তোকে ঘিরে পর্ব-০৭

0
780

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_০৭
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

আমাকে টান মেরে মুখ চেপে আমগাছের আড়ালে সেটে ধরলো! শরীর নাড়িয়ে চিৎকার করছি একটা আওয়াজ বাইরে যাচ্ছেনা! হঠাৎ সেই অবয়বটা আরো কঠিন করে মুখ চেপে ধরলো! গাছের সাথে লেগে ঘাড়ে ব্যথা পাচ্ছি। চোখ ঠেলে অশ্রুজল গাল গড়িয়ে পড়তেই কি হলো জানিনা সে হাত আলগা করে দেয়। আমি মুখ হা করে শ্বাসকার্য চালাচ্ছি হঠাৎ সে বলে উঠে,

– পূর্ণ খুব ব্যাথা পেয়েছো? আর ইউ ওকে?

মাথা উঠিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, আরে হারামি! আমি তো মানুষ! ওমন বাঘের মতো চেপে ধরলে কার না ব্যথা করবে! খবিশের বাচ্চা! নালায়েক! দুঃখ একটাই কথাগুলো ঝপাঝপ বলতে পারলাম না। কষ্টসহকারে মুখে তালা লাগিয়ে মাথা হ্যাঁ সূচকে নাড়লাম। উনি আমার দিকে এগিয়ে হঠাৎ এমন কাজ করলেন আমি পুরো থতমত খেয়ে যাই! আমার মুখে কাপড় জাতীয় কিছু বেধে উনি কোলে তুলে বাড়ির পিছন সাইড দিয়ে হাটা দিলেন! আমি বাচার তাগিদে গোঙাতে গোঙাতে উনার ঘাড়ে, গলায় আচড় বসিয়ে দেই তবুও উনি উফ শব্দ করলেন না! নির্বিঘ্নে চুপচাপ পা চালিয়ে একটা অটোরিকশায় বসালেন! অটোওয়ালা আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকালে পূর্ব ভাই এক ধমক দিয়ে বললেন,

– ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ দেখা লাগবো না মামা! তুমি তোমার বুলেট ট্রেন হাকাও!

অটোওয়ালা মুখ কাঁচুমাচু করে স্টার্ট দিলেন। এই অটো কি আগে থেকেই বুক করা ছিলো? পূর্ব আমার সাথে কি করতে চাইছেন? আল্লাহ্ বাড়িতে যদি আমাকে না পায় কি গন্ডগোল হবে! পূর্ব ভাইয়ের হাবভাব আমাকে চরমসীমায় ভয় পাইয়ে দিচ্ছে! আমি হাত নাড়িয়েও কুল পাচ্ছিনা উনি আমার হাতদুটো আমার ওড়না দিয়ে বেধে দিয়েছেন। আমি ডুকরে কাদছি শুধু, সেই কান্নাও উনার কান অবধি পৌছাচ্ছে না! পূর্ব ভাই আপনি কি করবেন?

অটোরিকশা এক ব্রিজের কাছে থামতেই দূর থেকে ঝাপসা আলোতে ব্রিজের রেলিংয়ের কাছে কাউকে দেখতে পাই! চোখ ঝাপটা মেরে যেই ঠিক করে দেখি ওমনেই আমি শক্ড! আনিশা আপু! আনিশা আপু রাতের অন্ধকারে ব্রিজে কি করে? কেমন গোলমেলে লাগছে!! পূর্ব টানতে টানতে আমাকে আনিশা আপুর সামনে দাড় করিয়ে অটোওয়ালাকে ওখানেই থাকতে বলে কালো ট্রাউজারের পকেটে হাত ডুবালেন। আনিশা আপু শাড়ির আঁচল কাধে টেনে বিমর্ষ চাহনিতে পূর্ব ভাইকে দেখছেন। হঠাৎ নিবরতার চাঁদরে ছেদন ঘটিয়ে আনিশা আপু স্তব্দ গলায় বললেন,
– বেশ! তুমি যখন আমাদের মাঝে পূর্ণতাকে জোরপূর্বক ঢুকাচ্ছো আমিও বারন করবো না! ওর সামনেই যা করার এবং বলার বলবো তাই!

পূর্ব ভাইয়ের চোখেমুখে কাঠিন্যের আভা আরো জটিল হয়ে এলো। উনি জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলেন,
– একজন বিবাহিত মেয়ের সাথে অবশ্যই আমি রাত বিরাতে নির্জন ব্রিজে একা দেখার করার মতো ভুল করবো না, রাইট? পূর্ণকে আমি আনিনি! তুমি বাধ্য করেছো মাঝখানে ঢুকাতে!
আনিশা আপু তাচ্ছিল্যপূর্ণ হাসি দিয়ে বলে উঠলেন,
– ওয়াও! ‘পূর্ণতা’ টু ‘পূর্ণ’? দি গ্রেটেস্ট আয়াশ ওয়াসিফ পূর্ব একটা কচি মেয়ের পিছনে হাডুডু খেলছে? হা হা হা
– মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ আনিশা! আই রিপিট! মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ! তোর ফাও কথা শুনার জন্য আমি বসে নেই বুঝছিস? তোর বরকে রেখে আমাকে একলা কেনো ডেকেছিস সেটা বল!
– বর তো সামনে দাড়িয়ে! কার জন্য অপেক্ষা করবো? প্লিজ আরেকবার তুমি ‘তুই’ ডাকোনা!!অস্থির লাগে!

পূর্ব ভাই কষিয়ে মারলেন চড়! আনিশা আপু গালে হাত দিয়ে চুপটি করে থাকলেও আমার হাত টেনে তার পাশে স্থির করলেন! পূর্ব ভাই হঠাৎই চেচাতে লাগলেন,

– আনিশা ডোন্ট বি ইনসেন! প্লিজ ওকে ছেড়ে দে! প্লিজ ছাড় আনিশা! যা বলার আমাকে বল!
– তুমি ভেবেছো কি পূর্ব! আমি তোমার কথামতো চলবো? তোমাকে একা আসতে বলেছি! তুমি এই পূর্ণতাকে সঙ্গে এনেছো! আমার বোনের সামনে তুমি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছো হ্যাঁ!

আনিশা আপু কাধে টানা আচল ফেলে পূর্ব ভাইয়ের টিশার্ট দুহাতে আকড়ে ধরলেন! পূর্ব ভাই বারবার বাধা দিয়ে বললেন,
– আনিশা দূরে যা! টিশার্ট ছাড় বলছি! আনিশা! প্লিজ টিশার্ট ছেড়ে কথা বল! পূর্ণতা সামনে! প্লিজ!

আপু কোনো কথাই কানে নিচ্ছেন না। উনাকে এখন বোধশক্তি লুপ্তের মতো লাগছে! নেশাগ্রস্তের মতো উনার মাথা তার দিকে ঝুঁকিয়ে ঠোঁটের দিকে এগুতেই পূর্ব ভাই মারলেন সজোড়ে ধাক্কা! আপু ধাক্কার তালে পিছিয়ে গিয়ে আমার উপর পড়তেই আমি উল্টে ব্রিজের ওপাশে উচু থেকে পড়ে যাই! একটা চিৎকারের সুযোগ নেই! সব বাধা আমার! পানির বিকট শব্দ তরঙ্গায়িত হয়ে আমার চোখ ঘোলাটে করে নাক মুখ দিয়ে পানি প্রবেশ করলো! আমি হাত-মুখ বাধা অবস্থায় পানিতে নাকানিচুবানি খাচ্ছি! আমি সাতার জানিনা! বারবার তলিয়ে যাচ্ছি!! হাপিয়ে উঠছি! মাথা ঝাকাচ্ছি! কিছুক্ষণ থাকলেই আমি নির্ঘাত অক্কা পাবো! সিউর!

পূর্ব ঘটনাক্রমে বিষ্ময় চাহনিতে অস্থিরচিত্তের মতো ব্রিজের নিচে তাকালো! পূর্ণতা হিমশিম খাচ্ছে পানির মধ্যে! পূর্ব অস্থির গলায় আনিশার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ও সাতার জানে? তাড়াতাড়ি বল!
– না, আনিশার নিচুস্বরের উত্তর।
পূর্ব একসেকেন্ডও দাড়ালো না, পকেট থেকে মোবাইলটা পাশে ছুড়ে ঝাঁপ দিলো ঠান্ডা পানিতে! পূর্ণতাকে নাগালে পেয়ে একহাতে সাতঁরে তাড়াতাড়ি তীরে উঠলো পূর্ব! আনিশা ততক্ষণে নিচে নেমে গিয়েছে! পূর্ব পূর্ণতাকে মাটির উপর নরম ঘাসে শুইয়ে হাত ও মুখের বাধন খুলে দিতে লাগল। পূর্ণতা অচেতন! ঠান্ডা হাতে মালিশ করতেই পূর্ব বলে উঠলো,

– পূর্ণ! পূর্ণ! প্লিজ চোখ খুলো! তাকাও পূর্ণ! এই মেয়ে তাকাও প্লিজ!!
আনিশা অভয়বানীতে পূর্বের কাছ ঘেষে বলে উঠলো,
– পূর্ণতার কিচ্ছু হয়নি পূর্ব, ও ভয় পেলেই সেন্সলেস হয়ে যায়। কাম ডাউন।। ঠিক হয়ে যাবে।

পূর্ব একহাতে পূর্ণতার হাত আবদ্ধ করে অপর হাত দিয়ে ঠাটিয়ে আনিশার গালে চড় মারলো! কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
– আরেকবার কানের কাছে কিছু বলবি!তোর জিহবা টেনে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবো!

আনিশা মুখটা বিষন্ন লাভায় আচ্ছন্ন করে একপা একপা করে পিছিয়ে গেল। পূর্ব তাড়াহুড়ো করে পূর্ণতার বামহাতে পালস রেট চেক করলো। প্রেশার ড্রপ খাচ্ছে! এভাবে ভেজা শরীরে বসে থাকা যায়না! পূর্ব আলতো করে ঠোট ভিজিয়ে পূর্ণতাকে কোলে তুলে উপরে নিয়ে গেলো! মাথা ঘুরিয়ে আনিশাকে আসতে বলার ইশারা করে হাটা ধরলো পূর্ব! পিছু পিছু আসলো আনিশা।দূরে থামানো অটোরিকশায় উঠে আনিশার উদ্দেশ্য বলে উঠলো,
– পূর্ণর শরীর ঠান্ডা! প্লিজ ওকে চেপে ধর! আমি মোবাইলটা নিয়ে আসছি!
– ইয়া আল্লাহ্ পূর্ব! ওর শরীর তো ভিজে জবজবা! ওকে ধরলে আমি ভিজে যাবো না?
পূর্বর ইচ্ছা করছিলো লাত্থি মেরে আনিশাকে ব্রিজ থেকে ফেলে দিতে! ভিজা ভিজা যে করছিস! তোকে এখন ঠান্ডা পানিতে গোসল দিলে কিরকম লাগে বুঝিস! পূর্ব কথাগুলো গিলে খেলো! মোবাইলটা যেখানে ছুড়ে ফেলেছিলো ওটা সেখান থেকে তুলে অটোর কাছে এসে পূর্ণতার পাশ থেকে আনিশাকে ধাক্কা মেরে উল্টোপাশের সিটে বসিয়ে দিলো। পূর্ণতার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরলো! হাতে হাত ডলছে অনবরত! আনিশা আশ্চর্য কন্ঠে বলে উঠলো,
– তুমি ওকে বউয়ের মত জড়িয়ে ধরছো কেন?

পূর্ব মেজাজ দেখিয়ে বললো,
– তোর এই বোকার মতো প্রশ্নের জন্য কমপক্ষে দশটা থাপ্পর মারা দরকার! ধাক্কাটা তো জোশ মারলি! ধরতে বললাম তাও অজুহাত দেখালি! এখন কোন আক্কেলে প্রশ্ন করছিস? চুপচাপ বস! জাস্ট রাগ তুলবি! তোকে আমি নিজ হাতে ব্রিজ থেকে ছুড়ে মারবো!

চুপসে গেলো আনিশা। নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য বেশ অনুতপ্ত ফিল হচ্ছে ওর। ইচ্ছে করে তো ধাক্কা মারেনি। ভুলবশত পিছিয়ে গিয়ে ধাক্কা লেগেছে। পূর্ব তো সেটা বুঝলো না। আনিশা মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেললো।

অটোরিকশা রাস্তা খালি পেয়ে খুব দ্রত টানছে। পূর্ণতা পূর্বের বাঁ পাজরের দখলে হুঁশহীন হয়ে ঢলে আছে! পূর্ব নিজের ভেজাচুলগুলোতে আঙ্গুল দিয়ে আলতো ঝাড়া দিচ্ছে। আনিশা অপলক দৃষ্টিতে পূর্বকে দেখছে। কি সুন্দর দেখতে পূর্ব! পানির স্পর্শ পেয়ে সৌন্দর্য্য যেনো আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে ওর! একবার ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর চুলগুলোতে! মুখটা কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো লালচে হয়ে গেছে। চোখের পাপড়িগুলো ভিজে কি দারুণ লাগছে! দ্বিগুণ বিস্তৃতিতে চোখ দুটো আরো লোভনীয় বস্তু ঠেকছে! যতবার পলক ফেলছে পাপড়িগুলোর আড়ালে কালোমণির মায়াজাল…উফফ! মুখটায় একবার ঠোট ছোঁয়াতে পারলে কি ধণ্য হতাম! কেন যে আল্লাহ্ ওকে মেয়েদের মতো ঠোটদুটো দিলো!! ওমন মেয়েদের মতো লাল লাল ঠোট কোনো ছেলের হয়? আল্লাহ্ যেনো এই ছেলেকে রূপ, মোহ, মায়া সব একসঙ্গে ঢেলে ঢেলে তৈরি করেছেন। নাহলে বারবার অপমানিত হয়ে কোনো মেয়ে নিজ থেকে যেচে পড়তে যাবে? দিহানও তো সুন্দর! কত সুন্দর! কিন্তু পূর্বের মতো তো না!!

– আনিশা? পূর্ণকে নিয়ে কিভাবে বাড়িতে ঢুকবি আইডিয়া আছে?
আনিশা ঘোর লাগা কন্ঠে বলে উঠলো,
– উহু,
– শিট! এই অবস্থায় ওকে ছাড়ি কিভাবে? পালস তো লো হয়ে আছে! জলদি গরম পোশাক পড়াতে হবে! বাড়িতে না ঢুকলে…
হঠাৎ আনিশার একধ্যানে তাকানো দৃষ্টি দেখে পূর্ব কপাল কুচকে বললো,
– তুই আবার ফালতু নজরে আমায় দেখছিস!
– তুমি অনেক হ্যান্ডসাম, তোমার মুখ থেকে তুই,তুমি শুনতে কি যে ভালো লাগে!! রাগলে তোমায় টাইট হাগ করে একটা কিস করতে ইচ্ছে করে।
– তুই এসব কি হাবিজাবি বলছিস আনিশা! প্লিজ ট্রায় টু আন্ডার্সন্টেড! তুই এখন বিবাহিত! তোর বর আছে! সংসার হবে! আমাকে নিয়ে ঘাটিস না প্লিজ!
– তুমি বললে আমি এখনো দিহানকে ছাড়তে রাজি। তুমি জাস্ট ‘হ্যাঁ’ বলো, বলো- হ্যাঁ !!

পূর্ব নিজেকে শান্ত করে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো। পূর্ণতার বদ্ধ চোখের মুখটা একবার দেখে নিতেই বুকে কেমন ঝাপটা লাগলো পূর্ব চোখ সরিয়ে ফেললো! নিশ্বাসে টান লাগছে, কার্ডিয়াক পেশি দ্রুত পাম্প করছে, হঠাৎ এমন অস্থিরতা ফিল হচ্ছে কেনো? ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে পূর্ব। নিশ্বাসের তালে তালে ভাবছে, কোন্ আর্কষনে প্রকৃতি বারবার পূর্ণতাকে কাছে টানছে? কেনো করছে প্রকৃতি? পূর্ব নিজের মধ্যে অবর্ণনীয় এক আলোড়ন অনুভব করলো! এক অকল্পনীয় দৃশ্যপট মূহুর্ত্তের মধ্যে মস্তিষ্কে আবিষ্কার করে দেখলো, পূর্ণতা পূর্বের দিকে খিলখিলিয়ে হাসছে! একটা প্রাণোচ্ছল কিশোরীর ন্যায় রিনিঝিনি মুগ্ধতা নিয়ে হাসছে। এতোটা অপরূপ সেই হাসি? কিভাবে? আশ্চর্য! একটা হৃদস্পন্দন যেনো হাসির মুখরে চক্রবৃদ্ধি হারে চুইচুই করে বাড়ছে! হাসির শব্দটা বৃষ্টির থোকা থোকা পানির মতো শব্দ উৎস সৃষ্টি করছে! অদ্ভুতদর্শনের মতো চোখকেও জুড়িয়ে দিচ্ছে! মনের ভেতর শুস্ক চৌচির দগ্ধের মাঝে তৃপ্তিকর বর্ষন ঢেলে দিলে যেমন সতেজ হয়ে উঠে ওরকম ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে। পূর্বদিকের তেজস্বী সূর্যের প্রকোপে যেমন মাঠঘাট ফেটে চৌচির হয়ে যায় তখন বর্ষার অঢেল বর্ষনে উত্তপ্ত প্রকৃতি স্নিগ্ধ শীতলে ছেয়ে যায়…কি অসাধারণ লাগে তখন!! নাহ্ নাহ্! পূর্ণতাকে নিয়ে ভাববে না! খুবই কটু দেখায়! প্রচণ্ডরূপে বেখাপ্পা দেখায়! প্রাক্তন প্রেমিকার বোনকে নিয়ে অনুভূতি? ছিঃ অসম্ভবের চেয়ে অসম্ভব! পূর্ব চোখ মেলে রাতের আকাশে ঝিকিমিকি তারার মাঝে মনের কোণে বুলি আওড়ালো,

আচ্ছা পূর্ণতাকে পূর্ণ ডেকে শান্তি পাই কেনো? একটা মানুষের জন্মগত নামকে ছোটখাটো করে ডাকার মাঝে এ কেমন অদ্ভুত ভালো লাগা? কি এসবের কারন? কিসের জন্য এমনটা হচ্ছে আমার? আনিশাকে সবসময় কাছে টানতে চেয়েছি। যেখানে একটা মেয়ে আমায় পাগলের মতো ভালোবেসেছে আমি ওর ভালোবাসাতে মত্ত হতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। কেন পারিনি? ভালোবাসা তো চুম্বকধর্মী! ‘প্লাস-মাইনাস’ সম্পর্ক! হিত-বিপরীত সম্পর্ক! আনিশাকে কেনো নিজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রতিটা নিউরন সেলে আবদ্ধ করতে পারিনি? ওর জন্য কেয়ার তো দূর! বারবার অপমান করে অপদস্থ করে আত্মসম্মান খসিয়ে অবমাননাকর কথা বলেছি! ঠেলতে ঠেলতে এতোটা দূর করেছি আজ ও অন্যের বউ! কেন হচ্ছে এরকম? অথচ দু’দিনের আসা একটি অদ্ভূত মেয়ের জন্য আমি কি না কি করছি! আমি তাকে বুকে আগলে রাখছি? হাও পসিবল?

পূর্ব অটোওয়ালার ভাড়া চুকিয়ে পূর্ণতাকে কোলে নিয়ে আনিশার পিছু পিছু গেলো। আনিশা ওদের ছোটঘরের দিকে চুপিসারে নিয়ে যাচ্ছে। উঠোন অন্ধকার, বড়ঘরের সব দরজা লাগানো, কাজেই মধ্যরাতে কেউ উঠবেও না। আনিশা ছোটঘরের দরজা খুলে ভেতরে আসতে বললো। পূর্ব পূর্ণতাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে আনিশা দরজা লাগিয়ে ছোট বারান্দা পেরিয়ে কোণার রুমটায় ঢুকে। রুমে একটা চৌকি বিছানো, পাশে জানালা খোলা, রুমে কোনো আহামরি জিনিসপত্র নেই। তবে একটা ঘুণে খাওয়া আলমারি ছাড়া। পূর্ণতাকে চৌকিতে শুইয়ে নিজেও পা তুলে বসলো পূর্ব। আনিশা ততক্ষণে পূর্ণতার কাপড় এনে ফেলেছে। পূর্ব পা ফেলে দরজার দিকে এগুতেই পেছন থেকে আনিশা বলে উঠলো,

– তুমি কোথায় যাচ্ছো? বসো এখানে! তুমি কোত্থাও যাবেনা!
পূর্ব মাথা ঘুরিয়ে একবার আনিশার হাতের দিকে আরেকবার পূর্ণতার মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে বললো,
– মাথার মধ্যে বুদ্ধি বলতে বুদ্ধি নেই? ওর কাপড় বদলাবি আমাকে কিভাবে বসতে বলিস ইডিয়েট! কাজ শেষ, আমি বাড়ি যাচ্ছি! বিকেলে আমাদের বাড়িতে দাওয়াত! বরকে আচলে বেধে চলে আসিস! গেলাম।।

পূর্ব পা ফেলে উঠোন পেরিয়ে যেতেই হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে পড়লো! তানিয়া কানে হেডফোন গুজে বিরাট বড় চোখ করে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছে! পূর্ব উপরের দাতঁ দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো তানিয়ার। যেতেই তানিয়ার মোহিত কন্ঠের ঘোর লাগা ফিসফিসানি, ‘কি হট রে..জাস্ট ফাটাফাটি …’ পূর্ব সেটা শুনতে পেয়ে ভ্রুকুচকালো কিন্তু পাল্টা জবাব দিয়ে শুধুশুধু ঝামেলার আমদানি করতে ইচ্ছে করলো না।

তানিয়া ছোটঘর তথা টিনের ঘরের দরজা খোলা দেখে কিছুটা সন্দেহ জাগলো! দাওয়াতে আসা এই সুন্দর ছেলেটা এতো রাতে ওদের আঙিনায় কিভাবে? মাথা খেলে গেলো তানিয়ার! চুপিচুপি দরজা ঠেলে আবিষ্কার করলো কোণার রুমের দরজার নিচ দিয়ে হলুদ আলো আসছে। নির্ঘাত ওই রুমে কেউ আছে! তানিয়া খুবই সাহসী ! ভূত টুতের ভয় তো কাবু করেই না! চোর ডাকাত এলেও জুতা হাতে এলোপাথাড়ি শুরু করে দেয়! সে ধাক্কা মেরে দরজা খুললে আনিশা হকচকিয়ে যায় রীতিমতো! তানিশা চমকে বলে উঠলো, ‘তুমি!’ আনিশাও সঙ্গে সঙ্গে একই টাইমে বলে উঠলো, ‘তুই’! আনিশা বুকে থুথু দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,
– দরজা লাগিয়ে আয় বেকুব! ভয় পাইয়ে দিয়েছিস!
তানিয়া কথামতো দরজা লাগিয়ে অনিশার পাশে চৌকিতে উঠে বসলো। পূর্ণতার গা ভেজা দেখে ভ্রুকুচকে বলে উঠলো,
– আনিশা আপু এ কি সর্বনাশ হয়েছে! পূর্ণতার শরীর ভেজা কিভাবে!
আনিশা তানিয়ার মাথায় চাট্টি মেয়ে বললো,
– পাড়া পড়শি ডাকতে চাস নাকি? আস্তে কথা বলতে পারিস না! পূর্ণতা পানিতে পড়ে গেছিলো। কাপড় বদলাচ্ছি। আগে বল, বাড়িতে ওকে বা আমাকে নিয়ে কিছু হয়েছে??
তানিয়ার মুখটা চরমভাবে বিগড়ে গেলো শেষাক্ত প্রশ্নটা শুনে! আনিশা উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে দেখে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– তোমার জামাইকে বলবা আমার হাতে ভালোমানুষের মতো একহাজার টাকা ফেলতে! না দিলে তোমার নিউজ যেয়ে থালা পিটিয়ে বলবো!
– আচ্ছা বলবো। এক না দুইহাজার টাকা দিতে বলবো। প্লিজ বল বাড়িতে কিছু হয়েছে?
– না আপু। ওয়াকিল ভাইয়ের ফোন বাথরুমে পড়ে গেছিলো এই নিয়ে কি এলাহীকান্ড!! পরে পূর্ণতাকে পায় না পায় না করে যখন শোরগোল হলো আমি যেয়ে বলে দিছি পূর্ণতা পাশের বাড়ির আলাউদ্দিন চাচার ওখানে বাথরুমে গেছে। ব্যস, আর কিছু হয়নি।সব আমি সামলেছি। আমি সিউর ছিলাম তুমি আর পূর্ণতা মেবি একসাথে আছো!! দেখছো ওটাই হইছে। দুলাভাই তো ঘুমে নাক ডাকছে আপু। তুমি যে পাশে নেই তা হয়তো বেচারা জানেনা।
– আল্লাহ্ ! বড় বাঁচা বাঁচলাম।। দিহানকে ঘুমের ঔষুধ খাইয়েছি ও উঠবেও না।
– আনিশা আপু তুমি কিন্তু প্রমিস করছো ফিরে আসলে আমাকে সব সত্য বলবা। এখন বলো কোথায় গেছিলা, কার সাথে জরুরী সাক্ষাৎ ছিলো, পূর্ণতা পানিতে কিভাবে পড়ছে?

আনিশা পূর্ণতার জামা চেন্জ করতে করতে তানিয়াকে সব বলে দিলো। তানিয়া প্রথমে হতভম্ব হলেও এখন ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। পূর্ণতার গায়ে কাথা টেনে দিয়ে আনিশা ও তানিয়া কলপাড়ে চলে গেলো। আনিশা টুলে বসে পা ধুচ্ছে আর তানিয়া কল চেপে দিচ্ছে।

– আপু পূর্ব কি তোর উপর ক্রাশ ছিলো?
– পূর্ব কি! ভাইয়া বল! সে তোর থেকে অনেক বড়!
– আচ্ছা আচ্ছা, এখন বলবো।।
– আমি ওর উপর ক্রাশ ছিলাম। ও তো আমাকে পাত্তাই দিতো না। ভার্সিটিতে যতগুলা মেয়ে ছিলো সবাই ডর ডরে পূর্বকে আড়াল থেকে দেখতো। কিন্তু সামনে গিয়ে কিছু বলার সাহস পেতো না। জানেই কিছু বললেই এককানে কম শুনা লাগবে।। আমিই প্রথম যে কিনা সবার সামনে ওকে প্রস্তাব দিয়েছি। আজও দেখ আমায় চড় মেরেছে। ওর তো একটা নিকনেমও দিয়েছিলাম, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’। ব্রিটিশদের কোম্পানির নামে। শুনতে পেরে সে কি চড়!! লেকচার এটেন্ড করতে পারিনি চড়ের গাল নিয়ে।
– কি বিপদজ্জনক পোলা রে আপু!
– এজন্যই বলি, তুই আর পূর্ণতা সাবধানে থাক। ও যেই রাগী মানুষ। জীবনেও হাসছে কিনা সন্দেহ। আন্টি ওকে পেটে ধরে ইচ্ছামতো ঝাল খেয়েছে সম্ভবত। কোনো ছেলে এরম বোম্বা মরিচের মতো তিরিক্ষি হয়? কিন্তু ওর মনটা পিউর। খাটি মন বলতে পারিস। ছোট বাচ্চা দেখলে নিজেই বাচ্চা হয়ে যায়।
– আপু তুই তাহলে এক কাজ কর। তাড়াতাড়ি দিহান ভাইয়ের কাছ থেকে বাবু উদ্ধার কর।। আর ওই বাবুটা পূর্ব ভাইয়ার কোলে দিয়ে নিজেও একটা ফিডার মুখে নিয়ে বসে যাস। দারুন না আইডিয়া টা?

আনিশা আহত বাগিনীর মতো তাকালো। ইচ্ছা করছে হাত ঘুরিয়ে ৩৬০ ডিগ্রি এঙ্গেলে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে! পূর্ণতা ও তানিয়া সমবয়সী হলেও তানিয়ার মাথায় যে ভুলবশত ঘিলুর পরিবর্তে গোবর আছে সেটা পরিস্কার বুঝা গেল। এমন বোকা বোকা কথার কোনো মানে হয়?

দুপুর পড়তে শুরু করেছে বাড়িতে আজ আনিশার বরকে দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ঝাক ঝাক আত্মীয় স্বজন এসেছে। উঠোনে পাটি বিছিয়েও জায়গা হয়নি এতো মানুষ!! বড়ঘরের সর্বত্র হৈ হল্লা, মহিলাদের হাসি ঠাট্টা, পুরুষদের আমোদিত বার্তা, ছোট ছোট বাচ্চাদের হৈচৈ চিল্লাচিল্লি…সব মিলিয়ে এক হূলস্থুল পরিবেশ। ছোটঘরের সবচেয়ে মার্জিত রুম হলো কোণার রুমের আগেরটা। সেই রুমে নতুন জামাই দিহানকে ঘিরে তানিয়া, পূর্ণতা, ওয়াকিল, সুহাসের ফূর্তির কলোরব। দিহান দেখতে মাশাআল্লাহ সুন্দর। গায়ের রঙ চাপা, মুখের গড়ন সুন্দর, গালে ছোট ছোট দাড়ি, চোখের কেন্দ্রবিন্দু বাদামী। খুবই শৌখিন প্রিয় মানুষ হলেও রসিকতায় প্রাণবন্ত এবং মিশুক প্রকৃতির। আনিশা অনেকক্ষন পর হাতে পাঁচটা শপিং ব্যাগ নিয়ে ঢুকলো। সেগুলো টি-টেবিলের উপর রাখতেই বলে উঠলো,

– বাবা তোমাদের জন্য পোশাক পাঠিয়েছে এগুলো পড়ে নিও। ওয়াকিল? বাবা তোকে ডেকেছে যা। পূর্ণতা, তানিয়া? তোরা এখন চল আমার সাথে। দিহানকে একটু রেস্ট নিতে দে।
দিহান হাসিমুখে বলে উঠলো,
– নতুন বরদের বিয়ের ছ’মাস পযর্ন্ত রেস্ট হয়না বুঝলে? পূর্ণতা তানিয়া তোমরা যাচ্ছো কেনো? বসো তো!! আড্ডা দিচ্ছি। আবার কবে না কবে ছুটি পাই জানিনা। মেরিনের জব তো মামাবাড়ির আবদার মন্জুর করেনা। কি যে কষ্ট!
পূর্ণতা নিজের শপিং ব্যাগটা তুলে বললো,
– ভাইয়া ছ’মাস তো পেয়েছেন? চিন্তা কিসের? আমাদের আড্ডা তো রথ করছিনা।। এখন একটু রেস্ট করুন। আমরা রেডি হয়েই আসছি।
আনিশা দরজার কাছে চলে যেতেই বলে উঠলো,
– শোন তোরা দুইটা!! সাজুগুজু করতে যেয়ে যদি ঘন্টার পর ঘন্টা লাগে আমি খুন্তি দিয়ে পেটাবো! চটপট শাড়ি পড়ে চুল আচড়ে বেরুবি! ওয়াসিফ বাড়িতে দাওয়াত। নানাভাই কিন্তু দেরি সহ্য করবেনা।

আনিশা আপুর আজ্ঞাপত্র পেয়ে আমরা রেডি হতে চলে গেলাম। মানুষ যা পারেনা তাকদির তাকে দিয়ে সেটাই বারবার করায়! আমি শাড়ি পরতে পারিনা আমাকে এখন শাড়ি পরতেই হচ্ছে। বিরক্ত লাগে শাড়ির গেটআপটা! কেন যে মেয়েরা শাড়ি পড়া পছন্দ করে! আনিশা আপু খুব দক্ষতার সাথে আমাকে আর তানিয়াকে শাড়ি পরিয়ে দিলেন তাও আবার বাঙালি স্টাইলে। এ আরেক ঝামেলা! ব্লাউজের গলা দেখি ইয়া বড়! পিঠ বেরিয়ে থাকে মাছের মুখের মতো! আমি পিঠে পাতলা চাদর টেনে নিয়েছি যাতে কিছু পরিদৃষ্ট না হয়। চুলে ডানদিকে সিথি তুলে একগোছা চুল সামনে ফেলে বাকি চুল পিঠের উপর ছেড়েছি। তানিয়া কি কি যে মাখলো নামও জানিনা। চোখের নিচে ফাউন্ডেশনের মতো কি যেনো দিয়ে ব্লেন্ড করলো, আরো হেনতেন জিনিস দিয়ে মুখে কৃত্রিম সৌন্দর্য্য আনলো। আমি ঠোঁটে স্ট্রবেরি পিংক লিপস্টিক লাগিয়ে সাজ কমপ্লিট করে বাইরে চলে গেলাম। তানিয়া আসতেই রাস্তার ধারে অপেক্ষারত অটোরিকশায় উঠে বসলাম।। টোটাল তিনটা অটো একটার পিছে আরেকটা চলছে। প্রথমটায় নানাভাইসহ পুরুষরা, দ্বিতীয়টায় আনিশা আপু ও দিহান ভাইয়া, তৃতীয়টায় আমরা ভাইবোনগুলা। মহিলারা কেউ আসেনি। দুপাশে টিনের ঘর, সারি সারি গাছ, গ্রামের চাষ করা জমিগুলোকে পাশ হটিয়ে অটো থামলো একটা সরু পথের মাথায়। আমরা সবাই সরুপথ দিয়ে মস্ত এক বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। বারান্দায় বসা ছিলেন ওয়াসিফ মূসা ও উনার সহধর্মিনী। আমাদের দেখেই সাদরে ভেতরে নিয়ে বসালেন। আমি চোখ ঘুরিয়ে রুমটা দেখছি। কি সুন্দর পরিপাটি তরিকায় সজ্জিত!রুমের কোণাগুলিতে চারাগাছ সহ টব। আলমারি, শোকেজ, আলনা পরপর সাজানো। তানিয়া আমার পাশে বসে কানের কাছে বলে উঠলো,
– পূর্ণতা? চল না এবাড়ির বড় নাতিকে দেখে আসি! ওইযে মেরুন পান্জাবীর ছেলেটা!! যা জোশ রে! কাল তো তোর সাথেই ছিলো!!
আমি চমকে তানিয়ার দিকে বিষ্ময়দৃষ্টিতে তাকালাম! তানিয়া তাহলে জানে? আমি স্বর নিচু করে বললাম,
– তুই জানিস কি করে?

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ এতো জোরে কিল মারলো আমি বাজখাই গলায় ভয়াবহ কিছু বলবো তার আগেই দেখি ওয়াকিল ভাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– তোরা ফিসফিস করবি বাইরে যা! এখানে এমন উগ্রস্বভাব দেখাচ্ছিস কেন? বড়রা বসে আছে দেখিস না? বেত্তমিজ গুলা!

আমি আর তানিয়া বাড়ি দেখার নাম করে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। তানিয়ার যে কি খুশি! পারেনা শাড়ি ধরে ‘বড়লোকের বেটি লো’ গানে নাচ দিয়ে ফেলে! আমি ভাবছি বাড়ি এতো ঠান্ডা ঠান্ডা কেনো? ওই শয়তানগুলা কি নেই?

– ‘ফুয়াদদের খুজছো? ওরা নেই। মধুটিলায় ঘুরতে গিয়েছে। ‘

একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর পেয়ে তানিয়া আমার হাত চেপে ধরলো। আমি তানিয়াকে শান্ত থাকতে বলে একসাথে দুজন পিছে ঘুরে তাকালাম। এই মেয়েটাকে ওদের সাথেই দেখেছি। নামটা মনে পড়ছেনা। আমাদের কাচুমাচু করতে দেখে মেয়েটা একপা এগিয়ে বলে উঠলো,
– পূর্ণতা আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি পূর্বিকা।
আমি ঢোক গিলে ঠোঁটে অনিচ্ছুক হাসি ঝুলিয়ে বললাম, হ্যাঁ এখন চিনেছি।
– বেশ। তো কেমন আছো? বাহ্ তোমাকে তো মিষ্টি লাগছে। তখনকার সাথে এই পূর্ণতাকে চিনাই যাচ্ছেনা। কি সুন্দর লাগছে তোমায়!!আসো ওদিকে আসো। এখানে দাদুরা থাকুক।

তানিয়া বাচ্চাদের মতো আমার হাত ধরে হাটতে লাগলো। পূর্বিকা আপু সামনে হাটছে আমরা দুজন পিছনে। উনি দরজা খুলে ভেতরে বসতে বলে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। দুপুরের তীক্ষ্ম ঝাঝালো রোদ এসে রুমটাকে আলোকিত করে দিলো। আপু বিছানায় বসে কোলে বালিশ নিয়ে আমাদের দিকেও বালিশ বারিয়ে বলেন,

– ইশ লজ্জা করো না, পা তুলে বসো। নাও বালিশ। শাড়ি নষ্ট হলে আমি আছি। টেনশন নেই।

পূর্বিকা আপু খুবই মিশুক! উনি এতো সুন্দর সুন্দর কথা বলে যে চুপচাপ শুধু শুনতেই ইচ্ছা করে। কথার ছলে ছলে রসিকতাও করেন বেশ। আপুও নাকি বিবাহিত কিন্তু কাবিন হয়েছে শুধু। সব বিষয়ে কথাবার্তা বলতেই তানিয়াও এখন চুটিয়ে আড্ডা জমিয়ে দিয়েছে। হাসি,তামাশা,উৎফুল্লতা সব মেতে উঠলো জমজমাট আড্ডাবাজিতে। আমাদের হাসাহাসির শব্দে হঠাৎ কেউ ধপ ধপ করে এগিয়ে এসে বাজখাই গলায় বলে উঠলো,

– এটা কি বাড়ি নাকি চিড়িয়াখানা? মাছের বাজারের মতো হুল্লোড় শুরু করেছে! কমন সেন্স টুকু নেই! অন্যের বাড়িতে এসে…

এটুকু বলতেই উনি থেমে গেলেন আমার দিকে তাকিয়ে। আমি পূর্বিকা আপুর দিকে একপলক তাকিয়ে উনার দিকে তাকালাম। একগাদা এলোমেলো চুলে কপাল ঢেকে আছে। হাতে আইপ্যাড, গায়ে ডার্ক ব্লু টিশার্ট, নাইক লোগোর ট্রাউজার, চোখে মুখে তব্দা লাগার ভঙ্গি। তানিয়া আমায় কনুই গুতা মেরে বললো, ‘দেখছিস পুরাই কিলিং লুক! এইভাবে যে সামনে আসলো আমার তো মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো রে! রাতের ঘুম হারাম! শেষ!! পূর্ণতা?তামিমের সাথে ব্রেকাপ!সিউর ব্রেকাপ! আজ থেকেই ব্রেকাপ!!’ পূর্বিকার আপুর কথায় সন্ধি ফিরে পেলাম আমরা,

– বাড়িতে কুটুম আসলে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস? এগুলো মেনার্স?
পূর্ব ভাই হতবিব্হল ভঙ্গিতে একবার আমার দিকে তো আরেকবার আপুর দিকে জবাবদিহির ছুতো খুজছেন। শেষে আমতা আমতা করে বলে উঠলেন,
– আপি সরি, আমার শরীরটা ভালো না জানিসই তো। চিল্লাচিল্লি শুনে রেগে গিয়েছিলাম। সরি…

পূর্বিকা আপু সরি ওয়ার্ড শোনার পরেই চুপ! তানিয়া এখনো পূর্ব ভাইকে দেখেই যাচ্ছে। আমি বিছানার দিকে দৃষ্টি রাখতেই হঠাৎ আরেকদফা শোনা গেলো,
– আপি? গেস্টদের খালিমুখে বসিয়ে রাখবি? যা চা-টা নিয়ে আয়।
– হায় রে!! দিনদিন সব ভুলে যাচ্ছি!! এই তোমরা বসো আমি আসছি!!

পূর্ব ভাই ডেভিল মার্কা হাসি দিলেন কেনো বুঝলাম না হঠাৎ উনি ভেতরে আসতে আসতে বললেন,
– এইযে পাশেরটা? কমলা শাড়ি! এভাবে কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছো কেনো? আমি যদি তোমাকে এখন ওভাবে ঘুরঘুর করে দেখি তোমার কেমন লাগবে?
– ভালো লাগবে।
সাথেসাথেই জিভ কাটলো তানিয়া। মাথা ঝড়ের স্পিডে ডানবামে ঝাকিয়ে বললো,
– না মানে ভালো লাগবেনা। খারাপ লাগবে।
পূর্ব ভাই বিছানার কাছে দাড়ালেন। আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কিনা জানিনা, আমি মাথা নিচু করে বিছানার উপর ফুলের প্রিন্ট গুনছি। হঠাৎ উনি হালকা কেশে গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন,
– আচ্ছা কমলা শাড়ি তোমার নাম কি?
তানিয়া খুশিতে জবাব দিলো, ‘তানিয়া ইবনাত’।
– আচ্ছা তানিয়া তুমি যে মোস্ট বিউটিফুল গার্ল সেটা জানো?
– ইয়া আল্লাহ!! সত্যি!!!
– ইয়েস, তিন সত্যি। আমার না বহুদিনের শখ। মোস্ট বিউটিফুল মেয়ের হাতে থেকে এককাপ কফি খাবো। কফিটা মিষ্টি হবেনা। তিতা স্বাদ থাকবে ইউ ক্যান স্যা, উইথআউট সুগার কফি। কফিটা খাওয়ার এতো ইচ্ছা যে…
মাঝপথে থামিয়ে তানিয়া লাফিয়ে বলে উঠলো,
– আমি কি আপনাকে এক কাপ কফি খাওয়াতে পারি?
– অফ কোর্স! কি সৌভাগ্য!!
– আপনি একটু দাড়ান। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি এক্ষুনি আসছি।।।

তানিয়া প্লিজ যাস না! যাস না!! মনের মধ্যে চিৎকার করে বলছি। কিন্তু তানিয়া শুনলো না! এখন কি হবে মাবুদ? উনি কি কালকের জন্য আমাকে উড়াধুড়া মারবেন? কাল তো ইচ্ছে করে পানিতে পড়িনি আপুর জন্য হয়েছিলো। বিপদ থেকে বাচার দোয়া পড়ছি। দোয়া ইউনুস! হযরত ইউনুস (আঃ) যখন মাছের পেটে আটকা পড়েন তখন উনি ওই কঠিন বিপদ থেকে বাঁচার জন্য উক্ত দোয়াটা পড়েছিলেন!! আল্লাহ্ পাক উনাকে উদ্ধার করলেও আমাকে এখন উদ্ধার করবেন কিনা জানিনা। আমি খিচ মেরে দোয়া জপে যাচ্ছি। হঠাৎ উনি চিৎকার করে বললেন,
– পূর্ণ তেলাপোকা!!! তোমার শাড়িতে তেলাপোকা!!

আমার আত্তা যেনো সাথে নেই! চিৎকার দেওয়ার আগেই আমি লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ি!! গায়ের চাদর সরিয়ে ঝাড়া দিচ্ছি!! শাড়ির ভাজে ভাজে ঝাড়া দিতেই উনি বলে উঠলেন,
– না না ওইযে!! ওইযে তেলাপোকাটা! এই তুমি আমার সাথে চলো!!

উনি আমার হাত ধরে রুম থেকে বের করে দুটো ঘর ওভারটেক করে অন্যরুমে নিয়ে গেলেন। আমি হাতের চাঁদরটা ঝাপটানি দিচ্ছি, চুল ঝাড়া দিতেই দেখি উনি আমার সামনে দন্ডায়মান। বুকটা ধক করে উঠলো। উনাকে স্বাভাবিক লাগছে কেন?মাথা পেছন ঘুরিয়ে দেখি দরজার দুটো সিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে। আমি ঢোক গিলে আস্তে আস্তে মাথা সামনে ঘুরাতেই দেখি উনি আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি সুযোগ বুঝে দৌড়াতে যাবো শাড়িতে পা আটকে উস্ট্রা খেয়ে শাড়ির ভাজ নষ্ট হলো! পূর্ব ভাই আমার অবস্থা দেখে উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে হাসছেন!! অলুক্ষনে পোশাক! আমি জীবনেও শাড়ি পরবো না! যতবার পড়েছি ততবারই বিপদের মধ্যে ফেসেছি! গতবার সুনশান রাস্তায়, আজ পূর্ব দিগন্তের আস্তানায়! উনি এগুতে এগুতে আমার পিছনে যাওয়ার রাস্তা খতম করে দিলেন। পিছনে কি আছে জানিনা, পিঠের ডলায় বুঝলাম দেয়াল টাইপ শক্ত কিছু!! হঠাৎ উনি দূরত্ব আরো সংকোচন করে বলে উঠলেন,
– পিছনে ভাঙা আয়না, সরে এসো। আয়নার ভাঙা টুকরো শরীরে ঢুকে পড়বে।

আমি কথা শুনে ভয়ের ক্রোশে আরো পিছিয়ে যেতেই পিঠে ঢুকে গেলো কাচ! আমি চোখ খিচ মেরে ‘উহ্’ করলে উঠলে উনি হাত টান দিয়ে উনার দিকে ঘুরিয়ে ফেলেন…

-চলবে

#FABIYAH_MOMO🍁