তোমার তুমিতেই আমার প্রাপ্তি পর্ব-১৩

0
595

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১৩

দরজায় নক করার শব্দে ইমতিয়াজ রহমান কড়া গলায় বললেন
–কাম ইন!

ঈশা দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে সালাম দিলো। ইমতিয়াজ রহমান চোখ তুলে সালামের জবাব দিলেন। ঈশা চোখ নামিয়ে হালকা হেসে বলল
–কেমন আছেন আঙ্কেল?

ইমতিয়াজ রহমান হেসে বললেন
–ভালো আছি মামনি। তুমি এখন কেমন আছো? মেডিসিন নিয়েছ তো?

ঈশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলল। তারপর নরম গলায় বলল
–আমাকে ডেকেছিলেন আঙ্কেল?

ইমতিয়াজ রহমান ঈশার দিকে তাকিয়ে বললেন
–হ্যা।বস।

ঈশা সামনের চেয়ারে বসলো। তিনি ঈশার দিকে তাকিয়ে ধির কণ্ঠে বললেন
–আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই মামনি।

ঈশা নত দৃষ্টিতে মাথা নাড়াল। ইমতিয়াজ রহমান বলতে শুরু করলেন
–ইভান কে নিয়ে কিছু কথা তোমাকে বলবো বলবো করে বলা হয়ে উঠেনি। আসলে আমি সবটাই জানি। তোমাদের মধ্যে কি হয়েছিলো। সবটা আমার জানা। ইভান সেই ছোটবেলা থেকে তোমাকে ভালোবাসে। আমি যখন তাকে পড়ালেখা কমপ্লিট করতে বিদেশে যেতে বলি তখন সে যেতে চায়না। কারণটা জিজ্ঞেস করলে খুব স্পষ্ট ভাবে তোমার কথা বলে।

ঈশা এক হাতে আরেক হাত খুব শক্ত করে ধরল। ইমতিয়াজ রহমানের এসব কথা বলার কারণটা বুঝতে পারলো না। কিন্তু সে শুনতে চায়। তাই চুপচাপ থাকল। তিনি আবারো বলতে শুরু করলেন
–আমি তাকে বলেছিলাম তুমি এখনো ছোট তাই এই মুহূর্তে তোমার আব্বুর সাথে বিয়ে নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। ইভানের পড়ালেখা কমপ্লিট হলে অন্তত আমি এটা নিয়ে কথা বলতে পারি। সে সেটাই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তার আগেই তোমার আব্বু অন্য জায়গায় তোমার বিয়ে ঠিক করে। এতে ইভান অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছিল। আমি অনেক বোঝাই ওকে। নিজেকে সামলে নিলেও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জিবনে কখনও বিয়ে করবে না। কিন্তু নিরবের কথা যখন জানতে পারলো তখন সে তোমার জীবন বাচাতে জোর করেই আংটি পরতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু তুমি সেটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারনি। আমি তোমার দোষ বলবো না। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়। এতো সহজে মেনে নেয়া সম্ভব না। কিন্তু আমি চাইনা এই জোর করে ধরে রাখা সম্পর্কটা নিয়ে তুমি সারাজীবন কষ্ট পাও। আমার মেয়ে হলেও আমি একি কথা বলতাম। আর আংটি তো খুলেই ফেলেছ। এখন আমি বলবো তুমি নিজের মতো করে জীবনটা সাজিয়ে নাও মামনি। খুব তাড়াতাড়ি। কারন ইভান অনেকটাই নিজেকে সামলে নিয়েছে। আমি চাইনা সে তোমার বিষয়ে আর কোন বাড়াবাড়ি করুক। বিষয়টা এখান থেকেই থেমে যাক।

ঈশা চুপচাপ বসে আছে। ইমতিয়াজ রহমান তার চুপ থাকা দেখে বললেন
–আমি কি বলছি সেটা বুঝতে পারছ তো মামনি? আমাকে ভুল বুঝিওনা। আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি। আমার মনে হয় ইভানের কাছ থেকে তোমার দূরত্ব বজায় রেখে চলা উচিৎ। এতে তোমাদের দুজনেরই ভালো হবে।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইমতিয়াজ রহমান কোন উত্তর আশাও করেন নি। কারন তিনি ঈশাকে এসব কথা বলতে ডেকেছিলেন শুধু। আর সে যে কোন কথা বলবে না সেটাও তিনি জানতেন। তাই কথা শেষ করে তিনি বললেন
–তুমি এখন যেতে পার মামনি।

ঈশা সালাম দিয়ে বের হয়ে এলো। ইমতিয়াজ রহমান যে তাকে এসব কথা বলতে ডাকবে সেটা সে ভাবেইনি। আর উনি তো কোন ভুল কথা বলেন নি। ঠিকই বলেছেন। তার ছেলে এতো কষ্ট পেয়েছে। বাবা হিসেবে তিনি চাইবেন যে আর কষ্ট না পাক। সেটাই স্বাভাবিক। আর এই কারনেই তিনি ইভানের থেকে ঈশাকে দূরে থাকতে বলবেন সেটাই কাম্য। বাবা হিসেবে উনি ওনার দায়িত্ব পালন করেছেন। ভাবতে ভাবতেই করিডোরের একটা ফাকা জায়গায় এসে দাঁড়ালো ঈশা। বাইরের দিকে চেয়ে আছে সে। একটা চাপা কষ্ট মনের মাঝে নাড়া দিচ্ছে।
–কি ভাবছিস?

ইভানের গলার আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল ঈশা। ইভান কে ভালো করে খেয়াল করলো। এতদিন মনের মাঝে যে কষ্টটা চেপে ছিল সেটা সে প্রকাশ করতে না চাইলেও ঈশার চোখে ধরা পড়েছিল। কিন্তু ঈশা নিজেকে নিয়ে এতটা ব্যস্ত ছিল যে সেটা নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তার। আজ ইভানের কষ্টটা অনেকটাই কমে গেছে মনে হচ্ছে। চোখে মুখে এক অন্য রকম প্রশান্তি ফুটে উঠেছে। ঈশা না বুঝেই ইভান কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু এখন আর কোন ভাবেই কষ্ট দিতে চায়না। তাহলে কি করবে ঈশা? এমন কি করলে ইভান কোন কষ্ট পাবে না। ইভান এতক্ষন ঈশার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিল কি হয়েছে? কি হয়েছে সেটা বুঝতে না পারলেও সে যে কোন বিষয়ে কনফিউসড সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছে। ইভান ঈশার একটু কাছে এসে দাঁড়ালো। তার গালে হাত দিয়ে বলল
–আর ইউ ওকে জান?

ইভানের কথা শুনেই ঈশার এক অদ্ভুত অনুভুতি হল। এক অন্য রকম ভাললাগা সারা শরীরে বিচরণ করতে থাকলেও মনের মাঝে কোথাও একটা চাপা কষ্ট। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। ইভান বুঝতে পেরে ঈশাকে টেনে নিজের বুকে তার মাথা চেপে ধরে বলল
–কেন কাদছিস? কি হয়েছে আমাকে বল? কেউ কিছু বলেছে তোকে?

ঈশার কান্না যেন থামছেই না। ইভান শক্ত করে ধরে আছে তাকে। ঈশার মাথা তার বুকে থাকায় সে বুঝতে পারছে খুব দ্রুত গতিতে ইভানের হার্ট বিট চলছে যেন এখনি বেরিয়ে আসবে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে তার। ইভানের কষ্টটা ঈশা খুব সহজেই উপলব্ধি করতে পারছে। ঈশার চোখের সামান্য পানি যদি এই মানুষটাকে এতটা কষ্ট দিতে পারে তাহলে তাকে হারানোর কষ্টটা ঠিক কতটা সেটা হয়ত ঈশা আন্দাজও করতে পারবে না কখনও। ঈশা আরও ডুকরে কেদে উঠলো। ইভানের হাতের বাধন আরও শক্ত হয়ে গেলো। এই মানুষটা কে আর কোনভাবেই কষ্ট দেয়ার সাধ্য ঈশার নেই। সে চাইলেও পারবে না। ইভান ঈশার মাথাটা তুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–কি হয়েছে আমাকে বল? আমি থাকতে তোর জিবনে কোন কষ্ট আসবে সেটা আমি কিভাবে মেনে নেই বল?

ইভানের কথা শুনে ঈশা সিক্ত চোখে ম্লান হাসল। সেই হাসিতেই যেন ইভান তার সমস্ত কথার উত্তর পেয়ে গেছে। সেও হাসল। কিছু বলল না। ঈশা চোখ মুছে বলল
–আমার একটু কাজ আছে। আমি আসি?

ইভান মাথা নেড়ে যেতে বলল। ঈশা একটু দূরে যেতেই ইভানের ডাকে আবার থেমে গেলো।
–ঈশা!

ঈশা পিছনে ঘুরে তাকাল। ইভান এগিয়ে এসে বলল
–আব্বু কেন ডেকেছিল?

ঈশা বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে বলল
–খোজ খবর নিতে। আমি কেমন আছি।

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভানের মুখ দেখে এতো টুকু বোঝা যাচ্ছে ঈশার কান্নার কারণটা সে কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু কি সেটা বুঝতে পারছে না। তাই খুব শান্ত সরে বলল
–কাজ শেষ করে সোজা আমার কেবিনে আসবি।

ঈশা মাথা নেড়ে চলে গেলো। ইভান সোজা ইমতিয়াজ রহমানের কেবিনে গেলো। দরজা ঢুকতেই তিনি ছেলেকে দেখে হাসি দিয়ে ভিতরে আসতে বললেন। ইভান চেয়ারে বসলো। তিনি ইভানের দিকে তাকিয়ে বললেন
–কি অবস্থা তোমার?

ইভান খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো
–আব্বু ঈশার সাথে তোমার কথা হয়েছে?

ইমতিয়াজ রহমান ইভানের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললেন
–হয়েছে। কিন্তু আমি যে কারনে ডেকেছিলাম সেটার সঠিক উত্তর পাইনি।

ইভান ভ্রু কুচকে তাকাল। তিনি আবারো বললেন
–আমি আসলে ঈশাকে ডেকেছিলাম তার মনের কথা জানতে। কিন্তু সে কোন উত্তর দেয়নি। তাই আমি আন্দাজ করেই বলেছি যে সে যদি এই সম্পর্কটা মেনে নিতে না পারে তাহলে যেন বিষয়টাকে এখান থেকেই থেমে দেয়। এখন ঈশার উপরে সবটা। আমি চেয়েছিলাম ঈশার দিক থেকে যেকোনো ধরনের পজিটিভ সাইন পেলেই আমি তোমার আঙ্কেলের সাথে কথা বলে একটা ছোট প্রোগ্রাম করে এঙ্গেজমেন্ট টা করে রাখতাম। যে সিচুয়েশনে আংটিটা পরা হয়েছে সেটা আসলে কারও ভালো লাগেনি। তাই নতুন করে ছোট একটা আয়োজন। কিন্তু সে তো আমাকে কিছুই বলল না।

ইভান মলিন হাসল। মাথা নামিয়েই বলল
–ঈশা যে কোনদিনই কিছু বলবে না সেটা আমি জানি আব্বু। ঈশা এমন একটা মেয়ে সে কি চায় সেটা নিজেই জানে না। যদি জানত তাহলে খুব ভালো হতো। আমার জন্য যেকোনো একদিকে যাওয়া খুব সুবিধা হতো। কিন্তু……।

বলেই থেমে গেলো ইভান। ইমতিয়াজ রহমান বললেন
–কিন্তু আমি ঈশার কথা না শুনে তো কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা ইভান। ঈশার দিক থেকে যতক্ষণ কোন পজিটিভ সাইন আসেনি ততক্ষন আমি কোনভাবেই কোন সিদ্ধান্ত নিবনা।

ইভান হেসে উঠে দাঁড়ালো। খুব শান্ত ভাবে বলল
–তোমাকে এখনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে না আব্বু। ছেড়ে দাওনা সবটা সময়ের উপর। ঈশা মুখে কিছু না বললেও সে কি চায় সেটা তো আমি জানি।

ইমতিয়াজ রহমান ছেলেকে থামিয়ে দিয়ে বললেন
–তোমার জানা না জানাতে কোন যায় আসেনা ইভান। ঈশা যেটা বলবে সেটার উপরে ভিত্তি করেই সবটা ঠিক করা হবে। এটাই আমার শেষ কথা।

ইভান কোন কথা বলল না। একটু থেমে বলল
–আমি আসি আব্বু।

বলেই বের হয়ে গেলো। ইভান নিজের কেবিনে এসে দেখে ঈশা এখনো আসেনি। সে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো ঈশার কথা। সবাই এই অনিশ্চয়তার সম্পর্ক নিয়ে অনেক চিন্তিত। কিন্তু ঈশা তো ইভান কে ভালোবাসে। ইভান সেটা ভালো ভাবেই জানে। কিন্তু নিজের মনের কথাটা মুখে উচ্চারণ করতে ঈশার কেন যে এতো সংকোচ সেটা ইভানের জানা নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইভান। এতদিনের অপেক্ষার প্রহর কি কখনও শেষ হবে? কখনও কি ঈশা বুঝবে ইভানের এতো বছরের এই শ্বাস রুদ্ধকর অপেক্ষার কষ্টটা? ইভান এটা ঈশাকে কখনও বুঝতে দেয়নি। কিন্তু ঈশার বোঝা উচিৎ ছিল। ইভান তাকে কতটা ভালোবাসে সেটা সবাই বুঝলে ঈশা কেন বুঝবে না? ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–তুই কি এভাবেই আমার কাছ থেকে সারাজীবন দুরেই থাকবি? আমি যে তোর অপেক্ষায় বসে আছি সেটা কি একবারও দেখিস না। আমার মনের ভালবাসা কষ্ট কিছুই কি তোকে ছুঁতে পারেনা জান? কবে তুই বুঝবি এসব? আমি ব্যর্থ। তোকে আমার এই ভালবাসা বোঝাতে ব্যর্থ। আজ মনে হচ্ছে আমি জীবনের কাছে হেরে গেছি।

খানিকবাদেই ইভান কারও উপস্থিতি বুঝতে পেরে চোখ খুলে দেখল ঈশা সামনে চেয়ারে হাসি মুখে বসে আছে। একটু অবাক হল। চোখ বন্ধ করে নিজের ভাবনায় এতটা বিভোর ছিল যে ঈশা কখন এসেছে সেটা বুঝতেই পারেনি। কিন্তু ঈশার এরকম হাসির কারণটা বুঝতে পারলো না। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কখন এলি?

–মাত্র।

ইভান কোন কথা বলল না। মাথা নিচু করেই টেবিলে রাখা পেপার ওয়েট টার দিকে তাকিয়ে নাড়াচাড়া করছে। ঈশা অনেক্ষন যাবত ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার এরকম আচরনে খুব বিরক্ত হল। একটু ঝুকে দুই হাতে ইভানের কলার টেনে ধরল। ইভান অপ্রস্তুত হয়ে গেলো এমন কাজে। বিরক্ত হয়ে বলল
–হোয়াট?

ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইভানের চোখে চোখ রেখে বলল
–হেরে গেছি শব্দটা সেই মানুষটার কাছে বড্ড বেমানান যে নিজের মানুষটাকে এক নিরস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জিতে নেয়। বাকি দুনিয়ার সব কিছু তার কাছে তুচ্ছ হওয়ার কথা ছিল।

চলবে……