“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭২
(নূর নাফিসা)
.
.
নাহিদা বাসায় ফেরার পাচ সাত মিনিট পরেই মেহেদী ফিরেছে। গাড়ি নিয়ে এসেছে তবুও তার পরে! কোনোদিকে গিয়েছিলো হয়তো। নাহিদা শাড়ি চেঞ্জ করে শুকনো কাপড়চোপড় এনে গুছিয়ে রাখছিলো। মেহেদী হনহন করে রুমে প্রবেশ করেছে। ঘড়ি ও ব্রেসলেট খুলে এক প্রকার ঢিল মেরে ফেললো ড্রেসিং টেবিলের সামনে! অত:পর শার্টের বোতাম এমনভাবে খুলছে যেন ছিড়ে ফেলবে! নাহিদা আড়চোখে তাকিয়ে লক্ষ্য করেছে বিষয়টি। এটাও লক্ষ্য করেছে গাড়িতে তার চোখে সানগ্লাস দেখেছিলো কিন্তু রুমে প্রবেশ করার সময় তার চোখে সানগ্লাস ছিলো না! রেগে ভেঙে এসেছে নাকি রাস্তায়!
নাহিদা ভাবতে ভাবতে এদিকে দেখলো মেহেদী ঘামে ভেজা শার্ট মুড়ে ওয়ারড্রবে রেখে দিলো! পরক্ষণে প্যান্টের পকেট থেকে সানগ্লাস ও ফোন বের করে ওয়ারড্রবের উপর রেখে টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো।
সন্ধ্যায় সকল কাজকর্ম শেষ করার পর জহিরুল ইসলাম নাহিদাকে অফিসের কার্যাদি সম্পর্কে অনেক কিছু জানালেন। আর এটাও বললেন সপ্তাহে তিনদিন যেন ক্লাস করে আর ভালো লাগলে বাকি দিন গুলো অফিসে কাটাবে। নাহিদা তার পরামর্শে একমত হলো।
প্রতিদিনের মতো আজও মেহতাজের রুমে ঘুমিয়েছে নাহিদা। অশ্রুতে ভিজিয়েছে বালিশ! দিনশেষে ক্লান্ত চোখে ঘুমের আগে কষ্টগুলো সব নেমে আসে। ভুলতে পারে না কোনোমতে! সংঘটিত ঘটনা গুলোকেই যেন আঁকড়ে ধরে বেচে থাকতে হবে তাকে!
দুদিন পর জহিরুল ইসলাম অফিস গিয়েছেন। গত দিনগুলোতে নাহিদা একা রিকশা করে গেলেও আজ গাড়িতে যাচ্ছে। মেহেদী ড্রাইভ করেছে। সময়টা কেটেছে সম্পূর্ণ নিরবতায়! কেননা মেহেদীর সাথে কোনো কথা নেই কারো! অফিসে এসে জহিরুল ইসলাম নিজে নাহিদাকে কাজকর্ম শিখিয়েছেন। তিনি ছেলের উপর ভরসা করতে পারবেন না কিন্তু নাহিদার মাঝে তিনি প্রচেষ্টা দেখে আনন্দিত! মেয়েটার জীবন এমনিতেই নষ্ট করে দিয়েছে, এবার তাকে নিজস্ব একটা অবস্থানে বসিয়ে দিতে পারলে তিনি শান্তি।
কেটে গেছে আরও এক সপ্তাহের মতো! এর মাঝে জহিরুল ইসলাম তিনদিন গিয়েছিলেন অফিসে। সেদিনের পর থেকে মেহেদী নাহিদার সাথে একেবারেই কথা বলে না। কোনো প্রয়োজন হলে ম্যানেজারকে দিয়ে বলিয়ে নেয়।
লাঞ্চের পর মেহেদী তার ডেস্কে এসে কাজে ব্যস্ত। কথা না বললেও লক্ষ্য করেছে নাহিদা লাঞ্চ করার জন্য ক্যানটিনে যায়নি আজ। কিন্তু মেহেদী তা নিয়ে মাথা ঘামালো না। একজন স্টাফ এসে মেহেদীকে ফাইল সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলে মেহেদী বলে দিলো,
-আমি ব্যস্ত, ম্যানেজারকে দেখান।
– স্যার তো নিচে গেছেন।
– তাহলে মেডামকে দেখান।
লোকটা কেবিনের দিকে চলে গেলো। প্রবেশ করেছে দৃঢ় পায়ে কিন্তু বেরিয়ে এলো দৌড়ে!
– স্যার, মেডাম মেঝেতে পড়ে আছে!
– কেন, চেয়ারে জায়গা কম ছিলো!
লোকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে মেহেদীর কথায়! পরক্ষণে আবার বললো,
– স্যার, মেডাম মনে হয় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে।
মেহেদী ফাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে লোকটার দিকে ব্রু কুচকে তাকালো! এবং বললো,
– মানে!
– না, মানে যেভাবে পড়ে আছে তা দেখে আমার মনে হলো আরকি।
মেহেদী ফাইল রেখে উঠে এবার দ্রুত পায়ে কেবিনে চলে এলো সাথে সেই লোকটা এবং তাদের কথপোকথন শুনে পাশের ডেস্কের দুজনও উঠে এসেছে। নাহিদাকে টেবিলের কোনের কাছে পড়ে থাকতে দেখে মেহেদী দরজার কাছ থেকে দৌড়ে এলো। মেঝেতে হাটু ভেঙে বসে নাহিদার মাথাটা ঝাকিয়ে ডাকলো। সাথে আসা মেয়ে স্টাফটা গ্লাসের পানি এনে মেহেদীর হাতে দিলো। মুখে পানি ছিটিয়ে মেহেদী আরও দু-তিনবার ডাকতেই নাহিদা নিভু নিভু চোখে তাকালো। পরক্ষণে আবারও চোখ বন্ধ হয়ে গেছে! চোখে মুখে দুর্বলতার ছাপ স্পষ্ট! সকালেও খেতে দেখেনি, দুপুরেও খেতে যায়নি। যার ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে! মেহেদী ভয় পেয়ে গেছে তার বর্তমান অবস্থা দেখে! বাকিরা বলছে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মেহেদী তা-ই করলো। নাহিদাকে নিয়ে মেয়ে স্টাফের সাহায্যে উঠিয়ে এবং হাটিয়ে লিফটে উঠলো। এবং সেই স্টাফকে সাথে নিয়েই হসপিটাল চলে এলো। কেননা সে ড্রাইভ করেছিলো তাই নাহিদার পাশে কাউকে প্রয়োজন ছিলো।
নাহিদা কেবিনে আর দুজন বাইরে অপেক্ষা করছে। ডাক্তার চেকাপ করে বেরিয়ে এসে বললো,
– উনি কি হয় আপনার?
– ওয়াইফ।
– আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। কিন্তু উনার শরীর অতি দুর্বল। আমি স্যালাইন দিয়েছি এখন। খাওয়াদাওয়ার প্রতি একটু বেশি লক্ষ্য রাখতে হবে। এমনিতেই আশপাশের যা অবস্থা, ভালো মানুষও টিকে না। আপনাদেরও সচেতন থাকা প্রয়োজন।
– ওকে। বাসায় নিয়ে যেতে পারবো না?
– হ্যাঁ, স্যালাইন শেষ হলেই নিয়ে যাবেন।
ডাক্তার চলে গেলো। মেয়ে স্টাফটা মেহেদীকে অভিনন্দন জানিয়ে নাহিদার কাছে কেবিনে চলে গেলো। আর মেহেদী একজায়গায়ই দাড়িয়ে আছে। ভেতরটা কেন জানি চিনচিন ব্যাথা করছে! এটা আসলেই ব্যাথা নাকি সুখ, বুঝতে পারছে না সে! কিন্তু অনুভব করতে পারছে কিছু একটা!
ফোনটা হাতে নিয়ে সময়টা দেখলো মেহেদী। পরক্ষণে কেবিনে এসে দেখলো মেয়েটা নাহিদার সাথে কথা বলছে। মেহেদী বললো,
– সাবিহা, অফিস চলে যান আপনি। আমি ওকে বাসায় রেখে তারপর যাবো।
– ওকে, স্যার।
মেহেদী একশো টাকার একটা নোট তার হাতে ধরিয়ে দিলো রিকশা ভাড়ার জন্য। মেয়েটি চলে গেলে মেহেদী নাহিদার পাশে এসে বসলো। নাহিদা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। মেহেদী তার দু’পাশে বেডে দুহাত রেখে তার দিকে একটু ঝুকে বললো,
– অভিনন্দন, বাবুর আম্মু।
নাহিদা দাত চেপে চোখের পাতা বন্ধ করে দুচোখে দুই ফোটা পানি ফেললো। পরক্ষণে এক হাতে চোখের ধার মুছে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
– আজ বলবেন না, বাচ্চা আশিক কিংবা অন্য কারো?
এইমুহূর্তে এমন কথা শুনে মেহেদীর চোখ জোড়া বড় আকৃতির হয়ে গেছে! সে ধমকের সুরে বললো,
– নাহিদা!
নাহিদা আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো এবং বললো,
– সেদিন তো খুব ভালো করেই অপবাদ দিতে পেরেছেন। তাহলে আজ কেন নয়? আজও বলুন, আমি শোনার জন্য প্রস্তুত আছি। সেদিনও মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছি আজও নেবো!
মেহেদীর রক্ত যেন আগুন হয়ে সর্বাঙ্গে চলাচল করছে! না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সইতে! বসে বসে নাহিদার কান্নাও দেখতে পারছে না! সে উঠে জানালার দিকে চলে এলো। ফোনটা বেজেই চলেছে! সে হাতে নিয়ে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে মেহেরুন ইসলাম বললো,
– মেহেদী? কি হয়েছে নাহিদার?
– তোমাকে কে বললো?
– ম্যানেজার কল করলো তোর আব্বুর কাছে! কি হয়েছে? এখন কেমন আছে?
– এখন ভালো আছে। আর তেমন কিছু হয়নি, তবে হবে।
– হবে মানে!
– হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো। হসপিটালে এনে জানতে পারলাম নাহিদা প্রেগন্যান্ট।
ওপাশ থেকে আর কোনো শব্দ শোনা গেলো না! সবটা নিরব! যার মর্মার্থ মেহেদীর বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! তার আম্মু কি জেনে খুশি হয়নি! এভাবে চুপ হয়ে গেলো কেন! সে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললো,
– আম্মু?
ওপাশ থেকে খুব শান্ত গলায় মেহেরুনের কন্ঠে ভেসে এলো,
– বাসায় ফিরবি কখন?
– স্যালাইন লাগানো হয়েছে, ওটা শেষ হলেই বাসায় ফিরবো।
মেহেরুন সাথে সাথেই কল কেটে দিলো। মেহেদীর ভেতরে যেন একের পর এক যন্ত্রণা চেপে যাচ্ছে! সবদিক থেকে এতো যন্ত্রণাময় চাপ কেন আসছে তার উপর! না জানি কভু সে পাগলই হয়ে যায়! একটা ভুলের জন্য কি তাকে এভাবেই প্রায়শ্চিত্ত করে যেতে হবে!
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো নাহিদা তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। এইমাত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। ছোটখাটো এক নিশ্বাস ছেড়ে আরও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণে ডাক্তারের সাথে কথা বলে তাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে এলো। মেহেদী তাকে ধরলে নাহিদা হাত সরিয়ে দিয়েছিলো। এবং একা একা হেটে আসার চেষ্টা করেছিলো। সেই মুহুর্তে প্রচুর রাগ হলেও মেহেদী রাগ কন্ট্রোল করে নাহিদার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে ধরে হেটে হেটে বেরিয়ে এলো। গাড়িতেও সামনের সিটে বসিয়ে সিট বেল্ট পড়িয়ে দিলো। বাসায় ফিরে দেখলো মেহতাজ এসেছে। নাহিদাকে অসুস্থ ব্যক্তির ন্যায় হেটে আসতে দেখে মেহেরুন এগিয়ে এলো এবং তাকে ধরে নিয়ে রুমে বসালো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
– এখন কেমন আছিস, মা?
– ভালো।
– পড়ে গিয়ে কি ব্যাথা পেয়েছিস খুব?
– বাঁ হাতের দিকে একটু লেগেছে। তেমন কিছু হয়নি।
তাদের পিছু পিছু রুমে এসে মেহেদী বললো,
– আম্মু, ওর শরীর অনেক দুর্বল। দুপুরেও খায়নি কিছু। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে বলেছে ডাক্তার আর সবদিক থেকেই সচেতন থাকতে বলেছে।
মেহেরুন কিছু বললো না তার কথার প্রেক্ষিতে। টেবিলের কাছে এসে এক গ্লাস পানি খেয়ে মেহেদী বেরিয়ে গেলো অফিসের জন্য। আয়াশ দৌড়ে এসে খাটে লাফিয়ে উঠলো এবং নাহিদার কাছে বসে বললো,
– তোমার কি হয়েছে মামি?
– কই, কিছু হয়নি তো!
মেহতাজ এসে বললো,
– আয়াশ, বাইরে যাও। মামি অসুস্থ।
– মামা চলে গেলো কেন?
– মামার অফিসে কাজ আছে। আরিশার কাছে যাও। কার্টুন দেখছে আরিশা।
আয়াশ চলে গেলো। মেহতাজ নাহিদার কাছে বসে বললো,
– কেমন আছো এখন?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– তোমাদের আরেকটু সময় নেওয়া প্রয়োজন ছিলো। অন্তত অনার্সটা কমপ্লিট করতে!
নাহিদা দৃষ্টি নিচের দিকে নামিয়ে নিলো। মেহতাজ আবার বললো,
– মেহেদী কিন্তু বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসে। তোমাদের মাঝে কি আদৌ ঠিক হয়েছে কিছুটা?
নাহিদা মাথা নিচু করে রেখেছে। কোনো জবাব নেই তার কাছে! কি বলবে! এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কি কোনো জবাব আছে তার কাছে! নাহিদাকে চুপ থাকতে দেখে মেহতাজ বললো,
– নতুন কিছু ঘটতে চলেছে। একটা সংসার পরিপূর্ণ হয় সন্তানসন্ততি নিয়ে। তোমাদের সংসারও পরিপূর্ণ হতে যাচ্ছে। এবার সুধরে নাও সবটা।
নাহিদা চাপা কান্নার সাথে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
– শুধরেই তো নিয়েছিলাম আপু! কই, সেটা তো আর স্থির হলো না! ক্ষণিকের শুধরানো!
মেহতাজ আর কোনো কথা বললো না। মেহেরুনও নিশ্চুপ! কে কি বলবে, ঠিকই তো! নাহিদা তো গোপন রেখে একা একা চেষ্টা করেছিলো তাকে শুধরে নেওয়ার। কিন্তু সে তো শুধরালো না নিজেকে! নাহিদার চোখ থেকে টুপটাপ পানি পড়ছে। মেহেরুন বেরিয়ে গেলো। মেহতাজ প্রসঙ্গ পাল্টে প্রেগ্ন্যাসি সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দিলো।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৩
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে খাওয়ার পর মেহতাজ মেহেদীকে তার রুমে ডাকলো। মেহেদী এসে বসলো। মেহতাজ বললো,
– মাতাল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি না পরিবার সামলে নিবি?
এমন প্রশ্নে মেহেদী বিরক্তি নিয়ে তাকালো বোনের দিকে! মেহতাজ আবার বললো,
– এখনো ছোট রয়ে যাসনি যে কদমে কদমে তোকে বোঝাতে হবে! যথেষ্ট জ্ঞান আছে তোর। ক’দিন পর বাবা বলে ডাকবে কেউ আর তোকেই বুঝিয়ে দিতে হবে তোর সন্তানকে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ! কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত! এখনো যদি নিজেকে আর তোর পরিবারকে না সামলে নিতে পারিস আর নিজেই অবুঝ সেজে বসে থাকিস তাহলে কিভাবে হবে! আগে যা করেছিস পরে আর তা করার চিন্তা করিস না। তোর একটা ভুলের জন্য আজ কতগুলো সম্পর্ক নষ্ট হতে চলেছে। আগেও বলেছিলাম, এখনো বলছি, শুধরে নে নিজেকে। তোর জীবনের সাথে সংযুক্ত এতোগুলা জীবনকে কষ্ট দিস না এভাবে। সবাই প্রিয়জনের ভালোটা চায় এবং প্রিয়জনের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করে। তুই ভালো হলে অনেকগুলো জীবন নিশ্চিন্তে কাটবে, অনেকগুলো প্রাণ শান্ত হয়ে ঘুমাতে পারবে। অশ্রু মুছে তারা আবারও হাসতে জানবে। যদি তুই একটু সুখ এনে দিস তো..
– কি করে আনবো সুখ? এটা কি প্যাকেট আকারে বিক্রয় করা হয়? যে কিনে এনে ঘরে রেখে দিলাম! কি করে ভালো হবো আমি, বলো তো? সেদিনের পর থেকে আব্বু একটা শব্দও বলে না আমার সাথে, দেখলেই যেন মুখ ফিরিয়ে নেয়! আম্মু যেন বাধ্য হয়ে আমার সাথে একটু আধটু কথা বলে! যেন কথা না বলতে পারলেই ভালো হতো উনার কাছে! বউ কথা বলে না, চোখের সামনে পড়লেই যেন আমি পোকা হয়ে তার চোখে পড়েছি! একই রুমে থাকতেও পারে না আমার সাথে! প্রতিদিন তোমার রুমে এসে ঘুমায়! আবার অফিস যাওয়া শুরু করেছে যেন অনাহারে মারা যাচ্ছে তাই তাকে উপার্জনে নামতে হবে! আব্বু আম্মুও কি সুন্দর তার সাপোর্টার হয়ে দাড়িয়েছে! ছেলে থাকতে ছেলের বউকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছে রোজগার করার জন্য! আমি না থাকলেই যেন তারা শান্তি পেতো! কেউ সহ্যই করতে পারে না আমাকে! আমিও তো মানুষ, নাকি? মানুষ কি ভুল করে না? একটা ভুলের জন্য কতবার ক্ষমা চেয়েছি আব্বু আম্মুর কাছে, কই? কেউ কি করেছে আমাকে ক্ষমা? তাদের কাছে ভালো হওয়ার একটুও কি সুযোগ পাচ্ছি আমি? এতো অবহেলার মধ্যে কিভাবে আমি ভালো থাকবো আর কিভাবে সুখ এনে দিবো সংসারে, বলো?
– তোর ছোটখাটো ভুল গুলোকে তো আব্বু আম্মু কখনোই ভুল বলে গন্য করেনি! এটা তো প্রকটভাবে আঘাত করেছে, এতো সহজেই কি ক্ষমা পেয়ে যাবি তুই? না জানি আবারও সেই ভুল করে বসবি তা কে জানে! তোর উপর থেকে তো বিশ্বাসটাই উঠে গেছে! বাধ্য হয়েছে নাহিদাকে অফিসে নিযুক্ত করতে! কি করবে, তোর উপর একবার ভরসা করে তো মেয়েটার জীবন নষ্ট করে দিয়েছে! সেই ভেবে তাকে একটা সম্মানিত জায়গায় বসাতে চাইছে বাবামা। আর সুযোগের কথা বললি না? সুযোগ তুই কখনোই পাবি না। সুযোগ তোকে তৈরি করে নিতে হবে। যদি ভালো হওয়ার চেষ্টা থাকে তো সকলের মনে নতুন করে জায়গা করে নে। দ্বিতীয় বার বিশ্বাস ভেঙে দিস না আবার। পাকাপোক্ত ভাবে বিশ্বাস স্থাপন কর। সন্দেহ নিয়ে কখনো সংসার সুখী হয় না সেটা জানিস তো? তোর এই সন্দেহের জন্যই বৃহৎ আকৃতির ধ্বংসের প্রভাব পড়েছে! নিজেকে নিয়ে মিথ্যে অপবাদ কারোই সহ্য হয় না। তোরও হবে না। ওসব ভেবে এখন লাভ নেই। যদি ভালো হতে চাস তো এটা মনে রাখ বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান সবার দায়িত্ব এখন তোর হাতে। ভেবে দেখিস আমার কথাগুলো।
মেহেদী নিশ্চুপ হয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। হাটতে হাটতে রুমের বাঁ দিকে ফাঁকা রুমটা তে এসে দু’হাতে জানালার গ্রিল আঁকড়ে ধরে দাড়ালো। ঘড়ির কাটা হয়তো এগারোটার কাছাকাছি। বাইরে অন্ধকারে ঢাকা ভুবন! যদিও উঁচু নিচু ভবনে ভবনে বৈদ্যুতিক বাতিতে আলোকিত হয়ে আছে তবুও তা প্রকৃতির অন্ধকার কাটাতে সক্ষম নয়। বিনা আভাসে মনের সাথে আজ প্রকৃতি বন্ধুত্ব করে ফেলেছে। খুশির খবর পেয়েও আজ মানব মনে অন্ধকার ছেয়ে আছে, শত শত বাতি পেয়েও প্রকৃতির অন্ধকার ঠিকই রয়ে গেছে! বাতাসটা দেহ ঠান্ডা করতে পারলেও ভেতরটা ঠান্ডা করতে পারেনি! আজ এমন কেন লাগছে! এতো বছর কেটে গেলো কষ্ট কি জিনিস তা তো উপলব্ধিও করতে পারেনি। আজ কেন এতো কষ্ট এসে ভীড় জমিয়েছে! দেহ রোগাক্রান্ত হলে তো মেডিকেল ট্রিটমেন্ট আছে কিন্তু মনে! এ কেমন রোগ, যার কোনো মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নেই!
নাহ! এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না! সবটা মিটমাট করে পূর্বের ন্যায় হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করবে। তার জন্য পরিস্থিতি এতোটা গম্ভীর হয়ে গেছে সুতরাং তাকেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
মাথায় ও চোখে মুখে হাত বুলিয়ে রুমে এলো মেহেদী। খাটে হেলে বসা নাহিদা পলকহীন তাকিয়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের দিকে! দুই গাল ভিজে আছে অশ্রুতে। মেহেদী যে রুমে এসেছে সেই খেয়ালও নেই। সে পুরোপুরিভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আছে! মেহেদী দরজা লক করে ফোনটা ড্রেসিং টেবিলে রাখলো। এতোক্ষণে নাহিদার ভাবনার ছেদ ঘটেছে! ফোন রেখে মেহেদী বাথরুমে চলে গেছে। তখন নাহিদাকে বসা অবস্থায় দেখলেও এখন বাথরুম থেকে বেরিয়ে শুয়ে থাকতে দেখলো৷ লাইট অফ করে মেহেদী নাহিদার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো এবং নাহিদাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে চেষ্টা করলো। হঠাৎ এমন কিছুতে নাহিদা আৎকে উঠেছে! সে মেহেদীর হাত সরিয়ে দিলো। উঠার চেষ্টা করতেই বহুদিন পর মেহেদী তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কোলবালিশ ন্যায় হাতে পায়ের বন্ধনে বেধে ফেললো! নাহিদার ছোটার জন্য আপ্রান চেষ্টা চলছেই! সাথে নীরব কান্না! মেহেদী এক হাতে অশ্রু মুছে দিতে দিতে বারবার বলতে লাগলো “সরি, সরি ফর এভরিথিং”। কানের নিচে ঠোঁটের স্পর্শ পড়তেই নাহিদার মুখে উচ্চারিত হলো, “ছি! আপনার ভুল হচ্ছে মিস্টার! আমি কোনো মাদকদ্রব্য নই! আর না কারো ব্যবহার যোগ্য গার্লফ্রেন্ড!”
কথাটি আঘাত হেনেছে মেহেদীর মনে! ড্রিম লাইটের আলোতে রুমে আবছা আলো আর আবছা অন্ধকার। মেহেদী নাহিদার চোখের দিকে তাকিয়ে বেশ নরম গলায় উচ্চারণ করলো, “নাহিদা!”
হাত পায়ের বাধন হালকা হয়ে আসায় নাহিদা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে কান্নার সাথে বললো,
– আই হ্যাট ইউ! আই হ্যাট ইউর টাচ! হ্যাট ইউর এভ্রিথিং!
নাহিদা কাদতে কাদতে ড্রেসিং টেবিলে হেলে বসে পড়লো! আর মেহেদী খাটে বসে আছে! দুতিনমিনিট নীরব থেকে নাহিদার উদ্দেশ্যে বললো,
– সরি বললাম তো সবকিছুর জন্য! আমার এসব একদম ভালো লাগছে না! আমাদের সবাইকেই স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন! আগের মতো লাইফটা এনজয় করতে চাই।
– হ্যাঁ, করুন না! নিষেধ করলো কে! আগের মতো গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরে বেড়ান, বন্ধুদের সাথে মাদক আড্ডায় মেতে উঠুন! আর বাবা-মাকে আবার কষ্ট দিন! আমাকে আবারও হাজার হাজার মিথ্যে অপবাদ দিন। নিষেধ করছে না তো কেউ!
– নেগেটিভে নিয়ে যাচ্ছো কেন! একটু পজেটিভ হও। আমি আর কোনো খারাপ কাজে জড়িত হতে চাচ্ছি না! একবার বিশ্বাস করো, নিজেকে পুরোপুরিভাবে শুধরে নেব।
– বিশ্বাস! তাও আবার আপনাকে! হুহ! আমিও মানুষ! কষ্ট আমারও হয়! বারবার ধোকা খেতে কে চায় বলুন তো? আর আপনার সাথে কথা বলতেই আমার রুচিতে বাধে! সেখানে বিশ্বাস কিভাবে করা যায়!
– অপ্রত্যাশিত ঘটনা গুলো ভুলে যাও না! আবার না হয় সবটা নতুন করে গুছিয়ে তুলি।
– সম্ভব না। সম্ভব না আপনার সাথে এক মুহুর্তেও থাকা! শুধুমাত্র মা বাবার মুখ চেয়ে এখনো আমি এই অবস্থানে আছি! যদি পারতাম তো যন্ত্রণাময় জীবনটাই শেষ করে দিতাম! আপনার এই স্পর্শ আমার দেহে আগুন হয়ে জ্বালা করে! যদি পারতাম তো স্পর্শ করা স্থান কেটে কেটে নিজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতাম! শুনতে পেয়েছেন কি! এতোটা ঘৃণা করি আপনাকে!
মেহেদী রেগে ঝটপট রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আর নাহিদা কাদতে কাদতে ফ্লোরে বসে পড়েছে! না চাইতেও মুখ থেকে যা তা উচ্চারণ করতে বাধ্য হচ্ছে সে! একদমই ভুলতে পারে না মেহেদীর কথা ভঙ্গ করার বিষয়!
এক সময় নিজে শান্ত হয়ে একটা বালিশ নিয়ে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। না চাইতেও কষ্টগুলো স্মরণ করতে করতে ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমে এসেছে। ফজরের আযান পড়লে ঘুম ভেঙে গেছে তার। বিছানায় তাকিয়ে মেহেদীর দেখা পায়নি আর! নামাজ পড়ে বাইরে এসে ড্রয়িং রুমে চোখ পড়তেই দেখলো কুশন কোলে নিয়ে আঁকড়ে ধরে সোফায় ঘুমাচ্ছে মেহেদী! সারারাত কি এখানেই থেকেছে! কারো উপস্তিতি টের পেয়ে পেছনে ফিরে দেখলো মেহতাজও তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত মেহেদীর দিকে। পরক্ষণে নাহিদার দিকে একবার তাকিয়ে আবার চলে গেলো কিচেনের দিকে।
নাস্তা শেষে নাহিদা অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। কাল অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো বিধায় মেহেরুন নিষেধ করেছিলো। কিন্তু সে আজ সুস্থতার সাথে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো। মেহেদী রুমে তাকে একা পেয়ে বললো,
– অফিস যাবে না তুমি। আমি একাই সামলে নিতে পারবো সবটা।
নাহিদা কোনো জবাব দিলো না। সে তার কাজ করেই যাচ্ছে! মেহেদী তার পাশে এসে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো,
– এতোটা ইগনোর করছো কেন! আমার কথা না-ই ভেবো, বেবির কথা একবার ভাববে না?
– যা ভাবার সব ভেবে নিয়েছি। আমাদের নিয়ে আপনাকে না ভাবলেও চলবে।
– একটু বেশি বেশি করছো না?
– হয়তোবা।
– নাহিদা, আমি বারবার একই কথা বলে যাচ্ছি। এতোটা এভোয়েড ঠিক না! একটা বার বুঝতে চেষ্টা করো আমাকে। আমি থাকতে প্রয়োজন নেই তো তোমার কোনো কাজ করার! তোমার কি প্রয়োজন হয় সেটা আমাকে বলো। এমনতো নয় যে আমি তোমাদের প্রয়োজন মেটাতে অক্ষম!
– আপনি বরং আপনার প্রয়োজন মেটান। আর কাজের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন না? আমার খুবই প্রয়োজন আছে কাজের! এখন আমি একা নই। ঘরে দুজন পিতামাতা আছে তারা আমাকে বিশ্বাস করে বিধায় তাদের কথা আমাকে ভাবতে হবে। আমার সন্তান আসতে চলেছে, একজন মা হওয়া সত্ত্বে আমাকে তার কথাও ভাবতে হবে। খুবই প্রয়োজন আমার উপার্জনে। আমার এতো প্রয়োজন মেটানোর প্রচেষ্টায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করবেন না প্লিজ! যদি মানুষ হয়ে থাকেন তো এইটুকু দয়া করুন অন্তত!
– বাহ! অতি সহজেই পর করে দিলে! সব আপন আর আমি পর! স্ত্রী নাকি পুরুষের কর্মের শক্তির উৎস হয়, আর এই তুমি আমার শক্তি উৎস হয়ে থাকছো! দারুন বলেছো! যাও, বাধা দিবো না তোমার কর্মে! আমি আর কার জন্য লড়ব! তুমিই উপার্জন করো আর আমি না হয় ঘরে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি!
– সেটা সম্পূর্ণই আপনার ইচ্ছে!
মেহেদীর কথায় ভেতরটায় আঘাত হেনেছে ঠিকই তবুও নিজেকে কঠিন করে নাহিদা চোখ মুছে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। এতো ইমোশনাল কথায় কাজ হলো না তা দেখে মেহেদী ব্যর্থতার নিশ্বাস ছেড়ে নিজেও বেরিয়ে গেলো অফিসের জন্য। যদিও একটু আগে বলেছিলো সে ঘরে বসে থাকবে! তা কি আর হয়! তাকে যে সকলের মনে নতুন করে জায়গা করে নিতে হবে!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৪
(নূর নাফিসা)
.
.
আজ জহিরুল ইসলাম ও আয়াশ অফিস গেছে। যাওয়ার সময় সবাই একসাথে গেলেও আসার সময় মেহেদী আর নাহিদা একসাথে ফিরেছে। কেননা দুপুরে জহিরুল ইসলাম ও আয়াশ চলে এসেছে। নাহিদা বাসায় ফিরে দেখলো মেহতাজ চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মেহেদী ফ্রেশ হয়ে আরিশাকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছে সাথে আয়াশও। আর মেহতাজ গোছগাছ করছে। নাহিদা ফ্রেশ হয়ে তার কাছে এসে বললো,
– আপু, থাকো আরও কিছুদিন।
– না, আয়াশের পড়াশোনা মিস হচ্ছে।
– ভাইয়াকে আসতে বললে না?
– বলেছিলো তো আসবে। কি যেন কাজ পড়ে গেছে তাই জানিয়েছে আসতে পারবে না এখন। কিছু কথা ছিলো, বাবার রুমে এসো।
মেহতাজের পিছু পিছু নাহিদা জহিরুল ইসলামের রুমে এলো। মেহেরুনও এসেছে। মেহতাজ বললো,
– বাবা কিছু কথা ছিলো।
– হ্যাঁ, বলো?
– ছেলে তো তোমার একটাই। অবহেলা করে নিজেরাও কম কষ্ট পাচ্ছো না! আর তাকে শিক্ষা দিতেও একটু বেশিই ইগনোর করে যাচ্ছো সবাই মিলে! এবার একটু নরমাল হও।
– ওকে নিয়ে কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই।
– যতই অভিমান নিয়ে থাকো, তার ভালোটা তো এখনো চাও। আমাদের চেয়ে কোনো কিছুই কম জানো না। তোমাদের দেওয়া শিক্ষা থেকেই তবুও বলছি, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। বেশি চাপে আবার এমন না হয়ে যায় ভালোর জায়গায় জঘন্য খারাপ! আমার মনে হয় ওর শিক্ষাটা যথেষ্ট হয়েছে। তোমাদের অবহেলার মাধ্যমে এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে আর নিজেকে খুব ভালো করেই সামলে নিচ্ছে। সে চায় সবটা সুন্দর স্বাভাবিক চলুক। এখন তো একটু কমিয়ে নিতে পারো অভিমানটা! অতি আস্কারা না ই বা দাও, কিন্তু স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তো রাখতে পারো! আর কত! তোমাদের মানানোর চেষ্টা করতে করতে তো একসময় সে-ই অধৈর্য হয়ে যাবে! যখন আরও ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হবে! নাহিদা, আমি কিন্তু শুধু বাবা-মাকে বলছি না কথাগুলো। তোমাকেও বলছি। আমরা সকলেই পরিবারের সুখটা কামনা করি। এভাবে এক একজন এক একদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলে অশান্তি তো কোনো দিনও শেষ হবে না!
– আমিও এটাই ভাবছিলাম আপু। আমারও মনে হচ্ছে হয়তোবা সে আর ওসব কাজে অগ্রসর হবে না। নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এখন স্বাভাবিক হওয়াটাই প্রয়োজন যদি বাবা মা চায় তো..
এরইমধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো। নাহিদা এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো। আয়াশ আরিশা দুহাত ভর্তি চিপসের প্যাকেট নিয়ে এসেছে। নাহিদাকে দেখে আরিশা মেহেদীর কোলে থেকেই হাত বাড়িয়ে দিলো। নাহিদা হাসিমুখে তাকে কোলে নিয়ে রুমে এলো। মেহেদী একটা প্যাকেট ছিড়ে আরিশার হাতে ধরিয়ে দেওয়ার সময় মেহতাজ বললো,
– মেহেদী, আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আয়।
– ব্যাগ গুছিয়েছো?
– হুম।
– এসো তাহলে। সন্ধ্যার আগেই যাও।
মেহতাজ বোরকা পড়ে বেরিয়ে গেলো মেহেদীর সাথে। মেহেদী তাদের বাড়িতে পৌছে দিয়ে আবার সাথে সাথেই চলে এসেছে বাসায়। সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যায় না মেহেদী। ফ্রেন্ডের সাথে মাঝে মাঝে ফোনেই কথা বলে কিন্তু দেখা করে না। অফিস বাদে বাকিটুকু সময় বাড়িতেই কাটায়। নামাজও পড়ছে নিয়মিত। আজ রাতে খাওয়ার সময় জহিরুল ইসলাম অফিসের বিষয় নিয়ে কথা বলেছে মেহেদীর সাথে। মেহেদী অবাক হয়েছে বটে, তাছাড়াও জবাব দেওয়ার সময় তার গলা কেন জানি ধাধিয়ে আসছিলো। কেন তার এমন লাগছিলো সে জানে না! এমন অনুভূতি তার মাঝে আর কখনোই আসেনি! আজই প্রথম ছিলো! খাওয়ার পরপরই মেহেদী আজ সবার আগে মেহতাজের রুম লক করে দিলো! চাবি তার পকেটে! ভেবেছে নাহিদা আজ আবার মেহতাজের রুমে ঘুমাতে যাবে কিন্তু তা আর হলো না! নাহিদা একবারের জন্যও ওই রুমের সামনে যায়নি! সে কি দরজা লক করতে দেখে ফেলেছিলো নাকি! তা না হলে এখন একবারও গেলো না কেন! কাজকর্ম সেড়ে সোজা নিজেদের রুমে চলে এলো! মেহেদী এ নিয়ে ভাবছে আর ভাবছে! পরক্ষণে যখন দেখলো নাহিদা ঘুমানোর জন্য বিছানা গুছিয়ে প্রস্তুত হচ্ছে তখন সে বললো,
– এখন কি পড়তে বসবে?
দেখেছে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তবুও জিজ্ঞেস করলো পড়ার কথা! এমন উল্টাপাল্টা কথপোকথনে নাহিদা কোনো মন্তব্য রাখলো না! শুধু মুখটা পেঁচার মতো করে তাকিয়েছিলো একবারের জন্য। মেহেদী ঝটপট আলমারি খুলে কিছু খুজে আবার ঝটপট ওয়ারড্রব খুলে ল্যাপটপটা হাতে নিলো। নাহিদা মাত্র শুয়েছে এমনি মেহেদী এসে তার পাশে বসে ল্যাপটপে ব্যস্ততা দেখিয়ে বললো,
– এই কাজটা কমপ্লিট করো তো! আজকের মধ্যেই করা প্রয়োজন। আগামীকাল মিটিংয়ে লাগবে। সময়ের স্বল্পতার কারনে করতে পারিনি আমি। এখনো আরও অনেক কাজ বাকি।
নাহিদা শুয়ে থেকেই বললো,
– কিসের কাজ?
– এক্সেলে কাজ করবে। কিছু হিসেবনিকেশ বাকি ছিলো। পেজটা কমপ্লিট করো। উঠো, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
– দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এক্সেলের কাজ আমি পারি।
– ওয়ার্কার্সের লিস্ট তো লাগবে নাকি? ওটা কি জানো?
নাহিদা আর কিছু না বলে উঠে বসলো। খাটে হেলান দিয়ে সে ল্যাপটপ নিলো। মেহেদী কাজ দেখিয়ে দিলে সে করতে লাগলো। ঘুম পেয়েছে প্রচুর, তবুও আর্জেন্ট হওয়ায় করতে হচ্ছে! আগে বললে তো সন্ধ্যায়ই করে রাখতো!
নাহিদার হাতে ল্যাপটপ ধরিয়ে দিয়ে ওদিকে মেহেদী আলমারি থেকে ফাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। নাহিদা কাজ করতে করতে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, মেহেদী কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘড়ি দেখছে। সে কি টাইম ধরে কাজ কমপ্লিট করে নাকি! বিষয়টা একটু ভেবে নাহিদাও একই কাজ করছে। প্রতি মিনিটের টার্গেট নিয়ে সে কাজের গতি বাড়িয়ে নিয়েছে। এবার মেহেদী তাকে লক্ষ্য করেছে! সে কয়েক মিনিট পরপর ঘড়ি দেখলেও নাহিদা প্রতি মিনিটে ঘড়ি দেখছে! যা দেখে মেহেদীর বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে নাহিদা ঘড়ির সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে। কিন্তু সে নিজে তো এজন্য ঘড়ি দেখছে না!
নাহিদার কর্মে মেহেদী মৃদু হেসে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ঘড়িতে সময় যখন এগারোটা উনষাট মিনিট, তখন মেহেদী খাট থেকে লাফিয়ে নেমে ছো মেরে নাহিদার হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে কাজ স্থির করে ওয়ারড্রবের উপর রেখে দিলো। সাথে তার হাতের ফাইল গুলোও। হঠাৎ এমন কান্ডে নাহিদা হতবাক! মেহেদী ঝটপট ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর রাখলো। যত দ্রুত সম্ভব বাক্সটা খুলে একটা বার্থডে কেক বের করলো! নাহিদার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে কেকের উপর! চোখ দুটোও ছলছল করছে। মেহেদী নাহিদার হাত ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়ে দাড় করালো। সময় এখন বারোটা এক মিনিট। নাহিদাকে কেকের সামনে দাড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, “হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট। ইট’স বার্থডে শুড মোর স্পেশাল ফর আওয়ার বেবি। লাভ ইউ।”
অত:পর একটা হাত পেটে রেখে কাধে ঠোঁটের আলতো স্পর্শ দিয়ে আবারও বললো, “লাভ ইউ মোর!”
তখন তো বাবা মা ও বোনের সামনে ঠিকই বলেছিলো মেহেদীকে এবার স্বাভাবিকভাবে মেনে নিবে! কিন্তু এখন! এখন যে না চাইতেও বড্ড অসহ্য লাগছে তাকে! যখনই কাছে আসে, বারবার মনে পড়ে যায় সে কথা দিয়ে কথা রাখেনি! এই হাতে, এই মুখে সে মদ স্পর্শ করেছে! তার এই স্পর্শ দেহ সয়ে গেলেও যে মনে সইছে না! কি করবে সে! কি করা উচিত! একদমই অসহ্য লাগছে সব! এতোক্ষণে মেহেদী তার গলায় একটা চেইন থাকা সত্ত্বেও তার উপর আরও একটা লকেট ঝুলিয়ে দিলো! অত:পর ছুরিটা এগিয়ে ধরলো কেক কাটার জন্য। নাহিদা হাত মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে! মেহেদীর হাসিমাখা মুখটা মলিন হয়ে গেলো! অত:পর সে নিজেই হাতে ছুরিটা চেপে দেওয়ার জন্য হাত টানতেই নাহিদা সরে এলো। এবং গলা থেকে চেইন খুলতে খুলতে বললো,
– কে বলেছে এসব ন্যাকামো করতে? বিরক্তিকর! যত্তসব ফাজলামো!
– আমি ফাজলামো করছি?
– তা নয় তো কি! এভাবে রাত বারোটা পর্যন্ত বসিয়ে রাখার কোনো মানে হয়! কে বলেছে আপনাকে এসব বার্থডে সেলিব্রেট করতে!
– কেক কাটবে না এখন?
– না।
কথাটুকু বলে নাহিদা লকেট খুলে মেহেদীর হাতে ধরিয়ে দিলো। মেহেদীর মেজাজ প্রচুর খারাপ হয়ে গেছে! সে লকেট ফ্লোরে ঢিল মেরে ফেলে বললো,
– এতো কষ্ট করে আমি এতো কিছুর আয়োজন করলাম আর এসব ফাজলামো বলছিস! কিসের এতো দাপট নিয়ে আছিস যে তোকে মানাতে হলে আমাকে যুগ যুগ ধরে তোর পিছু পিছু ঘুরতে হবে! এতো ঠেকা পড়েনি তোর পেছনে ঘুরার! যেখানে তোর মতো এমন হাজারটা মেয়ের লাইন পড়ে আমার পেছনে সেখানে তোর পেছনে আমি ঘুরবো কিসের লোভে! রাবিশ!
– হ্যাঁ, ঘুরবেন কেন আমার পেছনে। আমি আপনার কিছু হই নাকি! আপনার পেছনে হাজার মেয়ের লাইন পড়ে তাহলে তাদের ঘরে তুললেন না কেন? আমি তো আর জোর করে আসিনি। আর ঘরে তুলে কি হবে, আপনি তো ওপেনলি-ই সব করতে পারেন! বউ দেখিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে আলাপ করতে পারেন, গলাগলি হয়ে হাটতে পারেন! কে জানে বেড শেয়ার হয়েছে কজনের সাথে!
– নাহিদা!
মেহেদী অতি রেগে হাত উঠিয়ে ফেলেছিলো থাপ্পড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু দেয়নি! হাত নামিয়ে দাত কিড়মিড় করে বললো,
– আমার সাথে কথা বলতে হলে মুখ সামলে কথা বলবে, না হয় জিভ ছিড়ে ফেলবো!
নাহিদার দিকে চোখ রাঙিয়ে অত:পর কেকটা হাতে নিয়ে উপুড় করে আছড়ে ফেললো ফ্লোরে। এবং বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আবারও হয়ে গেলো এক ঝগড়া! ভেবেছিলো মেনে নিবে তাকে, কিন্তু মন কেন মানছে না! বারবার সেই কষ্টগুলোই এসে মনকে ঘিরে ধরে! আর সে! সে হাত তুলেছিলো কিন্তু থাপ্পড় দিলো না কেন! একটা তো দেওয়া প্রয়োজন ছিলো! কে জানে, হয়তোবা এতেই মনটা একটু শান্ত হতো!
মনের সাথে আলাপ করতে করতে নাহিদা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো লকেটের দিকে। হাটু ভেঙে মেঝেতে বসে হাতে নিয়ে দেখলো চেইনটা দুভাগ হয়ে গেছে। আর লকেটটা সিম্পল একটা রিং। দেখতে খুবই সুন্দর। মনের অজান্তেই মিলিয়ে নিলো চেইনের দুই খন্ড তারা দুজন যারা ঝগড়া লেগে বিভক্ত হয়ে থাকে, আর রিংটা তাদের সন্তান! চোখ ভরা অশ্রু, মন ভরা কষ্ট আর মুখে মৃদু হাসির রেখা! ভাবনা শুধু একটাই, কখনো কি হবে তাদের মন মিল?
মেহেদী বাইরে বেরিয়ে গেলেও তিন চার মিনিটের মধ্যেই রুমে চলে এসেছে। পকেট থেকে চাবিটা বের করে ফ্লোরে বসে থাকা নাহিদার সামনে ঢিল মেরে ফেললো। অত:পর লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পাশের বালিশটাও মেঝেতে ফেলে দিলো। নাহিদা চোখ মুছে চাবিটা হাতে নিয়ে দেখলো রুমের চাবি! ধরে নিয়েছে মেহতাজের রুমেরই হবে হয়তো! চাবি ড্রেসিং টেবিলে তুলে রেখে নষ্ট কেক প্যাকেটে মুড়ে কিচেনে ঝুড়িতে ফেলে দিলো। মেঝে পরিষ্কার করে সে বালিশ নিয়ে মেঝেতেই শুয়ে রইলো! ভালো লাগে না আর চোখের পানিতে বালিশ ভেজাতে, ভালো লাগে না আর কোনো কষ্ট সইতে! নিজের কাছেই অসহ্য হয়ে পড়েছে জীবন! কবে অবসান ঘটবে এই জীবনের ধারাবাহিক কষ্টগুলোর!
চলবে।