তোকে ঘিরে পর্ব-৫৪+৫৫

0
1985

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো

পূর্বদিকের তপ্তকর সূর্যটা দারুণ দগ্ধ করছে পরিবেশ। খাঁ খাঁ করা গরম। সেই সাথে পথচারীদের গলা শুকিয়ে কাঠ। ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে পূর্ণতা ও আয়মান। গোল টেবিলের ঠিক দুইপাশে মুখোমুখি হয়ে বসেছে দুজন। পুরো টেবিলে অফসেট পেপারের অগোছালো ভাব। বর্তমানে নোট ও লেকচার নিয়ে তুমুল সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার এক পর্যায়ে অর্ডারকৃত খাবার চলে আসলে বিরতি নেয় দুজন। ঠান্ডা কোকের স্ট্রতে ঠোঁট চেপে ফোনের গ্যালারি ঘাটতে থাকে পূর্ণতা। এরই মধ্যে দুজনের একইসাথে নজরে পরে দূরে দাড়িয়ে থাকা একটি সাদাসিধে মেয়ের দিকে। মেয়েটার সাথে আগেও দেখা হয়েছে আয়মানের। ব্যাপারটা ঠাহর করতে পেরে আয়মান চোখ ঘুরিয়ে নিজের নোটের দিকে দৃষ্টি রাখলো। পূর্ণতা স্ট্র থেকে ঠোঁট উঠিয়ে সেদিকে লক্ষ রেখে চকিত ভঙ্গিতে আয়মানকে বললো,

– দোস্ত দেখ? মেয়েটা বোধহয় জায়গা পাচ্ছেনা। হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। ওকে এখানে বসতে দেই?

আয়মান একপলক পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে পরক্ষনে মেয়েটার দিকে ভালোভাবে তাকালো। পূর্ণতার কথা সঠিক দেখে আয়মান মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,

– তোর চোখে কি নোটগুলো পরেনা? ওই মেয়ের খাবারের ঝোল যদি একটা পেপারে পরে কি অবস্থা হবে চিন্তা করছিস?
– আহ্! কি বলছিস এগুলো? ক্যান্টিনে তাকিয়ে দেখতো কোনো টেবিল খালি আছে কিনা? একটাও নেই। ওকে আমি ডাক দেই দোস্ত। তুই প্লিজ কিচ্ছু বলিস না।
– যেটা মন চায় ওইটা কর। কিন্তু আমার নোটে যদি একফোঁটা ঝোল লাগে ওই মেয়ের গুষ্ঠি উদ্ধার করে ফেলবো।

পূর্ণতা সে কথায় পাত্তা দিয়ে মেয়েটাকে ডেকে তার পাশে বসালো। পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলো মেয়েটার নাম সাবিহা। নিউকামার স্টুডেন্ট। এখানে আসার পর তার যে ক’জন বন্ধু-বান্ধুবী জুটেছে সবাই লাগাম ছাড়া বেপরোয়া, তাই সাবিহা একা একাই থাকে। মেয়েটার চোখদুটো কাজল কালো। ভ্রুগুলো সরু। হাসলে অনেকটা বাচ্চাসুলভ মায়া ভেসে উঠে। চুলগুলো রিবন্ডিংয়ের মতো ঝলমল করে, যেনো পার্লার থেকে এই মাত্র চুল সুন্দর করেছে সে। কথার পরিপ্রেক্ষিতে এটাও জানতে পারলো সাবিহা গ্রামের মেয়ে। নেত্রকোণার ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসেছে। এদিকে পূর্ণতার মিশুকে আচরণের জন্য আয়মানের প্রচণ্ড বিরক্তিবোধ হচ্ছে। এমনেই সাবিহা নামের মেয়েটার সাথে প্রথম দেখাটা খুবই বিব্রতকর ছিলো, তার উপর একই টেবিলে বসে মেয়েটা বারবার আড়চোখে ওকে অদ্ভুত নজরে দেখছে। সাবিহা জুসের বোতলে এক চুমুক খেয়ে মিষ্টি হাসিতে বললো,

– আপু আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

পূর্ণতা সহজ হাসিতে জবাব দিলো,
– অবশ্যই করো।
– আমি শুনেছি আপনি নাকি বিবাহিত। কথাটা আসলে কতটুকু সত্যি সেটা আমি জানিনা। তাই আপনাকে জিজ্ঞেস করলাম।

এবার আয়মান ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গরম গলায় কপাল কুঁচকে বললো,

– মানুষের পার্সনাল লাইফ নিয়ে এতো ইচিং কেনো তোমার? আমরা যে তোমার সিনিয়র ভুলে গেছো? লিমিটের মধ্যে কোয়েশ্চ্যান করবা।

আয়মানের ইচ্ছে করছিলো এখুনি টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে। কেউ বিবাহিত না অবিবাহিত এসব নিয়ে প্রশ্ন করার ও কে? কে অধিকার দিয়েছে এসব সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করতে? ফাজিল মেয়ে! এদিকে আয়মানের রাগান্বিত চেহারা দেখে পূর্ণতার আর বুঝতে বাকি রইলো না, আয়মান এ মেয়েটিকে তেমন সহ্য করতে পারছেনা। সাবিহাও অপরাধীর মতো মুখ করে মাথা নিচু করে ফেলেছে। পূর্ণতা সবটা সামাল দিতেই সাবিহার হাতে হাত রেখে বললো,

– আমি বিবাহিত। তুমি প্লিজ ওর কথা শুনে মন খারাপ করো না। খাবারটা খেয়ে নেও।

আয়মান এদিকে রাগে ফুসছে। তার বান্ধুবী তারই সামনে অন্য একটা মেয়েকে সাপোর্ট দিবে ভাবতেও পারেনি ও। আয়মান খেকিয়ে উঠলো,

– তুই কি ইনডাইরেক্টলি আমাকে অপমান করলি পূর্ণতা? তুই নিজের ব্যাপারে এইসব তথ্য বাইরের মানুষকে বলতে যাস কেন? কার মনে কি মতলব ঘুরে তুই কি জানিস?
– তুই একদম চুপ করবি আয়মান। আমি অবশ্যই বোকা না। এটুকু অন্তত বুঝার ক্ষমতা হয়েছে কে ভালো, কে খারাপ। সাবিহাকে সরি বল!
– তুই কাকে সরি বলতে বললি?
– চোখে দেখিস না কাকে বলতে বলেছি?
– না, দেখি না। এই দুদিনের উটকো ঝামেলাকে আমি কিজন্য সরি বলতে যাবো? কি দায় আমার?

পূর্ণতা চরমসীমায় রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে নেবে হঠাৎ টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়ালো সাবিহা। আকস্মিক উঠার জন্য টেবিলে জোরালো রূপে বিকট শব্দ হলো। এতে আশেপাশের সকলের চক্ষুজোড়া ওদের টেবিলের দিকে তাক হতেই সাবিহা মেজাজটা শান্ত রেখেই আয়মানকে বললো,

– আমাকে ক্ষমা করবেন আয়মান ভাইয়া। কিন্তু আপনি একটা নিচু মনের নষ্টালজিক লোক! আমি তো আপনাকে ক্ষতি করে কথাটা বলিনি। আমি সোজাসুজি আপুকে জিজ্ঞেস করেছি। ক্যাম্পাসের চর্তুপাশে পূর্ণতা আপুকে নিয়ে যে যে গুজব রটে সেটা কতটুকু সত্য এটুকু জানার জন্য আমি প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছি। এতে আপনার কোন্ চুলায় আগুন ধরেছে আমি সিরিয়াসলি জানিনা। আমি গ্রামের মেয়ে এই কথাটা শোনার পর থেকেই আপনার চোখে মুখে কেমন ঘেন্না-ঘেন্না ভাব জড়িয়ে গেছে। লজ্জা হওয়া উচিত আপনার! আর শুনুন, আপনার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম এজন্যই, আপনার ঘাড়ের কাছে টিস্যু লেগে আছে। আর যেটা দেখতে খুবই বিশ্রী লাগছে। আমি কিছু বললে আপনি যদি রাগ করেন সেজন্যই ওখানে তাকিয়ে আপনাকে ইশারা দিচ্ছিলাম। আপনি সত্যি খুব জঘন্য মস্তিষ্কের মানুষ! ছিঃ!

সাবিহা কাধে ব্যাগ তুলে ট্রে নিয়ে হনহন করে ক্যান্টিনের কাউন্টারে চলে গেলো। উপস্থিত সবাই যে আয়মানের দিকে তাকিয়েছিলো, আয়মান সেটা বুঝতে পেরে পূর্ণতাকে উঠতে বলে চলে যায়। সাবিহার জন্য পুরো মেজাজটাই বিগড়ে গেছে আয়মানের। কোনোরকমে ব্যাগের মধ্যে নোট গুছিয়ে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে পরে। পূর্ণতা বিল পে করে আয়মানের পাশাপাশি হাঁটতে থাকলে হঠাৎ একটা দৃশ্য ভেবে অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। একবার শ্রেয়ার সাথে এরকম ঝগড়া হয়েছিলো। সেদিন শ্রেয়াও আয়মানকে ‘নষ্টালজিক’ বলে অপদস্থ করেছিলো। আয়মান এর বিপরীতে কিচ্ছু বলেনি। পূর্ণতার জানামতে আয়মান এমন কোনো গালি শিখতে বাদ রাখেনি যেগুলো এই মূহুর্তে উচ্চারণ করলে সবাই কানে হাত চাপা দিবে। সেই আয়মান শ্রেয়ার বেলায় যেভাবে চুপ ছিলো, আজ সময়ের পরিবর্তনে সাবিহার বেলায়ও চুপ। তবে আয়মানের জীবনে কি পরিবর্তন আসা সম্ভব? আবারও কি সম্ভব সেই হাসিখুশি আয়মানকে ফিরে পাওয়া? আয়মান যে আর অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেনা, সেটা কিভাবে পরিবর্তন করবে? এসব নিয়ে পূর্ণতা নানা চিন্তাভাবনা করতে থাকলে হঠাৎ ওর চিন্তার প্রহরে দাগ বসিয়ে আয়মান বলে উঠে,

– ওয়াসিফ ভিলায় যাবি?

পূর্ণতা চমকে গিয়ে হাঁটা থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। আয়মান পাশে তাকিয়ে দেখে পূর্ণতা নেই, সে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখলো পূর্ণতা আশ্চর্য দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে। আয়মান আবার পূর্ণতার পাশে এসে বললো,

– জাওয়াদের মৃত্যুশোকে তোর শ্বশুরবাড়ির অবস্থা কেমন একবার তো দেখতে যাওয়া উচিত। পূর্ব ভাই নিশ্চয়ই সব একা সামলাচ্ছে। ওখানে একবার গেলে ঠিক হয়না?

আয়মানের কথা শুনে তৎক্ষণাৎ পূর্ণতা পেটের উপর হাত রাখলো। চোখের সামনে আজও সেদিনের বীভৎস ঘটনাগুলো স্পষ্ট ভাসে। জাওয়াদের মৃত্যুর পেছনে পূর্বের হাত আছে পূর্ণতা এটুকু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। পূর্ব কি ভালো আছে? এই সুযোগে ওকে যদি একবার দেখার সুযোগ হয় সেটা পূর্ণতা ছাড়বেনা। কিন্তু পূর্ব যেখানে কল দিয়ে ওকে খবরটা দেওয়া প্রয়োজনবোধ করেনি সেখানে বেহায়ার মতো যাওয়ার মানে কি? পেট থেকে ধীরেধীরে হাত সরিয়ে শক্ত গলায় বললো,

– আমি ওখানে যাবো না। আর তুই যদি ওখানে যাওয়ার কথা ভুলেও কখনো বলিস, আমি ভুলে যাবো তুই আমার বন্ধু।

.

দুপুর বারোটায় বাসায় ফিরে আসে পূর্ণতা। সবসময়ের মতো আজও হাসপাতালে ব্যস্ত খোদেজা। একটা বড় ডিলের ঝামেলার জন্য বাধ্য হয়ে পূর্ণতার বাবা সিলেট গিয়েছে। বাসায় নূরানী ছাড়া কেউ নেই। চারদিন হলো পূর্ণতার জন্য আবারও খোদেজা নূরানীর বেতন বাড়িয়ে বাসায় নিয়ে এসেছেন। নূরানী পূর্ণতার সবটা দেখভাল করলেও পূর্ণতাকে খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম থেকে উদ্ধার করে পারেনি। গোসল শেষ করে সালোয়ার-কামিজ পরে আয়নার সামনে যখন চুল ঝারছিলো হঠাৎ পূর্বের কথা বেখেয়ালে মনে পরে যায় ওর। এই মানুষটা কত নিষ্ঠুরভাবে দূরে চলে গেছে! কল দিয়েও খোঁজ নেয়নি ‘ কেমন আছো? বেঁচে আছো তুমি? ‘। হাসপাতালে ওই মূমুর্ষ অবস্থায় পূর্ণতা যখন রাতদিন অপেক্ষায় ছিলো তখন সেই মানুষটা আঙ্গুলের ফাঁকে আঙ্গুল গুঁজে দেয়নি। পূর্ণতার শূন্য হাতটা কাতরাতো পূর্বের শক্ত হাতের উষ্ণ অনুভব করার জন্য। ঠোঁটেদ্বয় পিপাসিত হয়ে যেতো তার ওষ্ঠযুগল স্পর্শের জন্য। অথচ দিনেকে-দিন চলে গেলেও মানুষটা কখনো আসতো না। যদি সন্তানটা পৃথিবীতে বেঁচে থাকতো, হয়তো এই অজুহাত হলেও পূর্ব ওকে ছেড়ে দিতো না। আজ পূর্ণতার কাছে কিছুই নেই যার জন্য পূর্ব আর ওর কাছে ভিড়বে। নতুন জিনিসের কদরটা কেটে গেলে পুরোনো জিনিসের তকমা লেগে যায়। আজ পূর্ণতা পূর্বের বিশাল আভিজাতপূর্ণ রুচির কাছে ‘পুরোনো’। উদাস দৃষ্টিতে কিছুক্ষন আকাশে তাকিয়ে থাকতেই চোখের কোনা থেকে পানি গড়িয়ে পরলো ওর। হঠাৎ কি যেনো ভেবে পূর্ণতা লেডিস ব্যাগে কিছু টাকা ভরে চটপট রেডি হলো। হাতে ঘড়ি পরতে পরতে মাথায় ঘোমটা টেনে পায়ে জুতা পরতেই নূরানীকে গলা উঁচিয়ে বললো,

– এই নূরানী শোন তো, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। মা এলে বলবি আমি কিছু কিনতে বের হয়েছি। বাসায় সবকিছু দেখে রাখিস। আমি আসছি।

নূরানীর পাল্টা উত্তর শোনার জন্য এক সেকেন্ডও নষ্ট করলো না পূর্ণতা, সোজা নিচে নেমে রিকশা ঠিক করলো সে। একটা উবার বুক করার জন্য ব্যাগে হাত দিতেই দেখলো মোবাইল ঢুকায়নি সে। এদিকে রিকশা যতদূর এসে পরেছে আবার ব্যাক করাটা বোকামি হবে ভেবে পূর্ণতা বাসস্ট্যান্ডে গেলো। টিকিট কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে একটা বাসে উঠে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছলো। আরো একবার পূর্ণতা অনুভব করলো আজ তার মন প্রচণ্ড ব্যকুল হয়ে আছে। যার জন্য সে এসেছে তাকে দেখার জন্য প্রচুর অস্থির-অস্থির লাগছে। শুষ্ক হয়ে আসছে গলা, পূর্ণতা বারবার ঢোক গিলছে। বাড়ির লন সাইডে শূন্য, কোনো মানুষ নেই। দরজা খোলা কিন্তু কোনো মানুষ থাকে বলে মনে হয়না। শোকের আবছায়া যেখানে ঘিরে থাকে, সেখানে কান্নার আহাজারি পাওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, পিনপতন চারপাশ এবং শব্দহীন। পূর্ণতা বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে কাউকে দেখতে না পেয়ে সোজা শ্বশুরের কক্ষে গেলো। বিছানায় যে ব্যক্তি শুয়ে আছে তার শরীরে হাড্ডির উপর কোনোমতে চামড়া সেঁটে আছে। হাতদুটো সুতোর মতো চিকন, কোনো মাংস নেই সেখানে। চোখের নিচে কালির আস্তরণ, ঠোঁটগুলো রোগার মতো সাদা হয়ে আছে। পূর্ণতা পলাশ ওয়াসিফের এই নাজুক অবস্থা দেখে নিঃশব্দে ফুপিয়ে কেদেঁ দেয়। শ্বশুর নামধারী বাবার মতো আগলে রাখা মানুষটা হাড় জিড়জিড়ে অবস্থায় কখনো শুয়ে থাকবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। পলাশের বেডের কাছে এসে ফ্লোরে বসে পরে পূর্ণতা। কারোর বসার তীক্ষ্ম আওয়াজ পেয়ে চোখ খুলে তাকায় পলাশ ওয়াসিফ। পূর্ণতাকে দেখেই তিনি কিছু বলার জন্য হাপাতে থাকেন, যুদ্ধ করতে থাকেন নিজের অক্ষম শরীরের সাথে কিছু বলার জন্য। কিন্তু তিনি পারেন না। কষ্টে চোখের পানি ছেড়ে দেন। পূর্ণতা পলাশ ওয়াসিফের ওই অবস্থা দেখে কাঠির মতো আঙ্গুলগুলো মুঠোতে নেয়। নিজের কপালে আঙ্গুলগুলো রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে পূর্ণতা। চিৎকার করে কাঁদতে যেয়ে অনবরত কাশতে থাকে ও। এ অবস্থা ঝাপসা চোখে দেখতেই পলাশ ওয়াসিফ ওই প্যারালাইসিস অবস্থায় কিছু বলার জন্য গোঙাতে থাকেন, জীর্ণতার কাছে হার মেনে কিচ্ছু বলতে পারেন না। পূর্ণতার কান্না শুনে পাশের কামড়া থেকে আয়েশা চাকরের সহযোগিতায় ছুটে আসেন। তিনিও দরজার মুখে দাড়িয়ে কান্না জর্জরিত গলায় ডেকে উঠেন,

– পূর্ণতা মা, মাগো…

আয়েশার ওইটুকু ডাকে পূর্ণতা ফ্লোর থেকে উঠে আয়েশার কাছে দৌড়ে যায়। হাতের উল্টোপিঠে অশ্রুপূর্ণ চোখ মুছে আয়েশাকে ধরে ধরে রুমে আনে পূর্ণতা। আয়েশা গা ছেড়ে দেওয়ার মতো করে কান্নাকাটি করছেন। স্বামীর প্যারালাইসিসজনিত অসুস্থতা, জাওয়াদের মৃত্যু, পূর্ণতার সন্তানহারা, পূর্বের একগুঁয়ে গম্ভীর আচরণের জন্য তিনি আজ দিশেহারা হয়ে কাঁদছেন। পূর্ণতা নিজেকে শান্ত করে আয়েশাকে অনেক্ষন সময় নিয়ে সামলায়। ফজরের ওয়াক্তে জাওয়াদকে মাটি দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে শেফালী পাগলের মতো প্রলাপ করতেই অসুস্থ হয়ে পরেছেন। সবাই শেফালীকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। পূর্ব জানাজার পর থেকে আর বাড়ি ফিরেনি। কোথায় আছে, কেমন আছে, কিভাবে আছে… কেউ ওর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখেনি। পূর্ব আগের মতো কথাবার্তাও বলেনা। কিছু জিজ্ঞেস করলে মাথা নাড়িয়ে কথা শেষ করে, মুখ ফুটে শব্দ উচ্চারণ করেনা। এদিকে সময়ের পাল্লা কখন দুপুর থেকে কখন সন্ধ্যার দিকে গড়ায় পূর্ণতা সেটা টের পায়না। ঘড়িতে একপলক সময় দেখে নিয়ে সেও নিষ্ঠুরভাবে আয়েশা ও পলাশকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে যায়। সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই মাগরিবের আযান দেয়। পূর্ণতা চিন্তা করলো এই ফাঁকে পূর্বের খালি রুমটা দেখে আসা উচিত। তড়িঘড়ি করে পূর্বের রুমে ঢুকে দেখতেই পূর্ণতা বেশ অবাক! চর্তুদিকে সবকিছু এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যেই পূর্ব সামান্যতম অগোছালো অবস্থা সহ্য করতে পারেনা, নিজেই নিজের জিনিস পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখে, আজ সেই পূর্বের রুমের অবস্থা এমন বেহাল হয়ে আছে তা ভাবাও দুঃসাধ্য! পূর্ণতা একবার ঠিক করল সবকিছু গুছিয়ে রেখে যাবে। আবার পরক্ষনে চিন্তা করলো জিনিস যেখানে যেমন আছে, সেগুলো সেভাবে থাকাই মঙ্গল। রুমের ভেতর সেই চিরচেনা ঘ্রাণ পেয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন নিরবতা কাটালো পূর্ণতা। সেই মাতাল করা নেশাময় ঘ্রাণটা শুকলে মনেহয় পূর্ব যেনো এখানেই আছে। কিন্তু কি আফসোস! ওয়াসিফ পূর্বের মুখদর্শন আর হলো না…

.

সন্ধ্যা পনে সাতটা। বাসস্ট্যান্ডে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে পূর্ণতা। এই সময় বাসায় ফিরতে হলে লোকাল বাসে করে ফিরতে হবে শুনেই ভয়ে ওর বুকটা কুকড়ে আছে। সিএনজিতে যাওয়ার সুযোগ নেই ওর। তারা স্ট্রাইক করছে কিছুদিন যাবৎ। নিরুপায় হয়ে লোকাল বাসের জার্নিটা সহ্য করতে হবে। বাস এলে পূর্ণতা অনেক কষ্টে পেছনের দিকে সিট পায় তাও জানালার কাছে একজন পুরুষ বসেছে।। ভ্যাপসা বিশ্রী গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে পূর্ণতার। নাড়িভুঁড়ি উল্টে বেরিয়ে আসতে চাইছে ওর। পূর্ণতা নাকে ওড়না চেপেও নিজেকে সুস্থবোধ করাতে পারছেনা। পাশে বসা লোকটা ধুমিয়ে সিগারেট টেনে সেটা আবার পূর্ণতার দিকেই ছেড়ে দিচ্ছে। বাস চলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। তিল ধারনের জায়গাটুকু নেই, তবুও কন্ডাক্টার অতিরিক্ত ভাড়ার লোভে ঠেসে ঠেসে যাত্রী তুলছে। পূর্ণতা নাকে ওড়না চেপে চোখ খিচে কোনোরকমে দ্রুত পৌঁছনোর জন্য জিকির করছে। আর পারছেনা দমবন্ধকর এই বাসে বসে থাকতে। মাথাও ঘুরাচ্ছে সিগারেটের গন্ধে। হঠাৎ খেয়াল হলো কেউ ওর বাহু ঘেঁষে একটা অপ্রীতিকর কাজ করছে। কিন্তু বাসের ঝাকুনিতে সেখানে প্রথম প্রথম দৃষ্টি না দিলেও এখন মনেহচ্ছে কেউ ওর বাহুতে ইচ্ছে করে পুরুষাঙ্গ ঘষছে। পূর্ণতা ওইটুকু সিটের মধ্যে নিজেকে সর্বোচ্চ সীমায় গুটিয়ে নিলেও লোকটা ততোই ওর দিকে ঘেঁষে সেই জঘন্য কাজটা করছে। পূর্ণতা অসহায় দৃষ্টিতে পাশের লোকটার দিকে তাকালো। লোকটার চোখ কেমন লাল। ভয় ধরে যায় ওই চেহারা দেখলে। আবার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা খুবই অশ্লীলভাবে নাড়ছে। পূর্ণতা সাথেসাথে চোখ ফিরিয়ে মাথা নিচে নুয়ে কোলের ব্যাগটা খামচে ধরলো। দেড়ঘন্টার রাস্তা, তার উপর জ্যামে ফাসলে পূর্ণতা এই যাত্রায় বেঁচে থাকবে তো? বামপাশের বাহুতে এখনো মনের শান্তিতে নোংরা কাজটা করছে লোকটা। পূর্ণতা মনেমনে আকুলিবিকুল করলো,

– ইয়া আল্লাহ্! আমি যদি জীবনে একটাও ভালো কাজ করে থাকি তাহলে এইমূহূর্তে আমাকে উদ্ধার করো। যদি আমি পাপ কাজ করে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করে এই বিপদ থেকে মুক্তি দাও। আমি আর সহ্য করতে পারছিনা আল্লাহ্!!

চলন্ত বাসটা জ্যামের মধ্যে আবার থামলো। কন্ডাক্টার এই সুযোগে জ্যামের মধ্যে আরো যাত্রী তুললে সামনে থেকে কিছু লোক হৈহৈ করে গালাগাল করলো কন্ডাক্টারকে। ‘ আপনেগোর বেশি সমস্যা হইলে থাকেন, নাইলে সিট ছাইড়া যান গা’ এমন ভঙ্গিতে ভাব দেখাচ্ছে কন্ডাক্টারটা। কেউ আর গায়ে পরে ঝামেলা করলো না। পূর্ণতার বাহু ঘেঁষে যে লোকটা এতোক্ষন দাড়িয়ে ছিলো হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠলো,

– ওই মিয়া? ধাক্কায়া পিছে ফালান ক্যা? চোখে কি আর জায়গা দেখেন না? এনেই খাড়ান লাগবো?

পূর্ণতা কি মনে করে যে চোখ খুলে আড়চোখে তাকালো, তাকাতেই দেখলো ওর পাশে এখন সাদা পান্ঞ্জাবী পড়ুয়া কেউ দাড়িয়ে। গায়ে আর কোনো বাজে স্পর্শ লাগছেনা। কে এই মানুষটা সেটা দেখার জন্য অজান্তেই বুকটা ঢিপঢিপ করে লাফাচ্ছে। পূর্ণতা ধীরে ধীরে চোখ তুলে মানুষটার মুখের দিকে তাকাতেই বুকের ভেতর সমস্ত জোয়ার যেনো তীব্র জলোচ্ছাসে আছড়ে পরলো! নীলচে রঙের সার্জিক্যাল মাস্কের আড়ালে ওই কাঠিন্য চোখদুটো অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। গরমে ঘেমে গিয়ে কিছু চুল কপালে সেঁটে রয়েছে। সাদা পান্ঞ্জাবীর হাতাগুলো সবসময়ের মতো কনুইয়ের কাছে ভাঁজ করা। পূর্ণতার সিটের মাথায় একহাত ফেলে অনেকটা ঘেরাও সিস্টেমে সামাল দিচ্ছে পূর্ব। এদিকে বিষ্ময়সূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে পূর্ণতা তাকিয়ে থাকলে আচমকা চোখাচোখি হয়ে যায় দুজনের। একজনের চোখে শান্ত ভঙ্গিতে কর্তব্যপালনের নিষ্ঠা, অন্যজনের চোখে প্রকাশ পাচ্ছিলো আকুল হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা। হঠাৎ পূর্ণতার পাশের লোকটা গন্তব্যে নামার জন্য সাইড দিতে বললে পূর্ণতা সরাসরি উঠে দাড়ায়। পূর্ব কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে পূর্ণতাকে দাড়াতে জায়গা দেয়। এরপর লোকটা বেরিয়ে গেলে পূর্ণতা জানালার কাছে বসে পরে। তার পাশেই চুপচাপ সিটে গা ছেড়ে দিয়ে বসে পরে পূর্ব। পকেট থেকে ফোন বের করে ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভঙ্গিতে স্ক্রল করতে থাকে। পূর্ণতা ওর দিকে তাকিয়ে কখন যে ওড়নাটা নাক থেকে সরিয়ে ফেলেছিলো জানা নেই ওর। ব্যাপারটা আড়চোখে লক্ষ করতেই পূর্ব পকেট থেকে হাত ঢুকিয়ে এক্সট্রা মাস্ক ওর দিকে এগিয়ে দিল। আদেশসূচকে বললো,

– মুখটা ঢাকো।

সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো শিউরে উঠে পূর্ণতা। পূর্বের দিকে তাকিয়ে নিবেনা-নিবেনা করেও মাস্কটা নিয়ে নেয়। মাস্কের রাবারদুটো কানে আটকে নিতেই পূর্ণতা বলে উঠে,

– আপনার মুখের মাস্কটা যদি পরতে দিতেন আমি খুব খুশী হতাম।

পূর্ব সাথেসাথে কপাল কুঁচকে চকিতে প্রশ্ন ছুড়ে বললো,

– কেনো?

পূর্ণতা হাসিহাসি চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমার চেয়েও আপনার মুখের মাস্কটা প্রচণ্ডরূপে ভাগ্যবান। সে প্রতি ক্ষনে ক্ষনে আপনার ঠোঁট স্পর্শ করার সৌভাগ্য পাচ্ছে।

চরমসীমায় আশ্চর্য হয় পূর্ব। পূর্ণতার দিকে হতবুদ্ধির মতো কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। এই পাগলামীপূর্ণ কথাগুলো বিয়ের আগে বলতো বলে ওকে সামলানো বড় দায় ছিলো। কিন্তু আজ আবার বললো? পূর্বকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। ছাড়তেই শান্ত গলায় বললো,

– আল্লাহ্ পাক আপনার সাথে এভাবেও দেখা করিয়ে দিবেন আমি ভাবতে পারিনি। আমার চোখদুটো ধন্য হয়ে গেছে জনাব। আপনাকে এক ঝলক দেখার জন্য যতখানি কষ্ট পেয়েছিলাম, এই সামান্য সাক্ষাতে সব শোধ হয়ে গেছে।
– তুমি আমার সামনে এগুলো উচ্চারণ করছো কেনো?

পূর্ণতা মাথা নিচু করে রইলো। অশ্রু আবার জমতে শুরু করেছে দু’চোখে। সেগুলো আড়ালে অতি সাবধানে জানালার দিকে মুখ করে মুছে ফেললো। মাথা ঘুরিয়ে অপ্রসন্ন হাসিতে বললো,

– আপনার সাথে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুখগুলো পেয়েছি।
– তুমি কি আমার জন্য আশা নিয়ে আছো?

পূর্বের কথা শুনে হেসে দিলো পূর্ণতা। এটা দেখে পূর্বের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে সুক্ষ্ম ভাঁজটা আরো তীব্র হলো। পূর্ণতা হাসি থামিয়ে উদাস ভঙ্গিতে স্বর নিচু করে বললো,

– আমার মধ্যে আপনাকে দেওয়ার জন্য বিশেষ কিছু থাকলে সত্যিই আশা নিয়ে থাকতাম। কিন্তু নেই।

বাস মন্থর গতিতে চলছে। পূর্ব ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও পূর্ণতা একটু পরপর ওকে দেখছে। হঠাৎ পূর্ণতা নিরবতা চিড়ে প্রশ্ন করলো পূর্বকে,

– আপনি লোকাল বাসে কেনো?

পূর্ব প্রশ্নটা শুনেও পূর্ণতার দিকে নজর করলো না। ওই ভঙ্গিতেই গম্ভীর সুরে বললো,

– জীবনে এই প্রথম লোকাল বাসে চড়েছি। সেটা কেনো চড়েছি অন্তত বুঝার কথা।

পূর্বের দুই বাক্যের উত্তর শুনে প্রচণ্ডরূপে অবাক না হয়েও পারলো না পূর্ণতা। কন্ডাক্টার এরই মধ্যে গন্তব্যের নামটা চেঁচানো সুরে উচ্চারণ করলে পূর্ণতা সেদিকে লক্ষ্য করে পূর্বের দিকে তাকিয়ে বলে,

– আপনার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারলাম না। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন মনে এই দুঃখটা নিয়েই নিশ্বাস ফেলবো।

হাতে ফোন নিয়ে পূর্ণতার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পূর্ব। সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে সেদিকে বিন্দুমাত্র আর ধ্যান না দিয়ে উঠে দাড়ায় পূর্ণতা। অনেকটা অপরিচিত ভঙ্গিতে বলে,

– আমার প্লেস এসে পরেছে। একটু যেতে দিন।

পূর্ব স্তব্ধ ভঙ্গিতে সিট থেকে উঠে দাড়িয়ে জায়গা দিলে পূর্ণতা বের হয়ে বাসের দরজা দিয়ে নেমে যায়। কাধে ব্যাগের ফিতা ঝুলাতেই ওড়নায় চোখ মুছে মুছতে হাত বারিয়ে রিকশা ডাক দেয়। বাসটা চলে গেলো পূর্ণতার সামনে থেকে। রিকশাও উল্টোপথে প্যাডেল ঘুরিয়ে চলতে লাগলো। রিকশার পেছনে যে খালি অংশটা থাকে সেখান দিয়ে বাসটার যাওয়া দেখছিলো পূর্ণতা। মনে মনে আওড়াচ্ছিলো সেই পরিচিত গানের সুর…

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না? কেন মেঘ হয়ে আসে হৃদয়ে?তোমারে দেখিতে দেয় না। মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না।

.

পূর্ণতা রিকশার ভাড়া চুকাতেই বুঝতে পারলো তার চোখদুটো ভীষণ ফুলে গেছে। ছিপছিপে অবস্থায় চোখের পাতা ভারী লাগছে। নাক বন্ধ হওয়ার কারনে নিশ্বাস নিতেও বেশ ঝামেলা হচ্ছে। পূর্ণতা ঢোক গিলে বিষন্ন ভঙ্গিতে পা চালিয়ে লিফটে ঢুকলো। খালি লিফটে মাথা নিচু করে সুইচ টিপে দিলে দুইপাশ থেকে দরজা চলে আসছিলো। হঠাৎ সেটা বাধাগ্রস্ত হয়ে লিফট খুলে গেলে পূর্ণতা সামনে তাকিয়ে দেখে পূর্ব। ধ্বক করে পূর্ণতার বুকে তীব্র একটা ধাক্কা খেতেই ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে পরে পূর্ব। লিফট বন্ধ হয়ে গেলে পূর্ণতার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে হাত বারিয়ে ‘পজ’ অপশনে টিপে দেয়। মূহুর্তের মধ্যেই তখন লিফটের উঠা-নামা আটকে যায়। পূর্ণতা অবুঝের মতো তাকিয়েছিলো শুধু। কিছুই বুঝতে পারছিলো না পূর্ব কেনো এখানে এসেছে। পূর্ব নির্লিপ্তে কানের দুপাশ থেকে নিজের মাস্ক খুলে ফেললে পূর্ণতা চরম মাত্রায় আশ্চর্য হয়ে যায়! পূর্ব এতেই ক্ষান্ত হয়না। সে পূর্ণতার মুখের মাস্কটাও একপ্রকার টান মেরে খুলে ফেলে। পূর্ণতা কানের পিছনে ব্যথা পেলেও পূর্বের সেই ধারালো দৃষ্টিকোণ থেকে চোখ সরাতে পারলো না। এ যেনো হিংস্র ঘায়েল দৃষ্টিতে ক্ষতবীক্ষত করার মতো বুকে লাগছে! পূর্ব আচমকা ওর গাল চেপে ধরলে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে পূর্ণতা। সমস্ত শরীরে শিরশির করে লাগে ওর। পূর্ব অদ্ভুত ভঙ্গিতে তেজালো গলায় বললো,

– এখন কাছে আসতে লজ্জা করছে? বাসে যখন ওইসব কথা ঠাস ঠাস উচ্চারণ করেছো তখন এই লজ্জাটা করেনি? এখন লজ্জা করছে কেনো?

পূর্ণতা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ঠোঁট কাপিয়ে কিছু বলবে পূর্ব সেই সুযোগটুকু দিলো না। একপ্রকার হামলে পরলো পূর্ণতার ওষ্ঠদ্বয়ের উপর। পূর্ণতার গাল থেকে হাত সরিয়ে চুলের ভেতর হাত ডুবিয়ে দিলো হামেশার মতো। হিংস্ররূপে কার্য চালালেও সেটা ধীরে ধীরে শান্তরূপে পরিণত হলো। পূর্ণতার ব্যকুল মনের ইচ্ছা, দীর্ঘদিনের চাওয়া, ছটফট প্রাণের আকাঙ্ক্ষাকে লম্বা সময় ধরে পরিপূর্ণ করলো পূর্ব। পূর্ণতাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ওর পিপাসিত অধরজোড়াকে সিক্ত করে দিচ্ছিলো সে। আজ পূর্বের মন কোনো বাধ মানবেনা। সে প্রিয়তমার কাছ থেকে একটুও দূরত্ব সহ্য করবেনা। অন্তত এই ক্ষনিকের মূহুর্তে শ্বাশুরির শর্ত ভুলতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেনা। পূর্ণতার কাছ থেকে এই অল্পক্ষণের মূহুর্তকে সে সবচেয়ে দামী মূহুর্ত হিসেবে মনের গোপন বাক্সে লুকিয়ে রাখবে। স্মৃতিরূপে প্রতিদিন সে বারবার স্মৃতিচারন করবে। রাতগুলো যে পূর্বের ভালো যায় না, কেউ কি সেটা জানে? পূর্ণতার গায়ের সাথে মিলেমিশে কতদিন সে শান্তির ঘুম দেয়না, সেটা সত্যিই কেউ জানেনা। পূর্ব চাইলেও ক্লান্ত দেহের ভারী মনটা নিয়ে পূর্ণতার কাছে বলতে পারেনা, ‘আমার কষ্ট হচ্ছে পূর্ণ, সবকিছু দম বন্ধ লাগছে। একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও? কোলে জায়গা দাও তুমি? আমি তোমার কাছ থেকে কিচ্ছু চাইনা…’
পূর্ণতার নরম হাতদুটো পূর্বের পিঠের পান্ঞ্জাবী মুচড়ে ধরেছিলো তখন। হাসপাতালে সন্তান হারানোর পর আর দেখা দেয়নি এই নিষ্ঠুর মানুষটা। চুটিয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পরেছে সে। পূর্ণতা পান্ঞ্জাবীটা আরো কঠোরভাবে মুচড়ে ধরলো। কোনোভাবেই পূর্বকে যেতে দিবেনা সে। নিরবতার ব্যাপক সময়ক্ষনের পর পূর্ব হঠাৎ ওকে ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিতেই তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে লিফটের ‘ওপেন’ সুইচ টিপতে লাগলো। লিফটের দরজা খুলে গেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যায় পূর্ব। অন্ধকার বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি নেমেছিলো। পূর্ব পান্ঞ্জাবীর হাতায় অনবরত চোখ ঘষতে ঘষতে বৃষ্টির মধ্যে চলে যাচ্ছিলো। মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকা পূর্ণতা শূন্য দৃষ্টিতে বন্ধ হয়ে আসা লিফটের বাইরে শেষ দৃশ্য দেখছিলো। ধপ করে লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলে মাথা নুয়ে নিজের হাতের দিকে তাকালো পূর্ণতা। শূন্য হাতদুটো কেমন থরথর করে কাঁপছে। একটু আগে শক্ত করে আকড়ে রাখার জন্য যে উন্মাদনার শিকার হয়েছিলো, মানুষটা তো শেষমেশ চলে গেলো…

– ‘ চলবে ‘

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৫.
#ফাবিয়াহ্_মমো

রাতে ফিরার পর থেকে পূর্ণতার রুমের দরজা বন্ধ। নূরানী শত চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হয়নি। ফলাফল অসীম সীমায় শূন্য। পূর্ণতার রুম থেকে কোনো কান্নার আওয়াজ না এলেও কোনো সাড়াশব্দ আসছিলো না। মূল ভয়টা এখানেই ছিলো পূর্ণতা নিজেকে ক্ষতি করলো কিনা। নূরানী আর কোনো ভাবান্তর না করে খোদেজাকে কল দিয়ে সবটা জানায়। মেয়ের অবস্থা দেখে তিনিও চরম মাত্রায় ভয় পেয়ে সব কাজ গুটিয়ে রওনা দেন। এর মধ্যে পূর্ণতার বাবা কবির বাসায় ফিরলে জানতে পারেন পূর্ণতা আসার পর থেকেই নিজেকে রুমে বন্দি করে রেখেছে। কবির অফিসের পোশাক না পাল্টেই প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে দরজায় ধাক্কা মারতে থাকেন। কিছুক্ষন হাকডাকের পর ভেতর থেকে খট করে দরজাটা খুলে যায়। কবির কিছুটা আশ্চর্য হয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে পা দেন। পুরো রুম একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। জানালায় পর্দা দিয়ে বারান্দার দরজাও আটকে রেখেছে। ফ্যানটা ভূতুড়ে ভঙ্গিতে চলছে। ফ্যানের তিনটা পাখা এতো আস্তে ঘুরছে যে খালি চোখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। পূর্ণতা বেডের সাথে পিঠ লাগিয়ে ফ্লোরে বসে আছে। হাটুদুটো থুতনির সাথে ঠেকিয়ে রাখা। চুলগুলো ছেড়ে রাখার পরও কেমন এলোমেলো লাগছে। হরর মুভিতে চুল ছেড়ে যেভাবে বসে থাকে, পূর্ণতাও সেভাবে বসে আছে। কবির ড্রিম লাইটের নীলচে আলোটা জ্বেলে দিয়ে পূর্ণতার পাশে বসে পরলেন। মেয়ের মাথায় হাত রেখে স্নেহভরা কন্ঠে বললেন,

– আমার মা এভাবে বসে আছে কেন? কেউ কিছু বলেছে?

পূর্ণতা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো শুধু। কোনো বাড়তি আওয়াজ করলো না। কবির অন্ধকারেও মেয়ের মলিন মুখটা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছেন। কোনো লাবণ্য ভাব নেই মুখে। হাসির মতো শ্রেষ্ঠ সুন্দর অলঙ্কারটা সুদূরে হারিয়ে গেছে। কবির মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

– পূর্ণতা, আমাকে বল মা। সমস্যাটা খুলে বলো। আমি জানি, ব্যবসার চাপে তোমার দিকে লক্ষ রাখতে পারছিনা। যদি এই ডিলটা একটু হেলা করি, তাহলে অনেক বড় ক্ষতি হবে। তুমিতো জানোই আমি ব্যবসায় আরো একবার লস খেয়েছিলাম।

পূর্ণতা অনেকক্ষন পর চোখ বাবার দিকে চোখ তুলে তাকালো। চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছে ওর। পূর্ণতা কিছুক্ষণ নিরবে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফুপিয়ে কেদেঁ বললো,

– আমার কি দোষ বাবা? আমার কপালেই কেনো এমনটা জুটে? আমি কি অপরাধ করেছি? সবাই খালি আমার কাছ থেকে দূরে চলে যায়। মা আমাকে একফোঁটা সময় দেয়না। উনি কেমন মা? মা কখনো এমন হয়? অন্যদের মা-তো এমন করেনা। তুমি সবসময় ব্যবসার জন্য ব্যস্ত থাকো তাই তোমার কাছে কোনো অভিযোগ আমি করতে পারিনা। ছোট থেকে যে বড় হলাম, এ কেমন পরিবেশে আমি বড় হয়েছি? যেখানে সন্তানকে দেখাশোনার জন্য বাইরের মানুষ রাখা লাগে, সেখানে কে আমাকে ভালোবাসে? কে? যাকে আমি বিয়ে করলাম। এতোগুলো দিন তার হাতের পুতুলের মতো নেচে বেড়ালাম। যখন যেখানে যা করতে বলেছে আমি তাই চোখবুজে করেছি। একটা পাল্টা শব্দ উচ্চারণ করিনি। শ্বশুরবাড়িতে মিলেমিশে থাকবো আমার ভাগ্যে সেটাও জুটেনি। কখনো দেখেছো শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বাড়ির বউকে এতোটা আদর করে? আমার শ্বশুর-শ্বশুড়ি করতো। করতো কি তারা এখনো করে। আজ উনাদের অবস্থা দেখে আমার বুকটা ফেটে আসছিলো বাবা। উনাদের দেখভালের জন্য একটা নির্দিষ্ট মানুষ নেই। আপনার জামাইবাবা তার ইলেকশন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। বাবার ব্যবসা দুইহাতে একাই সামলাচ্ছেন। অথচ? অথচ আমি যে এখানে ওই বাড়ির বউ আর উনার স্ত্রী হয়ে জীবিত আছি সেদিকে কারোর ধ্যান নেই। উনি আমাকে দেখতেও আসেন না। খোঁজখবর নেয়া তো পরের ব্যাপার। মা প্রতিটা দিন সকাল বিকাল পূর্বকে নিয়ে কিসব বলে আমার তো ওগুলো শুনতে ভালো লাগেনা বাবা। পূর্ব এমন কি মহাপাপ করে ফেলেছে মা উনাকে দেখতেই পারে না?

পূর্ণতা চোখে হাত চেপে হু হু করে কাঁদতে লাগলো। কবির নিরুত্তেজ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে রইলেন। খোদেজার ভাষ্যমতে, পূর্বের মতো রাজনীতিতে জড়ানো পুরুষরা একদিন-না-একদিন চরিত্র নষ্ট করে মেয়েছেলে নিয়ে বিছানায় শুবে। এরা উপরে ফিটফাট এবং ভেতরে সদরঘাট হতে পিছপা হয়না। পূর্ণতা এখন যেটা দেখছে সেটা পূর্ব নিজে ওকে ভালোরূপ দেখাচ্ছে, ভেতরের নোংরারূপ না। যার বংশের বাকি ভাইদুটোই ওমন লম্পট, অশ্লীল, অসভ্য ধরনের তার চরিত্র আর কতো বিশুদ্ধ হবে খোদেজার জানা আছে। তবে পূর্ব যদি ভালো হয়েই থাকে পূর্ণতা ওর কাছে দুঃখ ছাড়া কিছুই পাবেনা। প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছে ফুয়াদের নোংরা আচরণের শিকার হয়ে, দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেয়েছে জাওয়াদের নিকৃষ্ট দুঃসাহসে। দুটো বেলায় পূর্বের সঙ্গ পায়নি পূর্ণতা। তৃতীয় ধাক্কার বেলায় পূর্ণতা জীবিত থাকেই কিনা তাই নিয়ে সন্দেহ হয় খোদেজার। নিজের মেয়েকে আর পূর্বের সাথে পাঠাতে তিনি মোটেও সাহস পান না। কবির সরল গলায় বললেন,

– তুমি এখন কি চাচ্ছো? তুমি কি পূর্বের কাছে যেতে চাও?

পূর্ণতা থুতনি থেকে হাটু নামিয়ে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে উত্তর দেয়,
– হ্যাঁ বাবা। ওই মানুষটা একদম ভালো নেই।উনি প্রচুরপরিমাণে পরিশ্রম করছেন। আজ নয়তো কাল এমন অবস্থায় পরে যাবেন তখন উনার সেবা করার জন্য আর কেউ থাকবেনা।

পূর্ণতার ব্যকুল অবস্থা দেখে কবির কিছুক্ষন নিজের মনে চিন্তা করলেন। এরপর পকেট থেকে ফোন বের করে পূর্বের নাম্বারে কল বসিয়ে লাউড স্পিকার অন করলেন। পূর্ণতা চটপট করে চোখ মুছে একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার ফোনের টুট টুট কলের দিকে। মৃদ্যু আলোর পরিবেশে হঠাৎ কট করে একটা শব্দ হয়ে গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে,

– আসসালামুয়ালাইকুম, বাবা। কেমন আছেন?

কবির মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, পূর্ণতা উন্মুখ দৃষ্টিতে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের বিপরীতে প্রচুর গাড়ি চলাচলের শব্দ হচ্ছে। পূর্ব সম্ভবত বাইরে আছে। কবির সৌজন্য গলায় বললেন,

– পূর্ব বাবা, আমার মেয়েটা ভালো নেই। কোনো বাবা মেয়ের খারাপ অবস্থা দেখার পর ভালো থাকতে পারেনা।

পূর্বের উত্তর শোনার জন্য প্রচণ্ড উদগ্রীব হয়ে আছে পূর্ণতা। পূর্ণতাকে অগ্রাহ্য করলেও বড়দের অগ্রাহ্য করার ভুলটা পূর্ব কখনো করেনা। পূর্ব তার ঠাঁট বজায় রাখা কন্ঠে বললো,

– আপনি আমাকে মাফ করবেন বাবা। কিন্তু সমস্যাটা আপনার মেয়ের মধ্যেই। তাকে ঠিক করে জিজ্ঞেস করুন মূল সমস্যাটা কি এবং সেটা কোথায়। আমাকে কল দিয়ে আপনি কোনো উত্তর পাবেন না। আমি একটু ব্যস্ত আছি। আমাকে মাফ করবেন।

পূর্বের কাটকাট জবাব শুনে কবির খুব কৌতুহল বোধ করলেও পূর্ণতা এদিকে জিদের রেশ আরো প্রবল করলো। সে ঠিক করলো আর নিজেকে সস্তা বানাবেনা। যেচে গিয়ে পূর্বের সামনে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করবেনা। পূর্বের এই কঠিন জবাবের মূল মর্ম এটাই ছিলো, পূর্ণতা ওর কেউ না। পূর্ণতা থাকুক বা না-থাকুক এতে পূর্বের চুল পরিমাণও আসে-যায় না।

.

দিন পেরিয়ে রাত। রাত পেরিয়ে দিন। সময়ের গন্ডি এভাবেই পার হচ্ছিলো দিনকে-দিন। পূর্ব নিজের ইলেকশনের প্রচারণার জন্য সকলের কাছে মুখিয়ে আছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী ইবরাহিম খান পূর্বের হৈচৈ সমাচার দেখে হিংসায় জ্বলেপুড়ে গেলেও চুপ করে থাকা ছাড়া কিছুই করতে পারছিলেন না। পূর্বের পার্টিও পূর্বের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পার্টির মুখ্যমন্ত্রী গোলাম আজাদও পূর্বের প্রতি জনগণের বিপুল সমাগম দেখে বাহ্বা জানিয়ে বিশেষ বার্তায় শুভকামনা পাঠিয়েছে। টিভির পর্দায় নিবার্চনের খবর যেনো সর্বেসর্বায় বিস্তার লাভ করেছে। জনতাও কাঙ্ক্ষিত দিনটির জন্য অপেক্ষায় কাটাচ্ছে। পূর্ণতার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষাও শেষ। এখন রেজাল্ট দেওয়ার পালা। পূর্ণতা নিজের নরম ব্যক্তিসত্ত্বার খোলস পাল্টে কঠিন ব্যক্তিত্বের রণরূপ নিয়েছে। পূর্বের জন্য আর সে উদাস হয়ে থাকেনা। না খেয়ে নিজের শরীরে দূর্বলতা বাধায় না। একপলক দেখার জন্য আগের মতো কাতরায় না। পূর্ণতার কঠোর রূপ দেখে খোদেজাও অবাক হয়ে গেছেন। কবির এর মধ্যে পূর্বের সাথে গোপনে কয়েকবার দেখা-সাক্ষাৎ করলেও পূর্ব তার এককথায় অনড়! আগে খোদেজাকে বলুন শর্ত তুলে নিতে নয়তো মেয়েকে বলুন মায়ের আচঁল ছেড়ে আমার কাছে আজীবনের জন্য চলে আসতে। পূর্ণতা এইবার যদি পূর্বের কাছে ফিরে আসে তাহলে সে কখনো মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবেনা। এমনটাই জানিয়েছে পূর্ব। এতোদিন পূর্ব ভাবতো, হয়ো পূর্ণতা খোদেজার কাছে বেশিদিন থাকতে পারবেনা। একপ্রকার অধিকার খাটিয়েই সে পূর্বের কাছে ফিরে আসবে। সেদিন যেভাবে জিদ দেখিয়ে বাঙলো বাড়িতে পূর্বের এক্সিডেন্টের সময় এসেছিলো ঠিক সেভাবেই পূর্ণতা আবারও ফিরে আসবে। কিন্তু পূর্ণতা ফিরেনি। আর ফিরেনি পূর্বের ওই কথা শোনার পর। ‘ মূল সমস্যা ‘ দ্বারা পূর্ণতার নিঃস্ব অবস্থার কথাটা পূর্ব যেভাবে ঠাসঠাস করে জবাব দিয়েছিলো, সেটা শোনার পর থেকে একমাত্র আত্মসম্মানহীন মেয়েই ওর কাছে বেহায়ার মতো ফিরবে। ওয়াসিফ পূর্ব যথেষ্ট ভালোই আছে, আর জীবনেও পূর্বের জন্য চিন্তা করবেনা সে। এখন থেকে নিজেকে যোগ্য প্রমাণের সঠিক যুদ্ধ লড়বে এবং দেখিয়ে দিবে ভালোবাসার কাঙাল হলেও নিজের আত্মগরিমায় দাগ লাগানো অবশ্যই পূর্ণতার পছন্দ না। এক অদ্ভুত জিদের বশে বশীভুত ছিলো পূর্ণতা। যেখানে আয়মান, খোদেজা, কবির, আয়েশা… কারোর কথাই সে কোনোরূপ কানে তুলেনি। খোদেজা একপর্যায়ে ডিভোর্সের কথা তুললে পূর্ণতা খোদেজাকে কথা শোনাতে একটুও চিন্তা করেনি। মনের সবপ্রকার জিদ মিলিয়ে ইচ্ছেমতো শুনিয়েছে খোদেজাকে। সেই সাথে পূর্বকে নিয়ে হাজার কটুক্তির মোক্ষম জবাবও পাইপাই দিয়েছে। খোদেজা সেদিন বাকরুদ্ধ হয়ে বাসায় ছিলেন, আর হাসপাতালে যাওয়ার মনোবল খুজেঁ পাননি।

আয়মান শিকদারের ভার্সিটি জীবন স্বল্প বিরতিতে কাটলেও নতুন ঝামেলা যুক্ত হয়েছে। সবে আয়মান নতুন চাকরিতে জয়েন করতেই ওর মা আফিয়া বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ছেলেকে উনি বিয়ে করাবেই, তা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। নাতী-নাতনীর মুখ দেখার জন্য ছটফটও বোধ করেন আফিয়া। এদিকে আয়মান না পারছে বাড়িতে একমিনিট বিশ্রাম নিতে, না পারছে শান্তিমতো একটু রিল্যাক্স হতে। উভয় দিকেই সংকট। নিজেকে রিফ্রেশ করতে সে একটা ছোট্ট শেডিউল ঠিক করলো। বাসা থেকে দূরে ভার্সিটির কাছে একটা আভিজাত্য কফিশপ হয়েছে, সেখানে নিরিবিলি কিছু সময় একাকী গুজরান করবে। যেই ভাবা সেই কাজ করতে আয়মান দ্রুত সাদা শার্ট গায়ে দিলো। কালো প্যান্ট পরে হাতে ফার্স্টট্র‍্যাক ব্রান্ডের কালো ঘড়ি পরলো। মিররের সামনে দাড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলা অবস্থায় বুকে প্রোফেশনালদের মতো স্প্রে করে নিলো। সুন্দর করে শার্টের হাতা ফোল্ড করে চুল ব্রাশ করে নিলো সে। পকেটে বাইকের চাবি ও হাতে মোবাইল নিয়ে তড়িঘড়ি করে রওনা দিলো। রেস্টুরেন্টে বসে সবার প্রথম ক্যাপোচিনো অর্ডার করলো আয়মান। বড় লম্বা মগের পানীয়ের উপর লাভ শেপের মতো ডিজাইন দিয়েছে। আয়মান সেটা দেখে ঠোঁটের কোণে সুক্ষ হাসির ভাঁজ ফেললো। দুহাতের ভেতর মগ আকড়ে গরম গরম ক্যাপোচিনোতে চুমুক বসালো। এসির শান্ত পরিবেশে বেশ আরাম লাগছে আয়মানের। একটু বিলাসবহুল বিধায় রেস্টুরেন্টে খদ্দের সংখ্যা নগন্য। আয়মান কাঁচের স্বচ্ছ দেয়াল গলিয়ে বাইরের ব্যস্ত সড়কে দৃষ্টি ফেললো। বিকেলের মেঘগুচ্ছ গোলাপী আভার আকাশে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সড়কে নজর পরতেই ওর চোখদুটো আটকে গেলো। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে আশ্চর্য হয়ে ঠোঁটের কাছ থেকে এমন ভঙ্গিতে ধীরেধীরে মগটা নামালো, যেনো বাইরে নেপালের ভূমিকম্প হচ্ছে। আয়মান কপাল কুঁচকে সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো বাইকে বসা একটা বখাটে ছেলে একটা মেয়ের সাইডব্যাগ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে চোখের পলকেই মেয়েটার হাতে ছুড়ি চালালো ওই ছিনতাইকারী! মেয়েটা ব্যথায় ‘মাগো..’ বলে চিৎকার দিতেই বখাটে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে বাইক ছেড়ে দিলো। মেয়েটা হাতের কবজি আকড়ে ব্যথায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে যেনো! আশেপাশে কোনো মানুষজন এতোক্ষন হা করে দৃশ্য দেখলেও মেয়েটার ককিয়ে উঠা চিৎকারে ভিড় করে ফেললো। আয়মান ওইটুকু দৃশ্য দেখার পর নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। তাড়াতাড়ি উঠে তিনশো টাকার কফিতে পাচঁশো টাকা বিল দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো! আয়মান ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই মেয়েটার দিকে চরম আশ্চর্য হয়ে চেচিয়ে উঠলো,

– মাই গড! তুমি ইন্জুর্ড হয়েছো সাবিহা?

সাবিহা চোখ ঘুরিয়ে শব্দ উৎসের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে উল্টে হাউমাউ করে কেদেঁ দিলো। সাবিহার কান্না দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় আয়মান। মানুষ আয়মানকেই এখন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখছে। আয়মান ব্যাপারটা ঠাহর করতে পেরে চকিতে সাবিহার দিকে আবার তাকালো। বাচ্চাদের মতো কাঁদলেও কবজির দিকে তাকালে বুকটা কামড়ে এলো যেনো! সেই একই দৃশ্য, একই কাটা জায়গা, একই রক্ত পড়ার মূহুর্ত! আয়মান খপ করে সাবিহার কাটা কবজিটায় শক্ত করে রুমাল চেপে ধরলো। আয়মান অস্থির উঠেছিলো গলগল করে রক্ত পরার দৃশ্য দেখে। পাগলের মতো ভিড় সরিয়ে সাবিহাকে জোরপূর্বক হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু সাবিহা সেই বাধভাঙ্গা কান্নাতে তোতলাতে তোতলাতে বললো,

– আআমার ককাছে কোনো টাটাকা নেই ভাইয়া..

আয়মান ঠাস করে একটা চড় মারে সাবিহার গালে। সাবিহা গালে হাত দিতেও যেনো ভুলে গেছে এমন ভঙ্গিতে হতবাক আছে। এদিকে প্রচণ্ড রাগে গজগজ করছে আয়মান! সে আর কিচ্ছু বলার উপায় না রেখে জোরপূর্বক সাবিহাকে টেনে হাসপাতালে আনে। পুরো হাত ভালোমতো ব্যান্ডেজ করানোর পর আয়মান ওকে বাসায় যেতে বলে। সাবিহা মুখ নিচু করে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে ধমকের সুরে চেঁচিয়ে ডাকে আয়মান,

– এ্যাই স্টপ!

সাবিহা মৃদ্যু ভঙ্গিতে কেঁপে উঠে পা চালানো থামায়। পিছনে ফিরে তাকালে আয়মান হেঁটে এসে ওর সামনে দাড়ায়। গমগম গলায় জিজ্ঞেস করে,

– এই অসময়ে এখানে কি করছিলে? তুমি কি জানোনা ভার্সিটির এরিয়ার কিভাবে চলা লাগে?

সাবিহা বুক ঠেলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে আয়মানের দিকে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– আয়মান ভাইয়া, আমি আপনার মতো বড়লোক না।

উত্তরের অবস্থা দেখে মাত্রাতিরিক্ত রাগ উঠলো আয়মানের! সোজা প্রশ্নের ত্যাড়া উত্তর দেখে ঠাস করে আরেকটা চড় মারতে ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর। শুধু হাতের দিকে একবার তাকিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো,

– আমার বড়লোক হওয়ার সাথে তোমার এই ব্যাপারের সম্পর্ক কি? আমার সাথে তুমি ইয়ার্কি করো? গাল লাল করে দিবো ফাজিল মেয়ে! সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করে আমাকে ত্যা…

আয়মানের বলার আগেই সাবিহা নিচু কন্ঠে বলে উঠে,

– আমি এখানে টিউশনি করাই ভাইয়া। টিউশনির জন্য প্রতিদিন হোস্টেল থেকে এখানে হেঁটে আসা লাগে। আজও এসেছিলাম।
– ব্যাগটাকে কামড়ে ধরেছিলো কেন? ওই ব্যাগটা যদি তখনই ছেড়ে দিতে আজ কবজিতে কাটা পরতো না।

সাবিহা অশ্রুপূর্ণ চোখে মাথা তুলে আরেকবার আয়মানের ক্রোধদৃষ্টির দিকে তাকালো। আয়মানের চোখেমুখে ভীষন রাগ দেখা যাচ্ছে। সাবিহা তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি রেখে উত্তর দিলো,

– ব্যাগে আমার টিউশনির টাকা ছিলো ভাইয়া। ওগুলো না পেলে আমি শেষ হয়ে যাবো।

সাবিহার শরীর মৃদ্যুতালে কাঁপছে। কান্না আটকানোর চেষ্টায় চোখ নিচু করে অশ্রু ঢাকতে চাইছে। আয়মান তখন কঠিন অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হলো। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

– কত টাকা ছিলো ব্যাগে?

সাবিহা উত্তর দিতে গিয়ে কান্নার জন্য আবারও কথা গুলিয়ে ফেলেছে। মাথাটাও উপরে তুলে কথা বলছেনা। আয়মান আবারও শান্ত সুরে অভয় দিয়ে বললো,
– বলো ব্যাগে কত টাকা ছিলো? খুব বেশি এমাউন্ট ছিলো?

সাবিহা কিছুক্ষন সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,

– চার হাজার।

আয়মান ওর মুখ থেকে উত্তরটা শুনতেই ব্যস্ততার সাথে প্যান্টের ব্যাক পকেট থেকে কালো ওয়ালেটটা বের করলো। ওয়ালেট খুলে কিছু টাকা নিয়ে সাবিহার দিকে এগিয়ে বললো,

– টাকাটা রাখো।

সাবিহা মাটি থেকে চোখ তুলে কান্নার হিড়িকে হাতের দিকে তাকালো। হাতে একহাজার টাকার অনেকগুলো চকচকে নোট। সাবিহা এবার আয়মানের চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– আপনি আমাকে টাকা কেনো সাধছেন আয়মান ভাইয়া? আমি এই টাকা নিবো না। আমার বেতনের টাকা তো ওই লুচ্চাটা ছিনতাই করেছে। আপনি প্লিজ টাকাটা রেখে দিন। আমি নিবো না।

আয়মান নিজের গম্ভীর এটিটিউট ফর্মে কিছুক্ষণ ডান ভ্রু চুলকে বললো,

– থাবড়া খাবা?
– জ্বী? , সাবিহার কৌতুহলজনিত প্রশ্ন।

সাবিহার ওই মুখ দেখে ফিক করে হেসে দিলো আয়মান। কি কারনে হাসলো সে নিজেই জানেনা। সাবিহা ওমন হা করে পিটপিট করে তাকিয়ে থাকলে সাথেসাথে আয়মান নিজেকে আগের মতো কঠোর বানিয়ে মুখ শক্ত করে বলে,

– বললাম থাপ্পর খাবে সোনামনি? যাইহোক! লেট ইট গো। চুপচাপ টাকাটা দিচ্ছি, চুপচাপ টাকাটা রাখো। পরে হিসাব মতো আমার কাছে পরিশোধ করে যাবে।

আয়মান জোর করে হাবলার মতো দাড়িয়ে থাকা সাবিহার হাতে দশটা একহাজার টাকার নোট গুঁজে বাইক ছুটিয়ে চলে গেলো। সাবিহা কি প্রতিক্রিয়া দিবে ভেবে পাচ্ছিলো না।হাতের মুঠোয় চকচকে এতোগুলো নোটের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো। এই মানুষটা কোথাও যেনো গভীরভাবে দাগ কেটে দেয়। চট করে গালে হাত রাখলো সাবিহা। আবারও দৃষ্টি দিলো শূন্য রাস্তার দিকে যেখানে বাইক দিয়ে আয়মান চলে গেছে। আচমকা ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হেসে দিলো সাবিহা। বুক ভরে দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে ছেড়ে দিলো হাসিমুখে। টাকাটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ফুটপাত দিয়ে হাটতে হাটতে আনমনে আয়মানের মুখটা স্মরণ করছিলো সে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখবন্ধ করলে ভেসে বেড়ায় সেই দৃশ্য। সাবিহা অজান্তেই কেনো জানি হেসে দিলো। আকাশে তাকিয়ে দেখলো, সন্ধ্যার বেগুনি আকাশে নীড়ের খোঁজে পাখি চলে যাচ্ছে। মনেমনে সাবিহা প্রিয় লাইনগুলো গুনগুনিয়ে সুর তুলছিলো,

আজ কল্পনায় বাস্তবতায়
তোকে ঘিরে,
আজ মেঘের গান গেয়ে যাই
তোর প্রতিক্ষনে।

.

পূর্ণতা এখন কবিরের কিনে দেওয়া নতুন গাড়িতে ঘোরাফেরা করে। ড্রাইভারটা কবিরের বিশস্ত লোক এবং পূর্ণতার পাশে সবসময় নূরানী থাকে। পূর্ণতা একা কখনো গাড়ি নিয়ে বের হতে পছন্দ করেনা। নিজের একাকীত্বের সময়গুলো সে চুপচাপ ঢাকা শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায়। নিজের ইচ্ছায় এখন সে বাবার ব্যবসায় টুকটাক ম্যানেজমেন্টের কাজটা দেখছে। এতে কবির প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। আজ বাবার সাথে দুপুরটা কাটিয়ে পড়ন্ত বিকেলে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে পূর্ণতা। নূরানীকে আনেনি আজ। ড্রাইভারকে বলে দিয়েছে যেদিকে চোখ যায় সেদিকে গাড়ি নিয়ে যেতে কিন্তু একই রাস্তায় টার্নব্যাক করা যাবেনা। সিটে পিঠ ঠেকিয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি দিয়ে পাখিদের উড়াল দেখছে পূর্ণতা। পি পি করে যানবাহনের বিকট হর্ণ বাজলেও সেদিকে খেয়াল নেই ওর। আপনমনে আকাশ দেখতে দেখতে হঠাৎ সন্ধ্যার তিমির নামলো। এদিকে রাস্তায় রাস্তায় চারপাশ ঘিরে পোস্টার, লিফলেট, ব্যানার টাঙানো। একহাত উঁচু করে আর্দশ স্টাইলে এক ভদ্রলোকের হাসিমুখ দেখা যাচ্ছে ছবিতে। পড়নে পান্ঞ্জাবী ও চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। এই লোকটার বক্তব্য টিভিতে অনেকবার দেখেছে পূর্ণতা। এই লোক পূর্বের অপজিট দলের প্রার্থী হিসেবে লড়ছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো কোথাও পূর্বের নামে সামান্য লিখাটুকুও নেই। জানালার কাছ ঘেঁষে বসলো পূর্ণতা। এখন সে পূর্বের এলাকায় রয়েছে। আর দশমিনিট গেলেই ওয়াসিফ ভিলা এসে পরছে। কিন্তু কোথাও পূর্বের নিবার্চন ঘিরে বিন্দুমাত্র পোস্টার নেই। অথচ ওই লোকের পোস্টার কারেন্টের থাম্বায়, উঁচু স্তম্ভে, তারে সারিবদ্ধ ভাবে ছড়াছড়ি অবস্থায় দেখেছে। পূর্ণতা কৌতুহল গলায় ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলো,

– চাচা নির্বাচনী এলাকায় এসে চমক খেলাম।

ড্রাইভার বৃদ্ধ মানুষ। তিনি নরম কন্ঠে বললেন,

– কি দেখে মা?
– ওইযে টিভিতে দেখেন না ওয়াসিফ পূর্ব নামে একজন তরুণ মানুষ নির্বাচনে দাড়িয়েছে? তার এলাকায় কোনো পোস্টার যে দেখা যাচ্ছেনা।

ড্রাইভার স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে হাসি গলায় বললো,
– আপনি শুনেননি ওই ছেলের কথা? এগুলো লাগালে নাকি পরিবেশ দূষণ হয়। এজন্য দলের সবাইকে বলে দিছে এসব না লাগাতে। যদি জনগণ তাকে ভালোবাসে এমনেই ভোট দিয়ে আসবে
– ও..

ঠোঁটে চোখা করে শব্দ ছেড়ে পূর্ণতা আবার জানালার বাইরে তাকালো। দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে পূর্ব চিন্তা করছে কিন্তু যাকে ‘ভালোবাসি’ বললো তার কোনো খোঁজই রাখেনা। পূর্ণতা আনমনে হেসে দিয়ে ড্রাইভারকে বললো,

– কি মনেহয় চাচা? এলাকায় এবার যুবক আসবে? ওই পূর্ব কি জিতবে?
– জিতার সম্ভাবনাই বেশি। বয়স কম হলেও এলাকায় যা যা করছে ওগুলো করেই ছেলেটা ভালোবাসা অর্জন করে ফেলছে। যদি নাও জিতে তাও মানুষ উনাকে ভালোবাসবো।
– কিন্তু আমার চোখে তো উনার এমন কোনো কাজ ধরা পরেনি। ওমন আহামরি কিছুই তো করতে দেখলাম না।
– মা, পূর্ব তো গতানুগতিক কাজ করেনা।
– মানে? , চকিতে প্রশ্ন ছুড়লো পূর্ণতা।
– পূর্বের একটা দলই আছে। যেইটা সমাজের কিছু মানুষের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা দেয়। ধরো, কেউ যদি চিকিৎসা করাতে চায়, ওদের দল এমন ব্যবস্থা করে দেয় যেখানে এক পয়সাও লাগেনা। বড় বড় হাসপাতালে অভিজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে ব্যবস্থা করায়। এই খরচের টাকা সব পূর্ব দেয়। ওদের কি বিশাল বাড়ি দেখছো না টিভিতে? আবার পারিবারিক ব্যবসা থেকেও ওদের ইনকাম আসে।
– ওহ্।

পূর্ণতা মুখ ঘুরিয়ে জানালার কাচঁটা একটু নামিয়ে দিলো। সামান্য ফাক দিয়ে দমকা হাওয়া ঢুকলো। ঢাকা শহরে এখন মৃদ্যু শীতের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে। রাতের দিকে বেশ ঠান্ডা নামে। ওই সময় বাইরে তাকালে কুয়াশায় কিচ্ছু দেখা যায়না। পূর্ণতা গায়ের পাতলা শালটা আষ্টেপৃষ্টে আকড়ে ধরলো। রাত এখন রাতটার বেশি। এই রাস্তায় গাড়ির চলাচল কিছুটা কমে আসছে এখন। হঠাৎ চোখের সামনে দিয়ে আলোয় আলোকিত দম্ভের মতো দাড়িয়ে থাকা ‘ওয়াসিফ ভিলা’ পেরিয়ে গেলো। ধুকপুক ধুকপুক করে কাপছে। হাত কেমন ঠান্ডা হয়ে আসছে। কেনো হচ্ছে? কোন আশায় মন ছটফট ভাব দেখাচ্ছে? কার দর্শনের জন্য আকুলিবিকুল করছে? সামনা সামনি আরো একবার কি দেখা হবে? লোকাল বাসে ভূতের মতো যেভাবে দেখা দিয়েছিলো আজ কি সুপারম্যানের মতো অদ্ভুতকাণ্ড দেখাতে পারেনা? মনের অগোচরে বুকের ভেতর পূর্ব-পূর্ব করে যন্ত্রটা লাফাচ্ছিলো। যতক্ষণ গেটের সেই আলোগুলো দেখা যাচ্ছিলো ততক্ষণ পূর্ণতা তাকিয়ে ছিলো। গাড়ি আরেকটু এগিয়ে গেলে জোরে নিশ্বাস ছাড়লো পূর্ণতা। এই বেহায়া মন কবে শুধরাবে? আর তোকে ও পাত্তা দিবেনা! পূর্ব নিজের জীবন সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলেছে। এখন ভোট হবে, ইলেকশন জিতবে, এমপি হয়ে শত মেয়ের মধ্য থেকে সবচেয়ে সুন্দরীকে বেছে নিবে। তোর কাছে মন ও শরীরের ধন-দৌলত ছিলো সেটা পূর্বের প্রাপ্য হয়ে গেছে। যদি ও তোকে ভালোবাসতো তাহলে শর্ত ছাড়াই কোলে তুলে নিয়ে যেতো। কাউকে পরোয়া করতো না। পূর্ণতা এসব ভাবতেই ভাবতে হঠাৎ আট-দশজন ছেলের একটা দলবল দেখতে পেলো। বেখেয়ালে সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে সামনে তাকালে হঠাৎ চোখ বড় বড় করে জানালার দিকে ঝাঁপিয়ে পরে উচ্চকন্ঠে চেচাতে লাগলো,

– চাচা থামান, থামান!! চাচা থামান প্লিজ!!

ড্রাইভার দুম করে ব্রেক কষে পিছু ফিরে তাকালে পূর্ণতা সাথে সাথে নিজের বেহায়া মনকে শান্ত করে জানালা থেকে সরে বলে,

– একটা বিড়াল গাড়ির নিচে চাপা পরতে নিচ্ছিলো চাচা। আপনি গাড়ি স্টার্ট দিন।

গাড়িটটা আবার জড়তা ভেঙ্গে চলতে শুরু করে। পূর্ণতা হাত মুঠো করে চোখ খিচে নিজেকে শক্ত করছে। আজ নিজের আবেগের কাছে হার মানবেনা, মানে মানবেনা। ওই স্বার্থপর মানুষ ওইভাবেই থাকুক! আর কখনোই যেনো চোখের সামনে না আসুক। বিড়বিড় করে মনে আওড়াতেই পূর্ণতা বাসায় ফিরে এলো। নূরানী ছাড়া আজও কেউ নেই। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ও আর খাওয়া দাওয়া করলো না। দরজা চাপিয়ে নূরানীকে ঘুমাতে বলে শুয়ে পরলো পূর্ণতা। দশটার দিকে শহরের বুকে প্রবল বেগে বৃষ্টি শুরু হলো। মূলত শীত নামানোর জন্যই আকস্মিক বৃষ্টির আগমন। ফ্যানের নিচে পাতলা কাথায় ঘুমানো যাচ্ছেনা। বাধ্য হয়ে কম্বল মুড়িয়ে শুলো পূর্ণতা। বারবার মনেহচ্ছে পূর্ব আসবে। ওর সাথে যতবার অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ হয়েছে, পূর্ব নিজের দ্বিতীয় দেখাটা সাংঘাতিক ভাবে দিয়েছে। এখনো লিফটের ঘটনাটা মনে পরলে লজ্জায় কুকড়ে যায় পূর্ণতা। ঠোঁটের উপর সেটাই ছিলো সবচেয়ে দীর্ঘতম অত্যাচার। বৃষ্টি যেভাবে পরছে কোনো সজ্ঞানে থাকা মানুষ অন্তত বাইরে বের হবেনা। কিন্তু মানুষ যা করে, পূর্ব তার বিপরীতটা করতে প্রচণ্ড ভালোবাসে। যদি আজ পূর্ব আসে তাহলে কি লিমিট ক্রস করে ফেলবে?

পূর্ণতার এলোমেলো চিন্তাভাবনায় বিশাল ছিদ্র করে হঠাৎ দরজায় কেউ ধাম ধাম করে ধাক্কাচ্ছে। পূর্ণতা চমকে গিয়ে হড়বড় করে কম্বল ছিটকে উঠে বসে। দুই হাতের শক্ত থাবা দরজার কাঠে ভয়ংকর ভাবে পরছে। খুবই হিংস্ররূপে শব্দ হচ্ছে। এখন তাহলে কে এসেছে? কে?

-‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO

( নোট : রিচেক দেওয়ার সময় হয়নি। )