তোমাতে পর্ব-০৩

0
2505

#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল

/পর্ব ৩/

মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এতবার কিভাবে লিখব আমি! গত দুদিনের বাড়িকাজও করিনি যে তিনবারেরটা এগিয়ে থাকবে! নিসার কাছাকাছি আসতে মেজাজ আরও খিচে গেল।

“তোর বয়ফ্রেন্ড আছে বলিসনি তো!”

মহাজাগতিক প্রাণী দেখার মুখভঙ্গিতে নিসার দিকে তাকাই। নিসা গাল ফুলিয়ে, ঠোঁট উল্টে তাকিয়ে। রেগে ওর মাথায় চাটি মারলাম জোরে। ব্যাথাদায়ক শব্দে নিসা বলে, “মারিস কেন শুধু শুধু! আমার মারার কথা উলটো তুই মারছিস!”

“বাজে কথা বললে তোকে পূজো করব? ইনি আমাদের বাসার নতুন ভাড়াটে!”

সন্দিহান চোখে, “বাড়িওয়ালিরা ভাড়াটেদের সাথে অমন চিপকে থাকে? ভাওতা মার মিয়া!?”

“থাপড়াই তোমার ভাওতা ধরা বের করব! বলছি না বাসার ভাড়াটে!” মুখটা গম্ভীর করে, “বফ হলে দুইহাতে জড়ায় ধরতাম! দূরত্ব বজায় রাখতে একহাতে ধরে সিঙ্গেলরা! নয়ত ছেলে যে স্পিডে গাড়ি চালায় তোর মতো বলদ বাদে কেউ মরে গেলেও একহাতে ধরবে না!”

নিসা কিছুক্ষণ বিস্মিত থেকে হেসে ফেলে। আমার বান্ধবীটা বোকাসোকা। সারাদিন হাসে। আর যখন হাসে তখন চারপাশ হাসির শব্দে কাঁপিয়ে ছাড়ে। আজকে স্যার, মেডামদের লুকিয়ে লুকিয়ে প্রত্যেক ক্লাসেই জিসান ভাইয়ের বাড়ি কাজ করেছি। তবু শেষ হয় না। এক সময় ত্যক্ত হয়ে নিসাকে লিখতে দিলাম। নিসা বিস্মিত, “মানে? তোর স্যার বুঝে ফেলবে এটা আমার লেখা!”

“আরে লিখ না। তোকে চিনে নাকি উনি? বুঝবে না।”

নিসা দোদুল্যমান আলস্য নিয়ে খাতা টেনে নিল। বান্ধবীর হাতে বহুত স্পিড। আমি করেছিলাম তিনবার, সে করল চারবার। নিসাও একসময় ক্লান্ত হয়। আমার দিকে খাতা বাড়িয়ে দেয়। কলেজ শেষের ঘন্টা পরে গেল। ঠেলাঠেলির ভিড়ে বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, “কি খাটাশ তোর স্যার!”

“বহুত!” নিসার হাত চেপে ধরে, “নিসা আজকে আমাদের বাসায় থাকবি?”

নিসা চোখ বড় বড় করে তাকায়, “মানে?”

আমি ঠোঁট টিপে হালকা হাসি, “আজকে কোচিংয়ের জন্য রেডি হয়ে একসেট বাড়তি কাঁপড় ব্যাগে ঢোকাবি। আমি আন্টিকে ফোন করে রাজি করিয়ে নিব। ব্যাগ গুছিয়ে একটু আগে বেরোবি ঠিকাছে?”

“কিছু করবি?”

সম্মতি দিয়ে দ্রুত রাস্তা পার হতে হতে চেঁচিয়ে বললাম, “মনে থাকে যেন! দ্রুত বের হবি আজকে!”

নিসা বোকাসোকা চেহেরায় তাকিয়ে থাকে। ভাইয়া গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে বিমল হাসে। আমি ভেঙচি কেটে ড্রাইভারের পাশের সিটে চুপচাপ বসে গেলাম।

বিকেল বেলা। চারপাশে এখন ঝিরঝিরে বসন্ত হাওয়ার মাতন। শুষ্ক, জীর্ণ পাতারা গাছগুলোকে পাতাবিহীন করে লুটিয়ে পরছে মাটিতে। ওদের দাপুটে গম্ভীর পদার্পণে তাই হাওয়ায় হাওয়ায় কখনো দু’একটা পাতা উড়ে আসে গায়ের ওপর। নিসার মাথায় তাদেরই দল বিচ্যুত শালগাছের লালচে হলুদ পাতা সানন্দে লেপ্টে। মেয়েটা সে সম্বন্ধে উদাসীন। মোটা এক শালগাছে হেলান দিয়ে ঘড়ি দেখলাম। আরেকবার মাথা তুলে চারপাশে তাকালাম। নিসা জুতো খুলে জুতোর উপর বসে গেছে। ভাবুক হয়ে আশপাশ দেখছে কখনো আমার দিকে দৃষ্টি ফেলছে। চোখাচোখি হলেই তার বিখ্যাত ভেবলা হাসি প্রদর্শন করে আমাকে ধন্য করছে।

“দোস্ত, পোলার কিন্তু চয়েজ ভাল। দেখ জায়গাটা কি সুন্দর।”

বিরক্তিতে ভ্রু কুচকাই, “ন্যাড়া মাথা সব গাছ ভালর কি দেখিস! বেটা নিজেও সিল্কি চুলের জন্য দিনদিন ন্যাড়া হচ্ছে। এলে দেখবি কপাল কি বড়!” ঠোঁট চিমটে কিছুক্ষণ ভাবি, “মনে হয় দিন দিন নিজের ন্যাড়া হওয়ার রোগটা এফেক্ট ফেলেছে পছন্দের ওপর।”

নিসা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়, বিস্ময়ে বলে, “সে তোর ক্রাশ না?”

উদাসমুখে মাথা নাড়ি। ঐ আসছে ইফাজ দুলকি চালে। মুখ বেকালাম। এই যদি হয় ছেলের সময়জ্ঞান তাহলে কাজ সেরেছে! নিসা তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায়। জুতো কোনমতে পরে কানের কাছে ঝুকে আসে। ফিসফিসিয়ে বলে, “হ্যা, রে এইটা কি সকালের জন?”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে অসম্মতি দিলাম। মেয়েটা আরও মৃদুস্বরে বলল, “ছেলেটা কিন্তু হেব্বি!”

আমি নাক মুখ কুচকে উনার আসাপথে তাকিয়ে থাকি। ছেলেটা এসে বিমল হাসে। নম্রকণ্ঠে বলে, “বেশি দেরি করালাম তোমাদের?”

নিসা মাথা নেড়ে না করে। আমি হ্যা করি। ছেলেটা চোখ বড় বড় তাকায়, বলে, “কারটা সত্যি ধরব?”

নিসা আমার দিকে তাকায়। বললাম, “অবশ্যই আমার। আপনি দেখা করতে আসছেন আমার সাথে তাহলে আমার কথারই প্রাধান্য থাকবে না?”

তিনি মুগ্ধচোখে তাকান। আমি হই বিরক্ত। বিরক্তির আরো একটা কারন এনাকে আমার কেন যেন আর ভাল লাগছে না। বারবার সকালের সুগন্ধিটা ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে পুরো অনুভূতিকে। আশ্চর্য সচেতন হয়ে যখন বুঝতে চাইছি সুগন্ধির উপস্থিতিটা সত্যি কিনা তখন আর পাচ্ছি না!

“আসলে বন্ধুদের আড্ডায় আটকে গেছিলাম।”

এবার আমি কোমড়ে হাত রেখে উনার দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যাই। ভ্রু কুঞ্চিত। তিনি আমার লড়াকু ভঙ্গিমায় ভড়কে যান। ভড়কায় নিসা। এক আঙুলে শাসিয়ে বলি, “চিঠিতে কি বলেছিলাম আপনাকে? চিঠিটা জনে জনে দেখাতে?”

তিনি থ’মুখে বলেন, “চিঠি? কিসের চিঠি?”

“এই একদম ঢং করবেন না। নিজে তো পড়েছেনই বন্ধুকেও পড়িয়েছেন!”

কুঞ্চিত ভ্রু’তে, “আমি কোন চিঠিই পাইনি! না পেলে দেখাবই বা কি? আর তুমি কোন বন্ধুর কথা বলছ?”

বজ্রাহত অবস্থায় কয়েক মুহূর্ত কাটল। তবু সেই ভাব কাটিয়ে নিসার দিকে তাকালাম। ওর বিস্ময়ভাব কাটেনি এখনো। ধাতস্থ হয়ে তেড়ে গেলাম, তিনি পিছিয়ে যান, “মিথ্যে বলবেন না মশাই। রাধিকা আপুর বিয়েতে আমি আপনার পাঞ্জাবির পকেটে চিঠি ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।”

তিনি চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, বলেন, “কখন দিয়েছিলে?”

“যখন বিয়ে পড়ানো হচ্ছে!”

তিনি অনেকক্ষণ ভাবেন, বলেন, “না আমি বাসায় এসে কিছু পাইনি পকেটে। ইভেন, বিয়েবাড়ি থাকতেই অনেকবার দুই পকেটে হাত দেয়া পরেছে তখনও পাইনি!”

এবার সত্যিই চুপ মেরে গেলাম। তিনি নিসার দিকে তাকালেন। আমাকে বললেন, “থাক বাদ দেও। হয়ত পকেটে ঢোকাতে গিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছ। চলো কোথাও বসি।”

এবার দ্বিরুক্তি করলাম না। হাঁটতে লাগলাম তিনজনে। তিনি নিসার সাথে পরিচয় হলেন। টুকটাক কথা চলতে থাকল উনাদের। ইফাজ তবু মাঝে মাঝে আমার দিকে চাইছে। চিঠি যাকে দিলাম সে জানে না আর জিসান ভাই জেনে বসে আছেন এটা হলো কিছু!? ইফাজ এক খোলামেলা দোকানে আনলেন আমাদের। বেঞ্চি, টেবিল বাইরে পাতা। এক টেবিল দখল করে বসলাম আমরা। ইফাজ গেলেন কিছুদূরে মাথা চোখা হাফ বিল্ডিংয়ের ভেতর। নিসা এসময় চিমটি কাটল হাতে, “এমন ব্যবহার করছিস কেন উনার সাথে? এমন ব্যবহারে কেউ পটবে!?”

বিস্মিত হয়ে বললাম, “কে পটাবে একে!?”

“তাহলে কোচিং মিস দিয়ে এলাম কোন দুঃখে!”

“জবাব নিতে! ইনি আমার চিঠি কেন অন্যকে পড়তে দিবেন! পার্সোনাল বলতে কিছু নাই নাকি উনার?”

নিসা পাশ থেকে হাত চেপে ধরল, “আস্তে বল। উনি শুনবেন!”

ভেঙচিয়ে, “উনি শুনবেন! আহা দেখা হলো না রূপে পটে গেলি। এবার বুঝলাম কেন সিল্কিচুলো টাকলারা বয়স হলেও কুমার থাকে!”

নিসা অসন্তুষ্ট মুখে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় ইফাজ আমাদের সামনের ফাঁকা চেয়ারে এসে বসেন। বলেন, “তুমি ফেসবুকে একরকম বাস্তবে আরেক!”

প্রশ্নের ইচ্ছা জাগল না। উনার দিকে একবার তাকিয়ে ঐ বিল্ডিংটায় মুখ ঘোরালাম। নিসার কৌতুহলে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”

“কথা বলে তখন খুব চঞ্চল মনে হয়েছিল ওকে। এখন দেখছি উলটো!”

নিসা বিগলিতে হাসে, “আপনি ভুল ভাবছেন। ঝুম কাছের বাদে অন্য কাউকে নিজের আসল রূপ দেখায় না। আস্তে আস্তে বুঝবেন।”

“ওহ, তোমার তাহলে আমাকে পছন্দ হয়নি?”

প্রশ্নটায় স্বাভাবিক মুখে উনার দিকে তাকাই। তিনি কৌতুহলে ভ্রু নাচান। তার উত্তর না দিয়ে উলটো প্রশ্ন করি, “আচ্ছা মনে করে দেখুন তো কনের কবুল বলার পর কেউ আপনার ডান পকেটে হাত দিয়েছিল?”

তিনি হাসেন, “তুমি হয়ত ভুলতে পারছ না ব্যাপারটা!”

“আরে আপনি ভাবুন না!”

তিনি কিছুক্ষণ ভাবেন। বলেন, “না কেউ..এক মিনিট এক মিনিট মনে পরেছে। শাফি তার কিছু সময় পর আমাকে ক্যামেরা ধরিয়ে ছবি তুলতে বলে ডান পকেটে লাইটার খুজছিল।”

সুচালো দৃষ্টিতে বললাম, “উনি যখন হাত বের করেন আপনি তখন উনার হাতে কিছু দেখেছিলেন?”

“আমি তো তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত..”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “ভাল করছেন ভাই। কপালে লাল বাত্তি জ্বালাই দিছেন।”

ইফাজ নিসার দিকে তাকালেন। নিসা বলল, “কি বলছিস এসব!”

নিসার হাত টেনে উঠালাম। বললাম, “উঠ। কোচিংয়ের সময় চলে যাচ্ছে।”

নিসার চোখ বিস্মিত। বিস্মিত ইফাজ। জোড়া পুরু ভ্রু কিছুটা কুঞ্চিত। বললাম, “অর্ডার করা খাবারগুলো এখন একা খেয়ে মাশুল দেন। আমরা আসি।”

“আজব তো কিসের দোষে? দোষ না করেও শাস্তি নিব?”

“আজব, তাজব বলবেন না একদম। আপনিই মস্ত আজব। জলজ্যান্ত এক মানুষ আপনার পকেট থেকে বড়সড় খাম নিয়ে নেয় আর আপনি টেরই পান না! মানে হয় কোন?”

হতবুদ্ধ নিসাকে টানতে টানতে পথ ধরলাম। একবার জ্বলন্ত চোখে পেছনে তাকিয়ে ছিলাম। বিরক্তি রাগ আরও পেয়ে বসল। পাগল নাকি ছেলেটা! একটা মেয়ে অপমান করে চলে যাচ্ছে আর তিনি দিব্যি হেসে যাচ্ছেন! আশ্চর্য!

চরম বিরক্তি, রাগের অনুভূতির মাঝে একইসাথে কখনো কি মুগ্ধতা অনুভূত হওয়া সম্ভব? আমার সাথে ব্যাপারটা হচ্ছে। আমি রেগে কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকেও ঠোঁট টিপে নিশব্দে হাসছি। আমি হয়ত পাগল হয়ে যাচ্ছি। জিসান ভাই নিমগ্ন চিত্তে খাতা দেখছেন। আমি উনাকে। উনার উঁচু নাক, চিবুক, টেপা ঠোঁট, গালের ডেবে থাকা অংশে এত ভাল লাগা মিশে কেন! আমি বিরক্ত হয়েও মুগ্ধতায় গুলিয়ে ফেলছি অনুভূতিদের! উনি একসময় মুখ তুলেন, গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “মাঝখানে এগুলো কার লেখা?”

~চলবে❤️