তোমাকে নিয়েই গল্প পর্ব-০২

0
1502

#তোমাকে_নিয়েই_গল্প
#পর্ব:২
#জুনাইনাহ_তাসনিম_অরহা

১.
সকালে ঘুম ভাংলো মায়ের জোরে জোরে আমার রুমের দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে,
–সূচী দরজা খোল তাড়াতাড়ি।সূচীইইই…

বেশ কিছুক্ষন মাকে ইগনোর করলাম কিন্তু একটা পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে উঠে বসলাম।চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুললাম।মা আমাকে এক হাত দিয়ে সরিয়ে ঝড়ের বেগে আমার ঘরে চলে এলো।আমার আলমারির ওপরে রাখা ৯০ দশকের স্যুটকেসটা নামিয়ে কি যেন খুজতে লাগলো।মা হন্নে হয়ে কি যেন খুজেই চলেছে,আমি হায় কাটতে কাটতে বল্লাম,
–মা ওই ভাবে কি খুজতেছো??আমি হেল্প করি?

মা আমার কোন কথার উত্তর দিলো না।স্যুটকেস থেকে মা একটা পুরাতন এলবাম বের করে স্যুটকেসটা আবার জায়গা মতো রেখে দিলো।আমি এখনো দরজার কাছে দাড়িয়ে,আমার কাছে এসে দাড়িয়ে ৩২টা দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলো।মায়ের এইভাবে কিছু না বলে চলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক না,তিনি প্রতিনিয়তই এটা করেন।কোন কিছুর উত্তর না দিয়েই পাগলের মতো হাসি দিয়ে চলে যায়।আমি বিছানায় গিয়ে আবার সুয়ে পড়লাম,অনেকক্ষন চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম এলো না।মায়ের ওপর এবার রাগ হচ্ছে,কি এমন মহামূল্যবান এলবাম ওটা যে তার জন্যে সকাল ৬টাই আমার ঘুম ভাঙালো।আমার জানা মতে ওই স্যূটকেসে মায়ের বাবার বাড়ির কিছু পুরাতন জিনিসপত্র আছে যা মা বিয়ের সময় আনে তাই তার এতো টান।
–এতোই টান যখন নিজের ঘরেও রাখতো কিন্তু রাখে নাই,আমার ঘরেই যতো পুরাতন মালপত্র রাখা লাগবে।ভাল্লাগে না ছাই(বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম)

সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছি,আবরারের মা বাবা এসে হাজির।ওনাদের দেখে আমার কাল রাতের কথা মনে পড়ে গেলো।আবরারের মা আমার কাছে এসে নিজের ছেলের নির্দোষ হওয়ার সাফাই দিতে আসলো কিন্তু আমিও ভার্সিটির জন্যে লেট হচ্ছি বলে বেরিয়ে গেলাম বাসা থেকে।

২.
ভার্সিটিতে এসে শুনি আজকের ফার্স্ট দুইটা ক্লাস অফ নাকি।ব্যাস মুড ভালো করার জন্যে আমি আর মারিয়া দুজন ঠিক করলাম শপিং এ যাবো।(মারিয়া আমার বেস্ট ফ্রেন্ড,নার্সারি থেকে দুজন একসাথে পড়ি।)রিক্সা ডেকে রওনা দিলাম দুজন।কিন্তু কপাল বেশি ভালো হলে যা হয়,ঢাকা শহরের জ্যামে আটকে গেলাম।আমি আর মারিয়ে দুজন গল্পই করছিলাম কিন্তু পাশ থেকে কে যেন কাকি কাকি বলে ডাকছে।আমি পাত্তা দিলাম না কারন আমার বা মারিয়ার কারোর বয়স এতোটাও না যে কেউ কাকি বলে ডাকবে।মারিয়া হটাত আমার হাত ঝাকিয়ে বললো,,
–এই সূচী,সূচী মনে হচ্ছে তোকেই ডাকছে।
–কি আমাকে?আমাকে কোন দিক থেকে তোর কাকি লাগে রে??
–আমার কোন দিক থেকে না লাগলেও পিচ্চিটার হয়তো লাগে।
–পিচ্চি?!!
মারিয়া চোখ দিয়ে সাইডে ইশারা করে।আমি তাকাতেই শকড।কাল রাতের সেই পিচ্ছিটা,আমার দিকে তাকিয়ে একনাগাড়ে কাকি বলে ডাকতেই আছে।এই পিচ্চিটা পাইছেটা কি রাস্তাঘাটে এইভাবে কাকি বলে চিল্লাচ্ছে,এতোক্ষনে আশেপাশের লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়েছে।আমি আশেপাশে চোখ ঘুরালাম,শুকনো ঢোক গিল্লাম।পিচ্চিটা গাড়ির ভিতর থেকে এখনো আমায় কাকি কাকি করে চিল্লাচ্ছে।আমি পিচ্চিটাকে বকা দিতে যাবো তখনি জ্যাম ছেড়ে গেলো আর পিচ্চিটার গাড়ি ছেড়ে দিলো।সে যাওয়ার সময় হাত ঝাকাতে ঝাকাতে বললো,
–বাই কাকি।।
–উফফ বিরক্তিকর(আমি দাঁত খিটমিট করে বলে উঠলাম)
–সূচী পিচ্চিটা ওইভাবে….
–চুপ একদম,একদম চুপ আরেকটা শব্দ বের কর মুখ দিয়ে তাহলে এক লাথি দিবো নিচে গিয়ে পড়বি।

বেচারি আমার ভয়ে আর কথা বলতে পারলো না।শপিং মলে এসে দুজন টুকটাক কেনাকাটা করলাম।মারিয়ার বাসা থেকে কল আসায় ও আমাকে এগিয়ে যেতে বললো অন্যদিকে।আমি ৫ তলায় যাওয়ার জন্যে লিফটের বাটন প্রেস করলাম।লিফটের দরজা খুলতেই একটা ছেলে আর মেয়ে অপ্রস্তুত ভাবে দাড়িয়ে পড়লো।আমি তাদের দিকে তাকালাম কারন আমি হয়তো তাদের প্রাইভেট মোমেন্টে ঢুকে পড়েছি।আমি হাতে থাকা নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে পড়লাম,কারন পাবলিক প্লেসে এসব আমার একটুও পছন্দ না।কিন্ত দু সেকেন্ড পরেই সামনে থাকা আয়নাতে পরিচিতি মুখ ভেসে উঠলো।এটা তো সেই ছেলেটাই,পাশে সুন্দরি একটা মেয়ে।মেয়েটা ছেলেটার হাত ধরে আছে,গার্লফ্রেন্ড হবে হয়তো এমন ভাবে ছেলেটার সাথে লেপ্টে আছে যেন ছাড়লেই পালিয়ে যাবে ছেলেটা।কিন্তু এইখানে এই ছেলেটাকে আমি একদমি এক্সপেক্ট করিনি।বেশ রাগ হলো ছেলেটাকে দেখে কারন ঘন্টা খানিক আগেই এই জনাবের ভাইপো রাস্তাই সবার সামনে কাকি কাকি করে চিল্লিয়ে তামাশা করেছে।মন চাচ্ছে ভাইপোর রাগ চাচার ওপরে ঝেড়ে দিই।আমার ৫ তলা এসে গেলো।আমি বের হয়ে পিছু ঘুরে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।ছেলেটা এতোক্ষনে আমাকে খেয়াল করেছে,কিন্তু কিছু রিয়াক্ট করার আগেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।

৩.
আমাদের শপিং শেষ,মারিয়া তখন বলে উঠলো,,
–সূচী বড্ড খুদা পাইছে চল না কিছু খায়।
–এখন??দেড়টা বাজতে গেলো প্রায়,এখন আর কিছু খাওয়া লাগবে না।একেবারে বাসায় গিয়ে খাওয়া যাবে।
–না না।আমি আর এক পা ও নড়তে পারবো না।মাথা ঘুরে পড়ে যাবো মনে হচ্ছে এক্ষুনি,,(মারিয়া মাথায়য় হাত দিয়ে চোখ ঘুরাতে লাগলো।কিন্তু এটা যে নাটক করছে তাও আমার অজানা না)
–আচ্ছা ঠিকাছে চল খেয়েই যাবো।
–সত্যি??
–হুম সত্যি
–চল,চল(মারিয়া ক্যাফের দিকে ছুটতে লাগলো)
–নটাংকি।
–কিছু বললি কি??
–না আপা,কিছু না।চলেন যায়।

ক্যাফেতে ঢুকে মারিয়া বসলো আর আমি গেলাম রিসিপশনে অর্ডার দিতে।দুইটা কোল্ড কফি,একটা চিকেন চিজ বার্গার আর একটা চকলেট মুজ কেক অর্ডার দিয়ে বসলাম।অর্ডার দিয়ার মিনিট পাঁচেক এর মধ্যেই খাবার চলে এলো।আমি আর মারিয়া তো বেশ অবাক।
–এরা এতো ফার্স্ট খাবার সার্ভ করা কবে থেকে শুরু করলো ব্রো??(মারিয়া নিজের চশমা ঠিক করতে করতে বলে)
–আমাকে কেন জিগায়তেছো ব্রো??ক্যাফের ম্যানেজার তো আর আমার জামাই লাগে না,তাই না??
–আজব!ম্যানেজার তোর জামাই হতে যাবে কেন??তুই কতো ব্রিলিয়ান্ট,কতো কিউট।তোর তো কোন বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হবে,এসব ম্যানেজার ট্যানেজার না।
–হ্যা হয়ছে এইবার বকবকানি থামিয়ে বার্গার খা।
–ওকে ডিয়ার।

মারিয়া বার্গারটা হাতে নিতেই যাবে কিন্তু তার আগেই কে যেন বার্গারটা নিয়ে নিলো,আমি আর মারিয়া দুজনেই ব্যক্তিটির দিকে তাকালাম।তিনি বার্গারে কামড় দিতে দিতে চেয়ারে বসলো।আমি আর মারিয়া ওনার কান্ড দেখে তো শকড।খেতে খেতেই বললো,
–তোমাদের পাশে বসলাম একটু আমার ভাইপোর কাকি।কিছু মনে করো না যেন…..

আহহহহহহহ!!এটা সেই ছেলেটাই।এই ছেলে তো দেখছি পিছুই ছাড়ছে না।কি কুক্ষনে যে দেখা হয়ছিলো,অবশ্য উনি ছিলেন বলেই কাল আমি সুস্থভাবে বাড়ি ফিরেছি।কিন্তু উনি তো ইচ্ছা করে আমাকে সাহায্য করেননি আর ওনার ওই ভাইপো।কাকি কাকি করে মাথা পাগল করে দিলো।
–এই এই আপনি আমার বার্গার খাচ্ছেন কেন হ্যা???(মারিয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলে ওঠে)

–উহু তোমার ভুল হচ্ছে।এটা তোমার বার্গার না গো আমার ভাইপোর কাকির চশমা পরা বান্ধবী ।

–কিহ?আপনার ভাইপোর কাকির চশমা পরা বান্ধবী মানে টা কি হ্যা??

–মানে এটা আমার বার্গার তাই আমিই খাচ্ছি।তোমার টা তুমি খাবে।

–এই যে মিষ্টার শুনুন কাজটা ভালো হচ্ছে না কিন্তু বলে দিলাম।(মারিয়ে একাধারে এই যে মিষ্টার বলতেই আছে)

–আমাকে ডাকছো?(লোকটা খাওয়া বন্ধ করে বলে ওঠে)

–তা কি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে ডাকছি?

–হাহহাহহাহহহা,,এইভাবে ডাকলে আমি কিভাবে বুঝবো আমার ভাইপোর কাকির চশমা পরা বান্ধবী গোওওও।।আর আমার তো সুন্দর একটা নাম আছে।ইশরাক এহসান।সুন্দর না বলো??(উনি দাঁত কেলিয়ে বলেন)

–একদমি সুন্দর না।
(আমি কথাটা বলেই কোল্ড কফিটা ওনার গায়ে ছুড়ে মারি।ওনার আর ওই পিচ্চির ওপরের যতো রাগ সব বের হয়ে গেছে আমার এই মুহুর্তে।উনি কয়েক সেকেন্ড পর যখন বুঝতে পারলেন যে আমি ওনার গায়ে কফি ঢেলে দিয়েছি উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকান।)
–তোর মতো লোফার ছেলেদের কে ইচ্ছা হয় খুন করে ফেলি।একটা মেয়েকে ইচ্ছা করে সাহায্য না করে বরং তাকে বিপদে ঢেলে দিস,পিচ্চিদের দিয়ে রাস্তার মাঝখানে হ্যারাস করাস,লিফটে মেয়েদের সাথে লুতুপুতু করে আবার অন্যদের ডিস্টার্ব করতে আসিশ।তোর বাবা মা ছেলেকে এই শিক্ষা দিয়েছে?ছিহ!আরে খাবার খেতেই যদি হয় তো এসে বলতিস।ভীখারিকে দান করতে আমার ভালো লাগে তোকেও না হয়….

আমি কথা শেষ করতে পারিনা।লোকটা আমাকে টান দিয়ে ওনার বুকের সাথে মিশিয়ে নেই,আচমকা ওনার এই আচারনে আমি ভয় পেয়ে যায়।আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন উনি,চোখ লাল হয়ে গেছে কিছুক্ষনের মধ্যে।আমার দুই হাতের পেশি শক্ত করে ধরে রাখে।আমি ছাড়ানোর চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয় না,আমার পেশিতে যেন রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে,আমি চাইলেও আর জোর খাটাতে পারছি না।উনি কিছু বলতে যাবেন তখনি ওনার পিচ্চি ভাইপোটা এসে ওনার টি-শার্ট টেনে ধরে,কয়েক সেকেন্ড পর উনি আমায় ছেড়ে দিয়ে চলে যান।

আমি খেয়াল করি ক্যাফের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে,তখনি ম্যানেজার আসে।
–সরি ম্যাম,এই অর্ডারটা স্যারের ছিলো।আমাদের ওয়েটার ভুল করে আপনাদের টেবিলে দিয়ে গেছে।সরি ম্যাম।আমি জানি স্যারের ভুল আছে কিন্তু আপনিই বেশি রিয়াক্ট করেছেন এখানে,সরি।

কথা শেষ করে ম্যানেজার চলে যায়।আমারো রাগ হয়ে যায়,ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় ক্যাফে থেকে।

বাসায় ফিরে দেখি মা,বড়াপু সবাই পুরাতন এলবাম দেখছে।
মা–সুমনা(বড়াপু) দেখ ইনি হলেন আমার ভাই,আর ইনি আমার আব্বা।
বড়াপু–মা এটা নানা ভাই আর এটা মামা??
–হ্যা এটাই তোর নানা আর এটা,,,আরে ওই দেখ সূচীও এসে গেছে।

আমাকে দেখে আপু জয়েন করতে বলে ওদের সাথে কিন্তু আমি কোন কথা না বলেই গটগট করে নিজের রুমের দিকে চলে যায়।
–মা তোমার ছোট মেয়ের কি হলো বলো তো??(বড়াপু)
–কি জানি বাপু!!কখন যে কি হয় তোর বোনের,,(মা)
–আচ্ছা দাড়াও আমি দেখে আসি।

৪.
–উহু উহু..(আপুর গলা ঝাড়ার আওয়াজ করে ওঠে)
–আপু তুই যা আমার ভালো লাগছে না।
–আমি তো যাস্ট কফি আনছিলাম…….

চলবে…….