#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬০
#ফাবিয়াহ্_মমো
( অংশ ০১.)
‘নির্বাচন’ শব্দটা যতো ছোট, ততোই জটিল সমস্যায় ঘেরা এক বিশাল রহস্য ছিলো। পূর্ব জানতো না তার দলেরই কিছু লোক তার পেছনে ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করেছে। ডানপন্থী দলের মুখ্যমন্ত্রী বিরাট চিন্তাধারা নিয়ে দেশের জন্য ভালো পরিকল্পনা রাখলেও তা যে নিজ দলের কিছু মুখোশধারী নেতার জন্য দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে পরিণত হচ্ছিলো সে খবর হয়তো কান পযর্ন্ত পৌঁছাতো না তার। দেশ পরিচালনার মতো বড় দায়িত্বে তিনি ব্যস্ত থাকলেও ছোট ছোট দুর্নীতিগুলো জানার উপায় কিছু ধৃষ্ট নেতারা দিতো না। পূর্ব জানতো দলের মধ্যে কিছু কিছু উর্ধ্বতন নেতা ভালো না, তারা তাদের পলিটিক্যাল পাওয়ারটা জনগণের জন্য ব্যবহার করতো না। অন্যায়ভাবে বিভিন্ন অনৈতিক কাজে পাওয়ারের জোর দেখিয়ে নিজেদের কার্য হাসিল করে তারা। সেদিন পূর্ণতা ফুপিয়ে কেদেঁ যে কথাগুলো বলেছিলো সেগুলো শুনে প্রচণ্ড অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেলে পূর্ব। পূর্ণতার মধ্যে হুটহাট যে ক্ষেপে যাওয়ার বিশেষ গুণটি আছে সেটাও দেখে নিয়েছে সে। অনেকটা ঘুমন্ত বাঘিনীর মতো আচরণ করে পূর্ণতা। সবসময় চুপচাপ থাকলেও যখন রাগে তখন ভালোই ক্ষিপ্ত আচরণ করে ও। পূর্ব যখন চোখ থেকে জোর করে কবজি উঠায় তখন রেগে গিয়ে পূর্ণতা ধাক্কা মেরে মুখ ঘুরিয়ে উঠে বসে। চোখ ছাপিয়ে অশ্রু পরতে থাকলেও সে পূর্বের দিকে ফিরেও তাকায় না আর। রাতটা গভীর এবং চারপাশ জোৎস্না আলোয় নিস্তব্ধ পরিবেশ। পূর্ণতার ঠিক পেছনেই ছিলো পূর্ব। শোয়া থেকে উঠে বসে ও। মাথা নিচু করে চুপ থাকলেও ভেতরটা চুরমার হয়ে আসছিলো তখন। একদিকে পূর্ণতার জিদপূর্ণ কান্না, অপরদিকে নির্বাচনের চিন্তা। দুটোই পূর্বকে অজানা ভয়ের চাদরে মুড়িয়ে দিয়েছিলো। কয়েক মিনিট ওভাবেই চুপচাপ বসে থাকলে মুখ তুলে পূর্ণতার দিকে তাকায় পূর্ব। কান্নার হিড়িকে অনবরত পিঠটা কাঁপছে, মাথাটা নিচু করে রাখা ওর। পূর্ব এগিয়ে গিয়ে খোপার পিনটা টেনে চুল ছেড়ে দিলো। একহাতে চুলগুলো পিঠের উপর থেকে সরিয়ে ডানকাধের ওপাশে ফেলে দিলো।ঘাড়ের উপর গভীর আবেশে চোখ বন্ধ অবস্থায় ওষ্ঠযুগল ছুঁয়িয়ে দেয় পূর্ব। পূর্ণতা মৃদ্যু ভঙ্গিতে কেঁপে উঠতেই পূর্ব তার হাতজোড়া দিয়ে পূর্ণতার কোমর জড়িয়ে ধরলো। পিঠের উপর গাল চেপে অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে বললো পূর্ব,
– তুমি আমার জন্য কতটুকু মূল্যবান আমি আর কিভাবে বোঝাই? এভাবে কাঁদলে যে আমার খারাপ লাগে এটা বুঝো না? সবসময় আবেগী হলে তো চলেনা। আজ এতো সুন্দর করে আমার জন্য সেজেছো, অথচ কেদেঁ-কেটে সব নষ্ট করে দিচ্ছো। এটা কি ঠিক পূর্ণ? আমাকে ধরো, আদর করো, দরকার পরলে দুই চারটা চড় মারো আমি আজ বাধা দিবো না। কসম, আমি একটুও রাগ করবো না। আমি তোমার সাথে যা করেছি সেটার জন্য অপমান, ধিক্কার, থাপ্পড় পাওয়ার যোগ্য। তুমিতো এসবের কিছুই করোনি। কেনো করোনি? এতো সহ্য করলে কিভাবে সামনে বাঁচবে পাগল? নিজেকে শক্ত করো। আমাকে মারো-ধরো-শেষ করো তবুও মুখ গুমরে বসে থেকো না।
পূর্ণতা কথা শুনে চুপ করে থাকলেও পেটের উপর থেকে পূর্বের শক্ত হাতজোড়া টেনে সরালো। পূর্ব অবাক হয়ে কিছু বলার জন্য আর শব্দ খুজেঁ পেলোনা। পূর্ণতা তখনও মুখ ঘুরিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে, পূর্বের দিকে তাকালো না। ওর দিকে কয়েক মূহুর্ত তাকিয়ে থেকে দুহাতে টিশার্ট খুলে পাশে শুয়ে পরলো। আজ এই প্রথম তার মেজাজ খারাপ হলো না, পূর্ণতার উপর রাগ উঠলো না, কড়া শব্দে চিল্লানোর জো হলো না। নিষ্প্রভ ভঙ্গিতে পূর্ব চোখের পাতা বুজে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো। হাত উল্টো করে মাথার নিচে হাতের তালু রেখে দিলো। ঠান্ডা বাতাস। সেই সাথে গা কাঁপিয়ে দেয়া হিম প্রহর চলছে। পূর্ণতা এতোক্ষন শীতটা টের না পেলেও আচমকা ওর শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছে। মুখ ফিরিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই পূর্ণতা আচঁলে ভেজা গাল মুছে নিলো। বারান্দার রেলিংয়ের ফাঁক গলে রাতের কয়েক টুকরো চন্দ্রকিরণ পূর্বের মুখে পরছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পূর্ব চোখ বন্ধ করে আছে। হঠাৎ মনের উপর অদ্ভুত বাসনা চেপে বসে পূর্ণতার। অনেকটা লোভীর মতো কিংবা কাঙালের মতো সে পূর্বের ঠোঁট ও চোখটা স্পর্শ করার জন্য উন্মুখ হয়ে যায়। ওই মুখটা ঘুমের আদালতে উপস্থিত হতেই কেমন নিষ্পাপ ছায়াতলে ডুবে যায়। যেনো দুনিয়ায় সে অনেক অপরাধ করে শেষে ক্ষমার জন্য মুখ অসহায় করেছে। পূর্ণতা এগিয়ে যায়। মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে পূর্বের একদম সন্নিকটে চলে যায়। দুহাতে পূর্বের মাথাটা বালিশ থেকে উঁচু করলে চট করে চোখ খুলে তাকায় পূর্ব। কিন্তু পূর্ণতার মধ্যে কোনো চমকানো ভাব দেখা গেলো না, সে পূর্বকে ছেড়েও দিলো না। ওইভাবেই পূর্বের চোখের উপর অধর ছেড়ে দিলো পূর্ণতা। টপটপ করে সিক্ত বর্ষনটা পূর্ব টের পাচ্ছিলো কপালে। পূর্ণতার ওর মৃত্যু সংবাদ শুনে ভয়ংকর ভাবেই চুপসে গেছে। একটু আগের যেই আবেগময় ভাবটা ছিলো সেটা ভয়ের কোঠায় ঢুকে গেছে। পূর্ব হাত উঠিয়ে পূর্ণতার ভেজা গাল স্পর্শ করলো। বৃদ্ধাঙ্গুলে চোখের নিচে অশ্রুপানির স্রোতটা বাধা দিলো। দুই নেত্রপল্লবে পরপর ঠোঁট ছুঁয়িয়ে লালচে অধরজোড়ায় নিজের ওষ্ঠদুটো মিলিয়ে দিলো। আকাঙ্ক্ষীত জিনিস পেলে মানুষের মন যেমন আপ্লুত হয়, পূর্বের ভেতরের ভয়টা পূর্ণতার ওষ্ঠস্পর্শে হঠাৎই যেনো গুটিয়ে গেলো। মন যেনো তীব্ররূপে জানান দিলো, পূর্ণতার জন্য হলেও জীবনের মূল্য দিতে হবে। পরের জন্য তগবগ জীবনটা বিলানোর আগে একজন অপেক্ষমাণ নারীর জন্য আকন্ঠ জীবিত থাকতেই হবে। যুদ্ধে যেহেতু নেমে গেছে, কাপুরুষতা দেখিয়ে নয় বরং বীরবেশে তাকে মোকাবেলায় অংশগ্রহন করতে হবে। জীবন তো যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। কালকের জন্য চিন্তা পুষে আজকের দিনটা কেনো ভুলে বসবে? জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত এখন ভীষণভাবে দামী। পূর্ব আনমনে নিজের উত্তেজিত মস্তিষ্কে এসব চিন্তা করতেই পূর্ণতার পিঠ আকড়ে তাকে বুকে চেপে ধরলো। অধরমিলন ছেড়ে দিয়ে পূর্ণতার কালো শাড়ির আচঁলটা তার হাতে পেঁচাতেই পূর্ণতার চোখের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো,
– আমি কখনো অন্যের ক্ষতি করিনি যে আল্লাহ্ আমার জীবনে কোনো অসহনীয় দুঃখ দিবেন। যদি দিয়েও থাকেন হয়তো সেগুলো আমার কোনো-না-কোনো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত থাকবে।
পূর্ণতা চুপ করে শুধু পূর্বের কথাগুলো শুনছিলো। কোনো সায় বা বাধা কিছুই দিচ্ছিলো না পূর্বের কথায় ও কাজে। পূর্ণতার কান থেকে টপের হুক খুলতেই পূর্ব বলতে লাগলো,
– পূর্ণ, তোমাকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ একা, নিঃস্ব, বিহ্বল। এটুকু বিশ্বাস করে আমাকে তোমার মাঝে আবদ্ধ করার অনুরোধ করছি। আমার বুকটা চিড়লে হয়তো দুঃখের সাথে কিছু সুখকর অনুভূতি দেখবে। সেটা তোমার জন্যই জম্মেছে এবং ওই জায়গাটার অধিকারিনী কেবল তুমি। তোমাকে ছাড়া আমি কারোর মধ্যে নিজেকে খুজেঁ পাবো না। হয়তো হারিয়ে যাবো নয়তো ভালোবাসতে পারার স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলবো। আমার এই কাঠিন্য স্বভাবের মাঝে তুমি যদি ভালোবাসা খুজেঁ পাও আমি এও বিশ্বাস করি একমাত্র তুমি আমার সর্বেসর্বার বিষয়গুলো বুঝবে।
কথা চলমান হলেও পূর্ণতার গলা থেকে চিকন হার, হাতের চুড়ি এবং সর্বশেষ শাড়ির সেফটিপিন খুলে নিলো। বাহুর মাঝে আবদ্ধ করতেই পূর্ব বলে লাগলো,
– তোমার পূর্ব তো সবার জন্য মজুত থাকতে চায় কিন্তু তোমার কাছেই সে নিজের বন্ধ দরজাটা খুলে দেয়। এভাবে যদি ভেঙ্গে পরো তাহলে তো আমি দরজাটা খুলতে সাহস পাবো না। ভয় পাবো। মনে হবে তুমি আমার ব্যাপারগুলো শুনে ভেঙ্গে পরবে, কষ্ট পাবে, দুশ্চিন্তায় ভুগবে। তুমি মাঝেমাঝে যেই রাগ দেখিয়ে রূপটা দেখাও না? আমি ওই মাঝেমাঝে ব্যাপারটা সবসময় দেখতে চাই। আমার জন্য তুমি এটুকু নিজেকে পরিবর্তন করো। আমি আমার ইচ্ছের ঝুলিকে এখানেই ইতি টানবো। আর কখনো তোমার কাছে কিছুই চাইবো না।
পূর্ণতা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে পূর্ব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তরের জন্য ভ্রুঁ নাচায়। খানিকটা সময় ওইভাবে উত্তরের আশায় থেকে পূর্ব যখন মুখ উদাস করবে অকল্পনীয় ভাবে পূর্ণতার ঠোঁটে তখন ভোরের আলোর মতো একটুকরো হাসি খেলে যায়। পূর্বের গালে চুমু দিতেই পূর্ব বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বেহুঁশ হবার ভঙ্গিতে হাসি দিয়ে বললো,
– তুমি ছুঁয়ে হায়… আমার কি যে হয়ে যায়।
পূর্ণতা কপট রাগ দেখিয়ে পূর্বের মাথায় চাট্টি মারলে পূর্ব আগের স্টাইলে গম্ভীর ভঙ্গিতে রাগ দেখাতে গিয়ে আচমকা শব্দ করে হেসে দেয়। অজস্র হাসির মূহুর্তে পূর্ণতাকে দুহাতে জাপটে ধরে ভালোবাসার এক বর্ণিল প্রহরে ডুবে যায়। যেখানে শুধু ক্ষণিকের সুখ দিয়ে স্মৃতির ডায়েরি আবদ্ধ হয়। পূর্বের ভাষায়, পূর্বদিগন্তে গভীর আবেশীভূষায় লিপ্ত হয় প্রিয়তমা পূর্ণতা।
.
দিনগুলো বড় অদ্ভুত ভাবে কাটতে লাগলো। হুরহুর করে সময়ের পাল্লা দ্রুততার সাথে চলে যেতে লাগলো। মানুষের সুখের মূহুর্ত যতো স্বল্প হয়, দুঃখের মূহুর্ত ততো দীর্ঘ হয়। পূর্ব জানতো না তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভয়াবহ দিনগুলো দরজায় এসে কড়া নাড়ছে। অনুমানও করতে পারেনি কতোটা বীভৎস চিত্র তার জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানোর জন্য অপেক্ষায় আছে। একদিকে পূর্ণতাকে আবারও কাছে পেয়ে আগের মতো আচরণ করতে শুরু করে পূর্ব। আয়েশা, পলাশের সাথে যোগাযোগটাও দৃঢ় হয়ে উঠে ওর।পার্টির প্রতিটা কাজ শেষে পূর্ণতা-সহ মা-বাবাকেও সময় দিতে শুরু করে। এদিকে পূর্ণতার জন্য সবকিছু মেলবন্ধন হয়ে যায় দুই পরিবারের মধ্যে। খোদেজা ও কবির মাঝে মাঝে সবাইকে দেখতে আসেন ওয়াসিফ ভিলায়। সবসময়ের মতো নির্বাচনের প্রচারণার জন্য পূর্ব বাইরে থাকলেও খোদেজা যেনো শান্তি পান। এখনো তিনি পূর্বের কিছু ব্যাপার সহজ ভঙ্গিতে মানতে পারেন না। তবে চেষ্টা করছেন পূর্বকে মনেপ্রাণে মেনে নেওয়ার।
আয়মান তার চাকরিজীবনে যথেষ্ট ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ভার্সিটির রেজাল্ট পাবলিশ হবার পরে এব্রডের জন্য ভালো ভালো অফারও পেয়েছে। কিন্তু এখনো ওই অফারে বেশ সময় আছে তাই দেশে থেকেই পূর্ব প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। আফিয়া তার ছেলের সিদ্ধান্ত শুনে কপাল কুঁচকে মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন। ঠিকমতো কথাবার্তা তিনি আয়মানের সাথে বলেন না। আয়মানও বিষয়টা কয়েকবার লক্ষ করলেও ওই ‘বিয়েশাদি’ ব্যাপারে মত দিতে রাজি না। শ্রেয়ার পর শূন্য জীবনটায় আর কাউকে স্থান দেয়ার মানে হয়না। সবাই ওই জায়গাটা পাওয়ার কাবিল না। আফিয়া এতোদিন আয়মানের পছন্দসই ব্যাপারটা জানতেন না কিন্তু মনেমনে ঠিকই একটু-আধটু বুঝে গিয়েছেন শ্রেয়ার মৃত্যুর পর তার ছেলে কিজন্যে বদলে গেছে। এই বদলে যাওয়ার কারণটা জানতে গিয়ে তিনিও রীতিমতো অবাক এবং বাকরুদ্ধ হয়েছেন। শ্রেয়া যেই নীতিহীন কাজটা করেছিলো সেটা পূর্ব,পূর্ণতা ও আয়মান দারুণভাবে ধামাচাপা দিয়েছিলো। কিন্তু সত্য কখনো গোপন থাকেনা। তাই পূর্ণতাকে কসম দিয়ে জিজ্ঞেস করতেই পূর্ণতা সবকিছু আফিয়াকে খুলে বলতে বাধ্য হয়। শেষে আফিয়াকে বলার ঘটনাটা পূর্ব ও আয়মানের কাছেও বলে দেয় পূর্ণতা। পূর্ব ঠান্ডা মাথায় রাখলেও আয়মান যেনো চেতে গিয়েছিলো। কেনো মায়ের কসম মেনে সত্যটা বলতে গেলো এ নিয়ে আয়মান কঠিন কিছু বলতে গিয়েও কড়া ভাষায় তেমন কিছু বলতে পারেনি। এরপর থেকেই হন্য হয়ে ছেলের জন্য মেয়ে খুজতে লেগে পরেন আফিয়া। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন বাসার গেটে একটা মেয়ে এসে দাড়ায়। আফিয়া অপরিচিত মেয়েটাকে চিনতে না পেরে কিছু জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা নাম জানায় সাবিহা এবং সে আয়মানের কিছু টাকা পরিশোধ করতেই অনেক দূর থেকে এখানে এসেছে। সাথে অনুযোগ করে এটাও বললো, ঠিকানাটা পেতে একটু ভোগান্তিতে ফেসেছে। আফিয়া সাবিহার আপাদমস্তক সবকিছু দেখার আগেই সাবিহার গ্রামের ঠিকানা ও বাবা-মায়ের নাম্বার নিয়ে নেয়। সাবিহার কাছে খটকা লাগলেও সে মুখে কিছু স্পষ্ট করে বলতে পারলোনা। কিন্তু চমক হিসেবে এটাই হলো সাবিহার বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ পাঠায় আফিয়া। সাবিহা আশ্চর্য হয়ে খুশি হলেও আয়মানের একমুখো স্বভাবের কথা চিন্তা করে সাথেসাথে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু গরীব বাবা-মা শিকদার পরিবারের স্ট্যান্ডার্ড দেখে সাবিহার মতের চিন্তা না করেই রাজি জানিয়ে দেয়। সাবিহার চিন্তা যেনো বাড়তে থাকে সময়ের সাথে। আয়মানের মতো এমন একটা মানুষ যার সাথে ওই ছিনতাইকারীর ইন্সিডেন্স ছাড়া আর কোনো যোগসূত্র নেই সেই মানুষ সত্যি কি মা-কে দিয়ে সম্বন্ধ পাঠিয়েছে? নাকি সবই ধাপ্পা?
সাবিহা আমরিন সহজাত গ্রাম্য পরিবার থেকে উঠে আসলেও তার আচার-আচরণ যথেষ্ট মার্জিত এবং সুন্দর। যার চুলে তেল ছাড়া বাড়তি প্রসাধনী মাখার সার্মথ্য নেই তাকে আল্লাহ্ দিয়েছেন ঝলমলে সমান চুলের বাহার। মুখে কৃত্রিম জিনিস মাখাটা ছোট থেকে সুযোগ না হওয়াতে বড় হয়েও অরুচি ধরেছে ওসবে। সামান্য লিপস্টিক জাতীয় জিনিসটাও শহরে এসে দিচ্ছে। এমন একটা গেঁয়ো মেয়েকে আফিয়া কিভাবে আয়মানের জন্য পছন্দ করলো? প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তরগুলো সবই অজানা। কিন্তু এদিকে আয়মানকে প্রচণ্ড বাধ্য করতে থাকেন আফিয়া। বিয়ে যদি করে সাবিহাকেই করবে এবং মেয়েটা দেখতেও সুন্দরী। আয়মান বুঝেই পায়না মা কিভাবে সাবিহার খোঁজ পেলো। অবশ্য আয়মান সকলের অগোচরে একটা সুক্ষ সত্য লুকিয়ে রেখেছিলো। সাবিহা দেখতে সুন্দরী হলেও ওর একটা বিশেষ দিক শ্রেয়ার সাথে মিলে। শ্রেয়া যখন চুল ছাড়তো ঠিক সাবিহার চুলের মতো ঝলমলানি দিয়ে উঠতো। ফাজলামির বশে শ্রেয়ার রেশমতুল্য চুল যখন টান মারতো আঙ্গুলের ফাঁক গলে সব চুল চলে যেতো। হয়তো আফিয়া সবদিক বিবেচনা করে সাবিহাকেই যোগ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু আয়মান কি করবে তা নিয়ে এখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
.
ভোর পাঁচটা থেকে তীব্র উত্তেজনায় উত্থাল-পাত্থাল হয়েছে ঢাকা শহর। বিভিন্ন চ্যানেলের সাংবাদিকরা মাইক হাতে ক্যামেরাম্যান নিয়ে লাইভ টেলিকাস্ট করছে টিভির পর্দায়। ভোটকেন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কার্য নির্বাহী কর্মকর্তা এবং টহল পুলিশ ঢুকেছে। সেই সাথে দুই দলের এজেন্সীও ভেতরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। হৈচৈ রাজপথ একটু পরপর তুমুল মিছিলের স্লোগান দেয়। পূর্ব ভোর চারটার দিকে আযানের আগেই পান্ঞ্জাবী গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। চিন্তার জন্য পুরো রাতটা ওর নির্ঘুমে কেটেছে। পূর্বের চিন্তিত মুখের এমন করুণ অবস্থা আগে কখনো দেখেনি পূর্ণতা। কোনোভাবেই পূর্বের চিন্তা কমাতে সক্ষম হয়নি ও। গতরাত থেকে মোমিন গুম হয়ে আছে। শত চেষ্টা করেও কোনো খোঁজ মেলেনি। আজ ভোটের দিন বলে পূর্ব মোমিনের খোঁজে নিজে যুক্ত হতে না পারলেও কৈলেশদের লাগিয়ে দিলো। ঘড়ির ঘন্টা ঢংঢং করে আটটার কাটায় পৌঁছলো। পূর্ব ভোটকেন্দ্রের ভেতরকার অবস্থা সম্বন্ধে খবর নিয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক এবং কারচুপির অবস্থা নেই কোনোস্থানে। ইবরাহিম খানের দল বেশ উদগ্রীব হয়ে আছে। মনোভাব এমন যেনো তিনিই বিজয়ী হবেন। সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে বেশিকিছু বক্তৃতাও দিয়ে ফেলেছেন। পূর্বকে ঘিরে যেই সাংবাদিকের জটলা ছিলো সেটা ছাড়াতে কিছু মানুষের প্রয়োজন পরে গিয়েছিলো। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর ঝড়ের বেগে ঠিকঠাক মতো দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে সে। টেনশনে মাথাব্যথাটা আবার না উঠলেও চলে। ড্রাইভার হিসেবে বর্তমানে সবুজ গাড়িতে বসে আছে। পূর্বের অশান্ত চোখদুটো তারও দৃষ্টি এড়ানি। অনেকবার চিন্তা করেছে পূর্বকে সান্ত্বনা দিয়ে সাহস জুগাবে কিন্তু পরক্ষনে পূর্বের মেজাজের অবস্থা চিন্তা করতেই চুপটি মেরে যায়। আর মাত্র পয়ত্রিশ মিনিট। এরপরই ভোটগ্রহণ শুরু হবে। ওয়াসিফ ভিলায় পূর্ণতা নাওয়া-খাওয়া সব যেনো বন্ধ। সে নিশ্চিত পূর্ব অতিমাত্রায় টেনশন করছে এবং না খেয়ে বসে আছে। পূর্বকে কল করেও লাভ হয়নি। পূর্ব কল রিসিভ না করলেও মেসেজে জানিয়ে দিয়েছে, ‘I’m busy in election area’. এরমানে পূর্ব ব্যস্ততার অজুহাতে কিছুই খাবেনা। আয়েশা ভোরে সকালে উঠে নামাজটা পরে বাদামী রঙের তসবী নিয়ে সোফায় বসেছেন। টিভির সামনে বসে মাথা-সহ পুরো শরীরটাই হিজাব ঢেকে রেখেছেন। ছেলের দীর্ঘ সংগ্রামের ফল আজ পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রথমে তিনি রাজনীতির ব্যাপারে নারাজ থাকলেও ছেলের অদম্য ইচ্ছাটা নাকোচও করতে পারেননি। পলাশ ওয়াসিফ ঘুমের ঔষুধে নিদ্রামগ্ন। বাড়ির প্রতিটি চাকর যেনো চুম্বকের মতো টিভির পর্দায় চোখ লাগিয়ে রেখেছে। কাজের ফাঁকফোকরে হুটহাট এসে পর্দায় বুলিয়ে যায়।
অপেক্ষাকৃত সময় সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা নাগাদ একটানা ভোটগ্রহণ কার্যসূচী পালিত হলো। পূর্ব পুরোটা সময় দলের সঙ্গে থাকলেও মাঝে মাঝে সাংবাদিকের প্রশ্নের জালে ফেঁসে যাচ্ছিলো। নিজের উদ্বিগ্ন চেহারা, চিন্তাপ্রবণ মন দুটোই সকলের আড়ালে রেখে কাঠিন্য মুখ বজায় রেখেছিলো। ভোটের প্রক্রিয়া শেষ হতেই গণনাকার্য শুরু হলো। দলের কিছু অন্যান্য নেতাসহ সাইফুল খন্দকার, মাসুদ আলমগীর, ইমতিয়াজ উদ্দিনও আজ উপস্থিত ছিলো। তাদের একপ্রকার জোরাজুরিতে পূর্ব দুপুরের খাবারটা খেতে একটু স্পেস পেলো। কিন্তু গলা দিয়ে এক বোতল ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ছাড়া কিছুই নামলো না। সবুজের তোষামোদে টংয়ের দোকানে বসে এক কাপ চাও খেলো পূর্ব। কিন্তু টংওয়ালা টাকা নিতেই চাইলো না। সাধারণ টংওয়ালা ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বললো,
– আপনেই জিতবেন দেইখেন। আমিও গিয়া ভোট দিয়া আইসি। আমার ছোডু পোলারেও ভোট দেওনের লিগা পাঠায়া দিছিলাম। চিন্তা কইরেন না বাজান।
পূর্ব সৌজন্য হাসিতে দিতে গিয়েও প্রশান্তমনে হেসে দিলো। চুপচাপ গাড়ির দিকে আবারও যাত্রা ধরলো। আকাশের দিকে একপলকের জন্য চোখ রাখলো পূর্ব। নীলচে আকাশটা বিকেলের প্রহরে গোলাপী রঙে ছেয়ে গেছে। দেখতে ভারী সুন্দর লাগলেও মনের ভেতর কেমন কুমন্ত্রণা দিচ্ছে। পূর্ব চোখ বন্ধ করে বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছে আজ যা হবে সব ভালোর জন্যে হবে। আল্লাহ পাক এবং জনগণের উপর বিশ্বাস রাখলেই চলবে। কিন্তু চোখ খুললেই ভয়ে মনটা গুটিয়ে থাকে। অস্বস্তিকর মনটা শেষমেশ পিছু ফিরে সবুজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
– অস্থির লাগলে কি করা উচিত বলতো? কোনোভাবেই টেনশন মুক্ত থাকতে পারছিনা। তোদের ভাবীকে এখানে ডাকবো?
সবুজ পুরো ব্যাপারটা ধরতে পেরে পূর্বের দিকে নম্র কন্ঠে বললো,
– ভাই আপনি টেনশন করেন কেন? আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি আপনি জিতবেন। আর ভাবীরে ডাকলে বোধহয় ভালো হয়। সিকিউরিটির টেনশন আপনি নিয়েন না। আমি গাড়ির কয়েক সীমানা পযর্ন্ত লোক লাগিয়ে দিতেছি।
পূর্ব তাতে সায় দিলো। আজ মন কোনোভাবে মঙ্গলকর ব্যাপারে সায় দিচ্ছেনা। পূর্ণতার সঙ্গটা পেলে হয়তো মনের উপর থেকে চিন্তার ছাপটা নেমে যাবে। সবুজ নিজেই গেলো পূর্ণতাকে আনতে। পূর্বের নির্দেশমতো কালো বোরখায় কবিরের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। কেউ যাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করুক ওয়াসিফ পূর্বের স্ত্রী এখানে এসেছে। সচরাচর চোখ দুটো বের করে নিকাব করলেও আজ সেই চোখদুটোও কালো রঙের পাতলা কাপড়ে ঢাকা। কবিরের গাড়ি থেকে নেমে পূর্ব আশেপাশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে একপ্রকার সবার চোখে ধূলো মেরে কবিরের গাড়িতে উঠলো। পূর্ণতার পাশে বসতেই পূর্ব গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিলো। পূর্ণতার দিকে ফিরে তাকাতেই পূর্ণতা চোখের উপর পাতলা কাপড়টা সরিয়ে বললো,
– তোমার কি টেনশনে আবার মাথাব্যথা হচ্ছে?
পূর্ব এসির সুইচে টিপ দিতেই পূর্ণতার জন্য বললো,
– না।
পূর্ণতার দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বসলো পূর্ব। পূর্ণতার মুখ থেকে নিকাবটা উঠিয়ে ওর দুইগাল ধরলো। প্রচণ্ড অস্থির এবং বিহ্বল কন্ঠে বললো,
– আমার মন যে কেমন করছে। কেমন যে কু ডাকছে আমি বুঝতে পারছিনা। আচ্ছা আমি যদি না জিতি তুমি কি অভিমান করে চলে যাবে? এই রাজনীতির জন্যই তো হাসপাতালে তোমাকে একা ফেলে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি সেদিন রাজনীতিটা চুজ করলেও আমার মনটা তোমার জন্যই পরে থাকতো। পূর্ণ, তুমি কি কোনো কারনে আমাকে ছেড়ে যাবে?
পূর্ণতা অবাকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হুট করে পূর্বের গাল থেকে পূর্বের হাত নামিয়ে চেপে ধরলো। আশ্চর্য কন্ঠে বললো,
– আমি কেনো তোমায় ছাড়তে যাবো? তোমার কি হয়েছে? আমার কাছে এই ইলেকশনের কোনো মানে নেই। আমার জন্য তুমি আগে। কেনো ভয় করছো?
পূর্ব ঢোক গিলে তীব্র উৎকন্ঠায় কিছুই বলতে পারলো না। মাথা নিচু করে দুইবার জোরে শ্বাস ছেড়ে পূর্ণতাকে জানালায় পিঠ লাগিয়ে হেলান দিতে বললো। পূর্ণতা অবুঝের মতো জানালার পিঠ লাগিয়ে হেলান দিলে পূর্বের ওর গলার মাঝে নিচে মুখ ডুবিয়ে গা ছেড়ে দেয়। পূর্ণতা একের পর এক ঝটকা খেয়ে অবাক হওয়াও যেনো ভুলে গেছে। পূর্ব আগে কখনো এমন কান্ড করেনি। পূর্ণতা আর নিজেকে শান্ত অবস্থায় রাখতে পারলো না। ভয়টা সংক্রামকের মতো ওকেও ঘিরে ধরলো। পূর্বের মাথায়, গালে, পিঠে বারবার হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললো। এই ভয়টা নির্বাচনকে ঘিরে হলেও মূখ্য যেনো পূর্ণতা ছিলো। আজ পূর্বের অবস্থা বড্ড আশ্চর্যজনক। এই রূপটা চোখের সামনে কোনোভাবেই মানতে চাইছেনা। পূর্ব চোখ বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে পূর্ণতার মাঝে এমনভাবে গুটিয়ে গেছে যেনো পূর্ণতার ছায়াতলে গা ঢাকা দিচ্ছে। বোরখার উপর পিঠের জায়গায় আঙ্গুল ক্রমান্বয়ে ডেবে যাচ্ছে পূর্বের। পূর্ণতাকে লতাপাতার মতো আকড়ে ধরার তীব্র ইচ্ছা যেনো জেগেছে। আজকের মতো এমন উদ্ভট আচরণ কখনো করেনি পূর্ব। কেনো কু ডাকছে পূর্বের মন?
– ‘ চলবে ‘
#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬০.
#ফাবিয়াহ্_মমো
( অংশ ০২.)
শহরের উপর এখন হিম হাওয়া চলছে। সেই হাওয়ায় গা যেনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। শীতটা জাকিয়ে না এলেও আগমনের বার্তা বুঝিয়ে দিচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর ঢাকাশহর সহসা থমকে গেছে যেনো। এখন কোনো হৈচে, শোরগোল, মাতামাতি হচ্ছেনা। মানুষের মধ্যে আর কোনো অস্থিরতা কাজ করছেনা। সব কেমন নিস্তেজ, নিসাড়, নিস্ক্রিয় হয়ে গেছে। রাত এখন এগারোটা বিশ বাজে। পূর্ণতার চোখ ছাপিয়ে বড় বড় ফোঁটায় অশ্রু পরছে। পূর্ব পাশে নেই ওর। সে এখন ভোটকেন্দ্রের ওখানে। সকল ভিড় যেনো পূর্বকে ঘিরে, রাস্তায় যতো মিডিয়ার লোক ছিলো সবাই এখন ওর ব্রিফ নিচ্ছে। পূর্ণতা সোফায় বসে টিভির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।আয়েশা একটু পরপর হিজাবের প্রান্তভাগে চোখ মুছছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী ইবরাহিম খান মুখ কালো করে এককোণায় দলবল নিয়ে বসে আছে। একটু আগে ঘোষণা হয়েছে ডানপন্থী দলের ওয়াসিফ পূর্ব বিপুল ভোটের ব্যবধানে এমপি পদে বিজয়ীর আসনটা দখল করেছে। এবারের নির্বাচনে জনগণের স্বর্তঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিলো মাইলফলক স্পর্শের মতো! তিনভাগের দুইভাগই পূর্বের ব্যালেটে জয় হিসেবে পাল্লা ভারি করেছে। অপরদিকে ইবরাহিম খান একভাগ ভোট পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু ভেতরে ভেতরে সুকৌশলে তিনি ঘুষ দিয়ে ভোটের ব্যবস্থা করেছেন। খবরটা গোপন হলেও কোনো শক্ত প্রমাণ না থাকায় আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেনি পুলিশ। উত্তপ্ত জনতা পূর্বের মুখ থেকে বিজয়ের উল্লাস শুনতে উদগ্রীব হয়ে আছে। সবার মধ্যে নিশ্চুপ অবস্থা বিরাজ করছে। লাইট, ক্যামেরা ও মাইকের পেচানো তারের জন্য পূর্বের সামনে হুলস্থুল অবস্থা হলেও পূর্ব তার কাঠিন্য ভাব বজায় রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠে,
– আসসালামুয়ালাইকুম,
চুপ করে থাকা জনতার মধ্য থেকে হঠাৎ চিল্লিয়ে জবাব এলো ‘ওলাইকুমসসালাম’। পূর্ব উত্তর শুনে মাথা নিচু করে হেসে ফেললো। পরক্ষনে মাথা উঠিয়ে উপস্থিত সকলের দিকে ডান থেকে বামে চোখ বুলিয়ে বলিষ্ঠ কন্ঠে বললো,
– আপনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আজকের এই বিজয় আপনাদের জন্যই সম্ভব হয়েছে এবং আপনাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমাকে অতিমাত্রায় সিক্ত করেছে। আমি আপনাদের মতোই একজন ঢাকাবাসী, একজন সাধারণ মানুষ, একজন নাগরিক। দেশ ও মানুষের সেবা করাটা আমার মূল ধর্ম এবং কর্ম। এখানে যতোপ্রকার সমস্যা আছে আমাকে আপনাদের একজন ভাই হিসেবে বিবেচনা করে বলবেন। কোনো নেতা বা এমপি হিসেবে না। আমি রাজনীতিতে শুধু আপনাদের জন্যই এসেছি, জনগণের জন্য অবশ্যই আমি নিয়োজিত। কিন্তু সরকার অনুমোদিত একটা পলিটিক্যাল পাওয়ার আমার দরকার ছিলো। একটা সরকারি সাপোর্ট আমার প্রয়োজন ছিলো। আজ সেই ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নটা আপনারা আজ বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলেছেন। আমাকে বড় কিছু না ভেবে নিজেদের কাছের মানুষ ভাবুন। মন খুলে আমার কাছে সব সমস্যা নিয়ে আসুন। আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা চালাবো। আমার স্বপ্ন ছিলো সমাজের জন্য কিছু করা, সেটার একমাত্র বাস্তবায়ন সম্ভব হবে আপনাদের সহযোগিতা দ্বারা। মনে রাখবেন, আমরা এমন একটি দেশের নাগরিক যারা প্রয়োজনে হিংস্র বাঘের মতো আচরণ করতে পারি, তাই নিজেদের সাহস ও উদ্দীপনা এমন হওয়া উচিত আমরা অন্যায় মানবো না, আমরা দূর্নীতি সহ্য করবো না। অন্যায় সর্বপ্রথম আমাদের বাসাবাড়িতে হয়, আপনাদের কাছে অনুরোধ রইলো এই ‘অন্যায়’ শব্দটিকে একদম মুছে দিন। একদম ভুলে যান। নিজেরা ভালো থাকুন, পরিবারকে ভালো রাখুন, বাকিটা আপনাদের দেখাদেখি সমাজ শিখে নিবে। আল্লাহ্ হাফেজ।
মিডিয়ার মানুষদের মধ্যে একপ্রকার যুদ্ধ শুরু হলো প্রশ্নাত্মক আচরণ নিয়ে। পূর্ব সেটা আপাতত স্থগিত রেখে সব ডিসমিস করতে চাইছে। পূর্বের ফোনে একের পর এক কল আসছে দলের বিভিন্ন নেতাদের কাছ থেকে। সবাই একইসুরে ‘অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা’ বার্তা জানাচ্ছে। সবশেষে ডানপন্থী দলের সরকার তথা মূখ্যমন্ত্রী থেকে ‘অভিনন্দন’ পেলো পূর্ব। টিভির প্রতিটি চ্যানেল এখন মুখরোচক শব্দ দ্বারা লাইভ টেলিকাস্টে সংবাদ পাঠ করছে। পূর্ণতা লাখ লাখ শুকরিয়া জ্ঞাপন করে শাড়ির আচঁলে চোখ ও গাল মুছে নিলো। আয়েশার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো আয়েশা মোনাজাতের ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়িয়ে চোখ বন্ধ অবস্থায় কিছু বলছেন। আকাশী রঙের হিজাব দিয়ে হাটু অবধি ঢাকা আয়েশার। সোফায় পা গুটিয়ে বসে এতোক্ষন ছেলের বক্তৃতা শুনে এখন যেনো শোকর গুজার করছেন তিনি। চোখের নিচে কালি জমার কারনে উনার ফর্সা মুখটা প্রচুর ক্লান্ত দেখায়। বয়সের ভারে হাতের চামড়া বেশ কুঁচকে আছে যেনো। আয়েশা দুহাতের তালুতে মুখ মাসেহ করে মোনাজাত শেষ করতেই পূর্ণতার দিকে তাকালেন। পূর্ণতা নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। বড় বড় নেত্রজোড়া অশ্রুর কারনে মায়াবী লাগছে। পুরো মুখটাই যেনো কান্নার কারনে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। আয়েশা হাত এগিয়ে পূর্ণতার গাল স্পর্শ করে বললেন,
– জিতে গেছে তো। আর কেঁদো না। চলে আসলে খেতে দিও। আজ সারাদিন কিছু খায়নি তো, এলে দুধ গরম করে খেতে দিও। শরীরে শক্ত আসবে। আমি তাহলে তোমার শ্বশুর আব্বার কাছে যাই মা। ও বেশি দেরি করলে তুমি আর জেগে থেকোনা। ঘুমিয়ে পরো।
আয়েশা কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে পূর্ণতার চোখদুটো আবার মুছে দিলেন। পূর্ণতা এতোক্ষন চুপ করে থাকলেও শ্বাশুরির স্নেহ আদরে যেনো সৎবিৎ ফিরে পায়। আয়েশা ততক্ষণে তার রুমের দিকে চলে গেছে। পূর্ণতা গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাইটটা নিভিয়ে দিয়ে রুমে যেয়ে দখিন দিকের জানালাটা খুলে দিলো। দুম করে এক পশলা ঠান্ডা বাতাস পূর্ণতার শরীরে হিম জড়িয়ে দিলো। পূর্বের সেই ভীত চেহারা নিয়ে প্রচুর টেনশন হচ্ছে পূর্ণতার। যার মধ্যে রাশভারী অবস্থা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না সেই ব্যক্তি আজ কিভাবে অতো শঙ্কিত মুখ করেছিলো? শুধুই কি নির্বাচনের চিন্তায়? মনে হয়না। পূর্বের এই ভীত চেহারা ওর স্বকীয় চেতনার সাথে বড্ড বেমানান। কেনো জানি মনেহচ্ছে পূর্ব শুধু একারনে ভয় পেয়েছিলো সে হয়তো পূর্ণতার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। কেননা, পূর্বের কিছু হলে পূর্ণতার দেখভাল এবং নিরাপত্তা দেয়ার মতো মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। খোদেজা ও কবির যতোই মেয়েকে আগলে রাখুক, পলিটিক্যাল ম্যাটার হলে কেউ কখনো ছাড় পায়না। পূর্ণতা এখনো শান্ত হতে পারেনি, পূর্ব যে দিনদিন নিজের শক্ত খোলস ছাড়িয়ে ভীত খোলসে গা ঢাকা দিচ্ছে, এটা পূর্বের জন্য খুবই ভয়াবহ ব্যাপার। চিন্তার দুনিয়ায় নানা বিচিত্র ভাবনার আনাগোনা হতেই দরজায় খটমট শব্দ হলো। পূর্ণতা সাথেসাথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো পূর্ব ক্লান্ত দেহ নিয়ে পান্ঞ্জাবীর বোতাম খুলতেই ভেতরে ঢুকছে। দুজনের চোখাচোখি হতেই পূর্ব একপেশে হাসি দিয়ে পূর্ণতার কাছে এসে দাড়ালো। পূর্ণতার নেত্রগোলকে দৃষ্টি স্থির রেখে বললো,
– তাড়াতাড়ি মিষ্টিমুখ করার জন্য চলে এলাম। ওখানে যেই ভিড়! নিশ্বাস আটকে আসে একদম। তুমি কি রাগ করে আছো? রাগ করো না প্লিজ। তুমি আর দশ মিনিট ওখানে থাকলে নির্ঘাত ধরা খেতে। আমি রিস্ক নিয়ে সত্যিই ভুল করেছি জানো। কেন যে তোমাকে আসতে বলেছিলাম ভেবেই পাইনা।
পূর্ব নিজের মতো করে কথাগুলো বলতে থাকলে পূর্ণতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শুধু। চোখের পলক ফেলা ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো কাজ করেনা সে। টেনশন নিয়ে মানুষ জীবিত থাকে ঠিকই কিন্তু পূর্বের মতো মানুষ কিভাবে নিজেকে শান্ত রেখে হাসিমুখে কথা বলছে ভাবা যায়না। এই মানুষটার এক ছটাক টেনশনও পূর্ণতা দূর করতে পারেনা। যদি সে পারতো? একটু যদি টেনশন থেকে বিরতি দিতে পারতো? পূর্ণতা উদাস হয়ে যায়। এদিকে পূর্ব যা কিছু বলছে সবই নির্বাচন এড়িয়ায় যা যা হয়েছে ওসব নিয়ে। হঠাৎ পূর্ণতা ওর কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে একটা অভাবনীয় কাজ করে বসলো। পূর্বের দুইগাল চেপে মাথা নিচু করে কাঙ্ক্ষিত মিষ্টিমুখ হিসেবে ওষ্ঠযুগল মিলিয়ে দিলো। পূর্ব তখন হাতের ঘড়িটা সদ্য খুলছিলো এমন কান্ড দেখে আশ্চর্য হয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। বাম কবজি থেকে ব্যালেন্স বিগড়ে ঘড়িটা ফ্লোরে পরে গেলো। পূর্ণতার এমন চান্ঞ্চল্যকর অবস্থার জন্য বহুদিনের ব্যবহার করা পছন্দসই ঘড়িটা বোধহয় ভাঙ্গলো এবার। পূর্বের সকল চিন্তা যদি নিজের ভেতরে টেনে আনা যেতো তাহলে পূর্ণতা নিজেকে উপযুক্ত মনে করতো পূর্বের জন্য। কিন্তু সে কিছুই করতে পারেনা। অক্ষম লাগে নিজেকে তখন। কিছুক্ষণ পর পূর্ণতা চোখ খুলে নিরবে পূর্বের ক্লান্তিকর চেহারায় অজস্র ঠোঁট এঁকে দিলো। চোখের পাতায় এখনো সেই ভয় জড়ানো মুখটার কথা মনে পরছে ওর। সেটা তীব্র ভাবে মনে পরলে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে যেনো। পূর্ব শান্ত দৃষ্টিতে সব কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করতেই নরম গলায় বললো,
– আমি খুব টেনশন দিয়ে ফেলেছি না?
পূর্বের উত্তরে পূর্ণতা ওর দিকে একপলক তাকিয়ে আর কোনো জবাব দিলো না। ঠোঁটের উপর পরপর ক’বার চুমু দিয়ে পূর্বের বুকে মাথা রেখে জাপটে ধরলো। পূর্ব ওর অবস্থা দেখে নিজের ঘামার্ত দেহ থেকে পূর্ণতাকে সরানোর স্পর্ধা পেলো না। জড়িয়ে ধরতেও দ্বিধাপূর্ণে ফেসেছে পূর্ব। এই ঘামযুক্ত শরীর যেখানে নিজের কাছেই অস্বস্তিকর সেখানে পূর্ণতা কিভাবে জড়িয়ে ধরে শান্তি অনুভব করে, পূর্ব হিসাব মিলাতে পারেনা।
.
আয়মান টিভির সামনে বসে রিমোট ঠোঁটে চেপে চুপচাপ খবর দেখছিলো। পূর্ব নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এই খবর শুনে খুশি হতে পারছেনা। একটু আগে আফিয়া জানিয়ে গিয়েছেন এ সপ্তাহের মধ্যে সাবিহাকে শিকদার বাড়ির বউ হিসেবে ঘরে তুলবে। প্রচণ্ড রাগে তীব্র ক্ষোভে রাতের খাবারও খায়নি আয়মান। আয়মানের বাবা আনোয়ার শিকদার পরিস্কার শব্দে জানিয়ে দিয়েছেন এ বাড়িতে উত্তরাধিকার চাই এবং সেটার জন্য আফিয়া যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাই যেনো অটলাবস্থায় থাকে। আয়মানের ইচ্ছে করছে ঘরের সব জিনিস তামা তামা করে ভেঙ্গে ফেলতে! যে বাড়িতে নিজের মতের কোনো মূল্য নেই, সেখানে তার থাকা চলেনা। আয়মান দোতলায় উঠে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। রাত এখন যতোই হোক ওই সাবিহার বাচ্চাকে একচোট গালিগালাজ করতে ইচ্ছে করছে ওর! কোন্ সাহসে বিয়ের পিড়িতে বসার জন্য মত দিতে গেলো? কতো বড় বুকের পাঁঠা আয়মানও খবর নিয়ে ছাড়বে! স্টাডি টেবিলের উপর থেকে আফিয়ার রেখে যাওয়া একটা কাগজ নিলো সে। সেখানে সাবিহা নাম্বার এবং অন্যান্য তথ্য লিখা আছে। আয়মান একমূহূর্ত দেরি না করে পটাপট কল করলো সাবিহাকে। গ্রামের বাড়িতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পরে সাবিহা। আজও ব্যতিক্রম হয়নি শুতে কিন্তু এমন উদ্ভট টাইমে কল পেয়ে তড়াক করে ফোন হাতে নিলো। ঘুমুঘুমু চোখ কচলাতেই দেখতে পেলো ‘আয়মান’ নাম দিয়ে সদ্য সেভ করা নাম্বার থেকে কল এসেছে। সাবিহা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আয়মান বাজখাই গলায় একনিশ্বাসে বলে উঠলো,
– তোর মতো হারামি আমি আজ পযর্ন্ত দেখিনাই! তোর এতো শখ ক্যামনে জাগলো হ্যাঁ? আমারে বিয়ে করার পিতলা শখ ক্যামনে জাগলো আমারে ভালোমতো খুইলা বল! তোর কি লজ্জা নাই? শরম নাই? বদ কিসিমের মাইয়া কোথাকার! সামনে পাইলে ঠাডায়া এক থাবড়া মাইরা তোর ব্রেন উল্টায়া দিতাম! তুই আমার সামনে কালকের মধ্যে আসবি! শুনছোস তুই? তুই আমার সামনে আমার অফিসের বাইরে কালকের মধ্যে উপস্থিত হবি!
সাবিহা চোয়াল ঝুলিয়ে আশ্চর্য হয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে ঠিকমতো স্ক্রিনে ভালোমতো দেখলো। আয়মান নাম দিয়ে সে কোনো ভুলভাল নাম্বার সেভ করেনি কিন্তু এ কোন্ আয়মান? আয়মান তো মুখ খারাপ করে কখনো শ্রুতিকটু শব্দে কথা বলেনা। সাবিহা ভয় ভয় কন্ঠে অনেকটা সঙ্কোচের সুরে বললো,
– আয়মান ভাইয়া, আমি কি করেছি সেটা তো বুঝলাম না। আপনি বেহুদা আমাকে বকছেন কেন? সমস্যা কি?
আয়মান প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
– থাবড়ায়া শালী তোর চান্দি ঘুরায়া দিমু! তুই আমার মায়ের কাছে বিয়ের জন্য রাজি বলতে গেছোস কেন? কি দেখে রাজি বলছোস তুই? টাকা দেখে? তোর কত টাকা দরকার আমার কাছে এক্ষুনি বল! তবুও তুই কাল সকালের মধ্যে ফোন দিয়ে বলবি তুই বিয়েতে রাজি না।
সাবিহা জোর গলায় ভয়াবহ কিছু বলতে পারছেনা। এমনেই গভীর রাতের মতো পিনপতন অবস্থা তার উপর জোরে চিল্লিয়ে কিছু বললে ওপাশের রুম থেকে সবাই শুনতে পাবে। সাবিহা তটস্থ কন্ঠে বললো,
– আপনি আমাকে কোন্ কারনে তুই তুকারি করছেন? দেখুন আপনি যদি ভদ্রভাষায় কথা না বলেন আমি আপনার মাকে সব কথা বলে দিবো।
– তোর তুইতোকারির মায়রে বাপ! তুই বিয়েতে না করবি এটাই ফাইনাল। আর যদি তেড়িবেড়ি করছোস তোর ওই নেত্রকোণার টুনটুনি মার্কা এলাকায় আমি পেট্রলবোমা ফালামু! আমারে তুই চিনোস না, যদি চিনতি তাইলে বিয়ের জন্য রাজি হতি না। এখন তোরে আমার ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝায়া দিলাম, যদি এরপরেও তুই রাজিফাজি হইছিস তোর কপালে শনি-সোম-মঙ্গল ক্যামনে ঘুরাই দেখিস!
বিশ্রী, অকথ্য, অশালীন কথাবার্তা বলে ফোন কেটে দিলো আয়মান। আজ বহুদিন পর নিজের মুখ খারাপ হলো। এইভাবে গালিগালাজ ওর শোভা না পেলেও সাবিহার কাছ থেকে নিস্তার পাওয়াটা জরুরী। সাবিহা কয়েক মিনিট স্রমতব্ধ হয়ে বসেছিলো। কপালে হাত রেখে ঘুণে খাওয়ার জানালাটা খুলে বাইরে চোখ রাখলো। এই মানুষটার ভাষা এতো বিশ্রী, অসভ্য সেটা কে জানতো? মাথাটা এখনো ভনভন করে ঘুরছে। কানের ভেতর ওই বস্তিওয়ালা শব্দগুলো ঘুরছে। সিক্স প্যাক বডিওয়ালা মানুষটার কথাগুলো এখনো বাঁজের মতো ঠেকছে।
অফিসের ব্যস্ততায় সাবিহার উপর আর ধমকানি চালাতে পারলোনা আয়মান। মেয়েটা একদম ‘উড়ে এসে জুড়ে বসছে’। পূর্ণতাকে সাবিহার ব্যাপারে বলার পর খুশিতে গদগদ হয়ে গেছে ও। এদিকে কাউকেই বুঝাতে পারছেনা সে তার শূণ্য জীবনে আর কোনো মেয়েকে জায়গা দিতে ইচ্ছুক না। এসময় পূর্ব ওকে সব সমস্যার সমাধান যেনো এক তুড়িতেই করে দিলো। জীবনের সেই পবিত্র ফুল যদি সাবিহার মতো শুভ্র মেয়ে হয়ে থাকে এক্ষত্রে বিয়ে করাটাই ঠিক। আয়মান তাও যেনো মানতে নারাজ। কিন্তু পূর্বের বিচক্ষনসম্পন্ন কথাবার্তা শুনে আয়মান স্থির করলো অন্তত মায়ের দিকে তাকিয়ে ওর বিয়েটা করা উচিত। সন্তান উৎপাদন এসব পরের ব্যাপার। আয়মান যেই পযর্ন্ত নিজেকে সাবিহার সাথে মানাতে না পারবে সেই পযর্ন্ত সে ওসবের কাছেও ভিড়বেনা। দরকার পরলে বিয়ের পর আলাদা থাকতেও প্রস্তুত সে।
সাংসদ সদস্য হিসেবে ৩৫০ টি আসনের মধ্যে একটি আসন দখল করলো পূর্ব। বাকি ৫০টি আসন মহিলাদের জন্য বরাদ্দ। পাঁচ বৎসর মেয়াদ হিসেবে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বসার সুযোগ পেলো ঠিকই কিন্তু এখনো কিছু আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম বাকি। জাতীয় সংসদে শপথ গ্রহণ কার্যটা শেষ হতেই পূর্ব নিয়মিতভাবে সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে পারবে। তবে একনাগাড়ে ৯০দিন অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ হারাতে পারে। আবার মৃত্যু, পদত্যাগ এবং অভিশংসন কারনে একজন সংসদ সদস্য তার স্বীয় পদটিও হারাতে পারে। বিভিন্ন কার্যনীতি সম্বন্ধে জেনে পূর্ব শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষায় আছে। এর মধ্যে আয়মানের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। শিকদার বংশের একমাত্র বউ হিসেবে সাবিহা আসতে চলেছে। যদিও বিয়েটা ঘরোয়াভাবে সাদামাটা তরিকায় হবে। আয়মান ঢাকঢোল পিটিয়ে গান বাজনা দিয়ে বাড়িতে বউ তুলার একদম বিপক্ষে। কোনোরকমে তিন কবুল ও কাগজে সই দিয়ে শিকদার পরিবার এনে দিয়ে খালাস হতে ইচ্ছুক। এরপর সে বিদেশে চলে যাবে এবং ভুলেও সে দেশের ফেরার মতো নাম উচ্চারণ আর করবেনা। সেদিন আয়মানের ওই রূঢ় আচরণ দ্বারা সাবিহা কষ্ট পেয়ে আফিয়ার কাছে ভাসা ভাসা উত্তরে বিয়েতে রাজি না জানিয়ে দেয়। এদিকে সাবিহার বাবা-মা মেয়ের ওমন ঔদ্ধত্য দেখে পারেন না তখনই চড় মেরে গাল লাল করে দেন। আফিয়া আড়ালে নিয়ে সাবিহাকে ঠিক করে জিজ্ঞেস করলে সাবিহা কেদেঁ দিয়ে ওইরাতের জঘন্য কথাগুলো বলে দেয়। আফিয়া থম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকলে শেষে সাবিহার কাছে হাতজোর করে ক্ষমা চান। ছেলের অতীতে যতোপ্রকার ঘটনা ছিলো এবং শ্রেয়ার যেই নীতিনষ্ট কাহিনী ছিলো সব খুলে বলেন। সাবিহা চোখের পানি মুছে অবাক হয়ে যায়। শ্রেয়া নামটা ক্যাম্পাসে থাকাকালীন অনেকের মুখেই শুনেছে কিন্তু আয়মানের ভেতরে এক দগ্ধময় অতীত যে শ্রেয়াকে ঘিরে রয়েছে সেটা ও জানতো না। আফিয়া আকুলিবিকুল করে আয়মানকে আগের মতো হাসিখুশি জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য। তার ছেলের জীবন থেকে সকল সুখ ও অনুভূতি শ্রেয়ার লাশের সাথে মাটির নিচে ডেবে গেছে। আফিয়া তার অশ্রুসিক্ত কন্ঠে সাবিহার হাতদুটো ধরে বলেন,
– আমি তোমার কাছে ভীষণ অপরাধী সাবিহা। তুমি আমার ছেলেটাকে আগের মতো ফিরিয়ে আনো। তার জীবনে আমি আর কিচ্ছু চাইনা। শ্রেয়া যেদিন যারা গেলো রুমের দরজা আটকে প্রচুর কেদেঁছে। আমি মা হয়েও বুঝতে পারিনি আমার ছেলেটা কেনো ওভাবে চিৎকার করে কেদেঁছে। আমি নিজের ব্যর্থতা মানতে পারিনা মা। আমার আয়মান তো কারোর ক্ষতি করেনি। ওকে আমি নিজের পেটে রেখেছি। এতো আদর যত্ন করে বড় করেছি কিন্তু ছেলে বলেই হয়তো শ্রেয়ার ঘটনাটা আমি আদৌ ধরতে পারিনি। একটা দুঃখ কি জানো? ছেলে বড় হলে আর বুকে টেনে ঘুম পাড়ানো যায়না। ঠোঁটে চুমু খাওয়া যায় না। একটা মায়ের কত সীমাবদ্ধতা থাকে তুমি একদিন বুঝবে সাবিহা। আমার ছেলেটা আর আগের মতো হাসিখুশি চন্ঞ্চল নেই। রাতের বেলা রুমে গেলে রুমের দরজায় নক করে যাওয়া লাগে। আর ছোট থাকতে আমি কোলে কোলে নিয়ে ঘুরতাম। সেই সন্তান আমার আজ এতো বড় হয়ে গেলো, নিজের সব দুঃখকষ্ট বুকের মধ্যেই লুকিয়ে রাখলো। তোমার পাদুটো ধরতেও রাজি আছি, তবুও তুমি এই বিয়েতে না করো না। তোমার মধ্যে আমি শ্রেয়ার বৈশিষ্ট্য দেখেছি। ওর মতো কিছু সুলভ আচরণ দেখেছি। আমার ছেলেকে তুমি বিয়ে করে নিজের মতো গড়ে দাও। ওর ভেতরে কিচ্ছু নেই। একদম খালি। আমার অনুরোধটুকু রাখো মা।
কাউকে কাঁদতে দেখে যারা নিজেরাই হাউমাউ করে কেদেঁ দেয় ওরকম নরম মনের মানুষ হয়তো দুনিয়ায় খুবই কম। সাবিহা কখন যে মনের অজান্তে গাল ভিজিয়ে অশ্রু ফেলছিলো ওর খেয়াল নেই। আফিয়ার কথা শুনে সে তার কঠোর মনকে কান্না থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আফিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে সাবিহা উঠে গেলো। দরজার কাছে যেতে যেতে ওড়নায় চোখদুটো ভালোমতো মুছে নিলো। এরপর মাথা ঘুরিয়ে সহজাত হাসিতে বললো,
– আন্টি আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আছি।
আফিয়া বিছানায় বসা অবস্থায় আরেকবার কান্নার বিষাদে আক্রান্ত হলেন। আয়মানকে স্বাভাবিক করার নিরবযুদ্ধে সাবিহার অংশগ্রহণ দেখে তিনি বিগলিত হয়ে গেলেন। তাড়াহুড়ো করেই সব আয়োজন সাজিয়ে আন্টি পড়িয়ে এলেন সাবিহাকে। আয়মান যখন মতের বিরুদ্ধে সব আচরণ মেনে নিচ্ছিলো তখন আফিয়া যেনো সাহস পেলেন এবার তার ছেলে আগের মতো ফিরবেই। এদিকে ওয়াসিফ ভিলায় পলাশের অবস্থা কিছুটা উন্নতির আলো দেখেছে। প্যারালাইসিস হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় কিছুটা নিস্তার হিসেবে এখন মুখ দিয়ে ঠিকরে ঠিকরে কথা বলতে পারেন। তার ব্যবসাটা পূর্ব খুব ভালোভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন এ খবরও পলাশ ওয়াসিফ পেয়ে খুশি হয়েছেন। একমাত্র তিনি ছেলের ভরসার উপর নিজের ভরসা ছেড়ে স্বস্তির নিশ্বাস নিচ্ছেন। পূর্ব ভোটের দিন থেকেই দুশ্চিন্তায় ভুগছে। মোমিন কিছুদিন লাপাত্তা থাকলেও হুট করে কোত্থেকে যেনো আবার উদয় হয়েছে। মোমিন এতোদিন কোথায় ছিলো তা জিজ্ঞেস করলে বলে,
– ‘ ভাই দেশের বাড়িতে আম্মার কঠিন অসুখ আছিলো, এই কারনে ওইহানে এতোদিন ছিলাম। ‘
পূর্ব ব্যাপারটা খটকা হিসেবে নিয়েছে। যেটুকু তথ্য সে জেনেছে তাতে এটাই ছিলো মোমিন তার গ্রামে যায়নি এবং ওখানকার ত্রিসীমানার কোনো জায়গায় স্থান নেয়নি। কিন্তু মোমিনের বিশ্বস্ততার উপর সন্দেহ করাটা অহেতুক হবে এবং ও শুনলে প্রচণ্ড কষ্ট পাবে দেখে পূর্ব বিষয়টা অতো গুরুত্ব হিসেবে দেখেনি। হয়তো প্রেমবিভ্রাটে ফেসেছে মোমিন, তাই সম্ভবত বলে-কয়ে যায়নি। এখনকার যা যুগ!
.
সকাল থেকে হৈচৈ করে শিকদার বাড়িতে বিয়ের আয়োজন সাজানো হয়েছে। আফিয়া কোনো আত্মীয়স্বজন কাউকেই খবর দেয়ার সাহস পাননি। আয়মান সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে, যদি একটা আত্মীয় বিয়েতে উপস্থিত হয় তাহলে সে চুপচাপ নিরুদ্দেশ হবে। আফিয়া তাই শুনে আর কোনো বিপদ টানতে চাননি। পূর্ব, পূর্ণতা, খোদেজা, কবির, শ্রেয়ার মা শায়লা ও বাবা শফিক, শ্রেয়ার ছোট বোনকে আমন্ত্রণ করেছেন। রাজিবের পরিবার গ্রামে ঘুরতে গিয়েছেন বিধায় তারা অনুষ্ঠানে আসতে পারেননি। পূর্ব দুহাতে আয়মানের বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য সব কাজ চটপট করে দিচ্ছে। কাজি, উকিল, শপিং, খাবার, অন্যান্য যতোপ্রকার কাজ আছে সব তাড়া দেখিয়ে সেরে দিচ্ছে। বহুদিন পর পূর্বকে আবারও কাজের মধ্যে তৎপর দেখে মুগ্ধ হলেন খোদেজা। যদিও এখন শীতকাল চলছে তবুও পূর্বের কপাল যেনো ভিজেই থাকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পূর্ণতার দিকে খেয়াল রাখা যেনো পূর্ব ভুলেনা। এসব কিছুই পলকে পলকে লক্ষ করছেন খোদেজা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আয়মানের সামনে কাজি এসে বসলো। মেরুন রঙের শেরওয়ানি, গলায় সোনালী সুতার কাজ। মাথায় মেরুন রঙের পাগরী এবং পাগরীর বামদিকে ছোট্ট একটা পাথরের সোনালী দামী ব্রোন্ঞ্জ। সুক্ষ দাড়িগুলো আজ শেভড, চোখের দৃষ্টি নত হলেও প্রখর, মুখে হাসি নেই একফোঁটা, গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে আয়মান। তারই ডানপাশে কাধে একহাত রেখে বসে আছে পূর্ব। গায়ে কালো রঙের পান্ঞ্জাবী। দুহাতা কয়েক ভাঁজ করে কনুইয়ে গুটিয়ে রেখেছে। সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পড়ুয়া। চুলের স্টাইল আবারও ট্রিম কাট করে কানের দুপাশ থেকে চুল ছেটেছে। পূর্ণতা এই লুক দেখে একবার নিজের দিকে তাকায়, আরেকবার পূর্বের দিকে। এই লোক কি এখন সুন্দর হওয়ার ঔষুধ খাচ্ছে? বয়স তো আর কম হলো না। আল্লাহ্ দিলে মাশাআল্লাহ বত্রিশে পা ফেলেছে। তার মধ্যে এই অবস্থা দেখলে মানুষ আসল বয়স ৩২ কে উল্টে ২৩ বানাতেও দ্বিধা করবেনা। পূর্ণতা না পারতে হঠাৎ ওকে জিজ্ঞেস করে,
– আচ্ছা তুমি কি দিনদিন বুড়ো থেকে কচি হচ্ছো?
পূর্ব এই প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,
– নাউযুবিল্লাহ, ছিঃ! এগুলো কেমন ভাষা?
পূর্ণতা কোমরে দুইহাত রেখে ভ্রুঁকুটি বলে উত্তর দিলো,
– আমাদের মেয়েটা বেঁচে থাকলে তোমার এই অবস্থা দেখে উত্তর দিতে পারতাম। মনকে বোঝাতে পারতাম.. না, ওয়াসিফ পূর্ব মেয়ের জন্য নিজেকে সুন্দর বানাচ্ছে। কিন্তু তুমি কোন্ মন্ত্রীর মেয়েকে পটানোর জন্য এই লুক মারছো বলোতো?
পূর্ব ওর উদ্ভট ধরনের প্রশ্ন শুনে ক্ষুদ্ধ গলায় বললো,
– একেবারে কানে কপালে চড় লাগাবো! তোমার যদি প্রেম-প্রেম পায় কাছে আসো, আদর করে দেই। তবুও ওই নষ্টালজিক কথাবার্তা বলতে এসো না।
পূর্ণতা মুখ কোমর থেকে হাত সরিয়ে মুখ করে বললো,
– উহু, ঠিক লজিক দিলাম তো। বিয়ে হচ্ছে আমার বন্ধুর। আর সেজেগুজে নিজে বর হচ্ছো তা তো চলেনা বস্!
– কি লাগবে তোমার সাথে পরিস্কার বলো। আমাকে বুড়ো বানাতে কি করা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে?
– ফ্যাকাশে মার্কা সাদা পান্ঞ্জাবী ছেড়ে একটু স্টাইল করুন কমরেড সাহেব। এখনো তো ব্যাচেলারের মতো লাগে আপনাকে। দয়াকরে কালো রঙের পান্ঞ্জাবীটা পরে ফেলুন। আমি আসছি।
পূর্ণতার কথা শুনে খিলখিলিয়ে হেসে দেয় পূর্ব। শপিং ব্যাগটা হাতে নিতেই পূর্ণতা রেডি হয়ে চলে যায়। আয়মান এখন কাজির সামনে বসে চুটিয়ে ঘেমে যাচ্ছে। তিন কবুল বলার জায়গায় চার কবুল বলাতে সবাই হেসে দিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। এদিকে পূর্বের ফোনে লাগাতার নানা মানুষের কল আসছে। কিন্তু হুট করে কেনো হুলস্থুল কল আসছে পূর্ব বুঝতে পারছেনা। পূর্ব এমন অবস্থায় ফোনও রিসিভ করতে পারছেনা। কবির আড়চোখে ব্যাপারটা বুঝতে পারলে পূর্বকে তিনি বাইরে যেতে বলেন। পূর্ব দোতলার সিড়ি ধরে নিচে নামতেই কানে ফোন এঁটে যেই কথা বলবে ওমনেই বাইরে থেকে বিকট সাইরেন বাজানোর শব্দ এলো। প্রচণ্ড কৌতুহল হয়ে ভ্রুঁ কুঁচকাতেই ফোনের বিপরীতে যা বললো তা শুনে পূর্ব হতভম্ব! নূরানীর চিৎকার শোনা যাচ্ছে! সে চিৎকার দিয়ে ‘ পূর্ব ভাই, ও খালাম্মা, পূর্ণতা আপা ‘ বলে গলা ফাটাচ্ছে। পূর্ব একদৌড়ে নূরানীর কাছে যেতেই বাগানে গিয়ে গেটের বাইরে গাঢ় নীলের জীপ দেখতে পায়! নীল পোশাক পড়ুয়া পুলিশের আইজি হাতে লাঠি নিয়ে ফোর্স সহ এদিকে আসছে। নূরানী যেনো পূর্বাশঙ্কায় ভয় পেয়ে হাপিয়ে নিশ্বাস নিচ্ছে। পূর্ব জোর গলায় নূরানীকে বলে চলে যেতে। কিন্তু নূরানী ঠায় দাড়িয়ে থেকে অস্থিরচিত্তে ঢোক গিলতে থাকে। পূর্ব এবার ধমকে উঠে নূরানী উপর,
– নূর! তোকে আমি যেতে বলছি!
পূর্বের ওমন আওয়াজে শিউরে কেঁপে উঠে নূর। চোখভর্তি পানি টলটল করা শুরু করে দেয় ওর। এরপর একছুট দিয়ে সে বাগান পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে বাইরে চিৎকার করে বাইরে ডেকে আনে। পূর্ণতা পুলিশের খবর শুনেই শাড়ি ধরে দৌড় দিয়ে বাইরে এসেছে। এসেই দেখে পুলিশের সাথে ছোটখাট তর্কবিতর্ক চলছে পূর্বের। পিছু পিছু বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি চলে এসে দেখে ওই অবস্থা। আয়মান মাথার পাগরী খুলে পূর্ণতার হাতে দিয়ে পূর্বের কাছে চলে যায়। কবির, আনোয়ার দুজনই পুলিশের সাথে নানাপ্রকার কথা বলতে থাকে। পুলিশ কেমন যেনো একগুঁয়ে হয়ে ফোর্সকে এগুতে নির্দেশ দিচ্ছে। ধ্বক ধ্বক করে পূর্ণতার বুকের ভেতর বারি খাচ্ছে! বুকের উঠোনটা শুষ্ক হয়ে কামড়ে আসছে! হাত-পা শীতল হয়ে আসছে অজানা ভয়ে! চোখের দৃষ্টি ব্যকুল হয়ে পুলিশকে বুঝাতে থাকা পূর্বের উপর আটকে আছে। পূর্ব খুব করে যেনো পুলিশকে বুঝাচ্ছে কিন্তু পুলিশ কিছু শুনছেনা। পূর্ণতার মনে হচ্ছিলো ওরা পূর্বকে সুস্থ রাখবেনা। কোনো অঘটন ঘটানোর জন্যই তার এখানে এসেছে। মূহুর্ত্তের মধ্যে কয়েকটা মাইক্রোবাস এসে রাস্তায় ভিড় করে ফেললো। পূর্ব এতোক্ষন যতোটা অস্থির ছিলো মাইক্রোবাস দেখে তাড়াতাড়ি পিছু ফিরে সোজাসুজি পূর্ণতার দিকে তাকালো! নূরানী এক চিৎকার দিয়ে বললো,
– নূর ওকে ভেতরে নে! তাড়াতাড়ি ভেতরে নে!
পূর্ণতা থম মেরে তাকিয়ে থাকলেও চোখ থেকে নিশব্দে পানি পরছিলো। গেটের বাইরে পুলিশের গাড়ির আশেপাশে সাংবাদিকের মাইক্রোবাস ঘেরাও হয়েছিলো। পূর্ব আরো একবার এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পূর্ণতাকে সরানোর জন্য নূরানীকে আদেশ দিলো। নূরানী ছিটকে আসা কান্নায় কেদেঁ দিয়ে পূর্ণতার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো। পূর্ণতা অটলদৃষ্টিতে অশ্রুপূর্ণ চাহনিতে পূর্বের দিকে তাকিয়েছিলো। কালো পান্ঞ্জাবীর মানুষটাকে রূপালী রঙের দুটো হ্যান্ডেক্রাফ পরাচ্ছিলো। সে বারংবার অনুরোধ করছিলো নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে। খোদেজা, আফিয়া, সাবিহা দূর থেকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে ওইটুকু দৃশ্য দেখে। পূর্বকে পুলিশ কেনো গ্রেফতার করছে তিনি কোনোভাবেই আঁচ করার ক্ষমতা পেলেন না। পূর্বকে সবার সামনে দিয়ে পুলিশের গাড়ির দিকে নিয়ে গেলো। সাংবাদিকরা যেনো হন্য হয়ে ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। আয়মান মুখ ফিরিয়ে পূর্ণতার অবস্থা দেখার জন্য বাড়ির ভেতরে তাকালো কিন্তু ততক্ষণে নূরানী ওকে একদম ভেতরে নিয়ে গেছে। পূর্ণতার কথা চিন্তা করতেই আয়মানের মনটা ভেঙ্গেচুড়ে আসলো। নিজের বিয়ের দিনে পূর্ণতার জন্য এমন বীভৎস ঘটনা কেনো হলো? আয়মান ঠোঁট কামড়ে নিজের অশ্রুবিদ্ধ আবেগ সংযত করার চেষ্টা করলো। পূর্ব পুলিশের গাড়িতে উঠে বসতেই হঠাৎ আয়মানকে জোরে হাক দিলো। আয়মান তাড়াহুড়ো করে ভিড়টা খাবলে-খামচে সরিয়ে পূর্বের একদম কাছে যেতেই বুঝলো পূর্বের চোখ ভিজে আসছে। সেদিনের মতো হাসপাতালে থাকাকালীন ঘটনার মতো পূর্বের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে। আয়মান পূর্বের হ্যান্ডক্রাফ পড়ানো হাতটা চেপে ধরতেই পূর্ব ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,
– ওর খেয়াল রেখো আয়মান। তোমার বোনটাকে দেখে রেখো।
পূর্বের কথা শুনে ঠোঁট কামড়ে চোখ কুঁচকে ফেলে আয়মান। ওই মূহুর্তেই ও টের পায় পূর্বের হাতটা ধীরেধীরে আলগা হয়ে ছুটে যাচ্ছে। জড়তা ছেড়ে গাড়িটা চলতে শুরু করেছে অনিকেত উদ্দেশ্যের দিকে।
-‘ চলবে ‘
#FABIYAH_MOMO
( নোটবার্তা : রিচেক দেয়া সম্ভব হয়নি।)