়ি যত ধনসম্পদ আছে আমি সব তোর জন্য গড়েছি। তুই সব ধ্বংস করে দে মদ্যপান করে, কিছু বলবো না আমি! অন্তত ওসব আমাকে দেখাস না! আমাকে দেখাস না ওসব!
এই বলে জহিরুল ইসলাম এলোপাথাড়ি থাপ্পড় দিতে লাগলো! মেহেরুন কান্না করতে করতে এসে থামানোর চেষ্টা করছে! জহিরুল ইসলাম ধমকের সাথে বললেন,
– আমার চোখের সামনে থেকে দূর হতে বলো। এই পাপকে পুষে আমি অনেক পাপ করে ফেলেছি, এখন এর মুখ দেখে আমি আর পাপ করতে চাই না!
অতি কষ্টে জহিরুল ইসলামের গলা ধাধিয়ে গেছে! মেহেরুন ঠেলে ঠেলে জহিরুল ইসলামকে রুমের দিকে নিয়ে গেলো। আর মেহেদী হাতের পিঠে চোখ মুছে রুমে এসে ফোন ওয়ালেট হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে! নাহিদা কিচেনের দরজায় হেলান দিয়ে মুখ চেপে কান্না করছে! ওদিকে মেহেরুন রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেছে। মেহেদীকে রুমে খুজতে লাগলো কিন্তু পেল না! নাহিদা বললো, “উনি বেরিয়ে গেছে, মা।”
মেহেরুন কান্নার সাথে বললো,
– নাহিদা, আমার কিছু ভালো লাগছে না! ভেতরটা বড় অশান্ত লাগছে রে মা! ওদিকে তার বাবা ছেলের গায়ে হাত উঠিয়ে নিজে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে আর এদিকে ছেলে অভিমান নিয়ে চলে গেলো! আমার খুব ভয় লাগছে! এই পাগল ছেলে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে কেউ ঠিক থাকতে পারবো না! কেউ না!
নাহিদা মেহেরুনকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতে কি লাভ হচ্ছে! মায়ের মন তো আরও বেশি ছটফট করে সন্তানের জন্য! নাহিদা মেহেরুনের ফোন থেকে তুর্যের নম্বরে ডায়াল করে মেহেদীর সাথে দেখা করতে বললো। আর তার পরিবারে তাকে নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে, আপাতত যেন সে মেহেদীকে একটু সামাল দেয় সেজন্য অনুরোধ করলো।
সারাদিন কেটে গেলো সকলের অনাহারে! সকালে যে রুটি বানিয়েছিলো তাতেও খাওয়াদাওয়া চলেনি! না গিয়েছে আজ অফিস আর না বসেছে কারো মন কোনো কাজে। চলার মতো শুধু কান্নাটাই চললো বিরতি নিয়ে! মেহেদীর দেখাও মিললো না কোন এক মুহূর্তের জন্য। তবে তুর্য একবার জানিয়েছিলো সে মেহেদীর সাথে আছে। দিন শেষে আজ রাত পেরিয়ে গেলো কিন্তু মেহেদী বাড়ি ফিরলো না! ঘরের বাইরে এমন অঘটনের কোনো আচও লাগতে দেয়নি কেউ! এমনকি মোহতাজও জানে না কোনো কিছু! সবাই মনমরা হয়ে ঘরে বন্দী!
সকালে নামাজ পড়ে কুরআন পড়তে বসেছে নাহিদা, একটু শান্তির প্রত্যাশায়! হঠাৎই মেহেরুনের কান্নাজড়িত কণ্ঠে হাক শোনা গেলো। নাহিদা ভয় পেয়ে কুরআনের আয়াত শেষ না করেই কুরআন বন্ধ করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। জহিরুল ইসলামের রুমে এসে দেখলো মেহেরুন জহিরুল ইসলামের বুকে মালিশ করছে আর কান্না করছে! নাহিদাকে দেখেই বললো,
– নাহিদা, তোর বাবা দেখ কেমন করছে! মেহেদীকে কল কর, মেহতাজকে কল কর! আল্লাহ তুমি রক্ষা করো!
নাহিদার পুরো শরীরে কম্পন ধরে গেছে! সে কি রেখে কি করবে মাথায় ধরছে না! ফোনের জন্য নিজের রুমের দিকে যেতে নিয়েও গেলো না! খাটে থাকা জহিরুল ইসলামের ফোন হাতে নিয়েই মেহেদীর ফোনে কল করলো। কিন্তু ফোন বন্ধ! অত:পর আসিফের ফোন নম্বর খুজে ডায়াল করতে করতে মেইন দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো। আসিফকে কল করেই নিচে এসে ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে গেলো। আর আসিফের বলা কথা অনুযায়ী জহিরুল ইসলামকে নিয়ে নিকটবর্তী ইসলামী ব্যাংক হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ওদিকে আসিফ পৌছে গেছে হসপিটাল। সেখানে জরুরি বিভাগের ডাক্তার দেখালো। অত:পর পরিস্থিতি বুঝে হসপিটালে ভর্তি করা হলো। ছোট খাটো এক স্ট্রোক হয়ে গেছে জহিরুল ইসলামের। মেহতাজ কান্না করতে করতে দুপুরের দিকে হসপিটাল এসেছে। নিয়াজ উদ্দিনের মতো আবারও এলো এমন এক দিন! একের পর এক এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ছে না!
পরিবারের লোকজন সব এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। কখনো ডাক্তার, কখনো রিসিপশন কখনো বা ওষুধপত্রের অনুসন্ধান! নিজেদের জন্য ভাবনা যেন তাদের হারাম হয়ে গেছে! সারাদিন পেরিয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ভর্তির ফি নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছিলো, সেটা মিটমাট করা হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য যখন নাহিদা রিসিপশনের দিকে আসছিলো তখন মেহেদীকে দৌড়ে হসপিটালে প্রবেশ করতে দেখলো। এখনো ঠিক সেই পোশাকেই আছে যেই পোশাকে কাল ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। এলোমেলো অবস্থা প্রায়! মেহেদী নাহিদাকে দেখে তার কাছে এসে বললো, ” আব্বু কোথায়?”
কিন্তু নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। সে ঝাপসা হয়ে আসা চোখ মুছতে লাগলো। জবাব না পাওয়ায় মেহেদীও আর তার জবাবের আশায় না থেকে রিসিপশনেই জিজ্ঞেস করে রুম নম্বর জেনে নিলো। অত:পর দৌড়ে সেদিকে ছুটলো। নাহিদা রিসিপশনে কথা বলে জানতে পারলো আসিফ সবটা মিটিয়ে গেছে। সে-ও আবার কেবিনে চলে এলো। মেহেদী তার বাবাকে দেখে স্তব্ধ! ফোলাফোলা গম্ভীর মুখ নিয়ে বেডে শুয়ে আছেন জহিরুল ইসলাম। মা পাশে বসেই শব্দহীন কাদছে! মেহেদীর উপস্তিতি টের পেয়ে তাকালো মেহেরুন ইসলাম। মেহেদী অপরাধী মনোভাবের সাথে পদার্পণ করলো কেবিনে। জহিরুল ইসলামও দেখেছেন কিন্তু প্রত্যক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেনি! মেহেদী মেহেরুনকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– আব্বু এখন কেমন আছে, আম্মু?
মেহেরুন ইসলাম দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। কোনো জবাব দিতে পারছে না তিনি! মনে হচ্ছে কেউ গলা টিপে ধরে রেখেছে! মেহেদী দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এলো। নাহিদাকে দরজার ওপারে দেখতে পেয়ে দু’হাতে বাহু চেপে ধরে দাতে দাত চেপে বললো,
– এসব ঘটছে আজ তোমার জন্য। শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি আজ ঘৃণিত সন্তান! কেউ আমাকে এখন সহ্যই করতে পারছে না! শুধুমাত্র তোমার জন্য আব্বু আজ এখানে! আই হ্যাট ইউ! যাস্ট হ্যাট ইউ, ইয়ার!
মেহতাজ ডাক্তারের কেবিন থেকে আসছিলো। মেহেদীকে নাহিদার বাহু চেপে ধরতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে ছাড়ালো মেহেদীকে। এবং বললো,
– হ্যাঁ, তার জন্যই বাবা আজ এখানে। তোর মতো এতো বড় এক ছেলে থাকতেও এইটুকু একটা মেয়ে হয়ে যথাসময়ে হসপিটালে এনেছে বাবাকে! সকাল থেকে এ পর্যন্ত বিনা ক্লান্তিতে দৌড়াদৌড়ি করছে কেবল একজন বাবাকে বাচাতে! তা না হলে যে কি হতো তা কেবল আল্লাহই ভালো জানেন! এ নাকি সন্তান আর সে নাকি পুত্রবধূ! কোথায় কার থাকার কথা আর সেখানেই তার অভাব! সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে গেছে আর এখন আসছে বাবার কাছে! লজ্জা করে না আবার তাকে দোষারোপ করতে! প্রতিটি জীবন ধ্বংস করার জন্য প্রত্যেক ঘরে ঘরে তোর মতো সন্তান হওয়া চাই! ছি! সময় হয়তো আল্লাহ রাখছে তোর হাতে। ভালো হয়ে যা। ভালো হতে তেমন পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না, যতটা পরিশ্রম হয় খারাপ হতে! একমাত্র ছেলে তুই, সেখানে পিতামাতার মুখে এক টুকরো হাসি না ফোটাতে পারলে কিসের সন্তান হইলি তুই? আর কীজন্যই বা বেচে আছিস? ওর মতো মেয়েকে দোষারোপ করতে!
মেহতাজ চোখ রাঙিয়ে নাহিদাকে টানতে টানতে চলে গেলো। মেহেদী এক হাতে নিজের মাথার চুল আঁকড়ে ধরলো! আজ এই প্রথম সবকিছু এমন অসহ্যকর মনে হচ্ছে তার কাছে। দুহাত একত্রে মুখে বুলিয়ে অত:পর ডাক্তারের কাছে এসে বাবার অবস্থা বিস্তারিত জানলো। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে! তার জন্যই আজ তার বাবার এই অবস্থা!
সন্ধ্যায় আরাফ ও নিয়াজ উদ্দিনও এসেছেন খবর পেয়ে। বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তারা চলে গেছে। কিন্তু ঘরের লোক ছাড়া বাইরের কেউ জানে না হঠাৎ কেন বয়ে গেলো এমন ঝড়! আজ সবাই হসপিটালে। আরিশার জন্য মেহতাজকে বাড়ি যেতে হয়েছে। তাকে বাড়িতে রেখে আসিফ আবার মেহেদীর বাড়িতে এসেছিলো, সাথে মেহেদীও। প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়চোপড় নিয়ে এ বাড়ি তালা দিয়ে তারা আবার হসপিটালে চলে গেলো। সকলেরই কাটছে নির্ঘুম রাত।
মাঝরাতে নাহিদা মেহেদীকে চিন্তিত হয়ে কেবিনের বাইরে পায়চারি করতে দেখে মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো। মেহেদী তার দিকে তাকাতেই নাহিদা বললো,
– কি, মাথা কাজ করছে না বাবার অবস্থা দেখে? সেদিন তো খুব কাজ করছিলো ঢকঢক করে গিলতে, তাহলে আজ কেন কাজ করছে না! আমাকে তো সুন্দর অপবাদও দিতে পেরেছেন। আজ বুঝতে পারছেন কিছু? একটুও কি উপলব্ধি করতে পারছেন, সেদিন আমার অবস্থাটা কেমন ছিলো! অসুস্থ বোনকে বাড়িতে রেখে আবার বাবাকে নিয়ে হসপিটালে দৌড়াদৌড়ি! কতটা ভয়াবহ ছিলো তখন আমার পরিবারের অবস্থা! আর আপনি সুন্দর সাজিয়ে ফেলেছেন আমি প্রেম জমিয়ে নিয়েছি! এটা প্রেম জমানোর উত্তম মুহূর্ত, তাই না? তাহলে আপনি এখন এতোটা চিন্তিত কেন? যান না, ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিন গিয়ে, গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রেম জমিয়ে তুলুন! দেখি কেমন পারেন!
কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বলে নাহিদা চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো! মেহেদীও তার কথার প্রেক্ষিতে কড়া দৃষ্টিতেই তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৬৮
(নূর নাফিসা)
.
.
গত দুই রাতের মতো আজও তাদের নির্ঘুম রাত কাটলো! ভোরে পাশের এক কেবিন থেকে আর্তনাদ শুনা গেলো। প্রসবের চারদিন পর আজ প্রসূতি মায়ের মৃত্যু হলো। স্বজনরা সব কান্নার রোল তুলেছে। মেয়েটির মা হামাগুড়ি দিয়ে কাদছে! নাহিদা দেখতে গিয়েছিলো। সহ্য করতে পারেনি সেই কান্না! আজ যদি সে মরে যায় তাহলে তো তার পরিবারও এভাবে কাদবে তার জন্য! তাছাড়া মা হারা এই নবজাতক বাচ্চাটারই বা কি হবে! চাপা কান্না নিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো নাহিদা। মেহেদী কেবিনের বাইরে ছিলো। নাহিদাকে সে দেখেছে দৌড়ে যেতে। কিছুক্ষণ পর যখন মৃত দেহ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, পুরুষ লোকটিকেও হাউমাউ করে কাদতে দেখেছে মেহেদী। কান্নার বিলাপে বুঝে নিয়েছে লোকটার স্ত্রী ছিলো, যে মারা গেছে। হসপিটাল এমন এক জায়গা, যেখান থেকে কেউ কোল ভরে মহাখুশি হয়ে বেরিয়ে যায় আবার কেউ মূল্যবান কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বের হয়! সেই ভেবে বড়সড় এক নিশ্বাস ছাড়লো মেহেদী।
একটু পর মেহেদী তার পরিবারের সবার জন্যই নাস্তা এনে দিলো। যদিও তার মাঝে সেই ক্ষমতা নেই সবাইকে সান্তনা দিয়ে খাওয়ানোর! তবে আসিফ বলে বলে খায়িয়ে নিয়েছে সবাইকে। গতকাল মেহেদীর বিষয় জেনে আসিফ এককভাবে মেহেদীর সাথে কথা বললো কিছুক্ষণ। নিজের সাধ্যমতো বুঝাতে চেষ্টা করেছে মেহেদীকে। মেহেদী তখন ছিল নিশ্চুপ। কানে তো পৌছেছে ঠিকই কিন্তু তা মগজে এঁটেছে কি-না কে জানে !
সকাল নয়টার দিকে অফিসের ম্যানেজার এসেছে জহিরুল ইসলামের সাথে দেখা করতে। তিনি এক পর্যায়ে অফিসের বিষয় তুললে জহিরুল ইসলাম বললেন, দেনাপাওনা মিটিয়ে কার্যাদি সব বন্ধ করে দিতে। তার মরোমরো অবস্থা নিয়ে অফিস তো যেতেই পারবে না, তাছাড়া কারো উপর ভরসাও করতে পারবে না! জীবন শেষ পথে চলে গেছে, এই দুনিয়া নিয়ে ভাবনার কোনো প্রয়োজন নেই। যেভাবে সম্ভব, যেন ব্যবসায়ের অবসান ঘটিয়ে দেয়।
মেহেদী বলেছিলো সে আজকের ডিলিং মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করবে কিন্তু জহিরুল ইসলাম তাকে হেলা করে ম্যানেজারকে নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে বিদায় করে দিলো। কিন্তু বললেই কি আর এভাবে হঠাৎ ব্যাবসায়ের অবসান ঘটানো যায়!
গতকাল বিকেল এসেছে মেহেদী অথচ এই পর্যন্ত বাবা তার দিকে ফিরেও তাকায়নি! এমনকি আসিফ ছাড়া বাকিদের মধ্যে কেউ নিজ থেকে কোনো কথাও বলেনি তার সাথে! এতোটা অবহেলা কার সহ্য হয়! ম্যানেজার চলে যাওয়ার পরপরই মেহেদী তার বাবার পায়ের কাছে বসে দুই পা ধরে ক্ষমা চাইছে, বারবার বলছে, “আব্বু, আমি আর কখনো ওসব খাবো না। এবার ক্ষমা করে দাও, আর কখনো কোনো খারাপ কাজে লিপ্ত হব না।”
জহিরুল ইসলাম নিস্তব্ধ। বেশ কয়েকবার বলার পরেও কোনো কথা বললেন না তিনি। একদম পাথর হয়ে গেছেন! ডাক্তার এলে মেহেদী উঠে কেবিনের এক কোনে চলে গেলো। দু-হাতে ভেজা চোখের ধার মুছে নিয়েছে সে। ডাক্তার প্রেশার মেপে বেরিয়ে যাওয়ার পর জহিরুল ইসলাম নাহিদাকে কাছে ডাকলেন। নাহিদা এসে পাশে বসলে জহিরুল ইসলাম অপরাধী মনোভাবের সাথে বললেন,
– পারলে ক্ষমা করে দিও মা। বুঝতে পারিনি দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছি। না জেনে না বুঝে তোমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়েছি আমি নিজ হাতে! খুব বড় আশা নিয়ে হাত পেতেছিলাম তোমার বাবার কাছে। তোমার বাবা তো আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি। আমার পরিবারে তোমাকে পাঠিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছিলো আমার খালি হাত। কিন্তু দেখো, কি হতবাগা আমি! পারলাম না তার সেই মর্যাদা রাখতে! সুন্দর জীবনটাকে নষ্ট করে দিলাম!
মেহেদীর ভেতরটায় সইছে না বাবার কষ্ট! সবদিক থেকে আজ নিরুপায় এবং তুচ্ছ মনে হচ্ছে নিজেকে! জহিরুল ইসলামের উক্তিত নাহিদা অশ্রুসিক্ত লোচন মুছে বললো,
– এসব কি বলছেন বাবা! এতে আপনার কোনো দোষ নেই। আপনার মতো বাবা দুনিয়াতে দু-একটা খুজে পাওয়া দুষ্কর। তাছাড়া আমার ভাগ্যে লেখা ছিলো সবটা। তারই স্বীকার আজ।
– সব ভাগ্যের লিখন না রে মা! অধিকাংশই আমাদের নিজ হাতে গড়া! পরীক্ষা নিতে আল্লাহ স্বাধীনভাবে চলাচলের বোধশক্তি দিয়েছেন তো আমাদের মাঝে! সেই বোধশক্তির অপব্যবহার করেই ঠেলে দেই আমরা ভাগ্যের নামে।
একটুও ভালো লাগছে না বাবার মুখে এমন সব কথা শুনতে। মেহেদী বেরিয়ে গেলো কেবিন ছেড়ে। অত:পর ডাক্তারের সাথে কথা বললো বাবার বর্তমান অবস্থা জানার জন্য। ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে মেহেদী ম্যানেজারকে কল করে জিজ্ঞাসা করলো,
– আংকেল, ডিল কি ক্যান্সেল করে দিয়েছেন?
– না। কেন?
– ক্যান্সেল করার প্রয়োজন নেই। আমি আসছি মিটিংয়ের জন্য।
– আমিও ভাবছিলাম তোমাকে কল করবো। স্যার তো মনে হলো রেগে বলেছেন। কিন্তু সময় কি আর কারো রাগ দেখে বসে থাকবে! বললেও তো হঠাৎ করে এভাবে কাজ থামিয়ে দেওয়া যায় না। কখন আসবে তুমি?
– এইতো, এখন রওনা দিবো।
– আচ্ছা।
আসিফকে বলে মেহেদী চলে গেলো অফিসে। মিটিং শেষ হতেই আবার হসপিটাল চলে এলো। ওদিকে দুদিন ধরে আসিফের কাজকর্ম বন্ধ যাচ্ছে। তাই মেহেদী এলে আবার আসিফ চলে গেলো দুপুরের দিকে। মেহতাজ আয়াশকে তার দাদুর কাছে রেখে আরিশাকে নিয়ে হসপিটালেই আছে। আরও একদিন হসপিটালে কাটিয়ে তারা আজ বাসায় ফিরেছে। গত দিনগুলোতে জনশূন্য বাড়ি যেন এলোমেলো হয়ে আছে! তারা বাড়ি ফেরার আগেই নাহিদা বাড়িতে এসে সব ঠিকঠাক করে নিলো। এর আগেও গোসল ও রান্না করে নিয়ে যেতে এসেছিলো একবার , সেদিন কুরআন শরীফ সে জায়নামাজের উপর রেখে গেলেও তখন বাড়ি ফিরে সেটা ওয়ারড্রবের উপর দেখেছে। মেহেদীই রেখেছিলো নিশ্চয়ই!
জহিরুল ইসলাম বাড়ি ফেরার পর নিয়াজ উদ্দিন ও রুমানা বেগম এসে দেখে গেছেন। বাবামায়ের কাছে নাহিদা শুনতে পেলো ওদিকে আবার ইমরান দুদিন আগে রিকশা থেকে পড়ে গিয়ে ব্যাথা পেয়েছে! পরপরই নাফিসার সাথে কথা বলেছে নাহিদা। চারিদিকে এতো বিপদ-আপদ ছড়িয়ে আছে, কোনো দিক থেকে যেন একটু বিশুদ্ধ শ্বাস গ্রহণের সুযোগ নেই!
সন্ধ্যায় ম্যানেজার কল করেছিলেন অফিসের একটু প্রয়োজনে। তখন জহিরুল ইসলাম প্রায় ধমকে বললেন, “আপনাকে না বললাম কাজ এগিয়ে না নিতে! অর্ডার কেন নিলেন! দেনাপাওনা মিটিয়ে সব বন্ধ করে দিন। কোম্পানি চালনার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। পার্টনারস কে ডাকুন, তাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আমি লিভ নিবো।”
নাহিদা ও মেহেরুন পাশেই ছিলো। মেহেদীও রুমের বাইরে থেকে শুনেছে বাবার গলা। ফোনে কথা বলা শেষ করলে নাহিদা সাহস যুগিয়ে কিছু প্রস্তাব রাখার চেষ্টা করলো। এতোটা সাহস হচ্ছে না তবুও ধ্বংসের হাত থেকে বেচে উঠতে এবং পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতস্তত বোধ করে বললো,
– বাবা, একটা কথা বলবো?
– হ্যাঁ, বলো?
– আমি যদি বুঝে নেই অফিসের কাজকর্ম?
প্রস্তাব রেখে নাহিদার বুক ধুকপুক করছে। জহিরুল ইসলাম ও মেহেরুন দুজনেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নাহিদা দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে আবার বললো,
– এভাবে সব শেষ করে দিলে বাকি জীবন চলবে কি করে! পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে এতোটা না ভেবে আমরা যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে ফেলি। পরে আবার তা নিয়ে আফসোস করি৷ চোখের সামনে সব তো আর জলে ভেসে যেতে দেখা যায় না! তাই বলছিলাম…
– বলেছো, তাতে তো খুশি হয়েছি। কিন্তু এতোটা ভারি কাজ কি তুমি পারবে! তাছাড়া বাবা থাকতে মেয়ে ভার বহন করে সেটা কেমন দেখায় তুমিই বলো?
– কেমন দেখায় সেটা দেখলে তো চলবে না, বাবা! বাচার জন্য যেকোনো পথ খুজতে মানুষ প্রস্তুত। কেননা এটা সবাই জানে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে মুখে অন্ন আসবে না। তার জন্য প্রচেষ্টা থাকতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে। তাছাড়া মেয়েরাও তো কোনোদিকে পিছিয়ে নেই। তাহলে সেখানে আমি এগিয়ে গেলে সমস্যা কি?
মেহেরুন বললেন,
– নাহিদা কিন্তু ঠিক বলছে। তুমি কাজের সম্পূর্ণ ভার তাকে না দাও, নিজেকে স্বাবলম্বী করার সুযোগ তো দাও। এমনিতেই তো দুঃস্বপ্ন দেখে মেয়েটাকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছি। এখন কার উপর তার দায়ভার তুলে দিবে যদি তাকেও নিজের পায়ে দাড়াতে না দাও?
– বুঝতে পারছি তোমার কথা, কিন্তু আমি চাইলেই তো সবটা হয়ে গেলো না! নিয়াজ উদ্দিন ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে।
নাহিদা বললো,
– বাবাকে এ নিয়ে কিছু জানানোর দরকার নেই। এখন বলতে গেলে পূর্বের ঘটনা জানাতে হবে বাবা। আর সংঘঠিত ঘটনা জানতে পারলে তিনিও আরও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এর চেয়ে কিছু না জানানোই ভালো। তবে আমি এটা নিশ্চিত, বাবা কখনোই নিষেধ করবে না ভালো কাজে অগ্রসর হতে। আমারও খুব ইচ্ছে নিজেকে কোনো কর্মের সাথে যুক্ত রেখে অবসর সময় কাটানোর।
– আচ্ছা, ভেবে দেখবো।
হঠাৎ করেই মেহেদীর আগমন! দরজার সামনে থেকেই জেদি কন্ঠে বললো,
– আমি কি মরে গেছি? অফিসের দায়দায়িত্ব সামলে নিতে পারবো, এইটুকু ভরসা রাখতে পারছো না আমার উপর! বারবার বলছি নিজেকে শুধরে নিবো তাও কেন কেউ বিশ্বাস করতে চাইছো না? বলছিতো সংসার পুরোপুরিভাবে সামলে নিবো, মানছো না কেন?
কেউ কোনো উক্তি রাখলো না তার প্রতুত্তরে! জহিরুল ইসলাম মুখ ফিরিয়ে নিলেন, নাহিদা চুপচাপ বেরিয়ে গেলো কিচেনের উদ্দেশ্যে, আর মোহিনীও চোখ মুছতে মুছতে স্বাভাবিকভাবে বললো,
– রাতে ভাত খাবি নাকি রুটি খাবি?
সকলের এমন অবহেলা দেখে মেহেদী জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘরের বাইরে। তিন-চার মিনিট বাইরে কাটিয়ে আবার নিজের রুমে এসেই বসে রইলো। এভাবে জেদ করে বাইরে সময় কাটালে চলবে না। পরিবারে তাকে প্রয়োজন। কখন কি ঘটে যায় বলা দুষ্কর! যেমনটা সেদিন ঘটেছিলো! কোনো পুরুষের অনুপস্থিতিতে কিভাবে তারা সবটা সামলে নিয়েছে তারাই জানে! এখন সে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সকলকে খুশি করতে। হোক সেটা অবহেলার মাধ্যমেই, কিন্তু হাল ছাড়বে না।সেদিনের পর থেকে সে-ও কাদছে কিন্তু তার অশ্রু গাল গড়ায় না সবসময়! যদিও মনে রক্তপাত হয় কিন্তু অশ্রু অদৃশ্যমান!
রাতে খাওয়ার জন্য ডাকতে মেহেরুন রুমে এলো। খাটের মাঝামাঝিতে কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে মেহেদী। মেহেরুন দরজার সামনে থেকেই বললো,
– মেহেদী?
মেহেদী কপাল থেকে হাত সরিয়ে তাকাতেই মেহেরুন বললো,
– ভাত খেতে আয়।
– ভালো লাগছে না, খাবো না।
মেহেরুন এক পলক তার চোখে তাকিয়ে বললো,
– তা খাবি কেন? ভাতে কি আর ওসবের স্বাদ পাওয়া যায়!
কথাটুকু বলে আর এখানে অপেক্ষা করেনি মেহেরুন। কিন্তু মেহেদীর গায়ে লেগেছে কথাটা! বেশ বুঝতে পারছে এখন তার ভালো লাগা আর না লাগারও মূল্য নেই কারো কাছে! বারবার একই কথা শুনতে হবে। ভাবতে ভাবতে ভালো না লাগলেও সে চলে এলো ভাত খেতে। জহিরুল ইসলামের ওষুধপত্র এগিয়ে দিয়ে এসে টেবিলে মাত্র প্লেটে খাবার নিয়ে বসেছিলো নাহিদা। মেহেদীকে টেবিলের দিকে আসতে দেখে আর ভাতে হাত লাগালো না। বসে আছে চুপচাপ। যখন দেখলো মেহেদী বেসিন থেকে হাত ধুয়ে এসেছে তখন সে প্লেট নিয়ে মেহেদীর খাবার বেড়ে দিলো। যে যার মতো চুপচাপ খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লো। নাহিদা সবকিছু গুছিয়ে রেখে মেহতাজের রুমে চলে গেলো। তার খুব উপকার হলো মেহতাজ বাচ্চাদের দুষ্টুমির জন্য বাসায় না আসায়। তা না হলে নাহিদাকে ড্রয়িংরুমে থাকতে হতো। মেহেদীর কাছে তো সে কখনোই যাবে না! এটা যেহেতু নিকটবর্তী রুম সেহেতু সকলের নজর এড়িয়ে এখানে থাকা যাবে।
বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে রুমে এসেছে। কিন্তু ঘুম নামছে না মেহেদীর চোখে! গতদিন গুলোতে তার সাথে ঘটা এবং ডাক্তারের বলা বাবার অসুস্থতার কথা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে এগারোটা বাজে। নাহিদা কি এখনো কাজ করছে! তা দেখার জন্য সে বিছানা ছেড়ে নেমে বেরিয়ে এলো। রুমের বাইরে কাউকে চোখে পড়লো না। ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে আবার কিচেনে উঁকি দিলো। কিন্তু কেউ নেই। তাহলে কি মায়ের রুমে বসে গল্প করছে? সেই রুমও তো বন্ধ! হয়তো একা একা সময় কাটাচ্ছে ওদিকটায়, তা ভেবে শেষ প্রান্তের ফাকা রুমটাতে উঁকি দিয়েও কাউকে পেল না। বাকি রইলো মেহতাজের রুম। মেহেদী দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে অন্ধকার রুম আলোকিত করলো। নাহিদাকে কাথা মুড়ে খাটে ঘুমাতে দেখে মেজাজ খারাপ করে সে লাইট অফ করে ঠাস করে দরজা চাপিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।
লাইটের আলোতে কোনো উপলব্ধি না হলেও দরজা লাগানোর শব্দে নাহিদার কাচা ঘুম ভেঙে গেছে।
কিসের শব্দ হতে পারে!
চোর টোর আসেনি তো!
লাইট জ্বালিয়ে বিষয়টি বুঝার জন্য সে ভয়ে ভয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বাইরে কাউকে না পেলেও তাদের রুমে মেহেদীকে বসে পানি পান করতে দেখে বুঝে নিলো, তাহলে সে-ই ছিলো এমন শব্দকারী। তাই আবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে চলে গেলো।
চলবে।