তোমার আসক্তিতে আসক্ত পর্ব-০৪

0
330

#তোমার_আসক্তিতে_আসক্ত
#সুবহী_ইসলাম_প্রভা
#পর্ব-০৪

সকাল বেলা রাদাফ উঠতেই আর্শিকাকে কোথাও নজরে পড়ে না।রাদাফ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে।বাসার আশেপাশে খুঁজেও রাদাফ আর্শিকার খোঁজ পায় না।রাদাফ চিন্তিত হয়ে বিছানায় বসতেই একটা চিরকুটে একটা পাথরে আটকানো দেখতে পারে।রাদাফ চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে,

আপনাকে ঠিক কি বলে সম্মোধন করব তা আমার জানা নেই। আমার জন্য যা করেছেন তার জন্য অনেক শুকরিয়া।বাকি রাস্তাটা আমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারব।ভালো থাকবেন।”

রাদাফ চিরকুটটা পেয়ে একটু রাগ হলো।যার জন্য এতো কিছু করেছে অথচ সে কি না না জানিয়েই চলে গেলো।বিষয়টা রাদাফের আত্ন-সম্মানীতে আঘাত হানে।রাদাফ বুঝে গেছে,এই দুনিয়ায় ভালো কাজের কোন মূল্য নেই।সাথে সাথে রাদাফের ভিতর থেকে হতাশা বেরিয়ে এলো।নিজের সমস্ত জিনিস নিয়ে রাদাফও নিজ গন্তব্যে বেরিয়ে গেলো।

✨✨

ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে জয়া,পিহু,নয়না আর আর্শিকা বসে আসে।সিলেট থেকে ফেরার এক সপ্তাহ পর আর্শিকা ভার্সিটিতে এসেছে।সিলেটের বৃষ্টিতে ভিজে আর্শিকা এই এক সপ্তাহ মারাত্নক জ্বরে আক্রান্ত ছিলো,তাই ভার্সিটিতে আসা হয় নি।ভার্সিটিতে এসে আর্শিকা সবাইকে প্রতীক আর জোহার বিয়ের সব কথা জানায় দেয়। মূল কেন্দ্র আজ আর্শিকা,তাদের বন্ধুমহলের সবাই আর্শিকা আর প্রতীকের বিষয়টা জানতো এমনকি প্রতীকের সাথে সবাই মিটও করেছে।প্রতীক এমন একটা কাজ করবে তা সবারই কল্পনাতীত।সবাই আর্শিকাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।জয়া আর্শিকাকে বলে,

“দোস্ত এসব বাদ দে।যা হওয়ার হইছে তুই এটা নিয়ে মুড অফ করিস না প্লিজ।তোকে এমন মুড অফ দেখলে আমাদের ভালো লাগে না।”

জয়ার সাথে তাল মিলিয়ে পিহু বলে,”আরে চিল ইয়ার।এরকম কত ছেলে আসবে আর যাবে।আর এমনিতেও ছেলেরা এমনই একটা নতুন পেলো তো পুরানকে ভুলে যাবে।”

পিহুর পরিক্ষেপে নয়না পিহুকে ধমক মেরে বলে,”চুপ কর পিহু।তোর বাজে বকা বন্ধ কর।ভুলে যাস না আমাদের বাবা ভাইও ছেলে তার মানে কি তারাও খারাপ?”

পিহু কিছু বলতে গেলেও জয়া চোখের ইশারায় পিহুকে থামতে বলে।ছেলেদের নিয়ে কোন কথাই নয়না সহ্য করতে পারে না।নয়না পিহুর কথার টান ধরে বলে,

“প্রতীক ভাইয়া নিশ্চয়ই কোনো বিপদে পড়েই বিয়ে করেছে।নইলে কেনো সে আমাদের আর্শিকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে? আর যদি করতোই তাহলে জোহাকেই বাহ কেনো?আর্শিকে কষ্ট দেওয়ার জন্য? আরে প্রতীক ভাইয়া জানতোই নাহ জোহা আর্শির বেস্ট ফ্রেন্ড।”

নয়নার কথায় আর্শিকা সবার মধ্যমণি থেকেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,”প্রতীক সব জানতো।”

আর্শিকার কথা শোনার সাথে সাথে বন্ধুমহলে যেনো একটা বড় সড় বোম ফাটলো।আর্শিকা সবার মুখ দেখেই বলে,

“তোদের কি মনে হয়?প্রতীক খুব ভালো। দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা।হা হা হা তাহলে বলবো তোরা প্রতীককে চিনিসই নি।৬ মাস আগে প্রতীক তার পরিবারকে ম্যানেজ করতে পরিবারের কাছে যায়।কিন্তু তার পরিবার আমাকে মেনে তো নেয়ই না উল্টো আমার পরিবারকে নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা শুরু করে। ইভেন আমাকে নিয়েও সে কত কথা।জোহার সাথে প্রতীকের কোন এরেঞ্জ ম্যারেজ না জোহা নিজে বলেছে জোহার সাথে প্রতীকের ৬ মাসের সম্পর্ক।প্রতীক আমাকে পিছন থেকে ছুড়ি মেরেছে।তবে ও শুধু আমাকে না জোহাকেও পিছন থেকে ছুড়ি মেরেছে।ও জোহাকে নয় জোহার বাবার সম্পত্তির জন্য ওকে বিয়ে করেছে।আর বেচারি জোহা ও তো জানতেও পারলো না ও কোনো গিরগিটির সাথে সংসার বেঁধেছে।”

আর্শিকার কথার প্রেক্ষিতে নয়না বলে,”তুই এসব জানলি কি করে?”

“এই এক সপ্তাহ আমি যেমন বেড রেস্টে ছিলাম তেমনিই সব জেনেছি।”

আর্শিকার উত্তরে পিহু হাত তালি দিয়ে বলে,”ইয়েপ জিওওওঅঅ এই না হলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর্শি কেয়া চিজ হে তু আগার মে লারকা হোতা তো তুমসে নিকা কার লে তি?”

পিহুর এমন সিরিয়াস মোমেন্টে ফান কথা সবার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো লাগলো।নয়না পিহুর মাথায় চাপর মে/রে বলে,

“তোর কি এই উদ্ভট কথা ছাড়া আর কোনো কথা থাকে না।এখানে সিরিয়াস কথা হচ্ছে আর তুই এখন বিয়ের কথা বলছিস।রোজ যে ১০১ টা ক্রাস খাও তাতে তোর হয় না?”

নয়নার সাথে সাথে জয়াও বলে,”আসলেই রে এই পিহুটা দিন দিন ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছে।নাম পিহু হবে ঠান্ডা তা না পুরো আগুন হয়ে থাকে।”

পিহু আর্শিকার দুই কাঁধ জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে,”দেখ না আশু বেবি সবাই আমাকে বকছে তোকে বিয়ে করবো বলে?আমি কি ভুল কিছু বলেছি বল বেবি।”

“না তুই যদি ভুল বলিস তাহলে তো আমরা রসাতলে যেতাম।”

“আশু বেবি শেষে কি না তুইও আমাকে লেগ পুল করছিস।যা তোদের সবার সাথে আড়ি।”

ঠোঁট উল্টেই কথা গুলো বলে পিহু একটু দূরে গিয়ে বাচ্চাদের মতো মুখ ফুলিয়ে বসে রইলো।এদিকে পিহুর এমন মুখ ফুলানো দেখে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।নয়না পিহুর দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আর্শিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“তুই তাহলে প্রতীক ভাইয়াকে কিচ্ছু বলিস নি?”

জয়া বলে,”আরে বলবে কি করে?ও তো রাগে দুঃখে ওখান থেকে চলেই এসেছে।আচ্ছা আশু যেই মানুষটাকে তোকে ঠকালো তুই কি না তার জন্যই কষ্ট পেয়েছিস?”

আর্শিকা জবাবে মুচকি হেসে বলে,”আমি একবারও বলেছি আমি প্রতীকের জন্য কষ্ট পেয়েছি?আমি কষ্ট পেয়েছি জোহার জন্য। যখন ও জানতে পারবে তখন আমাকে অবিশ্বাস করবে না তো?আর প্রতীকের এসব কাজ আমি ৪ দিন আগেই জানতে পেরেছি তাই ওর জন্য তো নিতান্তই কষ্ট পাই নি তা নাহ পেয়েছি।বিশ্বাস করেছিলাম তো আর ঠকেছিলাম।”

জয়া আর্শিকার কাঁধে হাত রেখে বলে,”দোস্ত মন খারাপ করিস না।তোর লাইফে ওই শা/লা প্রতীকের চেয়ে আরও ভালো কেউ আসবে দেখে নিস।যে তোকে কোন কিছু ঠকতে দিবে না।”

আর্শিকা জয়ার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,”আর বাঁচতেও দিবে না।যেমনটা ওই প্রতীক করেছে।”

পিহু আনমনে আর্শিকাকে বলে,”আশু বেবি তুই ওই শা/লাকে কিচ্ছু করবি না।”

আর্শিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে হতাস ভঙ্গিতে বলে,”সুখ পাখি ফিরে গেছে আপন নীড়ে, এতে এই দুঃখিনীর করারই বাহ কি আছে?”

✨✨

কেটে গেছে সাত মাস।গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ পার হয়ে হেমন্ত শেষে এসে ঠেকেছে।হালকা হালকা ঠান্ডা আবহাওয়া শীতের আগমন জানান দিচ্ছে। ভার্সিটির ক্যাম্পাস আজ নতুন উদ্যামে সাজানো হচ্ছে। কেনো সাজানো হচ্ছে তা সবার অজানা।কেউ কেউ বলছে ভার্সিটিতে নিশ্চয়ই কোন সেলিব্রেটি আসবে, কেউ কেউ বলছে কোন সম্মানীয় ব্যক্তি আসবে।কিন্তু এসব কোনো প্রভাবই চার মানবীর মন জয় করতে পারছে না। জয়া ফোনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে,

“আচ্ছা ভার্সিটিতে কোনো এলিয়েন আসবে নাকি যে এতো আয়োজন?”

নয়না বলে উঠে,”আরে এলিয়েন আসবে কেনো দেখ ভুত আসছে।আর সেই ভুতকে দেখে পিহু ১২২ টা নাম্বার ক্রাস খাওয়ার রেকর্ডটা ভাঙবে।”

নয়নার সাথে তাল মিলিয়ে আর্শিকা বলে,”তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।ভার্সিটিতে কোনো হ্যান্ডসাম আসবে আর তাকে দেখে আমাদের পিহু বাঁশ খাবে না তা তো ভাবাই যায় না।”

পিহু এত্তোক্ষণ সবার কথা শুনে বেশ ভাব নিয়ে বলল,”হুউউ আমাকে নিয়ে তোদের এই ধারণা? মানলাম আমি একটু ক্রাস খাই তাই বলে এভাবে আমাকে লেগ পুল করবি।মানবো না আমি এই অবিচার?আমি সন্যাসিনী হবো।”

নয়না বলে,”ওহে ওভার এক্টিং এর দোকান তোর ড্রামা বন্ধ কর।তুই আর সন্ন্যাসিনী প্লিজ সন্ন্যাসিনী হয়ে সন্ন্যাসিনীদের অপমান করিস না।”

পিহু রেগে নয়নাকে বলে,”দেখ নয়ন। একদম বাজে কথা বলবি না।আ’ম টু মাচ সিরিয়াস।”

“ফার্স্ট ওফ ওল ওটা নয়ন না নয়না হবে যা তোকে হাজারের উপরেও বলেছি এন্ড লাস্ট অফ ওল এই নয়ন বাহ নয়না যেটাই বলিস আমি যা বলি সঠিক বলি।”

বেশ ভাব নিয়ে নয়না কথাগুলো বলল।পিহু তো রেগে ফায়ার। জয়া আর্শিকার কানে কানে বলে,”আশু এদের থামাতে হবে রে নইলে এখানে বোম ফাটবে।”

“উফফফ জয়া দেখ না আগে আগে হোতা হে কেয়া।যদি ফ্রেন্ডশিপ ঝগড়াই না হয় তাহলে স্ট্রং হবে কি করে?ওরা ঝগড়া করে তাই দেখিস না ওদের বন্ডিং খুব স্ট্রং। আর আমরা দর্শক সো চিল মজা নে।”

আর্শিকা আর জয়া চুপচাপ মজা নেয়।এদিকে নয়না আর পিহু নিজেরাই ঝগড়া করে চুপ হয়ে যায়।সারাদিনে ওরা আর একটা কথাও বলে না।দিনশেষে সবাই সবার নীড়ে ফিরে আসে।আর্শিকা বাসায় আসার সাথে সাথেই বাড়িওয়ালা আন্টি তাদের ঘরে আসে।আর্শিকা ঘরে না ঢুকেই আন্টির সাথে দেখা হয়ে যায়।আর্শিকা সবিনিময়ে সালাম দেয়।বাড়িওয়ালা আন্টিও তার সালামের উত্তর দেয়।

“আর্শিকা শুনো,এ মাসের বাড়ি ভাড়া তুমি দেও নি।এভাবে হলে কি করে হবে আর্শিকা?একেই তুমি এক যুবতী মেয়ে একা একটা বাসায় থাকো? তোমায় নিয়ে আমার বেশ ভয় তার উপর উঠতি বাড়ি ভাড়া দিচ্ছো না। এরকম করলে তো চলবে না।”

“আন্টি এই পর্যন্ত আপনি আমার কোন খারাপ দিক পান নি ইনশাআল্লাহ সামনেও পাবেন না। আমি আপনাকে ২/৩ দিনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া দিয়ে দিবো।”

বাড়িওয়ালা আন্টি আর কিছু বলে না।কেনো জানি আর্শিকাকে আন্টির ভীষণ রহস্যজনক লাগে। আর্শিকার ব্যবহার আচার-আচরণে আর্শিকাকে বেশ বিত্তশালী মনে হয়।কিন্তু আর্শিকার বেশ ভূষণ কোন কিছুই অতিমাত্রার বিত্তশালী নয়।তবে মাঝে মাঝে আর্শিকার আশেপাশে কিছু লোককে দেখা যায় কেমন একটা গম্ভীর প্রকৃতির।বাড়িওয়ালা আন্টি আর ভাবলো না, একটা ভাড়াটে নিয়ে এসব ভাবা তো আর যায়েজ না।

আর্শিকা নিজের রুমে এসে ক্লান্ত হয়ে সটান করে শুয়ে পড়ল।শরীরটা আজ ভীষণ ক্লান্ত। তখনজ তার মুঠোফোমে একটা বার্তা আসে।আর্শিকার দেখার ইচ্ছে না থাকলেও মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে বার্তাটি দেখে।দেখলো একটা নাম্বার থেকে তার বিকাশে ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে।আর্শিকা জানে এটা কার কাজ।আর্শিকা ফোনটা রেখে বারান্দায় চলে যায়। মন খারাপ হলে এটাই একমাত্র জায়গা যেখানে আর্শিকা যেতে পারে।আর্শিকা আকাশের দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে,

“সুখ পাখি উড়ে গেছে অসীম আকাশে,
ফিরে আয় না এই বন্দীনীর গৃহে।”

#চলবে