তৃ-তনয়া পর্ব-৯৯+১০০+১০১

0
722

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ৯৯
(নূর নাফিসা)
.
.
সন্ধ্যায় রাগারাগি করে ইমরান বেরিয়েছে বাসা থেকে। ফেরার আর খবর নেই! ডিনারের সময় হয়ে গেছে, না এসেছে ইমরান আর না এসেছে আরমান! নাফিসা কাউকে বুঝতে দেয়নি যে তাদের মাঝেও কিছু হয়েছে! ইমরানের কথা জিজ্ঞেস করা হলে বলেছে তার ফিরতে দেরী হবে। আর এদিকে আরমানকে কল করে ফোন বন্ধ পায়! দুই মায়ের মনেই অশান্তি কাজ করছে। বড়মা তাদের খেয়ে নিতে বললো। নাফিসার পেট ব্যাথা করছে তাই সে খেয়ে নিলো। আর জেরিন খেতে চায়নি তবুও তার খাবার নিশাতের হাতে তার রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। খাওয়া শেষে টেবিল গুছিয়ে রাখছে নাফিসা। আরমান এসে গেইটে নক করলো। নিশাত গেইট খুলে দিলো। জিহান ঘুমিয়ে পড়েছে আরমানের কাধে। আরমান তাকে নিয়ে রুমের দিকে যাচ্ছে। আবিদা বেগম খাওয়ার জন্য বললে সে বলে দিলো বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। আবিদা বেগম গম্ভীর মুখ নিয়ে রুমে চলে গেলো। আরমান রুমে এসে জিহানকে খাটে শুয়িয়ে দিয়ে জেরিনকে একপ্রকার টেনে ধাক্কা দিয়ে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দরজা ভেতর থেকে লক করে দিলো আরমান! যা কেবলমাত্র নিশাত ও নাফিসার চোখে পড়েছে! জেরিন আর ভেতরে যাওয়ার প্রচেষ্টা না করে লজ্জিত দৃষ্টি নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে গেলো। নাফিসা ইমরানের জন্য নেওয়া খাবারের প্লেট হাতে নিচ্ছিলো আর নিশাত দ্রুত পায়ে বড়মার রুমে গেলো। বড়মা সহ নিশাত আবার বেরিয়ে এলো। বড়মা দু-তিনবার ডাকলো আরমানকে। কিন্তু আরমানের কোনো জবাব এলো না। তাই তিনিও আর বিরক্ত না করে সকালে সাক্ষাৎ করার আশায় রইলেন। বাড়ির এই পরিস্থিতি একদমই ভালো লাগছে না কারো কাছেই! নিশাত এবং নাফিসা গেইট খুলে ইমরানের খাবার নিয়ে তাদের ঘরে এসে পড়লো। বড়মা গেইট লাগিয়ে জেরিনকে ডেকে তার রুমে নিয়ে গেলো।
সবাই ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত, শুধু নাফিসাই বসে আছে ইমরানের অপেক্ষায়। নাফিসা কল করছে আর বারবার কেটে দিচ্ছে। রাত এগারোটার দিকে দরজায় টোকা পড়লে নাফিসা প্রথমে আঁতকে উঠল এবং বললো,
– কে?
বাইরে থেকে কোনো জবাব এলো না, বিপরীতে দরজায় জোরে থাপ্পড় পড়লো। নাফিসার মনে হচ্ছে ইমরান। কেননা সে গেইট তালা দিয়ে এসেছে। যার ডুবলিকেট চাবি আছে ইমরানের পকেটে। তবুও সে দরজা খুলতে ভয় পাচ্ছে। ফোন নিয়ে ইমরানের নম্বরে ডায়াল করতেই দরজার বাইরে রিংটোন বেজে উঠলো। এবার সে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই দরজা খুলে দিলো। ইমরান হনহন করে ঘরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিলো। অত:পর টিশার্ট খুলে আবার বেরিয়ে গেলো বাথরুমের দিকে। সে হাতমুখ ধুয়ে এলে নাফিসা গ্লাসে পানি ঢেলে প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
– এতোগুলো কল দিলাম রিসিভ করোনি কেন?
ইমরান কোনো জবাব না দিলে নাফিসা আবার বললো,
– খাবার এখানেই নিয়ে এসেছি। খেয়ে নাও।
ইমরান মশারী টানাচ্ছে, নাফিসা বললো,
– খাবে না?
ইমরান লাইট অফ করে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়লো। নাফিসা প্লেট ঢেকে রেখে দিলো। ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে সে লাইট জ্বালিয়ে দিলো। অত:পর সে-ও বিছানায় চলে গেলো। পেছন থেকে ইমরানকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমার সাথে রাগ করে নিজে না খেয়ে আছো কেন? সরি, আর কখনো তোমাকে না জানিয়ে কিছু করবো না।
ইমরান তার হাত ঝাড়ি দিয়ে সরিয়ে দিলো। নাফিসা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– সরি বলছি তো। এমন করছো কেন তুমি? রাগ ভাঙানোর সুযোগ তো দাও একবার।
ইমরান ঘাড় ঘুরিয়ে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
– চুপচাপ থাকতে পারলে থাকবি নতুবা রুম থেকে বের হো।
– বেরিয়ে যাবো?
– হ্যাঁ, যা..
নাফিসা কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে গাল মুছতে মুছতে নেমে গেলো বিছানা ছেড়ে। দরজা খুলে বেরিয়েও গেলো সে। খুব কান্না আসছে তার, তবে এটাও মানছে অপরাধ যেহেতু করেছে একটু শাস্তি তার পাওয়া দরকার। আবার এতেও বিশ্বাস রেখেছে যে সে উল্টো রাগ করলে ইমরানই আবার তার রাগ ভাঙাবে। দু মিনিটের মতো বারান্দায় দাড়িয়ে থেকে পরে আবার নক করলো নিশাতের রুমে। নিশাত দরজা খুললে সে ভেতরে চলে গেলো। ঘুমিয়ে পড়লো নিশাতের রুমেই। ঘুম ভাঙলোও নিশাতের রুমেই! আজ ঘুম ভাঙতে একটু দেরী হয়েছে তার। ঘুম থেকে উঠে সে নিশাতকে জিজ্ঞাসা করেছিলো ইমরান রাতে এসে ডেকেছে কি-না? কিন্তু নিশাত জানালো ডাকেনি! নাফিসার মনটা খারাপ হয়ে গেলো! ভেবেছিলো রাতেই ইমরান তাকে নিতে আসবে। কিন্তু তা আর হলো না!
নাফিসা ব্রাশ করতে করতে তাদের রুমের দিকে এসে দেখলো দরজা ভেতর থেকে বন্ধ! নাফিসা হাতমুখ ধুয়ে নিলে ইমরানের দেখা পেল। ইমরান বাথরুমের দিকেই আসছে। নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছিলো মনে হয়। ইমরান যেমন গাল ফুলানো মুডে আছে নাফিসাও ঠিক তেমনই ভাব প্রকাশ করলো তার সামনে। সে রুমে এসে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে মুখ মুছতে লাগলো। ইমরান হটাৎ করেই তার হাত থেকে তোয়ালে টেনে নিয়ে নিজের মুখ মুছতে লাগলো! নাফিসা তার এমন কান্ডে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইমরান ঝটপট মুখ মুছে নাফিসার মুখের উপর ছুড়ে মারলো তোয়ালটা! নাফিসার খুব রাগ হলো, সে-ও তার দিকে ছুড়ে মারতে চেয়েছিলো কিন্তু মারলো না। নাফিসা বড়ঘরে এসে দেখে দুই শ্বাশুড়ি রান্না প্রায় শেষ দিকে নিয়ে এসেছে আর জেরিন হাত-পা গুটিয়ে মন খারাপ করে বসে আছে সোফায়। কি করবে ভেবে না পেয়ে থালাবাটি এনে টেবিলে রাখলো। পরক্ষণে ইমরানের জন্য নেওয়া খাবারের কথা মনে হতেই আবার রুমের দিকে এলো। ইমরান শার্ট-প্যান্ট পরে দরজা লাগিয়ে কোথাও যাচ্ছে! নাফিসা বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করলো,
– এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?
ইমরান তার কথার জবাব না দিয়ে তাকে উপেক্ষা করে চলে গেলো! নাফিসা রুমে এসে খাবারের প্লেট নিয়ে আবার বড় ঘরে চলে এলো। আরমানের রুমে এখন জিহানের কথা শোনা যাচ্ছে সাথে গাড়িতে বাজছে গান। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। নাফিসা কিচেনে চলে এলে বড়মা বললো,
– ইমরান খায়নি রাতে?
– না।
– তার আবার কি হলো?
– কি জানি! হয়তো মুখের রুচি উড়ে গেছে। ভাবছি ভাতের পরিবর্তে রুচি ঝাল চানাচুর খেতে দিবো আজ থেকে।
– ঝগড়া হয়েছে?
– উহুম। শুধু শুধুই এমন করে কেন বুঝি না আমি! এমনসব পুরুষদের বুঝতে গেলে নারীদেরকে অসাধ্য সাধন করতে হবে।
হুট করেই আবিদা বেগম বললো,
– বুবু, মন চায় আমিই বাড়ি ছাইড়া চইলা যাই। একদম ভাল্লাগে না এতো অশান্তি! একেকজনের মুখ ফোলা, চোখ ফোলা দেখতে দেখতে অধৈর্য হইয়া গেছি! না করছিলাম ফিরাইয়া আনতে। গেছে, গেছেই! এতো আদরামের কি দরকার ছিল! এহন তো আরও অশান্তি হাজির হইলো!
– চুপ কর তুই। আমি আরমানের সাথে কথা বলবো। ইমরানের সাথেও।
নাফিসা আরমানের খাবার টেবিলে দিলো। এদিকে আরমান গোসল করে জিহানকেও গোসল করিয়ে বাবা ছেলে একেবারে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এসেছে রুম হতে। জিহান টেবিলের পাশে নাফিসাকে দেখে বললো,
– চাচী…
নাফিসা তার দিকে তাকাতেই জিহান হাত নাড়িয়ে অন্য একটা গাড়ি দেখালো। আরমানের হাতে চিপস আর বিস্কিটের প্যাকেট। নাফিসা প্রতুত্তরে হাসলো। জিহান আরমানের থুতনি ধরে বললো,
– আব্বু?
– হুম?
– আম্মু কই?
– আম্মু নেই।
– এহ! আছে।
আরমান আর কিছু বললো না। নাফিসা আরমানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– ভাইয়া, খাবার দিয়েছি।
আরমান চুপচাপ দরজায় তালা লাগিয়ে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো জিহানকে নিয়ে। তাদের কথা শুনে জেরিন বেরিয়ে এসেছিলো। কিন্তু জিহান পিছু ফিরে তাকায়নি বিধায় দেখলো না তার আম্মুকে! নাফিসা দ্রুত কিচেনে এসে বড়মাকে বললো। আর নিশাত দৌড়ে গেইটের কাছে এসে বড়মার কথা বলে ডাকলো। কিন্তু আরমান শুনলো না। দুই মায়েরই ভেতরটা ভারি হয়ে এসেছে ছেলেদের এমন অপ্রত্যাশিত কান্ড দেখে! তারা পুরো পরিবারকেই ইগনোর করছে! এদিকে ইমরানও আর ফিরেনি! নাফিসা ফোন করলো কয়েকবার। কিন্তু ফোন বন্ধ! কোথায় গেলো সে! এতো সকালে তো তার অফিস টাইম ছিলো না! অবশেষে দুপুরের অগ্রভাগে বড়মা নিজ ফোন থেকে আরমানের ফোনে কল করলো। প্রথমবার রিং হয়ে দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। বড়মা গম্ভীরমুখে বললেন,
– কোথায় তুই?
– অফিসে।
– জিহান কোথায়?
– আমার সাথেই।
– খুব বড় কলিজা ওয়ালা ব্যাটা হয়ে গেছিস যে মাকেও ভুলে গেছিস? আর ছেলেকে নিয়ে গেছিস কোন আন্দাজে? এইটুকু বয়সে অফিসের কাজ শিখিয়ে দিবি?
আরমান চুপ করে রইলো। বড়মা আবার বললো,
– নিজে তো খাবি না, বাচ্চাটাকেও না খায়িয়ে মারবি?
– খায়িয়েছি হোটেলে।
– হোটেলে খাওয়াবি কেন? আমরা রান্না করতে পারি না! আর অফিসেই নিয়ে যাবি কেন!
– কি করবো, তোমরা অধৈর্য্য হয়ে গেছো বলেই তো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছো। আর কাউকে এতো ধৈর্য ধরতে হবে না, আমি একাই জিহানের খেয়াল রাখতে পারবো।
– কথা তো ভালোই বলতে শিখেছিস! আমরা অধৈর্য্য হয়ে গেছি? মা ছাড়া যে প্রতিনিয়ত কান্না করে সেটা চোখে পড়ে না তোর?
– জিহান ভালো আছে এখানে।
– জ্ঞান দিতে আসছিস? ভালো মন্দ বুঝি না আমরা? কতোক্ষণ ভালো থাকবে? এখন তো মনে হচ্ছে আমরা পালন করিনি তোদের! তোরাই আমাদের লালন পালন করেছিস ছোট থেকে!
ইমোশনাল কথাগুলো আরমানের ভেতরটায় আঘাত হানছে তাই সে চুপ করেই রইলো। বড়মা গম্ভীর গলায় বললো,
– অফিস টাইম শেষে দুই ভাইকেই বাড়ি দেখতে চাই আমি। কোথাও যাবি তো খুব খারাপ কিছু হবে যার দায়ী তোরা। কি, ফিরবি না?
– হুম।
– ইমরান কোথায়?
– জানি না।
– অফিস যায়নি?
– না।
– বাড়িতেও নেই, অফিসও যায়নি তো গেছে কোথায়!
– কি জানি, আমার সাথে দেখা হয়নি।
বড়মা ফোন রেখে দিলো। আর নাফিসার মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেলো! তার সকালের নাস্তাও করা হলো না! ইমরানের অপেক্ষায় বসে আছে সারাদিন। দুপুরেও যেহেতু ইমরান ফিরলো না তখন সবার মাঝেই ভয় জেগেছে। ফোনও বন্ধ, অফিসেও নেই, বিকেলে আরমান বাসায় ফিরে জানতে পারলো ইমরান নিখোঁজ! অত:পর সে খোঁজ করতে লাগলো ইমরানের বন্ধুবান্ধবদের কাছে। আবিদা বেগমের বুকে ব্যাথা করছে! বড়মা ও নিশাত পড়ে আছে তার সেবাযত্নে। জেরিনের যেন সবকাজ করতেই মানা! নাফিসা ঘরবন্দী হয়ে কান্না করছে! সবকিছু যুক্তিযুক্ত মনে হলেও শেষ পর্যায়ে নিজেকেই দোষী করছে সে! নারীদের রাগ কম কিন্তু প্রকাশ পায় বেশি। যার ফলে রাগারাগি করে বেশি আর মানিয়ে নেওয়াও সহজ। আর পুরুষের রাগ বেশি, কিন্তু প্রকাশ পায় কম। সহজে রাগে না তারা আবার একবার রেগে গেলে খুব বড় অঘটন ঘটিয়ে ছাড়ে! যেমনটা ঘটিয়েছিলো আরমান আর এখন ঘটাচ্ছে ইমরান! এক পর্যায়ে আশিককে কল করে ইমরানের খোঁজ পেল! আরমান রেগে তাকে এই মুহুর্তে বাড়ি আসতে বললো। সবচেয়ে বেশি রাগ তো হচ্ছে সে ফোন বন্ধ রেখেছে সেই কারণে!
সন্ধ্যার পর ফিরেছে ইমরান। আরমান প্রথমে বকেছে তাকে তারপর বড়মা দুই ভাইকে অর্থাৎ আরমান ও ইমরান উভয়কেই বকেছে! আরমানের ইস্যু ছিলো সে জেরিনসহ তার পুরো পরিবারকে উপেক্ষা করছে সাথে জিহানেরও ক্ষতি করছে। আর ইমরানের ইস্যু ছিলো সে অযথা এমন কান্ড ঘটিয়েছে। কাউকে না জানিয়ে হুটহাট ঘুরতে চলে যাওয়া৷ যদিও তার উদ্দেশ্য ঘুরতে যাওয়া না, সে নাফিসার সাথে রাগ করেই এমনটা করেছে। কিন্তু নাফিসা ছাড়া সকলের অজানাই সেটা। বড়মা কঠোর হয়ে শেষ বারের মতো সাবধান করে দিলো উভয়কেই। দুজন শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলো। বহুদিন পর আজ এমন শাসাচ্ছেন বড় মা। আগে দুইভাই পড়াশোনায় ফাঁকি দিলে কিংবা ঝগড়া লাগলে এমনভাবে শাসাতেন। আবিদা বেগম ঠাসঠাস পিটুনি লাগাতেন আর বড়মা পিটুনি ছাড়াই শাসাতেন এবং বুঝাতেন। এরপর ছেলেরা বড় হয়ে গেলে তা আর দেখা যায়নি।
ইমরান আশিকের সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে এবং আরমান বলার পর বাড়ি আসছে তা জানার পরপরই নিশাত নাফিসাকে ইনফর্ম করে গিয়েছিলো। আর এখন ইমরান ঘরে এলে দেখলো নাফিসা টেবিলে মাথা রেখে জানালার বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে। দরজা লাগানোর শব্দে নাফিসা ঘুরে তাকালো। ইমরানকে দেখে সে ঝটপট উঠে চেয়ারে হোচট খেয়েই তেড়ে এগিয়ে এলো। দু’হাতে শার্টের কলার মুঠোয় ধরে নাফিসা বলতে লাগলো,
– তোর সাহস কি করে হয়ে আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার! এতোই ঠেকা পড়েছে, তুই রাগ করবি আমি তোর ধারে ঘুরে ঘুরে রাগ ভাঙাবো? এতোই ঠেকা পড়েছে আমার, যে তুই না খেয়ে থাকবি সেইজন্য আমিও না খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিবো? এতো কেন আমার ঠেকা, যে তোকে ভাবতে ভাবতে আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো! এতো কেদেছি কেন আমি তোর জন্য? আমাকে কাদাতে খুব ভালো লাগে তোর? আগেই তো আমি ভালো ছিলাম। সবসময় হাসিখুশি থাকতাম। এখন কেন আমাকে এতো কান্না করতে হয়!
ইমরান নিশ্চুপ তাকিয়ে আছে তার চোখেমুখে। চেহারায় স্পষ্ট ভেসে আছে অনাহারের ছাপ! স্পষ্ট ভেসে আছে সারাদিন কান্না করার ছাপ! নাফিসা কলার ছেড়ে তাকে ঝাপটে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে কান্না করতে লাগলো। তার যেন কাদতেও কষ্ট হচ্ছে! কথাও বলতে পারছে না ঠিকমতো! তবুও সে কান্নার সাথে বলছে, “সরি বলেছি না আমি? আর কখনো কিছু করবো না তোমার অনুমতি ছাড়া। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো একবার।”
এটুকু কথা বলতেই নাফিসা হাপিয়ে উঠেছে। অতি ক্ষুধার কারণে পেট থেকে যেন কথাটাও ঠিকমতো বের হতে চাইছে না। শুকনো গলায় কথা আটকে যাচ্ছে বারবার! ইমরান তাকে দুহাতে শক্ত করে বেধে চুপ করতে বললো। তবু্ও নাফিসা কিছু বলতে চাইছে। ইমরান তাকে ছাড়াতে চেয়ে ব্যর্থ! ইমরানের মতে সে হচ্ছে পঁচা মিষ্টি কুমড়া! যা বাইরে থেকে দেখতে ফিটফাট, অথচ স্পর্শ করলেই খোলস ভেঙে গলে পড়ে! পঁচা মিষ্টি কুমড়ার মতো সে-ও এতোক্ষণ যাবত স্ট্রং থেকে এখন ইমরানের কাছে এসে ভার ছেড়ে ঢলে পড়েছে। বরাবরই এমনটাই করে। ইমরান জানে একে আর কথা শুনানো যাবে না এখন। অত:পর পিছু ঠেলতে ঠেলতে আবার টেবিলের কাছে এনে তাকেসহ খাটে বসে পড়লো ইমরান। গ্লাসের অর্ধেক পর্যন্ত পানি নিয়ে সে মুখের সামনে ধরে পান করতে ইশারা করলো। অনিচ্ছা সত্যেও নাফিসা এক ঢোক গিলে আবার ইমরানের উপর হেলান দিয়ে বললো,
– তুমি বাসা থেকে এভাবে বেরিয়ে গেলে কেন? আমি কি রাস্তায় রাস্তায় খুঁজে পেতাম তোমাকে? আমাকে বলেছো রাগ করে যেন কখনো বাড়ি না ছাড়ি, আমি তো রেখেছি তোমার কথা। তাহলে তুমি রাগ করে আমাকে এভাবে শাস্তি দিলে কেন!
– চুপ করো।
– আমি তো তোমার অবাধ্য হতে চাইনি! তুমি কোনো কথাই শুনছিলে না। তাই বাধ্য হয়েছি সেটাও লুকিয়ে রাখতে। নতুবা তোমার সাথে পরামর্শ করে আমি সব কাজ করতাম। কেবল জিহানের কথা ভেবে আমি ভাবির পক্ষ নিয়েছিলাম৷ তাছাড়া ভাবি প্রেগন্যান্ট। সেটাও জানে না কেউ! এদিকে ভাইয়া না জেনে ডিভোর্স দিয়ে দিচ্ছে আর সেদিকে ডিভোর্স পেপার পাওয়ার পর ভাবির অন্যত্র বিয়ের ব্যবস্থা করছে মামামামী। কতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পথে ছিলো যা দেখতে পারছিলাম না আমি। তাই অবাধ্য হয়েছি তোমার।
– চুপ করতে বলেছি না!
নাফিসা সোজা হয়ে আবার তার কলার মুঠোয় ধরে বললো,
– এখন এতোটা ইজি তুমি, তো সারাদিন সবাইকে এমন টেনশনে রাখলে কেন? কতগুলো প্রাণকে ভয় দেখিয়েছো? একবার ভেবেছো আমাদের কথা? এখন আবার আমাকে চুপ করতে বলা হচ্ছে? করবো না আমি চুপ। আমাকে শাস্তি দিয়েছো, এখন তোমাকেও শাস্তি পেতে হবে।
ইমরান নিশ্চুপ থেকে তাকে শান্ত করতে ঠোঁট ছুয়ে দিতেই নাফিসা তার ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দিলো! ইমরান বললো,
– ওফ্ফ! লাগছে আমার! সারাদিন না খেয়ে কথা বলার শক্তি নেই, কামড় দেওয়ার শক্তি আসে কোত্থেকে? এই, ব্যাথা লাগছে তো!
নাফিসা ছেড়ে দিয়ে তার গলা জড়িয়ে পড়ে রইলো! হাত বাড়িয়ে নাগাল না পাওয়ায় ইমরান হাতে বোতল নিয়ে ফ্যানের সুইচটা অন করলো। অত:পর বললো,
– আমি শুধু কাঁদিয়েই যাই তোমায়, তাই না?
– গত উনিশ-বিশ বছরেও আমি এতোটা কাঁদিনি যতটা বিয়ের পর কাঁদতে হয়েছে!
– নিষেধ করলেও সেই কাজ কেন করো? আমাকে না রাগালে চলে না তোমার? কথা শুনলে আর কখনোই কাঁদতে দিবো না মাই হার্টবিটকে।
– শুনবো।
আরও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে তারপর সে ফ্রেশ হতে গেলো। একেবারে গোসল সেড়ে এসেছে। নাফিসাও হাতমুখ ধুয়ে এলো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০০
(নূর নাফিসা)
.
.
ইমরান দু’হাতে মাথার চুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
– সারাদিনে রান্নাবান্না হয়েছে কিছু?
নাফিসা হাতমুখ মুছতে মুছতে জবাব দিলো,
– সকালের রান্না করা খাবারই আছে।
– নষ্ট হয়ে গেছে না এতোক্ষণে?
– জানি না।
নাফিসা বড়ঘরে এলো। সব নিশ্চুপ। আবিদার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– আম্মা, বুক ব্যাথা কমেছে?
– হু।
– লেবুর শরবত বানিয়ে দিবো?
– না। খাইছি।
নাফিসা কিচেনে এসে দেখলো ভাত ভেজা ভেজা হয়ে গেছে। সে ভাতে পানি ঢেলে তরকারি গরম করতে বসালো। আরমানের রুম থেকে এইমাত্র বড়মা এসেছে এখানে। বড়মার জন্য প্লেটে ভাত তুলে অত:পর নিশাতকে ডাকলো খাওয়ার জন্য। আরমান জেরিন কাউকেই দেখা গেলো না। জিহানেরও কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সে নিজের এবং ইমরানের জন্য খাবার নিয়ে তাদের ঘরে চলে এলো। পান্তাভাত, কাচা মরিচ আর তরকারি। খেতে খেতে নাফিসা বললো,
– ভাইয়া কি আজও বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে?
– কেন?
– কারো কথাবার্তা শুনা গেলো না। তাই মনে হলো।
– বড়মা বকেছে তাই নিশ্চুপ সবাই।
– কাকে বকেছে?
– ভাইয়াকে এবং আমাকেও।
– উচিত করেছে। আমি থাকলে লাঠি এগিয়ে দিতাম।
ইমরানের দৃষ্টি প্লেটের দিকেই। ঠোঁটের কোনে একটুখানি হাসির ঝিলিক ভেসে উঠেছে শুধু। নাফিসা আবার বললো,
– ভাইয়া তাহলে শান্ত হয়েছে। আর ডিভোর্স দিবে না। তাই না?
ইমরান তার দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার খেতে খেতে বললো,
– ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট হলে আবার ডিভোর্স দেয় কিভাবে!
– বুঝলাম না!
– কুরআন পড়োনি?
– হুম।
– অনুবাদ পড়েছো?
– উহুম। ছোট ছোট কয়েকটা সূরার পড়া হয়েছে।
– সূরা আত্ব-ত্বালাক্ব এর প্রথম আয়াতেই লক্ষ্য করে দেখবে বলা আছে কোনো পুরুষ যদি স্ত্রীকে তালাক দিতে চায় তবে তাকে অবশ্যই ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। ইদ্দত গণনা করতে হবে। স্ত্রীকে বাড়ি থেকেও বহিষ্কার করা যাবে না। এবং স্ত্রী স্বেচ্ছায়ও যেতে পারবে না, যদি না সে কোনো সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যা লঙ্ঘন করা যাবে না।
– ভাইয়া কি জানে না এসব?
– জানবে না কেন!
– তাহলে ভাইয়া যে পেপার রেডি করতে লাগলো।
– শুনিয়েছে মাত্র। তেমন কিছুই করেনি।
নাফিসা চুপচাপ আবার খেতে লাগলো। ইমরান বললো,
– জেরিন যেমন তেমন থাকুক, তুমি তার কাছ ঘেষবে না। মনে থাকে যেন।
– ওকে।
– বড় মাকে বলবো হয় জেরিনকে আলাদা করে দিতে না হয় আমরা আলাদ হয়ে যাবো। ওর সাথে এক হাড়িতে রান্না চলবে না।
– এটা কি বলছো তুমি! বাবার স্বপ্ন যৌথ পরিবার আর তুমি এখন সেটা ভেঙে একক করে ফেলবে! এমনটা করো না।
– বাবার স্বপ্নে নিশ্চয়ই কোনো খুনী ছিলো না! যদি জানতেন এমন খুনী প্রবেশ করবে সংসারে তো যৌথ পরিবারের স্বপ্ন দেখতেন না।
– তবুও বলবো এমনটা করো না। ভাইয়া তো আর একক হতে চায় না। তুমি এমন প্রস্তাব করলে ভাইয়া কষ্ট পাবে। অত:পর ভাইয়ে ভাইয়ে দন্দ সৃষ্টি হবে।
– তো এখন কি করার! দন্দের ভয়ে সবাই একসাথে থাকি আর একে একে সবাইকে আবার মেরে ফেলুক!
– ভাবিকে রান্নাবান্নায় হাত লাগাতে নিষেধ করেছেন আম্মা। এমনিতেই তো সে হাড়ি থেকে দূরে থাকবে, তাহলে সেখানে হাড়ি আলাদা করার কি প্রয়োজন? প্লিজ এমন কিছু বলো না। যা বুঝার আম্মা আর বড়মা ই বুঝবে।
ইমরান আর কিছু বললো না। তাদের খাওয়া শেষ হলে নাফিসা প্লেট রেখে এলো।
.
বড় মা প্রথমে বকে পরে আবার আরমান আর জেরিনকে একসাথে বুঝিয়ে গেছেন। জিহান ঘুমাচ্ছে, জেরিন গুটিসুটি মেরে খাটের এক কোনে বসে আছে। আর আরমান দু’হাতে জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। তার মাঝে শুধু অনাগত সন্তানের ভাবনাই আছে এখন। কিছুক্ষণ আগেই বড়মার মুখে শুনলো। কিন্তু জেরিনের উপর জেদটা এখনো রয়ে গেছে।
সেই বিকেলে এসেছে, এখনো পোশাকাশাক চেঞ্জ করেনি সে। জেরিন চোখ মুছতে মুছতে ওয়ারড্রব থেকে টিশার্ট, লুঙ্গি বের করে বললো,
– পোশাক পাল্টাইবা না?
আরমানের কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। জেরিন সেগুলো খাটে রেখে পিঠে মাথা রেখে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,
– আর কোনোদিন এমন কিছু করবো না। বিশ্বাস করো।
আরমান কিছু না বলে পেটের উপর থেকে তার হাত ছাড়িয়ে দিতে চাইলো কিন্তু জেরিন শার্ট আঁকড়ে ধরে রেখেছে! আর কান্নার সাথে ক্ষমা চেয়েই যাচ্ছে! সে এবার আচমকা ঝাড়ি দিয়েই ছুটিয়ে নিতে গেলে তার কনুই গিয়ে লাগলো জেরিনের নাকে! ফলশ্রুতিতে জেরিনে নাকের পিন ভেঙে গেছে এবং পিনের আঁচড়ে নাক একটু কেটে গেছে! জেরিন ব্যাথা পেয়ে “আহ!” শব্দ করে উঠলো। আরমান তার দিকে না তাকিয়ে কাপড়চোপড় নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। গোসল সেড়ে রুমে এসে দেখতে পেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে হাতে তুলা নিয়ে নাক মুছছে জেরিন। আর একটু পরপর হাতে চোখ ও গাল মুছছে। আরমানকে দেখে সে সরে এলো ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে। আরমান মাথা মুছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দেখতে পেল ভাঙা নোজ পিন! তখন কি তাহলে নাকে লেগেছে! সে তোয়ালে গলায় ঝুলিয়ে জানালার সামনে জেরিনের কাছে এলো। জেরিন নাকে তুলা চেপে রেখেছে। আরমান তার দিকে ঘুরিয়ে জেরিনের হাত সরিয়ে দেখলো নাক লাল হয়ে আছে। সে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করতেই জেরিন ব্যাথায় কেপে উঠলো! আরমান ড্রয়ার থেকে একটা মলম এনে নিজেই লাগিয়ে দিলো। জেরিন তার চোখে তাকিয়ে থাকলেও আরমানের দৃষ্টি নাকের দিকেই ছিলো। এখন হঠাৎই চোখে তাকালো। আর পলকহীনই তাকিয়ে রইলো। এই দৃষ্টি যেন চরম ব্যাথা প্রকাশ করছে! ব্যথিত দৃষ্টি যেন জেরিনকে বলছে,
“বারবার সাবধান করার পরেও কেন করতে গেলি এমন? এমনটা না করলে তো আজ খুব ভালো থাকতো সবকিছু! কোনো ঘৃণার সৃষ্টি হতো না কারো মনে!”
জেরিন যেন এই ভাষাগুলোই স্পষ্ট পড়ে নিয়েছে তার চোখে! তাই আবারও জড়িয়ে ধরে কান্নার সাথে বললো, “সরি। সরি দুইটা বাবুর আব্বু। মাফ করো একবার…”
জেরিন কাদছে আর আরমান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বললো,
“আর কখনো যদি কোনো খারাপ হতে দেখি, জানে মেরে ফেলবো একদম।”
“আচ্ছা।”
নিশাত বাইরে থেকে ডেকে বললো,
“ভাইয়া, এখন ভাত খাবে?”
“আসছি।”
“পান্তা ভাত খেতে হবে কিন্তু। আর গরম ভাত খেলে একটু পরে।”
“আসছি।”
নিশাত বাইরে থেকে ডাকলে জেরিন তাকে ছেড়ে দিয়ে দরজা খুলে নিশাতকে পিছন থেকে ডেকে বললো,
– নিশাত, তুই একটু এনে দিবি এখানে?
নিশাত পেছনে ফিরে বললো,
– আনছি।
অত:পর নিশাত খাবারের প্লেট ও বাটি এনে জেরিনের হাতে দিলো। নাকের দিকে চোখ পড়তেই বললো,
– তোমার নাকে কি হয়েছে?
– কিছু না। হাত লেগে ব্যাথা পেয়েছি একটু।
নিশাত আরমানের জন্য পান্তা ভাত এনে আবার জেরিনের জন্য বাটিতে মুড়ি এনে বললো,
– তোমার পান্তা ভাত খাওয়া নিষেধ। তুমি মুড়ি খাও এখন, একটু পর ভাত খেয়ো।
খাওয়াদাওয়ার পর জেরিন অন্য একটা নাকফুল পরে নিলো আরমানের সাহায্যে। আরমান নিষেধ করেছিলো এখন পড়তে কিন্তু আঘাতের চিহ্ন অন্যদের চোখে লুকিয়ে রাখতে সে পরে নিয়েছে। অন্যদিন হলে হয়তো ব্যাথার কারণে চিৎকার করে সারাবাড়ি জানাতো। আজ সে অপরাধী বলে কোনো আহ্লাদও নেই, সব দিক থেকেই নিশ্চুপ!
.
রমজান মাস শুরু হয়েছে। দ্বিতীয় রমজানে আরমান সন্ধ্যায় বাজারের দিক থেকে আশিককে রাস্তায় পেয়ে জোর করেই সাথে নিয়ে এসেছে ইফতার করার জন্য। আশিক তার ফ্রেন্ডদের সাথে ঘুরতে এসেছিলো বিকেলে। সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথেই আরমানের সাথে দেখা হলো আশিকের।
ইফতারের পর কথাবার্তা বলে, জিহানের সাথে দুষ্টুমি করে যখন বাড়ি ফেরার জন্য উঠুনে বেরিয়ে এসেছে তখন নিশাত গেইটের কাছে এসে পেছন থেকে ডাকলো,
– ভাইয়া…
আশিক পিছু ফিরে বললো,
– কি?
– এক মিনিট দাড়াও।
নিশাত আবার ঘরে এসে ছোট ঘরের চাবি নিয়ে আবার দ্রুত পায়ে তার রুমে এলো। আশিকও দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এসেছে পিছু পিছু। আশিক যখন হাটতে হাটতে তাদের বারান্দা পর্যন্ত এলো ততক্ষণে নিশাত রুম থেকে বইটা নিয়ে এসেছে। আশিকের সামনে এগিয়ে ধরে বললো,
– এটা নিয়ে যাও।
– তোকে না এক্সামের পর পড়তে বললাম!
নিশাত নিচু স্বরে বললো,
– পড়ে ফেলেছি।
আশিক বইটা হাতে নিয়ে একটু বড় ঘরের দিকে তাকালো কেউ আসে কি-না দেখার জন্য! অত:পর নিশাতকে বললো,
– পড়েছিস, কিছু বুঝেছিস?
– কি বুঝবো!
– এই রাজকুমারটা অনেকটা আমি। যদিও আমার অবস্থান রাজপ্রাসাদে না আর তার অবস্থানও পরিচারিকার ঘরে না, কিন্তু লাইফ স্টাইলটা এমন ধারায়ই চলেছে অনেকটা।
আশিক কথা শেষ না করতেই নিশাত বললো,
– এতো ঘুরেফিরে বলার কি আছে। বই দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিলো না তো। বুঝতে যেহেতু পেরেছো সরাসরি বললেই পারতে। আমি তো আর তোমাকে ফোর্স করিনি কোনো ব্যাপারে।
– অনেক কথা সহজে হজম করা যায় না। ধীরে ধীরে আঘাত আর হঠাৎ পাওয়া আঘাতে বেশ পার্থক্য আছে। ভেবেছি প্রত্যক্ষ ভাবে ইগনোর করলে কষ্ট বেশি পাবি তাই বলিনি। এখন যেহেতু বুঝতে পেরেছিস, আই হোপ লাইফ থেকে এমন সব পাগলামি রিমোভ করবি। আর অভিজ্ঞতা থেকে একটা উপদেশ দিতে চাই, সেটা হলো কারো ক্ষেত্রেই এভাবে এগিয়ে যাস না। যে ভাগ্যে আছে সে যেকোনো অজুহাতে চলে আসবে। অহেতু নিজের পছন্দে অন্যকে এভাবে চেয়ে ব্যর্থ হোস না। আসি…
আশিক এক কদম এগিয়ে এলেই নিশাত ধাধানো স্বরে বললো,
– তো তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো? সারাজীবন এমন অনন্ত রাজকুমারই থেকে যাবে?
– সে তো আল্লাহই ভালো জানেন। তবে আমার ইচ্ছেটা এমনই হয়ে গেছে।
– ভাইয়া ওটা গল্প আর লাইফটা বাস্তব। সে গল্পে থেকেছে বিধায় পেরেছে, যেটা তুমি এই সমাজে অবস্থান করে পারবে না। আমার এইটুকু বিবেক থেকে এটা নিশ্চিত বলতে পারি, জীবনকে কারো না কারো সাথে জড়াবেই।
– জড়াবো না।
– পারবে তো? দেখে নিবো কিন্তু আমিও।
– বসে থাকবি আমাকে দেখার জন্য?
– তা কি আর আমার মতো মেয়েদের কাছে সম্ভব! পুরুষ তান্ত্রিক সমাজ তো। তোমার জন্য বসে না থাকলেও অন্যের ঘরে থেকেই দেখে নিবো। আর হ্যাঁ, তোমার উপদেশটাও ধারণ করলাম। আর কাউকে চাইবো না। সবকিছুর পেছনে এটা তো মানতেই হবে, যাহা চাই তাহা পাইনা, আর যাহা পাই তাহা চাই না! অথচ নিজেও জানিনা এমন করে করে লাইফটাকেই শেষ করে দিচ্ছি। যখন সময় চলে যায় তখন উপলব্ধি করি যা পেয়েও ছুড়ে ফেলে দিয়েছি তা-ই ভালো ছিলো। আর যার জন্য তুমি এমন অনন্ত রাজকুমার হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছো মনে, সে তো নিশ্চয়ই সেই পরিচারিকার মেয়ের মতো সংসার সাজিয়ে নিয়েছে তাই না?
– হুম।
– ছোট মুখে আমারও একটা অনুরোধ, আমি না হয় তোমার অযোগ্য বিধায় উপেক্ষাতেই থেকে গেলাম। তুমি তোমার যোগ্যকেই খুঁজে নির্বাচন করে নাও। তবুও শরীয়তের বাইরে, সমাজের বাইরে অনন্ত রাজকুমার হয়ে বসে থেকো না। যাও তোমার লেট হয়ে যাচ্ছে।
আশিক বারান্দা থেকে বের হতে হতে বললো,
– এখন এটা পড়ে এক্সামের সময় নষ্ট না করলেও পারতি।
নিশাত বেরিয়ে গেইটে তালা লাগাতে লাগাতে বললো,
– ঝামেলা থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসা যায় ততই ভালো।
আশিক আবার পেছনে এসে পকেট থেকে একটা সেন্টারফ্রেশ বের করে নিশাতের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
– রোজা থাকায় পকেটেই রয়ে গেছে। আর এখনই মনে পড়ে গেলো! এটা তোর ভাগ্যেই ছিলো মনে হয়।
নিশাত তার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
– আশেপাশের সবাই বলে আমি আর ছোট রয়ে যাইনি। আমি নাকি যথেষ্ট বড় হয়ে গেছি। তাই এগুলো থেকেও রুচি উঠে গেছে।
এই মুহূর্তে নিশাতের ইগনোরে আশিকের ব্রু সামান্য কুচকে গেলো! যেখানে তারা ভাইবোনরা একটা চকলেট, একটা চিপস নিয়ে যেই কাড়াকাড়ি করতো, সেখানে এই মেয়েটা আসলেই কি বড় হয়ে গেছে! এমনি ইমরান বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে।
– কিরে তুই যাসনি! যেই তাড়া দেখাচ্ছিলি, মনে হয়েছে কোটি টাকা জলে ভেসে যাচ্ছে!
আশিক মুখে হাসি ফুটিয়ে তার দিকে এগিয়ে বললো,
– সব কিছু এতো টাকা দিয়ে পরিমাপ কেন ভাই?
– দুনিয়াটাই তো টাকার খেলামেলা!
– হাহাহা.. নিশাত নাকি বড় হয়ে গেছে তাই সেন্টারফ্রেশ খায় না। বিয়ে দিয়ে দাও তাকে। একটা বিয়ে খাওয়া যাবে।
– কোথায় সেন্টারফ্রেশ, দেখি?
আশিক প্যাকেট ছিড়তে ছিড়তে বললো,
– এইতো আমার মুখে যাচ্ছে।
কথা বলে সারতে পারেনি ইমরান ছো মেরে নিয়ে নিয়েছে। এতো হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত ইমরানের মুখে সেন্টারফ্রেশ! তারা কথা বলতে বলতে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে আর নিশাত আশিকের মুখে তার বিয়ের কথা শুনে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলো কিন্তু কেউই দেখেনি সেই দৃষ্টি। সে গেইট লাগিয়ে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে তারপর ভেতরে এলো।
.
বাসায় ফিরে আশিক বারবার ভাবছে সন্ধ্যায় বলা নিশাত ও তার কথা গুলো। সেখান থেকে তো কাটিয়ে এসে পড়লো কিন্তু নিশাতের কথাগুলো তো যুক্তিহীন নয়। নাহিদার জন্য সে এমন হয়ে গেছে। কিন্তু নাহিদা তো ঠিকই সংসার সাজিয়ে নিয়েছে। তাহলে সে কেন এমন বিরহে অগোছালো থাকবে। তার জীবনেরও তো একটা গতি হওয়া দরকার। জীবনটাকে কেন এভাবে উপেক্ষা করবে! তাছাড়া সে তো এখন আর নাহিদাকে নিয়ে ভাবেও না। শুধু নিজের লাইফটাই যেন মজে গেছে! সত্যিই কি সে হারিয়ে ফেলছে কিছু! আচ্ছা, তার মাঝে ফিলিংস না থাকলেও তো নিশাত তাকে চায়! তাহলে নিশাত তার বউ হলে কেমন হয়! বয়স, শ্রেনী, সামাজিক মর্যাদা সবদিক থেকেই তো মোটামুটি ঠিকই আছে। তাহলে আকৃষ্ট না কেন? নিশাত কি দেখতে খারাপ? নাহ, দেখতেও খারাপ না। তাহলে? নাহ, মন্দ হয় না তো নিশাত বউ হলে! কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে কি আদৌ সম্ভব! অবশ্যই সম্ভব! কেননা মা, খালা, মামা তো নিজেদের মধ্যে আত্মীয় করতে বেশ পছন্দ করে! তাহলে অবশ্যই সম্ভব। নাহ, যা হারানোর তা হারিয়েছে। এখন যা পাওয়ার মতো কিছুটা নিশ্চয়তা আছে সেটা কেন অযথা হারাতে বসবে!
রাতের কিছুটা সময় শুধু এ নিয়েই ভাবলো। ভোরে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। আটটার দিকে ঘুম ভেঙেছে তার। সে বাইরে এসে দেখলো আয়েশা বেগম উঠুন ঝাড়ু দিচ্ছে। উঠুনের এক কোনে বসে নাজিয়া হাড়িপাতিল মেজে নিচ্ছে। আশিক তার মায়ের সামনে এসে বললো,
– মা, আমি নিশাতকে বিয়ে করবো।

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০১
(নূর নাফিসা)
.
.
– মা, আমি নিশাতকে বিয়ে করবো।
ছেলের মুখে হঠাৎই এমন কথা শুনে আয়েশা বেগম বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌছে গেছেন! ঝাড়ু দেওয়া থামিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছেন আশিকের দিকে। ওদিকে নাজিয়ার কাজও স্থগিত! আশিক একবার তার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার ভাবির দিকে! কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে নাজিয়া ফিক করে হেসে উঠলো! আশিক বললো,
– হাসো কেন?
– ভাবছি স্বপ্ন টপ্ন দেখে এলে নাকি! তা কি বলেছো সেটা তোমার মনে আছে তো?
– ভাবি, উপহাস করবে না। সিরিয়াসলি বলছি।
আয়েশা বেগম বললেন,
– তুই কি প্রেমটেম করছ নিশাতের লগে?
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে আশিক বিরক্তি নিয়ে একবার মায়ের দিকে তাকালো আরেকবার ভাবির দিকে! নাজিয়া মুখ চেপে হাসছেই! আর আয়েশা বেগম উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে আশিকের মুখপানে! আশিক বললো,
– বিয়ে করতে হলে প্রেম করতে হয়? প্রেম ছাড়া বিয়ে হয় না? ভাইয়া বিয়ে করেনি?
– চুপ থাক! কই আরাফ আর কই তুই! প্রেম না করলে এই বয়সেই বিয়ার শখ জাগছে ক্যা? আরাফরে তো হাজার বইলাও বিয়া করাইতে পারলাম না!
– তুমি আছো আরেক সংস্কার নিয়ে! মেয়ে ইন্টার পরীক্ষা না দিতেই বিয়ে দিয়ে দাও আর ছেলে ভার্সিটির শেষ প্রান্তে অথচ তার ক্ষেত্রে যেন আকাশ থেকে পড়লে।
– মেয়ের সাথে ছেলের জোড়া দিলে চলবো! তুই উপার্জন করবি, বাড়িঘর গুছাইয়া নিবি তারপরে না…
– বাড়িঘর গুছানোই আছে। আর স্বল্প উপার্জনও আছে। তাছাড়া বউ বাড়িতে আনবো না এখন। শুধুমাত্র বিয়েটা করে রাখবো। এখন তুমি তোমার বোনের মেয়েকে আমার জন্য আনবে কি-না সেটা বলো?
– আমারও তো ইচ্ছা, নিশাতরেই ঘরে তুলমু। তোর একটা ভালো ব্যবস্থা হইলেই প্রস্তাব পাঠামু।
– আমার ব্যবস্থা ভালোই আছে। এবার প্রস্তাব পাঠাও। নতুবা দেখবে পরীক্ষাটা শেষ হতেই নিশাতকে বিয়ে দিয়ে দিবে খালামনি। তোমার প্রস্তাবের অপেক্ষায় থাকবে না।
– আইচ্ছা।
– কি আইচ্ছা?
– আবিদার কাছে প্রস্তাব পাঠামু।
– হুম, তারাতাড়ি করো৷ এই রমজান মাসের মধ্যেই যেন কাজ সম্পন্ন হয়।
– তোর এতো তাড়া ক্যা? আমি বইলা রাখমু পরে একসময় বিয়া হইলেই হয়।
– না, তোমার একসময় নিয়ে বসে থাকবো না। দিনকাল ভালো না, জানো না সেটা? আশেপাশে দেখো না প্রেমপিরিতির কারণে দিনরাত পালিয়ে যাচ্ছে ছেলে মেয়ে? কোনদিন না আবার তোমার বোনের মেয়েরও এই অবস্থা হয়ে যায়! তার চেয়ে ভালো আগেই বিয়ের ঝামেলা শেষ করে রাখো।
– বাবা রে বাবা! এতো বিয়ার জন্যে এতো ফাল ক্যা তোর!
– এমনি। এটা একটা চ্যালেঞ্জ ভাবতে পারো। এই রমজান মাসের মধ্যে নিশাতের সাথে বিয়ে না হলে কিন্তু বাড়িতে আর ছোট বউ আসবে না কখনো।
কথা বলতে বলতে আশিক বাথরুমে চলে গেলো। প্রথমে হাসলেও নাজিয়া এখন হতবাক হয়ে আছে! এ আবার কোন পাগল! আর কিসের চ্যালেঞ্জ এর কথা বললো আশিক! সে ভাবতে ভাবতে এদিকে আয়েশা বেগম তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
– কিসের চ্যালেঞ্জ কইলো?
নাজিয়া জবাব দিলো,
– জানি না তো আম্মা!
আয়েশা বেগম আবার ঝাড়ু দিতে দিতে বিড়বিড় করতে লাগলো,
– আজকালকার পোলাপাইন! বিয়া নিয়া ও নাকি চ্যালেঞ্জ ধরে! নির্ঘাত বন্ধুবান্ধবদের লগে পাল্লা ধরছে বিয়া করার!
আশিক গোসল সেড়ে কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। নাজিয়া হাড়িপাতিল ধুয়ে কিচেনে রেখে রুমের দিকে যাচ্ছিলো। আশিক বেরিয়ে তার মাকে না দেখতে পেয়ে বললো,
– মা আবার কোথায় গেলো!
– বাথরুমে গেছে।
– ভাইয়া স্কুলে গেছে না?
– হুম।
– স্কুল না প্রথম রোজা থেকেই বন্ধ দিয়ে দিলো!
– জেএসসি ও এসএসসির কোচিং চলে যে!
– ফিরে কখন?
– এগারো বারোটার মধ্যেই ফিরে আসে।
– সবই ভালো, আমরাই কপাল কুন্ডলা! যাদের আটটা থেকে চারটা পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়!
– ওইযে, এক ঘন্টা কমিয়ে দিছে।
– ধুর! চারটা পর্যন্ত করতে পারলে পাঁচটা পর্যন্ত কে না পারবে!
– তোমার তো যখন ইচ্ছে তখন গেলেই হয়।
– কারো ভালো কেউ দেখতে পারে না, বুঝেছো? ম্যানেজার যেই দেখছে সারাদিনে দুতিন ঘন্টা কাজ করে আমি তেরো হাজার বেতন পাই সেই মালিকের কানে ফুসলে দিছে। আর মালিক আমার ঘাড়ে কৌশলে আরও কাজ ফেলছে। এখন আমি আবার চেষ্টা করছি ওই পন্ডিতের পন্ডিতি কমানোর। দেখি, মালিককে খুশি করে পদোন্নতির মাধ্যমে ওই ম্যানেজিং পদটা দখল করতে পারি কি-না!
– উনার সাথে হিংসে করছো? তাহলে সেটা মোটেও ঠিক হবে না।
– হিংসে নয়, ভাবি। আমি যোগ্যতার সাথে পদার্পণ করতে চাইছি। শুধু অনার্স কমপ্লিট করার অপেক্ষা। এরপর অন্যকোনো ভালো পদে বা অন্যত্র চাকরিতে ট্রাই করা যায়।
– হুম, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কি, বলোতো? হঠাৎ নিশাতের দিকে ঝুকে পড়লে! হুম? রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি!
– কিসের রহস্য! ক’দিনের জন্য পৃথিবীতে এসেছি। বিয়ে তো একসময় না একসময় করতেই হবে। তো শুধু শুধু অবিবাহিত থেকে প্রেমের সময়টা এভাবে নষ্ট করার কি আছে বলোতো!
নাজিয়া হেসে বললো,
– ভুল বলোনি, তাই বলে ডিরেক্টলি নিশাত!
– ভালো লাগলো তাই বলে দিলাম।
– কিন্তু চ্যালেঞ্জটা কিসের? বুঝলাম না!
আশিক ফিসফিসিয়ে বললো,
– আরে চ্যালেঞ্জ ট্যালেঞ্জ কিছু না! মাকে একটু তাড়া দেওয়া আরকি।
– নিশাত সমন্ধে আবার খারাপ বললে যে! নিশাতকে কি তোমার এমন মনে হয়েছে কোনো দিক থেকে, যে পালিয়ে যেতে পারে!
– এটাও সেই তাড়া দেওয়ার জন্যই।
আশিকের সাথে নাজিয়াও হেসে উঠলো। এদিকে আয়েশা বেগমকে দেখতে পেয়ে আশিক বললো,
– মা, আমি আসছি। খালামনিকে আজকেই খবরটা দিও কিন্তু।
.
পরীক্ষার দিনগুলোতে বেশিরভাগ আরমান ই গিয়েছে নিশাতের সাথে। আর মাঝে মাঝে ইমরান৷ আজ শেষ পরীক্ষায় এক্সাম হলে ইমরান গিয়েছিলো নিশাতের সাথে। সাথে নাফিসাও গেছে। এক্সাম চলাকালীন দুজন আশপাশ ঘুরেছে। আর এক্সাম শেষে তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে চলে গেছে। ঘুরাফেরা শেষে বিকেলে বাড়ি ফিরেছে।
নিশাত আজ থেকে স্বাধীন। শুধু প্রাকটিক্যাল এক্সাম বাকি। সেটা নিজ কলেজেই। আসরের নামাজ ঘরে পড়ে ইমরান বই নিয়ে বসেছে। নাফিসা বড় ঘরে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর আবার রুমে এসে দরজা চাপিয়ে বললো,
– আমি তো অবাকের চেয়েও বেশি অবাকিত!
ইমরান বই থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললো,
– এ আবার কেমন কথা!
নাফিসা ধপাস করে খাটে বসে বললো,
– যেমন শুনেছো ঠিক তেমনই। আমি গিয়েছিলাম নিশাতের ব্যাপারটা নিয়ে বড়মার সাথে একটু কথা বলতে! গিয়ে শুনি উল্টো গীত! খালা শাউড়ী আম্মা নাকি আশিক ভাইয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইয়া দিছে! তা-ও নাকি এই রমজান মাসেই বিয়ে!
– হু, কে বলছে এসব!
– ওই, তোমার কি মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি!
– সত্য মনে করার তো কোনো কারণ দেখছি না! আর সত্য হলেও নিশাতকে এখন বিয়ে দিবো নাকি!
– ওই, তুমি এমন করো কেন! বিয়ে হলে সমস্যাটা কি! আশিক ভাইয়া তো ভালোই, নিশাতও লাইক করে! আর আম্মাতো দেখলাম আনন্দিতই! আর আমি শীঘ্রই একটা বিয়ে খাবো তার জন্য বিমোহিত!
ইমরান বই রেখে চলে গেলো বড় ঘরের দিকে। নাফিসা ভেঙচি কেটে ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে ঘরটা ঝাড়ু দিতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ইমরান ফিরে এসে দেখে নাফিসা ঘর ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে রুমে প্রবেশ করছে আর গান গাইছে,
“নিশাত বানুর বিয়া গো, বিয়ার বাজনা বাজে পে পো পো…”
যদিও ইমরান জানে না কিন্তু সুর টেনেছিলো সে ইমরানকে এদিকে আসতে দেখেই। ইমরান বললো,
– রোজা থেকে এসব কি!
– কই কি!
– কিসের পে পো শুরু করছো! আর তুমিই না নিশাতের ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে তাকে উক্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চাইছিলে আর এখন বিয়ে নিয়ে নিজেই বিমোহিত!
– ধুর! প্রেম হারাম তাই উক্ত পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে চাইছি। বিয়ে করতে নিষেধ করছি নাকি! যত আগে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়া যায় ততই ভালো। তারা আর হারাম পথে লিপ্ত হয় না। আমি তো এটাই চিন্তা করছিলাম যে, আমার বাচ্চারা প্রাইমারি লেভেল পার করলেই বিয়ে দিয়ে দিবো।
– তাই নাকি! তাহলে তুমি ভার্সিটি লেভেলে উঠেও বিয়ে করতে চাওনি কেন! কান্না করে যেই জ্বালাতনটাই না করছো আমাকে!
– হুহ্! আমার সাথে সবার জোড়া? সবাই তো আর এক না! পোলাপাইন টিনএজ এ পড়লেই নিজের ভবিষ্যৎ সহ বাচ্চাকাচ্চার ভবিষ্যৎ ও চিন্তা করে ফেলে! আর আমি তো নিজের বিয়ের কথাই কখনো মাথায় আনলাম না! তখন শুধু এটা মাথায় ছিলো যে অন্যের বিয়ে কবে খাবো আর জীবনের বর্তমান মুহুর্ত গুলোকে দুষ্টুমি ফাজলামোর সাথে কিভাবে মাতিয়ে রাখা যায়। তো এমন সময় বিয়ে দিলে কান্না করবো না!
– ইশ! কাদুনী বুড়ি!
– এতো কথা বাদ। ওই ঘরে গেলে, কি শুনে এলে? আমি মিথ্যা বলছি?
– হুম, এখন না বললেও আগে বলছো।
– আগে! আগে কি বলছি?
– তুমি না বলছো নিশাত আশিককে পছন্দ করে? তাহলে নিশাত এখন আশিককে বিয়ে করতে রাজি না কেন?
– কি! নিশাত রাজি না? আমি শিওর সে আশিককে পছন্দ করে। নতুবা সেদিন মিটিমিটি না হেসে আমাকে ডিরেক্টলি নিষেধ করে দিতো!
– ঘোড়ার ডিম শিওর তুমি। আশিককে পছন্দ করলে কি সে এখন বিয়ের কথা শুনে অমত পোষণ করতো? সে তো প্রায় কান্নাই শুরু করছে দেখলাম। আশিককে বিয়ে করবে না। অন্য কারো সাথে বিয়ে হলেও নাকি তার আপত্তি নেই কিন্তু আত্মীয়ের মধ্যে সে বিয়ে করবে না!
– এ..! তাহলে কি এখন বিয়েটা খাওয়া হবে না আমার!

চলবে।