“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৮
(নূর নাফিসা)
.
.
মাগরিবের নামাজ পড়ে ইমরান পাঁচটা সিঙ্গারা ও হাফ কেজি পিয়াজু নিয়ে এসেছে। জন প্রতি একটা করে সিঙ্গারা খেলেও পিয়াজু নিলো না তারা। নাফিসার জোরাজুরিতে বড়মা একটা মুখে দিয়েছে, আবিদা বেগম নিলোই না। নাফিসাও তাকে জোরাজুরি করলো না। ইমরানকে বললে ইমরান বললো,
– উহুম, তুমিই খাও!
নাফিসা ভেঙচি কেটে বলে গেলো,
– হুহ্! এজন্যই সাধি না কাউকে। বাঙালির বদ অভ্যাস, সাধলে দাম দেখায়। আর মনে মনে পোষে “আরেকবার সাধিলে খাবো!”
ইমরান হেসে উঠলো তার কথায়। এবং বললো,
– আরেকবার সাধিলেও খাবো না। তুমিই খাও আর খাওয়াদাওয়ার পর পড়তে বসো।
নাফিসা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। নিশাতের রুমের দরজার কাছে গিয়ে আবার ফিরে এলো। ইমরান পড়তে বসেছিলো। আর পড়ার মাঝেই নাফিসা ঠেলে তার মুখে একটা পিয়াজু দিয়ে বললো,
– না দিয়ে খেলে আবার আমার পেট ব্যাথা করবে। তাই আমি আগে থেকেই সাবধান।
নাফিসা আবার নিশাতের রুমে চলে গেলো। দুজন গল্পগুজব করতে করতে পিয়াজু খাচ্ছে। নিশাতের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থাকায় বেশি খায়নি কিন্তু নাফিসা সবটা ফিনিশ করেছে একাই! অত:পর ইমরানের ডাক পড়লে ঢেকুর তুলতে তুলতে রুমে এলো।
– কি?
– এতোক্ষণ লাগে খেতে! ইশার আযান পড়ে যাবে এবার। এখনো বই হাতে নাওনি! পড়াশোনায় এতোটা অমনোযোগী হয়ে গেছো কেন তুমি!
– কই, অমনোযোগী?
– এ মাসে ভার্সিটিতে ক’দিন ক্লাস করেছো?
– এ অবস্থায় ক্লাস করতাম কিভাবে!
– আমি তো অফিস জয়েন করেছি সেই কবে থেকে! আর আমার অসুস্থতার অযুহাতে তোমার ভার্সিটি মিস!
– এহ, অযুহাত বলবেন না একদম! আপনার জন্য আমি আমার বাপের বাড়ি পর্যন্ত যাইনি! আর গত সপ্তাহে তো ভার্সিটি অফ ছিলো!
– আচ্ছা, সময় অনেক নষ্ট হয়েছে। সব দোষ আমারই, এখন তুমি একটু মনযোগী হয়ে পড়তে বসো।
– আমি বাড়ি যাবো।
– এখন!
– এখন আর তখন কি! যেখানে নতুন বউ ঘনঘন বাপের বাড়ি বেড়াতে যায় সেখানে আমি মাত্র একবার গিয়েছি! এতোদিন পর আবার বলছি যাবো আর তখন আপনার এখন আর তখন বেরিয়ে গেলো!
– তাই বলে এখন রাতের বেলা যাবে!
– আমি রাতের কথা বলেছি! এজন্যই বেশি জ্ঞানী লোক দেখতে পারি না! অযথা দু’লাইন বেশি বুঝে!
ইমরান শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো। নাফিসার মোটেও পছন্দ হলো না তার হাসি! সে গোমড়া মুখু হয়ে বললো,
– কাল যাবো?
– শুক্রবার তো বাবা-মা ই আসবে। তো কাল গিয়ে তুমি কি করবে?
– ওহ্! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম! তাহলে বাবামায়ের সাথে সেদিনই চলে যাবো। ওকে?
– হুম, সে তোমার বলার আগেই জানি। বাবা-মা এলে আর তোমার মন টিকবে নাকি!
– হুম, টিকবে না মন। এবার তাহলে কনফার্ম যাবো। হুম? কি হলো, বলুন?
– আমি নিষেধ করলে যাবে না?
নাফিসা কিছু বললো না। শুধু আহ্লাদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। ইমরান মুচকি হেসে নিজের পড়া দেখতে দেখতে বললো,
– পড়তে বসো আগে।
নাফিসা বই নিয়ে নিশাতের রুমে যেতে লাগলে ইমরান বললো,
– এই, এদিকে এসো। এখানে পড়তে বসো। দুইজন একসাথে হলে কারোই পড়া হবে না। নিশাতের পরীক্ষা চলছে। তারও ক্ষতি তোমারও ক্ষতি!
রাতে আর ভাত খায়নি নাফিসা। সিঙ্গারা আর পিয়াজু খেয়ে তার পেট ভরে গেছে। আর ঘুমাতে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর শুরু হয়েছে ডাইরেক্ট একশান! প্রথমে পেট ব্যাথায় ছটফট আর কান্নাকাটি! পরক্ষণে রুম থেকে বাথরুম দৌড়াদৌড়ি! ইমরান বললো,
– পিয়াজু কি সব একাই খেয়েছো তুমি?
– একা কোথায় খেলাম! আপনাকে দেইনি? নিশাতকে দেইনি?
– আর বাকিগুলো?
– আমি।
– আগে আরও হয়েছে এমন?
নাফিসা ভিজাবিড়াল ন্যায় স্বরে বললো,
– সবসময়ই হয়!
ইমরানের চেহারায় এবার রাগ স্পষ্ট!
– সবসময় হয় তো জেনেশুনে রাক্ষসের মতো খেলে কেন সব!
– আমি রাক্ষস? আপনি রাক্ষস, আপনার চৌদ্দগোষ্ঠী রাক্ষস।
– তাহলে আমার চৌদ্দগোষ্ঠীর কিছু হলো না কেন?
– আমি কি জানি!
– তো আমিও জানি না কিছু। গুড নাইট।
– বেড নাইট…
ইমরান লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। আর নাফিসা পেট চেপে রেখে বসে বসে কান্না করছে! একটু পর আবারও পেটে মোচড় পড়লো! নাফিসা লাইট জ্বালিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য নেমেছে বিছানা ছেড়ে। কিন্তু দরজা খুলে একা যাওয়ার সাহস হচ্ছে না! এদিকে ইমরান চোখ বুজে থাকলেও ঘুমায়নি। পাশে বসে কেউ এমন ছটফট করলে কি ঘুমানো যায়! নাফিসা এসে আবার ইমরানকে ঠেলতে লাগলো।
– এই, শুনছেন?
ইমরান তার হাত সরিয়ে দিলো। নাফিসা বুঝতে পেরেছে সে ঘুমায়নি। আবারও একবার ঠেলে বললো,
– আমি বাইরে যাবো।
ইমরান এবারও কথা কানে নিলো না। নাফিসা এবার রেগে গিয়ে বললো,
– বউ ভালোবাসি? এই তোর ভালোবাসা? আমি কেদে মরি আর তুই শান্তিতে ঘুমাস! বাইরে গিয়ে এখন ভয় পেয়ে যদি স্ট্রোক করি তো তুই দায়ী থাকবি বলে দিলাম!
এবার আর অপেক্ষা না করে নাফিসা হনহন করে বেরিয়ে গেলো। ইমরান চোখ খুলে তাকিয়ে ছিলো তার যাওয়ার দিকে। আর কিছু জানুক আর না জানুক, জেদটা ঠিকই খুব ভালো দেখাতে জানে! ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে ইমরান বাইরে এসে দাড়ালো। নাফিসা বেরিয়ে এসে তাকে বারান্দায় দেখতে পেল। সে গোমড়া মুখু হয়ে নিশাতের রুমের দিকে এসে দেখলো দরজায় তালা ঝুলছে। পরক্ষণে মনে হলো নিশাত আজ বড়ঘরে আছে। সে আবার নিজের রুমে চলে এলো। ইমরান রুমে এসে গেইটের চাবি ও ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,
– তুমি বসো, আমি আসছি।
ইমরান বেরিয়ে গেলে নাফিসার ভয় করতে লাগলো! এই ঘরে এখন সে একা। চোর ডাকাত এসে যদি হামলা করে তো সে নিশ্চিত এই প্রথম হার্ট অ্যাটাক করবে! তাই সে দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিলো। ইমরান নিশাতকে কল করে বড় ঘরের গেইট খুলতে বললো। লবন আর গুড় নিয়ে আবার গেইট লাগিয়ে দিতে বললো। নিজের ঘরে এসে দেখে দরজা বন্ধ! সে নাফিসার নাম ধরে ডাকতেই নাফিসা আচমকা কেপে উঠলো। ইমরানের গলা শুনে সে দরজা খুললো। ইমরান চুপচাপ ঘরে এসে স্যালাইন তৈরি করে নাফিসার হাতে দিলো। কিন্তু নাফিসা যে এটা গলা দিয়ে নামাতে পারবে না! গুড় দেখলেই তার গা গুলিয়ে আসে। ইমরান বললো,
– এভাবে বসে আছো কেন? তারাতাড়ি গিলে ফেলো।
– আমি এটা খেতে পারবো না।
– না খেলে সুস্থ হবে? তারাতাড়ি খাও।
– সম্ভব না। মিঠাই খাই না।
– এছাড়া তো এখন কোনো উপায়ও নেই। এতো রাতে দোকান খোলা আছে নাকি! চেষ্টা কর খাওয়ার।
– পারবো না।
– এখন কিন্তু মাইর খাবে!
– তবুও সম্ভব না!
– নাক চিপে ধরে তারপর খাও।
নাফিসা তার কথায় নাক চিপে ধরে তারপর মুখের সামনে নিয়ে গেলো। কিন্তু মুখে নেওয়ার আগেই বারবার নাক ছেড়ে দিচ্ছে! ইমরানের আর সহ্য হচ্ছে না তার ন্যাকামো! তাই সে নিজেই জোরে নাক চেপে ধরে বললো, “তারাতাড়ি সবটা গিলে ফেলো, নয়তো নাক ছাড়বো না। এরপর দম আটকে ইন্না-লিল্লাহ!”
জবরদস্তিতে এবার ঢকঢক করে গিলতে বাধ্য নাফিসা! নাক ছেড়ে দেওয়ার পর আয়নার সামনে এসে দেখলো তার নাক টকটকে লাল হয়ে আছে! রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালে ইমরান বললো,
– পাউডার আছে না, মেখে দাও। সাদা হয়ে যাবে।
সারারাত কাটলো তার ছটফটিয়ে! নিজেও ঘুমায়নি, ইমরানকেও ঘুমাতে দেয়নি! তবে একটা জিনিস খুব ভালো লক্ষ্য করেছে, সে নিজে রাগ দেখালেও ইমরান তার প্রতি একটুও বিরক্ত হয়নি। বরং তাকে একটু শান্তিতে রাখার চেষ্টা করেছে। নির্ঘুম রাত পার করেছে। নিজে দোয়াদরুদ পড়ে নাফিসাকেও পড়িয়েছে। অবশেষে শেষ রাতে নাফিসা একটু শান্ত হয়েছে। আর তখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো ইমরানের বুকে। ইমরানেরও চোখ জোড়ায় ঘুম নেমে এসেছিলো মাত্র। আর এমনিতেই আযান পড়ে গেছে! তার আর ঘুম হলো না। কিন্তু সকাল আটটা পর্যন্ত নাফিসা ঘুমিয়েছে। ঘুম ভাঙতেই ইমরান বললো,
– উঠে নাস্তা করো৷ তারপর এই ট্যাবলেটটা খেয়ে নাও।
– ঘুমাও নি?
তুমি করে বলাতে ইমরান তার দিকে একবার তাকালো কিন্তু কিছু না বলে আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নাফিসা গোসল সেড়ে এসে দেখলো ইমরান নাস্তা করে অফিসের জন্য তৈরি। আজ নিজের কাপড়চোপড় নিজেই ধুয়ে রেখেছিলো।
হাফ ডে হওয়াতে দুপুরে বাসায় ফিরেছে ইমরান। সারাটাদিন আজ তার ঘুম ঘুম পাচ্ছে! তাই দুপুরে খাওয়ার পরই ঘুমিয়ে পড়েছে। নাফিসারও ভালো লাগছিলো না কিছু। রুমে এসে দেখলো ইমরান ঘুমাচ্ছে। সে-ও ঘুমানোর চিন্তা করলো। তাই দরজা লাগিয়ে এসে ইমরানের কাছে এসে বসলো। অন্য দিনের তুলনায় লোকটাকে আজ একটু বেশিই ভালো লাগছে। সারারাত ঘুমায়নি, এখন বিরক্ত না করাই ভালো। তা ভেবে আর তার বুকে মাথা রাখলো না। কিন্তু কপালে আলতো পরশ দিতে ইচ্ছে হলে তা পূরণ করে ফেললো। আর অমনি ইমরান তাকে জড়িয়ে ফেললো বাহুডোরে। যদিও একটু আগে এসে শুয়েছে কিন্তু দেখে মনে হয়েছিলো গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে! এ তো বড্ড পাজি! তা ভেবে নাফিসা হেসে উঠলো! আর বললো,
– ঘুমাওনি এখনো!
ইমরান চোখ বন্ধ রেখেই জবাব দিলো,
– উহুম, ঘুমাবো৷
সারা দুপুর ঘুমিয়ে বিকেলে ঘুম ভাঙলো চেচামেচিতে! জিহান ফিরে এসেছে বাড়িতে। আর উঠুনে খেলায় নেমে গেছে পাশের বাড়ির সঙ্গীর সাথে। আর জেরিন চেচিয়ে ডাকছে যাতে ময়লা না ধরে! বাড়ির ছেলে বাড়িতে ফেরায় ফাঁকা বাড়িটা এবার পূর্ণ হলো৷ একদিকে ভালো লাগলেও অন্যদিকে বিরক্তিকর! ইমরান আড়মোড়া ভেঙে উঠে চলে গেলো। আর নাফিসা উঠে বসে মনে মনে বললো,
“নাইওর শেষে এসে গেছে আবার অশান্তি! আয়, তো কি হয়েছে! আমিও চলে যাবো কিছুদিনের জন্য। এরপর দেখি, তোকে শুধরানোর কোনো ব্যবস্থা করা যায় কিনা! হুহ্!”
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৭৯
(নূর নাফিসা)
.
.
শুক্রবার নাজিয়া ও নাহিদার পরিবারসহ সবাই এসেছে ইমরানের বাড়িতে। বিয়ের পর নাফিসার বাড়িতে দাওয়াত করা হলেও ইমরানের বাড়িতে আজ প্রথম। আরও আগেই হতো এই আয়োজনটা কিন্তু ইমরানের এক্সিডেন্টের জন্য স্থগিত ছিলো। এদিকে আয়াতসহ ইমরানের মামার বাড়ি থেকেও লোকজন এসেছে। ঘরোয়া ভাবে মোটামুটি বড়সড়ই এক আয়োজন হলো। সেই সুবাদে একে অপরের সাথে দেখা হলো, সাক্ষাৎ হলো। বেশ ভালোই লাগলো সবার।
নাহিদার পরিবারের বাকি সদস্য এলেও মেহেদীকে দেখা গেলো না! ইমরান নাহিদাকে জিজ্ঞেস করলে জানালো মেহেদীর জরুরী কাজ আছে তাই আসতে পারেনি। ওদিকে তুর্য এসেও একই কথা জিজ্ঞেস করলো,
– মেহেদী আসেনি, ভাবি?
– না, ভাইয়া। ওর একটু জরুরি কাজ আছে অফিসে। তাই আসতে পারেনি।
– আমিতো আসার সময় তাকে রিকশা করে বাড়ির দিকে যেতে দেখলাম।
– প্রয়োজনে গেছে হয়তো।
শেষ কথাটা একটু চিন্তিত ভাব প্রকাশ করলো নাহিদা। তুর্যের চোখে ধরা না পড়লেও ইমরানের চোখে ধরা পড়েছে সেটা। আর নাহিদা মনে মনে ভাবছে, “তার তো এসময় অফিসই থাকার কথা। তাহলে বাড়ির দিকে যাবে কেন! তাহলে কি এখানে না আসার জন্য মিথ্যে বলেছে সে! আসবে না-ই বা কেন! আশিকের জন্য?”
নানান কথা ঘুরপাক খেলেও সে মা বোনদের সাথে মিশে তা ভুলে গিয়েছিলো। প্রায় অনেকদিন পর সবাই একসাথে হয়েছে। তাই ওসব ভাবনা একপাশে ফেলে বর্তমান মুহুর্তটা উৎফুল্লতার সাথেই উপভোগ করলো। দুপুরে খাওয়ার পর যখন নাজিয়ার সাথে কথা বলছিলো তখন মেহেদীর ফোন এলো। নাহিদা রিসিভ করে সালাম দিতেই মেহেদী সালামের জবাব দিয়ে বললো,
– তোমার বোরকার সাইজ কত?
বোরকার কথা জিজ্ঞেস করাতে নাহিদা একটু অবাকই হলো। কিন্তু নাজিয়া পাশে থাকায় অতিরিক্ত কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সে-ও স্বাভাবিকভাবে বলে দিলো, “৫৪”
“ওকে”
জানার পর আবার মেহেদী সাথে সাথেই কল কেটে দিলো।
বাকি মেহমানদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে ইমরান, আশিক প্লেট নিয়ে নিশাতের রুম ফাঁকা পেয়ে সেখানেই চলে এসেছে। নাফিসা তার আপুদের সাথে খেতে বাধ্য হয়েছিলো। আর আপ্যায়ন করতে করতে অবশেষে বাকি এই দুইজন। তাদের আপ্যায়নে এবার নেমেছে নাফিসা। সাথে হেল্প নিয়েছে নিশাতের। আজ জেরিন একটু দূরেই আছে। নিজের বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে সে ব্যস্ত। ইমরানের প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে গেলে ইমরান অল্প দিতে বললো। কেননা, সে বাকিদের খাওয়ানোর সময় টুকটাক খেতে খেতে পেট এখন অর্ধেক ভরা ই আছে।
আশিকেরও একই উক্তি। কিন্তু নাফিসা ইচ্ছে করে একটু বেশি দিয়েই বললো,
– আরে খান ভাইয়া। অভ্যাস করতে হবে তো। নতুবা পরবর্তীতে ঠিকমতো জামাই আদর পাবেন না বলে দিলাম!
ইমরান ও আশিক উভয়ের দৃষ্টিই নাফিসার দিকে! আর নাফিসার মুখে দুষ্টুমি হাসি! এদিকে নিশাত পানির জগ রেখে দাড়িয়ে ছিলো, আর এখন নাফিসার কথা শুনে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে! তারা দুইভাই একে তো নাফিসার কথা কিছুই বুঝতে পারেনি, এখন আবার নিশাতের যাওয়ার দিকেও একটু অবাক হয়ে তাকালো! কিছু কিছু সন্দেহজনক আবার কিছু কিছু গোলমাল! নাফিসা বললো,
– ওইদিকে কি দেখেন? খাবার তো প্লেটে! এদিকে তাকিয়ে খান। আমি লেবু শসা নিয়ে আসছি।
আশিকের মুখভঙ্গিতে একটু চিন্তিত ভাব দেখতে পেল নাফিসা। আর ইমরান তাকে চোখে ইশারা করে জানতে চাইলো। নাফিসা বেরিয়ে যেতে যেতে ঠোঁট নাড়িয়ে ইশারা করলো পরে বলবে।
দুজনেই অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করতে করতে খাওয়া শেষ করে নিলো।
বিকেলের দিকে সবাই যার যার বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। ইমরান তার মামার বাড়ির লোকজনকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো। আয়াতও চলে গেছে। আর বাকিরাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। নাফিসা তার মাকে বেশ কয়েকবার বলেছে তাকে যেনো আজ নিয়ে যায়। এখনো বড়মার সাথে কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করলে রুমানা বেগম বললো,
– আমার কাছে এসে যাবো যাবো বললেই কি নিয়ে যেতে পারবো আমি? এ পরিবারের কারো কাছে কি একবার পারমিশন চেয়েছিস?
নাফিসা বড়মার দিকে আহ্লাদী সুরে বললো,
– বড়মা, যাবো না?
– যাবি না কেন। যা, থেকে আয়। নিষেধ করবে না কেউ।
এবার তার মাকে বললো,
– শুনেছো তো এবার?
– তবুও সব কিছুর একটা নীতি আছে, নাফিসা। সবসময় নিজের মর্জিতে সব হয় না। তাই বলেছি। বেয়াইনের কাছে বল, ইমরানের কাছে বল। ইমরান যেতে চাইলে এরপর গিয়ে রেডি হ…
নাফিসা আবিদা বেগমের কাছে এসে দেখলো মাত্র আসরের নামাজ পড়ে উঠলেন। আর আয়েশা বেগম নামাজ পড়ছে। সে দরজার কাছে দাড়িয়েই বললো,
– আম্মা, আজ বাবামায়ের সাথে বাসায় যেতে চাইছিলাম। বড়মা বলেছে যেতে। আপনি কি বলেন, যাবো?
– যাও। শুক্রবারের আগে আগে আইসা পইড়ো। দাওয়াত আছে।
– ওকে।
নাফিসা এবার খুশিমনে তাদের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। উঠুনের একপাশে চেয়ারে বসে আছে আরমান, আরাফ, নিশাত, নাজিয়া এবং নাহিদা। আর ইমরান, জিহান ও আশিক মাত্রই রাস্তার দিক থেকে বাসায় প্রবেশ করেছে। হাতে স্পিড ও সেভেন-আপ। নাফিসা ইমরানকে বললো,
– এদিকে এসো তো একটু।
– কেন?
– প্রয়োজন আছে বলেই তো বললাম!
ইমরান আশিকের হাতে বোতল দিয়ে আসতে যাবে এমনি নাফিসা বললো,
– এই দাড়ান দাড়ান দাড়ান….
বলতে বলতে ইমরানের হাত টেনে আবার আশিকের সাথে দাঁঁড় করিয়ে করিয়ে উচ্চতা মেপে বললো,
– এল্লা! বাট্টু! হিহিহি….
নাফিসা হাসতে হাসতে আবার তার ঘরের দিকে চলে গেলো। ওদিকে আশিক বুঝতে পেরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো! আর ইমরান আশিককে তাড়া করে ঘরে চলে এলো। নাফিসা এখনো হাসছে! ইমরান তাকে কাছে টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে বললো,
– কোথায় বাট্টু? দেখোতো…. তোমার থেকে সাড়ে চার ইঞ্চি লম্বা আছি। আর দেড় ইঞ্চি হলে ছয় ফুট হতাম!
– দেড় ইঞ্চি আর হাফ ইঞ্চি। নিজের ছোটভাই থেকে তো বাট্টুই তাই না?
– মাত্র দুই ইঞ্চি শর্ট।
– হিহিহি… দুই ইঞ্চি মাত্র হয়! তাছাড়া শর্ট তো শর্ট ই!
– এই, ভালো কথা। তখন তুমি আশিককে ওটা কি বললে? জামাই আদর মানে?
– এতো কিছু বুঝতে হয় না। বেশি বুঝলে জ্ঞানী লোকের আবার জ্ঞান কমে যাবে!
– কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। আমি কিন্তু সিরিয়াস হয়ে জানতে চাইছি।
– নিশাত আশিক ভাইয়াকে পছন্দ করে।
– কে বলেছে এই কথা?
– কাউকে বলতে হবে কেন। আমি কি দেখে বুঝি না কিছু!
– কি ভাবছো এসব! মোটেও এমন কিছু না। আমাদের কাজিনদের মধ্যে খুব ভালো রিলেশন। আলতু ফালতু টাইপ কিছু নেই।
– হ্যাঁ, ভালো রিলেশন বলেই তো জেরিন পড়ে আছে তোমার পিছে। তাই না?
ইমরানের মুখটা সাথে সাথেই ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! তার মনেই ছিলো না জেরিনের কথা! তবুও বললো,
– জেরিন যেমন তেমন, নিশাত কিন্তু এমন না। আর না আশিক। তুমি ভুল ভাবছো।
– আশিক এমন কিনা সেটা আমি শিওর না। আর জেরিনের সাথে নিশাতের তুলনাও করছি না। তবে এটা সত্যি, আশিক ভাইয়া পছন্দ না করলেও নিশাত পছন্দ করে। ধরা পড়েছে আমার চোখে। এ নিয়ে কথাও হয়েছে তার সাথে।
– কি কথা হয়েছে? নিশাত বলেছে সে পছন্দ করে?
– না। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু সে কোনো স্পষ্ট জবাব দেয়নি। নিরব ছিলো। আর জানো তো, মাঝে মাঝে নিরবতাই সব জবাব দিয়ে দেয়!
– ছোট হলেও আশিক আমার সাথে সব বিষয়ে ফ্রি। এরকম কিছু আমি তার মাঝে আদৌও দেখিনি।
– বোকার মতো কথা বললে না? তোমার বোনকে যদি পছন্দ করেও থাকে তাহলে কি সেটা তোমার কাছে এসে সরাসরি বলে দিবে? আর এসব কিছু আবার জিজ্ঞেস করতে যেওনা নিশাতকে। ভাই হোক আর যে-ই হোক, একটা মেয়ে একটা মেয়ের সাথে যতটা ইজি হয়ে কথা বলতে পারবে একটা ছেলের সাথে তেমন ভাবে কথা বলতে পারবে না। আমার কাছেই চাপা রেখেছে আর তোমার কাছে মোটেও বলবে না। আর যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলো তাহলে হয়তো সেও ভয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে। তার বর্তমান বয়সটাই আবেগের। আবেগের বশেই এমন ভালো লাগা কাজ করছে। আবার আবেগের বশেই হয়তো উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে। তাছাড়া তোমাদের দুইভাইকেই যথেষ্ট সম্মান করে। তোমার বোনটা কিছুটা ভীতুও বটে। তার উপর চাপা স্বভাবের। তাই একটু নরমালই থেকো।
– যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তো কথা বলে মিটমাট করতে হবে না? আগে থেকে ব্যবস্থা না নিলে তো আরও বেশি খারাপ পথে এগিয়ে যেতে পারে!
– ভুল বলনি, কিন্তু তোমার কাছে বলবে না তো সবটা। দেখি, সুযোগ পেয়ে না হয় আমি আবার জিজ্ঞেস করবো। নতুবা বড়মার সাহায্য নিবো। পরীক্ষাটা শেষ হোক। এখন ওসব কথা তুলো না।
ইমরান ছোটখাটো নিশ্বাস ফেলে বললো,
– ওকে।
– যে জন্য ডেকেছিলাম। বাসায় যাবো না?
– আমি না বললে যাবে না?
ইমরান আবারও একই কথা বললো তাই নাফিসার রাগ হলো! তাই সে কড়া কণ্ঠে বললো,
– এখন যাবো কি-না, সেটা বলুন?
– যাও।
নাফিসা তার পেটে কনুই দিয়ে মেরে বললো,
– তাহলে এবার শুনুন মিস্টার, আপনি না বললেও যেতাম। হিহিহি…
নাফিসা আলমারি খুলে জামাকাপড় নিতে লাগলো। ইমরান নিজের পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
– সত্যি তো?
– উহুম।
– হাহাহা, জানি মিসেস। নূর, আমার পেটটা কি ইদানীং বড় হয়ে গেছে?
– জানি না।
– না, সত্যিই। দেখো তো। সকালে ওজন মেপেছিলাম। এক কেজি বেড়ে গেছি!
– আসুন, তবে মাথা কেটে ফেলে দেই। দশ কেজি কমে যাবেন।
– দাও…
– রেডি হও। সন্ধ্যার আগেই বের হবো।
– আমি যাবো না তো।
নাফিসা একটু বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালে ইমরান বললো,
– এভাবে তাকাও কেন? অফিস যেতে হবে না? যতদিন ইচ্ছে তুমি থেকে এসো। যখন চলে আসবে তখন না হয় আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।
– তাহলে সেটা বাবা-মাকে বলে এসো। আমি কারও কাছে কোনো জবাবদিহি করতে পারবো না।
নাফিসা ইমরানের জামাকাপড় আবার রেখে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিলো।
নিয়াজ উদ্দিন, আলফাজ সাহেব ও জহিরুল ইসলাম ঘুরতে বেরিয়েছিলো বিকেলের শুরুতে। এখন সন্ধ্যায় তারা ফিরে এলে মেহেরুন জহিরুল ইসলামের সাথে রাগারাগি শুরু করলো। নাহিদার এই অবস্থার জন্য তিনি সন্ধ্যার আগেই ফিরতে চেয়েছিলান। তা আর হলো না জহিরুল ইসলামের জন্য! পরক্ষণে সন্ধ্যার পরই সবাইকে যেতে হলো। প্রথমে নাহিদা, তারপর নাজিয়া, এরপর নাফিসা। দুপুরের কোলাহল পূর্ণ বাড়ি এখন শান্ত! শুধু জিহানের চেচামেচিতেই যতটুকু অশান্ত হওয়ার কথা, ততটুকুই। সবাই চলে গেলেও ইমরান জোর করে আশিককে রেখে দিয়েছে আজ।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮০
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফিরে মেহেদীকে পেল না। ফ্ল্যাটের তালা খুলে জহিরুল ইসলাম মেহেদীকে কল করলে মেহেদী বললো সে বাসায় আসছে। নাহিদা রুমে এসে দেখলো খাটে শপিং ব্যাগ রাখা আছে। প্যাকেট একটু ফাক করে কাপড় দেখতে পেল। অত:পর চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে তারপর প্যাকেট খুললো। একটাতে টিশার্ট, আরেকটাতে প্যান্ট এবং আরেকটায় বোরকা! নাহিদা বোরকাটা খুলে দেখলো স্টোনের হালকা কাজ করা। দেখতে খুবই সুন্দর। মাত্রই মেহেদী রুমে এসেছে। নাহিদাকে বোরকা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে দেখে বললো,
– পড়ে দেখো তো, ঠিক আছে কি-না!
নাহিদা তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কখন এসেছো বাসায়?
– তোমরা যাওয়ার সময় বের হওয়ার পর এগারোটার দিকে এসেছিলাম। গোসল করে আবার বেরিয়েছি যোহরের নামাজ পড়ে ফিরেছি। সারা দুপুর ঘুমিয়ে আসরের পর আবার বেরিয়েছি।
– সারাদিন তো বাসায়ই কাটালে। কোনো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ তো দেখলাম না। তাহলে গেলে না কেন? আশিকের জন্য?
মেহেদী ঘড়ি খুলতে খুলতে বললো,
– এমন কিছু হলে তোমাকেও যেতে দিতাম না।
– এ ছাড়া তো আমি অন্য কোনো কারণ দেখছি না! এখনো কি বিশ্বাস করতে পারছো না আমাকে?
– অযথা রেগে যাচ্ছো কেন! বলেছি তো ইম্পর্ট্যান্ট কাজ ছিলো।
– কোথায় তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ? সারাদিন ঘুমিয়েছো আর শপিং করেছো এটাই তোমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ?
নাহিদার গলার স্বর আস্তে আস্তে বেড়ে গেছে, সাথে চোখে অশ্রু এসে ভীড় জমিয়েছে। সে রাগলেও মেহেদী একটুও রাগ দেখালো না। কারণ সে জানে বর্তমান অবস্থার কারণে নাহিদার মেজাজ এখন একটু খিটখিটে হয়ে গেছে। মেহেদী শান্তভাবে তার পাশে এসে তার বাহু ধরে বললো,
– সত্যিই কাজ ছিলো। তা না হলে কি আব্বু জোর করতো না আমাকে তোমাদের সাথে যাওয়ার জন্য? সাড়ে দশটার দিকে এক লোকের সাথে দেখা করার কথা ছিলো। অফিস থেকে লোন নিয়েছিলো, আজ পরিশোধ করবে বলেছে। তাই অফডে হওয়া সত্ত্বেও যেতে হয়েছে অফিস। আমি অফিস যাওয়ার পর কল করে বললো তার একটু সমস্যা, এখন আসতে পারবে না। তাই বিকেলে আসবে। এরপর লোকের আসতে আসতে সন্ধ্যা! এই মাত্র চেক নিয়ে এলাম। বিশ্বাস না হলে এই যে দেখো..
মেহেদী পকেট থেকে চেক বের করে দেখালো। নাহিদা বললো,
– তো, এটা পরে দেওয়া যেতো না! আর বিকেলে আসবে যেহেতু তুমি দুপুরে যেতে পারলে না কেন?
– এটা লক্ষাধিক টাকার ব্যাপার। ডেট ঘোরাতে ঘোরাতে আজ দিবে বলেছে৷ তাই প্রাধান্য দিতে হয়েছে। আর তোমরা চলে গেছো সেখানে আমি একা যাই কিভাবে। তাই আর যাইনি। তাছাড়া এই যে, এসেছো সন্ধ্যায়। লোকের কথার নেই স্টেশন! আমি যেতাম কল করলে আবার তারাহুরো করে চলে আসতাম এটা কি ভালো দেখাতো!
নাহিদা চোখ মুছতে মুছতে বললো,
– দুপুরে খেয়েছো কিছু?
– এতোক্ষণে না লাইনে এলে। একটা কেক খেয়ে ঘুম দিয়েছিলাম। আর কিছু না।
– কেন, রেস্টুরেন্ট ছিলো না? দিনদিন খাওয়া একদম ভুলে গেছে! আগে তো তিনবেলা রেস্টুরেন্ট টাকা ফেলা হতো। আর এখন প্রয়োজনেও কেন নয়?
– আসলেই তোমার মতো না-খাদকের সাথে থাকতে থাকতে খাওয়া ভুলে গেছি! এবার পড়ে দেখো তো বোরকাটা। আমিও দেখি।
– এসব বোরকা এনেছো কেন? আমি এসব পড়ি? আর এখন বোরকারই প্রয়োজন ছিলো না। যথেষ্ট আছে।
– প্রয়োজন আছে বলেই এনেছি। পড়…
নাহিদা বোরকা পড়লো। কফি কালারটা ভালোই মানিয়েছে তাকে৷ তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে। বোরকা পড়ার পর মেহেদী তার পেটের দিকেই বেশি তাকিয়েছে৷ নাহিদাও এবার আন্দাজ করতে পেরেছে কেন এনেছে এই বোরকা! পরক্ষণে বললো,
– হয়েছে দেখা? খুলে ফেলবো?
– হুম। এখন থেকে এটা পড়ে ভার্সিটি যাবে। আর আগের গুলো আলমারিতেই থাকুক আপাতত।
– কেন?
– এমনি।
– হুহ্, এমনি! কেন বলছে বুঝিনা না-কি!
বিড়বিড় করে বললেও মেহেদী বুঝতে পেরেছে। এসি টা অন করে সে ধপাস করে খাটে শুয়ে পড়লো এবং বললো,
– বুঝোই তো সব। আবার জিজ্ঞেস করো কেন?
নাহিদা বোরকাসহ বাকি প্যাকেটগুলো রেখে মেহেদীর দিকে তাকাতেই মেহেদী হাত বাড়িয়ে ইশারা করলো তার কাছে যাওয়ার জন্য। নাহিদা এসে পাশে বসে বললো,
– কি?
মেহেদী তাকে টেনে তার হাতের উপর শুয়িয়ে দিয়ে একটু আদুরে গলায় বললো,
– মাঝে মাঝে শাড়ি পড়তে পারো না বাসায়?
– ইশ! শখ কতো! ছাড়ো, রান্না বসাতে হবে৷
– উহুম।
– বালিশ ছাড়া শুয়েছো কেন। উঠো।
মেহেদী মুহুর্তেই ঘুমের ভান করে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। না নিয়েছে বালিশ আর না ছেড়েছে নাহিদাকে। নাহিদা তার নাক টেনে ধরলো, তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না! এবার নাহিদা বললো,
– অনেক দিন হলো বাসায় যাই না। বেড়াতে যাবো না?
মেহেদীর কোনো সাড়া নেই! নাহিদা তার গালের উপর খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,
– সিরিয়াস কথা বলছি তো!
– আজ দেখা হয়নি বাবামায়ের সাথে?
– এটুকু সময়ের জন্য! বাড়িতে গিয়েও তো কিছুদিন থাকতে ইচ্ছে হয়।
– ওকে, যাবে।
– কবে যাবো?
– পরে।
– আজ নাফিসা গেছে। একসাথে বেড়াতে গেলেই তো ভালো লাগে।
মেহেদী এবার চোখ খুলে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। আর নাহিদার মুখটা মলিন হয়ে গেছে! সে ভেবে নিয়েছে মেহেদী নারাজ! তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মেহেদী তার দুই গাল এক হাতে চেপে ধরে বললো,
– বাবুর সাথে একটু কথা বলছিলাম, শান্তি দিলো না বাবুর আম্মু! যাও, কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে দিয়ে আসবো। দুদিন পর বিকেলে অফিস থেকে ফিরে আবার নিয়ে আসবো। এবার তো একটু চুপ থাকো।
নাহিদা এবার খুশিমনে চুপচাপ মিশে রইলো মেহেদীর সাথে।
বাসায় ফিরে নাফিসা তার মায়ের হাতে কাগজে মোড়ানো কিছু দিলো।
– এটা কি?
– নাকফুল। আসার সময় আম্মা দিয়ে দিছে নাক ফুটো করে যেন পড়ি। এখন আমি তো নাক ফুটো করবো না। তাহলে কিভাবে কি করা যায় বলোতো একটু। এটাকে কি কোনোভাবে চাপ দিয়ে লাগানো পিন বানানো যাবে?
– একটা মাইর দিয়ে নাক ফাটিয়ে ফেলবো! শ্বাশুড়ি শখ করে দিয়েছে আর সে চাপ পিন বানাতে যায়! কাল ফুফু আম্মাকে ডাকবো নাক ফুটিয়ে দেওয়ার জন্য।
– মাইর দিয়ে নাক ফাটাবে তো তোমার ফুফু আম্মাকে আবার ডাকার কি প্রয়োজন! ফাটার মধ্যেই না হয় ফুল পড়ে নিবো!
রুমানা বেগম হেসে উঠলো নাফিসার কথায়। পরক্ষণে হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কে দিয়েছে এই বালা? তোর শ্বাশুড়ি?
– বড়মা দিয়েছে। আর আম্মা এই প্রথম আজ নাকফুল দিলো৷
– আমিও তো বালা বানিয়ে দিতাম। কিন্তু এখন তো হাতটানের সময় তারাহুরো করে সব হয়ে গেলো! আরও কিছুদিন যাক, দেখি খামারে একটু ভালো আয় হলে নাজিয়া নাহিদার টার চেয়েও বেশি মোটা করে বানিয়ে দিবো তোকে।
– লাগবে না আমার ওসব। মোটা করে বানিয়ে তুমিই পড়ে থেকো। এইটা পড়েই যেই যন্ত্রণায় আছি! কোনো কাজে হাত লাগাতে গেলে মহা ঝামেলা সৃষ্টি করে!
– পড়তে পড়তেই অভ্যাস হয়ে যাবে। আর শোন, ওবাড়িতে সবার কথামতো চলবি তো আদর পাবি। বাবামায়ের সম্মান বাঁচিয়ে রাখিস শ্বশুর বাড়িতে। আর শ্বশুর বাড়ির সম্মানও বাঁচিয়ে রাখবি বাবার বাড়িতে। দুটোই তোর পরিবার। কাউকে কোনোদিকে ছোট হতে দিস না। আর ইমরানের কথা একদমই অমান্য করবি না।
– তোমাদের দেওয়া এতো রুলস আমার মনে রাখা সম্ভব না। শুনতে শুনতে ক্লান্ত! বেড়াতে এসেছি এখনো শান্তি নেই। এর চেয়ে ভালো লিস্ট করে দিও, সময় নিয়ে পড়ে নিবো।
– বড্ড বেশি মজা করতে জানিস!
– মজা না করলে থামো নাকি আম্মাজান! যেই জ্ঞান দিতে থাকো, আমার ব্রেইনে জায়গা হয় না! আর শুনো, নাক ফুটো করবো না ফাইনাল ডিসিশন। প্রয়োজনে ওবাড়িতে যাওয়ার সময় দোকান থেকে টিপ নত কিনে নিয়ে যাবো। এটা এখানেই থাকুক। শ্বাশুড়ি আম্মার চোখের আড়ালে। আর ফেরত চাইলে নিয়ে ফেরত দিয়ে দিবো।
– সাহস কত বড় মাইয়ার!
– ঠিক তোমার মাইয়া যত বড়… হিহিহি…
রাত এগারোটার দিকে ঘুমাতে গেলেও ঘুম আসছে না চোখে! তাই একটু অনলাইনে ভ্রমণ করতে গেলো। তিন চার মিনিট অতিক্রম হতেই ইমরানের আইডি থেকে মেসেজ! সিন করে দেখলো,
“ঘুমাসনি কেন রে?”
অটোমেটিক নাফিসার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে! সে-ও রিপ্লাই করলো,
“আমি ঘুমিয়ে গেলে তোর তদারকি করবে কে?”
“ঠিকই তো! তা তদারকি করে কি অনুসন্ধান করতে পারলি?”
“মাত্রই অনুসন্ধানে নেমেছি আর অমনি তোর মেসেজ! আপাতত এইটুকু নিশ্চিত, তুই ঘুমাসনি! আচ্ছা, তুই ঘুমাসনি কেন রে?”
“ক্যামনে ঘুমাই বলতো! বউ যে আজ গলা জড়িয়ে ঘুমালো না!”
“ইশ, কি আমেজ! তা, বউ ছাড়া এখন কি করছিলি?”
“বউ তো আমাকে একা রেখে বাপের বাড়ি গেছে, তাই একটু মাস্তিতে নেমেছি!”
“মাস্তি! পাশে কে? তোর গার্লফ্রেন্ড নাকি?”
“না, বয়ফ্রেন্ড”
“নাম কি ছোকড়ার?”
“আশিক”
“ভাইয়া যায়নি পরে?”
“না, রেখে দিয়েছি আজ।”
“মাস্তি কি বাইরে না ঘরে?”
“তোর আমার শয়নঘরে।”
“ভাইকে দেখিয়ে বউয়ের সাথে আলাপ করছিস, লজ্জা করে না! ছি!”
“বিপরীতমুখী তো। ভাই একদিকে আমি আরেকদিকে।”
“যেই কচ্ছপ ভাই তোর, দেখ আবার উঁকি মেরে দেখছে কি-না!”
ইমরান পেছনে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই উঁকি মেরে আছে আশিক! ইমরানকে তাকাতে দেখে আশিক বললো,
– ভাই! ভাবি তোমাকে তুইতোকারি করে! আর কতবড় কোটনা দম্পতি তোমরা, অন্যকে নিয়ে সমালোচনা করো। এটা কিন্তু ঠিক না ভাই! আমার বাড়ন্ত বয়সে দুজন মিলে আমাকে পঁঁচিয়ে ফেলছো!
ইমরান নাফিসাকে রিপ্লাই করলো,
“সত্যিই আশিক উঁকি মেরে দেখছিলো বউ! দাড়াও, তার আগে স্পেশাল ক্লাস নিয়ে নেই।”
নাফিসা হাসতে হাসতে টাইপ করলো,
“ক্লাস নে তুই, ঘুম চলে আসছে আমার। গুড নাইট ফর আস, বেড না ফর আশিক ভাই….!”
চলবে।