তোকে ঘিরে পর্ব-৬১

0
711

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬১.
#ফাবিয়াহ্_মমো

প্রচণ্ড উত্তেজনায় রাজপথ সমাগম হলো! টিভির পর্দায় ফলাও করে দেখাতে থাকলো নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য ওয়াসিফ পূর্বকে অভিশংসন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশের ব্রিফ অনুযায়ী ওয়াসিফ পূর্বের নিজ বাসস্থান হতে লাইসেন্সবিহীন কিছু বিদেশী অস্ত্র, ওয়াকি-টকি, দামী ড্রাগস এবং ফেনসিডিলের বিভিন্ন ব্র‍্যান্ডের বোতল পাওয়া গেছে। এমন গর্হিত কাজের জন্য পুলিশ তৎক্ষণাৎ পূর্বকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ জানায়, ওয়াসিফ পূর্বের গাড়ি থেকে কোকেন পাওয়া গেছে, যেগুলো বিদেশ হতে আমদানিকৃত এবং গাড়ির ঠিক পেছনের সিটে গদির মধ্যে কোকেনের প্যাকেটগুলো লুকায়িত ছিলো। এমন খবরে প্রচুর সমালোচনার মুখে পরেছেন ডানপন্থী দলের নেতারা। তাদের দল থেকে কেউ এমন নীতি লঙ্ঘিত আচরণ করতে পারে তারা ভাবতে পারেন নি আদৌ, তবে পূর্বের ব্যাপারে ঘটনা যদি সত্যতা প্রমাণিত হয় তাহলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করা হবে তাকে। আইনের ভয়াবহতা থেকে বাদ দেওয়া হবেনা পূর্বকে। একদিকে গোটা ঢাকা শহর যেমন চান্ঞ্চল্যকর খবর পেয়ে উত্তপ্ত হয়েছে তেমনি অপরদিকে সাংবাদিকের নানা মুখরোচক খবরের কারনে পূর্বের আর্দশ ব্যক্তিত্বের মধ্যে জঘন্য ভাবে কালি লাগিয়ে দিচ্ছে। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম সোজাসুজি পূর্বকে ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে ঘোষণা দিতেও পিছপা হয়নি। মিথ্যা মামলায় ফেসে যাওয়া হতবিহ্বল পূর্ব নিজের বীভৎস অবস্থা বুঝতে পেরে শুধু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছিলো জেলের মধ্যে। তার মন ও মস্তিষ্ক শক্ত ভাবেই বিশ্বাস করে, সে কোনো ভুল করেনি। কাজেই সত্যের জয় হবেই। কিন্তু জেলের ভেতর থেকে কীভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবে সেটাই কোনোভাবে ভাবতে পারছিলো না। গাড়িতে কিভাবে ওই কোকেনের প্যাকেট পৌঁছালো সেই সমীকরণও মিলাতে পারছেনা পূর্ব।। নিতান্ত কাছের মানুষ ছাড়া সে নিজের গাড়ি কাউকে স্পর্শ করতে দেয়না, ওয়াসিফ ভিলা এবং নিজের রুমের ভেতর চাকর ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি ঢুকার সাহস পাবেনা। এমতাবস্থায় কে এমন দুঃসাহস দেখিয়ে ওই বস্তুগুলো রেখে এমন জঘন্যভাবে ফাসিয়ে দিলো বুঝতে পারছেনা পূর্ব।

পূর্বের গ্রেফতার হওয়ার দৃশ্যটা খুব পরিস্কার চোখেই দেখেছে পূর্ণতা। সবসময় যেই ব্যাপারটা নিয়ে পূর্ণতা ভয়ে তটস্থ থাকতো আজ যেনো অক্ষরে অক্ষরে দাগ কেটে সেটাই ঘটে গেলো। পূর্ণতার রুমবন্দি চিৎকার আয়েশা ও পলাশের কান এড়িয়ে যায়নি। কিন্তু পূর্ণতাকে সামলানোর মতো অবস্থা পূর্ব ছাড়া আর কারোর নেই।বিদেশ থেকে আসার জন্য সবকিছু রেডি করে ফেলেছে পূর্বিকা। কিছুদিনের মধ্যে সে নিজেই একা ফিরবে, স্বামীর কর্মজীবনের জন্য সে একা আসতে বাধ্য হচ্ছে। পরিবেশ এখন গরম! একদল পাব্লিক পূর্বের শোচনীয় অবস্থার জন্য বেশ ফায়দা লুফে নিচ্ছে, অপরদিকে সাধারণ জনতা বিক্ষোভে ফুসে ফুসে উঠছে! কিন্তু বস্তিবাসী-সহ কিছু আমজনতা তুমুল প্রতিবাদে ফেটে পরার হুমকি দিলে তা শেষপর্যন্ত বড় বড় নেতাদের বিভিন্ন কার্যালাপে পন্ড হয়ে যায়। সবার মধ্যে ভয় ঢুকে সব আন্দোলন, বিক্ষোভ একনিমিষে যেনো থমকে যায়।

আয়মান তার সদ্য বিবাহের জীবনে কোনোভাবেই খাপ খাওয়াতে পারছেনা। একদিকে তার বোন সমতুল্য বান্ধুবীর করুণ অবস্থা, আরেকদিকে নিজের মতের বিরুদ্ধে বিয়ের পিড়িতে বসা এ সবই যেনো বিষিয়ে তুলছে। আয়মান নিজেকে নানাভাবে বুঝিয়েও কোনোভাবে উপায় বের করতে পারছেনা। শ্রেয়ার স্মৃতি যেখানে ও এখনো ভুলতে পারেনি, সেখানে নতুন মানবী সাবিহার আগমন একপ্রকার অহেতুকই বটে। বাসর কক্ষে ঢুকতে যেয়ে থমকে যায় আয়মান। নিজের বিছানার উপর ঘোমটায় মুখ আবৃত করে বসে থাকা সাবিহাকে দেখে বড্ড অসহ্য লাগে ওর। মেজাজটা যেখানে শান্ত ছিলো সেটা হুট করেই অশান্ত আকারে চটে যায়। একপ্রকার হুঙ্কার দিয়ে সে সাবিহাকে বিছানা থেকে জোর করে নামায়। মাথা থেকে ঘোমটা পরে যেতেই সাবিহার নজরে আয়মানের রাগান্বিত চোখদুটো আটকায়। রাগে চোখদুটো শক্ত হয়ে আছে। ঠোঁট কুঁচকে মুখটা আরো ভয়ংকর লাগছে। আয়মানের হুটহাট চিল্লাচিল্লি শুনে দৌড়ে আফিয়া ও আনোয়ার বাধ্য হয়ে ছেলের রুমের বাইরে আসে। আসতেই তারা দেখতে পান আয়মান ধাক্কা দিয়ে সাবিহাকে রুম থেকে বের করে দিচ্ছে এবং আফিয়াকে হতভম্ব হয়ে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়মান রাগে তপ্ত গলায় বলে,

– ওকে আমার রুমে পাঠানোর মানে কি? বিয়ে করেছি বলেই সংসার করবো? অসম্ভব মা! আমি ওকে মেনে নিতে পারছিনা। ওকে কোথায় রাখবে রাখো। দয়াকরে আমার রুমে তুমি ভুলেও ওকে পাঠাবেনা।

কথাগুলো শেষ করতেই ধাম করে মুখের উপর দরজা আটকে দেয় আয়মান। আফিয়া ও আনোয়ার ছেলের এমন অকাজ দেখে ওখানেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। সাবিহা নিজেকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সংযত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছিলো। আয়মান বিয়ের রাতেই এমন সিনেমাটিক কাহিনী করবে সেটা আন্দাজেও ছিলো না ওর। অন্ততপক্ষে একরুমে থাকতে দিতো কিন্তু আলাদা বিছানায় ঘুমাতো ঠিক এমন কিছুই আয়মানের আচরণ থেকে আশা করেছিলো সাবিহা। কিন্তু ধারণাতীত খুবই জঘন্য আচরণ করলো আয়মান। আফিয়া মুখ তুলে বন্ধ দরজার দিকে স্থিরপানে তাকিয়ে থাকা সাবিহার দিকে তাকায়। আনোয়ার আফিয়াকে চোখ দিয়ে ইশারা করে রুমের দিক চলে যায়। আফিয়া এগিয়ে গিয়ে সাবিহার হাত ধরে সান্ত্বনা সূচকে নিজের পাশের রুমটায় নিয়ে যায়। আয়মানের কাছে থাকতে দেয়ার মানে নেই। আয়মান রাগের বশে কখনো যদি সাবিহার উপর হাত তুলে তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না আফিয়া। সাবিহাকে বিয়ের শাড়ি বদলে সাদামাটা পোশাক হিসেবে সাদা গোলাপীর সালোয়ার-কামিজ দিয়ে যায়। শিকদার ভিলা তিনতলা। বাড়িটা বেশ পুরোনো বলে চর্তুপাশে বড় বড় গাছের বাহার। বেশিরভাগই ফলের গাছ তবে দু-একটা নারিকেল গাছও আছে। বাড়ির সামনের দিকটা পুরোই সবুজ ঘাসে আবৃত এবং গেট থেকে বাড়ির সদর দরজা পযর্ন্ত যেটুকু পথ শুধু ওইটুকু রাস্তা মার্বেল পাথরে বাধাই করা। তিনতলায় আগে দাদা-দাদী থাকতো কিন্তু মারা যাওয়ার পর সেখানকার সব রুমই তালাবন্দী। দোতলায় আয়মান, আফিয়া ও আনোয়ার এবং একটি বাড়তি রুম অতিথির জন্য রাখা। রুমের দরজা আটকে হাতমুখ ধুয়ে মেকআপ তুলতেই আয়নার দিকে তাকায় সাবিহা। তার চকচকে লাবন্যময় ফর্সা গালে বুরুশের আঁকিবুকিতে রঙিন করা। চোখের উপর বিভিন্ন রঙের মিশেলে সুন্দর করে চোখের সজ্জা করা। ঠোঁটের উপর শুকনো হয়ে থাকা হালকা লাল লিপস্টিক দেয়া। আজ যে এতো সুন্দর করে সাজানো হলো সেটা আসলে কার জন্য ছিলো? মানুষকে দেখানোর জন্য নাকি আয়মান নামক স্বামীর জন্য? কি অদ্ভুত! কিছুদিন আগেও সে আয়মান নামক মানুষটাকে সহ্য করতে পারতো না। সেদিন রাতের ওই নিকৃষ্ট কথা শুনে ওকে স্বামী হিসেবে মানাটা বড্ড কষ্টদায়ক ছিলো। নিজের বাবা-মা যেখানে মেয়ের সিদ্ধান্ত কানে নিলো না, বিয়েতে গড়গড় করে রাজি হলো, সেখানে তার আর কি মূল্য থাকতে পারে? আপন পরিবারই যদি মেয়েকে বুঝতে না পারে তাহলে শ্বশুরবাড়ির মানুষ কি তাকে যেচে বুঝতে যাবে? চোখ ভরে পানি এলো সাবিহার। ছোট্ট নিশ্বাস ফেলতেই আচমকা ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বন্ধ চোখজোড়ার দুই কার্নিশ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পরলো। লাল খয়েরীর শাড়িটা বদলে শুয়ে পরতেই চিন্তা করলো এভাবে চুপচাপ সহ্য করার মানে হয়না। আয়মান যদি অপমান করতে থাকে তাহলে সেটা চিরকার করতেই থাকবে, ওর স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরা হবেনা। এক্ষেত্রে সাবিহার শক্ত ভূমিকা পালন করাই উচিত। আয়মানের সকল কথা ও কর্ম অগ্রাহ্য করে স্বামী হিসেবে সেবা করা এবং যতোদিন আয়মান নিজ থেকে ওর কাছে না আসবে সেই পযর্ন্ত সামনে অগ্রসর না হওয়া এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।

দিনগুলো খুবই বিভৎস ভাবে কাটতে লাগলো। ভয়াবহ আচরণ ও লোমহর্ষক কান্ড যা জেলের ভেতরে ঘটানো হচ্ছিলো সে সম্বন্ধে কেউ জানতো না। পূর্বের গ্রেফতার নিয়ে জটিল চক্রান্ত সম্পর্কে অনেকেই সত্য ধারণা জানতো কিন্তু বুকে যেনো মৃত্যুর ভয় গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে মিথ্যাকে আকড়ে রাখতে উদ্বুদ্ধ করছিলো। কেউ পূর্বের সত্যটা মজবুত করতে এগিয়ে আসার সাহস দেখালো না। নীল নকশাকারীরা আরো সাহস পেয়ে পূর্বের উপর জঘন্য আচরণ করতে লাগলো। ধীরে ধীরে মানুষের মনে পূর্বকে নিয়ে এমন একটা ধারণা ঢুকিয়ে দিলো যে, ওয়াসিফ পূর্ব এতোদিন জনগণের সাথে প্রতারণা করে তাদের মূল্যবান ভোট পাওয়ার জন্য সাহায্যের হাত বারিয়েছে। পূর্ব একটা মুখোশধারী মিথ্যাবাদী যে জনগণকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিজের আয়ত্তে এনেছে। ক্রমশ পরিস্থিতি আরো প্যাঁচ লাগতে শুরু হলো। মানুষের মধ্যে যে চাপা উত্তেজনা ছিলো তা আর কেউ বাইরে প্রকাশ করে প্রতিবাদ করার ক্ষমতা দেখালো না। কোনো উকিল পূর্বের কেস নিয়ে শক্তভাবে লড়তে পারছিলো না। পূর্ণতা ভেতরে-ভেতরে বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও বাইরে থেকে শক্ত মানসিকতা নিয়ে পূর্বকে রেহাই করার নানা পন্থা খুজছিলো শুধু। এদিকে পূর্বের সাথে দেখাও করতে দিতো না পুলিশরা। পূর্ব ভেতরে কেমন আছে, বেঁচে আছে নাকি মেরে ফেলেছে এ নিয়ে কেউ মুখ ফুটে টু শব্দ পযর্ন্ত করতো না।

হঠাৎ মধ্যরাতে তীব্র আর্তনাদে চিৎকার দিয়ে উঠলো পূর্ণতা। আয়েশার কানে স্বাভাবিক ঠেকলো না চিৎকারটা। পলাশ মুখ ঠেলে কোনোরকমে জড়িয়ে আসা কন্ঠে বললেন পূর্ণতার কাছে এক্ষুনি যেয়ে দেখতে। আয়েশা সেটাতে সায় দিয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে পূর্ণতার রুমের দিকে চলে যায়। বড় বড় পা ফেলে হাটার জন্য দুহাঁটুর গিটে মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণার উদ্ভব হলে তিনি পরোয়া না করে যতো দ্রুত সম্ভব পূর্ণতার কাছে গেলেন। দরজা খুলে দেখেন পূর্ণতা পেট খামচে ফ্লোরে বসে ব্যথায় গোঙাচ্ছে। আয়েশা ওই দৃশ্য দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে পূর্ণতার কাছে গেলেন। মাথায় অস্থির ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে দিতেই অনবরত জিজ্ঞেস করছেন পেটে কি হয়েছে। পূর্ণতা ঠোঁট খুলে কিছু বলার অবকাশও পাচ্ছেনা, ওমনেই দাঁত ঠোঁট কামড়ে খিচুনি মেরে ককিয়ে উঠছে। চোখ উপচে ঝরঝর করে পানি পরছে। আয়েশা হতবাক হয়ে যায়। কি করবে বুঝতে না পেরে তাড়াতাড়ি উনি ডাক্তার ডাকায়। ততক্ষণে চাকরদের সাহায্য নিয়ে পূর্ণতাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়েছে কিন্তু পূর্ণতার পেট খামচে আর্তনাদের সুর কমেনি। আয়েশা নানা প্রকার দোয়া পরে পূর্ণতার মুখে ফু দিচ্ছেন, আসন্ন বিপদ যেনো আল্লাহ্ পাক কাটিয়ে দেন। আয়েশা পূর্ণতার মাথাটা কোলে নিতেই খেয়াল করেন উনার চোখ ভিজে উঠছে। পূর্ব ওখানে জেলে ধুকে ধুকে মরছে, এদিকে মেয়েটা অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে ফেসে ভীষণ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আয়েশা জোরে হাক দিয়ে ডাক্তারের আগমন নিয়ে তাগাদা দেয়। এই মধ্যরাতে কোনো গাইনী বা মহিলা ডাক্তার আসতে পারবেন না জানিয়ে দিয়েছেন। এদিকে পুরুষের প্রবেশ নিয়ে পূর্ব বহু আগেই ওয়াসিফ ভিলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছে। আয়েশা নিরুপায় হয়ে উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলে চাকরদের একজন বলে খোদেজার কথা। হঠাৎ যেনো ঘুটঘুটে অন্ধকার একটুকরো আলোর দেখা পেলেন আয়েশা। তাড়াতাড়ি খোদেজাকে সব বলতেই খোদেজা হাট-পাট সব ছেড়েছুড়ে ওয়াসিফ ভিলায় সে পরেন। পূর্ণতার রুমে এসে আয়েশার অশ্রু ভারাক্রান্ত মুখ দেখে তিনি দুধাপ ভয়ে কুকড়ে যান, মেয়ের দিকে আর তাকানোর সাহস পান না। আয়েশা সব চাকরকে রুমের বাইরে পাঠিয়ে দ্রুত দরজা চেপে পূর্ণতার মাথার কাছে বসেন। এদিকে খোদেজা চোখ বন্ধ করে ‘বিসমিল্লাহ্’ বলে মেয়ের অবস্থা পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। মনেমনে বুকের ভেতর একটাই সুর যেনো দুই মাতৃকুলের মধ্যে চলছিলো, পূর্ণতার যেনো কিছু না হোক খোদা, মেয়েটা কোনো জটিল রোগে না ফাসুক। খোদেজা বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে সবকিছু নিবিড়ভাবে অবলোকন করছেন, আয়েশা একহাতে পূর্ণতার মাথা বুলিয়ে অন্যহাতের আঙ্গুলে নানা আমল জপছেন। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় রুমের মধ্যে শুধু পূর্ণতার গোঙানো সুরের ‘ মা, মাগো ‘ বলে আর্তনাদ বাজছিলো। সময় যেনো আরো কিছুক্ষন নিরবতা পালন করে খোদেজার ব্যাগ থেকে দুটো ইনজেকশন বের হয়ে পূর্ণতার শরীরে ঢুকলো। ধীরেধীরে কুঁচকানো চোখদুটো স্বাভাবিক হয়ে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলো। আয়েশার অস্থিরতা একটু যেনো হাফ ছাড়লো। পূর্ণতার মাথায় বুলিয়ে দেয়া হাতটা ধীরেসুস্থে ওর ভেজা গালটা মুছে দিলো। খোদেজা তার সাদা এপ্রণের হাতায় চোখ ডলে আয়েশার দিকে একটা ঢোক গিলে বললেন,

– চিন্তা করবেন না বেয়াইন। উঠে আসুন। ও ঘুমাক। আপনিও এখন ঘুমিয়ে নিন। রাত কম হয়নি।

আয়েশা পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে খোদেজার উদ্দেশ্যে ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
– আমার ঘুম হয়না গো। ঘুম সেই কবেই পালিয়ে গেছে। আজকের রাতটা ওর কাছে থাকবো। আপনার বেয়াই মশাইর কাছে চাকর পাঠিয়ে দিবো।

আয়েশার কথা শুনে খোদেজা কিছুক্ষন মৌনব্রত পালন করলেন। এরপর জোরে নিশ্বাস ছেড়ে মলিন কন্ঠে বললেন,

– এমন বিপদের সময় বাড়িতে আবার নতুন অতিথি আসতে যাচ্ছে। আল্লাহ্ এ কি দিন দেখালো বুঝতে পারছিনা। আমার যেনো মরনও হয়না বেয়াইন!! আমি আমার মেয়ের এই অবস্থা দেখতে পারছিনা কোনোভাবে।

খোদেজার কন্ঠে কান্না মেশানো যে সুর ছিলো, তা যেনো আয়েশার হৃদয়ে এফোড়-ওফোড় করে টুকরো করে দিলো। ঝাপসা হয়ে আসলো উনার দুচোখ। তিনি অটল হয়ে বসে থাকতেই হঠাৎ হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে বললেন,

– আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত আপনার মেয়ে পাচ্ছে। যদি সঠিক সময়ে ছেলের মাথা থেকে রাজনীতির ভূত নামিয়ে ফেলতাম তাহলে আজ এ দিন দেখতে হতো না। সবই আমার দোষ। এই দোষটা কোনোদিন আমার কপাল থেকে যাবেনা।

খোদেজা মাথা নিচু করে টলমল চোখ আড়াল করলেন। তবুও নাক টেনে কান্না দমনের শব্দ আয়েশার কান এড়ালো না। আয়েশা গুমোট পরিস্থিতির ভেতর খোদেজাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– পূর্ণতা ওভাবে গোঙাচ্ছিলো কেন? পেটে কি গুরুতর সমস্যা আছে?

আয়েশা জোর নাক টেনে দুচোখে বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী চেপে বললেন,
– স্বাভাবিক ব্যথা ছিলো। চিন্তার কিছু নেই। মাঝেমাঝে গর্ভধারণের সময় শরীরের কিছু মাংসপেশী টান খায়। পেটের জরায়ু সন্তান ধারনের জন্য বেড়ে উঠলে ব্যথা করে। কারো ক্ষেত্রে একটু বেশি হয়, কারো ক্ষেত্রে কম। ওর আগের ঘটনার জন্য এবার একটু বেশি ব্যথা করেছিলো। এমনিতে ভয়ের কারণ নেই।

খোদেজা চোখ ছেড়ে গাল মুছে নোটপ্যাডে কিছু মেডিসিন লিখে দেন। আয়েশার সেটা হাতে নিয়ে চাকরদের মধ্য থেকে একজনকে ডিসপেন্সারীতে পাঠিয়ে দেন। খোদেজা কিছুসময় মেয়ের পাশে কাটিয়ে চলে যান। সকাল নয়টার দিকে পূর্ণতার ঘুম ভাঙলে পূর্ণতাকে হাতমুখ ধুইয়ে গর্ভধারণের কথাটা জানিয়ে নাস্তা আনতে চলে যান আয়েশা। আবারও গর্ভবতী হওয়ার সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় পূর্ণতা। নিজের আবেগ ও অনুভূতির উপর কোনো হেলদোল থাকেনা। পেটে হাত দিতেও যেনো অবাক লাগছে। পূর্বের শেষ ইচ্ছা পুনরায় ফিরে এসেছে। কিন্তু যে মানুষটার সন্তান সে পেটে নিয়েছে ওই মানুষটা কি আদৌ সংবাদটা শোনার অবস্থায় আছে? পুলিশ তো কিছুই জানায়নি পূর্ব কেমন আছে। আচমকা পূর্ণতার মাথায় পূর্বকে দেখার জন্য তীব্র ইচ্ছা চাপলো। যে করেই হোক সে পূর্বের সাথে দেখা করবে, তাকে সংবাদটা জানাবে, তার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য উদগ্রীব বোধ হচ্ছে! পূর্ণতা তাড়াহুড়ো করে চিন্তা করতেই আয়মানের কথা মনে পরলো। আয়মানকে ফোন দিয়ে ওয়াসিফ ভিলায় এই মূহুর্তে আসার অনুরোধ করলে আয়মান অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত পূর্ণতার কাছে যায়। পূর্ণতা তখন বহুকষ্টে অরুচি মুখে নাস্তা সেরেছে ওমনেই আয়মানের আগমন। আয়মানকে নিয়ে আয়েশার সামনেই পূর্বের ব্যাপারে গম্ভীর আলোচনায় বসলো! ঘটনার শুরু থেকে সব পয়েন্ট সিকুয়েন্স করতেই বুঝতে পারলো এখানে তদন্তের জন্য একজন বিশেষ ব্যক্তি দরকার। আয়মানের সংযোগ কাজে লাগিয়ে পূর্ণতা আরো একবার তাশরিফ সাগ্রতকে ডাকায়। সাগ্রত তখন গোয়েন্দা ডিপার্টমেন্টের আদেশে অন্য জায়গায় কেস হ্যান্ডেল করছিলো, কিন্তু পূর্ণতার কাছ থেকে বিশদ ঘটনা শুনে ওই কেস অন্যজনকে হ্যান্ডওভার করে জানালো সে শীঘ্রই আসছে।

.

টিভিতে সংবাদ মাধ্যম জানালো ওয়াসিফ পূর্বের জন্য আবারও রিমান্ড মন্ঞ্জুর করেছে আদালত। টানা পাঁচদিনের রিমান্ড পেয়েছে শুনে সাগ্রত এবার খটকা মনে সবকিছু নিজের মতো করে গোপনে তদন্ত শুরু করলো। এখানে কিছু তো কারসাজি আছে, কিছু তো চলছে যা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছেনা। একদিন সন্ধ্যায় হুট করে ওয়াসিফ ভিলার কড়া নেড়ে প্রবেশ করলো সাগ্রত।পূর্ণতাকে দেখে সাগ্রত যেনো তুমুল আকারে হোচট খেয়ে কপাল ভীষণ কুঁচকে ফেললো! পূর্ণতা ওই অবস্থা দেখে জিজ্ঞাসা না করে পারলো না, চট করেই প্রশ্ন ছুড়লো,

– ভাইয়া আপনি এভাবে থমকে গেলেন যে? সোফায় বসবেন না?

পূর্ণতার উত্তর শুনে সাগ্রত আরেকবার ওর দিকে আপাদমস্তক চোখ বুলাতেই ধীরেসুস্থে সোফায় আসন নিলো। পূর্ণতা চায়ের ব্যবস্থা করতে বলে সাগ্রতের দিকে তাকাতেই সাগ্রত কৌতুহল গলায় বললো,

– তুমি প্রেগনেন্ট হয়েও এই অবস্থা কেন করেছো? তোমার হাসবেন্ড যদি এই অবস্থা দেখে কি পরিমাণ কষ্ট পাবে আন্দাজ আছে?

পূর্ণতা অনেকক্ষন পর যেনো সাগ্রতের প্রশ্নাত্মক অবস্থার কারন ধরতে পারলো। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,

– আপনি এতো সহজে বুঝে গেলেন?

সাগ্রতের সামনে ততক্ষণে এক কাপ চা এসে গেছে, সঙ্গে বহুপদের খাবার সাজানো। সে চায়ের কাপ তুলে ঠোঁটের কাছে আনতেই চকিতে উত্তর দিলো,

– বাহ্ চমৎকার! আমি আবার বুঝবো না? আমি নিজেই একজন মেয়ের বাবা। কিন্তু তোমার যা অবস্থা দেখছি তোমার হাসবেন্ড সেটা দেখলে খুব কষ্ট পাবে। এমনেই জেলে উনার অবস্থা নাজুক।

শেষ কথাটা শুনে শাড়ির আচঁলে হাত চেপে এলো পূর্ণতার। থরথর করে মৃদ্যু ভঙ্গিতে ঠোঁট কেঁপে উঠলো। সাগ্রত জ্যাকেটের চেইন খুলে ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে টেবিলে রাখলো। পূর্ণতা নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই সাগ্রত উত্তরের ঝুলি খুলে বললো,

– পূর্বের গাড়ির ড্রাইভারটা কে ছিলো? মোমিন না? সে কি এখন বাড়িতে আছে?

পূর্ণতা মাথাটা ‘হ্যাঁ’ সূচকে নাড়িয়ে বললো,

– ও আছে। ডাকবো?

সাগ্রত কিছু অন্যমনষ্ক হয়ে নিরবতা পালন করে হঠাৎ চকিত ভঙ্গিতে বললো,

– কৈলেশ বা সবুজ ওরা এখন কোথায়? ওরা কি তোমার জন্য সিকিউরিটি দিচ্ছে?

পূর্ণতা সাগ্রতের কথাগুলো কিছুই বুঝতে পারছিলো না। কিন্তু ঘটনা যতো সহজ লাগছিলো পূর্ণতার সেটা তত জটিল
ভাবছিলো। পূর্ণতা নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,

– ওরা কোথায় আছে আমি জানিনা। শুধু পূর্ব যেদিন গ্রেফতার হলো ওইদিন আমাকে বলেছিলো পূর্ব নাকি আমার সবপ্রকার নিরাপত্তা দিতে ওদের লাগিয়ে রেখেছে। যেকোনো প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে ওদের জানাতে বলেছে। কিন্তু গ্রেফতারের দ্বিতীয়দিন থেকে ওরা কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। দেখাও দেয়নি।

সাগ্রত নিজের মনে যেনো অস্ফুট সুরে বলে উঠলো,

– আশ্চর্য এটা নিয়েই লাগছে। এটা নিয়েই কেসটা আরো জটিল লাগছে। কিছু একটা আছে…কিছু একটা..

নিজের সাথে প্রলাপ করতেই হঠাৎ পূর্ণতার দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করলো,
– ব্যাংক, ডেবিট কার্ড সব অফ না? এখানে আর্থিক অবস্থা কিভাবে চলছে?

পূর্ণতা শব্দ করে শ্বাস ছাড়তেই কিছুক্ষন চুপটি থেকে মাথা নিচু করে বললো,

– কিছু ক্যাশ টাকা সবার নামে আলাদা করে রেখেছিলো। সেটা আমি জানতাম না। গ্রেফতার হওয়ার পর সবুজ কয়েকটা খাম এনে দিয়ে গেছে। আব্বার চিকিৎসার জন্য যে টাকা দরকার ছিলো সেটা পযর্ন্ত ও বন্দোবস্ত করে গেছে। কিন্তু নিজের জন্য কিছুই রাখেনি। জেলের ভেতর কেমন হালে আল্লাহ্ পাক ভালো জানেন।

বিষাদের কন্ঠটা যেনো সাগ্রতকেও স্পর্শ করলো। এমন একটা মানুষ যে নিজের অবস্থা বিপন্ন করেছে ঠিকই, কিন্তু পরিবারের উপর কোনো বিপদের ছায়া আসতে দেয়নি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া সাগ্রত আর কিছুই করতে পারছিলো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মস্তিষ্কের ভেতর প্যাঁচগুলো ঠিকমতো গুছাতেই পূর্ণতা জিজ্ঞেস করলো,

– আপনি কি কাউকে ধরতে পেরেছেন? কে করেছে এই কাজ অনুমান আছে?

সাগ্রত গ্লাস নিয়ে দুই চুমুক পানি খেয়ে টেবিলে রাখতেই বললো,

– তিনটা ব্যক্তি সাসপেক্টেড। এক. কৈলেশ, দুই. সবুজ, তিন. মোমিন। বাকিটা আমি বের করছি।

সাগ্রত উঠার জন্য ব্যস্ত হলে পূর্ণতা চট করে অনুরোধের সুরে অস্থির গলায় বললো,
– পূর্বের সাথে দেখা করার অনুমতিপত্র পাওয়া সম্ভব? আমার ওর সাথে দেখা করাটা খুবই জরুরী, খুব বেশি জরুরী। কিছু করুন ভাইয়া, ওর সাথে আমি একটাবার দেখা করতে চাই! পুলিশ আমাকে ভেতরে ঢুকতেই দেয়না! কি করি আমি?

পূর্ণতার অস্থির হয়ে উঠা মুখটা দেখে সাগ্রতের মনটা ধব্ক করে উঠলো। জীবনে আপন বলতে তো কেউ নেই। সবাই সাগ্রতের জীবন থেকে পিল পিল করে চলে গেছে। স্নেহময়ী ছাড়া তার জীবনে আর কোনো আপনজনের অস্তিত্ব নেই। আধো আধো গলায় ‘বাববা’ বলে ডাকা মেয়েটার মুখ ডেকে সেই প্রথম কেদেঁ দেয় সাগ্রত। যার জীবন থেকে কান্না করার অনুভূতি শুকিয়ে গিয়েছিলো সেই মানুষের বুকটা ছোট্ট শিশুর মুখটা দেখে আনন্দে অশ্রুবিদ্ধ হয়। আজ যেনো খুব কাছের কেউ আবদার করলো। এই আবদারটা রক্তের সম্পর্কহীন স্বল্প পরিচয়ে আপন হয়ে উঠা বোনটার ছিলো। সাগ্রত এগিয়ে গিয়ে পূর্ণতার মাথায় হাত রেখে গাঢ় কন্ঠে বললো,

– আমি নিজে ওই মানুষটাকে খাটতে দেখেছি। ওমন মানুষ যদি মরে যায় এই দেশের প্রতি আমার সত্যিই শ্রদ্ধা কমে যাবে। এই দেশ আরেকটা জঘন্য অভিশাপ পাবে। তুমি চিন্তা করো না, আইনী কেসে হোক বা দূর্নীতি করে আমি তোমার সাথে ওর সাক্ষাৎ করানোর ব্যবস্থা করবো। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নাও। আমি আজ আসি। যেকোনো দরকারে আমাকে ফোন করতে পারো। আমি পাশে আছি। যাই হ্যাঁ? খেয়াল রেখো।

সাগ্রত তাড়াতাড়ি নিজের আবেগান্বিত ফুলগুলো নিজের শক্ত ফুলদানিতে তুলে রাখলো। পূর্ণতাকে বিদায় দিয়ে দ্রুত ওয়াসিফ ভিলা ছেড়ে চলে গেলো। গাড়িতে উঠে বসতেই নিজের উপর বিশাল দায়িত্ববোধের ভার অনুভূত হলো। মুখ ঘুরিয়ে ওয়াসিফ ভিলার দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে নিজের মনে বললো, আমি নিরাপরাধ মানুষকে কোনো ভাবেই শাস্তি মুখোমুখি হতে দিবো না। সরকার ও জনগণের অগোচরে যেই অপশক্তির একগুচ্ছ দল দেশের সত্যিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে তাদের ধরিয়ে দিবেই।

.

দিনটা ছিলো মঙ্গলবার। ক্যালেন্ডারের পাতায় কোনো এক মাসের তেরো তারিখ। সাবিহা খুব ভোর সকালে উঠে পূর্ণতার সাথে করতে গিয়েছে। আয়মান এ ব্যাপারে কিছুই জানতো না, সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে আফিয়ার কাছ থেকে শুনেছে। আজ দুপুর বারোটার দিকে পূর্বের সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছে ওরা। তাই আয়মান দ্রুত রেডি হয়ে ওয়াসিফ ভিলায় চলে গেলো। যেয়ে দেখে ইতিমধ্যে সাগ্রতও চলে এসেছে। আয়েশার সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। পূর্ণতার খোঁজ করতেই উপরে চলে গেলো আয়মান। রুমের ভেতর ঢুকতেই দেখলো সাবিহা পূর্ণতার চুল আঁচড়ে দিচ্ছে। গোলাপী শাড়ি পড়ুয়া সাবিহার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা পূর্ণতার দারুণ লাগছে! আয়মান দরজার ওখানে মুগ্ধ নয়নে থম মেরে দাড়িয়ে থাকলে আয়নার হঠাৎ ওর প্রতিচ্ছবি দেখে থতমত খায় সাবিহা। আয়মানের চোখের দৃষ্টি আজ যেনো অন্যরকম। প্রচণ্ড অন্যরকম দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে, যে দৃষ্টিতে আগে কখনো দেখেনি সাবিহাকে। দুজনের দৃষ্টিলব্ধের দিকে চোখ পরতেই পূর্ণতা হালকা কেশে উঠলো। ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তায় দুজন অপ্রস্তুত হয়ে গেলে পূর্ণতা মুচকি হেসে দিলো। আয়মান চটপট ভেতরে ঢুকে বললো,

– দেখ বইন! তোর জামাই এমনেই তোর উপর হাবুডুবু খায়। বেশি স্টাইল মারলে পরে দেখা যাইবো জেলের কর্তৃপক্ষের সামনে ভাই উল্টাপাল্টা অঘটন ঘটায়া ফেলছে। এখন উঠ, আর ঘষামাজা করিস না।

আয়মানে বিশ্রী ভাষা শুনে পূর্ণতা খিলখিল করে হেসে দিলেও সাবিহা ক্ষুদ্ধ কন্ঠে জবাব দিলো,

– আপু শুধু চুলটাই আঁচড়ানো হয়েছে। আপনি চোখ-কান খোলা রেখে ভালো করে দেখেন ফেসে কিছুই দেয়নি। বেহুদা কথা না বলে আপনি চলে গেলে ভালো হয়।

আয়মান ভ্রুকুটি করে শক্ত কিছু বলবে ওমনেই পূর্ণতার বাধা পেয়ে আর কিছুই বললো না। সাগ্রতের সঙ্গে ওরা দুজন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পৌঁছালো। পূর্ণতা সম্পূর্ণ কালো বোরখার আবৃত। চোখের উপর সবসময়ের মতো কালো পাতলা কাপড়। হাত ও পা ছাড়া পূর্ণতার কিছুই দেখা যায় না। সাগ্রত প্রথমে ভেতরে ঢুকে তারপর ওদের আসতে ইশারা দিলো। পা যতো একপা করে ফেলছে ভয়ে বুকের ভেতরটা ধপাস ধপাস করে কাঁপছে। বোরখার নিচে স্বাভাবিক ভাবে শ্বাস নেয়া গেলেও এখন যেনো অস্বাভাবিক লাগছে। দাঁতের সাথে দাঁত লেগে যাচ্ছে, হাত কেমন নিসাড় ও ঠান্ডা হয়ে আসছে। অনবরত ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। আয়মান আড়চোখে পূর্ণতার অস্থির আচরণ দেখে নিচু কন্ঠে আস্তে করে বললো,

– খারাপ লাগছে তোর? পানি খাবি?

পূর্ণতার জন্য পানির বোতল নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলো আয়মান। পূর্ণতা বোতলটার দিকে কালো পর্দার আড়ালে একপলক তাকিয়ে গাঢ় করে ঢোক গিললো কিন্তু তৃষ্ণা নিবারণটা সাইডে ফেলে মাথা ‘না’ সূচকে নাড়িয়ে এগুতে লাগলো। ক্রমশ বিশ্রীবাজে গন্ধে পূর্ণতার বমিভাবে উদ্রেক হলো।নিকাবের উপরেই হাত চাপা দিয়ে গন্ধটা আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস করলো। আয়মান চটজলদি পূর্ণতার একটা হাত চেপে বললো,

– আরেকটু ধৈর্য্য ধর, এইতো সামনেই। কষ্ট কর পূর্ণতা।

সাগ্রত ওদের থেকে বেশ এগিয় ছিলো বলে মাথা ঘুরিয়ে পূর্ণতার অবস্থা স্বচক্ষে দেখলো। ওর জায়গায় স্নেহা থাকলে এতোক্ষনে বমি করে গা ভাসিয়ে অসুস্থ হয়ে যেতো, সেই জায়গায় পূর্ণতা নিজেকে অমায়িক ভাবে কন্ট্রোল করছে। সাগ্রত হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে ওদের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বললো,

– এইযে এসে গেছি।

কথাটা শুনে সমস্ত অস্থিরতা যেনো একনিমিষে পূর্ণতার উপর আছড়ে পরলো। এখন ঢোক গিলতেও মারাত্মক অসহন ঠেকছে। ছটফট করে উঠা ব্যকুল মনটা চান্ঞ্চল্যকর অবস্থায় ছুটে চলছে। শীতের কনকনে কাপুনির মতো পূর্ণতা চোয়াল কাঁপাতেই ডানে চোখ ফিরিয়ে শিকের ভেতর দৃষ্টি ফেললো। ওমনেই দাঁতে দাঁত চেপে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো পূর্ণতার দৃষ্টি। নিকাবের ভেতর ফুপানোর নিশ্বাসটা এতো প্রখর ছিলো যে, আয়মান আর সাগ্রত হাত মুঠো করে ফেলে তখন। আয়মান তৎক্ষণাৎ পূর্ণতার হাত ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চোখে রুমাল চাপে। সাগ্রত ব্যাপারটা অনুকূল করতেই আয়মানের কাধে হাত রেখে পূর্ণতাকে স্পেস দেয়ার জন্য দূরে যাওয়ার ইশারা দেয়। আয়মান সম্মতির সূচকে মাথা নেড়ে সাগ্রতের সাথে হাঁটা দেয়। পূর্ণতা ডুকরে উঠা অনুকম্পায় কাঁপতে কাঁপতে ফ্লোরে বসে লোহার শিকদুটো দুহাতে ধরে। শিকের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দৃষ্টি নত করতেই ফুপানো সুরে কেদেঁ দেয়। হঠাৎ কারোর আকস্মিক কান্নাটা কানের ছিদ্রপথে যেতেই পূর্ব ভেজা পাপড়ির চোখ খুলে তাকায়। এক মূহুর্ত ওইভাবে কেটে যেতেই পূর্ব সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো উৎকন্ঠা বোধ করে! নোংরা ফ্লোরে ক্ষতবীক্ষত হাতের তালু দিয়ে ভর ঠেলে অমানুষিক যন্ত্রণা দাঁত চেপে উঠে বসে। পূর্ণতার ওই কান্না করা দৃশ্যটুকু দেখে বুকের ভেতরটা দগ্ধ হয়ে উঠে ওর। রক্তাক্ত ঠোঁট, সেই সাথে সর্বত্র কেটে গেছে তবুও পূর্ব বহু চেষ্টায় ঠোঁট নাড়িয়ে অস্ফুট সুরে উচ্চারণ করে,

– তুতমি কেন এসেছো?

পূর্ণতা তড়াক করে মাথা তুলে শব্দ উৎসের দিকে তাকায়। শিকের ভেতরে যে মানুষটা বসে আছে তার গায়ে সেদিনের কালো পান্ঞ্জাবীটা আর নেই। ফর্সাটে চামড়ার সর্বত্রজুড়ে কালচে লম্বা ছাপ, মাথার চুল এলোমেলো, ঠোঁটদুটো কাঁটাছেড়ার মতো রক্তের প্রলেপে শুকিয়ে আছে। ঘন পাপড়িগুলো আজ একটু বেশি ঘন লাগছে। চোখদুটো ভেজা ভেজা ঠেকছে। পূর্বের ওই করুন অবস্থা দেখে পূর্ণতা শিকের ফাঁক গলে দুহাত বারিয়ে কাছে আসতে বলে। পূর্ব যেই এগুতে নিবে হঠাৎ ওর খেয়াল হয় এই জেলের ভেতর আরো একজন আসামী কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। পূর্ব তার দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলো মাস্তানের মতো দেখতে লোকটার চোখ এখন বন্ধ। আর কোনো বিপদ নেই বুঝতেই, পূর্ব এক মিনিটও দেরি করলোনা কাছে আসতে। হাড়ভাঙ্গা যতো ব্যথা ছিলো সব দাঁতে চেপে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গেলো। পূর্ব ওর হাতদুটো যেই ধরবে ওমনেই পূর্ণতা চট করে পূর্বের গাল ধরে হু হু করে কেদেঁ দিলো। জেলের রুমে ছোট্ট জানালা দিয়ে যেই আলোটা আসছিলো তাতে পূর্ণতার চোখের উপর থাকা পাতলা কাপড়টা ভেদ করে স্বচ্ছ অশ্রুজল দেখা যাচ্ছিলো। পূর্ণতা টান দিয়ে চোখের উপর পাতলা কাপড়টা সরিয়ে নিকাবের নিচটা ধরে যেই মুখ বের করবে সাথেসাথে পূর্ব ওর হাত ধরে বাধা দিলো। মাথা না সূচকে নাড়িয়ে বললো,

– খবরদার নিকাব খুলবে না। আমি এখানে একা নই। চোখ দিয়ে দেখো, পেছনে আরেকজন শুয়ে আছে। লোকটা খুনের আসামী! সাবধান!

পূর্বের সর্তক বার্তায় পূর্ণতা আর নিকাব খুললো না। কিন্তু পূর্বের দুগাল ধরে নিকাবের উপরেই অসংখ্য চুমু খেলো। শিকের স্বল্প ফাকের জন্য পূর্বের বেশ অস্বস্তিকর লাগলেও পূর্ণতার কাছ থেকে এটুকু প্রাপ্য যেনো লোভাতুর করে তুললো। যদি জেলের ভেতরে ঢুকার অনুমতি দিতো তাহলে পূর্ণতা ওকে বুকের মধ্যে আগলে রেখে দিতো। কোনো বাধাই তখন পূর্ণতা মানতো না। পূর্ণতা ওর কপালে ঘন করে চুমু খেয়ে ঠোঁটে যেই স্পর্শ করবে পূর্ব চট করে মাথা পিছনে নিয়ে বললো,

– ঠোঁটে না। থামো!

পূর্ণতা বিষ্ময়সূচকে তাকিয়ে থাকতেই কিছুক্ষন পর কৌতুহল গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– কেনো?

পূর্ব ওর দিকে দৃষ্টি রেখে ঢোক গিললো। আর শিকের কাছ ঘেঁষে বসলো না ও। পূর্ণতা বহুবার ডাকলেও পূর্ব আর আসেনা। এদিকে পূর্ণতার কাছে বাবা-মায়ের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলো পূর্ব। এরই মধ্যে ভিজিটিং পারমিশন শেষ হতে আর দুই মিনিটের মতো আছে। পূর্ব সেই যে দূরে গিয়ে বসেছে আর কাছে আসলোনা। পূর্ণতার মধ্যে অস্থিরতার ঢেউ আবার আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অশান্ত চোখ শান্ত হলেও এখন সত্যি কথাটা বলার সময় এসেছে। পূর্ব ওর দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি ভাবটা বুঝতে পেরে হঠাৎ ঠান্ডা গলায় বললো,

– কিছু বলার আছে? চুপ করে থেকোনা পূর্ণ। আর হয়তো আমাদের দেখা করার সুযোগ নাও হতে পারে। আমার কাছে কিছু লুকিও না।

পূর্ণতা শিক থেকে হাত আলগা পূর্বের দিকে আবার হাত বারিয়ে দিলো। আকুলিবিকুল চাহনিতে অনুনয় কন্ঠে বললো,

– কাছে আসো। আমি যেটা বলবো ওটা জোরে বলার মতো না।

পূর্বের ভ্রুদ্বয়ের মাঝে সুক্ষ ভাঁজ পরলো। সেই ভ্রুদুটোর নিচে থাকা ঘন পাপড়িময় চোখদুটোও কৌতুহলে আবৃত হলো। খানিকটা সময় নিয়ে পূর্ব শিকের কাছে চলে আসলে পূর্ণতা ওর একটা হাতটা বাইরে বের করে নেয়। দুই পার্টের বোরখার প্রথম তথা উপরের অংশটা খানিকটা তুলে পূর্বের হাতটা পেটের উপর রেখে দেয়। ওমনেই পূর্ব চমকে উঠে চোখ বড় করে তাকালে পূর্ণতা ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,

– সে চলে এসেছে।

-‘ চলবে ‘

#FABIYAH_MOMO