তোকে ঘিরে পর্ব-১০+১১

0
805

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_১০
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

সকালে চোখ খুলে দেখি সব অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখছি। আশ্চর্য! আমিতো রুমের লাইট জ্বালিয়ে জানালা খুলে শুয়েছি রুম এতো অন্ধকার কিভাবে? বিছানা থেকে উঠতে যাবো দেখি শরীরের উপর পর্বতপ্রমাণ ভারী কিছু লাগছে! আমি অস্থিরচিত্তে হাত নাড়াচাড়া দিতেই হঠাৎ হাতদুটো কেউ বিছানার সাথে চেপে ধরলো! আমি চিৎকার দিয়ে উঠি! চিৎকারের শব্দে পাড়ার লোক জেগে যাওয়ার কথা কিন্তু শব্দটা শুনে বাবা, মাও এলোনা। প্রচণ্ড ভয়ে শরীরের লোম দাড়িয়ে গেছে গা ছমছম করছে! হঠাৎ আমার কানের কানে একটা ফিসফিস শব্দতরঙ্গ এলো। খুবই ফিসফিস!

‘পূর্ণ আমাকে ভয় পাও কেন…’

চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে শব্দ উৎসের দিকে মুখ করতেই সে আমার গলার কাছে হাত ডুবিয়ে ঘাড় চেপে কাছে আনলো! রুম এখনো অন্ধকার! আমি কাপা কাপা গলায় ঠেলেঠুলে হাত বের করে তার দিকে রাখতেই সূচের মতো খোচাখোচা অমসৃণ কিছু হাতের তালুতে লাগলো। উনার গাল! উনি আচমকা দুহাতে জড়িয়ে ধরে একহাত আমার চুলে ঢুকিয়ে পাঁচ আঙ্গুলের প্রায়োগিক দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলেন। এমন ভাবে চেপে ধরেছেন যে, তার বুকের কাছে আমার ঠোঁট ছুচ্ছে। শরীরের নিচে চাপা পড়ে যাওয়া হাতটি উনার পিঠের উপর রাখতেই সে আমার চুলে ঠোঁট বসিয়ে বলে উঠলেন,

– আমাকে আসতে বলো না কেন?

স্বপ্ন না হ্যালুয়েশন কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি। যদি পূর্ব হয়েই থাকে আমি আজ উনাকে যেতে দিবো না! খামচে, জড়িয়ে নিজের পার্সনাল ডায়েরির মতো লুকিয়ে রাখবো। উনি কোমল কন্ঠে ঠান্ডা গলায় বললেন,

– চলে যাবো?

অসম্ভব! কক্ষনো যেতে দিবোনা! এই লোক ভাবলো কি করে আমি উনাকে যেতে দিবো! গেলে আমার লাশ যাবে! আমি উনাকে আরো শক্ত করে দুহাতের দশটি আঙ্গুলের সাহায্যে লতার মতো আকঁড়ে ধরেছি।

– পূর্ণ ইউ আর ক্রায়িং…

আমি কাঁদছি? কই নাতো? চোখ থেকে কখন পানি পড়লো?উনার যাওয়ার কথা শুনেই কি বেহায়া চোখগুলা ভিজে উঠেছে? পূর্ব আমার চুল থেকে ঠোঁট সরিয়ে কানের কাছে হাত ডুবিয়ে আমার মাথা কিছুটা উচু করে বলে উঠলেন,

– কাদঁছো কেন?

অন্ধকারে উনার মুখ অদৃষ্ট! কিন্তু গলার নেশামাখা কন্ঠটা শুনে গলা জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। কিছুটা সময় নিরবতা কাটিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলাম,

– আপনি খুব বাজে একটা লোক! এক নাম্বার নোংরা! স্বার্থপর! আপনি কখনো এসে খোঁজ নিয়েছেন, ‘পূর্ণ কেমন আছো?’ ট্রেনেও আপনি সেদিন বিদায় দিতে আসেন নি। ওইদিন রাতেও মুখ ফিরিয়ে একটা বার দেখেন নি। তো এখন কেন এসেছেন? আরো কষ্ট দিতে?

আবার চুপ করে রইলেন উনি। নিরবতা নিয়ে কোনো আওয়ার্ড থাকলে নির্ঘাত টপ টেনে থাকবেন উনি! আমি পাক্কা সিউর! হঠাৎ গম্ভীর সুরে উনি আস্তে করে বললেন,

– কষ্ট কিভাবে দেয়? আমি তো কেউ না।
– কে বলেছে কেউ না!
– বলতে হয়না।
– আপনাকে আমি মেরে ফেলবো! আপনি আমায় কষ্ট দিচ্ছেন! মা আমাকে পাগল বলে আখ্যা দিয়ে ফেলেছে! সবকিছু আপনার জন্য হয়েছে ! আপনি দোষী! অপরাধী! পাপী!

হঠাৎ তড়িৎ বেগে আমার পায়ের কাছে তীব্র ব্যাথায় সন্ঞ্চার হয়ে আমার সমস্ত গা ঝিমুনি দিয়ে উঠলো!আমি চোখ খুলে দেখি মা সামনে দাড়িয়ে উনার হাতে মোটা কাঠের লাঠি! উনাকে রাক্ষসীর মতো ভয়ঙ্কর লাগছে! পায়ের ব্যথা শেষ না হতেই মা শূন্যে লাঠি উঠিয়ে আরেক দফা মারলেন! কয়েকমিনিট আমি চোখ কুঁচকে দাঁতে ঠোঁট কামড়ে স্থির হয়ে আছি। কানের ভেতর শুধু ভো ভো শব্দ শুনছি। চোখের দুই প্রান্ত থেকে টপ করে পানি খসে পড়তেই বাহুতে যন্ত্রণার ঝাঁজ অনুভব করছি!

– তুই ভালো মানুষের মতো চলবি কিনা বল! যদি না পারিস আমি তোকে এখুনি মেরে কবর দিয়ে আসবো! বল কি করবি!

চোখ খুলেও অশ্রুর কারনে মায়ের চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা। হাতে আগুনের গোলা পরলে যেমন দাউদাউ করে ব্যথা করে ওমন করে যন্ত্রণা করছে। মা রাগে গজগজ করতেই আমার পা ধরে হেচকা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিলেন। ফ্লোরের সাথে মাথা লেগে চোখমুখ অন্ধকার দেখছি! শরীর প্রবল অসারে জ্ঞানহীন হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে! মা চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

– তোর মতো বের্জন্মা মেয়েকে পেটে ধরেছি ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে! তুই একটা পর পুরুষকে নিয়ে পাগলামো করছিস! ছিঃ! আবার জল্পনা করছিস ওই ছেলেকে নিয়ে! থু!

লাঠি ফেলে মা চলে গেলে আমি ফ্লোরে শুয়ে চোখ বন্ধ করি। একটু আগে আমি পূর্বকে নিয়ে টানা ষষ্ঠ বারের মতো হ্যালুয়েশন দেখেছি। পূর্বকে নিজের আশেপাশে ভেবে কল্পনার জগত সাজিয়ে উদ্ভট আচরন করছি। আচ্ছা আমি কি মেন্টালি ডিসঅর্ডার হয়ে গেলাম? মেন্টালি সিক?

.
দূর্বল হার্টের মানুষ যেমন তীব্র ঝটকা নিতে পারেনা তেমনি পূর্ণতার মতো মানুষ প্রিয় জিনিসটার দূরত্ব মানতে সক্ষম হয়না। যে জিনিসটা প্রিয়! যেটা নিজের কাছে রাখার মতো তীব্র বাসনা! সেটা হঠাৎ এভাবে দুমকা হাওয়ার মতো হারিয়ে গেলে মস্তিষ্ক ঠিক থাকেনা। মন কিছুই ভাবতে পারেনা। সবাই পূর্ণতাকে মানসিক ভাবে দূর্দাস্ত ভাবলেও পূর্ণতা জানে সে কল্পনা করছে, তার মস্তিষ্ক হ্যালুয়েশন নামক শব্দটি দ্বারা বারবার নির্যাতিত হচ্ছে। এসময় বন্ধুরা এসে সার্পোট করবে, পরিবারের সবচেয়ে মূখ্য ব্যক্তি মা পাশে দাড়াবে কিন্তু তার একটিও জীবনে হলো না। বাবা নামক মানুষটির কাছেও পূর্ণতা সব কথা খুলে বলতে পারলো না। কিছু কথা বাবা-মাকে বলা যায় না, কিছু কথা বন্ধুমহলেও বলা যায় না, কিছু কথা কাউকেই বলা যায় না। সেই ‘কিছু কথা’ আজীবন নিজের ভেতরেই থেকে যায়। যদি কখনো আর্শীবাদ স্বরূপ সেই ‘কিছু কথা’ বলার মতো একজন বিশেষ ব্যক্তি পাওয়া যায়, তখন সে হয়ে যায় সৌভাগ্যশালী। কিন্তু পূর্ণতার জীবনে কেউ এলো না। দেয়ালে টাঙানো রঙিন ওয়ালমেটের মতোই সে নির্জীব হয়ে রইলো সবার কাছে।

দুপুরের তেজবর্ণ গলে গিয়ে বিকেলের লাল আভায় পূর্ণতা মেলেছে আকাশ। খোলা চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, কপালের উপর কিছু চুলের খেলা হচ্ছে, ঠোট জোড়া স্থির হয়ে শান্ত চোখজোড়া দিয়ে আকাশ দেখছে। বিকেলবেলার প্রকৃতি কি সুন্দর লাগে! চুপচাপ নিরবতার ভঙ্গিতে বারান্দায় দাড়িয়ে পূর্ণতা প্রকৃতি দেখছে। তার ঠিক পাশে দাড়িয়ে রেলিংয়ের উপর প্লেট রেখে আপেল কাটছে কাজের মেয়ে নূরানী। বাবা নূরানীকে পূর্ণতার দেখভালের জন্য নিয়োজিত রেখেছে। মেয়েটার গায়ের রঙ শ্যামলা, চোখদুটো ভারী ভারী, চুলগুলো খোপায় গাঁথা, পড়নে সালোয়ার কামিজ।

– আপা দোলনায় বসেন আপেল কাটছি।
পূর্ণতা ম্লান গলায় জবাব দিলো,
– আগে তুই খা। আমি একটু পর খাচ্ছি। আকাশটা দেখতে দে।
নূরানী পূর্ণতার দৃষ্টি ধরে আকাশের দিকে চোখ ঘুরালো। দুপাটি দাঁত বের করে বললো,
– আজকা আকাশটা খুউব সুন্দর লাগতাছে তাইনা পূর্ণতা আপা?
– হু। কিরে দোলনায় বসতে বলেছিনা? ফ্লোরে বসবি! আমি তোর পা ভেঙে দিবো।
– আপা দোলনা হইলো আপনাগোর বসোনের জায়গা। আমি বইলে নোংরা হইবো।
পূর্ণতা ‘নোংরা’ শব্দটা শুনে নূরানীর দিকে ঝট করে তাকালো। এই একটি শব্দের জন্য নিজেকে আজও খুব দোষী মনে হয় পূর্ণতার। পূর্ণতা নূরানীকে একপ্রকার জোর করে দোলনায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। নূরানীর বয়স কম। মাত্র সতের। পূর্ণতা নূরানীর মাথায় হাত রেখে বললো,
– নূরানী নিজেকে নোংরা বলবিনা পাগলী। তুই নোংরা হলে আল্লাহ্ তোকে সৃষ্টিই করতো না বুঝেছিস? নে আপেলটা খা। আর কখনো এসব বলে আমাকে কষ্ট দিস না। তুই তো জানিস এ ঘরে তোর খালাম্মা আমায় পছন্দ করেনা। এমনেতেও কষ্টে আছি।

নূরানী মন খারাপ করে পূর্ণতাকে আচমকা জাপটে ধরলো। পূর্ণতা নূরানীর মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু বলবে তার আগেই নূরানী বলতে লাগলো,

– আপনে কষ্ট পান শুনলে আমার খুব কষ্ট হয় আপা। আপনে কাইদেন না আপা। আপনার চোখে পানি ভালো লাগেনা। আপনে আমারে যেমনে আদর করেন ওমনে আমার নিজের মা-ও কদর করেনাই। অপয়া বইলা গাইল্লাইছে। আমি বলে…
পূর্ণতা ওকে থামিয়ে বললো,

– চুপ চুপ…ওসব অতীত নিয়ে কথা বলতে যাবিনা। মেয়েদের সবসময়ই নিচু করে দেখা হয়। ওতে তোর দোষ না। তোর পরিবার যদি তোর গায়ের চামড়া মুখের সৌন্দর্য নিয়ে কটুক্তি করে দুকান দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিবি। ওগুলা কখনো ভালো মানুষ করেনা! চুপ কর এখন। আপেলটা খেয়ে আমায় উদ্ধার কর।

নূরানীকে ছেড়ে পূর্ণতা নিজের ওড়না দিয়ে ওর চোখ মুছিয়ে আপেল খেতে বলে। নূরানী আবদার জুরে বসে ঠান্ডা ঠান্ডা সুন্দর বিকেলে কিচিরমিচির পাখির আওয়াজে পূর্ণতা যেনো একটা গান শোনায়। পূর্ণতার গানের গলা মারাত্মক! পূর্ণতা প্রথমে রাজি না হলেও শেষে আবদার পূরণ করলো। চোখ বন্ধ করে হালকা নিশ্বাস ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলো,

‘তোমায় ঘিরে যে ভালোলাগা হয়নি বলা ভাষায়..
হাজার ভিড়ে যে খুজেঁ পাওয়া সেই তুমি আজ কোথায়,
তোমাকে নিয়ে সেই স্মৃতিরা আজো খুজে ফেরে আমাদের,
কি যেনো কি ভেবে হারিয়ে গেলে
এসো না ফিরে হৃদয়ে…’

.

নূরানীকে নিয়ে বিকেল টাইমে একটু বাইরে বেরিয়েছি। বিষন্ন মনটাকে একটু খুশি রাখার প্রয়াসে আবাসিক এলাকার রাস্তা পেরিয়ে নূরানীকে সঙ্গে নিয়ে মেইন রোড দিয়ে রোজ গার্ডেনের দিকে যাচ্ছি। নূরানী ওর জীবনের মজার মজার ঘটনাগুলো আমাকে রসালো করে বলছে। মেয়েটার মন খুব নরম, কোমল, সরল। হেসে হেসেই সব কথা বলে। হঠাৎ একটা গাড়িকে লাগামহীন ভাবে আসতে দেখে আমার বুকটা ধব্ক করে উঠলো! কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আমি নূরানী ধাক্কা মেরে ফুটপাতের অংশে ফেলে চোখ খিচুনি দিয়ে মুখ দুহাতে ঢেকে ফেলি। বুকটা ধ্বকধব্ক করে কাপছে। আমি এক্সিডেন্টে মরে যাবো!! গাড়িটা বিকট হর্ণ বাজিয়ে আমার পায়ের কাছে থামতেই আশপাশের দোকানদারের চিৎকার শুনতে পেলাম। আমি মুখের উপর আঙ্গুল ফাঁক করে দেখি গাড়িটা আমার একদম কাছ ঘেঁষে থেমেছে! আল্লাহ্ কি ভয়ংকর এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচলাম! লোকটা গাড়ি থেকে নেমে আমার উদ্দেশ্যে গালাগালি করবে তার আগেই রাস্তায় থাকা পাব্লিক লোকটাকে এক ধোলাই দিলো।

– মদ খাইয়া গাড়ি চালাস? এইটা তোর বাপের রাস্তা যেমনে মন চায় ওমনে চালাবি!

বলেই কষিয়ে মারলো এক চড় ওই গাড়ির ড্রাইভারকে। লোকটাকে দেখে মনে হলো নেশাজাতীয় কিছু খেয়েছে। চোখ লাল, শরীরও দুলছে। একটুর জন্য যে আমি বেঁচে গেছি তা হারে হারে টের পাচ্ছি। ফুটপাত দিয়ে হাটলেও এখন দূর্ঘটনা থেকে নিস্তার নেই! কি আজব ট্রাফিক সিস্টেম!

বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে অন্ধকার হয়ে এলে নূরানীকে নিয়ে বাসার জন্য পা বাড়াই। দোকান থেকে দুইটা আইসক্রিম কিনে দুজনে খেতে খেতে বাসার সামনে আসতেই আমার চোখ থতমত খেয়ে হাত থেকে আইসক্রিমের কাপ পরে যায়। নূরানীও একই দর্শনে আশ্চর্যজনক ভঙ্গিমায় ঢোক গিলছে। আমি ও নূরানি একে অপরের দিকে তাকালে নূরানী বলে উঠলো,

– আপা এইডা হেই গাড়ি না যেইডা আপনেরে ধাক্কা মারতে নিছিলো?

আমি ওড়নায় হাত মুঠো চেপে ঠোঁট আলতো ভিজিয়ে মাথা ঈষৎ নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝাই। নূরানী ঝট করে আমার পিছনে লুকিয়ে উকি মেরে সামনে থাকা তছনছ ভাঙচুর গাড়িটা দেখছে। নূরানী ভয়ে চুপসে যেয়ে মৃদ্যূ কন্ঠে বলে উঠলো,

– আপা আপনের লগে জ্বিন আছে মনেহয়। নাইলে এই গাড়ি এট্টু আগে আপনেরে টক্কর দিতে লইছিলো এখন এইডা মোয়ার মতো ভাঙচুর করছে কে? জ্বিনেই করছে আপা।

আমি খুবই সর্তক দৃষ্টিতে ডানপাশ থেকে চোখ ঘুরিয়ে বামপাশে দেখছি। জ্বিন করবে বলে আমার বিশ্বাস হয়না। এইটা মানুষের কাজ! কে করেছে সেটাই ধরতে পারছিনা! ডানহাত এনে বুকের বাম পাশে রেখে চোখ দিয়ে এপাশ ওপাশ দেখেই যাচ্ছি। বুকটা কি ধরফর ধরফর করছে। কে আমাকে ফলো করছে? আমি নূরানীকে ছেড়ে গাড়িটার চর্তুপাশে ক্লু খোজার চেষ্টা করছি। যে এই গাড়িটা ভেঙেছে সে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ভুল করে কোনো ক্লু ছেড়েছে! বিধ্বস্ত গাড়িটার নিচে চেক করার জন্য আমি হাটু গুজে মাথা নুয়ে ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেই হঠাৎ চাকার কাছে একটা কাঠের কি রিং দেখতে পেলাম। আমি আরেকটু চেষ্টা চালিয়ে হাত সম্পূর্ণ প্রসার করে চাকার কাছ থেকে কি রিংটা আনি। ওটা উল্টেপাল্টে চেক করতেই দেখি ছোট্ট কাঠের উপর ছাপিয়ে লিখা – ‘কমরেড পূর্ব’

-চলবে

#তোকে_ঘিরে❤
#পর্ব_১১
#ফাবিয়াহ্_মমো🍁

গাছের সাথে বেধেঁ হকিস্টিক হাতে পাচঁজন ছেলে তুখোড় মেজাজে এক মধ্যবয়স্ক লোককে পিটাচ্ছে! লোকটার সাদা শার্ট ঘামের বদলে রক্তে ভিজে আছে, চোখের কোণা দিয়ে রক্তফোঁটায় অশ্রু ঝড়ছে, মুখ দিয়ে পড়ছে তরল রক্ত। হঠাৎ একটা তীব্র কন্ঠ এসে বাতাসের সাথে মিশে চারধার যেনো প্রবল প্রতিধ্বনিত্ব হলো,

– থাম!

ওরা হকিস্টিক থামিয়ে আগত কন্ঠধ্বনিটার আজ্ঞা পালন করতে আহত লোকটা থেকে কয়েক কদম দূরে যেয়ে দাড়ালো। কালো শার্ট পড়নে! বেশ দীর্ঘ উচ্চতা! গায়ের বেশভূষা ও মুখের সুদর্শন আদল দেখলে কেউ বলবেনা ছেলেটা মারাত্মক ভয়ংকর নেতা! শার্টের হাতা কনুইয়ে ফোল্ড করে লোকটার পেছনে থাকা গাছের উপর একহাত রেখে কিছুটা ঝুঁকলো সে! লোকটা আঘাতপ্রাপ্ত চোখ দিয়ে অন্ধের মতো আলতো খুলে তাকাতেই কাপা কাপা গলায় থেমে বলে উঠলো,

– আমাকে.. আমাকে ধরেছেন কেন? কি দোষ.. দোষ আমার?

এই উত্তর শুনে দূরে দাড়ানো পাচঁজনের মধ্যে একজন খেকিয়ে বলে উঠলো,
– পূর্ব ভাই হারামজাদারে মারতে দেন! শালার হুশ এখনো হয়নাই! কুত্তার বাচ্চা এক্সিডেন্ট মারায়া জিগায় কি দোষ!

পূর্ব গম্ভীর মুখে বাম ভ্রু খানিকটা উপরে তুলে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোর হুঁশ কি আমি বোঝাবো ড্যামিশ?

পূর্বের উষ্ণ ধ্বনি শুনে ভয়ংকর রূপে চুপসে গেলো ছেলেটা। পূর্বের কাজে নখ ঢুকানোর জন্য মাথা নুয়ে ঢোক গিলে নিজের ভুল বুঝতে পারলো সে। পূর্ব নিজের হাতঘড়িটা চোখের সামনে এনে বলে উঠলো,
– পাক্কা তিন ঘন্টা পিটিয়েছে! এমন তিন ঘন্টা যদি গাড়ি চালানো শিখতি তাও এনাফ হতো ! তোদের মতো পশুর বাচ্চাকে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স কে দেয় জানিনা!

পূর্ব গাছের কাছ থেকে হাত সরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কার নাম্বারে যেন কল দিয়ে বললো,

– হ্যালো? আমি আয়াশ ওয়াসিফ পূর্ব বলছি। একটা নাম্বার নোট করুন! 07***** – এই কার্ডধারী ব্যক্তিকে গাড়ির লাইসেন্স থেকে বরখাস্ত করুন! কাল সকালের মধ্যেই যেনো নিউজটা পেয়ে যাই! যথাযথ প্রমাণ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষুনি স্টেপ নিন!ধন্যবাদ।

পূর্ব কল কেটে চোখ ঘুরিয়ে ওদের পাচঁজনকে ইশারা করে বেরিয়ে পরে সেখান থেকে। পূর্ব প্রস্থান করলে নিয়াজ, আরাফাত, ওমর, সবুজ, কৈলেশ লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে স্ব স্ব স্থানে চলে যায়। লোকটা এখনো ভ্যাবাচেকা খেয়ে আছে তিনঘন্টার পিটুনি খেয়ে! আচ্ছা? এই তরুণ ছেলেগুলো কেন তাকে ইচ্ছামতো পেটালো!! কি তার মহাপাপ!!

.
রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় বসে কাঠের চাবির রিংটা বারবার দেখছে পূর্ণতা। মনে ভীষণ আশঙ্কাময় সন্দেহ! পূর্ব কি ওকে দেখছে এখনো? হয়তো দেখছে! নাহলে ভাঙচুর গাড়ির কাছে এই রিংটা পাবে কিভাবে? ‘কমরেড পূর্ব’ ! আচ্ছা কমরেড দিয়ে কি বোঝায়? পূর্বের নামের আগে এ কেমন অদ্ভুত পরিচয়? পূর্ণতা মোবাইল নিয়ে গুগুল ঘেটে দেখলো কমরেড মানে বিশস্ত সহযোগী। যারা সবসময় পাশে থাকে, বিপদ থেকে উদ্ধারের কাজে তৎপর থাকে! স্ক্রল করে আরো নিচে গিয়ে দেখলো সেখানে লিখা, কোনো কমিউনিস্ট দলের আন্ডারে কর্মরত কোনো বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিকে সম্মান করে ‘কমরেড’ বলা হয়। পূর্ণতার ভ্রু কুচকে গেলো আর্টিকেলটা পড়ে। পূর্ব তাহলে পলিটিক্স করে? কাদের সাথে? কেনো করে? ওকে কেনো কমরেড ডাকবে? প্রচুর প্রশ্ন এসে মাথা লন্ডভন্ড করে ঘুরপ্যাঁচ খাইয়ে দিচ্ছে তার। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে ঘূর্ণায়মান সিলিং ফ্যানের দিকে মুখ করে ভাবতে লাগলো। আচ্ছা? ওয়াকিল ভাই কি এ ব্যাপারে পরিস্কার ধারনা দিতে পারবে? ভাই তো পলিটিক্স সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানে!! যেই ভাবা সেই কাজ! পূর্ণতা ঝটপট ওয়াকিলকে কল বসিয়ে ছাড়লো! রাত এখন একটা! তবুও ওয়াকিল ফোন রিসিভ করলো!
– হ্যালো ভাই তুমি জেগে আছো?
– আছি বল।
– ভাই কমরেড মানে কি?
ধপ করে শোয়া থেকে উঠে বসলো ওয়াকিল। পূর্ণতার মুখে এরকম প্রশ্ন শুনে রীতিমতো আকাশের চাঁদ যেনো দেখতে পাচ্ছে রুমে! চোখ কচলিয়ে থতমত খেয়ে বলে উঠলো,
– তোর মাথার মধ্যে এইসব উল্টাপাল্টা প্রশ্ন কে ঢুকাইছে পূর্ণতা!
– ভাই তুমি বলো না কমরেড দিয়ে কি বুঝায়? আমি তো এভাবেই জানে চাচ্ছি।।
– সত্যি তো?
– হ্যাঁ সত্যি। এমনে এমনেই জানার শখ।
– যারা রাজনীতির সাথে সংযুক্ত কোনো নির্দিষ্ট দলের তত্ত্বাবধানে কাজ করে ওদের মূলত কমরেড বলে। ওরা পলিটিক্সের লোক বুঝলি এবার?
– ওরা খারাপ না ভালো?
– তোর ওইসব জেনে কি লাভ?
– ইশ সোজাসাপ্টা জবাব দাও না।
– সব জায়গায় ভালো খারাপ আছে। কমরেডের মধ্যেও ভালো মন্দ আছে। যেমন আমাদের ভার্সিটিতে খারাপগুলার দাপট বেশি।
– কেন? ভালোরা কেন প্রায়োরিটি পায় না?
– সাহস থাকলে তো! ওদের যেই পাওয়ার! পান থেকে চুল খসলেই শেষ! বাদ দে এইসব। তোর শরীর কেমন? খালা যে বললো তোকে নাকি কাল্পনিক বিষয়বস্তুর সমস্যা হয়েছে! আসলে কি সত্যি?
– হু,
– কি সাংঘাতিক পূর্ণতা! তুই কাকে নিয়ে ইমেজিন করিস? এই অল্প বয়সে তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস!!
– আমার অবস্থা ব্যক্ত করার মত কোনো উপায় নেই। না আছে কোনো সুযোগ।
– তুই বিষয়টা খুলে বলবি? না বলবে আমরা বুঝবো কিভাবে?
– তোমাদের কি আমার কথা শোনার টাইম আছে? নেই তো। প্রয়োজন ছাড়া কল করো না! আবার ঠিকই অন্যদের সামনে মুখ ফুটিয়ে বলো কাজিনরা আমরা এক হতে পারিনা!তোমরা কাজিন নামে কলঙ্ক!

পূর্ণতা মুখের উপর কড়া কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দিলো। ওয়াকিলের সাথে করা উদ্ভট ব্যবহারটা ইদানিং সবার সাথেই করছে পূর্ণতা। কাউকে এখন পাশে সহ্য হয়না! কারোর কথা শুনতে ইচ্ছে করেনা! কারোর সাথে মিশতে ভালো লাগেনা! রাজিব, শ্রেয়া, আয়মান প্রতিদিন দেখা করতে আসলেও পূর্ণতা ওদের খারাপ ভাষায় গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়। পূর্ণতার বিচিত্র স্বভাব, রাগান্বিত আচার, চুপচাপ থাকা সবমিলিয়ে বিষিয়ে তুলছিলো বাবা-মায়ের মনটা। মা প্রথম প্রথম কাঠের মোটা লাঠি দিয়ে পেটালেও এখন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে হাসপাতালের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। পূর্ণতার বাবা অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভীষন মগ্ন হয়ে মেয়ের দিকে খেয়াল রাখতে অনীহ হয়েছেন। পূর্ণতা পড়াশোনার প্রতি ধীরে ধীরে সরে এসে ঝুকে পড়ছিলো মনোকল্পিত কষ্টে। যেখানে সে মনের সুপ্ত কথাগুলো একা একা আনমনে আওড়ায়, কখনো বদ্ধ রুমে আয়নায় দাড়িয়ে কথা বলে, কখনো শাওয়ারের নিচে ভিজা শরীরে চোখ বন্ধ করে ঘন্টা পার করে। চাবির রিং টা নিয়ে কল্পনাপ্রবন রাজ্যে চিন্তা করে ঘুমিয়ে পরা পূর্ণতার এখন নিত্যদিনের কর্ম। গাড়ি ভাঙচুর ঘটনার পর থেকে প্রায় এক সপ্তাহ হতে চললো বাইরের আবহাওয়ায় লম্বা শ্বাস টানেনা পূর্ণতা।
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে দোলনায় বসে চা খাচ্ছিলো পূর্ণতা। দরজা ঠেলে ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে নূরানী এসে পূর্ণতার পাশে বসলো। আজও বাসা খালি, শুধু পূর্ণতা ও নূরানী আছে সবসময়ের মতো। পূর্ণতা চায়ে চুমুক দিয়ে আকাশে তাকাতেই নূরানীর পেছন থেকে তিনজন মানুষ এসে বারান্দার দরজায় দাড়ালো। পূর্ণতা ওদের দেখে চায়ের গরম পানীয়তে ঠোঁট পুড়তেই ছিটকে সমস্ত চা নিজের গায়ের উপর ফেলে দিলো। পূর্ণতা লাফিয়ে উঠে গা থেকে চায়ের অবশিষ্ট ঝাট দিয়ে ফেলতেই মেজাজ তীক্ষ্ম করে বলে উঠলো,

– এখানে কেন এসেছিস তোরা! বেরিয়ে যা!
শ্রেয়া এগিয়ে পূর্ণতার ঝাট দেওয়া হাত থামিয়ে শক্ত করে বলে উঠলো,
– আজ আমরা তিনটা তোকে ছাড়ছিনা! তোর কি হয়েছে! না হয়েছে সব আমাদের খুলে বলবি! আর এখনই বলবি!

আয়মান দরজার কাছ থেকে সরে এসে বারান্দার রেলিংয়ের উপর বসলো। রাজিব দোলনার পাশে থাকা বেতের মোড়ায় পা তুলে বসতেই নূরানীকে বলে উঠলো,
– নূরানী ফ্লোরটা দ্রুত মুছে দে। আর তিন কাপ গরম গরম কফি নিয়ে আয়। কুইক!

নূরানী নির্দেশ পেয়ে চলে যেতেই শ্রেয়া পূর্ণতাকে দোলনায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো। শ্রেয়া এক্সট্রোভার্ট টাইপের মানুষ! খুব সহজেই মানুষকে আপন করার মতো অদম্য শক্তি ওর আছে! পূর্ণতার এই অদ্ভুত আচরণে ও রয়েসয়ে ছিলো ঠিকই আজ পূর্ণতাকে একলা ছাড়বেনা একদমই!

– বল তোর কি হয়েছে? কেন আমাদের ইগনোর করছিস? কি ফল্ট আমাদের ?

পূর্ণতা মাথা নুয়ে চুপ করে থাকলে শ্রেয়া চোখ দিয়ে আয়মান ও রাজিবকে ইশারা করে, ‘দোস্ত কি করবো? চুপ তো!’ রাজিব চোখ বড় করে তাকালে শ্রেয়া আয়মানকে একই ইশারায় ভাবার্থ বোঝালে আয়মান চোখ বন্ধ করে ডান হাত দিয়ে ধীরেসুস্থে শান্তভাবে কথা বলতে বোঝায়। শ্রেয়া ঠোট টিপে মাথা হ্যাঁ বোধকে মৃদ্যূ নাড়িয়ে পূর্ণতার থুতনি ধরে মাথা তুলে বলে,

– পূর্ণতা আমাদের যদি একটুও সম্মান করিস তাহলে প্লিজ খুলে বল। প্লিজ দোস্ত বল। এভাবে গোমড়া হয়ে থাকলে তুই বা আমরা ঠিক থাকবো? আমাদের ফ্রেন্ডশিপটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দোস্ত। প্লিজ একটু ভাব!
পূর্ণতা স্বাভাবিক হয়ে দুটো নিশ্বাস ছেড়ে শান্ত হয়ে বলে উঠে,
– তোরা আমাকে একটা বার জোর করে বলেছিস পূর্ণতা তোর কি হয়েছে? সেদিন যদি তোরা মা-কে এই ব্যাপারে না বলতি তাহলে মা আমার সাথে রুড বিহেভ করতো না। কেন করলি এমন বিশ্বাসঘাতকতা?
আয়মান প্রসঙ্গটা নিজের দিকে টেনে বললো,
– তোর সেইফটির জন্যই আমরা আন্টিকে বলতে বাধ্য হয়েছি দোস্ত। তুই যেভাবে পাবলিক প্লেসে পাগলামি করতি সেটা কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছিলো। আন্টি না জানলে…
আয়মানের কথায় ফোড়ন ঝুলিয়ে নিজের কথা যুক্ত করলো রাজিব,
– পূর্ণতা তুই একটা ব্রাইট স্টুডেন্ট! কেন ওই ছেলেটার জন্য নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছিস? এভাবে নিজের সাথে আনজাস্টিস করলে চলে?
শ্রেয়া বলে উঠলো,
– তুই ক্লাস করিস না, মক টেস্টেও পার্টিসিপেট করিসনি। টিচার তোর জন্য আমাদের তিনটার রিপোর্টে কোয়েশ্চ্যান মার্ক ঝুলিয়ে দিয়েছে।
পূর্ণতা অবাক হয়ে গেলো শ্রেয়ার কথায়। পূর্ণতা ক্লাস করেনি তার জন্যে ওদের কেনো রিপোর্টে কাটা পড়বে? ওরা কি রিপোর্ট জমা দেয়নি? মক টেস্টে হলে বসেনি? ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বললো,
– আমার জন্য তোদের কেন মার্ক যাবে? কি করেছিস তোরা? রিপোর্ট জমা দিসনি? আয়মানে দিকে তাকিয়ে বললো, এই আয়মান? কিরে টেস্ট দিসনি?
আয়মান ভারী গলায় বললো, না।
পূর্ণতার কৌতুহলী চোখ রাজিবের দিকে উত্তরের আশায় গেলে রাজিবও বলে উঠে, ‘দেইনি’। এবার শ্রেয়ার দিকে চোখ ঘুরালে শ্রেয়া ডায়েবায়ে মাথা নাড়ায়। পূর্ণতা খানিকটা জোর গলায় বলে উঠলো,
– আজব! কেন টেস্ট দিস নি! তোরা আমাকে কনফিউজ করতে এসেছিস এখানে?
প্রথমে আয়মান, পরে রাজিব এবং শেষে শ্রেয়া পর্যায়ক্রমে বলে উঠলো,

– তুই ছাড়া একা একা রিপোর্ট জমা দিতে ভালো লাগেনা।
– নিজেকে সেলফিস মনে হয়।
– সবাই রিপোর্ট জমা দিয়ে পাশ করবে আর তুই একা বাশ খেয়ে ঝুলে থাকবি। এটা মানতে পারবোনা। আমরা কেউই রিপোর্ট প্লাস টেস্ট দেইনি। ক্যাম্পাসেও যাইনি। লেকচারও এটেন্ড করিনি।

পূর্ণতা দোলনা ছেড়ে উঠে শ্রেয়া, আয়মান ও রাজিবের মাথায় খুব জোরে একটা চাট্টি মারলো! সবাই চাপা ব্যথায় আহ্ করে মাথায় হাত বুলাতে থাকলে পূর্ণতা কোমরে এক হাত রেখে তর্জনী উঠিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠে,

– তোদের মতো হারামিগুলার জন্য আমি ঠিকমতো ডিপ্রেশনেও যেতে পারিনা! আরে একটু তো ডিপ্রেশ্ড থাকতে দে? ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হবো! এটাই তো স্বাভাবিক!আর এদিকে আরেক ঝামেলার ফান্দে ফাসিয়ে হাজির হয়েছিস ফাজিলগুলা!

নূরানী এসে কফির মগ সবার হাতে দিয়ে চলে যাবে ওমনেই শ্রেয়ার বাধা পেয়ে নিজেও একটা টুল টেনে ওদের সঙ্গে বসে পরলো। নূরানীর বড্ড খুশি লাগলো ওদের সাথে একসঙ্গে বসতে পেরে। কি ভালো পূর্ণতার বন্ধুদল! ও একটা সামান্য গেয়ো কাজের মেয়ে কিন্তু ব্যবহার করছে সঙ্গীর মতো। আড্ডা বেশ জমে উঠলে কিছুক্ষণ পর নূরানী বলে উঠে,

– আপা ভাইয়া? আপনেরা জানেন পূর্ণতা আপার সাথে জ্বিন আছে?জানেন না তো !! শুনেন ঘটনা, ওইদিন আপারে একটা গাড়ি টক্কর মারতে নিছিলো পরে সন্ধ্যার সময় দেখি ওই গাড়িরে কে জানি মোয়া বানায়া দিছে।
নূরানীর কথা শুনে সবাই একপলকে পূর্ণতার দিকে তাকালো! আয়মান প্রশ্ন ছুড়েই ফেলল,

– পূর্ণতা ইজ দিস ট্রু? তোর সাথে সিরিয়াসলি প্যারানরমাল কিছু আছে?

পূর্ণতা আসন ছেড়ে রুমের ভেতর থেকে কি যেন এনে আবার আসনে বসতেই ওদের সামনে হাতের তালু এগিয়ে বললো,

– এটা দেখে কোনো এঙ্গেলে তোদের প্যারানরমাল কিছু মনেহয়? চেক কর নে!

শ্রেয়া ভালোভাবে চোখ বুলাতেই হঠাৎ চোখ অস্বাভাবিক হারে বড় করে বললো, পূর্ব তোকে ফলো করছে! কি সাংঘাতিক দোস্ত! এখানে পূর্বের নাম!

শ্রেয়ার হাত থেকে রিংটা নিয়ে এনালাইসিস করে আয়মান ভাবুক চিন্তিত গলায় বলে উঠলো,
– কেউ তোকে সামান্য টিজ করতে না করতেই ওই পূর্ব পশ্চিম কাউকে ছাড়েনা। বাহ্ রে বাহ্!!ইন্ট্রেসটিং প্রেমিক তো!

পূর্ণতা খপ করে হাত থেকে চাবির রিং নিয়ে গমগম গলায় বললো,
– উনি এখনো আমার প্রেমিক হয়নি ফাজিল! খবরদার উনাকে নিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসবি না!
– লে ব্যাটা! প্রেমিক না হতেই প্রেমিকের তরফদারী শুরু! কেমন গিরগিটির মতো রে তুই! এমনে রঙ বদলাবি? হারাম খোর!

শ্রেয়া, পূর্ণতা, আয়মান তিনটা এক ক্যাটাগরির হলেও রাজিব তন্মধ্যে কিছুটা ভিন্ন। ওরা যখন তর্কযুদ্ধে মগ্ন তখন রাজিব পূর্বের কমরেড হওয়ার সাথে কিছু বিষয়ে নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত। পূর্ব যেহেতু কমরেড তার মানে অবশ্যই সে নামীদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই রাজনীতিতে হাত মিলিয়েছে। বর্তমানে তুখোড় লেভেলে আছে ঢাবি ক্যাম্পাস। এই পূর্ব আবার আনিশার প্রাক্তন ছিলো। আনিশার সাথে এক ভার্সিটিতে পড়তো। আনিশা পড়তো ঢাবিতে। আনিশা ও পূর্ব সেম ভার্সিটি….তারমানে পূর্ব ঢাবিতে পড়ছে! রাজিব সব লজিক একরেখায় কানেক্ট করে লাফিয়ে বলে উঠলো,

– পূর্ব ঢাবির স্টুডেন্ট! পূর্ব ঢাবিতে পড়ছে! ও ওখানকার কমরেড! লজিক বুঝছিস? আনিশা আপু আর পূর্ব সেম সেম ভার্সিটি!!

রাজিবের কথায় শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠলো পূর্ণতার! শ্রেয়া বিস্কুটে কামড় দেওয়া ভুলে গেছে এই নিউজ শুনে! আয়মান মুখভর্তি পানি নিয়ে ভু ভু করে সব পানি বারান্দা দিয়ে ফেলে দিয়ে দিচ্ছে!! হৈচৈ করা আড্ডামহলটা নিমিষেই নিবরতার চাদঁরে গুটিয়ে গেলো। রাজিব ঠোট থেকে হাসির পসরা একটু একটু করে সরিয়ে বলে উঠলো,
– তোরা লুঙ্গি ডান্স দিবি না? পূর্বের ইনফরমেশন বের করছি তো।

তিনজন এখনো তাল সামলাতে পারছেনা। রাজিবের দিকে পুতুলনাচের মতো একধ্যানে তাকিয়ে আছে। রাজিব হাসি উড়িয়ে মুখ ভেঙচি করে মোড়ায় বসে পড়লো। ওর এই নিউজ শুনে সবাই উড়াধুরা লুঙ্গি ডান্স দিবে ইয়াহু ইয়াহু করে পাগলের তিন নাম্বার স্টেজের মতো লাফাবে তা না উল্টো সবগুলা মরার মতো তাকিয়ে আছে। কাটায় কাটায় তিন মিনিট পেরুতেই চিৎকার দিয়ে শিষ বাজিয়ে শ্রেয়া, আয়মান, পূর্ণতা নাচতে লাগলো। আয়মান নাচতে নাচতে বলছে, মুন্নি বাদনাম হুয়ি ডার্লিং তেরে লিয়ে…আয়মানের ফাটা গলার বেসুরা গানের মধ্যেই শ্রেয়া কালো স্কার্ট দুহাতে ধরে লুঙ্গি স্টাইলে নাচছে, পূর্ণতা হাততালি দিয়ে হরদমে নাচানাচি!! রাজিব একবার শ্রেয়ার দিকে তো একবার আয়মানের বলদের মতো নাচের দিকে তাকাচ্ছে। পূর্ণতার তালি বাজিয়ে নাচটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো শেষে। কতদিন পর পূর্ণতা খিলখিল করে হাসছে। কি মারাত্মক সেই খিলখিল হাসি। উজ্জ্বল গালদুটোতে কি অদ্ভুত লাবণ্য ভেসে উঠেছে আজ!পূর্ণতার মায়ায় ডাসা ডাসা চোখদুটো ডার্ক সাকেলের মধ্যেও অদ্ভুত ভাবে চকচক করছে!! বাতাসে ঢেউয়ের মতো উড়ছে কালোমেঘের সুন্দর চুলগুলো। থুতনিতে গর্ত হয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যটা কি দারুন লাগছে!উফ! কোনো ছেলে যদি পূর্ণতাকে একবার দেখে সবার আগে ওর থুতনির উপর ছোট্ট গর্তটা দেখে প্রেমে পরবে! আরেকবার প্রেমে ফাসবে ওর ছন্দময় মিষ্টি হাসি দেখে! মেয়েদের হাসি সবচেয়ে বড় গহনা! সবচেয়ে দামী অলংকার! এই একটি অলংকার পুরুষ কখনো কিনে দিতে পারেনা! কুড়িয়ে দিতে হয়! মিষ্টি হাসির রাজ্য থেকে সুখের বাহনে করে এই হাসির আমদামী করতে হয়।

রাজিব বুকের ভেতর প্রচুর ব্যথা অনুভব করলো। অসহনীয় প্রকট ব্যথা। এই ব্যথা কাউকে দেখানো যায়না! শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়না! শুধু চোখের ভাষায় কাউকে অনুভব করানো যায়। আফসোস!সেই মানুষটা রাজিবের চোখের ভাষা পড়তে পারেনা। রাজিব খুব অসহায়। ঠোটে মিথ্যে হাসি প্রসার ঘটিয়ে আমেজপূর্ণ নাচের মধ্যে পূর্ণতার উদ্দেশ্যে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে বললো,

– তোকে খুব সুন্দর লাগছে পূর্ণতা। একদম রূপকথার কিশোরির মতো। আজীবন এভাবেই হাসিস দোস্ত। তোর হাসিটা ভয়ংকর সুন্দর!

রাজিবের কথায় পূর্ণতা তালি থামিয়ে সন্দেহী চেতনায় ভড়কে তাকালো। আয়মান হাফিয়ে উঠে দোলনায় বসে দুলতে দুলতে বলে উঠলো,
– পূর্ণতা অনেক বিউটিফুল মাইয়া বুঝছোস! যেই পোলা ওরে বউ হিসেবে পাইবো মনে কর ওই বেটার কপাল লাখ গুণে ভালো !যেমন ধর পূর্ব পশ্চিম পোলায়!

রাজিব ঘোরমগ্ন কন্ঠে পূর্ণতার দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে বললো,
– ঠিক বলেছিস। হান্ড্রেড পার্শেন্ট কারেক্ট! হি উইল বি দ্যা মোস্ট লাকিয়েস্ট পার্সন.. আই মিন ইট!
পূর্ণতা রাজিবের কথায় দ্রুত চোখ সরিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে শ্রেয়াকে বললো,
– ঢাবি তে যাবি? মাত্র তো বাজে সাড়ে দশটা।
শ্রেয়া আমোদিত কন্ঠে গদগদ করে বলে উঠলো,
– যাবো মানে! জাস্ট কোপাবো! ওই পূর্বকে এনে তোর কোলে বসিয়ে রুমের দরজা একমাসের জন্য কনফার্ম! আটকে দিবো।

আয়মান দুষ্টুমিপূর্ণে কন্ঠে বলে উঠলো,
– একমাস কি কি করবি পূর্ণতা?হু হু…

পূর্ণতা ওদের কথায় নাক ফুলিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে উঠলো,
-একদম বাজে কথা বলবিনা বলছি! রেডি থাক। আমি ড্রেসটা পাল্টে আসছি।

পূর্ণতা পরনের জামাটা বালতিতে সাবান পানিতে ডুবিয়ে অন্য একটা জামা পরে নিলো। লং ধূসর রঙের গোলাকার ঘেরযুক্ত কুর্তি, গাঢ় নীলের জিন্স, গলায় সাদা ওড়না একপাক পেচিয়ে বুকের দুইসাইডে অবশিষ্ট ওড়না ঝুলিয়ে চুলের গোছা উচুতে তুলে কালো মোটা রাবার ব্যান্ডে ঝুটি বাধলো। হাতে ফর্মাল লেডিস ঘড়ি পড়ে ঠোঁটে বেবি পিংক কালারের ন্যূড লিপস্টিক লাগিয়ে ব্যাকপ্যাক কাধে নিলো। পূর্ণতা রেডি হয়ে গেলে সবাইকে ডাক দিলে বারান্দা থেকে পাশের রুমে চলে যায় সবাই। পূর্ণতাকে অনেকদিন পর হাস্যোজ্জ্বল মেয়ের মতো অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে! পূর্ণতা বলে,

– দোস্ত? অল ওকে?
আয়মান থুতনিতে ভাবুক স্টাইলে হাত রেখে বললো,
– সামথিং ইজ মিসিং!
– কি? পূর্ণতা বিচলিত হয়ে পড়লো।
– পায়ে স্নিকার পর! পুরাই মাথানষ্ট লাগবো!

রাজিব পকেটে হাত ঢুকিয়ে সিগারেটের প্যাকেট দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে ফেলছে। অন্যদিকে শ্রেয়া ও আয়মান পূর্ণতার প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ। নূরানীকে বিদায় দিয়ে ওরা ঢাবির জন্য বাসার নিচে নামলো। ঘড়িতে এগারোটা বেজে যাচ্ছে। এই টাইমে রাস্তায় হবে দমবন্ধ করা প্রচুর জ্যাম! তাই সিদ্ধান্ত নিলো রাজিব ও আয়মানের বাইকে চড়েই ঢাবিতে যেয়ে নামবে ওরা। মেইন সড়কে জ্যাম দেখলেই অলিগলি ধরে এগুবে! পূর্ণতা আয়মানের বাইকে উঠলো এবং শ্রেয়া উঠলো রাজিবের বাইকে। ঘড়ির সময় বারোটা তেত্রিশ হলে ঢাবির বিরাট বড় সম্মুখ গেটের সামনে ওরা নামে। নাহ্ আজ কোনো ওয়ে নেই আউট স্টুডেন্ট হিসেবে ভেতরে ঢুকার। রাজিব এমন হুটহাট সিচুয়েশনে সলিড আইডিয়া দিতে পারে! আল্লাহ্ এই ছেলেকে কঠিন মূহুর্তের জন্যই সম্ভবত ওদের বন্ধু বানিয়েছে। রাজিব ওদের বললো, ‘শোন সব! দারোয়ানকে আমি টাকা খাইয়েছি সে আমাদের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে যাবেনা। আমরা নরমাল স্টুডেন্টের মতোই এন্ট্রি করবো এবং পূর্বকে খুজঁবো। আরেকটা কথা! পূর্বের নাম ধরে কেউ ডাকিস না। ভাই বলবি নাইলে বস। বুঝছিস?’

রাজিবের কথামতো আমরা সবাই পূর্বকে খোঁজার জন্য মিশনে নেমেছি। শ্রেয়া ও আমি এক টিম হয়ে বিশাল মাঠে পইপই খুজে চলছি। আয়মান ও রাজিব বিভিন্ন একাডেমিক ভবনে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে। এই ভার্সিটির মাঠ এতো বড় যে বাংলাদেশের বিরাট মানচিত্রের একখন্ড অংশ যেনো এখানেই জায়গা পেয়েছে। হেঁটে হেঁটেও শেষ করতে পারিনা এতো বড়! শ্রেয়ার ফর্সা মুখটা লাল কৃষ্ণচূড়ার মতো হয়ে উঠেছে। কপালে ঘামের অজস্র কণা লেপ্টানো! শ্রেয়া তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো কোমরে হাত রেখে বাম হাতের তালুতে কপাল মুছে বললো,
– একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার খুঁজি?
– আচ্ছা।

আমরা একজনকে জিজ্ঞেস করতেই সে বসার জায়গা হিসেবে একটা ভবনের নিচতলার রুম দেখিয়ে দেয়। আমরা রুমে ঢুকে লো বেন্ঞ্চের উপর বসে হাই বেন্ঞ্চে ব্যাগপ্যাক রেখে দেখি আমাদের চারপাশে অনেক মেয়ে এখানে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। ঠিক কিছুক্ষণ পর আমাদের পাশের বেন্ঞ্চ থেকে শুনতে পেলাম কানাঘুসার স্বর!

– পূর্বকে আজ দেখেছিস? হোয়াইট টিশার্ট পরে এসেছে!
শ্রেয়া পানি খেতে ব্যস্ত কিন্তু আমি কান সজাগ রেখে সবটা শোনার ট্রায় করছি। আরেকজন বলে উঠলো,

– পূর্ব আজও একজনকে পিটাচ্ছে। তৃতীয় তলায় থাকা কি মুশকিল! ছেলেটার কি নিদারুণ চিৎকার! রড দিয়ে পেটাচ্ছে।

আমার রক্ত টগবগ করে উঠলো! পূর্ব কাউকে মারছে! রড দিয়ে মারছে!! প্রথম মেয়েটার কন্ঠস্বরে অসহায়ত্ব প্রকাশ পেলো,
– আমার খুব কষ্ট হয় এগুলো শুনলে। একটা ছেলে শুধুশুধুই পলিটিক্সে যোগদান করে নিজের লাইফটাকে হ্যাল করছে। এখন দেখ যে ছেলে নিজের প্রোফেশনাল লাইফের দিকে ঝুকবে !সে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে এগুচ্ছে! এগুলো কি ঠিক?
– পূর্বকে কেউ বোঝানোর মতো পার্সন এখনো দেখেছিস ক্যাম্পাসে? ওই আনিশাও তো টিকতে পারলো না! শুনলি না? ফ্যামিলির বাড়াবাড়িতে শেষে বিয়ে করে ফেলেছে?
আনিশা আপুর কথা উঠতে দেরি হঠাৎ একদল ছেলের হৈচৈ মিছিল সিড়ি দিয়ে আসতে দেরি হলো না! সবাই টনক নড়ার মতো সিট ছেড়ে রুম ত্যাগ করতে তৎপর হলো। আমাকে ও শ্রেয়াকে বসে থাকতে দেখে একজন এসে অস্থির গলায় বললো, গাধার মতো বসে আছো কেন? পূর্বের সাঙ্গু পাঙ্গু দেখার আগেই পালাও! আমি কৌতুহলবশে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পালাবো কেন?ওরা মেয়েদের গায়ে হাত তুলে?’ সে আমাদের কথায় চরম বিরক্ত হয়ে ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে চলে গেলো। শ্রেয়া আমার হাত টেনে ঘড়িতে সময় দেখতেই সিড়ি দিয়ে একটা ছেলেকে টেনে হেচড়ে পা ধরে নামাচ্ছিলো! শ্রেয়া ও আমি ডানদিকে থাকা সিড়ির দিকে তাকিয়ে হকচকিয়ে ওদের নির্মম আচরন দেখছি! ভিক্টিম ছেলেটার গায়ের শার্ট ছিড়ে রক্ত বের হচ্ছে, মুখ ফুলে টিমটিম হয়ে গেছে, পা দুটো জুতোহীন! চারজন ছেলে ওই ভিক্টিম ছেলেটার দুইহাত, দুইপা ধরে আমাদের সামনে দিয়ে যেতেই সবার শেষের ব্যক্তিকে দেখে আমি অন্যমনস্কের ঘোরে কখন যে সিট থেকে দাড়িয়ে পরলাম একবিন্দু হুশ নেই। কানে ফোন এটে পকেটে হাত ঢুকিয়ে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে আসছেন উনি। উনার হাটার প্রতিটা দ্রুত পদক্ষেপে চুলগুলো হেলেদুলে উড়ছে। আমার চারপাশ যেনো কয়েক মিনিটের মধ্যে স্তব্ধ অসাড়পূর্ণ হয়ে গেলো! চোখ স্থির হয়ে বুকের ভেতর অনৈচ্ছিক পেশির কার্ডিয়াক যন্ত্রটা ধুকধুক করে ছন্দপূর্ণে টালমাটাল হচ্ছে। কানে আসছে শুধু বুকের ধুকধুক আওয়াজটা! হাত ঠান্ডা হয়ে শিরা উপশিরায় রক্তের দাপট হতে লাগল!বন্দুকের বুলেটগামী বেগের মতো সমস্ত গা শিউরে উঠলো! পাশ থেকে একটা জোরে ঝটকা পেয়ে হুশ ফিরতেই শ্রেয়ার কন্ঠনালির কন্ঠস্বর পেলাম,

– পূর্ণতা তাড়াতাড়ি বল কোনটা পূর্ব!
আমি সম্মোহনী চাহনিতে হালকা গলায় বললাম,
– চলে যাচ্ছে…সাদা গেন্জি চলে যাচ্ছে…
শ্রেয়া আমার উত্তর পেয়ে ঝড়ের বেগে পূর্বের সামনে যেয়ে কাকতাড়ুয়া ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
– স্টপ! যাবেন না! আপনি পূর্ব না? চলুন আমার সঙ্গে!কথা আছে!

পূর্ব কপালে তীক্ষ্ম রেখায় ভাজ ফেলে কান থেকে ফোন নামিয়ে মেয়েটাকে চেনার চেষ্টা করলো। একটা মেয়ে পূর্বের রাস্তা আটকে দিয়েছে দেখে এগিয়ে যাওয়া দলবল শ্রেয়ার সাথে খারাপ কিছু করার জন্য পা বাড়াবে পূর্ব চোখ দিয়ে ইশারা করলো! ওরা চারজন সম্মিলিত চাহনিতে আজ্ঞাপন পালনের মতো চলে গেলো! শ্রেয়া পূর্বের হেলদোল না দেখে পূর্ণতার হাত ধরে পূর্বের সামনে দাড় করিয়ে বললো,

– পূর্ণতার ডিসক্রাইভ মতে, স্কেচ আর্টিস্ট যে ছবিটা এঁকেছে সেটা সম্পূর্ণ আপনার ফেসের হুবহু! আপনিই পূর্ণতার সেই কল্পপুরুষ ঠিক বলছি না? এই নিন আপনার মালপত্র! আমি বাইরে যাচ্ছি।

শ্রেয়া বাইরে চলে গেলে পূর্ব পূর্ণতাকে গম্ভীর ভঙ্গিতে চোখ ছোট করে দেখতে থাকে। পূর্ণতার ভেতরে ঝড়ের তান্ডব বয়ে যাচ্ছে পূর্বকে দেখে! এই সেই পূর্ব? যে ওকে অজানা রাস্তা থেকে তুলে এনে সেবা করেছে? ট্রেন জার্নির পুরোটা ওকে পথ আগলে রেখেছে? তাকদিরের কারিস্মায় গ্রামেও অদ্ভুত ভাবে দেখা হয়েছে? পূর্ণতা কঠিন হয়ে দাড়িয়ে থাকলেও ঠোঁটদুটো মৃদ্যু মৃদ্যু কেঁপে চোখের পানি লম্বাটে হয়ে পরছিলো। ইচ্ছা করছিলো পাগলের মতো জাপটে ধরতে! দুহাতের শক্ত বেষ্টনীতে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখতে! পূর্বের গালে নিজের দুইহাত বসিয়ে অজস্র ঠোঁট ছুয়িয়ে দিতে! হঠাৎ নিরবতার প্রখরতায় আলতো ছিদ্র করে বলে উঠলো পূর্ব,

– আমি কি আপনাকে চিনি? হু আর ইউ? ইডিয়েটের মতো রাস্তা আটকে দেয় ফাউলগুলা!

-চলবে

#FABIYAH_MOMO🍁🍁