তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-০৫

0
345

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-০৫

ভোর হতে না হতেই আর্শিকা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো।গন্তব্য কোনো এক নিরুদ্দেশে। কিছুদূর সামনে যেতেই একটা মাইক্রোতে উঠে একটা এতিমখানায় চলে আসলো।হাতে অনেকগুলো চকলেট,জামা আর বইখাতা। আর্শিকা যাওয়ার সাথে সাথে এতিমখানার সব বাচ্চারা একসাথে মেহু আপি বলে চিৎকার করে আর্শিকাকে ঘিরে রাখে।আর্শিকা সবার সাথে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে সবাইকে চকলেট ও যাবতীয় জিনিসপত্র দেয়।এরইমধ্যে এতিমখানা দেখাশোনার ম্যাম চলে আসে।আর্শিকা তার সাথে সবিনিময়ে সালাম বিনিময় করে।মিস আর্শিকার উদ্দেশ্য বলে,

“এসব কি মেহু?প্রত্যেক মাসে তোমার বাবা তো এইসব…..”

আর্শিকা মিস.কে থামিয়ে দিয়ে বলে,”মিস এটা আমার মায়ের প্রিয় জায়গা। এই জন্য বাবা তার স্ত্রীর কথা রাখতে এখানের এতিমদের সব দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু এটা আমার প্রিয় জায়গা তাই আমি এখানকার সব কাজ করি।এসব বাচ্চাদের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে।এদের দেখলে নিজেকে একটু হলেও সুখী মনে হয়।ওদের তো বাবা-মা নেই আর আমি বাবা থাকতে এতিম।”

শেষের কথাটা আর্শিকা অনেকটা কষ্টের সাথে বলল।মিস এসব কিছু জানে।একটা রাত যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা তিনি ছয় বছর আগেই জানতে পেরেছেন।ছয় বছর আগে এই আর্শিকা পাথর হয়ে এই এতিমখানায় ফিরে এসেছিল।তখন প্রায়ই আর্শিকা পাগলের মনে আচরণ করতো।অনেক কষ্টে এসব বাচ্চারা আর মিস মিলে আর্শিকাকে স্বাভাবিক করতে পেরেছে।তাও আর্শিকা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক না মাঝে মাঝে রেগে অনেক অস্বাভাবিক কাজ করে, কখনো কখনো তো নিজের ক্ষতিও করে।

“ওকে মিস আমার ভার্সিটি আছে।আজ অনেক মনটা খারাপ লাগছিলো তাই দেখে গেলাম। নেক্সট আবার আসবো।”

আর্শিকা বের হতে গেলেই একটা বাচ্চা মেয়ে আর্শিকার ওড়না টেনে ধরে।আর্শিকা পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে বয়স ৪/৫ বছর হবে। বাচ্চা মেয়েটা তার আদুরী গলায় আর্শিকাকে বলে,

“মেহেপু তুমি তলে যাবে?”

“না আপু আমি আবার আসবো তো।তখন তোমার জন্য আরও বেশি করে চকলেট নিয়ে আসবো।”

“তামনে আমাদের তন্মদিন তুমি আতবে তো?”

আর্শিকা মুচকি হেসে বলে,”নিশ্চয়ই।সেদিন তোমাদের সবার জন্য এতো এতো গিফট নিয়ে আসবো।”

আর্শিকার কথায় বাচ্চা মেয়েটা খুব খুশি হয়ে যায়। খুশিতে বাচ্চা মেয়েটা আর্শিকাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়।

✨✨

নয়না আর্শিকার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুধু নয়না না সবাই আর্শিকার দিকে একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কিন্তু আর্শিকা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কোল্ড কফিটা খাচ্ছে।নিরবতা ভেঙে নয়না বলে,

“এতো সকাল সকাল এতিমখানায় তোর কি?”

“পিকনিক খেতে গেছিলাম।”

আর্শিকার ডোন্ট কেয়ার কথায় পিহু বলে উঠে,”এহহহ এতো সকাল সকাল পিকনিক?পিকনিক তো মানুষ রাতে করে?”

জয়া পিহু মাথায় চাপ/র মে/রে বলে,”আরে বুদ্দুরাম ও ফান করছে এটাও বুঝিস না।তা আশু এতো সকালে এতিমখানায় কি করছিলি?”

নয়না জয়ার সাথে তাল মিলিয়ে বলে,”আমি দেখেছি তুই ওদেরকে কিছু গিফট দিচ্ছিলি কিন্তু কেনো?”

আর্শিকা নয়নার কথায় ভ্রু কুচকে বলে,”বাই এনি চান্স তুই কি আমাকে ফলো করছিস?”

“জ্বি না আমার এতো ঠেকা পড়ে নি আমি আপনাকে ফলো করবো। আমার বাসায়ই ওইদিকে সকালে বের হতে গিয়ে তোকে দেখতে পাই তাই জিজ্ঞেস করছি।আর আমাদের জানা মতে তোর পরিবারের অবস্থা এতোটাও সচ্ছল না সেখানে তুই সমাজসেবা করছিস?”

নয়নার কথায় আর্শিকা বলে,”সমাজ সেবা করতে বুঝি পরিবারের অবস্থা সচ্ছল হওয়া দরকার?”

“না কিন্তু…”

“আমি ওসব আমার মা’য়ের টাকা দিয়ে করেছি।আমার মা এতিমদের সাহায্য করতে পছন্দ করতো তাই আমিও ওদের সাহায্য করি।”

জয়া আর্শিকার কথার প্রসঙ্গে বলে,”তোর বাবা?”

“আমার বাবা তার স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে।তিনি নিজে এতিমদের জন্য টাকা পাঠিয়ে দেয়।”

পিহু না বুঝেই আর্শিকা প্রশ্ন করে ফেলে,”আচ্ছা আশু বেবি আঙ্কেল কি করে রে?তার তো আজ পর্যন্ত দেখাই পেলাম না।”

পিহু অবুঝ প্রশ্নে হটাৎ করেও আর্শিকা বুকটা ধক করে উঠে।পুরোনো স্মৃতি ভেসে উঠে।মুহুর্তেই আর্শিকা ক্ষিপ্ত বাঘিনীর মতো পিহুর প্রশ্নে হামলে পড়ে বলে,

“বন্ধুত্ব তোদের আমার সাথে আমার বাবার সাথে না।তোরা আমার বিষয়ে জানবি অন্য কাউকে নিয়ে আমাকে কেনো প্রশ্ন করবি?নেক্সট টাইম আমার পরিবার আর বাবাকে নিয়ে কিছু বললে তোদের সাথে আমি আর বন্ধুত্বই রাখবো না।”

বলেই আর্শিকা আর একমুহুর্ত দেরি না করে আর্শিকা দ্রুত বেগে চলে যায়।আর্শিকা যাওয়ার পথেই কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তির সাথে ধাক্কা লাগে। ধাক্কা লাগার ফলে সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির গায়ে গরম কফি পর্যন্ত পড়ে যায়।কিন্তু আর্শিকা সেদিকে না তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,

“চোখ কি কপালে নিয়ে হাটেন নাকি পকেটে নিয়ে হাটেন?সরুন সামনে থেকে যতসব লোকজন সামনে পড়ে বিরক্ত শুরু করে।”

আর্শিকা কথাগুলো বলতে বলতে চলে যায়।জয়া পিহুকে রাগ করে বলে,

“কেনো আশুকে রাগাতে গেলি বল তো?তোরা তো জানিসই আশু রেগে গেলে নিজের কি যে করবে তা ওর কোনো হুসই থাকে না।”

পিহু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”আমার কি দোষ বল তো?আমরা তো ওর ফ্রেন্ড সেই স্কুল লাইফের শেষের দিকে ফ্রেন্ড আমরা স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে ভার্সিটি লাইফে এসে পড়েছি অথচ ও আমাদেরকে ওর পরিবার নিয়ে কিচ্ছু বলে নি।ইভেন নিজের বাড়ি নিয়েও কিছু বলে নি।আমরা শুধু জানি আর্শিকা নামে আমাদের একটা ফ্রেন্ড আছে দ্যটস ইট।আমাদের কি ওকে নিয়ে জানার কোনো অধিকার নেই।”

পিহুর প্রশ্নে ঠিক কি উত্তর দিবে তা জয়ার জানা নেই।আর্শিকার সব থেকে ঘনিষ্ট ফ্রেন্ড জয়া নিজেই।কিন্তু আজ পর্যন্ত আর্শিকার নিজস্ব কোনো কথাই আর্শিকা জয়ার সাথে শেয়ার করে নি।মাঝে মাঝে মনে হয় আর্শিকা শুধুমাত্র নাম রক্ষার্থে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে রেখেছে।

✨✨

অনেক কষ্টে জয়া আর্শিকাকে মানিয়ে ক্লাসে নিয়ে আসে। তারপর ৪ জনে মিলে একসাথে ক্লাসে যায় কিন্তু ক্লাসে গিয়ে দেখে মহা বিপত্তি তাদের জায়গার একটা ছেলে ক্যাপ পড়ে বসে বসে ফোন টিপছে।এমন ভাবে ক্যাপ দিয়ে মুখটা ঢেকে রেখেছে যে মুখ দেখার উপায় নেই। আর্শিকা এমনিতেই রেগে ছিলো, আবার এই ছেলেটাকে নিজের জায়গায় বসে থাকতে দেখে আর্শিকা মাথা ধপ করে উঠলো। সোজা গিয়ে বেঞ্চে ধপাস করে হাত রেখে রাগান্বিত স্বরে বলে,

“এই ছেলে এটা আমাদের সিট তুমি এখানে বসেছো কেনো?উঠো এখান থেকে।”

ছেলেটা আগের অবস্থায় থেকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে মাথা তুলে বলে,”এখানে কি কোথায় তোমার নাম লিখা আছে?”

“মানে?”

“মানে সিট সিট বলে যে তর্ক করছো তা সিটটা কি তুমি কিনে নিয়েছো নাকি?”

জয়া ছেলেটার প্রশ্নে বলে,”সবাই জানে আমরা এখানে বসি।”

“সবাই জানুক আর না জানুক তাতে আমার কি?আমি এখানে এসে আগে বসেছি সো এখানে আমিই বসবো।”

পিহু তেজ দেখিয়ে বলে,”এই এতো কথা কিসের ছেলেটা না উঠলে টেনে তুলবো।”

“তোমরা কি ৩/৪ এর বাচ্চা যে সিট নিয়ে ঝগড়া করছো?”

নয়না স্বাভাবিক গলায়ই বলে,”তো আমরা না’হয় ৩/৪ এর বাচ্চা আর আপনি না’হয় বুড়ো তো এতো ভদ্র ভাবে বলার পরও কেনো শুনছেন না?”

আর্শিকা রেগে গিয়ে ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,”দেখুন আমরা ৪ জন আর আপনি একা। আপনাকে এখান থেকে টেনে তুলে চ্যাং-দোলা করে নিয়ে ক্লাসের বাহিরে ফেলে দিতে আমাদের কিন্তু ২ মিনিটও লাগবে না। সো ভালোর ভালোয় বলছি উঠুন।”

ছেলেটা মুচকি হেসে বলে,”দল বেঁধে তো কুকুররা আসে,সিংহ তো একাই রাজ করে।”

ছেলেটার উত্তরে চার ক্ষিপ্ত নারী ছেলেটার দিকে আঙুল তাক করে বলে,”এইইইইই….”

“ওকে ওকে প্রিটিরা আপনারাই এখানে বসুন, আমি চলে যাচ্ছি।তবে দেখবো এই সিটে এই চারজন কতক্ষণ বসে থাকতে পারেন”

বলেই ছেলেটা ডেভিল হাসি দিয়ে চলে যায়।এদিকে ছেলেটার কথায় ৪ জনেরই মাথা গরম হয়ে গেছে।পিহু রাগী গলায় বলে,

“কি আমাদের আলাদা করবে?দেখি কত সাহস আমাদের আলাদা করে?”

নয়না পিহুর সাথে তাল মিলিয়ে বলে,”একদম আলাদা করতে আসলে চ্যাং-দোলা করে উগান্ডায় পাঠিয়ে দিবো।”

আর্শিকা এখনো নিশ্চুপ। হয়তো রাগ সংবরণের চেষ্টা চালাচ্ছে।কিন্তু আর্শিকার কেনো জানি মনে হচ্ছে ছেলেটাকে সে আগেও দেখেছে। কিচ্ছুক্ষণ পরে ছেলেটা আবারও ফিরে আসে কিন্তু এখন তার সাজসজ্জা কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।চোখে চশমা, উপরে যে কালো কোর্ট পড়ে ছিলো তা নেই বরং সাদা রঙের একটা শার্ট, পুরো ফরমাল ড্রেস। ছেলেটা ক্লাসে আসলে কেউ তার দিকে তেমন কোন রিয়েক্সন দেয় না।তাই ছেলেটা নিজের হাত দিয়ে বেঞ্চে সজোরে বারি মারে।যার আওয়াজে সবাই থমকে যায়।

“এটেনশন স্টুডেন্ট। ইন্ট্রোডাকশন মাইসেল্ফ। আ’ম রাদাফ ইসলাম, নিউ প্রফেসর অফ দিস ভার্সিটি।”

কথাটা বলার সাথে সাথেই ক্লাসে সবাই চরম অবাক হয়ে যায়। বিশেষ করে সেই চার ব্যক্তি। আর্শিকার এবার চিনতে আর একমুহুর্তও দেরি হলো না যে এই সেই ব্যক্তি যে কি’না ৬/৭ মাস আগে তার ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছিল আর আজ তার প্রফেসর। সবার অবাকতার মুখ দেখে রাদাফ মুচকি হেসে বলে,

“আসলে আমার টিচিং স্টাইল আলাদা।আমি প্রথমে স্টুডেন্টদের সাথে মিশি তারপর তাদের পড়াই। বলতে গেলে একটু ইউনিকলিই মিশি।”

রাদাফের কথার মাঝে পিহু আর্শিকা চিমটি কেটে বলে,”আশু বেবি,আমি তোকে একটা চিমটি কাটি, আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি তা একটু দেখি?”

আর্শিকার উত্তরের আগেই পিহু জোরে চিমটি কাটে। আর্শিকা জোরে আহ বলে চিৎকার করে পিহুকে রাগান্বিত চোখে তাকালেই পিহু ভ্যাবলাকান্তের হাসি উপহার দেয়। রাদাফ আর্শিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“হেই স্ট্যান্ড আপ। ”

আর্শিকা রাদাফের কথা মতো উঠে দাঁড়ায়।

“কি হয়েছে ওখানে?”

“নাথিং স্যার।খুব মশা তো তাই।”

“কিইই ক্লাসে মশা?”

“জ্বি স্যার এত্তো বড় মশা তাই তার কামড় একটু জোরেই লেগেছে।”

“ক্লাসে এসে মজা নিচ্ছো আমার সাথে?গেট আউট অফ মাই ক্লাস।”

“বাট স্যার….”

“আই সে গেট লস।”

রাদাফ বেশ জোরেই আর্শিকাকে ধমক দেয়।যা শুনে আর্শিকা সহ পুরো ক্লাস কেঁপে উঠে।উপায়ন্তর না পেয়ে আর্শিকা ক্লাসের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।আর পিহু এবং তার স্যারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে।

“উলুকুন্ডার ভেড়া,পেটকাটা মহিষ,ছাগলের চার নম্বর বাচ্চা,টিকটিকির মামা,ভুড়িওয়ালা উট।দোষ করলো পিহু আর সাজা পেলাম আমি।তোরে যদি আমি তেলাপোকার সুপ না খাওয়াইছি না তাইলে আমার নামও আর্শিকা না।”

#চলবে