তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-০১

0
2253

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#সূচনা_পর্ব
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

আমেরিকা ফেরত পিএইচডি ডিগ্রী প্রাপ্ত আমার হবু স্বামী এখন রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমে অন্য মেয়ের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে,যা দেখে আমার চক্ষু চড়ক গাছে।এক সপ্তাহ আগে আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে পারিবারিক ভাবেই যদিও।আমার বড়চাচির ভাইপো যে এতো বড় লুচু তা নিজেরে চোখে না দেখলে হয়তো জানতাম না।আবরার মানে আমার হবু স্বামী মেয়েটার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো যা দেখে আমি আরো শকড হলাম।হাসবো না কাঁদবো কিছুই বুঝতিছি না।আমি তাসনুভা আমিন সূচী,সদ্য অনার্স ১ম বর্ষের ভর্তি হয়েছি।বাড়ির লোকের পছন্দেই বিয়েতে রাজি হয়েছি,এসেছিলাম বন্ধুদের নিজের বিয়ের ট্রিট দিতে আর এসে কিনা এইসব দেখা লাগছে,জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম তারপর কোনকিছু না ভেবেই নিজের মোবাইলটা বের করলাম।বাসার সবাইকে তো জানানো লাগবে যে কতো বড় লুচুর সাথে আমার বিয়েটা দিতে যাচ্ছে।যেমন ভাবনা তেমন কাজ,ক্যামেরা অন করেই ফটাফট আবরার আর ওই মেয়েটির ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি তুলে ফেললাম কিন্তু আমার ভাগ্যটা বোধহয় ভালো ছিলো না মেয়েটা আমায় দেখে ফেললো।আর জোরে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো,,
–হে গার্ল,হোয়াট আর ইউ ডুয়িং??

মেয়েটার এভাবে বলাতে আবরার আমার দিকে তাকায়,আমাকে দেখেই সে ঘাবড়ে যায় আর সাথে সাথে ওই মেয়েটিকে দুরে সরিয়ে দেই।তারপর আমার দিকে আসতে থাকে,
–সূচী,সূচী লিসেন এরকম কিচ্ছু না।আমরা তো যাস্ট,,
আমি আবরারের কোন কথায় শুনিনা,কেন জানি না বাবা,মা দাদি সবার ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে এরকম একটা লুচুর সাথে বিয়ে ঠিক করার জন্যে যে কিনা রেস্টুরেন্টে অন্য মেয়ের সাথে এইভাবে রঙ্গলীলা করতে যেয়ে ধরা খায়।বন্ধুদের রেখেই আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে যায়।আজ বিকাল থেকেই বৃষ্টি হয়েছে তাই এখন রাস্তাঘাটে কোন সিএনজি বা রিক্সা কিচ্ছু নেই।এদিকে আবরার ও আমার পিছু পিছু চলে এসেছে নিজের সাফায় দিতে,কিন্তু আমি তার কোন কথায় কান দিলাম এর মাঝে একটা সিএনজি পেয়ে উঠে গেলাম।সিএনজিতে উঠে মিনিট দশেক মাকে কল দিলাম জানানোর জন্যে,মা কল রিসিভ করার সাথে সাথেই সিএনজি ওয়ালা খুব জোরে ব্রেক কসলো,আমি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম,রেগে বললাম,,

–কি করছেন মামা??সাবধানে চালাতে পারেন না গাড়ি??

–আমার কি দোষ আপা??ওই ভাইজানই তো সামনে চলে আইছে।(সিএনজি ওয়ালার কথায় বাইরে উকি দিয়ে দেখি আবরার গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।মেজাজ আবার আরো চটে গেলো।আজ তো আর এই লোকের রক্ষে নেই আমার হাত থেকে।ব্যাগটা হাতে নিয়ে নেমে গেলাম সিএনজি থেকে)

–কি সমস্যা আপনার??এইভাবে রাস্তা আটকিয়ে দাড়িয়ে আছেন কেন??

–সূচী তুমি ভুল ভাবছো,তুমি যা দেখেছো সব মিথ্যে।আমি তো…

–আমি যা ভাবছি তা একদম সত্যি আর আমি যা দেখেছি সেটাও সত্যি আর এই সত্যি কথাটা এবার বাড়ির লোক জানবেও আর দেখবেও।আপনি যে কতোটা নিচ তার সব প্রমান আমার কাছে আছে মিষ্টার আবরার শিহাব।

–প্রমান??কেমন প্রমান??

–জী হ্যা,প্রমান।আপনার ওসব রঙ্গলীলার সমস্ত ছবি আমার মোবাইলে আছে যেটা আমি এক্ষুনি বাসায় গিয়ে সবাইকে দেখাবো।

–হোয়াট??আমাদের আর কদিন পর বিয়ে সূচী।

–হাহাহহাহাহহহহহ,,আপনি ভাবলেন কি করে আপনার মতো একটা লুচু ছেলের সাথে আমি এখনো বিয়ে করবো??সন্দেহ আমার আগেই হয়েছিল কিন্তু মনের ভুল ভেবে তা পাত্তা দিইনি।কিন্তু আজ যা দেখলাম তারপর তো বিয়ের প্রশ্নই আসে না।

কথাটা বলে আমি চলে আসতে চাইলাম,কিন্তু পেছন থেকে আবরার আমার হাত টেনে ধরলো,আমি আবরারে দিকে তাকিয়ে হাতটা ছাড়তে বললাম কিন্তু সে হাত ছাড়লো,উল্টে বিশ্রী একটা হাসি দিয়ে বলল,,
–সত্যিটা যখন জেনেই গেছো তখন তো তোমাকে এতো সহজে ছাড়া যাবে না সোনাপাখি।

–হাত ছাড়ো আবরার না হলে ভালো হবে না কিন্তু।

–হাহহাহাহহহ,,ভালো তো হবে না জানি,কিন্তু সেটা আমার না তোমার।

–মানে??

আবরার তার পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে মোবাইলটা চাইলো।আমি দিলাম না,সে আমার ব্যাগ কেড়ে নিতে গেলো আমি কিছুতেই ছাড়লাম না ব্যাগ,এর মধ্যে সিএনজি ওয়ালা এসে আবরারকে আটকাতে লাগলো।আবরার আমার হাত ছেড়ে সিএনজি ওয়ালাকে মারতে শুরু করল।তারা হাতাহাতি করছে,রাস্তায় আর একটা কাকপক্ষীও নেই যে আমি সাহায্য চাইবো,সিএনজি ওয়ালা চিল্লিয়ে বলা শুরু করলো আপা তুমি পালাও পালাও।আমি ওনাকে এইভাবে রেখে যেতে চাইনি কিন্তু আবরারকে এতোটা হিংস্র লাগছিলো যে আমি দৌড় দিলাম।আবরার ও আমার পিছু নিলো।আমি ছুটতে ছুটতে হটাত একটা চলন্ত গাড়ির সামনে পড়ি।গাড়িটা আগেভাগেই ব্রেক কষায় আমি বেচে যায়।গাড়িটা দেখে আমার মনে আশা জাগে।আমি হেলপ হেল্প বলে চিল্লাতে থাকি।এমন সময়েই গাড়ি থেকে ৬ ফিট লম্বা,মিডিয়াম ফিগার,ফর্সা গায়ের রং এর একটা ছেলে বের হয়।তার বাম একহাতে আইস্ক্রিম,ডান হাত দিয়ে চোখের সামনে থাকা সিল্কি চুলগুলো সরাতে থাকে।

–ও হ্যালো ম্যাডাম,মরার জন্যে আমার গাড়িই পেয়েছিলেন??(ওনার কোন কথা না শুনেই আমি ওনার কাছে ছুটে যায়)
–আমাকে বাঁচান প্লিজ,আমাকে ও খুন করে ফেলবে।প্লিজ আমাকে বাঁচান।
–কি??কে খুন করবে??
–আমার ফিয়নসে।।
–হোয়াট??হাহহাহাহহাহহ,,আপনার ফিয়নসে আপনাকে খুন করে ফেলবে??হাহাহহাহহা নাইস জোক।তা ম্যাডাম আপনি বিয়ে থেকে পালাচ্ছেন যে সেই রাগে আপনার ফিয়নসে আপনাকে মারতে চাইছে??
–দেখুন এতো কথা বলার সময় নেই আমার,ও এক্ষুনি চলে আসবে,,
–আমি অলরেডি চলে এসেছি সোনাপাখি(পিছন থেকে আবরারের গলা শুনে আমি আরো ভয় পেয়ে যায়))ভাই ও আমার হবু বউ,ওকে আমার কাছে দিয়ে দিন।(আবরার ওই ছেলেটিকে কথাটা বলে)
–ইয়া ইয়া আপনার বউ আমি নিয়ে কি করবো??।

আইস্ক্রিম খেতে খেতে ছেলেটি আমার হাত ধরে আবরারের কাছে নিয়ে যায়।হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে,
–এনজয়
তারপর সে পিছু ঘুরে তার গাড়ির দিকে যায়।আমার এই মুহুর্তে ওই ছেলেটার ওপরে আরো রাগ বেড়ে যায়।আমি চিল্লিয়ে বলে উঠি,,
–হে মিষ্টার,হেল্প করতে না পারেন তাই বলে কাউকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন।এই শিক্ষা পাইছেন পরিবার থেকে??
আমার কোন কথাতেই কাজ হলো না,ছেলেটা হেটেই যাচ্ছে।এর মধ্যেই আবরার বলে ওঠে,,
–এসব কাপুরুষ ছেলে সোনাপাখি,তোমার জন্যে তো আমিই আছি নিজের পুরুষত্ব প্রমান করার জন্যে।
আমি আবরারের দিকে ঘৃনার দৃষ্টিতে তাকায়,তারই মাঝে হটাত কে যেন আবরারকে এক ঘুষি দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলো,আমি সাউডে তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা আইস্ক্রিম হাতে দাড়িয়ে।আবরার মাটি থেকে তাকিয়ে,,
–ইউ স্কাউন্ড্রেল,,
–না না না,,গালি দিবেন না আমায়।আমাকে কেউ গালি দিলেই না আমার মটকা গরম হয়ে যায়।আর একবার আমার মটকা গরম হলে আমি না ডানে তাকায় না বামে,সামনে যাকে পাই দমাদম তারে কেলাই।
(ছেলেটার কথা শুনে আবরার আরো রেগে গেলো,মাটি থেকে উঠেই ছেলেটাকে পাল্টা ঘুষি দিলো।ছেলেটার হাতের আইস্ক্রিম গিয়ে পড়লো মাটিতে।)
–আমার আইস্ক্রিম ফেলে দিলি…(ছেলেটা মুচকি হাসলো আমার দিকে তারপর নিজের হাতের মুঠি শক্ত করে আবরারের পেটে দিলো এক ঘুষি)
–জিয়ো কাকু,

৪র্থ গলার আওয়াজ পেয়ে আমি গাড়ির দিকে তাকাই।৬-৭ বছর বয়সী হাফ প্যান্ট পরা একটা ছেলে গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে হাসছে আর আইস্ক্রিম খাচ্ছে।এদিকে আবরার আর ওই ছেলেটা প্রচুর মারামারি করছে।আমি ভয় পেলেও না ভয় পাওয়ার ভান করে দাড়িয়ে আছি।এক সময় আবরার না পেরে পালিয়ে যায় আর গাড়ি থেকে পিচ্চি ছেলেটাও নেমে আসে।লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
–চলেন আপনাকে বাসায় পৌছে দিই।
–তার কোন দরকার নেই(ছেলেটা আবরারকে মেরে তাড়িয়েছে ঠিকি কিন্তু সেটা আমার জন্যে না নিজের জন্যেই তাই ছেলেটার প্রতি আমার প্রচন্ড রাগ হয়েছে)
–ঠিকাছে।ওই ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা করার ইচ্ছা মনে হয়।অয়ান চল বাপ আমরা বাসায় যায়।
ছেলেটা পিচ্চিটার হাত ধরে চলে যেতে লাগে,আমি মনে মনে ভাবি কথাটা তো সত্যি আবরার যদি আবার আসে তখন??আমি কোন কিছু আর না ভেবেই তাদের সাথে যেতে চাই।গাড়ির পিছনের দরজা খুলতে যাবো তখন ছেলেটা বলে ওঠে,,
–ও ম্যাডাম আমি কি আপনার ড্রাইভার যে ওখানে বসছেন??
–মানে??
–মানে সামনে এসে বসেন।আমি আপনার ড্রাইভার না যে আপনি পিছনে মহারানীর মতো বসবেন আর আমি ড্রাইভারের মতো গাড়ি চালবো।বাবা আয়ান যাও তো পিছনে গিয়ে বসো।

–ওকে কাকু।
পিচ্চি ছেলেটা পিছনে গিয়ে বসে আর আমি বসি সামনের সিটে মানে ছেলেটার পাশে।ছেলেটাকে আমার বাড়ির ঠিকানা দিই।সে গাড়ি চালাচ্ছে হটাত পিছন থেকে পিচ্চি ছেলেটা বলে ওঠে,

–কাকু কতোদিন পর তোমাকে ফাইট করতে দেখলাম।মন টা জুড়িয়ে গেলো পুরো।

–এই কতো দিন কই রে??কাল সকালেও তো পিটালাম।অবশ্য তুই ছিলি না,তোর মা ছিলো।

–হু মা তো বলছিলো যে,আয়ান তোর কাকু আজ আবার একজনকে পিটিয়েছে।আমি তো গল্প শুবে অনেক হেসেছি।হাহহাহাহহাহাহ,,কিন্তু কাকু আজ তুমি কাকিকে যেভাবে বাঁচালে একদম বলিউডের হিরো লাগছিলো তোমায়।

–কাকি??(আমার পাশে বসা ছেলেটা অবাক হয়ে ওঠে)

–হ্যা ওই যে তোমার পাশে বসে আছে আমার কাকি।(আমি এতোক্ষন এদের কথায় কান দিচ্ছিলাম না কিন্তু পিচ্চিটার কথা শুনে আমিও অবাক)

–আরে আরে বাপ কি বলছিস এ??

–ঠিকি তো বলি,আমি তো মুভিতে দেখেছি এইভাবেই হিরোইনকে বাচাই হিরো তারপর তাদের মধ্যে ভাব হয়,তারপর বিয়ে,তারপর এক ঘরের মধ্যে…(পিচ্চিটার কথা শেষ করতে দেই না ছেলেটা তার আগে থামিয়ে দেই))

–আরে আরে বাপ থাম।বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না??

চাচা ভাইপোর এসব কান্ডে আমার আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো,কিন্তু কিছুই বললাম না।কারন আমার বাসা এসে গেছে,আমি গাড়ি থেকে নামতে যাবো তখন,ছেলেটা আস্তে করে জানতে চাইলো,
–এই যে ম্যাডাম থ্যাঙ্কস না দিয়েই চলে যাচ্ছেন??

আমি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে,,
–থ্যাঙ্কস!মাই ফুট…

আমি গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে বাসায় ঢুকে গেলাম,আর ছেলেটা বলতে লাগলো,,
–এই জন্যেই মানুষের ভালো করতে নেই।ধন্যবাদ তো জানাবেই না বরং রাগ দেখাবে উল্টা।হাহ!

–আরে কাকু তুমি কাকির কথায় রাগ করো না,কাকি তো…

–আয়ান থামবা তুমি নাকি মার খাবা??

–না না আমি আর কিছু বলছি না।এই যে গালে হাত দিলাম আর কিচ্ছু বলবো না।

–হুম গুড বয়..

ছেলেটা গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল।এদিকে বাসায় এসে আমি বাবা মাকে আবরারের সমস্ত নোংড়া ছবি আর ঘটনা গুলো বলে দিয়েছি।বড় চাচি অনেক চেষ্টা করছে নিজের ভাইপোর হয়ে সাফাই দেয়ার কিন্তু বাবা একবারেই বিয়েটা ক্যান্সেল বলে দিল।আমি নিজের রুমে এসে দরজা দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম।দেড় ঘন্টা ধরে সাওয়ার নিলাম।আবরারের ওপর রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে আমার।সাওয়ার নিত্র এসে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম।সকালে ঘুম ভাংলো মায়ের জোরে জোরে আমার রুমের দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে…..

চলবে।