তৃ-তনয়া পর্ব-৯৩+৯৪+৯৫

0
758

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৩
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে ঘুমানোর সময় নাফিসা আলসেমি করে মশারী বিছানায় গুজে দেয়নি। ইমরান বললে সে উল্টো ইমরানকে বললো। সে এমন আলসেমি করায় ইমরানও আলসেমি করে শুয়ে রইলো।
ইমরানের হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে নাফিসা। হঠাৎই খুব কোমলতা অনুভব করলো সে। খুব তুলতুলে নরম কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে তার হাত। ঘুমে থেকেই অনুভব করতে পারছে ইমরানের কনুই ভাঙা এক হাত তার মাথার নিচে, অন্যহাত তাকে জড়িয়ে রেখেছে। আর পা তো পায়ের ধারেই, তাহলে নাফিসার হাতে এমন স্পর্শ কে করছে! তাও এতোটা তুলতুলে! মৃদু স্বরে “মেও” শব্দ হতেই নাফিসা চমকে উঠে চোখ খুলে তাকালো। তার হাতের উপর কালো বিড়াল শুয়ে আছে! চোখের সামনে কালো বিড়াল দেখে সে চিৎকার করে উঠলে ইমরানের ঘুম ভেঙে গেলো! আর বিড়াল এক লাফে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে পালানো! ইমরান চোখমুখ কুচকে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে?
নাফিসা তার হাত ইমরানের শরীরে ঘষতে ঘষতে কান্নার সাথে বললো,
– বি..বিড়াল আমার হাতে শুয়ে ছিলো! আ…উহু… উহু!
ওদিকে বিড়াল মেঝেতে দাড়িয়ে আবার “মেও” শব্দ করলে ইমরান তাকালো এবং হেসে উঠলো! তার হাসিতে যেন নাফিসার কান্না আরও বেড়ে গেছে! ইমরান হাসতে হাসতে বললো,
– বলেছিলাম না মশারী দিতে! শুনেছিলে? যা হয় ভালোর জন্যই হয়! তুমি আমার হাতে ঘুমাচ্ছিলে আর বিড়াল তোমার হাতে! ভালোই তো..!
নাফিসা কান্না করতে করতে ইমরানকে ঠেলে উঠে বসলো। মশারী ভালো করে বিছানায় গুজে দিয়ে তারপর বালিশে শুয়ে পড়লো। সে হাত চুলকাতে চুলকাতে এখনো কাদছেই আর ইমরান হাসছেই! অত:পর ইমরান হাসি থামিয়ে বালিশ থেকে তাকে কাছে টেনে নিলো। নাফিসা তাকে সরাতে চেয়েও ব্যর্থ! ইমরান তাকে এভাবে হাত চুলকাতে দেখে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
– চামড়া ছিলে যাবে তো! কিছু হবে না, ঘুমাও।
– উহু..! আমার কেমন কেমন যেন লাগছে!
– আরে, কিছু হবে না। মানুষ বিড়ালকে কোলে নিয়ে ঘুমায় আর তুমি এইটুকুতে চামড়া কেটে ফেলছো!
– ছি! আমি কখনো ধরিই নি! মুরগী ধরতেই ভয় পাই আবার বিড়াল!
– মুরগী পালক আবার মুরগী ধরতেও ভয় পায়!
– খামারের ভদ্র মুরগী ধরতে পারি, কিন্তু দেশী অভদ্র মুরগী একদম না!
ইমরান হেসে বললো,
– আরেকবার চুলকাতে দেখলে এখন বিড়াল ধরে এনে বিড়ালের সাথে বেঁধে ঘুম পাড়িয়ে দিবো! ঘুমাও চুপচাপ!
সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় নাফিসার চোখ পড়লো ঘরের কোনে মাঝারি আকৃতির লিচু গাছের দিকে! গাছ ভর্তি লিচু! সে একটু এগিয়ে গেলো। গাছের তুলনায় এতো বেশি লিচু দেখে যেন আত্মহারা হয়ে গেছে! লিচু গাছ দেখেছে, ঝুলন্ত লিচুও দেখেছে। কিন্তু গাছভর্তি লিচু এই প্রথম দেখা! সে ক্ষণিকের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো দিনাজপুর লিচুর জন্য বিখ্যাত! যেটা এখন মনে পড়লো! যদিও লিচু খাওয়ার উপযুক্ত হয়নি কিন্তু তার মাঝে খুব উৎফুল্লতা কাজ করছে! সে ব্রাশ করা রেখে যতটুকু সম্ভব সবগুলো লিচু ছুয়ে দিলো! ইমরান বাথরুম থেকে বের হতেই নাফিসা তাকে ইশার করলো এদিকে আসার জন্য। ইমরান বুঝতে পেরে বললো,
– আমি থাকতে লিচুতে আকৃষ্ট হয়ে গেলে!
– ওফ্ফ! চুপ থাকো তো! আমার এত্তো ভালো লাগছে গাছটা ইচ্ছে করছে মাথায় তুলে রাখি!
– পারলে রাখো।
– আমার যদি এই গাছটা থাকতো না, একটা লিচুও ছিড়ে ফেলতাম না৷ পারলে সারাজীবন চোখের সামনে সাজিয়ে রেখে দিতাম! পলকে পলকে শুধু তাকেই দেখতাম! সব ছেড়ে দিনরাত শুধু তারই সেবা করতাম। আমি তো তার মায়ায় পড়ে গেছি!
– ওরে বাব্বাহ! গাছের সাথে এতো প্রেম!
– হুম! অনেক অনেক! এই, গাছটা কিনে নাও না! ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো যেকোনো ভাবে।
– মাথা খারাপ! পাগল হইছি তো এতো বড় গাছ উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাবো! আর যে প্রেম দেখলাম তোমার, সুব্যবস্থা থাকলেই নিয়ে যাবো না-কি! আল্লাহ জীবনেও এমন গাছ তোমার না করুক! তাহলে আমি শেষ!
নাফিসা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে ইমরান চলে যেতে যেতে বললো,
– ওযু করো এসে। আর গাছের উপর থেকে নজর উঠিয়ে আমার দিকে নজর দাও একটু।
নাফিসা ভেঙচি কেটে আবার লিচু স্পর্শ করলো। এমনি আবার শব্দ হলো, “মিও!” নাফিসা দেখলো লিচু গাছের গোড়ায় বসে আছে সেই কালো বিড়াল! ইচ্ছেতো করছে এক ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে দিতে! মাঝরাতে যেই ভয়টাই না দেখিয়েছে বিল্লু! মাথা না ফাটালেও সে ছোট ইটের টুকরো নিয়ে তাড়া করলো তাকে! নাফিসা নামাজ পড়ে বাইরে এসে লিচু গাছের সাথে সেল্ফি তুললো। আবার ঘরে যাওয়ার সময় দেখলো উঠুনে বসে শিপনের ভাতিজি সেই কালো বিড়ালকে ভাত খাওয়াচ্ছে! দেখে নাফিসার ঘিনঘিন লাগলো! তারা সকাল সকাল নাস্তা করার পর আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য তৈরি। শিপন, তার পাঁচ বছরের মেয়ে এবং ইমরানের সাথে নাফিসা যখন বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হচ্ছিলো তখন আবার দেখলো বিড়ালকে শ্যাম্পু দিয়ে ঘষেমেজে গোসল করানো হচ্ছে! এই বিড়াল কুকুর পোষণের ব্যাপারটা নাফিসার একদম ভালো লাগে না! দেখলেই ঘিনঘিন লাগে! হাটতে হাটতে নাফিসা বললো,
– আমরা গরুর গাড়িতে চড়বো কখন?
শিপন জবাব দিলো,
– বিকেলে চড়বেন ভাবি। বলে রাখছি একজনকে।
– অহ, আচ্ছা। কিন্তু কাল থেকে একটাও চলতে দেখলাম না কেন রাস্তায়! বিকেলেই কি সবাই বের হয়?
– উহুম। মানুষ তো প্রযুক্তির সাথে এগিয়ে চলেছে দিনদিন। যার ফলে পুরোনো ঐতিহ্য সব আজ বিলুপ্তির পথে। যেখানে সবকিছুই ইঞ্জিন চালিত, সেখানে আর গরুর গাড়ির প্রচলন থাকবে নাকি! যে-কোন ক্ষেত্রেই সবাই এমন দিক বেছে নেয় যেটায় কষ্ট কম হবে।
– হুম, আরাম প্রিয় মানুষ বাঙলার ঐতিহ্যকে প্রযুক্তির নিচে চাপা দিয়ে ফেলেছে। আমরা তো তা-ও দু’একটা দেখছি, নেক্সট জেনারেশন সেটাও দেখতে পাবে না।
কথা বলতে বলতে তারা মেইন রোডে এসে গাড়িতে উঠে গেলো। বিরল থেকে যাত্রা শুরু করলো ধর্মপুর ফরেস্টের দিকে। কিছু সময়ের জন্য আশপাশের জায়গা ঘুরে আবার চলে গেছে মহনপুর। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে এবার দীঘিপাড়া, রামসাগর জাতীয় উদ্যানে। অসম্ভব ভালো লাগছে নাফিসার। ঘুম কাটানোর জন্য এসেছে তারা আর ঘুম কি জিনিস সেটা যেনো একেবারেই ভুলে গেছে! মনে মনে ইচ্ছা পোষণ করে, সারাক্ষণ চোখ মেলে যেন এই প্রকৃতিই দেখুক! সারাক্ষণ প্রাণ ভরে শুধু এই প্রকৃতির ঘ্রাণেই মাতোয়ারা হয়ে থাকুক! জীবন কেন এতো ক্ষুদ্র! তা কি প্রকৃতির বিশালতার মতো বিশাল হতে পারে না? যুগ যুগ ধরে এই প্রকৃতি কেন চিরতরে মায়ায় জড়িয়ে মানব মনকে সতেজ রাখতে পারে না? ভালো লাগে না তো সেই ধুলাবালি, জ্যামময় জীবন! কেবল প্রকৃতির সাথে মিত্র হয়ে মিশে থাকতে ইচ্ছে করে সারাক্ষণ!
বাঙলার বেঁচে থাকা সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তারা সকাল ও দুপুর কাটিয়ে দিয়েছে! ঘুরাঘুরি করে তারা একটু লেট করেই লাঞ্চ করতে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো। রেস্টুরেন্টের নাম দেখে নাফিসা মুখ টিপে হাসলো। ফরমান ভাঙা হোটেল! ইমরানের চোখ যেন সারাক্ষণ নাফিসাকেই পর্যবেক্ষণ করে! যার ফলে এই মুখ টেপা হাসি দেখেও ব্রু নাচিয়ে হাসির কারণ জানতে চায়! নাফিসা ফিসফিসিয়ে ইমরানকে বললো,
– এতো সজ্জিত রেস্টুরেন্ট অথচ নাম ভাঙা হোটেল কেন! দুনিয়াতে নামের অভাব পড়ছে নাকি!
ফিসফিস করে বললেও শিপনের কানে চলে গেছে কথা। তাই শিপনই হেসে জবাব দিলো,
– আগে ভাঙা ছিলো, এখন জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাবি। কিন্তু নামটা জোড়া লাগাতে পারেনি, তাই সেটাই রয়ে গেছে৷
নাফিসা নিচু শব্দে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। মেয়েটার এতো দুষ্টুমি দেখে ইমরানের মুখেও লেগে আছে প্রশান্তির হাসি। ইমরান খাবার অর্ডার করলো। তারা গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলো। নসন দিঘির পাড় ঘুরে তারা এবার সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
আসরের আযান পড়ে গেছে। তারা বাড়িতে নামাজ পড়ে আবার বেরিয়ে গেলো নিজ এলাকায়। দেহ যেন একটু বিশ্রাম করতেও ভুলে গেছে! তবে এবার তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিপনের বউ এবং দুই বাচ্চা। সাথে বড় ভাইয়ের এক মেয়েও। গরুর গাড়ি আনা হয়েছে চড়ার জন্য। গাড়ির চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে বেশ পুরনো গাড়ি। কিন্তু পাকাপোক্ত! নাফিসার বেশ আনন্দ হচ্ছে নতুন কিছু দেখে! সারাদিন বোরকা হিজাব পড়ে ঘুরলেও এখন মাথায় ওড়নায় ঘোমটা টেনে থ্রিপিস পড়নে সে। গাড়িতে উঠে সামনের দিকে গরু সহিত এবং গাড়ির পেছন দিক থেকে ছবি তুললো ইমরান৷ সিঙ্গেল এবং কাপল উভয় ধরনের পিকই! বেড়াতে এসেছে, মুহূর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী না করলে সার্থকতা আছে নাকি! তবে নাফিসার বড্ড আফসোস হচ্ছে এই ভেবে, কেন সে শাড়ি পড়ে গ্রাম্য বধূ সেজে গরুর গাড়িতে চড়তে পারলো না! শখ জাগলেও তা পূরণ সম্ভব না। সে এই বেশেই সবার সাথে গরুর গাড়িতে চড়ে মজা করে পথঘাট ভ্রমণ করলো। মাগরিবের আজান পর্যন্ত তারা ঘুরাঘুরি করেছে। এরপর বাকি সময় বাসায় কাটিয়েছে। ইমরান সন্ধ্যায় বেরিয়েছিলো শিপনের সাথে, ইশার নামাজ পড়ে আবার ঘরে ফিরে এসেছে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৪
(নূর নাফিসা)
.
.
যৌথ পরিবারের আলোচনা সভা খুব ভালো লাগে নাফিসার। সন্ধ্যায় সব মহিলারা একত্রিত হয়ে চুলার পাশে বসেছে রান্না করতে। সাথে গল্পসল্পও চলছে বেশ! এখন রান্নাবান্না প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইমরান ঘর থেকে নাফিসাকে ডাকলো,
– নাফিসা, ফোন বাজে।
– কে?
– জানিনা। আননোন নম্বর।
– রিসিভ করো।
নাফিসা আসর থেকে উঠে ঘরে যেতে যেতে ইমরান রিসিভ করলো। সে সালাম দিয়ে “হ্যালো, হ্যালো” বলে যাচ্ছে কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো জবাব আসছে না! নাফিসা এসে জিজ্ঞেস করলো,
– কে?
ইমরান ফোন এগিয়ে দিয়ে বললো,
– কি জানি! কথা বলে না!
নাফিসাও সালাম দিলো কিন্তু ওপাশে নিরব! আশপাশের কোনো শব্দও নেই যে বুঝে নিবে ভুলে এসেছে! নাফিসা বিরক্ত হয়ে বললো,
– আশ্চর্য! কথা বলবেন না যেহেতু কল দিয়েছেন কেন! যত্তসব ফাউল মার্কা!
নাফিসা টুট করে কল কেটে দিলো! ফোন ইমরানের কাছেই রেখে আবার চলে গেলো। ডিনার করে আবার কথা বললো নিশাত ও বড়মার সাথে। নিশাত জানালো আজ মা এবং চাচ্চুকে না পেয়ে অনেক কান্না করেছে জিহান। আরমানও বাসায় ফিরেছিলো একটু দেড়ি করে। এসে দেখে কাঁদতে কাঁদতে কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়ে পড়েছে। জিহানের অবস্থার কথা শুনে অটোমেটিক নাফিসার চোখে পানি এসে গেছে! জিহান এতোটা ছোট নয় যে দু চারদিন গেলে সে মাকে ভুলে অন্যদের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। মাকে চেনার মতো যথেষ্ট স্মরণশক্তি আছে তার এই বয়সে। বছর পেরিয়ে গেলেও সে পরিবারকে চিনবে। তার বয়সটাই এখন এরকম।
মা-বাবা ও আপুদের সাথে নাফিসার কথা হয় সকালের দিকে। সকালে ব্যস্ত থাকলে যখন ফ্রী হয় তখন। এখন নিশাতের সাথে কয়েক মিনিট কথা বলে নাফিসা ফোন রেখে দিলো৷ ইচ্ছে করছে নিজের মতো করে সব সাজিয়ে দিতে। সবাই যাতে সুখে থাকতে পারে। কিন্তু সে চাইলেই কি হবে! তার কথায় কি জগৎ চলবে! ভিন্ন জনের ভিন্ন মত! জিহানের জন্য হলেও জেরিন ফিরে আসুক, সেটা সে চাইলেও বাকিরা চাইবে না। অবশ্য সে এমন জঘন্য কাজ করেছে, না চাওয়াটাই স্বাভাবিক!
বাকিটা সময় কাটলো বিষন্নতায়! যতক্ষণ না চোখে ঘুম নেমে এসেছে ততক্ষণ শুধু জিহানের মায়াবী চেহারাটাই চোখের সামনে ভেসেছে! মনের সাথে চোখও কেদেছে, কিন্তু অশ্রু গড়ানোর আগেই তা মুছে ফেলেছে। যাতে ইমরান বুঝতে না পারে। যদিও ইমরান তার মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখে জিজ্ঞেস করেছিলো কিছু হয়েছে কি-না। উত্তরে নাফিসা “না” বলেছিলো।
সকালে আজ তারা নিজ এলাকায় ঘুরতে বেরিয়েছে। নাফিসা, ইমরান, শিপন এবং তার বউ, সাথে তার ছোট বাবুটাও। কথা বলতে বলতে হাটছে তারা। শিপন তাদের এক বাড়িতে নিয়ে গেলো দেশের বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী নীলগাই দেখার জন্য! পৃথিবী থেকে অনেক জীবজন্তুই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং এখনো হচ্ছে! এই নীলগাইও আজ বিলুপ্তির পথে। কিন্তু এর অস্তিত্ব ধরে রাখতে নীলগাই সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা চলছে দিনাজপুরে। কখনো দেখেনি নাফিসা, আজই প্রথম দেখা! ইমরানও নাম শুনেছে কিন্তু সামনাসামনি দেখেছে আজ প্রথম। তারা ছবি তুললো নীল গাইয়ের, যারা লালন পালন করছে তাদের সাথেও টুকটাক কথা বললো ইমরান এবং শিপন। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা আবার এলাকার পথ ধরে হাটতে লাগলো। দুপাশে ফসলের মাঠ, মাঝে ছোট ছোট যান চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা। পূর্বদিক থেকে মৃদু বাতাস বইছে। বেশ ভালো লাগছে পরিবেশটা। নেই কোনো যানজট আর নেই কোনো কোলাহল! আছে শুধুই প্রকৃতির স্নিগ্ধ নীলাচল!
তারা ছোট ব্রিজটার উপর দাড়িয়েছিলো। ব্রিজ আছে অথচ নিচে কোনো খাল-বিল নেই! মাটি দেখা যাচ্ছে যেখানে ঘাসে ভরপুর। হয়তো বর্ষার পানি আসা-যাওয়ার জন্যই ব্রিজটি তৈরি।
বাবুর জুতা খুলে গেছে, সেটাই ঠিক করছে তার বাবা মা। আর নাফিসা ও ইমরান রেলিংয়ে হেলান দিয়ে একপাশে দাড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে সবুজ ধান ক্ষেতের দিকে। যেখানে মৃদু বাতাস ঢেউ খেলে যাচ্ছে ঘাসে ঘাসে! নাফিসা ইমরানকে বললো,
– আবারও গরুর গাড়িতে চড়তে ইচ্ছে করছে।
– এটা অটো রিকশা নয় যে এবেইলএবল পাবে! কাল কতোক্ষণব্যাপী ঘুরলে শখ মিটেনি!
– উহু।
– গরুর উপর বসানো উচিত ছিলো, তাহলে শখ মিটে যেতো!
নাফিসা ভেঙচি কেটে নিজের ফোনে গতকালের তোলা ছবি দেখতে লাগলো। ছবির দিকে তাকিয়েই বললো,
– জানো, একটা কারণে খুব আফসোস হয়েছিলো তখন। আমি যদি গ্রাম্য বধূর ন্যায় শাড়ি পড়ে গরুর গাড়িতে চড়তাম খুব ভালো দেখাতো না?
ইমরান মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ঝকঝকে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাফিসার দিকে! এভাবে তাকাতে দেখে নাফিসা ব্রু নাচাতেই ইমরান বললো,
– বাস্তবে তো সম্ভব নয়, তবে আমি অলরেডি কল্পনা করে ফেলেছি তোমাকে কেমন লাগতো। আর এটাও কল্পনায় এসেছে যে তুমি তখন নিশ্চয়ই আমাকে গাড়ি চালাতে বলতে আর নিজে আরামে বসে বসে গান ধরতে “তোমার গরুর গাড়িতে আমি যাবো না, না নানা নানানা না…”
নাফিসা হেসে উঠলো। ইমরান বললো,
– চলো সামনে যাই..
তারা আরও সামনে হাটতে লাগলো। হঠাৎই দেখা পেলো বৃহৎ সেই স্থলচর প্রাণীর! এখানেও সে! ঘন্টি বাজিয়ে হাতি আসছে এদিকেই। পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে কিছু বাচ্চাকাচ্চা! নাফিসা ভয়ে ইমরানের হাত চেপে ধরলো! ইমরান বললো,
– ভয় পেও না, কিছু করবে না।
ইমরানের এই সান্ত্বনা কি কোনো কাজে লেগেছে! নাফিসা তো ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে! এমন জায়গায় এসেছে, আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই যে টুপ করে ঢুকে পড়বে! দুপাশে শুধু ধান ক্ষেত! কেবল পেছনের রাস্তাই খোলা তাদের জন্য! কিন্তু এতোটা পথ ফিরে যাবেই কিভাবে! দৌড়ে গেলে যদি হাতিও পিছু পিছু দৌড় দেয়! তাহলে তো সে শেষ! ইমরান আর শিপন পড়লো মুশকিলে! শিপনের বউও ভয় পাচ্ছে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে! তাই তারা ভাবছে কি করা যায়! এখন কি আবার ফেলে আসা পথে ফিরে যাবে! নাকি রাস্তার একপাশে দাড়িয়ে থাকবে! এদিকে হাতি ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। এতোক্ষণ একটা দেখা যাচ্ছিলো। এখন সাথে আরেকটা বাচ্চাও আছে! এই সরু রাস্তায় দুইটা একসাথে হাটলে তো আর জায়গাই খালি থাকে না! নাফিসা আর তাদের ভাবনার অপেক্ষায় না থেকে জুতা হাতে নিয়ে ঢালু বেয়ে ধান ক্ষেতে নেমে গেলো! ইমরান বললো,
– সাবধানে, কাটা ফুটবে!
নাফিসা আর তার সাবধানতা অবলম্বনে নেই। সে যতদ্রুত সম্ভব নেমে গেলো! তাকে দেখে শিপনের বউও বাচ্চাকে নিয়ে নেমে গেলো। নাফিসা দিকবিক না তাকিয়ে আইল ধরে হাটতে হাটতে দুই ক্ষেত পেরিয়ে গেছে। ইমরান আর শিপন রাস্তায়ই দাড়িয়ে আছে। হাতি নিকটে এলে তারা লোকের সাথে কথা বলছে। নাফিসা আর দাড়িয়ে না থেকে ভাবির সাথে কথা বলতে বলতে হাটতে লাগলো। ইমরানের জোরে হাক পড়লে সে চমকে পেছনে তাকালো। দেখলো দুজনেই হাতির উপর বসে আছে! নাফিসা অবাক হয়ে আবার রাস্তার নিকটে এলো। সে নিচ থেকেই ছবি তুললো তাদের। অত:পর হাতি চলতে লাগলো, আর তারা চড়তে। নাফিসা ছবি তুলে আবার ভাবির সাথে হাটতে লাগলো। এমনি ফোন বেজে উঠল। আরাফ কল করেছে৷ নাফিসা রিসিভ করে সালাম দিলো।
– আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ। ঘুরাঘুরি কেমন লাগছে?
– নতুন জায়গায়, বেশ ভালোই কাটছে সময়।
– কবে ফিরছো?
– কাল।
– ইমরান কোথায়?
– রাস্তায়, হাতির পিঠে।
– ভালোই তো! আর তুমি?
– আমি হাতির ভয়ে ধান ক্ষেতের আইলে!
আরাফ হেসে উঠলো। পরক্ষণে বললো,
– জেরিন কল করেছিলো তোমার কাছে?
– না তো!
– আমার কাছে প্রতিদিনই কল করে, ওবাড়ির কথা বলে বলে কান্না করে। আরমান নাকি ডিভোর্স পেপার রেডি করছে।
– ভাইয়া, আমার ভালো লাগছে না এসব! জিহানের কথা মনে হলেও একদমই ভালো লাগে না! প্রতিদিন কান্না করে ছেলেটা। ভাবিকে মারতে দেখে ভাইয়াকেও ভয় পায় সে! চাই তো সবাই ভালো থাকুক। কিন্তু তার চরিত্রের কারণে আজ সবার চোখেই নিচু হয়ে গেছে সে! আমিও পারছি না তার পক্ষ নিয়ে সাহস করে কাউকে কিছু বলতে!
– দেখি, আজ সন্ধ্যায় যাবো আমি আরমানের সাথে কথা বলতে। জেরিন তোমার ফোন নম্বর নিয়েছিলো কাল, কল দিবে বলে। তাই জানতে চাইলাম কথা হয়েছে কি-না।
নাফিসার মনে হলো সেই আননোন নম্বরের কথা! সেটা গোপন রেখেই নাফিসা বললো,
– না হয়নি। ভাইয়া একটা কাজ করলে কেমন হয়, জিহানকে যদি আপনাদের বাড়িতে নিয়ে ভাবির সাথে একটু সাক্ষাৎ করান! এতোদিন মাকে দেখে না, বাচ্চাদের তো বন্দী করে এতোটা প্রেশারে রাখা যায় না। হয়তো এতে ভালো লাগবে উভয়েরই!
– ঠিকই বলেছো। জেরিন পরশু এসেছিলো বাড়িতে।
– হ্যাঁ, আপু বলেছিলো। আপুর সাথে কথা বলে কান্নাও করেছে নাকি।
– হ্যাঁ। দেখি আশিককে পাঠিয়ে নিয়ে আসতে পারি কি-না জিহানকে। আমি তো স্কুলে। জেরিনকেও কল করে বলে দিবো আসতে।
– হুম, এটাই করুন।
– আচ্ছা, রাখি এখন। ভালো থেকো।
নাফিসা এতোক্ষণ কথা বলতে বলতে হাটছিলো। কল কেটে পেছনে ফিরে ইমরানকে দেখতে পেল তার নিকটে! রাগান্বিত হয়ে আছে চেহারা! আর শিপন ও তার বউ পানির ড্রেনের কাছে পা ধুয়ে নিচ্ছে। ইমরান বললো,
– ভাবতেই অবাক লাগে অযথা তোমাকে নিয়ে আমি এতোটা ভাবি! এতোটা স্টুপিড কি করে হতে পারো তুমি আমি সেটাই ভেবে পাই না! যে তোমাকে মারতে বসেছিলো তুমি তাকেই আবার ঘরে তুলতে চাইছো! ভাইয়ার চেয়েও বেশি দরদ তোমার? ভাইয়া নিজেই চায় না তাকে এক্সেপ্ট করতে আর তুমি!
নাফিসা মলিন স্বরে বললো,
– আমি তো তাকে বাড়ি আসতে বলিনি। জিহানের সাথে একটু দেখা করানোর কথা বলেছি শুধু! ছেলেটা মাকে ভেবে কান্না করে প্রতিদিন।
– তোমার জন্য আরও এরকম! তুমি মনে করিয়ে দেও বলেই কান্না করে সে৷
– আমি মনে করিয়ে দেই! বাচ্চা তার মাকে ছাড়া কতোক্ষণ থাকতে পারে! সেটা কি একবার ভেবেছো!
– না, প্রয়োজন নেই তো এতো ভাবার! তোমার প্রতিও ভাবনা ছাড়তে হবে দেখছি। অতি আস্কারায় সাহস বেশি বাড়ে বিধায় মাথায় উঠে যায়! যেটা অকল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম!
ইমরান হনহন করে উল্টো পথে হাটতে লাগলো। নাফিসা সেখানেই দাড়িয়ে আছে। ইমরান রাস্তার ধারে এসে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললো,
– দাড়িয়ে আছো কেন এখানে?
নাফিসা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তার পথে হাটতে লাগলো। ইমরানের মেজাজ খারাপ হচ্ছে খুব! নাফিসাকে আইল ধরে একা একা হাটতে দেখে শিপন বললো,
– ভাবির আবার কি হইছে!
– কি জানি! তোরা যেতে থাক। আমরা আসছি।
তারা দুজন রাস্তায় উঠে হাটতে লাগলো। ইমরান নাফিসার কাছে এসে হাত ধরলে নাফিসা ঝটকায় হাত ছুটিয়ে নিলো। ইমরান বললো,
– এদিকে কই যাও? এখন কিন্তু মাইর খাবা!
– আস্কারায় মাথায় উঠে গেছি, মাইর তো খেতেই হবে! দিন মাইর। মাথায় যেহেতু উঠে গেছি, মাথা থেকে এবার নিচে আছড়ে ফেলুন। এতে অভ্যস্তই আমি!
– রাগ কিন্তু বাড়িয়ে দিচ্ছো!
– এতো ঠেকা পড়েনি কারো রাগ ভাঙানোর কিংংবা বাড়ানোর! আমার সাথে না এলেই তো হয়! কে বলেছে পিছু পিছু আসতে! আমি তো আমার মতোই চলছি। অযথা আমাকে নিয়ে ভাবছেন কেন! নিজেকে নিয়ে ভাবুন!
নাফিসা মোরে এসে অন্য আইলে হাটতে লাগলো! এসেছে বেড়াতে, এখন কি রাগারাগি করলে চলবে! তাই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে ইমরান সেই সোজা আইলেই হাটতে লাগলো। নাফিসা তার বিপরীত আইলে হাটছে। ওড়নার আঁচলে চোখও মুছে নিচ্ছে বারবার। দুজন দুই আইলে, মাঝে সবুজ ধান ক্ষেত। ক্ষণে ক্ষণে বইছে মৃদু বাতাস আর ভাঙছে তাদের ক্ষীণ অভিমান! হাটতে হাটতে তারা অন্যপাশের রাস্তায় উঠলো। নাফিসা রাস্তায় উঠে দাড়িয়ে আছে নিশ্চুপ হয়ে। দুজনের মাঝে এতোক্ষণ দুরত্ব ছিলো কেবল একটি ধান ক্ষেত। আর এখন দূরত্বের সাথে অভিমান ভেঙে ইমরানই অগ্রসর হলো নাফিসার দিকে। রাস্তাটা প্রায় ফাঁকাই আছে তাদের থেকে অনেকটা দূরে শিপনরা আছে। নিরিবিলি হাটছে দুজন। ইমরান নাফিসার হাত ধরতেই নাফিসা সরিয়ে দিলো। ইমরান এবার শক্ত করে মুঠোয় ধরে শিপনদের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু নাফিসা এক জায়গায়ই দাড়িয়ে আছে। ইমরান তার হাত টানলো কিন্তু সে একটু এগিয়ে এলেও নড়তে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। ইমরান হাত ছেড়ে তার পেছনে একহাত রেখে বললো,
– এখন কি রুমে আছি, যে আদর করে রাগ ভাঙাবো!
পেছন থেকে হাত সরিয়ে নাফিসা বললো,
– একদম টাচ করবেন না আমাকে!
– কেন?
– আপনি হাতির উপর উঠেছেন, হাতি স্পর্শ করেছে, হাতসহ জামাকাপড়ে হাতির ময়লা লেগে আছে! আমার ঘিনঘিন লাগছে এখন আপনাকে! আপনি হাতটা পর্যন্ত ধুয়ে আসেননি!
ইমরান তার কথা শুনে এবং বাচ্চাদের মতো তার মুখ ভঙ্গি দেখে বিস্মিত! পরক্ষণে হাসতে হাসতে ঢালুতে নেমে এলো। সেচের পানির ড্রেনে হাত ধুয়ে আবার উঠে এলো। নাফিসার ওড়নায় হাত মুছে বললো,
– এবার ঠিক আছে তো!
নাফিসা ঠোঁটের এক কোনে দুষ্টুমির হাসি ফুটিয়ে বললো,
– হাতে স্পর্শ করতে পারবেন কিন্তু দুরত্ব বজায় রাখবেন। গোসলের পূর্ব পর্যন্ত আমার সাথে ঘেষবেন না একদম! ইমরান ডান পাশে থেকে নাফিসার বাম কাধে ধরে কাছে টেনে বললো,
– এতো নিয়মকানুন আবার আমি মানতে পারি না।
দুজন দুষ্টুমি করতে করতেই হাটতে লাগলো সেদিকে, যেদিকে শিপনরা এগিয়ে যাচ্ছে।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৫
(নূর নাফিসা)
.
.
কাজ একটু তারাতাড়ি সেড়ে গার্মেন্টস থেকেই আশিক দুপুরে জিহানকে নিতে এসেছে। তার হাতে একটা বই। আরাফ যখন এবাড়িতে আসার কথা বলেছিলো তখন সে এই বই নিয়ে অফিস গিয়েছে। নিশাত আজ বাড়িতেই আছে। তাকে দেখে সালাম দিয়ে কেমন আছে তা জিজ্ঞেস করলো। আশিক স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো। অতপর খালামনিদের সাথে দেখা করে জিহানকে রেডি করতে বললো। আরমান এসময় অফিসে। সে কল করে বললো জিহানকে ঘুরতে নিয়ে যাবে তাদের বাড়িতে। রাতে আরাফ আসবে, তখন আবার নিয়ে আসবে। আরমান অনুমতি দিয়ে দিলো। আবিদা বেগম আশিককে লাঞ্চ করতে বাধ্য করলেন। আশিক খেয়ে আরমানের রুমে এলো। নিশাত এখানে জিহানকে রেডি করছে। আশিকের সাথে বেড়াতে যাবে বলে জিহান বেশ উত্তেজিত! বাবা এবং চাচ্চুদের সাথে তার ভাবটা সবসময় উত্তেজিত হয়, যদিও বাবার ব্যাপারে বর্তমানে সেটা কম। তবুও বাইরে বেড়াতে গেলে সে বাবার সাথে মোটামুটি ফ্রিই থাকে, আর তাই আরমান প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। আশিক খাটে বসে নিশাতকে বললো,
– তোর এক্সাম কেমন হচ্ছে?
নিশাত আগের মতো এতোটা দুষ্টুমি করে না আশিকের সাথে। এখন যেন তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও ইতস্তত বোধ করে। যদিও দূর থেকে আবার পলকহীন তাকিয়ে দেখে! সে জিহানকে রেডি করতে করতেই বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ।
– আয়াতের নাকি একটা খারাপ হয়েছে।
– হুম, ইংলিশে। কিন্তু এতোটা খারাপ হয়নি। পাশ আসবে, সে নিশ্চিত।
– আর ক’টা বাকি আছে?
– দুইটা।
– কবে শেষ হবে?
– কাল দিবো একটা। আরেকটা তৃতীয় রোজায়।
– এইটা ধর।
আশিক বইটা এগিয়ে দিলে নিশাত বিস্মিত হয়ে একবার বইয়ের দিকে তাকালো, পরক্ষণে আবার আশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
– এটা কার?
– আমার। এক্সাম শেষ হলে তুই পড়বি এবং পড়া শেষে আমাকে রিটার্ন করবি।
নিশাত বইটা হাতে নিলো। বইয়ের নাম “অনন্ত রাজকুমার”! এর মানেটা নিশাত বুঝলো না। কিন্তু এটা উপলব্ধি করতে পারছে যে এটা রাজকুমার সম্পর্কিত বই। সে বইটা একপাশে রেখে জিহানকে জুতা পড়িয়ে দিলো। অত:পর আশিক বেরিয়ে গেলো জিহানকে নিয়ে।
বহুদিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে কেদে উঠলো জেরিন। যদিও জিহান প্রথমে তার মাকে দেখে খুশি হয়ে দৌড়ে এসেছিলো নিকটে। কিন্তু তাকে এভাবে কাদতে দেখে হাসিমাখা মুখটা গম্ভীর হয়ে গেছে! কেমন যেন ভয়ার্ত দেখাচ্ছে তাকে! নাজিয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। মানুষ হিসেবে যেমনই হোক সে একজন মা। তার না দেখা সন্তানের জন্যই এখনো মনটা যেভাবে কাদে সেখানে জেরিন তো পেটে ধরে লালনপালনও করেছে! নাজিয়া জেরিনকে বললো,
– জিহান ভয় পাচ্ছে, জেরিন। চুপ করো। এভাবে কাদে না। এই বললাম না চুপ করতে!
নাজিয়া বলে থামতে পারেনি এদিকে জিহান ভয়ে কান্না শুরু করেছে। আশিক জেরিনের প্রতি বিরক্ত হয়ে জিহানকে কোলে নিয়ে আবার বেরিয়ে গেলো। আয়েশা বেগম জেরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। নাজিয়া কিছুক্ষণ বুঝিয়ে তারপর রান্নাঘরে চলে গেলো। জিহানের জন্য কম মশলা দিয়ে নুডলস রান্না করলো। রাস্তায় কিছুক্ষণ হাটাহাটি করে আশিক আবার জিহানকে নিয়ে এসেছে। জিহান এখন শান্ত। সে আর জেরিনের কাছে যায়নি। কিচেনে নাজিয়ার কাছে চলে এসেছে।
– ওয়াও! ভাবি, নুডলস রান্না করছো আমার জন্য!
নাজিয়া মুচকি হেসে বললো,
– উহুম, জিহান বাবাটার জন্য।
– না, জিহান খায় না। জিহানের দাত উঠেনি।
আশিকের কথায় জিহান জেলাসি হয়ে বললো,
– আমি খাবো! এই দাত।
– উহুম, আমি খাবো।
– আমি!
নাজিয়া হেসে জিহানকে কোলে নিয়ে বললো,
– উহুম, জিহানই খাবে।
আশিক কড়াই থেকে এক চিমটি নুডলস নিয়ে মুখে দিয়ে বললো,
– আহ, কি টেস্ট!
জিহান কান্নার ভঙ্গিতে বললো,
– ই.. আমি খাবো!
নাজিয়া তাকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বললো,
– ওফ্ফ! গরম। ঠান্ডা হোক একটু পরে খাবে।
– চাচ্চু খায়!
– চাচ্চু খাবে না। আশিক নাড়া দাও নুডলস। আমি আসছি।
নাজিয়া তাকে নিয়ে জেরিনের কাছে এলো। এবার জেরিন নিজেকে শান্ত রেখে তারপর কোলে নিলো। জিহান তার কাধে মাথা রেখে গলা ঝাপটে পড়ে আছে। জেরিন টুকটাক কথা বলছে ছেলের সাথে। জিহান নিজের মর্জিতে কখনো জবাব দিচ্ছে কখনো দিচ্ছে না। নুডলস খেয়ে খেলাধুলা করলো কিছুক্ষণ। জিহানের জন্য আশিক আর বের হয়নি বাসা থেকে। বাকিটুকু সময় এখানে কাটিয়ে সন্ধ্যায় আরাফ জেরিনকে তার বাড়িতে রেখে এসেছে। ইচ্ছে করছিলো না জিহানকে ছাড়তে তবুও সে ছাড়তে বাধ্য! আরমান জানতে পারলে কিছুতেই দেখার সুযোগও দিবে না আর! জিহানও আসতে চাইছিলো না। আরাফ এক প্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে আবার উল্টো পথে যাত্রা শুরু করলো। জেরিনকে তাদের বাসায় পৌছে দিয়ে আসায় লেট হয়েছে ফিরতে। এর মাঝে আরমান দুবার কল করেছে আর আরাফ বলেছে সে রাস্তায় আছে। আরাফ এলে আরমান একসাথে ডিনার করলো। জিহান ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল থেকে এ পর্যন্ত আর বাবার সাথে কথাবার্তা হলো না তার। খাওয়ার পর আরাফ আরমানের সাথে রাস্তায় হাটতে বের হলো। জেরিনের দোষ স্বীকার করে কিছুটা তার পক্ষ নিয়ে যথাসম্ভব বুঝালো আরমানকে। আজ যে জেরিনের সাথে জিহানের সাক্ষাৎ হয়েছে সেটাও জানিয়ে দিয়েছে। যদিও জেরিনের ব্যাপারে শুনতে ইচ্ছে করছিলো না তবুও আরমান চুপচাপ শুনে গেলো। বড় ভাই বলে মুখের উপর নিষেধ করতে পারলো না। রাত দশটা বেজে গেছে। যা বললো তা নিয়ে একটু ভাবতে বলে আরাফ গাড়িতে উঠে চলে গেলো। আরমান তাকে বিদায় দেওয়ার পরপরই বাসায় ফিরে এসেছে।
আশিক বইটা দিয়ে যাওয়ার পরই মনের ভেতর উশখুশ করছিলো! এটা একটা গল্পের বই। কিন্তু কিসের গল্প! আর আশিকই বা তাকে কেন দিলো! ইচ্ছে তো করছে এখনই পড়ে ফেলতে! কিন্তু আগামীকাল এক্সাম থাকায় সে বইটা একপাশে রেখে দিলো।
নাফিসা ইমরান আজ বিরলেই ঘুরে বেড়ালো। বিরল ডিগ্রি কলেজের সামনের পথ ধরে হাটাহাটি, অত:পর কড়াই বিলে ভ্রমণ। অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা কড়াই বিল। আম, জাম, লিচু, মেহগনি, আকাশমনি সহ নানান প্রজাতের বৃক্ষ! পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় জায়গা এটি। সরকার উদ্যোগ নিলে এটি দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম।
দুপুরের পরপরই তারা শিপনের বাড়ি ত্যাগ করলো। শিপন আরও দুতিনদিন থাকতে বলেছিলো কিন্তু রমজান মাস অতি নিকটে হওয়ায় ইমরান থাকতে রাজি না। বাসায় যাওয়ার তাড়া তাদের। তারা বিরল ছেড়ে ফুলবাড়িয়া চলে এসেছে। খাওয়ার উপযুক্ত না হলেও নাফিসা সেই গাছের লিচু নিয়ে এসেছে কয়েকটা! টক এবং তেতো স্বাদযুক্ত! শিপন জানিয়ে দিয়েছে আরেকটু বড় হলে লিচু পাঠিয়ে দিবে। রাতে থাকার জন্য হোটেলে ব্যবস্থা করলো ইমরান। রাতটা কাটিয়ে তারা সকালেই ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো। আশেপাশের জায়গায় একটু ঘুরাঘুরি করলো। নিকটবর্তী এক শপিং সেন্টারে প্রবেশ করলো কিন্তু তেমন কিছু কিনলো না। নাফিসার ইচ্ছায় কাপল ব্রেসলেট কিনলো এবং ইমরানও সানগ্লাস দেখে বিনা পরিকল্পনায় কাপল সানগ্লাস কিনলো। নিশাতের জন্য এক জোড়া জুতা কিনে তারা এবার রওনা হলো ফুলবাড়িয়া স্টেশনের দিকে। অনলাইনে টিকিট কিনেছে ইমরান। সকাল দশটায় ট্রেন। এরই মধ্যে ভোর থেকে তারা স্বপ্নপুরী, কয়লাখনি, যমুনার তীর সহ অনেকটা পথ ভ্রমণ করে নিয়েছে। বাস স্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, শপিংমল, বন্দর, ফ্লাইওভারের নিচে, স্কুল কলেজের সামনে চোখ বুলালে দেখা যায় কতো অসহায় মানুষ পথে দিন কাটায়! কারো অঙ্গপ্রতঙ্গের অভাব, কারো শক্তির অভাব। সব মিলিয়ে সবারই আশ্রয়স্থলের অভাব! নাফিসা দুজন অচল লোককে সাধ্যমতো দান করে ট্রেনে উঠলো। কমলাপুর থেকে যাত্রা শুরু করে তারা নেমেছিলো কাঞ্চনজাংশন রেলস্টেশনে। কিন্তু এবার ঢাকা ফিরছে ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে কমলাপুরে। মাঠ পেরিয়ে, বন হারিয়ে, স্টেশনের পর স্টেশন ত্যাগ করে, দিন কাটিয়ে, রাত কাটিয়ে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে পরদিন সকালে ঢাকায় পা রাখলো তারা। এতোটা পথ ভ্রমণ করে নাফিসা ক্লান্ত। যাওয়ার সময় যতটা ঘুম হয়েছিলো তার, আসার সময় তার এক-তৃতীয়াংশ ঘুম হয়েছে। এখন বাসায় এসে গোসল করে খেয়ে অনেকটা সময় তার ঘুমে কাটলো! সাথে ইমরানেরও।

চলবে।