“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৫
(নূর নাফিসা)
.
.
সারারাত কাটলো একই রুমে। একজন বিছানায় অন্যজন মেঝেতে! শেষ রাতে চোখে ঘুম নেমে এসেছে তাই ভোরে উঠার সুযোগ হয়নি! নাহিদা চোখ খুলে দেখলো বাইরে থেকে আসা আলোতে আলোকিত সম্পূর্ণ রুম! বাইরে সূর্যের আলো তীব্র! মেহেদী মাত্র দরজা খুলে বেরিয়েছে। আর দরজা খোলার শব্দেই নাহিদার ঘুম ভেঙেছে। মেঝেতে শুয়ে শরীর যেন ব্যাথা ব্যাথা লাগছে! সে উঠতে গেলে টের পেলো তার মুঠোয় এখনো সেই ভাঙা লকেটটি আছে! লকেটের দিকে তাকিয়ে বড়সড় এক নিশ্বাস ছাড়লো নাহিদা। অতপর সবকিছু গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মেহেরুন এতোক্ষণে রান্নাবান্না শেষ করে নিয়েছে। নাহিদাকে দেখে বললো,
– শরীরটা কি খারাপ?
– না, মা। ঠিক আছি। ঘুম থেকে উঠতে দেড়ি হয়ে গেছে।
– আমি চোখেমুখে অসুস্থতা আন্দাজ করছি! কি হয়েছে, বল আমাকে?
– কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। বাবা কি আজ অফিস যাবে?
– ভালো লাগলে যাবে তো বলেছিলো।
– আরও কিছুদিন বেড রেস্টে থাকলেই ভালো হয়। বাবা এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে বলেই দুর্বলতা অনুভব করে। সঠিক সময়ে খাওয়াদাওয়ার দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার।
– আর আপনি? আপনার শরীর এতো দুর্বল কেন? অন্যকে বুঝ দেন নিজের বুঝটা কোথায় থাকে? এক বেলা খেলে বদহজমের বাহানায় বাকি দুই বেলা মিস! এভাবে কি মানুষ বাচে! অভ্যাস করতে হবে না?
নাহিদা একটা পিয়াজু তুলে নিয়ে খেতে খেতে বললো,
– এইযে, আমিও তো খাচ্ছি! অভ্যাস করছি না বুঝি!
– হ্যাঁ, খুব দেখছি তো! এটা পরে খা। আগে একগ্লাস পানি পান কর। শরীরে পানিটা বেশি প্রয়োজন। প্রতিঘন্টায় এক গ্লাস পানি পান করবি।
– আচ্ছা। চেষ্টা করবো।
– শুধু চেষ্টা না, আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।
– আচ্ছা, আপ্রাণ চেষ্টা করবো।
নাহিদা হাতের পিয়াজু নিয়ে মিটিমিটি হেসে বেরিয়ে এলো কিচেন থেকে। টেবিলের প্লেট গুলো খালি পানিতে আবার ধুয়ে ঠিকঠাকভাবে রেখে গেলো। রুমে এসে দেখলো মেহেদী বাথরুমে গোসল সেড়ে নিচ্ছে! তার হয়ে এলে পরপরই নাহিদা গোসল করে এলো। এতোক্ষণে বাবার সাথে নাস্তা করে নিয়েছে মেহেদী। নাহিদা নাস্তা করার জন্য এলে মেহেরুন ও সে একসাথে নাস্তা করে নিয়েছে। রুমে এসে দেখলো মেহেদী অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছে। নাহিদা আলমারি খুলে বোরকা নির্বাচন করতে লাগলো। মেহেদী তাকে বললো,
– অফিস যাবে না তুমি আজ।
নাহিদা একবার তার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজ করতে লাগলো। মেহেদীর এই অভ্যাসটা তার খুব ভালো লাগে। কারো সাথে রাগ করে বেশিক্ষণ থাকে না সে। প্রয়োজনে নিজ থেকেই কথা বলে। তার সাথে গতরাতে ঝগড়া হলো আর আজ সকাল হতেই কথা বলছে। বাবা-মায়ের সাথেও সেদিন রাগ করেছে একদিন বাদে সে-ই আবার কথা বলছিলো!
এদিকে নাহিদাকে বোরকা বাছাই করতে দেখে মেহেদী একটু জোর গলায়ই আবার বললো,
– কি বললাম, কানে যায়নি তোমার!
– আশ্চর্য! আমার প্রয়োজন হলে আমি যাবো না?
– তোমার কিসের প্রয়োজন? তোমার কোনো প্রয়োজন নেই।
– আছে আমার প্রয়োজন।
– কি প্রয়োজন তোমার? ঘুরে ঘুরে লোকজনকে পেট দেখাবে যে তুমি প্রেগন্যান্ট? আর তারা চোখ দিয়ে গিলে খাবে, এটাই তোমার প্রয়োজন?
নাহিদা করুণ দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে! এতো ভালো লাগার মাঝেও এসব আঁকাবাঁকা কথার জন্য মেহেদীকে ঘৃণা করে সে! মেহেদীর দৃষ্টিও রাগান্বিত! নাহিদাকে এভাবে তাকাতে দেখলে মেহেদী আবারও কড়া কণ্ঠে বললো,
– কি? শুনতে খারাপ লাগে? কিন্তু দৃষ্টির বাইরে তো এটাই সত্য! চোখ থাকলে খুলে দেখো লোকজন কিভাবে তাকায় আশেপাশে কোনো ত্রুটি তাদের দৃষ্টিতে আটকালে। হোয়াট এভার, তুমি অফিস যাবে না এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত! একজন হাসব্যান্ড হিসেবে এটা আমার আদেশও বটে। এর পরও যদি মান্য না করো তো পরে দেখবে এর পরিনাম!
নাহিদাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মেহেদী ফোন হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। দরজার সামনে মেহেরুনকে দেখে সে একটু থেমে গেলো। পরক্ষণে আবার বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– আম্মু, আমি আসছি।
মেহেরুন দরজার সামনে থেকে সরে এসে বললো,
– দাড়া।
– কি?
– এভাবে কথা বললি কেন তার সাথে। নাহিদার বর্তমান অবস্থা কি তুই জানিস না?
– জেনেই তো বললাম।
– তাই বলে তোর এভাবে রাগারাগি করতে হবে!
– আম্মু, সে একটা কথাও শোনে না। তোমাদের আস্কারাতে আরও এমনটা হয়েছে! খুব কি প্রয়োজন ছিলো তাকে অফিস পাঠানোর!
– তোর জন্যই তো পাঠালাম! তোর উপর ভরসা রাখতে পারছি না তাহলে মেয়েটাকে কি পথে ছেড়ে দেবো!
– কেন, এখন যাচ্ছি না আমি অফিস? করছি না আমি কাজ? তাহলে তাকে কেন যেতে হবে!
– সেটা ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেই পারতি। প্রয়োজন ছিলো না তো এমন উল্টাপাল্টা বলার!
– ভালোভাবে বুঝাবো কি করে? কখনো দেখেছো তুমি, আমার প্রত্যেকটা কথা কেমন ইগনোর করে! আমার প্রতিটা কাজই তার অপছন্দ! ভালো কিছু করলেও যেন তার পছন্দ হয় না! আমি বলতেই সে বিরক্ত!
মেহেদী জেদ নিয়ে একটু জোরে বললেও মেহেরুন নিচু স্বরে বললো,
– তবুও তুই এমন আচরণ করবি না। আমিও লক্ষ্য করছি নাহিদার আচরণ। এতে তার কোনো দোষ নেই। এসময় মেজাজ একটু খিটখিটে হয়ই। সেটা আমাদের বুঝা উচিত।
– এসময় মানে? কোন সময়ের কথা বলছো?
– নাহিদার প্রেগন্যান্সির কথা বলছি। কখনো তার ভালো লাগবে আবার কখনো খারাপ। তাছাড়া এমনিতেও ভার্সিটি অফ থাকলে মেয়েটা সারাদিন ঘরে বসে থাকে। বাইরে থেকে ঘুরে এলেও তো মনটা একটু ফ্রেশ হয়। সেই ভেবেই তোর আব্বু তাকে অফিসে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যাতে সময়টা একটু ভালো কাটে।
– তাই বলে এই অবস্থায়?
– তখন কি আর সেটা জেনেছি, অবস্থা কোন দিকে!
মেহেদীর ফোন বেজে উঠলে সে বললো,
– আব্বু কল করছে। আমি যাচ্ছি আর আমার বুঝ তো মাথায় নেয় না। তুমিই বুঝাও যাতে আর অফিস না যায়! আমি এবার সিরিয়াস হয়ে বলছি, ঘাড়ে ঠেলে যদি অফিস যায় তো আমি সত্যিই কাজ করা বন্ধ করে দেবো। যার জন্য দায়ী থাকবে তোমরা।
– সে তোর মতো অবুঝ না।
– না হলেই ভালো।
মেহেদী বেরিয়ে গেলে মেহেরুন দরজা লাগিয়ে নাহিদার কাছে এলো। মেহেরুনকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে নাহিদা দুহাতে চোখ মুছে বোরকা ঠিকঠাকমতো রেখে আলমারি লাগিয়ে দিলো। মেহেরুন তার কাছে এসে কাধে হাত রেখে বললো,
– কান্না করছিস কেন? সে তোর ভালোর জন্যই বলছে। কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারছে না। জানিসই তো একটু বেশি জেদি ছেলেটা।
নাহিদা একহাতে আবারও চোখ মুছে মেহেরুনের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,
– মা, দেখুন তো। আমার কি পেট বুঝা যায়? তাহলে এমন কথা বলে গেলো কেন আমি পেট দেখানোর জন্য অফিস যাই? এমন বাজে কথা কার সহ্য হয়! আপনিই বলুন!
– তুই মানছিস না বলে পরবর্তী সময়ের কথা ইঙ্গিত করেছে। আজ বুঝা যায় না, কিছু দিন পর তো ঠিকই একটু বড় দেখাবে। তাই তোকে অফিস যেতে নিষেধ করেছে। এই অবস্থায় বেশি চলাফেরা ঠিক হবে না তোর। তাছাড়া এখন তো তোর বাবাও যাচ্ছে, আর যেতে হবে না অফিস। হুম?
– সেটা কি ভালোভাবে বলা যেতো না? সে রেগুলার অফিস যাচ্ছে তাই আমি দু-এক সপ্তাহ বাদে এমনিতেও যেতাম না। আর আমি কি অফিস যাচ্ছিলাম নাকি ভার্সিটি যাচ্ছিলাম! এখন তার জন্য পড়াশোনাও বন্ধ করে বসে থাকি!
– ভার্সিটি যাবি?
– অনেক দিন হলো যাই না। প্রয়োজন ছিলো যাওয়া।
মেহেরুন দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এসে নিজের ফোন নিয়ে মেহেদীকে কল করতে করতে আবার নাহিদার কাছে এলো। মেহেদী রিসিভ করতেই বললো,
– এই, তুই শুধু শুধু মেয়েটাকে এভাবে বকে গেলি কেন! সে তো অফিস যেতো না। ভার্সিটি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো!
– সেটা কি একবারও বলেছে আমাকে?
– জিজ্ঞেস করেছিস তুই?
– না।
– তবে কি করে বলবে?
– গাড়িতে আছি। দুই মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে আসতে বলো। নামিয়ে দিয়ে যাবো।
মেহেরুন কিছু বলার আগে নাহিদা ই ফোনের কথপোকথন শুনে বলে দিলো,
– যাবো না আমি কোথাও!
ওদিক থেকে মেহেদী বললো,
– আম্মু? যাবে না সে?
– হ্যাঁ, যাবে। তুই দাড়া, আমি পাঠাচ্ছি।
মেহেরুন কল কেটে বললো,
– রেডি হয়ে যা ঝটপট।
– মা, আমি যাবো না।
– জেদ করিস না। ক্ষতি তোরই হবে।
– জেদ করছি না, মা। সত্যিই এখন যাওয়ার মুড নেই।
– গেলেই ভালো লাগবে। যা।
নাহিদা যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবে বললো,
– এতোটা ইম্পর্ট্যান্ট না। তখন যেতে চেয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু এখন ভালো লাগছে না।
– রাগ করে বলছিস না?
– উহুম, সিরিয়াসলি বলছি। দেখি নেক্সট উইক থেকে যাবো।
– চলে যেতে বলবো তাদের?
– হুম।
মেহেরুন কল করে আবার চলে যেতে বললো তাদের। পরক্ষণে ড্রয়িংরুমে বসে নাহিদার মাথায় তেল মালিশ করতে করতে গল্প করলো দুজন। মেহেদীর বলা কথা ভুলতে পেরে নাহিদার মনটা ভালো হয়ে গেছে। পরক্ষণে নাজিয়া, নাফিসা ও মায়ের সাথে কথা বললো বেশ কিছুক্ষণ। ড্রেসিং টেবিলের সামনে আসতেই চোখ পড়লো ছেড়া লকেটের দিকে! আবারও মনে হয়ে গেলো গত রাত ও সকালের ঘটনা। লোকটাকে নিয়ে একদিকে ভালোলাগা কাজ করে, অন্যদিকে বেদনা! এই দুইয়ের মাঝে চাপা পড়ে কোনো কূল ধরতে পারছে না সে। বেশ কিছুক্ষণ লকেটটা নিয়ে খেলা করে তা কোনোমতে জোড়া লাগিয়ে দিলো। এবং এটাও স্থির করলো, এভাবে হার মেনে, অভিমান নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কষ্টগুলো চাপা দেওয়ার জন্য আরেকটা বার চেষ্টা করতে হবে তাকে। আরেকটাবার সুযোগ দিতে হবে মেহেদীকে। যদি এবার মনটা একটু শক্ত হয়। এবার যদি মেহেদীটা একটু সঠিক পথে স্থীরভাবে অবস্থান করে।
যদিও গতরাতে বলা মেহেদীর কথা অনুসারে নাহিদা এখন ৮০ভাগ নিশ্চিত যে, মেহেদী তাকে আর প্রশ্রয় দিবে না। তবুও তার ক্ষণিকের রাগের উপর ২০ভাগ নিশ্চিত হয়ে প্রত্যাশা করছে মেহেদী মানবে হয়তো!
বিকেলে বাসায় ফিরলে কেউই কারো সাথে কথা বললো না। এমন ভাবে চলছে যেনো দুজনেই দুজনকে ইগনোর করছে! একে অপরের দিকে তাকানোও যেন কোনো প্রয়োজন মনে করছে না! কেবল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত! নিজেদের ইচ্ছে নিয়ে ব্যস্ত! মেহেদীর মনোভাব, বেশি প্রশ্রয় দিলে মানুষ মূল্য দেয় না। আর নাহিদার মনোভাব উৎফুল্লতা! কেন জানি তার খুব ভালো লাগছে দুজনই দুজনকে ইগনোর করছে বলে! আবার মাঝে মাঝে ভাবছে, মেহেদীর সাথে স্বাভাবিক আচরণের সুযোগ পাবে তো? কি করে পাবে! সে তো অনেক মুডে আছে! যা ভেবে রাখে সবসময় তার উল্টোটা কেন ঘটে! বিকেল সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতে ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে। হলো না কারো সাথে কারোই কোনো কথা! অবশেষে নাহিদা ই সাহস করে এক ধাপ এগিয়ে গেলো। এইবার যদি কোনো উল্টাপাল্টা বলে মেহেদী, তাহলে সোজা শ্বশুর মশাইয়ের কাছে নালিশ জানাবে! তারপর যা হবার হবে!
মেহেদী লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছিলো। নাহিদা বালিশ ঠিক করে তার পাশেই খাটে শুয়ে পড়লো। মেহেদী সোজা হয়ে থাকলেও এবার বিপরীত মুখী কাত হয়ে আছে! নাহিদা চুপচাপ এগিয়ে এসে মেহেদীর পিঠে মাথা ঠেকিয়ে একহাত পেট পর্যন্ত নিয়ে গেলো! মেহেদী হাত সরিয়ে দিতে চাইলে নাহিদা টিশার্ট আঁকড়ে ধরে রাখলো! কিন্তু কারো মুখেই কোনো শব্দ নেই। পরক্ষণে মেহেদী আবার সোজা হতে চেষ্টা করলো আর নাহিদা তার পিঠের নিচে অর্ধেক চাপা পড়ে গেলো! মেহেদী ইচ্ছে করে করছে এমটা! রাগ হলেও কিছু বললো না নাহিদা! দম যেনো তার বন্ধ হয়ে আসছে! এমনটা করার কোনো মানে হয়! তবুও কিছু বলছে না। দুতিনমিনিট পাড় হতেও যখন দেখলো মেহেদী সরছে না তখন আর চুপ থাকতে পারলো না! শ্বাস নিতে তার কষ্ট হচ্ছে তাই বলেই ফেললো,
– হচ্ছে কি এসব! আমার মাথা চাপা পড়ে আছে সেটা কি দেখছে না কেউ!
বিপরীতে কোনো জবাব এলো না! নাহিদা এবার নিজেই তাকে দু’হাতে ঠেলে সরে এলো। এতোক্ষণ ভার হালকা থাকলেও এবার পুরোপুরি ভার ছেড়ে আয়েশ করে সোজা হয়েছে মেহেদী! কোনো প্রতিক্রিয়া ছাড়া মেহেদীকে চোখ বুজে ঘুমানোর ভঙ্গিতে দেখে নাহিদা একটু বিরক্তবোধ করলেও কিছু বললো না। চুপচাপ মাথাটা মেহেদীর বুকে রেখে ডান হাতটা টি-শার্টের নিচে পেটে রাখলো। না বলুক কোনো কথা। সে-ও বলবে না কিছু। দুজনেই চুপ।
চোখে ঘুম নেমে এসেছে মাত্র এমন সময় বাহুতে টান পড়লো এবং মাথাটাও চলে গেলো বালিশে! ঘুম ঘুম চোখে তাকাতেই আবছা আলোতে দেখতে পেলো মেহেদীর মুখখানা। নাহিদাকে তাকাতে দেখে মেহেদী বললো,
– কি?
– ঘুমাবো।
– তো আমার কাছে কি?
– স্বপ্ন।
– ঘুমাবে তুমি আর স্বপ্ন চোখ ছেড়ে আমার কাছে কেন?
ছোট ছোট চোখে নাহিদা কয়েক সেকেন্ড স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে বললো,
– আমরা নিজেরা ঠিক না হলে আল্লাহ ছাড়া কারো সাধ্য আছে আমাদের ঠিক করার?
– তুমিই তো দাম দেখাও!
– দেখাবো না! আপনার দাম আছে আর আমার দাম নেই!
– কত টাকা?
– আপনার মুখে এসব বাজে কথাগুলোই তো শুনতে ভালো লাগে না!
মেহেদী তার উপর হাত ও পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বললো,
– আর বলবো না, প্রমিজ।
– যে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারে না, তার কথা দেওয়াই উচিত না।
– রাখবো।
– কোনো প্রয়োজন নেই তো বারবার মন ভাঙার! এরচেয়ে ভালো কখনো কোনো কথা দিতে হবে না।
মেহেদী ছোটখাটো এক নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ওকে।
নাহিদার ঘুম ফুড়ুৎ করে উড়ে গেলো! আর চাপা কষ্টগুলো আবারও কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো। ভিজিয়ে দিচ্ছে মেহেদীর টিশার্ট! মেহেদী বললো,
– ভালো লাগছে না কান্না। বেশ কয়েকদিন যাবত আমি হাসতে ভুলে গেছি তোমার জন্য।
– হ্যাঁ, সব দোষ তো আমারই! আর আপনি খাটি লোক!
– না, দোষ আমারও। তাই বলে কি এখন কাদবেই?
নাহিদা টিশার্টে চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই তার মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার চরিত্র। আর তার চরিত্র নিয়ে যদি কেউ উল্টাপাল্টা কিছু বলে কার সহ্য হবে তা? আশিকের সাথে আমার কখনোই কোনো রিলেশন ছিলো না। সত্যি বলছি আমি।
– বাদ দাও।
– না, বাদ দিবো না। আমাকে নিয়ে কেউ সন্দেহে বসে থাকুক তা আমি চাই না। আশিক আমাকে পছন্দ করতো ঠিকই, প্রপোজও করেছিলো কিন্তু আমি তা গ্রহণ করিনি। তবুও সে এককভাবে চেষ্টা করেছিলো আমাকে বুঝানোর। সবদিক থেকে আমার মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তার শেষ কথা একটাই, আমি যেন তার হই! কিন্তু আমার তো এসব হারাম সম্পর্ক পছন্দ না। তাই আমি বরাবরই ইগনোর করেছি তাকে। তবে বন্ধুত্বের তালিকায় ঠিকই রেখেছিলাম। সর্বশেষে এনগেজমেন্ট সম্পাদনের পর সে তার চেষ্টায় ব্যর্থতা মেনে নিয়েছে। এরপর থেকে তার সাথে যোগাযোগ হয়না বললেই চলে। সেদিন নাফিসা কল করেছিলো ভার্সিটি যাওয়ার জন্য। আমিও বিয়ের পর তেমন ক্লাস করি না। তাই মাঝে মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করি। হঠাৎই দেখা হয়ে গেছে ইমরান ভাইয়া ও আশিক ভাইয়ার সাথে। আর তুমি…! না জেনেশুনে এভাবে হার্ট করো কেন? কারো সম্পর্কে উল্টাপাল্টা বলার আগে সবটা সম্পর্কে কি ক্লিয়ার জানা প্রয়োজন না? আজও তো আমি ভার্সিটি যেতে চাইছিলাম। তোমাকে রেগুলার অফিস যেতে দেখলে এমনিতেই আমি অফিস যাওয়া ছেড়ে দিতাম! শুধুমাত্র তোমার জন্যই গিয়েছি অফিস। নিজেকে কাজে জড়িয়ে রাখার ইচ্ছে থাকলেও এই অবস্থায় আমি কাজে জড়িয়ে থাকতাম না। আর তুমি কি বললে! আমাকে কি কখনো অস্বাভাবিক চলাফেরা করতে দেখেছো? যার ফলে এমন সব শুনালে? বলছো না কেন?
মেহেদী চুপ করে আছে। নাহিদা কান্না থামানোর চেষ্টা করে আবার বললো,
– আর কি কি বিষয় নিয়ে সন্দেহে আছো? বলো আমাকে। মনের ভেতর হাজারো ভাবনা না রেখে সরাসরি জিজ্ঞেস করো। খোচা মেরে কোনো কথা আমার সহ্য হয়না। বলো, আর কি জানতে চাও?
– কিছু না। চুপ।
– কিছু না কেন? কিছু না হলেই কি তুমি ওয়াদা ভঙ্গ করেছো?
– বললাম না কিছু না।
নাহিদা এবার খিটখিটে মেজাজে জিজ্ঞেস করলো,
– তাহলে মদ খেয়েছো কেন?
– তোমার জন্য।
– আমি বলে দিয়েছিলাম খেয়ে আসার জন্য?
– বলতে কেন হবে! যেভাবে হার্ট করেছো সেটা কি যথেষ্ট ছিলো না? তোমার জন্যই খাওয়া ছেড়েছিলাম আবার তোমার জন্যই খেতে হয়েছে! আমার মেয়ে ফ্রেন্ড আছে অনেক কিন্তু কখনো কোনো মেয়ের প্রতি এমন ফিলিংস আসেনি। প্রথম প্রথম তোমার প্রতিও ছিলো না। আস্তে আস্তে একেবারে বদলে গেছি আমি। কেন জানি হারিয়ে গিয়েছিলাম তোমার মাঝে। আবার হারানোর ভয়ও পেয়ে গেছিলাম! মনের মধ্যে এক্সট্রা কেয়ারনেস ভাব চলে আসতো! কেমন জানি একটা টেনশনও কাজ করতো। আর সেই সূত্রে তোমার সম্পর্কে একটু ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে শুধু চোখে পড়লো আশিক আশিক আর আশিক!
– জানো তো? একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূল শক্তি কি? বিশ্বাস। তাও সেটা চিরস্থায়ী হতে হবে। এই ক্ষণস্থায়ী বিশ্বাস ক্ষণিকের জন্যই সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর খুব শীঘ্রই তার অবসান ঘটে! আমার সংসারের সুখ চাই না। আমার স্বজনদের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। তা যদি সফল হয়, সুখ এমনিতেই চলে আসবে। তোমাকেও আমার এভাবে চাই না। আগে বিশ্বাস নামক খুটিটা গড়ে তোলো, তারপরই আমায় ডেকো। আমি অপেক্ষা করবো।
নাহিদা মেহেদীর হাত সরিয়ে দিতে গেলে মেহেদী আরও শক্ত করে তাকে বেধে রেখে বললো,
– অতীতকে স্মরণ করে করে কি বর্তমানটা ধ্বংস করে দিবে?
– না, অতীতকে স্মরণ করিয়ে ভুলগুলো শুধরে নেব, যাতে দ্বিতীয় বার আর সেই ভুল গুলো না হয়। বর্তমান সজ্জিত করতে হলে তো অতীতের ভুলগুলো স্মরণ করতেই হবে।
– তাহলে তুমি স্মরণ করতে থাকো আর আমি ঘুমাই।
– ঘুমাবেই তো। যাও, ঘুমাও।
– পিটুনি খাওয়ার কাজ করছো কিন্তু। রাত ক’টা বাজে, খেয়াল আছে?
– পারবে তুমি পিটুনি দিতে? দুইবার হাত তুলেও তো নামিয়ে নিয়েছো!
– তিনবারের মাথায় যদি উঠিয়ে ফেলি?
নাহিদা মৃদু হেসে বললো,
– অপেক্ষায় রইলাম। আচ্ছা, হাত উঠলো অথচ থাপ্পড় পড়লো না কেন?
– কাউকে মেরে অভ্যস্ত নই। তাছাড়া হবেই বা কি করে , ছোট ভাইবোন থাকলে তো মেরে মেরে অভ্যাস করে ফেলতাম।
– ঝগড়াঝাটি করোনি কখনো?
– আউটসাইডে হয়েছে স্কুল কলেজ ভার্সিটি। সেগুলোর ব্যাপার আলাদা। ঘুমাও এবার।
– না, আমার কিছু প্রশ্ন আছে।
– কাল সকালে।
– না, এখন।
– তাহলে তো তুমিই জানো সব।
– এমন করছো কেন!
– ওকে, বলো। তারাতাড়ি…
– আগে বলো আমার সম্পর্কে আরও কোনো জিজ্ঞাসা আছে কিনা?
– আশিকের জন্য তোমার মধ্যে কখনো ফিলিংস আসেনি?
– প্রত্যক্ষ কোনো ফিলিংস আসেনি। আর পরোক্ষভাবে এসেছে কিনা সেটা আমি ক্লিয়ার না। বিয়ের পর যখন তুমি আমাকে ইগনোর করে মেন্টালি টর্চার করতে তখন কখনো কখনো আশিকের কেয়ারনেস গুলো মনে পড়তো! যেগুলো আমি কখনোই প্রত্যাশা করতাম না তার কাছে।
– এখন মনে পড়ে?
– উহুম।
– তাহলে আগে একটু হলেও ফিলিংস ছিলো যেটা এখন আর নেই। এবার বলো তোমার প্রশ্ন?
– কক্সবাজারে দেখা হয়েছিলো, ওই মেয়েটার সাথে তো তোমার কোনো রিলেশন ছিলো না। তাহলে ওর সাথে এখন কেন তুমি এভাবে কথা বলো? শুধুই কি আমাকে দেখানোর জন্য? নাকি অন্য কোন কারণ?
– আবার কোন মেয়ে এসে পড়লো! ঘুমাতে পারবো না আজ!
– দেখো, এসব কিন্তু পরকীয়া হয়ে যায়! হালাল স্ত্রী বা স্বামী রেখে অন্য মেয়ে বা ছেলের সাথে এ ধরনের সম্পর্ক মোটেও ঠিক না। বন্ধুবান্ধব এক রকম আর তুমি যেভাবে মিন করো সেটা অন্যরকম অর্থাৎ খুবই বাজে! এগুলো ঠিক না।
– হ্যাঁ, তোমাকে দেখানোর জন্যই ছিলো সবটা। বিশ্বাস না হলে ফোন চেক করে দেখো, নম্বর ব্ল্যাক লিস্টে পাবে। আইডি ও ব্লকে রাখা হয়েছে। ওর মতো ফ্রেন্ড থেকে পালিয়ে থাকতে পারলে বাচি আমি। ক্লিয়ার?
নাহিদা তার সাথে মিশে চোখ বন্ধ করে বললো,
– হুম।
– এই?
– হু?
– বাবু সম্পর্কে এবার কিছু বলো?
– কি বলবো?
– যা ইচ্ছে তোমার।
নাহিদা মেহেদীর চোখের উপর হাত রেখে বললো,
– বাবুর আব্বু এখন ঘুমাবে। শুভ রাত্রি।
– এতোক্ষণ বকবক করে এখন এটা কি হলো!
– ঘুমানোর জন্য বলা হলো।
– আজ বেচে গেলে, এরপর আর বাচতে পারবে না।
– দেখা যাবে। এখন হাত পা একটু সাবধানে রাখা প্রয়োজন।
– ওফ্ফ, সময় লাগবে অভ্যাস চেঞ্জ করতে।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৬
(নূর নাফিসা)
.
.
অফিস থেকে ঘরে ফিরতেই নাফিসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো ইমরানের দিকে! তার এমন দৃষ্টিতে ইমরানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়লো! পরক্ষণে দরজা চাপিয়ে এগিয়ে এসে বললো,
– কি হয়েছে গিন্নি? এতো রেগে আছো কেন?
নাফিসা কোমড়ে হাত রেখে ঝাঝালো কণ্ঠে বললো,
– আপনি আবারও বেল্টের জুতা পড়ে অফিস গেছেন!
ইমরান নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে জ্বিভ কেটে দুইহাতে নাফিসার কান ধরে বললো,
– সরি, ভুল হয়ে গেছে!
নাফিসা রেগে তার হাত সরিয়ে বললো,
– ভুল? প্রত্যেকদিন এসে বলবেন ভুল হয়ে গেছে আর আমি বিশ্বাস করে নিব? ভুল মানুষের একবার হতে পারে কিন্তু বারবার না! ইচ্ছে করে এসব করে আবার মিথ্যে বলতে আসে আমার সাথে!
– গরমের দিন, কেডস শো পড়লে পা জ্বালা করে। বুঝো না?
– আর ধুলাবালিতে যে কাটা জায়গায় ইনফেকশন হয়ে যায় সেটা আপনি বুঝেন না?
– অযথা এতো চিন্তা করো না, কিছু হবে না।
– হ্যাঁ, হবে না। আর যখন হবে তখন বলবে “ভুলে হয়ে গেছে”! আমার কি আমার কিছু আসে যায় নাকি! যার যার সমস্যায় সে ভুগবে। এতো ঠেকা পড়েনি কারো মাথা থেকে পায়ের জুতা পর্যন্ত খেয়াল রাখার! কয়েকদিন জুতা মোজা পড়লে যেনো উনার পা জ্বলে আগুন ধরে যাবে!
নাফিসা রাগে ফুসতে ফুসতে ঘরের অগোছালো টুকটাক জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলো। ইমরান মুচকি হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– তোমারই তো সব। আচ্ছা, যাও। এরপর থেকে প্রতিদিন পড়ে যাবো।
– সড়ুন! হয়ে গেছে দিন দেখা!
ইমরানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নাফিসা বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। ইমরান এখন মোটামুটি ভাবে সুস্থ। প্রথম এক সপ্তাহের মতো তার বাইরে চলাচল নিষিদ্ধ ছিলো। তারপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করছে। বাকি সবদিক থেকে সুস্থ হলেও পায়ের কাটা চামড়াটা স্থির হয়নি। সেলাই খুলে ফেলা হয়েছে কিন্তু ওষুধ লাগাতে হয় নিয়মিত। সাথে ধুলাবালি হতে সতর্কতা! কেননা ঘাঁ শুকাতে আরও সময় লাগবে। আল্লাহর রহমতে পায়ের ঘাঁ বাদে বাকি সবদিক থেকে সে সুরক্ষিত। এক্সিডেন্টের পর সবদিক থেকেই নাফিসা তার যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে। প্রথম এক সপ্তাহের মতো ইমরানকে ধরে ধরে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, সাবধানে গোসল করানো আর খায়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারটাই একটু বেশি কষ্টকর ছিলো নাফিসার জন্য। এখন সব ঠিক আছে। আর গতদিন গুলোতে তাদের সম্পর্কটাও এগিয়ে গেছে বহুগুণ। এখন আর বিরক্ত বোধ হয়না ইমরানকে। কাছে আসার ভয়ও পায় না। বরং নিজ থেকেই নিকটে অবস্থান করেছে ধীরে ধীরে। একজন স্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্বটাও বাড়িয়ে নিয়েছে বহুগুণে। সকল বিষয়ে লক্ষ্য রাখা, ভুল হলে বা তার মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করলে অল্পতেই রাগারাগি মন্দ লাগে না ইমরানের কাছে। কেননা তাকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে তার মাঝে।
বরাবরের মতো জুতার ঘটনা নিয়ে নাফিসা সারাদিন রেগে থাকলেও দিন শেষে মানিয়ে নিয়েছে ইমরান। কিন্তু সকাল হতেই আবার এক মহা প্রলয়!
ঘুম ভাঙলে আবছা আলোতে চোখ খুলেই দেখলো অগ্নি দৃষ্টান্ত তাকিয়ে আছে চোখ জোড়া! ইমরান নাফিসার নাক টেনে বললো,
– এভাবে তাকি আছো কেন বুড়ি? সকাল সকাল ঘুম ঘুম চোখে তাকালেই তো ভালো দেখায় বুড়িটাকে!
নাফিসা ইমরানের হাতে এক ঘা মেরে বললো,
– আমার ফোনের এলার্ম বন্ধ করেছেন কেন?
– ওফ্ফ! এতো জোরে কেউ মারে! সকাল সকাল উষ্ণ ছোঁয়াতে কোথায় মিষ্টি বানিয়ে দিবে, তা নয়!
– রাখেন আপনার মিষ্টি! আমার ফোনের এলার্ম বন্ধ করলেন কেন?
– রাত বারোটার এলার্ম দিয়ে রেখেছো কেন? তাইতো বন্ধ করে দিয়েছি!
– আমার প্রয়োজন ছিলো বলেই তো দিয়েছি! আপনাকে মাতব্বরি করতে কে বলছে! আমার সব প্ল্যান নষ্ট করে দিছে!
ইমরানকে সরিয়ে কান্না করতে করতে নাফিসা উঠে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। ইমরান বিস্মিত হয়ে বললো,
– বারোটায় তোমার কিসের প্ল্যান!
– আপনার মাথা! কোনো কথা বলবেন না আমার সাথে! ভেবেছিলাম নাহিদা আপুকে সবার আগে আমি বার্থডে উইশ করবো তা আর হলো না!
– বার্থডে উইশ! তা আপু কি তোমার উইশের জন্য রাত জেগে বসে আছে!
– আপনি জানেন, জেগে আছে না ঘুমিয়ে গেছে? আর বসে থাকতে হবে কেন! একটা কল করলেই তো ঘুম ভেঙে যেতো!
– শুধু শুধু ঘুম নষ্ট করার মানে হয়!
– আবারও কথা বলেন আপনি! একটা কথা বললে মাথা ফাটিয়ে দিবো এখন!
– ঘুম ভাঙেনি তোমার। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসো।
নাফিসা দরজা খুলে ঠাস করে দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে গেলো। নামাজ পড়ে কুরআন পড়ে সে গোমড়ামুখু হয়েই বসে রইলো! ইমরান তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে বললো,
– এ নিয়ে রাগ করে বসে আছো? এখন ফোন করে উইশ করে দাও তাহলেই তো হয়।
– আপনাকে বলেছি আমাকে জ্ঞান দিতে?
ইমরান দু’দিকে মাথা নেড়ে চুপ করেই রইলো। তিন-চারদিন হলো জেরিন বাবার বাড়ি গেছে। নাফিসা বড়ঘরে এসে চুপচাপ কাজ করে যায় ঠিকই। না কথা বলে ওই জেরিনের সাথে আর না কথা বলে আবিদা বেগমের সাথে! আবিদা বেগম কিছু বললে সে চুপচাপ কাজ করে দেয়। এতে আর কারো সাথেই কোনো কথা কাটাকাটি হয় না। কথায় কথা বাড়ে! আইডিয়াটা ছিলো বড়মায়ের। নাফিসা তা-ই অনুসরণ করে যাচ্ছে। বড়মার কথা অনুযায়ী সে মিলিয়ে নিলো আসলেই আবিদা বেগম চুপচাপ স্বভাবের। কিন্তু মাঝে মাঝে বোনের প্রেতাত্মা এসে তার মাঝে ভর করে!
নাস্তা করার সময় হয়ে এলে ইমরান বড়ঘরে এলো। এতোক্ষণ স্বাভাবিক হয়ে থাকলেও এখন মুখটা লুচির মতো ফুলিয়ে রেখেছে নাফিসা! চুপচাপ সে একে একে খাবারের প্লেট ও বাটি এনে রাখছে। তার কাজে জেদ স্পষ্ট! ইমরান নিচু স্বরে বললো,
– এভাবে রাগ করে থাকলে তো আর আমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। বছরে একবার বার্থডে আসে আর তুমি উইশটা করছো না! দিন ফুরিয়ে গেলে আফসোস তোমার আর ক্ষতি নাহিদা আপুর!
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। ইমরান আবার বললো,
– বসো, একসাথে খাই?
– হুহ!
নাফিসা ভেঙচি কেটে চলে গেলো! আজ তো আর জেরিন নেই তাই সে অন্যান্য কাজেই ব্যস্ত থেকে ইমরান থেকে দূরে থাকতে পরিকল্পনা করলো। কিন্তু এরই মাঝে ইমরানের ডাক পড়ে গেলো! মা, বড়মার সামনে কি আর তার ডাক উপেক্ষা করে থাকা যাবে! সে এটাও নিশ্চিত, সবটা জেনেই এমন করেছে স্টুপিড লোকটা!
নাফিসা বাধ্য হয়ে এখানে এলো।
– কি?
– বসো এখানে।
– কেন? আজ তো আর সে নেই!
– কথা কম। যা বলছি তা করো।
নাফিসা সোফায় বসতে গেলে ইমরান বললো,
– সোফায় না, আমার কাছে বসো।
নাফিসা সেখানেই বসে রইলো। ইমরান ভাত মাখতে মাখতে বললো,
– বাবা কিন্তু বলেছিলো, আমার কথা অমান্য করলে যাতে বাবাকে বলি। আমি তো আমার বউ নিয়ে কারো কাছে নালিশ জানাতে চাই না। কেননা, আমার বউ এমনিতেই আমাকে মানে।
– হইছে, এতো পাম মারতে হবে না। ডেকেছেন কেন সেটা বলুন, আমার আরও কাজ আছে।
বলতে বলতে নাফিসা ইমরানের কাছে এসে বসলো। ইমরান মুচকি হেসে তার মুখের সামনে এক লোকমা খাবার তুলে ধরলো। নাফিসা মুখ সরিয়ে নিলো! ইমরান বললো,
– নাও, নতুবা এখন আমি খাবো না।
– এতো ঢং দেখাচ্ছেন কেন!
– তুমি নিবে নাকি আমি খাবার রেখে উঠে যাবো?
নাফিসা চেহারায় বিরক্তিকর ভাব এনে খাবার মুখে নিয়ে বললো,
– আমি এখন আর খাবো না।
– আরেকবার।
দ্বিতীয়বার দেওয়ার সময় নিশাত রুমে চলে এলো! ইমরানকে খায়িয়ে দিতে দেখে জ্বিভে কামড় দিয়ে হাসতে হাসতে আবার বেরিয়ে গেলো! খাওয়া শেষে যখন নাফিসা সব গুছিয়ে রাখছিলো তখনও নিশাত মিটিমিটি হাসছে! নাফিসা ব্রু কুচকে বললো,
– এতো হাসির কি আছে! তোমাকে কেউ খায়িয়ে দেয় নি কখনো? বিয়ের পর দেখো, তোমার হাসব্যান্ড খায়িয়ে দেয় কিনা! আর তখন আমিও দেখবো খাও না ফেলে দাও!
মা এবং বড়মায়ের সামনে এভাবে বলায় নিশাত নিজেই লজ্জা পেয়ে গেছে! সে দাতে দাত চেপে আর কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা বড়মার রুমে চলে গেলো! এদিকে আবিদা বেগম নাফিসার দিকে তাকিয়েছিলো একবার, বড়মাও তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে নিজের কাজ করছে। কিন্তু নাফিসার মাঝে লজ্জার রেশটুকুও দেখা গেলো না। কেননা তার কাছে বিষয়টা অতি সাধারণ। বিয়ের আগে প্রায়ই মায়ের হাতে ভাত খেতো। মাঝে মাঝে বোন ও বাবার হাতেও। আর বিয়ের পর ইমরানকে খায়িয়ে দিতে হয়েছে! আবার ইমরানের হাতে খেতেও হয়েছে।
খাওয়া শেষে ইমরান মা ও বড়মার কাছে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আবার নাফিসাকে ডেকে গেলো। হাতের কাজ রেখেই নাফিসা চলে এলো তাদের ঘরে। বিরক্তিকর মনোভাব নিয়েই বললো,
– ডেকেছেন কেন?
– কাজে বের হবো এখনো কি এমন লুচির মতো গাল ফুলিয়ে রাখবে?
– হুহ্, সবসময় মেজাজ খারাপ করে দিয়ে আবার ঢং দেখাতে আসছে!
– হু, ঢং ই। এবার হাসো একটু, দেখি?
নাফিসা তার ফোন নিয়ে সাইড বাটনে চেপে ইমরানের সামনে ধরলে ইমরান বললো,
– আমার ছবিই আমি দেখবো?
নাফিসা দেখলো সত্যিই ইমরানের ছবি! সে লক খুলে আবার হোম স্ক্রিনে সেট করা নিজের হাসিমাখা মুখের ছবিটা দেখালো। ইমরান মুচকি হেসে ফোনটা রেখে নাফিসার ঠোঁটের দুই কোনা টেনে বললো,
– কৃত্রিম ছবিতে নয়, আমি বাস্তব ছবিতে দেখতে চাই।
নাফিসা তার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
– আমি জোকার নই যে অযথা দাত কেলিয়ে থাকবো!
– আচ্ছা, যাও। হাসতে হবে না। তবে একটা কিসিমিসি কি পাবো?
নাফিসা এবার লজ্জা পেয়ে বললো,
– যাহ! নির্লজ্জ ব্যাটা!
– পাবো না?
– কিশমিশ চাইলে দিতে পারি।
– না, আমার কিসিমিসি লাগবে।
ইমরান একটু এগিয়ে আসতেই নাফিসা তাকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেলো! ইমরান মোজা জুতা পড়ে দরজা লাগিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো নাফিসা বড় ঘরের গেইটের সামনে দাড়িয়ে মুখ চেপে হাসছে। তার দুষ্টুমিতে ইমরানও ঠোঁটের কোনায় হাসি ফুটিয়ে চলে গেলো।
নাস্তা করে নিশাতের সাথে একটু গল্পগুজব করে নাফিসা নাহিদাকে কল করে বার্থডে উইশ করলো। পরক্ষণে সময় কাটাতে অনলাইনে প্রবেশ করলো। ইমরানকে এক্টিভ দেখে তার মাথায় দুষ্টুমি চাপলো। সে তার ফেইক আইডি দিয়ে ইমরানকে মেসেজ রিকুয়েষ্ট দিলো “হাই…”। টাইমলাইনে ঘুরাঘুরি করতে করতে দু’মিনিট পরেই দেখতে পেল রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্টেড এবং ইমরানের রিপ্লাই, “হ্যালো?”
নাফিসা খুশি হয়ে টেক্সট করলো,
– কেমন আছো, জান?
– প্রচন্ড গরমে একটুও ভালো নেই, জান!😰
এমন রিপ্লাইয়ে নাফিসার প্রচুর রাগ উঠে গেলো! এই ব্যাটা তো দেখছে লুচুও বটে! চেনা নেই , জানা নেই কি অসভ্যতার সাথে রিপ্লাই দিলো! সে রাগ কন্ট্রোল করে আরও একধাপ এগিয়ে গেলো,
– কেন জান? এসি নেই তোমার অফিসে?😢
– অফিসে আছে, কিন্তু আমার আশেপাশে নেই!😰
– ওফ্ফ! সো সেড! তা তুমি আমাকে চিনতে পেরেছো তো?
– কি বলো! তোমাকে চিনবো না!😳
– বলোতো কে আমি?
– কেন, আমার সে তুমি? ☺
– সে কে?
– তুমি?😍
– না, মানে “আমার সে” যে বললে, সেই “সে” টা ই বা কে?
– সে ই তো আমার সে!😊
– ওফ্ফ! বড্ড কথা প্যাচাও তুমি!
– প্যাচগুলো তোমার কাছেই তো শেখা!😅
– বলো না, আমার নামটা কি? দেখি তুমি চিনতে পেরেছো কিনা?
– তোমার নাম তো প্রোফাইলেই দেওয়া! দেখে নিলেই পারো!
– না, তোমার ডাকা সেই নামটা বলো।
– মাই হার্টবিট।❤
– ইশ! দুষ্ট একটা! বিয়ে করে বউকে পেয়ে তো ইদানীং আমাকে ভুলেই যাও!
– কি যে বলো! বিয়ের আগে যেমন তেমন, বিয়ের পর তো তোমাকে মুহুর্তের জন্যও ভুলতে পারি না!
ইমরানের প্রত্যুত্তরে এদিকে নাফিসার উক্তি, “লুইচ্চা ব্যাটা, তুই বাড়ি ফিরে আয় আগে। বউ কি জিনিস হারে হারে টের পাবি!” মেজাজ তার প্রচন্ড খারাপ থাকলেও টেক্সট করলো,
– ওহ্, তাই বুঝি?
– হুম। গোসল করেছো?
– নাহ, গো! ভেবেছিলাম তোমার সাথেই গোসল করবো। কিন্তু কি ভাগ্য আমার, দেখো! তোমার সাথে তো দেখা ই হয় না কতদিন হলো!
– আহারে, ঘন্টা-মিনিট গুলো তোমার এতোটা লম্বা সময় হয়ে কাটে! সকালেও না কিসিমিসি চেয়ে এলাম! তখন পালিয়ে গিয়ে কিন্তু একটু ভুল করে ফেলেছো। ইনশাআল্লাহ, বাড়ি ফিরে দ্বিগুণ শোধ তুলবো। গোসল করো গিয়ে, লেট করলে ঠান্ডা লাগবে।
নাফিসার চোখের আকৃতি দ্বিগুণ হয়ে গেছে! এতো সহজে ধরা পড়ে গেলো কিভাবে! এটা সম্ভব হতে পারে না! না! না! নাফিসার এখন খুব খুব কান্না করতে ইচ্ছে করছে! ইমরান তাকে সুযোগ দিলো না কেন একটু যাচাই করার! কিন্তু ইমরানের কথায় যেন তার কান্নাও পালিয়ে গেছে! ইচ্ছে তো করছে এখন চোখে কমলালেবুর খোসা চিপে তারপর কান্না করুক!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৭
(নূর নাফিসা)
.
.
– আহা! পেটটা ইদানিং পেটুক হয়ে গেছে! খালি খাই খাই করে!
নিশাতের রুমে প্রবেশ করতে করতে নাফিসার মুখে এমন উক্তি শুনে নিশাত হেসে উঠলো! পরক্ষণে বললো,
– ভাবি, হঠাৎ এতো খাই খাই করে কেন? পেটে কি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাইছে?
– একটা দিবো মাইর, পুচকে মেয়ে! শুধু উল্টাপাল্টা বিষয় মাথায় ঘুরে! কবে বিয়ে হবে, কবে সংসার করবে আর কবে এক গাদা বাচ্চাকাচ্চা জন্ম দিবে, এসব নিয়েই চিন্তা করো, তাই না? দাড়াও, বড়মার কাছে বলে নেই!
– ইশ! আমি মোটেও এসব নিয়ে ভাবি না।
– আহা! ভাবেন না? দেখি তো কেউ এলে যে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন! আর ভাবনা কতদূর এগিয়েছে সেটা তো আমার ভাবনারও বাইরে!
– কোথায়? কার দিকে তাকিয়ে থাকি?
– সে আর আমার বলতে হয় নাকি! তা তো তুমিই ভালো জানো। অবশ্য তোমাকেও দোষ দেওয়া যায় না। শুনেছি এ নাকি বয়সের দোষ! কেউ নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে আবার কেউ পারে না। যে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে, সে-ই উত্তম।
নিশাত তুলনামূলক নিচু স্বরে বললো,
– তোমার কথা কিন্তু সবটা আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
– হ্যাঁ, আমার কথা তো মাথার উপর দিয়েই যাবে! আমি কি আর আশিক, যে কান দিয়ে আমার কথা মগজ পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তা খুঁজে পাবে!
নিশাত খাতার দিকে মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ খিচে বন্ধ করলো। পরক্ষণে চুপচাপ লিখালিখি করতে লাগলো। খাটে বসে পা নাচাতে নাচাতে নাফিসা তা স্পষ্ট লক্ষ্য করেছে। নিশাতকে এবার চুপ থাকতে দেখে নাফিসা বললো,
– কি, ভুল বললাম কিছু?
নিশাত কোনো জবাব দিলো না। নাফিসা এবার তার দুষ্টুমি ভঙ্গি ত্যাগ করে স্বাভাবিকভাবে বললো,
– নিজ থেকে কাউকে পছন্দ করা, অর্থাৎ জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রত্যাশা করা সম্পূর্ণ হারাম। সবার আগে তোমাকে মনে রাখতে হবে তুমি একজন মুসলিম কন্যা। আর কারো উপর এসব ক্রাশ ঘাস খাওয়া সম্পূর্ণ হারাম। তুমি কেবল তোমার প্রিয়জনকেই উঁকি মেরে দেখতে পারো, প্রিয়জনের উপর মুগ্ধ হতে পারো। এ সেই প্রিয়জন যার সাথে তোমার হালাল সম্পর্ক বিদ্যমান। সেখানে ইসলামসহ কেউই তোমাকে আর বাধা দিচ্ছে না, কারো অপছন্দও হচ্ছে না। যদিও আমরা অতটা পর্দা করে অভ্যস্ত নই কিন্তু হালাল হারাম বেছে চলতে ও শালীনতা বজায় রেখে ছোট ছোট পাপ থেকে মুক্তি পেতে তো সক্ষম? তাহলে হারাম দিকে কেন অগ্রসর হবো?
নিশাত চুপচাপ লিখছে। কখনো কলম থেমে যাচ্ছে আবার কখনো অতি দ্রুত চলছে। নাফিসা আবারও বললো,
– আমার কথা শুনতে নিশ্চয়ই ভালো লাগছে না তোমার, তবুও জানানো প্রয়োজন মনে করলাম। যদি পারো তো কথাগুলো একটু ইতিবাচকভাবে ভেবে দেখো। আমার মতে মেয়েদের ছোট থাকতেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে আর পর পুরুষের দিকে কারো নজর পড়তো না। সবাই তো আর ঝড়ের সময় খুটি আঁকড়ে ধরতে পারে না! আমিও ভেবে রেখেছি, ভবিষ্যতে আমার বাচ্চাকাদের ছোটকালেই ঘরোয়াভাবে বিয়ে দিয়ে দিবো। এরপর চুকিয়ে প্রেম কর, আর কোনো হারাম থাকবে না তোদের প্রেম!
নিশাত ফিক করে হেসে উঠে বললো,
– এমন হলে আর তোমার বাচ্চাকাচ্চা প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না কোনোভাবে! শুরুতেই সংসারে মজে যাবে। সেই প্রাচীনকালের মতো দেখবে ঘর ভরা তোমার নাতি-নাতনি!
– ধুর, আমি কি আর বিয়ের সাথে সাথেই সংসারে পাঠিয়ে দিবো নাকি! বিয়ে দিবো ছোটকালে আর শ্বশুর বাড়ি পাঠাবো উপযুক্ত বয়সে। ওই যে, স্কুলের নাম করে বয়ফ্রেন্ডের সাথে সিনেমা হলে চলে যাবে, সেই সুযোগ যেন না পায় তার জন্যই শুধুমাত্র বিয়ে দেওয়া হবে। নিজের সাধ্যমতো প্রতিষ্ঠিত করে তারপর যা, সংসার কর। বুঝো নাই?
– তাহলে তো আরও বেশি বেশি যাবে। যদি একই স্কুলের হয় তো ক্লাস রেখে বলবে, “চলো আজ সিনেমা হলে যাই, চলো আজ তেতুল তলায় আড্ডা দেই।”
– একেবারেই নাই বুদ্ধি! ক্যামনে দিচ্ছো এইচএসসি পরীক্ষা! আমি কি সমবয়সীর হাতে তুলে দিবো নাকি! মেয়ে পড়বে প্রাইমারি স্কুলে তো ছেলে হাইস্কুলে। মেয়ে হাইস্কুলে তো ছেলে কলেজে আর মেয়ে কলেজে তো ছেলে ভার্সিটিতে! তখন আর এতো ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। ছেলে বড় থাকলে নিজেকে একটু দায়িত্বশীল মনে করে পিচ্চি বউকে শাসন করবে, চোখে চোখে রাখবে।
“কে পিচ্চি বউ?”
হঠাৎ আগমন ঘটলো ইমরানের! নিশাত খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
– বাচ্চাকাচ্চা না আসতেই ভাবি এখনই বাচ্চাকাচ্চাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে!
ক্লিয়ার কিছু না বুঝতে পেরে ইমরান ব্রু হালকা কুচকে ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসলো আর নাফিসা তাকে দেখে বললো,
– তুমি চলে এসেছো! আমি তো কল করতাম!
ইমরানের দৃষ্টি তাৎক্ষণিক উজ্জ্বল হয়ে গেছে! চেহারায় একটা হাসিমাখা ভাব ফুটে উঠেছে। সে স্বাভাবিকভাবেই জিজ্ঞেস করলো,
– কেন?
– কবে থেকে বাইরের খাবার খাই না! আজ খেতে ইচ্ছে করছিলো। তাই পিয়াজু কিংবা সিঙ্গারা আনতে বলতাম।
ইমরান নিজের রুমে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– ঘরে তৈরি করে খাও। বাইরের খাবার অস্বাস্থ্যকর।
নাফিসা মেজাজ খারাপ করে তার পিছু পিছু হনহন করে যেতে যেতে বললো,
– ঘরে তৈরি করে খাওয়াবে কে? আপনি?
– আমি কেন খাওয়াবো!
– তবে?
– অবশ্যই তুমি।
– আমি এতো ঝামেলা করতে পারবো না। কিপ্টুস একটা, বললেই হয় পকেট খরচ করতে চান না!
– বলবো কেন এটা! ঘরে তৈরি করলে কি পকেট খরচ হবে না?
– লাগবে না খাওয়া। পেট এমনিতেই ভরে গেছে।
– মাগরিবের পর এনে দিবো।
– না, লাগবে না।
– এখন মাত্র এলাম, আবার যাবো!
– বললাম তো খাবোই না!
ইমরান শার্ট খুলে নাফিসার মুখের সামনে ধরে বললো,
– দেখো, আজ অনেক বেশি গন্ধ ছড়িয়েছে না?
নাফিসা পেছনে হেলে খপ করেই শার্ট হাতে নিয়ে বললো,
– হ্যাঁ, ছড়াবেই তো! আমি আছি না ধুয়ে দেওয়ার জন্য! প্রথম প্রথম কি ভাব, নিজের কাজ নিজেই করতে জানি! হুহ্! ঘোড়ার ডিম করতে জানে!
– আমার কি দোষ! বউ নিজেই তো আমাকে অলস বানিয়ে দিয়েছে!
নাফিসা লুঙ্গি এনে ইমরানের হাতে দিয়ে বললো,
– কথা কম বলেন, চেঞ্জ করেন দ্রুত। শার্ট ঘামে ভিজছে প্যান্ট কি আবার এসির নিচে ছিলো!
ইমরান দুষ্টুমির সাথে হেসে বললো,
– জান, গোসল করেছো নাকি এখন আমার সাথে করবে?
নাফিসার এতোক্ষণ খেয়ালই ছিলো না! আর এখন মনে হতেই সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
– চোর! আপনি আমার আইডি হ্যাক করছেন কেন?
– আমি কখন তোমার আইডি হ্যাক করলাম!
– তা না হলে জানলেন কিভাবে ওটা আমি ছিলাম! ঘরে বসে বসে আমার ফোন নিয়ে সারাক্ষণ তদারকি করেন আমি কি করছি না করছি!
ইমরান হেসে বললো,
– আমার তদারকি করা লাগে, বউ তো নিজেই বলে দেয় সব!
– আমি কখন বলছি আমার ওই আইডির কথা?
– নূর নাফিসার সাথে ম্যাচুয়াল দেখেই একটু সন্দেহ হয়েছিলো। পরে যখন নিশ্চিত হওয়ার জন্য কথায় তাল মেলালাম, তখনই অফিসের কথা জিজ্ঞেস করলে! অপরিচিত কেউ হলে তো আর এমন কিছু আন্দাজ করতে পারতো না যে আমি তখন অফিসে আছি কি নেই!
নাফিসা মনে মনে নিজেকে বোকা মেয়ে বলে বকা দিতে দিতে শার্ট-প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। ইমরান তার পথ আটকে বললো,
– মেসেঞ্জারে তুমি ছিলাম, নিশাতের রুমেও তুমি ছিলাম, এই রুমে আবার আপনি কেন হলাম?
– আপনাকে আপনি বলবো না তো কি বলবো!
– অবশ্যই তখনকার মতো তুমি বলবে।
– পারবো না। আপনি ই বলবো।
– উহু, জান। তুমি বলবে।
– না। আপনি বলবো।
– না, তুমি।
– সরুন তো! তা না হলে এগুলো ধুয়ে দিবো না।
– না, দাও। তবুও তুমি বলবে।
– না, আপনি।
– না, তুমি।
– না, আপনি।
– না, তুমি।
– না, আপনি।
– না, আপনি।
– না, তুমি।
ইমরান হাহাহোহো করে হেসে বললো,
– ওকে, এবার ঠিক আছে।
কথার প্যাচে পড়ে শেষ পর্যন্ত তুমিই বলে ফেললো নাফিসা! সাথে অটোমেটিক লজ্জা স্পষ্ট ধরা দিয়েছে তার মুখে! ইমরান এটা ইচ্ছে করেই করেছে। স্টুপিডটা বারবার তাকে প্যাচিয়ে দেয়! কি বলবে তা ভেবে না পেয়ে তার পেটে একটা মেরে নাফিসা হনহন করে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
– স্টুপিড! অফিসে বসে বসে কাজে ফাঁকি দিয়ে অনলাইনে টাইম নষ্ট করে! দাঁড়ান, ভাইয়ার কাছে বিচার দিবো। ফাকিবাজের বিরুদ্ধে যাতে কঠিন ব্যবস্থা নিতে পারে সেই আবেদন করা প্রয়োজন বসের কাছে।
হাতমুখ ধোয়ার জন্য ইমরান তার পিছু পিছু যেতে যেতে বললো,
– ভাইয়ার কাছে বিচার দেওয়া কি প্রয়োজন! তুমি নিজেই আবেদন করো বসের কাছে।
– আমি অফিস থাকলে ঠিকই করতাম! হুহ্! এমন অনৈতিক কাজ আমার সামনে, ইম্পসিবল!
– মেডাম, অনৈতিকের কিছু নেই এখানে। যখন আমার কাজ থাকবে, তখন সম্পাদন করে দিতে পারলেই হয়। বাকিটা ফ্রী টাইম। সেটাও নষ্ট করি না। আউটসোর্সিং-এ ব্যয় করি।
– আপনি ফ্রিল্যান্সিং জব করেন?
– করি তো মাঝে মাঝে।
– আমারও খুব ইচ্ছে শিখার।
– কিছুদিন পর কম্পিউটার আনবো, তখন শেখো।
– ওই ঘরে না একটা আছে।
– ভাইয়ার টা? ওটা নষ্ট। ঢাকঢোল পিটিয়ে, আছাড় মেরে, হিসু করে আরও একবছর আগেই জিহান একেবারে শেষ করে দিছে! এখন ওটা বিক্রি করে পাপন ভাজা খেতে পারবে।
নাফিসা হাসতে হাসতে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। এতোক্ষণে ইমরান হাতমুখ ধুয়ে নিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
– নাফিসা, আউটসাইড রিলেশন নিয়ে তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে নাফিসা তার দিকে এক পলক তাকালো। কিন্তু কিছু বললো না। ইমরান জবাব না পেয়ে আবার বললো,
– আমার সব বিষয়ে কিন্তু জানার অধিকার আছে তোমার আর আমিও স্পেশালি কিছু গোপন রাখতে চাইনা। তোমার এরকম কোনো সন্দেহ থাকলে জিজ্ঞাসা করে ক্লিয়ার করে নিতে পারো। সন্দেহের বশে সংসার টিকে না, সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন হয় বিশ্বাসের।
নাফিসা কাপড় কাচতে কাচতে বললো,
– আমি তখন ফান করার জন্য মেসেজ দিয়েছিলাম। সন্দেহের বশে না।
– না, ওটা বাদেও আমি নরমাল সিচুয়েশনের কথা বলছি।
– না, করি না সন্দেহ।
– বউ…. ভালোবাসি।
কথাটা বলার পর ইমরান দশ সেকেন্ডের বেশি অপেক্ষা করেনি এখানে। কেননা সে বুঝতে পেরেছে নাফিসা লজ্জা পেয়েছে। তাই তাকায়ও নি একবার তার দিকে! এদিকে ইমরান চলে যাওয়ার পর নাফিসার ঠোঁটের কোনায় লজ্জাময়ী হাসির রেখা স্পষ্ট হলো! আর সাথে মনোক্তি,
“নির্দিষ্ট কোনো সময়, সুযোগ, স্থান নেই তার! যখন তখন ভালোবাসা প্রকাশ করে ফেলে! অবশেষে আজ বাথরুমটাও বাদ রাখলো না! বাথরুমে এসে কেউ ভালোবাসা প্রকাশ করে! আর ভালোবাসিস সেটা বারবার ঢাকঢোল পিটানোর কি আছে! আস্ত একটা গাধা ইমরাইন্নার বাচ্চা! হিহিহি…!”
চলবে।