তোকে ঘিরে পর্ব-৫৬

0
679

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৫৬.
#ফাবিয়াহ্_মমো

প্রবল বৃষ্টি। মেঘের পৈশাচিক গর্জনে রাতের শহরটা কেঁপে উঠছে। আকাশ চিড়ে দিনের আলো ফুটে আবার নিকষ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। বৃষ্টির টালমাটাল বেগতিক শব্দের ভেতর রুমের দরজায় কে ধাক্কা দিচ্ছে পূর্ণতার জানা নেই। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ভয়ের স্তপ জমা হয়েছে। হৃদপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে ছুটছে। পূর্ণতা ফ্লোরে পা ফেলে ধীরগতিতে দরজার দিকে এগুতেই হঠাৎ শব্দটা থেমে গেলো। পূর্ণতা বড় একটা ঢোক গিলে দরজা খুলতেই দেখলো নূরানী। পূর্ণতা নূরানীর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে বললো,

– তুই এভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছিলি? রাত কয়টা বাজে দেখেছিস? এভাবে কেউ ধাপুস ধুপুস করে দরজা ধাক্কায়?

নূরানী ভয়জড়িত কন্ঠে কিছু বলতে যেয়ে হঠাৎ পূর্ণতাকে জাপটে ধরলো। পূর্ণতা নূরানীকে নিয়ে বিষ্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছেনা। ওর হাবভাব স্বাভাবিক লাগছেনা। কিছু তো হয়েছে। কিছু তো নির্ঘাত হয়েছে। পূর্ণতা ওর পিঠে হাত রেখে ওকে আশ্বস্ত করে নম্র কন্ঠে বললো,

– কি হয়েছে? ভয় পেয়েছিস? আমাকে বলবিনা? নূরানী আমার দিকে তাকিয়ে বলতো কি হয়েছে?

নূরানী জাপটে ধরেই বললো,
– আপা বাসায় কে জানি ছিলো।

পূর্ণতা চরম আশ্চর্য হয়ে গেলো। নূরানী ছাড়া ফ্ল্যাটে কেউ নেই। খোদেজা একটা সিজারের কেস হ্যান্ডেলের জন্য হাসপাতালে। আর কবির ভোরের দিকে বাসায় ফিরবে। পূর্ণতা গলায় ঢোক ফেলে নূরানীকে ছেড়ে দিয়ে বললো,

– কখন টের পেয়েছিস? মেইন ডোর কি লক করা না?
– আপা বিশ্বাস করো, খালাম্মা যেমনে দরজা লাগায় আমিও ওমনে লাগাইছি। ওই গোল জিনিসটা মোচড় মাইরা মাঝখানে টিপ মাইরা দিছি।
– তাহলে ঘটনাটা কি?
– আপা তুমি যখন দরজা চাপায়া ঘুমিয়ে গেছো আমিও তোমারে দেইখা আইসা দরজা চাপায়া শুয়ে পরছি। পরে খট কইরা কেমুন জানি একটা শব্দ হইলো। আমি লগে লগে দেখি দরজার নিচ দিয়া কেউর ছায়া গেলো।
– এরপর কি হলো?
– এরপরে দরজা খুইলা দেখি সব অন্ধকার। লাইটও নাই যে পরিস্কার দেখা যাইবো। আমি সাহস কইরা তোমার রুমের দিকে যাইতেই ওই খট করনের শব্দটা আবার আইলো। আমি তাত্তাড়ি লাইট জ্বালায়া দেখি কেউ নাই। কিন্তু আপা আমি শিউর দিতাছি কেউ ছিলো।
– শোন, সন্ধ্যায় কোনো ভূতের সিনেমা দেখবিনা। তোকে যদি ওই ইন্সিডিয়াস টাইপের মুভি দেখতে দেখি তাহলে খবর আছে। চুপচাপ রুমে যা।

নূরানীকে চুপচাপ ঘুমাতে যেতে বললো পূর্ণতা। ড্রয়িংরুমের লাইট জ্বালিয়ে সে মেইনডোরের কাছে চেক করে এলো। দরজা আগের মতোই লক দেখে রুমে এসে শুয়ে পরলো। পূর্ণতার চোখে ঘুম নেই। নূরানীর ভয়ার্ত চেহারা দেখে তার ঘুমটা পালিয়ে গেছে। নূরানী গ্রামের মেয়ে হলেও ওর বুকে প্রচুর আছে। জ্বিন-ভূত দ্বারা ভয় না পেলেও পুরুষজাতির উপর ওর যথেষ্ট ভয় আছে। কুরআনের দুয়া-দুরুদ দ্বারা জ্বিনদের তাড়ানো সম্ভব হলেও পুরুষদের হিংস্র কবল থেকে বাঁচা যায়না। হঠাৎ পূর্ণতার খেয়াল হলো, রাজিব যেদিন অশ্লীল কাজটা করলো সেদিন পূর্ণতা হতবুদ্ধির মতো একপর্যায়ে রুমের দরজা বন্ধ করেছিলো। কিন্তু অলৌকিক হোক অথবা লৌকিক কারবার, পূর্ব সেই নবের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিলো। তাহলে কি নূরানী সত্য বলছিলো?

.

পূর্বের পদপ্রার্থীর নিউজ শোনার পর থেকে বামপন্থীর কিছু লোক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নানা মুখরোচক বার্তা প্রতিদিন ফলাও করে সংবাদ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। ডানপন্থী হিসেবে পূর্বের নির্বাচনে দাড়ানোটা নাকি হাস্যকর ব্যাপার। দল ঠিকমতো যোগ্য ব্যক্তিকে জনগণের জন্য দাড় করায়নি এমন নানা কথা তারা সুচারুরূপে ব্যক্ত করছে। কিন্তু জনগণের উপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে পূর্বও বলে দিয়েছে সময় নিশ্চয়ই যোগ্য জবাব দিবে। এখন কোনোরূপ হিতকর আলোচনা, হিংসাত্মক কথা ও ঠাট্টামস্করার জবাবদিহিও পূর্ব দেওয়াটা পছন্দ করেনা। তর্কের চেয়ে নিরবতা শ্রেয় এবং এমনটা ভেবে সে দেদারসে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ইমতিয়াজ উদ্দিন পার্টির কিছু লোককে আগেও যেমন সাহায্য করেছে, এখনো সে করছে। গোলটেবিলে বসা সেই তিনজন ব্যক্তিবর্গ মাসুদ আলমগীর, সাইফুল খন্দকার ও বাশার মল্লিক এখনো ইমতিয়াজকে আশ্বাস দিয়েই যাচ্ছে ভোট যেহেতু এখনো হয়নি, কাজেই পূর্বকে রাস্তা থেকে চুপ করে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করা যাবে। ইমতিয়াজ উদ্দিন এবার যেনো মরিয়া হয়ে উঠেছেন পূর্বকে রাস্তা থেকে সরানোর জন্য। এদিকে পূর্ব জানেও না নিজ পার্টির কিছু লোকই ওর ভয়ংকর শত্রু হয়ে গেছে। যারা এই মূহুর্তে স্বার্থের জন্য বিশ্রী নীল-নকশা সাজিয়ে ফেলেছে।

.

ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম ঠেলে উঠে পূর্ব।বাইরে দৌড়াতে বেরিয়ে যায় সে। শ্রেয়ার কবরটা দেখে এসে মসজিদে নামাজ পরে আবার বাসায় ফিরে। কোনোরকমে নাস্তাটা সেরে সকাল সাতটার দিকে পার্টির কাজে বেরুয়। দলবল নিয়ে এলাকার সমস্যাগুলো মস্তিষ্কে নোট করে রাখে, নাহয় তৎক্ষণাৎ সমাধান করে আসে। নিজের প্রতি অযত্ন, খাবারের প্রতি অনীহা, কাজের প্রতি কর্মঠ হতে গিয়ে পূর্ব নিজের শরীরে অতি মাত্রায় ধকল দিচ্ছে। নিজেকে যতোক্ষন কাজের মাঝে রাখে ততোক্ষনই পূর্ণতার চিন্তা কিছুটা ভুলে থাকে। কিন্তু দিনশেষে যেই মানসিক কষ্টটা ভোগ করে সেখান থেকে কোনোভাবেই রেহাই পায়না সে। রাতগুলো নির্ঘুমে কাটাতে গিয়ে এখন বাধ্য হয়ে ট্যাবলেট গিলে ঘুমাতে হচ্ছে। মাথার যন্ত্রণায় সারারাত সে ছটফট করে। ঘুমাতে পারেনা। চুল আকড়ে বিছানায় শক্ত হয়ে বসে থাকে। আগের তুলনায় মাথাব্যথাটা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে ওর। এখন আর সহ্য করতে না পেরে ঘন্টার পর ঘন্টা শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। বাবার ব্যবসাটা আবার চাঙ্গা হয়ে গেছে। কিন্তু চাচারা কেউ সাহস করে ইন্ড্রাস্টিজ সামলানোর দায়িত্ব চাইতে পারেনা। ব্যবসা যেভাবে ডাউন করে দিয়েছিলো এরপর থেকে গুমড়ে গিয়ে চাচারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা গ্রামের ভিটেবাড়িতে বাকিদিন কাটাবে। মূসা ওয়াসিফ অর্থাৎ পূর্বের দাদার কাছে তারা ফিরে যাবে। পুরো ওয়াসিফ ভিলায় এখন শুধু পলাশ ওয়াসিফ ও আয়েশা থাকে। তাদের দেখভালের জন্য চাকরদের জায়গা দেওয়া হয়েছে। পূর্ব বাইরের কাজ সামলে বাড়িতে ফিরলেও নিজের শূন্য রুমটার জন্য এখনো আশা রাখে। পূর্ণতা হুট করে ওকে চমকে দিয়ে এই রুমটায় আবার চলে আসবে। হয়তো অধিকার নিয়ে গমগম গলায় বলবে, ‘ কমরেড সাহেব! আমি আপনাকে খুন করবো! আপনি আমাকে এতোদিন স্মরন না করে যেই পাপ করেছেন, সেটার জন্য আপনার মৃত্যুদন্ড কার্যকর! কিন্তু আপনাকে ছাড়া তো আমার থাকা অসম্ভব। তাই যোগ্য শাস্তিরূপে আপনাকে যতোদিন আমার সঙ্গে থাকতে বলবো ততদিন আপনি থাকবেন। নো পার্টি, নো কাজ। পান্ঞ্জাবী খুলে আমার শয়ন জায়গাটা রেডি করুন। ‘

পূর্ব কথাগুলো ভেবে হেসে দেয়। যদি পূর্ণতা আরেকটু জিদ দেখিয়ে চলে আসতো? এই জিদটা যখন সব জায়গায় খাটাচ্ছে পূর্বের ব্যাপারে খাটালে কি হতো? পূর্ব রুমে ঢুকে দুহাতে পান্ঞ্জাবীটা খুলে বেডের উপর রাখলো। আয়নার সামনে দাড়িয়ে পকেট থেকে ওয়ালেট, মোবাইল ও ব্লুটুথ বের করে রাখতেই আয়নার দিকে তাকিয়ে মনেমনে বললো, তুমি আমার কাছে একবার আসলে আমি কি ফিরিয়ে দিতাম? কখনোই দিতাম না। তুমি আব্বু আম্মুর সাথে দেখা করে গেলে কিন্তু আমার জন্য অপেক্ষা করলেনা। কেন করলে না? কম ভালোবাসা দিয়েছিলাম? আমার ব্যস্ত সময় থেকে কি সত্যি তোমার জন্য সময় বের করিনি? রাতটুকু তো তোমার জন্য ছিলো। যত সমস্যাই হোক আমি তোমার কাছে ফিরতাম। আমার তো খারাপ লাগে। কারোর কাছেই কিচ্ছু প্রকাশ করতে পারিনা। এইযে মাথাব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি সেটাও কাউকে বলতে পারছিনা।তুমি থাকলে কি আমার এই যন্ত্রণাটা হতো?

আয়নায় তাকিয়ে পূর্ব দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। বাম হাতের কবজি থেকে ঘড়ি খুলে রাখলো। গত কয়েকটা দিন থেকে শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। ইদানিং কাজেও সে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছেনা। ডাক্তারের দীর্ঘ চিকিৎসার পর আয়েশা আগের তুলনায় সুস্থ বলে নিজেই ছেলেকে দেখতে এলেন। রুমে ঢুকে দেখেন পূর্ব ক্লোজেট খুলে টিশার্ট-ট্রাউজার বের করছে।রুমের অবস্থা আজও এলোমেলো। চোখ ফিরিয়ে তিনি ছেলের কাছে গেলেন। পেছন থেকে পূর্বের উন্মুক্ত পিঠে হাত রেখে শিউরে উঠলে তাড়াতাড়ি পূর্বকে নিজের দিকে ফিরিয়ে কপালে হাত রেখে বললেন,

– এতোবছর পর তোর জ্বর এলো কি করে?

পূর্ব ভাবলেশহীন সুরে বললো,
– কিছু হয়নি। খেয়েছো? আব্বু কি ঘুম? নাকি জেগে আছে?

আয়েশা হকচকিয়ে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,
– তুই কি এখন নিজেকে মেরে ফেলতে চাচ্ছিস? কি শুরু করলি? শেষবার কবে জ্বর হয়েছিলো সেটাও আমি ভুলে গেছি। এদিকে আজ তোর শরীর পুড়ছে! বাবা আমার, একটু কথা শোন? জ্বর নিয়ে হেলাফেলা করিস না। কত বছর পর অসুখ এসেছে, এটা ভালো লক্ষন না বাবা। এখন যদি যত্ন না করি তুই বাঁচবি বল?

পূর্ব মায়ের কথা শুনে চোখদুটো সরু করে তাকালো। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

– আমি তো এই সামান্য আঘাতে মরবো না আম্মু। মরন এতো সোজা না। যদি সোজা হতো তাহলে আমাকে জীবিত দেখতে পেতে না। এই সুযোগে আল্লাহ্ যদি আমার মৃত্যু কবুল করেন, আলহামদুলিল্লাহ খুশি হবো।

এক মূহুর্ত দাড়ালো না পূর্ব। সেই উত্তপ্ত শরীরে সে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। আয়েশা নির্বাক চাহনিতে ছেলের অবস্থা দেখে প্রচণ্ডরূপে কষ্ট পেলেন। ছলছল করে উঠলো উনার চোখ। উনার ছেলে হয়তো মরে যাওয়ার ব্রত হিসেবে আজ বহুবছর পর অসুখ ডেকেছে। বৃষ্টিতে ভিজলেও যার জ্বর আসতো না, মৌসুম পাল্টালে সর্দি-কাশি হতো না, বড় ধরনের অসুখ বাধতো না… তার শরীরে কত বছর পর জ্বরাক্রান্ত ব্যাপারটা এলো? মাথাব্যথার রোগটা ছাড়া পূর্বের বিশেষ কোনো অসুস্থ অবস্থা কখনো হতো না। সেই পূর্বের শরীরটা অমন আগুনের মতো পুড়ছিলো?

.

তিনদিন ব্যাপী তুমুল বৃষ্টির তান্ডব শেষে হুট করে ঢাকা শহরে মৃদ্যু শীত নামলো। কনকনে মৃদ্যু শীতের আভাষ যেনো বহু যুগ পর এলো। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য নাকি দিনদিন আবহাওয়া পাল্টে যাচ্ছে।। যার কারনে পুরো শহরটা এখন মৃদ্যু শীতের চাদরে ঢেকে গেছে। রাত দশটার পর থেকে হালকা কুয়াশা। বাইরে তাকালে ধোয়া ধোয়া। পূর্ণতা কিছুদিন আগে খোদেজার কাছে বকা খেয়েছে। বকাটা এ কারনে, পূর্ণতা যেদিন ওয়াসিফ ভিলায় গেলো সেদিন সাইড ব্যাগে করে পূর্বের শার্ট, টিশার্ট ও একটা পান্ঞ্জাবি এনেছে। আর রাতেরবেলা কামিজ না পরে পূর্ণতা পূর্বের পোশাক পরে থাকে। খোদেজা এ ব্যাপারে জানতেন না। জানার পর এমন ছেলেমানুষি কাজের জন্য প্রচুর বকেছেন। তাতে পূর্ণতার কিছুই হলো না।

রাত ঠিক এগারোটার দিকে আচানক বৃষ্টি নামলো। পূর্ণতা সত্যিই আশ্চর্য হয়ে গেছে। এখন অসময়ে বৃষ্টি নামলো? মানুষ যে বলে ঠিকই বলে। প্রকৃতি সত্যিই দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। কখন যে ঝড় নামে, কখন যে বৃষ্টি হয়, কখন যে গা কাঁপে ঠিক কিছুই অনুমান করা যায়না। পূর্ণতা গায়ে মোটা চাঁদর পেচিয়ে এককাপ কফি নিয়ে দোলনায় বসলো। বৃষ্টির ছাট এসে চোখে-মুখে লাগছে। বাসায় আজও কেউ নেই। পূর্ণতার নানাভাই খুব অসুস্থ বলে খোদেজা ও কবির আজ সকালের তিস্তা ট্রেনে দেওয়ানগন্ঞ্জ চলে গেছে। পূর্ণতাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য অনেক তোষামোদ করলেও লাভ হয়নি, ও যায়নি। নূরানী ড্রয়িংরুমে বসে টিভির পর্দায় জলসা নিয়ে বসেছে। হঠাৎ কে যেনো মেইন দরজার বাইরে কলিং টিপলো। পূর্ণতা তখন কফিতে চুমুক দিচ্ছিলো। শব্দটা শুনে ও আর দিলো না। দোলনা থেকে নেমে টেবিলে কফিটা রেখে সোজাসুজি দরজার দিকে চলে গেলো। নূরানী দৌড়ে এসে খুলতে আসলে নিলে পূর্ণতা ‘আমি খুলছি, তুই যা’ বলে ওকে বাধা দিলো। লুকিং মিররে চোখ বসিয়ে দেখলো দারোয়ান। দরজা একটু খুলে সরু ফাঁক করতেই পূর্ণতা দারোয়ানের উদ্দেশ্য কিছু বলবে তার আগেই দারোয়ানটা গড়গড় করে বললো,

– নিচে আপনেরে ডাকে। একজন বইসা আছে।
– কে ডাকে?
– হেইডা আমি ক্যামনে কইতাম?
– ছেলে না মেয়ে?
– বেডা মানুষ।
– লোক এসেছে?
– আল্লাহ তায়ালার দেয়া দুই চোখ দিয়া তো হেডাই দেখলাম।

দারোয়ানের প্যাঁচমুখো কথাগুলো কখনো পূর্ণতার সহ্য না। নিচে কেউ এসেছে এটা সুন্দর করে বললে কিছু হতো? পূর্ণতা দারোয়ানকে যেতে বলে জানিয়ে দিলো সে আসছে। নূরানী দরজার পাশে দাড়িয়ে সব কথা শুনেছে। ও হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে ভাবছে ‘যাবে নাকি যাবেনা’। এর মধ্যে নূরানী মুখ খুলে বললো,

– আপা নিচে যদি ওই লোকে বইসা থাকে তাহলে তো বারান্দা দিয়াই দেখা যাইবো।
– চল।

পূর্ণতাকে রেখেই নূরানী বারান্দার দিকে ছুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি গ্রিল ধরে নিচে দৃষ্টি ছুঁড়লো। পূর্ণতাও কাছে এসে যেই নিচে তাকাবে হঠাৎ নূরানী এক চিৎকার দিয়ে বললো,

– ভাই আসছে আপা! পূর্ব ভাই নিচে!

ধ্বক করে কেঁপে উঠলো পূর্ণতা। চোখ বড় করে যখন তৎক্ষণাৎ নিচে তাকালো ওর বড় চোখ আরো বিশাল বড় হয়ে গেলো। চোয়াল ঝুলে মুখ হা হয়ে গ্রিল থেকে হাত সরে গেলো। নূরানী খুশিতে নিচে তাকিয়ে থাকলেও পূর্ণতা তখন বারান্দা একপা একপা করে পিছিয়ে যাচ্ছিলো। পূর্ণতার কাছ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে নূরানী পিছু ফিরে দেখলো পূর্ণতা তখনও চোখ বড় করে আছে। নূরানী ওই অবস্থা দেখে পূর্ণতাকে অস্থির ভঙ্গিতে ঝাকিয়ে বললো,

– আপা.. আপা তোমার কি হইছে? ভাই বৃষ্টির মধ্যে নিচে তো। ও আপা? তুমি কিছু বলো? তুমি নিচে যাইবা না?

পূর্ণতা কোনো উত্তর দিচ্ছিলো না। ওয়াসিফ পূর্ব বাসার নিচে কিভাবে? কিভাবে সম্ভব? ও কিভাবে আজ এলো? নিজেকে খানিকক্ষন পর ধাতস্থ করে সৎবিৎ ফিরে পেলো পূর্ণতা। কোনোভাবেই নিজেকে এখন শান্ত করতে পারছেনা। ঢকঢক করে কয়েক গ্লাস পানি খেলো, অথচ ঠিকমতো শ্বাস টানা যাচ্ছেনা। একদম শ্বাস কুলাচ্ছে না। বুকে অক্সিজেন ফুরিয়ে আকস্মিক চাপে ধড়ফড় ধড়ফড় করে হৃদযন্ত্র লাফাচ্ছে। পূর্ণতার অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখে নূরানী উন্মাদের মতো প্রশ্ন করতে লাগলো। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে নিজেকে কন্ট্রোল করে একদম স্বাভাবিক হয়ে বললো,

– নূরানী, তুই এখন নিচে যাবি। ওই লোককে জিজ্ঞেস করবি এখানে কোন্ মরা মাটি দিতে এসেছে। এরপর উত্তরটা শুনে চুপচাপ চলে আসবি। একদম দাড়াবি না।

নূরানী চরম অবাক হয়ে বললো,

– আপা তুমি ভাইরে বাসায় আসতে বলবা? ভাই তো ভিজে গেছে।

পূর্ণতা কপট রাগ দেখিয়ে ঝাঝালো কন্ঠে বললো,

– তোকে উনার খেদমত করতে বলছি? জাস্ট নিচে যাবি! উত্তরটা শুনবি! আর চুপচাপ চলে আসবি। আর যদি ওই লোক উপরে আসতে চায়, তাহলে তোর আত্মীয় ভেবে ভেতরে ঢুকাবি। আমি এতে দায়ী না। আমার ঘুম পাচ্ছে। আমি ঘুমাবো।

পূর্ণতা চটপট উত্তর দিয়ে একপ্রকার পালিয়ে গেলেও বুকের ভেতরে আনচান করছিলো ওর। পূর্ব নিচে এসেছে এটুকু শুনেই বেহায়া মন আবার তীব্র উৎকন্ঠায় ভুগছিলো। বিছানায় শুয়েও পূর্ণতার চোখ ও মন চাপিয়ে দেওয়া দরজা দিকে আটকে ছিলো। নূরানী নিচে গিয়ে দেখে পূর্ব বৃষ্টির মধ্যে সিড়িতে বসে আছে। দারোয়ানটা একটু দূরে গিয়ে মনের সুখে বিড়ি খাচ্ছে। গায়ের সাদা টিশার্ট ও কালো নাইকের ট্রাউজারটা একেবারে চুপচুপে ভিজে গেছে। নূরানী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সরল গলায় ডাকলো,

– পূর্ব দুলাভাই?

চকিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে উঠে দাড়ালো পূর্ব। নূরানীকে দেখতে পেয়ে সজাগ চাহনিতে একপলক ওর দিকে তাকিয়ে এরপর কিছুটা দূরে থাকা দারোয়ানকে দেখলো। নূরানী যেভাবে জোরে ডেকে উঠলো এতে ওই দারোয়ানটা ‘পূর্ব’ নামটা না শুনলেই চলে। ভেজা শরীর নিয়ে ভেতরে ঢুকলো ও। পূর্বের মুখে সার্জিক্যাল মাস্কটা ভিজে নীল থেকে আরো গাঢ় নীল হয়ে গেছে। পূর্ব নূরানীর সামনে এসে নিচু গলায় সর্তক ভঙ্গিতে বলে,

– তোর আপু কোথায়?

নূরানী ছোট্ট ঢোক গিলে অপ্রসন্ন কন্ঠে বললো,
– আপা আসেনাই। আপনে কেন আসছেন, এটা জিজ্ঞেস করতে আমারে নিচে পাঠাইছে।

কথাটা শুনতেই মেজাজটা তুঙ্গে চড়লো পূর্বের। এই কয়দিনে ওর এতো তেজ বেড়েছে? বিয়ের আগে এই তেজ, এই দেমাগ কোথায় লুকিয়েছিলো? নূরানী দেখলো পূর্ব ইতিমধ্যে মাস্কের আড়ালে কয়েকবার হাঁচি দিয়ে ফেলেছে। চোখগুলোও বেজায় লাল। শরীর যেভাবে ভিজে গেছে সর্দিজ্বর নির্ঘাত লাগবে। কিন্তু নূরানী জানেনা, জ্বরটা অলরেডি পূর্বের শরীরে উচ্চ তাপমাত্রায় বয়ে চলছে। পূর্ব যতটা সম্ভব শান্ত হয়ে উত্তর দিলো,

– ওকে বলে দিও আজকের পর আমি আর কখনো আসবো না। ও যদি মায়ের মতোই অহংকার নিয়ে থাকতে চায় থাকুক।

নূরানী এবার নাছোড়বান্দার মতো পূর্বের হাত টেনে ধরলো। আকুতি মিনতি করতে করতে একপ্রকার জোর করে পূর্বকে নিয়ে লিফটে ঢুকলো। নূরানীর কর্মকাণ্ডের জন্য দারোয়ানও এখন তীর্যক চোখে তাকিয়ে দেখছে। নিরুপায় হয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে নূরানীর কথা তখন শুনলো পূর্ব। নূরানীর সাথে লিফটে চড়ে ফ্ল্যাটে ঢুকলো। মনেমনে ঠিক করলো কাটায় কাটায় ঠিক দশ মিনিট এখানে বসবে। এরপর যত বাধাই আসুক না কেনো সে চলে যাবে। পূর্ণতার চেহারাও সে দেখবেনা। তাই ড্রয়িংরুমে না বসে নূরানীর দেখিয়ে দেওয়া রুমে বসলো পূর্ব। রুমটা দেখেই চিনতে পারলো এটা অতিথি কক্ষ। নূরানী দ্রুত চা করতে চলে গেলে পূর্ব রুমের লাইটটা নিভিয়ে ফ্লোরে বসলো। তার পুরো শরীর যেভাবে ভিজে আছে এই শরীর নিয়ে বিছানায় বসলে ওদের মহা দামী চাদরটায় পানি লেগে নষ্ট হয়ে যাবে। পূর্বের মাথা টলছে। চোখ লাল হওয়ার কারনে ঝাপসা দেখছে। জ্বরের কারনে চোখদুটো একটু বন্ধ করলো পূর্ব। মুখে মুখে আওড়ালো… শুধু দশমিনিট, আর দশমিনিট, তুই ঠিক আছিস, ড্রাইভ করতে পারবি, জ্বরে কেউ মরে না, তুইও মরবিনা।

পাশের রুমে প্রচণ্ড অস্থির হয়ে অন্ধকারের মধ্যেই পূর্ণতা অনবরত পায়চারী করছে। নিজের চুল টেনে ছিড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে!কষিয়ে গালে চড় মারলে ঠিক হতো। বারবার মন ওদিকে যাচ্ছে কেনো? কি আছে ওই ঘরে? বিশেষ মধু আছে? এতো বেহায়া কবে হলো পূর্ণতা? নিজের অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ঘেন্না হচ্ছে। আবারও সেই পাষাণের কাছে ছুটার জন্য আকুপাকু করছে? ওই পাষাণ তো একটা স্বার্থপর ছাড়া কিচ্ছু না। পূর্ণতা নিজেকে কয়েক চোট গালাগাল করে শক্ত মুখে বিছানায় বসলো। এদিকে নূরানী চুলায় চায়ের পানি বসিয়ে পূর্বের সাথে কথা বলতে আসলে আলোকিত রুমটা লাইটহীন অন্ধকার। অবাক হয়ে সুইচ টিপতেই ও আরো বহু মাত্রায় আশ্চর্য হলো! পূর্ব ফ্লোরে বসে ঝিমুচ্ছে! নূরানী তাড়াতাড়ি কাছে এসে পূর্বের হাত ঝাকুনি দিবে ওমনেই বুঝতে পারলো জ্বর এসেছে। সামান্য জ্বর নয়, ভীষণ জ্বর। নূরানী কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে তড়িঘড়ি করে যেই উঠতে নেবে পূর্ব ওই অবস্থায় গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

– খবরদার নুর! তুই ওকে ডাকবিনা! ও জানুক আমি সুস্থ আছি। ওকে বলবি আমি ওকে ছাড়া যথেষ্ট ভালো। উল্টো ওর জন্য এতোদিন খামোখা কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কাজ ফেলে ওকে সময় দিতে গিয়ে আমার অবস্থা টাইট হয়েছে। তুই ওকে কিচ্ছু বলবিনা নূর। ভুলেও কিচ্ছু বলবিনা।

নূরানী পূর্বকে ওভাবে বলতে দেখে কেদেঁ দিলো। পূর্বের কপালে ও গলায় হাত রেখে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,

– ভাই আপনের শরীর সত্যি খুব খারাপ। ভাই আমারে আপার কাছে যাইতে দেন। এইভাবে বইলেন না। আপা আপনের এই অবস্থা দেখলে কষ্ট পাইবো।

পূর্ব চিৎকার দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

– অসম্ভব! ওর মতো নির্দয় কখনো কষ্ট পাবেনা। নূর তুই ওকে কিচ্ছু বলতে যাবিনা। আমি এখুনি চলে যাবো। এখানে আমি থাকতে আসিনি।

পূর্ব ফ্লোর থেকে উঠতে নিলে নূরানী উচ্চাঙ্গে কেদেঁ দেয়। বাইরে তুখোড় বৃষ্টি, আকাশে বিকট শব্দে বাজ পরছে। পূর্ব নিজের দিকে বিন্দুমাত্র না ধ্যান দিয়ে এমন ভাবেই উঠে দাড়ালো যেনো তার কিছুই হয়নি। সে পুরোপুরি সুস্থ। পকেট থেকে ভেজা মাস্কটা বের করে মুখে পরতে নিলে নূরানী ওকে বাধা দেয়ার জন্য দৌড়ে গিয়ে পূর্ণতার দরজায় পাগলের মতো আবার ধাক্কাতে লাগলো। পূর্ণতা শিউরে উঠে তড়াক করে বিছানা থেকে উঠতে বাধ্য হলো।দরজার বাইরে থেকে জোরে জোরে গলা ছেড়ে নূরানী কাঁদছে। একতালে সেদিনের দরজা ধাক্কাচ্ছে। পূর্ণতা ঝটপট দরজা খুললে দেখে পূর্ব মেইন দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এদিকে নূরানীর দিকে দৃষ্টি পরতেই নূরানী চিল্লিয়ে বলতে থাকে,

– আপা.. আপা ভাইরে থামাও। যাইতে দিও না। ভাইয়ের শরীরে খুব জ্বর। আপা গো, তুমি ভাইয়ের সাথে এমন করো না.. ওনার গায়ে হাত দিয়ে দেখো। আগুনের মতো পুড়তাছে।

চলবে।