তোমাকে ঘিরে আমার অনুভূতি পর্ব-১১

0
585

#তোমাকে_ঘিরে_আমার_অনুভূতি💖
#পর্ব_১১
#Anika_Fahmida

অনু নিজের বাসায় চলে গেল। বিকেল বেলা অনু নিজের রুমে বই নিয়ে পড়াশোনা করছিল কিন্তু অনুর মাথায় শুধু আদ্রের চিন্তা ঘুরঘুর করছে। এই যেন মনে হচ্ছে অনুর সামনে আদ্র দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলছে,

–এই অনু এটাও লেখতে পারিস না তুই! কি পড়লি তুই এতোদিন? কিছুই তো পারিস না।

অনু বই বন্ধ করে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। আর কারও চিন্তা অনুর মাথায় আসে না। আসতে দিতে চাইলেও অনু অন্য কারও চিন্তা মাথায় আনতে পারে না। এই দুইটা বছর খেতে গেলেও অনুর আদ্রের কথা মনে পড়েছে। পড়তে গেলেও আদ্রের কথা মনে পড়েছে। গোসল করতে গেলেও আদ্রের কথা মনে পড়েছে। ঘুমাতে যাওয়ার আগেও আদ্রের কথা মনে পড়েছে। অনুর মনটা খুব টানত আদ্রের ফোনটা একবার ধরার জন্য কিন্তু পরমুহূর্তেই অভিমানে অনু চুপ করে বসে থাকত। অনু বইয়ের দিকে তাকিয়েই মনে মনে বলল,

–তোমার কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারি না আদ্র। কেন আমার মনে, মগজে তুমি সবসময় ঘুরঘুর করো বলতে পারো? তুমি বলবে কি করে? তুমি তো আর আমার কাছে নেই। অনেক দূরে আছো তুমি।

এমন সময় অনুর ফোনে কল আসল। অনু ভেবেছিল আদ্রের ফোন কিন্তু না। অনু মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল বাংলাদেশী অচেনা নাম্বার। অনুকে কে ফোন করেছে এটা জানার জন্য অনু ফোন রিসিভ করে বলল,

–হ্যালো কে বলছেন?

–হাই অনু!আমি পল্লব।

অনু অবাক হয়ে পল্লবকে বলল,

–আপনি আমার ফোন নাম্বার পেলেন কি করে?

পল্লব হেসে অনুকে বলল,

–নেহার কাছ থেকে তোমার ফোন নাম্বারটা পেয়েছি। কেমন আছো তুমি?

অনু বিরক্তি স্বরে বলল,

–নেহা আমাকে না জিজ্ঞেস করে আপনাকে আমার ফোন নাম্বার কেন দিল?আর আপনিই বা আমাকে ফোন দিয়েছেন কেন?

–আরে অনু তুমি নেহার উপর রাগ করো না। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছি তাই ফোন দিয়েছি।

অনু গম্ভীর স্বরে পল্লবকে বলল,

–কি বলবেন? বলে ফেলুন।

–আগে বলো কেমন আছো?

–হ্যা ভালো আছি।

–কি করছো?

–কিছু না।

–অনু তুমি আমার বন্ধু হতে কেন চাইছো না বলো তো?

–এমনি।

–এমনি এমনি কেউ বন্ধু হতে চায় না? আমি তোমার কথাটা বিশ্বাস করতে পারলাম না।

–বিশ্বাস না করলে আপনার সমস্যা। আমার না।

অনু ফোনটা কেটে দিল। নেহার কাজে অনু প্রচুর বিরক্ত হয়েছে। না জিজ্ঞেস করে ফোন নাম্বারটা নেহা কি করে দিল! অনু পড়ার টেবিল থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর আদ্রের কল আসল কিন্তু অনু ধরল না। ধরতে ইচ্ছে করলেও ধরল না।

ভার্সিটিতে কিছু ছেলে অনুকে ভীষণ বিরক্ত করছে। অনুর একদম ভালো লাগছে না। ছেলেগুলো অনুকে বিরক্ত করার জন্য পিছু পিছু হেঁটে বলতে লাগল,

–ঐ উড়ু পাখি দাঁড়াও। এতো তাড়াতাড়ি কেন চলে যাচ্ছো? কথা বলো আমাদের সাথে।

একটা ছেলে অনুর হাত চেপে ধরল। অনু রাগী স্বরে ছেলেটিকে বলল,

–আরে সমস্যা কি আপনার? হাত ছাড়ুন। আমি কিন্তু স্যারের কাছে আপনাদের ব্যাপারে বিচার দিব।

শ্যামলা করে ছেলেটি বলল,

–তাই নাকি কিউটি? কিন্তু তুমি তো আমাদের চিনো না। আমরা কোনো কিছুতে ভয় পাই না৷ বিচার দিতে চাইলে বিচার দাও কোনো সমস্যা নেই।

অনুর খুব ভয় লাগছে। আশেপাশে তেমন কেউ নেই। সবাই ক্লাসরুমে। অনুর ভার্সিটিতে আসতে লেট হয় আর ভার্সিটির মাঠেই এমন কিছু হবে অনু ভাবতে পারে নি।
অনু ছেলেটির কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এবার বাধ্য হয়েই অনু ছেলেটির গালে জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ছেলেটি রক্তলাল চোখে তাকিয়ে অনুর হাত ছেড়ে দিয়ে অনুকে বলল,

–ঐ ছেমরি তুই আমাকে থাপ্পড় দিলি?তোর এতো বড় সাহস তুই আমাকে থাপ্পড় দিলি?

ছেলেটি রেগে গিয়ে অনুকে পাল্টা থাপ্পড় দিতে যায়। অনু ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিন্তু না অনুর গালে থাপ্পড় পড়ল না। অনু চোখ খুলে দেখল ছেলেটির হাত পল্লব মুচড়ে ধরে আছে। পল্লব রেগে ছেলেটিকে বলল,

–তোর এতো বড় সাহস তুই অনুকে থাপ্পড় দিতে চেয়েছিস? তোর হাত আমি…

পল্লব ছেলেটির হাত মুচড়ে পেছন দিকে নিয়ে ছেলেটির গালে অনেকগুলো থাপ্পড় দেয়। ছেলেটি ভয় পেয়ে পল্লবকে বলল,

–পল্লব ভাই আমরা আর এই মেয়েকে বিরক্ত করব না। আমাদের ক্ষমা করে দেন।

পল্লব ছেলেটিকে ছেড়ে দিল। ছেলেটি তার দলবল নিয়ে চলে গেল। পল্লব অনুর দিকে তাকাল। অনুর চোখে জল। পল্লব অনুকে বলল,

–কেঁদো না। তোমাকে কাঁদলে ভালো লাগে না অনু।

অনু পল্লবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি এখন না এলে আমার কি যে হতো ভাবলেই ভয় করছে।

পল্লব মুচকি হেসে অনুকে বলল,

–আমি তোমার ধন্যবাদ চাই না। অন্য কিছু চাই।

অনু বুঝতে না পেরে পল্লবকে বলল,

–মানে?

পল্লব হেসে অনুকে বলল,

–মানে হলো আমি তোমার বন্ধু হতে চাই। তুমি কি আমার বন্ধু হবে?

অনু হাসিমুখেই পল্লবকে বলল,

–হ্যা আমি আপনার বন্ধু হলাম।

পল্লব খুশির সাথে অবাক হয়ে বলল,

–সত্যি অনু তুমি এখন থেকে আমার বন্ধু হয়েছো?

–হ্যা এখন থেকে আমি আপনার বন্ধু।

–অনু তুমি খুব ভালো!

পল্লব খুশিতে অনুকে জড়িয়ে ধরতে গেলে অনু তাড়াতাড়ি পেছন সরে যায় যাতে পল্লব অনু্কে ছুঁতে না পারে। অনু ভয় পাওয়া স্বরে পল্লবে বলল,

–আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না।

পল্লব অবাক হয়ে অনুকে বলল,

–কেন অনু? সমস্যা কি? আমরা তো বন্ধু! আর বন্ধু হিসেবে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরলে সমস্যা কি?

অনু বিরক্তি স্বরে পল্লবকে বলল,

–আমি আপনার বন্ধু হই৷ আপনার প্রেমিকা নই।

পল্লব অনুর কথা বুঝতে পেরে মন খারাপ করে বলল,

–আই এম সরি অনু।

অনু গম্ভীর স্বরে পল্লবকে বলল,

–ইট’স ওকে।

–অনু একটা কথা বলি?

–হ্যা বলুন।

–আমরা যেহেতু বন্ধু হই। তুমি আমাকে আপনি না বলে তুমি করে বলবে? তোমার মুখে আপনি বলে ডাকটা ভালো লাগে না। বন্ধু হিসেবে আমরা তো তুমি করে বলতেই পারি। তুমি করে বলবে তো?

–ওকে বলবো।

অনু চলে যাচ্ছিল তখন পল্লব আবারও বলল,

–এই অনু একটু দাঁড়াও।

অনু পেছন ফিরে পল্লবকে বলল,

–আর কিছু বলবে?

–আজকে ভার্সিটির ক্লাস শেষ হওয়ার পর আমি তোমার সাথে একটু আশেপাশের কোনো কফিশপে বসে কথা বলতে চাই। তুমি কি একটু কথা বলতে পারবে অনু? প্লিজ না করো না।

অনু ভাবতে লাগল পল্লবকে হ্যা বলবে নাকি না বলবে। যেহেতু পল্লব অনুকে গুন্ডা ছেলেগুলোর থেকে বাঁচিয়েছে তাই অনু পল্লবকে না বললে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। তাই অনু পল্লবকে হাসিমুখে বলল,

–আচ্ছা ঠিক আছে।

কফিশপের একটা সিটের টেবিলের একপ্রান্তে বসে আছে পল্লব এবং টেবিলের অপর প্রান্তের সিটে বসে আছে অনু। পল্লব কফি অর্ডার করল কিন্তু অনু কফি খেল না। পল্লব অনুকে বলল,

–এই অনু কফিটা খাও। খাচ্ছো না কেন?

অনু মুখ গম্ভীর করে পল্লবকে বলল,

–পরে কফি খাওয়া যাবে। তুমি কি বলবে বলো?

পল্লব কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর অনুকে জিজ্ঞেস করল,

–অনু তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?

অনু অবাক হয়ে পল্লবকে বলল,

–তুমি কেন আমার এসব ব্যাপারে জানতে চাইছো?

–বন্ধু হিসাবে এইটুকু তো জানতেই পারি।

–না, আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।

অনুর কথা শুনে পল্লব খুশি হলো৷ কিন্তু অনু গভীরভাবে ভেবে পল্লবকে আবারও বলল,

–তবে…

পল্লব অনুকে জিজ্ঞেস করল,

–তবে কি?

–আমার একটা প্রিয় মানুষ আছে।

অনুর কথা শুনে এবার পল্লব খুব কষ্ট পেল। পল্লব নিজের অজান্তেই বুকের ভিতরে একটু বেশি কষ্ট অনুভব করল। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে পল্লব অনুকে জিজ্ঞেস করল,

–তোমার প্রিয় মানুষের নাম কি?

অনুর এবার কান্না পাচ্ছে। পল্লব দেখল অনু কেঁদে ফেলেছে। অনুর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পল্লব একটা ছোট রুমাল পকেট থেকে বের করে অনুর দিকে এগিয়ে দিল। অনু পল্লবের থেকে রুমালটা নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,

–আমার প্রিয় মানুষটির নাম আদ্র। খুব বেশি ভালোবাসি আদ্রকে। কিন্তু কখনো আমি আদ্রকে মুখ ফুটে বলতে পারি নি যে আমি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসি। আসলে আমি আমার মনের কথা বুঝতাম না। যেদিন আদ্র আমাকে ছেড়ে দূরে গেল সেদিন বুঝতে পেরেছি যে আমি আসলে আদ্রকে কতটা ভালোবাসি।

পল্লব অনুকে জিজ্ঞেস করল,

–আদ্র দূরে চলে গিয়েছে মানে কোথায় গিয়েছে?

অনু পল্লবের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল,

–আদ্র পড়াশোনার জন্য লন্ডন গিয়েছে। পাঁচ বছরের জন্য চলে গিয়েছিল। সবে মাত্র দুই বছর হলো আদ্র যে গেল। আরও তিনটা বছর রয়েছে।

–তোমাদের ফোনে কথা হয় না?

–আদ্র এই দুই বছরে প্রতিদিন আমাকে অনেকবার ফোন দেয় কিন্তু আমি ফোন রিসিভ করি না

–কেন?

–অন্য কোনোদিন বলবো। আর কিছু জানার জন্য জোর করবে না।

অনুর চোখে আবার জল টলমল করতে লাগল। অনু মাথা নিচু করে নিজের কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে।
আদ্রের প্রতি অনুর গভীর ভালোবাসা দেখে পল্লবের জেলাস ফিল হতে লাগল। পল্লব মনে মনে বলল,

–এমন ভালোবাসা যদি অনু আমাকে বাসতো তাহলে হয়তো নিজেকে পৃথিবীর সেরা ভাগ্যবান মানুষ বলে মনে করতাম। আদ্র আসলেই অনেক লাকী যে অনুর মতো একজন ভালোবাসার মানুষ পেয়েছে। আমার কপাল আসলেই খারাপ।

অনু নিজের চোখের জল মুছে পল্লবের দিকে তাকাল। পল্লবের মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। অনু পল্লবকে জিজ্ঞেস করল,

–তোমার কি হয়েছে পল্লব?

পল্লব হাসির চেষ্টা করে অনুকে বলল,

–কিছু হয় নি।

অনু নিজের হাতের ঘড়িতে টাইম দেখে নিল। বিকেল গড়িয়ে রাত হতে চলেছে। অনু পল্লবকে বলল,

–অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি এখন বাসায় চলে যাই।

পল্লব অনুকে বলল,

–আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই।

অনু শান্ত স্বরে পল্লবকে বলল,

–না কোনো দরকার নেই।

পল্লব মন খারাপ করে অনুকে বলল,

–আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না অনু? আমাকে কি তুমি এতো খারাপ ছেলে ভাবো?

অনু তাড়াহুড়ো করে বলল,

–না, না। তোমাকে খারাপ ভাববো কেন? তুমি যথেষ্ট ভালো ছেলে পল্লব।

পল্লব মুচকি হেসে অনুকে বলল,

–তাহলে চলো আমি তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দেই। না করবে না।

পল্লব নিজের গাড়ি দিয়ে অনুকে বাসায় পৌঁছে দিল। অনু গাড়ি থেকে নেমে নিজের বাসায় চলে গেল। পল্লব অনুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

আরও বেশ কিছুদিন চলে গেল। এরই মাঝে পল্লব এবং অনু খুব ভালো বন্ধু হয়েছে। পল্লব তার হাসির কথা বলে অনুকে সবসময় হাসানোর চেষ্টা করে। অনুও মনে মনে পল্লবকে ভালো বন্ধু হিসেবে মেনে নিয়েছে।

আজ অনু ভার্সিটিতে যায় নি। এখন বিকেল বেলা। ঘড়িতে ৪ঃ১১ বাজে। অনু নিজের বাসার বিছানায় গভীর ঘুমে মগ্ন। হঠাৎ অনুর মনে হলো অনুর ঠোঁটে কেউ গভীরভাবে ঠোঁট বসিয়ে রেখে চুমু দিচ্ছে। অনুর দুই হাত কারও দুই হাতের সাথে শক্তভাবে আবদ্ধ। অনুর শ্বাস আটকে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে নিজের দুই চোখ খুলে অনু নিজের ঠোঁট কারও ঠোঁটের মধ্যে মেশানো দেখল। সামনের ব্যক্তিটি অনুকে গভীর চুমু দিচ্ছে। অনু চরম শকড খেল। তাড়াতাড়ি করে অনু সজোরে ধাক্কা দিয়ে নিজের উপর থাকা সামনের ব্যক্তিটিকে সরিয়ে দিল। অনু দ্রুত গতিতে বিছানায় শুয়া থেকে উঠে বসে জোরে জোরে হাঁপাতে লাগল। অনু বড়বড় চোখ মেলে খেয়াল করে সামনের ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে রইল। অনু ভয় পাওয়া গলায় সামনের ব্যক্তিটিকে অবাক হয়ে বলে উঠল,

–আ…আ…আদ্র তু…তুমি?

#চলবে…