“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৪
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে ইমরান বেরিয়েছে বাসা থেকে। অনেকদিন হলো বন্ধুবান্ধব একসাথে হয় না তাই একটু দেখাসাক্ষাতের উদ্দেশ্যে যাওয়া। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। ইমরান যাওয়ার সময় বলে গেছে এদিকেই যাচ্ছে। কিন্তু এখনো একবারের জন্য বাড়ি এলো না যেখানে সে সন্ধ্যার পর সাধারণত বাড়ির বাইরেই থাকে না! শুধু আযান হলে মসজিদে যায় আর বাকি সময় বই পড়ে কাটায়। সে কোথায় আছে জানতে নাফিসা কল করলো। ইমরান জানালো সে বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। একটু পরেই চলে আসবে। ইশার নামাজ পড়ে রাতে খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, ইমরান আসেনি। নাফিসা আবার কল করলো। সে বললো তাদের খেয়ে নিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যে যেহেতু আসবে তাহলে কি সে একা একা খাবে! তার চেয়ে বরং সে নিজেও পরে খাবে সেই ভেবে নাফিসা বসে রইলো। সবার খাওয়াদাওয়া শেষ। নাফিসা কিছুক্ষণ টিভি দেখলো। দশটা বেজে গেছে! সেই যে বিকেলে বেরিয়েছে ইমরান এখনো আসছে না! নাফিসা কল করতে করতে নিশাতের সাথে এই ঘরে চলে এলো। প্রথম বার কল কেটে গেছে। দ্বিতীয় বার ইমরান রিসিভ করে ফিসফিসিয়ে বললো, ” কিছু শুনতে পাচ্ছি না আমি। আমার ফিরতে একটু লেট হবে, জান।” নাফিসাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো সাথে সাথেই! ওদিকে হাসাহাসির শব্দও শোনা যাচ্ছিলো। নাফিসা নিশাতের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো। বড়মা বড় ঘরের গেইটের সামনে দাড়িয়ে বললো,
– নাফিসা? ইমরান আসেনি?
– না বড়মা। এখন জানিয়েছে, একটু লেট হবে আসতে।
– কোথায় গেছে?
– ফ্রেন্ডদের সাথে।
– তুই খেয়ে নে, বসে থাকিস না।
– ভালো লাগছে না এখন খেতে। পরে খেলে খাবো না খেলে নেই।
নাফিসা রুমে চলে এলো। মশারী টানিয়ে সে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুম আসছে না চোখে! এগারোটা বেজে গেছে তা-ও ইমরানের খবর নেই! খুব রেগে আছে নাফিসা। এতো রাতে বাইরে তাদের কিসের আড্ডা!
সময় এখন বারোটা চল্লিশ মিনিট! ইমরান দরজায় টোকা দিয়ে স্বাভাবিক শব্দে ডাকলো। নাফিসা জেগেই আছে। প্রথমবার কেপে উঠেছিলো। কিন্তু দ্বিতীয়বার ডাকতেই বুঝতে পারলো ইমরান এসেছে। এতোক্ষণ লাইট জ্বালানো থাকলেও এখন হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দিলো এবং চুপচাপ শুয়ে রইলো। জানালার গ্লাসের দিকটায় হঠাৎ আলো নিভে যাওয়া টের পেয়ে ইমরান বুঝতে পেরেছে নাফিসা জেগে আছে। আরও একবার নক করে সে কল দিলো। রিংংটোন বাইরে থেকেই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু নাফিসা রিসিভ করছে না। দ্বিতীয়বার যখন কল করলো তখন রিং হচ্ছে কিন্তু রিংটোন শোনা যাচ্ছে না! সে নিশ্চিত ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে! সে জেগে আছে অথচ দরজা খুলছে না তাই ইমরান বুঝে নিলো নাফিসা রেগে আছে তার উপর! সে দরজায় নক করে বললো,
– নাফিসা? সরি।
-…..
– নাফিসা?
-…..
– সরি বলছি তো।
-…..
– হার্টবিট, দরজা খুলো। আজ কি বাইরেই থাকবো?
-…..
– খুলবে না দরজা? আমি কি চলে যাবো? খুজবে না তো আবার?
-…..
– চলে যাচ্ছি কিন্তু!
নাফিসা তবুও কোনো সাড়া দিলো না৷ পাঁচ ছয় মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর যখন আর কোনো সাড়া পাচ্ছে না ইমরানের তখন ভাবলো সে সত্যিই চলে গেছে নাকি! নাফিসা উঠে লাইট জ্বালিয়ে আরও দুতিন মিনিট বসে রইলো। ইমরান আর ডাকছে না! এবার নাফিসা দরজার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে দরজা একটু ফাঁক করে কাউকে দেখতে পেল না! আরেকটু ফাঁক করে ডানদিকে চোখ পড়তেই দেখলো ইমরান বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে আর তাকিয়ে আছে দরজার দিকেই। নাফিসা গম্ভীরমুখে চলে এলো দরজা যতটুকু ফাঁক করেছিলো ততটুকু ফাঁক রেখেই। ইমরান ছোটখাটো এক নিশ্বাস ফেলে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। এমনি বাইরে থেকে হাক পড়লো,
– ইমরান এসেছিস?
ইমরান দরজা খুলে দেখলো বড় ঘরের গেইটের ভেতর দাড়িয়ে আছে বড় মা। সে বললো,
– হ্যাঁ, বড়মা।
– খাবি না?
– খেয়েছি আমি। গেইট তালা দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো।
আরও কিছু হয়তো বলেছিলো কিন্তু ইমরান শুনতে পায়নি স্পষ্ট। সে আবারও “ঘুমিয়ে থাকো” বলে দরজা লাগিয়ে দিলো। নাফিসা খাটে বসে আছে, ইমরান ড্রেসিং টেবিলে ঘড়ি, ফোন রেখে শার্ট খুলছে। রাত ১’টা বেজে গেছে। নাফিসা গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো,
– কোথায় ছিলেন এতোক্ষণ?
ইমরান ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকে এক পলক দেখে বললো,
– ফ্রেন্ডদের সাথে একটু সময় কাটিয়েছি।
– রাতের বেলায় কিসের সময় কাটান ফ্রেন্ডের সাথে? এতো রাত পর্যন্ত কেন বাইরে থাকবেন?
– একটু লেট হয়ে গেছে। সরি বললাম তো!
– কিসের সরি হ্যাঁ? এখানে একটু লেট হয়েছে? সেই বিকেলে বেরিয়েছেন কোনো খোজ খবর আছে! বাড়ির মানুষ বেঁচে আছে না মরে গেছে সেই খেয়াল আছে আপনার!
– এভাবে কথা বলছো কেন! সবসময় কি বাইরে সময় কাটাই। মাঝে মাঝে একটু দেখাসাক্ষাৎ হতেই পারে। তুমি যাও না তোমার ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে।
– আমি রাতের বেলা ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাই?
– রাতের কথা বলেছি নাকি।
– তাহলে আমার সাথে তুলনা করলেন কেন? এসব চোর ডাকাতের সাথে আপনার কিসের বন্ধুত্ব? এমন করে কি ভালো মানুষের পরিচয় দিচ্ছেন!
– কিসব বলছো তুমি! মাথা ঠান্ডা করো আর না জেনে অন্যের উপর অপবাদ দেওয়া বন্ধ করো। আমার কোন ফ্রেন্ড চোর ডাকাত নয়।
– চোর ডাকাত নয় তো কি? কোনো ভালো মানুষের আড্ডা চলে এতো রাতে! চোর ডাকাত না হলে তারা রাতে ডাকবে কেন আড্ডা দেওয়ার জন্য? এসব আমাকে বুঝাতে আসেন! এতোটাই অবুঝ আমি! বাড়ির কতগুলো মানুষ জেগে আছে আপনার জন্য সেটা কিছু না? সকলের ঘুম হারাম করে আপনি বন্ধুবান্ধব নিয়ে পড়ে আছেন! দরকার নেই তো এমন বন্ধুবান্ধবদের! যারা দিনে সময় পায় না, রাত ১ টা পর্যন্ত আড্ডা দিবে! এসব লোকদেরই বিনা কারণে পুলিশের হাতে ডান্ডার বারিসহ জেলের ভাত খেতে হয়! উচিত করে পুলিশ। আজ ঘরে জায়গা হয়েছে৷ নেক্সট টাইম ঘরে জায়গা না-ও হতে পারে। আর আপনার জায়গা হলেও আমি থাকবো না। এ-ই বলে দিলাম!
নাফিসা জেদ নিয়ে মশারীর ভেতর চলে গেলো। ইমরান চুপই রয়ে গেলো। এমনিতেই একজন রেগে আছে, এখন সে-ও যদি রেগে যায় তো ঝগড়ার সৃষ্টি হবে যেটা মোটেও মঙ্গলজনক নয়! শান্তি চাও তো একজন রাগলে অন্যজন নীরবেই থাকাই শ্রেয়। এতোটা মেজাজ দেখাচ্ছে তবুও ইমরান মনে মনে হাসলো এই ভেবে, “কে বলেছে শুধুমাত্র বংশ বৃদ্ধির জন্য বউ আসে ঘরে! বউ তো স্বামীকেও শাসনে রাখতে জানে, আবার স্বামীর শাসনের আওতায়ও থাকতে চায়! পরিবারে তো এটাই প্রয়োজন। স্বামী স্ত্রীকে শাসন করবে আর স্ত্রী স্বামীকে। স্বামী স্ত্রীর যত্ন নিবে আর স্ত্রী স্বামীর! স্বামী স্ত্রীকে ভালোবেসে আগলে রাখবে আর স্ত্রী স্বামীকে। তবেই না হবে একে অপরের পরিপূরক!”
ইমরান ঘুমানোর সময় নাফিসার উপর হাত রাখতেই নাফিসা তার হাতের উপর এক ঘা মেরে দিলো! ইমরান ব্যাথা পেয়ে বললো,
– উফ্! পুলিশের ডান্ডার বাড়ি না খেয়েও তো বউয়ের ডান্ডা খেতে হচ্ছে! আশেপাশে সারাজীবন শুনে এসেছি ছেলেরা বউ পেটায়! আমার ক্ষেত্রে উল্টো কেন! আমি পেটানোর আগেই বউ আমাকে পেটায়!
– কেন? ছেলেরা বউ পেটাতে পারলে বউরা পেটাতে পারবে না? অন্যায় যে করে এবং অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী। আমি কোনো অপরাধী হতে পারবো না।
– আমি তো তেমন কোনো অন্যায় করলামই না, আর তুমি মাইর শুরু করেছো!
– একশো বার মারবো। আমাকে ধরবেন না। সরুন! বাইরে থেকে এখন এসেছে সেটা অন্যায় নয়! হুহ্! সাধু মানুষ!
ইমরান এবার তাকে সম্পূর্ণ নিজের অধীনে বন্দী করে বললো,
– এতোটা রিয়েক্ট করছো কেন! শোনো আগে।
– না, কিচ্ছু শুনতে হবে না। ছাড়ুন!
– আরে, শোনো। আমি কি আর কখনো এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থেকেছি?
– তো আজ গেলেন কেন!
– অনেকদিন দেখাসাক্ষাৎ হয় না কারো সাথে। সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। দেখা করার মতো সময় পাই না তাই আজ সুযোগ বুঝে একটু সময় কাটালাম একসাথে।
– কেন? সাপ্তাহিক ছুটি নাই কাজে? সেদিন দেখা করতে পারেন না? রাতের বেলা কেন!
– ছুটি থাকলেই কি, সবার কি আর সুযোগ হয় সবসময়!
– তো দেখা করে আসতে আট ঘন্টা সময় লাগে! ভণ্ডামির জায়গা পান না!
– এতোক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো না। সন্ধ্যায় ঘুরেফিরে চলে আসতাম। হঠাৎই প্ল্যান করা হলো নিজেরা রান্না করে খাওয়াদাওয়া হবে। চলে গেলাম এক ফ্রেন্ডের বাড়িতে। সবজি কাটাকাটি, গল্পগুজব, রান্নাবান্না তারপর খাওয়াদাওয়া। হঠাৎ প্ল্যান, সময় তো লাগবেই। তাই না?
– তো রান্নাবান্নাসহ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা হলো যেহেতু বন্ধুর বাড়িতে ঘুমানোর জায়গা হলো না? চলে এলেন কেন এতো রাতে! থেকে যেতেন সেখানেই!
ইমরান তার নাক টেনে বললো,
– চলে আসবো না! বউকে একা থাকতে দিবো নাকি! এতো রাগ করলে ভাঙাবো কি করে, বল তো!
নাফিসা গোমড়া মুখু হয়ে চুপ করে রইলো। ইমরান আবার বললো,
– এভাবেই থাকবি? হাসবি না একটু? একটু হেসে দেখা, আমিও দেখি…
এই বলে ইমরান কাতুকুতু দিতে লাগলো। নাফিসা ছটফট করে বিরক্তির সাথে বললো,
– ওফ্ফ! অসহ্য লাগছে। ভালো লাগছে না কিন্তু।
– আচ্ছা, আর দিবো না। শর্ত একটাই, চুপচাপ ঘুমাবি আমার কাছে। হুম্ম?
– বারান্দার গেইটে তালা দিয়েছো?
– হুম।
– গরম লাগছে। ফ্যানের সুইচটা অন করো।
ইমরান বুঝতে পারলো নাফিসার মুড ঠিক হয়েছে। তাই মৃদু হেসে ফ্যানের সুইচটা অন করে দিলো। নাফিসার এই অভ্যাসটা ইমরানকে খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় সে কখন রেগে থাকে, কখন স্বাভাবিক আর কখন রোমান্টিক মুডে থাকে! যখন নরমাল তখন তুমি করে বলবে, যখন রেগে থাকবে তখন আপনি করে বলবে আর যখন অতি রেগে যায় তখন তুই করে বলে। এছাড়া ইমরানের সাথে তাল মেলাতে রোমান্টিক মুডে থাকাকালীনও তুই করে বলে। তখন ভাবটাও অন্যরকম হয়!
.
সকালে যখন ইমরান রেডি হয়ে নাস্তা করছে তখন বড়মা নাফিসাকে বললো,
– তুই খাবি না?
– হ্যাঁ, পরে খাই।
– পরে কেন! এখন খা! রাতেও খাসনি আর এখন আটটা বেজে গেছে! প্লেট নিয়ে যা।
– আসছি, পানি দিয়ে আসি।
নাফিসা পানির জগ নিয়ে ড্রয়িং রুমে আসতেই ইমরান বিষ্ময়কর ভাবে বললো,
– রাতে খাও নি তুমি?
নাফিসা ব্যঙ্গ করে বললো,
– আমাকে না ফ্রেন্ডের বাড়িতে নিয়ে গেছেন খাওয়ার জন্য?
– এখন মুড নাই বলে বেঁচে গেলে, আর আগে জানলে রাতেই মেরে হাড্ডি গুড়ো করে ফেলতাম! না খেয়ে এতোটা সময় পাড় করলে কিভাবে! বসো এখানে।
– প্লেট নিয়ে আসি।
– প্লেট নিতে হবে না, বসো।
– ইশ! নির্লজ্জ ব্যাটা। সবাই ঘরে আর আমি বসে বসে এখানে তার হাতে খাবো!
নাফিসা ব্রু সংকুচিত করে ফিসফিসিয়ে বললো কথাটা। ইমরান মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
– দুইবার নাও। হা করো। আর কখনো কারো জন্য বসে থাকবে না। নিজের খাবার নিজে সময়মতো খেয়ে তারপর বাকিসব। মনে থাকবে?
– হু।
– ভার্সিটি যাবে না?
– হুম।
নাফিসা দুই লোকমা ইমরানের হাতে খেয়ে প্লেট নিয়ে এলো। সাথে বড় মা ও এসেছে। তিনজন একসাথেই খাওয়া শেষ করলো।
ভার্সিটি থেকে ফিরে নাফিসা গোসলের জন্য বাথরুমে এলো। লাইটটা অন করতেই দৃষ্টি আটকে গেলো ভেন্টিলেটরের কর্ণারের ফাঁকা জায়গার দিকে। কালো কিছু একটা রাখা আছে। হাতের কাপড় রেখে সে জিনিসটা হাতে নিলো। এটা একটা ফোন! এটা কার ফোন হতে পারে! তাও আবার এখানে ফোন রাখবেই বা কেন! এটা কি ফোন রাখার জায়গা! নাফিসা সাইড বাটনে ক্লিক করতেই দেখতে পেল প্যাটার্ন লক করা। স্ক্রিনে জিহানের ছবি! তাহলে কি এটা জেরিনের ফোন! তার ফোন এখানে থাকবে কেন! সে তো এই বাথরুমে আসে না বললেই চলে!
নাফিসার মনে কিছুটা সন্দেহ এসে হানা দিলো! সে একবার ট্রাই করতেই প্যাটার্ন লক খুলে গেলো! কেননা পরশু দিন ছবি নেওয়ার জন্য নিশাতকে লক খুলতে দেখেছিলো। যেটা চোখে এটে আছে এখনো! আর এখন যা দেখলো তাতে সে ভীষণ শকড! ভিডিও রেকর্ডিং! ২০ মিনিট লেফট! বাথরুমে ভিডিও রেকর্ডিং করে কি অনুসন্ধান করতে চাইছে সে! আর এই বাথরুম যারা ইউজ করে তারা তো কেউই বাসায় নেই! নাফিসা মাত্র এলো৷ তাহলে জেরিন কি তার ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চাইছে ভিডিও করে! তা নয় তো আর কি হতে পারে! ভাবতেই নাফিসার মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেলো! কতটা নিচু মনের অমানুষ এরকম কাজ করতে পারে! নিজে একটা মেয়ে হয়ে অন্য একটা মেয়ের সাথে এমন কিছু করতে তার বিবেকে বাধলো না! ছি! ইচ্ছে করছে ফোনটা আছাড় মেরে গুড়ো করে ফেলতে! কিন্তু না। সে এটা তার রুমে লুকিয়ে রেখে এলো। আগে থেকেই সাইলেন্ট করা ছিলো, তাই তাকে আর কিছু করতে হলো না। গোসল সেড়ে নামাজ পড়ে ফ্যানের নিচে বসে চুল শুকানোর সময় জেরিন রুমে প্রবেশ করলো। নাফিসা এক পলক তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে বললো,
– ভাবি, কিছু বলবেন?
জেরিন দাতে দাত চেপে বললো,
– আমার ফোন কোথায়?
নাফিসা তার দিকে আবার তাকিয়ে লক্ষ্য করলো, একদিকে তাকে ভয়ার্ত দেখাচ্ছে অন্যদিকে রাগান্বিত! দুই ভাবভঙ্গিই উপস্থিত! নাফিসা ব্রু সংকুচিত করে বললো,
– আপনার ফোন কোথায় সেটা আমি কি জানি! আপনি কি আমার কাছে ফোন দিয়ে গেছেন নাকি!
– ন্যাকামো করো না। পস্তাবে বলে দিচ্ছি।
– কি আশ্চর্য! আপনার কথা তো আমার কানের অগ্রভাগেও স্পর্শ করতে পারছে না!
– ভালোয় ভালোয় দিয়ে দাও। নতুবা…
এমনি নিশাত হাজির। নাফিসা জেরিনকে ইগনোর করে নিশাতকে বললো,
– নিশাত, এক্সাম কেমন হয়েছে?
– আলহামদুলিল্লাহ। অনেক ভালো।
– হুম, তোমার ফেস দেখেই বুঝা যাচ্ছে। অহ, ভালো কথা। ভাবির ফোন দেখেছো সকালে? ভাবি নাকি ফোন খুঁজে পাচ্ছে না!
– না তো! কখন থেকে খুঁজে পাচ্ছো না আপু?
জেরিন জবাব না দিয়ে নাফিসার দিকে একবার তাকিয়ে দাত কিড়মিড়িয়ে চলে গেলো। নিশাত ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে, নাফিসাও ঠোঁট উল্টে ইশারা করলো জানে না কিছু!
দুপুরে খাওয়ার পর নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ইমরানে ডাকে তার ঘুম ভাঙলো। কিন্তু ইমরানকে পেলো না কোথাও!
– ওদিকে কাকে খোজো? আমি এদিকে। দরজা খুলো।
নাফিসা জানালার দিকে তাকিয়ে ইমরানকে জানালার বাইরে দেখতে পেল। অত:পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে এসে দরজা খুলে দিলো। ইমরান রুমে প্রবেশ করতে করতে বললো,
– তুমি এখানে শান্তিতে ঘুমাচ্ছো, ওদিকে নাকি জেরিনের ফোন চুরি হয়ে গেছে! ভর দুপুরে একটু সাবধানে থেকো। আর ঘুমানোর সময় জানালাও লাগিয়ে রেখো। কিংবা দরজা জানালা সব বন্ধ করে তালা লাগিয়ে বড়ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে থেকো।
নাফিসা আবার দরজা লাগিয়ে খাটে বসে বসে হাই তুলছে আর ইমরানের কথা শুনছে। ইমরান বললো,
– ঘুম কাটেনি এখনো! আসরের আযান দিয়েছে তো মাত্র। নামাজ পড়ে নাও।
নাফিসা চুপচাপ বসেই আছে। ইমরান শার্ট খুলে আলমারি থেকে টিশার্ট নিতে নিতে বললো,
– নূর, আমি একটা বিষয় ভাবছি। বাড়িতে যদি চোর এসে থাকে তবে সব রেখে শুধু মাত্র ফোন নিয়ে চলে গেলো কেন! তাহলে তো এটাও মানতে হয়, চোরও মানুষ চিনে চুরি করে। কি বলো?
নাফিসা ঠোঁটের এক কোনে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বুক সেলফের দিকে গেলো। ইমরান আবার বললো,
– চোর লোকটা নিশ্চয়ই চোরদের মধ্যে সৎ লোক, যে কি-না ভালোদের জিনিসপত্র রেখে দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের জিনিস চুরি করতে পছন্দ করে।
এমনি নাফিসা ইমরানের বই ঘেটে ফোনটা বের করে বললো,
– দেখো তো, এটা তোমার ভাবীর ফোন কি-না?
ইমরান ফোনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার নাফিসার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকালো! পরক্ষণে বললো,
– তোমার কাছে এই ফোন কেন?
নাফিসা তার জবাব না দিয়ে ভিডিওটা বের করে দেখালো যতটুকু রেকর্ড হয়েছে। কিন্তু ইমরান এর আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না! সে বললো,
– এটা কিসের ভিডিও? বাথরুম দেখা যাচ্ছে শুধু!
নাফিসা শেষ দিকটা দেখিয়ে বললো,
– এতে কিছু বুঝতে পারছো?
– তোমাকে দেখা যাচ্ছে। কাপড় নিয়ে প্রবেশ করছো। কিন্তু বুঝলাম না কিছু!
– আমি গোসল করতে যাওয়ার পূর্বে তোমার ভাবি রেকর্ডিং অন করে এসেছে আমার গোসল দেখার জন্য। আর লোকজনকে দেখিয়ে ইজ্জতের ফালুদা বানানোর জন্য। এবার বুঝতে পেরেছো কিছু?
ইমরান ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রইলো নাফিসার দিকে! নাফিসা আবার বললো,
– আল্লাহর রহমতে আমার দৃষ্টি সেই ত্রুটিপূর্ণ জায়গায়ই আটকে গেছে আর ফোন নিজের কাছে লুকিয়ে রেখে দিয়েছি। ঘুমানোর পূর্বে ফোন চাইতে এসেছিলো তোমার ভাবি। সাথে ধমকিও দিচ্ছিলো। কিন্তু আমিও একটু উল্টো ড্রামা করলাম যে ফোন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না! সে নিজে একটা মেয়ে হয়ে আমাকে নিয়ে খেলতে চাইছে৷ এখন বলো, তার ফোনটা কি ফিরিয়ে দেওয়া উচিত?
– ব্যাপারটা ভাইয়াকে জানানো উচিত। ভেবেছিলাম দিনদিন তার পাগলামো কমে গেছে, কিন্তু এখন তো দেখছি আড়ালে আড়ালে সেটা আরও ভয়ানক হয়ে যাচ্ছে!
– এখন ভাইয়াকে জানালে সংসারে অশান্তির ছায়া পড়বে। হয়তো বা বউকে বিশ্বাস করে তোমার সাথে বিচ্ছেদ নতুবা তোমাকে বিশ্বাস করে বউয়ের সাথে বিচ্ছেদ! যার কোনোটাই আমি চাই না আর কোনোটাই মঙ্গলজনক নয়! প্রথমে বুলি তারপর লাঠি। আমি ভাবিকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাই, দেখি তার পরিবর্তন হয় কিনা। এতেও যদি ঠিক না হয় এরপর খারাপ কিছু ঘটলেও আমি উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
– সুযোগ দেওয়া হয়েছে অনেকবার!
– আজ একটু ভয় দেখেছিলাম তার চেহারায়। কেন জানি মনে হচ্ছে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। ভালো হলেই তো সবার জন্য ভালো। হুম?
– যা ইচ্ছে করো।
– এটার তো একটা ফানি সলিউশন দিতে পারো। কি করবো এটা?
– কাঁচা ড্রেনে ফেলে দাও নয়তো ভাঙারির কাছে বিক্রি করে সন্দেশ খেয়ে ফেলো!
– ভালো একটা আইডিয়া মনে করিয়ে দিয়েছো তো!
– মনে করিয়ে দিয়েছি!
– হ্যাঁ, মনে করিয়ে দিয়েছো। কাঁচা ড্রেনে ফেলবো না কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
– কি?
– বাথরুমে সেট করেছিলো না? তার ফোন এবার বাথরুমের ময়লাতেই চুবিয়ে তারপর ফেরত দিবো। দারুণ হবে না?
– ছি! তুমি ওই ফোন চুবিয়ে আবার হাতে ধরবে!
– ধুর! খালি বেশি বেশি!
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৫
(নূর নাফিসা)
.
.
নামাজ পড়ে নাফিসা ফোনটা দুই লাঠির মাঝে আটকে নিয়ে ভাবি ভাবি বলে জোর গলায় ডাকতে ডাকতে বড় ঘরের গেইটের সামনে এলো। আরমান মাত্রই আসরের নামাজ পড়ে এসেছে। জেরিনও বিরক্তি নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলো এক হাতে নাফিসা নাক চেপে ধরে রেখেছে আর অন্যহাতে দুই লাঠির মাঝে তার ভেজা ফোন! নাফিসা বললো,
– ভাবি, এটা আপনার ফোন নাকি?
নিশাত দেখে বললো,
– এটাই তো আপুর ফোন!
– তো ভাবির ফোন ও ঘরের বাথরুমে গেলো কি করে!
– বাথরুমে!
– হুম, আমি বাথরুমে যাওয়ার পর দেখি আলো জ্বলে আছে কমোডের ভেতরে! পরে ব্যাপারটা বুঝার জন্য লাঠি দিয়ে তুলে দেখলাম ফোন! আর মনে হলো ভাবি ফোন খুজে পাচ্ছে না যেহেতু এটা ভাবির ফোন নয়তো!
জেরিন তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
– আমার ফোন বাথরুমে যাবে কি করে!
– সেটাই তো আমি জিজ্ঞেস করছি! আপনার ফোন বাথরুমে গেলো কি করে! জিহানকে তো আজ ওই বাথরুমে যেতে দেখলাম না! আপনি না দুপুরে বাথরুমে গিয়েছিলেন? তখন পড়ে যায়নি তো আবার?
– আ..আমি কখন বাথরুমে গেলাম!
নিশাত বললো,
– হ্যাঁ, আমি যখন বাসায় ঢুকছিলাম তখন না তুমি বাথরুম থেকে বেরিয়ে ভাবির রুমের দিকে গেলে!
– আমি ফোন নিয়ে বাথরুমে যাইনি!
আরমান বললো,
– তাহলে ফোন উড়ে উড়ে গেছে? আজকাল তোমার ধ্যান কোথায় থাকে বুঝি না! বাথরুমে ফোন ফেলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছো চোর এসে শুধু তোমার ফোন নিয়ে চলে গেছে, না? আবার ক্ষণে বলছো জিহান কোথাও ফেলে এসেছে!
– আশ্চর্য, আমি বলছি আমি ফেলি নি আর তোমরা সবাই মিলে আমাকে বকছো! হতেও তো পারে কেউ চুরি করে বাথরুমে ফেলে দিয়েছে!
নাফিসা বুঝতে পেরেছে অপবাদটা তার দিকেই ঠেলে দিচ্ছে! আরমান ব্রু কুচকে জেরিনকে বললো,
– ঘরের সদস্য ছাড়া তো আর কেউ বাথরুম ইউজ করে না! তো তুমি কিসব উল্টাপাল্টা বুঝাতে চাইছো? আমরা কেউ তোমার ফোন চুরি করে তাও আবার বাথরুমে ফেলে এসেছি?
– আমি সেটা বলেছি নাকি!
– তো কি বলছো?
– এতো মেজাজ দেখাও কেন! হতেও তো পারে জিহানই খেলতে খেলতে ফেলে এসেছে। দুপুরের আগে কি তারা বাড়িতে ছিলো, যে দেখবে!
– জিহানের হাতে আর কখনো ফোন দিবে না। এবার ইউজ করো ময়লা, দুর্গন্ধযুক্ত ফোন।
আরমান ঘরে চলে গেলো। নিশাতও হাসতে হাসতে চলে গেলো। ইমরান তাদের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলো এবং শুনছিলো সব। জেরিন প্রচুর রেগে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে। যেন কান্নাই করে দিবে! সে জিদ্দি গলায় বললো,
– কাজটা তুই মোটেও ভালো করলি না। একে একে আমার সব ধ্বংস করে দিচ্ছিস! পরিনতি খুব খারাপ হবে দেখিস!
নাফিসা লাঠি ফেলে ফোনটা হাতে নিয়ে জোরপূর্বক জেরিনের হাতে রেখে বললো,
– সময় হয়তো এখনো আছে। ভালো হয়ে যান। ভালো হতে পয়সা লাগে না, শুধু একটু চেষ্টা থাকলেই যথেষ্ট। আগেও অনেকবার বুঝিয়েছি, এখনো আবার বলছি। তবে এটা লাস্ট ওয়ার্নিং ভেবে নিতে পারেন। এরপর এমন আলতু ফালতু কাজ করতে দেখলে জেলের ঘানি টানাতেও দ্বিধাবোধ করবো না। তাছাড়া আমি কিন্তু সত্যি চাপা রাখতে পারি না! আজ শুধু ইমরান জেনেছে আপনার কর্ম, এরপর ফুল ফ্যামিলি জানবে। সুতরাং সময় থাকতে শুধরে নিন। আরে ফোন তো আজ মগে পরিষ্কার পানির ভেতর চুবিয়েছি, নেক্সট টাইম এমনও হতে পারে আপনাকে সহ না আবার কমোডের ভেতরে চুবানি দেই!
নাফিসা ফোন তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শুকনো কাপড়চোপড় নিতে লাগলো। তবুও জেরিন হয়তো কিছু বলতো কিন্তু ইমরানকে দেখে আর কিছু বলেনি।
সন্ধ্যার আগে বড়মা তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে, অসুস্থ ভাইকে দেখতে। ইমরান পৌছে দিয়ে এসেছিলো। সন্ধ্যায় যখন নাফিসা রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে, কথায় কথায় নাফিসাকে স্পষ্ট দোষী করে তুলেছে আবিদা বেগমের কাছে। চোরের অপবাদ দিয়েছে সে নাফিসাকে। কিন্তু তা নিয়ে আবিদা বেগম নাফিসাকে কিছু বলেনি। শুধু জেরিনকে একবার চুপ থাকতে বলেছিলো। কিন্তু মিথ্যে অপবাদ নিতে তো নাফিসা প্রস্তুত নয়! তাই সে জেরিনের মুখের উপর জবাব দিয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে দুজনের মধ্যে তর্কবিতর্ক! আরমান ঘরে ছিলো না তখন। তাদের গলা শুনে ইমরান ও নিশাত এই ঘরে চলে এলো। ইমরান জানতে চাইলো কি হয়েছে, কিন্তু তার জবাব পেল না কারো কাছেই। তারা দুজন তর্ক করেই যাচ্ছে আর আবিদা বেগম দুজনকেই থামানোর চেষ্টা করছে। জেরিনের প্রায় কাদো কাদো ভাব! হঠাৎই নাফিসার মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়ে এলো, “যেমন ফুপি তেমন ভাতিজি! সব এক গোয়ালের মুর্খ গরু!”
যদিও নাফিসা ইঙ্গিত করেছিলো আয়েশা বেগমকে, ইমরান বুঝে নিয়েছে তার মাকে বলেছে! অথচ আবিদা বেগম যে জেরিনের ফুপু, এই মুহূর্তে তা খেয়াল ছিলো না নাফিসার! যার ফলে সাথে সাথেই খেতে হলো ইমরানের হাতে সজোরে থাপ্পড়! মুহুর্তেই নাফিসা স্তব্ধ এবং চোখ ভরে গেছে পনিতে! বিনা অপরাধে থাপ্পড় খেয়ে সে রেগে বললো,
– আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে মারার!
ইমরান আরও একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো,
– কেন, আমার সাহস হতে পারে না তোকে মারার! এতো স্পর্ধা কেন তোর? যা, ঘরে যা। আর একটা কথা বললে মেরে ফেলবো একদম। যা, ঘরে যা!
খুব জোরে ধমক দিয়ে বললে নিশাতই ভয় পেয়ে গেছে। দ্বিতীয় বার হাত তুলতে দেখেও থামানোর চেষ্টা করতে মুখে উচ্চারণ করলো, “ভাইয়া!”
আর নাফিসা কান্না করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে! পরিবেশ এখন সম্পূর্ণ নিরব! ইমরান জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে তোর? বল আমাকে? কি হয়েছে?
জেরিন একদম চুপসে গেছে! আবিদা বেগম ইমরানকে বললো, “কিছু হয় নাই। শান্ত হ তুই। জেরিন, ঘরে গিয়া চুপচাপ বইসা থাক। আর একটা কথাও যাতে না শুনি।”
ইমরান বললো,
– না, যাবে কেন এখন। বল কি বলছিলি এতোক্ষণ। আমিও শুনি।
জেরিন চুপচাপ কেটে পড়লো এখান থেকে। “ফোন নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে” এটুকু বলে আবিদা বেগম ইমরানকে শান্ত করতে ব্যস্ত। কিন্তু ইমরান কি শান্ত হয়েছে। সে তো অনেক কিছু জানে এই ফোনের ব্যাপারে যেটা বাকিরা জানে না। তার আগেই ধারণা ছিলো এটা নিয়ে একটা গন্ডগোল বাধবে! তাছাড়া আবিদা বেগম একটু বললেও সে অনেকটা বুঝে নিয়েছে। আর মায়ের কথায় কান না দিয়ে সে এক গ্লাস পানি পান করে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগলো। পিছু নিলো জিহান! ইমরান আবার জিহানকে ঘরে রেখে গেইট লাগিয়ে নিজের ঘরে এলো। নাফিসা বোরকা পড়ে মাথায় কোনোমতে ওড়না পেচিয়ে প্রস্তুত! অশ্রুতে গাল ভেজা! বারবার চোখের ধার ও নাক মুছতে মুছতে এটুকু সময়েই চেহারা লাল বানিয়ে ফেলেছে। চাবি নিয়ে আলমারি খুলছে সে। ইমরান কাছে এসে বললো,
– কোথায় যাচ্ছো?
নাফিসা কোনো জবাব না দিয়ে আলমারি থেকে তার পার্স বের করে নিলো। অত:পর আলমারি লক করে বেরিয়ে যেতে লাগলে ইমরান হাত ধরে টেনে বললো,
– হচ্ছে কি এসব! কোথায় যাচ্ছো!
– যেখানেই যাই না কেন, তোর কাছে জবাবদিহি করতে হবে! হাত ছাড় আমার।
– বিহেভিয়ার ভালো করো।
– পারি না আমি ভালো বিহেভ করতে, আর পারবোও না কোনোদিন। যে পারে তার কাছেই যা। আমার সাথে কথা বলতে আসবি না।
নাফিসা কথা বলতেই ইমরান লক্ষ্য করলো তার মুখের ভেতর রক্ত! দাতের ফাঁকে ফাঁকে লাল হয়ে আছে! নাফিসা ঝাড়ি দিয়ে হাত ছুটিয়ে নিলে দরজার দিকে যাওয়ার আগেই ইমরান আবারও হাত টান দিয়ে নিজের সাথে তাকে একহাতে চেপে ধরে বললো,
– দেখি মুখে কি হয়েছে! মুখ খোলো। খোলো…
নাফিসা দুই ঠোঁট চেপে রেখেছে। সাথে ইমরানের কাছ থেকে ছোটার চেষ্টা। ইমরান তার হাত থেকে পার্স টানলো নাফিসা ছাড়লো না। অত:পর মাথায় প্যাচানো ওড়না ছুটিয়ে ঢিল মেরে খাটে রেখে বললো,
– রাতের বেলা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার এতো সাহস আসে কোথা থেকে! এক পা ও ঘরের বাইরে রাখবে না।
– তুই বলার কে! সর!
– আবারও এভাবে কথা বলে! একদম চুপ থাকো। এভাবে রাগ করে বাড়ি ছাড়লে ভালো দেখায়! যাবেই বা কোথায়? এখন যদি তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাও বাবা মা কি ভাববে!
– যে যা ভাবার ভাবুক। সেটা তোর ভাবতে হবে না। যেদিকে খুশি যাবো। প্রয়োজনে পথেঘাটে দিন কাটাবো। তবুও তোর সংসারে না।
– একদম চুপ! বাড়াবাড়ি করলে একটা মাইর দিবো এখন।
– দে, দিবি ই তো। এ আর নতুন কি, সেই শুরু থেকেই তো মেরে আসছিস! এখন মেরে ফেল একাবারে। বেঁচে থাকতে আমি এ বাড়িতে থাকবো না।
নাফিসার অতিরিক্ত মাত্রায় জেদ ইমরানের মোটেও ভালো লাগছে না! এমনিতেই সে রেগে আছে। তার উপর একে তো তার এই ধরনের কথাগুলো ভালো লাগছে না, অন্যথায় মুখের ভেতরটা দেখারও সুযোগ পাচ্ছে না। তাই সে-ও অতি রেগে আবারও একটা থাপ্পড় দিলো, যেটা আগের গুলোর মতো এতোটা জোরে নয়। নাফিসার কান্না আরও বেশি বেড়ে গেলো! সে কান্নার সাথেই এক হাতে পার্স থেকে ফোন বের করার চেষ্টা করতে করতে বললো,
– এখন আমি বাবার কাছে কল করে বিচার দিয়ে বলবো আমাকে নিয়ে যেতে। পেয়েছিস কি, যখন ইচ্ছে তখন মারবি! আর আমি চুপচাপ মার খেয়ে যাবো!
ইমরান তার দুই গাল চেপে ধরে বললো,
– এতো জেদ কেন তোর? কখন থেকে বলছি চুপ করতে! আর কখন থেকে বলছি মুখ দেখাতে! বেশি আস্কারার পরিনাম না এগুলো? এইজন্যই লাঠির আগায় রাখতে হয় এসব মেয়েদের! দেখি কিভাবে তুই ঘরে থেকে বের হোস! আর কিভাবে বাবার কাছে বিচার দিস!
ইমরান তাকে ছোটখাটো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে পার্স থেকে ফোনটা নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজা লাগিয়ে দিলো। নাফিসা কান্না করতে করতে দরজায় থাপ্পড়, লাথি দিতে লাগলো। খুব কষ্ট লাগছে ভেতরটা! পরপর তিনটা থাপ্পড় খেতে হলো বিনা কারণে! চোখের সামনে যা আছে সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তেমন কিছুই করলো না। শুধু হাতের পার্সটা বরাবর ছুড়ে মারলো, যেটা খাটে ড্রপ করে মেঝেতে পড়ে গেছে। বোরকা খুলে সে ফ্লোরে বসেই কান্না করছে।
এদিকে ইমরানেরও ভেতরটা বড্ড অশান্ত লাগছে নাফিসাকে মেরে! এতো জেদ করলে কি নিজের রাগ কন্ট্রোল করা যায়! বড় ঘরে থাকাকালীন যেই থাপ্পড়গুলো দিয়েছে, তার কারণেই ঠোঁটের ভেতরের দিক অথবা গাল কেটে গেছে। সেটাই ইমরানের ভাবনা। দেখতেও তো দিলো না জিদ্দি মেয়েটা! কান্নার শব্দ রুমের বাইরে চলে আসছে। খুব ব্যাথা পেয়েছে নিশ্চয়ই!
ইমরান জানালা থেকে একটু দূরে অন্ধকারে দাড়িয়ে নাফিসাকে লক্ষ্য করছিলো, অতি রেগে আবার উল্টাপাল্টা কিছু করে কি-না দেখার জন্য! যদিও সে ৮০ ভাগ নিশ্চিত, নাফিসা এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না যেটা হারাম! জিদ্দি হলেও তার মাঝে একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে। যার কারণে সে হালাল হারাম বেছে চলতে জানে। অপকর্ম সম্পর্কে নিজে বুঝে এবং অন্যকেও বেশ ভালো বুঝাতে পারে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে এমন নারী নিশ্চয়ই সুইসাইড জাতীয় কোনো কাজ করবে না।
“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৮৬
(নূর নাফিসা)
.
.
বেশ কিছুক্ষণ জানালার বিপরীতে দাড়িয়ে ইমরান মশার কামড় খেয়েছে। শুধু অপেক্ষা করছিলো কখন নাফিসা একটু শান্ত হবে। তাকে কাদতে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না! কিন্তু কি করার ছিলো! বিনা কারণে মাকে এভাবে বলা কি তার উচিত হয়েছে! এইটুকু বোধ তো তার মাঝে নিশ্চয়ই ছিলো। এভাবে কথা বললো কেন! এর কারণই বা জানবে কি করে! সে সামনে গেলেই তো জিদ্দি মেয়েটা পাগলের মতো আচরণ করে যাচ্ছে! রাগের মাঝেও রাগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে! জেদটা একটু কন্ট্রোল করে কি শান্ত ভাবে কথা বলতে পারে না!
ইমরান ভাবছে আর অন্ধকার উঠুনে পায়চারি করছে। এর মাঝে নিশাত এসে বই নিয়ে আবার বড় ঘরে চলে গেছে। এমনি ইশার আযান পড়ে গেছে। নামাজ পড়তে যেতে হবে। কিন্তু এর খেয়াল রাখবে কে! নিশাতকে ডাকবে! নিশাত এলে যদি সে সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে যায়! না, একাই থাকুক। একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ইমরান ওযু করে বারান্দার গেইটে তালা দিয়ে মসজিদে চলে গেলো। নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর এক ফুপাতো ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। সেখানে আবার কথা বলে কিছুক্ষণ সময় ব্যয় করলো। ফিরে এসে জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো নাফিসা একই জায়গায় বসে আছে। কান্নার শব্দ থেমে গেছে কিন্তু হেচকি উঠছে। দুই হাটু মুড়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। বাইরে আর এখন অন্ধকার নয়। আরমান বাসায় ফিরে বাইরের লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। ইমরান তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই নাফিসা তার দিকে তাকালো। সাথে সাথেই দৃষ্টি সরিয়ে চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাড়ালো সে। পায়ে ভেজা অনুভব করতে পেরে ইমরান ফ্লোরের দিকে লক্ষ্য করে দেখলো ঘরে থু থু ফেলেছে নাফিসা। রক্ত মিশ্রিত লালা। এদিকে নাফিসা দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছে। ইমরান জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছো?” কিন্তু নাফিসা কোন জবাব দিলো না৷ ইমরান দরজার কাছে এসে দাড়িয়ে দেখলো নাফিসা বাথরুমে যাচ্ছে। তাই সে আবার রুমে চলে এলো। পাপোশ দিয়ে ফ্লোর মুছে জানালা লাগিয়ে দিলো। নাফিসার পার্স, বোরকা তুলে আলমারিতে রাখলো। অত:পর টিশার্ট খুলে ফ্যানের নিচে বসলো। প্রায় দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে নাফিসা এখনো রুমে আসেনি। সে নাফিসাকে খুজতে এসে বাথরুমে পেলো না! তাহলে কি বেরিয়ে গেছে! গেইট তো ভেতর থেকে লাগানো দেখা যাচ্ছে! অত:পর নিশাতের রুমের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো ভেতর থেকে দরজা বন্ধ! ব্যর্থতার এক নিশ্বাস ছেড়ে ইমরান দরজায় নক করলো। কিন্তু এতে কোনো লাভ হলো না।
সে নিজের রুমে এসে বই নিয়ে বসে রইলো কিন্তু পড়ায় মন বসছে না। যদিও এতোক্ষণে নাফিসার প্রতি তার রাগ চলে গেছে তবুও নাফিসাকে ব্যাথা দিয়েছে যেহেতু এখন রাগ না ভাঙানো পর্যন্ত শান্তি নেই তার! কিন্তু সেই সুযোগটাই তো পাচ্ছে না! এদিকে আরমানের ডাক পড়লো ডিনার করার জন্য। ইমরান বলে দিলো পরে খাবে। একটু পর আবারও ডাক পড়লো নিশাতের, ইমরান তখন নিশাতকে এ ঘরে আসতে বললো। বইয়ের কথা বলে কৌশলে নাফিসাকে ডাকতে বললে নিশাত তা-ই করলো। বেশ কয়েকবার ডাকলো কিন্তু নাফিসা সাড়া দিলো না! নিশাত যখন বললো, “ভাবি, দরজা খুলো। বই নিবো আমি। পড়তে হবে তো!” অতপর নাফিসা দরজা খুলে দিলো। নিশাতের সাথে সাথেই ইমরানও প্রবেশ করলো রুমে। নিশাত খেতে যাওয়ার জন্য বললে নাফিসা দ্রুত এসে খাটে শুয়ে পড়লো। ইমরান তার হাত ধরে টানলো উঠার জন্য, কিন্তু সে উঠলো না। অবশেষে ইমরান বললো,
– নিশাত, তুই কিছু দেখছিস?
– কি?
– এখন তুই কিছুই দেখবি না কিন্তু।
নিশাত প্রথমে না বুঝতে পারলেও এবার কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে মুখ চেপে হেসে টেবিলে নিজের কাজে মনযোগ দিলো। ইমরান হুট করেই নাফিসাকে শোয়া থেকে কোলে তুলে বেরিয়ে যেতে লাগলো! নাফিসা অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না, শুধু ছটফট করছে! ইমরান বললো,
– আরে! করছো কি! এখনই তো পড়ে যেতে!
তবুও নাফিসার ছটফট থামেনি! ইমরান যতদ্রুত সম্ভব রুমে চলে এলো। নাফিসাকে খাটে নামিয়ে দিয়ে বললো,
– ধুর, নামো! লম্বা মেয়েদের কোলে নেয়া যায় নাকি!
নাফিসা বিছানা ছেড়ে নেমে যেতে যেতে বললো,
– আমি বলেছি নাকি কাউকে কোলে নিতে!
ইমরান দরজা লাগিয়ে নাফিসার হাত ধরে বললো,
– বারবার ইগনোর করা কারোই পছন্দ হয় না। আমরা ঠান্ডা মেজাজে কথা বলি?
নাফিসা হাত ছুটানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছে! তার চোখে অটোমেটিক পানি চলে এসেছে। ইমরান বললো,
– নাফিসা, কথা শুনো।
– কোনো কথা শুনবো না আমি। আপনাদের এ বাড়িতে থাকতেও চাইনা আর!
– কেন, কোথায় যাবে?
– যেদিকে খুশি যাবো। কারো খেলনার পুতুল হয়ে থাকতে পারবো না এ বাড়িতে, আর না পারবো একজনের হাত থেকে অন্যজনকে রক্ষা করতে। আমি কোনো মহৎ কিছু নই, যে হাতের ইশারায় সব ঠিক করে দিবো! আমিও সাধারণ একজন মানুষ।
– এসব কেন বলছো! আমি তোমাকে বউ করে নিয়ে এসেছি।
– বউ? বউ করে এনেছেন কেন? দিনরাত নির্যাতন করতে? আপনার ভালোর জন্য কাজও করে দিবো আমি আবার আপনার হাতের মাইর ও খাবো! এতোটাই অসহায় হয়ে পড়েছি পৃথিবীতে? যেন আপনি আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে আশ্রয় দিয়েছেন!
– কথা কোন দিক থেকে কোন দিকে নিয়ে যচ্ছো! আমি কি বলছি আর তুমি কি বলছো এসব!
– কোনো কিছু বলতে চাই না। হাত ছাড়ুন! আমার পথে কাটা হয়ে আসবেন না।
– আমি তোমার পথের কাটা?
নাফিসা কোনো জবাব দিলো না। চুপচাপ শুধু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। নিশাত খেতে যাওয়ার জন্য বললে ইমরান বলে দিলো খাবে না। আর যেন না ডাকে কেউ। নিশাত চলে যেতেই ইমরান বললো,
– এতো জেদ করো কেন? আমি কি শুধু শুধু তোমাকে মেরেছি? হুম? সবসময় জেদ করলে চলে?
– আমার ইচ্ছে হয়েছে জেদ করেছি, তাতে আপনি বলার কে!
ইমরান নাফিসার এক গালে ঠোঁট ছুয়ে দিতেই নাফিসা খুব জোরে তাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
– খবরদার, আমাকে স্পর্শ করবি না তুই! সবকিছু জেনেশুনে ওই দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য আমার গায়ে হাত তুলেছিস, আবার বলছিস শুধু শুধু মারিস নি? ওই মেয়ে আমাকে চোরের অপবাদ দিয়ে যাচ্ছিলো আর তুই তাকে কিছু না বলে আমাকে মেরেছিস! কেন? আমি সবটা জানাই নি তোকে? সব কিছু শেয়ার করিনি? তাহলে কেন আমাকে চোরের অপবাদ দিয়ে মারলি! আমি ফোন চুরি করেছিলাম!
ইমরান অবাক হয়ে আছে তার কথায়! সে বিস্ময়ের সাথে বললো,
– জেরিন তোমাকে চোরের অপবাদ দিয়েছে?
– আমাকে এতোক্ষণ মেরে সাধু সাজতে আসছিস এখন আমার কাছে!
– আমি তোমাকে জেরিনের জন্য মারিনি৷ মেরেছি মায়ের ব্যাপারে তুমি এভাবে কথা বলেছিলে কেন? কি করেছে আমার মা, বলো? কি করেছে, যার ফলে তুমি মাকে বকে এলে?
– উল্টাপাল্টা কথা আমি মোটেও সহ্য করতে পারি না। আপনার মাকে আমি কখন বকেছি?
– জেরিনের সাথে তুলনা করলে কেন? যেমন ফুপু তেমন ভাতিজি! বলোনি এটা? জেরিন ভালো না মানছি, মায়ের কি দোষ ছিলো?
– আমি আপনার মাকে বলেছি, নাকি আপনার ওই ডাইনী খালাকে বলেছি!
– মুখ সামলে কথা বলো। অন্যের কর্মের জন্য নিজের মুখ খারাপ করো না। মানুষ যেমনই হোক উনারা গুরুজন।
– কিসের গুরুজন হু? যে নিজের সম্মান ধরে রাখতে পারে না, অন্যের উপর দিনরাত নির্যাতন করে কিসের গুরুজন সে! সে যদি গুরুজন হয়ে থাকে তো ছোটদের সাথে এতো বাজে আচরণ কিভাবে করতে পারে! সে তো নিজেই জানে না কাকে সম্মান করতে হয় আর কাকে স্নেহ! তাহলে তাদের গুরুজন কিভাবে মানবো! নিজের সংসার তো জ্বালিয়ে দিচ্ছেই সাথে এখানেও আগুন ধরাচ্ছে। তার ডুবলিকেট হয়ে জন্মেছে আরে পিশাচী!
ইমরান তার খালার ব্যাপারে আর কিছু বললো না। কেননা সে জানে তার খালা একটু ভিন্ন স্বভাবের মহিলা। নাজিয়াকে মানসিকভাবে যখন নির্যাতন করতো আরাফ সব শেয়ার করতো ইমরানের কাছে! নিজের মা বলে আরাফই সেই সময় গুলোতে চুপ করে থাকতো! তাই ইমরান সেই প্রসঙ্গে কিছু না বলে অন্যকথায় বললো,
– মা ও তো জেরিনের ফুপু। তুমি যে এভাবে বলেছো, মা কি কষ্ট পায়নি!
– মা কষ্ট পেয়েছে সেটা দেখলেন, আর আমাকে যে এই মায়ের সামনেই যা তা বলে যাচ্ছিলো সেটা কারো নজরে পড়লো না!
– দোষ তো তোমারই! আমি যে সেখানে গিয়ে বললাম কি হয়েছে, তার জবাব কি আমাকে দিয়েছো? তখন যদি বলতে জেরিন তোমাকে চোরের অপবাদ দিয়েছে তা হলে তো আর এতো কিছু ঘটতো না! জেরিনের স্পর্ধা দেখে নিতাম!
– হু, এতোদিন দেখে দেখে উল্টাইছেন আর এখন পাল্টাইতেন! আড়ালেই শুধু ডবডব! আর প্রকাশ্যে বউ পিটিয়ে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া!
– আমি কিন্তু জানতাম না এসব কিছু! যদি জানতাম তো কখনোই হাত তুলতাম না তোমার উপর।
– তো না জেনে শুনে আমার উপর হাত তুললেন কি করে! লজ্জা করে না আবার এরকম কথা বলতে!
– তুমি বরাবর তোমার জেদের কারণে মাইর খাও! একটা কথাও শুনো না কেন? বারবার এভয়েড করলে কার রাগ না ওঠে! বলো?
– আমি বরাবর জেদ করি, তার জন্য আমার বাবা মা আমাকে এতোবছরেও এভাবে মারেনি আর দুদিনের সম্পর্কে আপনি যুগ যুগের অধিকার নিয়ে আসছেন শাসন করতে!
কথাটা ইমরানের বুকে বিধলো। তবুও এ নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া না করে সে বললো,
– তুমি বাবামায়ের সামনে হয়তো এমন কোনো আচরণ করোনি তাই এতোটা শাসন বাবা মা করেনি তোমাকে।
নাফিসা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে আবার বেরিয়ে যেতে লাগলো। ইমরান তাকে নিজের কাছে আটকে রেখে অপর গালে ঠোঁট ছুয়ে দিতেই নাফিসা আবারও তেড়ে বললো,
– ছাড় আমাকে! তোর ভাবির কারণে মেরেছিস আমাকে, তোর ভাবির কাছেই যা। একদম টাচ করবি না!
– বউ থাকতে ভাবির কাছে যাবো কেন, হুম! সবকিছুর মূলে তো তুমি! আগেই জানতাম কোনো না কোনো একটা গন্ডগোল ঠিকই বাধবে! বলেছিলাম না ভাইয়াকে দেখাই, দিয়েছো দেখাতে?আর ফোন আটকিয়েছো যেহেতু রিটার্ন করলে কেন? সুযোগ দিবে তুমি, দাও আরও সুযোগ! সেও সুযোগে সৎ ব্যবহার করে যাক! তারউপর তখনও জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে, আমাকে ইগনোর করে জেরিনের সাথে তর্ক করেই যাচ্ছো! তখন বললে কি আমি জেরিনকে এমন সসম্মানে রেখে আসি! লোহা গরম থাকতে না পেটালে কি কাজ হয়? যথাসময়ে কাজ কেন করতে পারো না! উল্টাপাল্টা বললে থাপ্পড় দিবো না তো কি করবো!
– সবটা না জেনে তুই ওই ফাজিলের সামনে আমাকে মারলি কেন! এখন তার কাছেই যা। কোনো কথা বলবি না আমার সাথে! ছাড়তে বলেছি, ছাড়!
ইমরান তার সাথে জড়িয়ে নিয়ে বললো,
– উহুম। আর মারবো না, সরি।
– সরি মাই ফুট! ছাড়!
নাফিসা তার বুকের উপর একটা খামচি বসিয়ে দিতেই ইমরান তার হাত ধরে বললো,
– ওফ্ফ! কি করছো! ব্যাথা পাচ্ছি তো!
– ওহ্, আমি মারাতে ব্যাথা লাগে আর আমাকে থাপ্পড় মারলে বুঝি ব্যাথা লাগে না আমার?
– অনেক ব্যাথা পেয়েছো?
– ঢং দেখাতে আসছিস! এসব ঢং আমি দেখতে পারি না। দূর হো…
– সরি। তখন মেরেছি এবার একটু আদর করে দেই হার্টবিটকে? ব্যাথা চলে যাবে। হুম?
নাফিসা নিজেকে ছাড়াতে ইমরানের পায়ে পা দিয়ে মেরে বললো,
– আদর ইজ মাই ফুট! তোর আদর তুই খা বেশি করে! আমার কাছ ঘেষবি না একদম! তোর সাথে আর এক মুহূর্তও নেই আমি। মেরেছিস না আমাকে, এর একটা কঠিন বিহিত করে ছাড়বো। দেখে নিস!
ইমরান দরজার ছিটকিনি উপর থেকে লাগিয়ে দিয়ে বললো,
– এদিকে কোথায় যাচ্ছো! ঘর থেকে বের হলে আদরের পরিবর্তে এখন বাদড় ফেস করবে তুমি। একই কথা বারবার বলতে হচ্ছে! এক পা ও বাইরে রাখবে না!
নাফিসা কান্নার সাথে জেদ নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। অসহ্য লাগছে সব! ইমরান বললো,
– খাবার এখানে নিয়ে আসি?
– তোদের খাবার তুই খা বেশি বেশি, আর তোর ভাবিকে খাওয়া গিয়ে। যা।
তার পাগলীটা ক্ষেপেছে বেশ, আজ বুঝি সে শেষ! তবুও তার লক্ষ্য এখন একটা, তা হলো নাফিসাকে শান্ত করা। যদিও জানে তার না জেনে মারাটা ঠিক হয়নি, কিন্তু একটা কথাই তো তাকে রাগিয়ে দিয়েছিলো তখন! যার জন্য সাথে সাথে হাত তুলতে বাধ্য হয়েছে।
ইমরান ছিটকিনি খুলে অল্প সময়ের জন্য বড় ঘরে গেলো এবং খালি হাতেই চলে এলো। বারান্দার গেইটে তালা লাগিয়ে রুমে এসে দেখলো নাফিসা বালিশে মুখ চেপে কান্না করছে। এই কান্না যে আর সহ্য হচ্ছে না! এতোক্ষণ কান্না বন্ধ ছিলো সেটাই ভালো ছিলো! ইমরান মশারী টানিয়ে দিলে নাফিসা লাথি দিয়ে মশারী সরিয়ে সে মশারীর বাইরে শুয়ে রইলো। এতোটা কিনারায় শুয়েছে, একটু মোড় নিলেই সরাসরি মেঝেতে! ইমরান তাকে টেনে মশারীর ভেতর নিতে চাইলে ঠিক সেটাই ঘটলো! ইমরানের খুব রাগ হচ্ছে! এভাবে পড়েছে ব্যাথা তো নিশ্চয়ই পেয়েছে!অতপর জোর করেই বিছানার মাঝামাঝিতে আনতে বাধ্য করলো! আর যা-ই হোক, একজন পুরুষ মানুষের শক্তির কাছে মেয়েদের হার মানতেই হবে, তাছাড়া নাফিসা এখন হাতে ব্যথা পেয়েছে! কিন্তু ইমরানের কাছ থেকে মুক্তি পেতে তার প্রচেষ্টা চলছেই!
– হচ্ছে কি এসব! পড়ে ব্যাথা পেয়েছো না? জেদ করে এভাবে নিজের ক্ষতি কেন করছো! আমি মেরেছি বলেই এমনটা করছো? তো আমাকেও মারো। যোগ বিয়োগে সব সমান হয়ে যাবে।
– একটা কথাও বলবি না আমার সাথে। একটুও আসবি না আমার কাছে! সকাল হতে দে, তোর বাড়িতে আর এক মুহূর্তও কাটবে না আমার।
– তুই চলে গেলে আমি থাকবো কাকে নিয়ে! ভালোবাসি তো জানপাখিটাকে!
নাফিসা একের পর এক খামছি দিয়ে যাচ্ছে ইমরানের শরীরে। আর বিপরীতে ইমরান এবার রেগে নয়, বরং আদরে রাগ ভাঙাচ্ছে। একটুও “উফফ” শব্দ করছে না প্রথম বারের মতো! বাধাও দিচ্ছে না নাফিসার হাত ধরে! ইমরানের ধৈর্য শক্তি দেখে এক পর্যায়ে নিজেই হার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে নাফিসা! নখ এবং দাতে এতোগুলো আঘাত করলো তবুও তার উপর একটু বিরক্ত হলো না! বরং বিপরীতে আদর করে গেছে! নাফিসা আর অভিমানে থাকতে না পেরে ইমরানকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেদে উঠলো! এটা দুখের কান্না নাকি অভিমান ভাঙার কান্না বুঝা দায় হয়ে পড়েছে ইমরানের কাছে! আবারও বিরতিহীন বেশ কিছুক্ষণ কাদলো নাফিসা। যখন আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে নাফিসার ঠোঁটের ছোয়া পড়লো তখন ইমরান প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললো! অনেক প্রচেষ্টার পর অবশেষে সে সফল হলো তাহলে!
চলবে।