তোমার তুমিতেই আমার প্রাপ্তি পর্ব-০৬

0
656

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৬

ছুটির দিনে আরামের ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল ইভান। হঠাৎ করেই চোখে আলো লাগতেই বিরক্ত নিয়ে পিট পিট করে তাকাল। পুরো চোখ না খুলেই ঘুমু ঘুমু চোখে তাকিয়ে ঈশাকে চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ করেই ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল

–এই মেয়েটা আমাকে মার্ডার করার সব রকম প্রস্তুতি সব সময় নিয়ে রাখে। সারা রাত স্বপ্নে বিচরণ করেই ক্ষান্ত হয়না সকাল সকাল কল্পনাতে বাস্তবের মতো রুপময়ি হয়ে এসে আমাকে জালিয়ে যায়। অদ্ভুত!

আবারো ভালো করে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষন পর নিজের আঙ্গুলে গরম আঁচ লাগতেই ‘আহ’ শব্দে চিৎকার করে উঠে বসলো। হা করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে।

–আমি কল্পনা নয় একদম জিবন্ত। আশা করি এতক্ষনে বিষয়টা মাথায় ঢুকেছে? এখন চা টা খেয়ে নিচে আসো। সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

ঈশা ঝাঝাল কণ্ঠে কথা গুলো বলে বেড সাইডে চায়ের কাপটা রেখে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে ইভান হাত টেনে ধরে। আচমকা এমন হওয়ায় ঈশা ঘাবড়ে যায়। ইভান কণ্ঠে অবাকের রেশ টেনে বলে
–তুই সত্যি?

ঈশা ভালো করে দাড়ায়। একটুক্ষন ইভান কে দেখে নিয়ে বলে
–আমাকে দেখতে পাচ্ছ?

–সে তো আমি সব জায়গাতেই পাই।

ইভানের অবাক করা কথায় ঈশা আবারো বিরক্ত নিয়ে বলে
–কথা শুনতে পাচ্ছ?

–সেটা তো কানে সব সময় বাজেই।

ঈশা ভ্রু কুচকে তাকাল। ইভানের চাহুনি আর কথা বলার ঢং দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে সে ঘোরের মধ্যে আছে। ঈশা কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ত্যাক্ত কণ্ঠে বলল
–এসব নাটক বন্ধ করো প্লিজ! আমি আর নিতে পারছি না।

ইভানের হাতের বাধন আলগা হয়ে গেলো। ঈশা পিছনে ঘুরে দরজার দিকে যেতেই ইভান বলল
–এতো সকালে আমার ঘরে আসার কারণটা জানতে পারি?

ঈশা থেমে গেলো। পিছনে না ঘুরেই বলল
–দাদি এসেছে। নিচে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে বলল।

ইভান মুচকি হাসল। সকাল সকাল এতো খুশির একটা খবর শুনতে পাবে ধারনা ছিল না। দাদি এসেছে মানে এখন ঈশা প্রায় সময়ই এই বাড়িতেই থাকবে। সম্ভব হলে ইভান দাদিকে পার্মানেন্টলি এই বাড়িতেই রেখে দিত। তাহলে অন্তত ঈশার নখরা টা তো কমতো। কিন্তু দাদি গ্রাম ছেড়ে থাকতেই চায় না। যাক এখন যা পাচ্ছে সেটা নিয়েই সে খুশি। ঈশা বের হয়ে যাওয়ার আগেই সে বলল
–তাহলে বিয়ের আগেই বউএর দায়িত্ব পালন করতে এসেছিস। খুব ভালো কথা। তো শুধু শুধু কি শশুর বাড়ির লোকজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করলেই হবে? বরের প্রতিও কিছু দায়িত্ব থাকে তো। সেসব পালন করবি না।

ঈশা পিছনে ঘুরল। শান্ত দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–সবার সামনে বউএর দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করেছ আমাকে। আর আমি কারও অসম্মান করতে চাইনা তাই সবটা মেনে নেই। কিন্তু এখন তো এই ঘরে শুধু তুমি আর আমি। তাহলে কেন অযথা নাটক করছ। সবাই অন্য কিছু জানলেও আমরা তো ঠিক টা জানি।

ইভান বাকা হেসে ধির পায়ে ঈশার সামনে আসল। একটু কাছে এসে মোহনীয় কণ্ঠে বলল
–এক্সাক্টলি! এখন ঘরে শুধু তুমি আর আমি। এই মুহূর্ত টাকে একটু স্পেশাল বানালে কেমন হয়?

বলেই এক হাতে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ঈশা দরজা লাগানর শব্দে ভয় পেয়ে গেলো। ইভান ঈশার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল
–তোমার মতে যদি সেটা নাটক হয়েই থাকে তাহলে আজকে এই নাটকের নায়কের মতো নায়িকার মাঝে হারিয়ে যেতে চাই আমি। তার খোলা চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে উষ্ণ গোলাপি ঠোটের আভায় আজ নিজের ঠোট দুটোকে রাঙ্গাতে চাই।

ঈশা শুকনো ঢোক গিলে পিছিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে গেলো। ঈশার ভয়ার্ত চেহারা দেখে ইভান শব্দ করে হেসে ফেলল। ঈশা ইভানের হাসির শব্দ শুনে চরম রেগে গেলো। রাগি চোখে তাকাতেই ইভান দুষ্টুমির সুরে বলল
–তোর তো খুব সাহস! এই সাত সকাল বেলা একা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডাকতে এসেছিস তাও আবার আমার ঘরে।

ঈশা কাপা কাপা কণ্ঠে বলল
–দ…দাদি বলেছে তাই……

ঈশার কথা শেষ করতে না দিয়েই ইভান বলল
–দাদি বলল আর তুই সাহসি নারির মতো চলে আসলি? একবারও ভাবলি না তোর প্রনয়ে কাতর এই তৃষ্ণার্ত প্রেমিক পুরুষের তৃষ্ণা যদি জেগে উঠে তাহলে কি হবে? কিভাবে সে আটকাবে নিজেকে? দিগ্বিদিক ভুলে যদি কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে তাহলে তার দায় ভার কে নিবে?

ইভানের ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে ঈশার অসস্তি হচ্ছে। সে এই মুহূর্তে ভাবছে কিভাবে এখান থেকে বের হতে পারবে। যদিও বা সে ভালো করেই জানে ইভান তাকে কখনও তার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করবে না। তবুও ইভানের এইসব কথাই ঈশাকে এক অসস্তির রাজ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে। মাথা ঘুরে যায় তার। ইভান আর কোন কথা না বলে সোজা ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বলল
–ছেড়ে দিলাম বলে ভাবিস না এভাবে দাড়িয়ে থাকলে বারবার ছাড় পাবি।

ঈশা চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ইভান মাথা বাকিয়ে সেদিকে তাকিয়ে হাসল।

———–
টি শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো ইভান। ইভান কে দেখে সৃষ্টি এক দৌড়ে এসে কোলে উঠে গেলো। ইভান তাকে কোলে নিয়ে ঈশার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশা সোফায় বসে ইভানের দাদির সাথে কথা বলছিল। সেখানে সুমি আমান আর ইফতি এক সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। ইভান কে দেখে তার দাদি কাছে বসতে বললেন। ইভান এক পাশে বসতে গেলেই তিনি বাধা দিয়ে বললেন
–নাত বউএর পাশে বস।

ঈশা অসস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে গেলো। ইভান একটু হেসে তার পাশে বসলো। ইভানের দাদি ভালো করে তাদেরকে দেখলেন। দুজনকে খুব সুন্দর লাগছে। সুমি তাদেরকে দেখে বলল
–বাহ! দাদি দেখেছ দুজনকে কতো মানিয়েছে।

ইভানের দাদি মুগ্ধ হয়ে তাদের দুজনকেই দেখছিল। তিনি হাসলেন। ইফতি বলল
–আমাকে বেস্ট ফ্রেন্ড বলে। কিন্তু কোনদিন আমাকেও তার মনের কথা বলেনি। আমার ভাইকে ভালোবাসে। তার বউ হতে চায় বললে কি আমি ভাগায় নিয়ে জাইতাম তোরে।

ইফতির কথা শুনে সবাই হেসে ফেলল। কিন্তু ঈশা রাগি চোখে তার দিকে তাকাল। ইফতি সেটাতে পাত্তা না দিয়ে দাত কেলাল। ইভান মুচকি হেসে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশার কালো মুখ দেখে ইভানের মন খারাপ হয়ে গেলো। নিজের বুক চিরে বের হওয়া দীর্ঘশ্বাস টাও লুকিয়ে ফেলল। সে জানেনা তার ভাগ্যে এই মেয়েটার ভালবাসা লেখা আছে কিনা। ছোট বেলা থেকে মেয়েটাকে সে নিজের জিবনের থেকেও বেশী ভালোবাসে। কতো কষ্ট পেয়েছে তার এই সুপ্ত ভালবাসার কারনে। কিন্তু কখনও তার সামনে প্রকাশ করেনি। অপেক্ষা করেছে বড় হওয়ার। কিন্তু বড় হওয়ার পর যখন নিজের সুপ্ত ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করলো তখন ঈশার এসব পছন্দ হতোনা। বারবার মনে হয়েছে ইভানের এসব কেয়ার ঈশার প্রতি অনধিকার চর্চা। যখন বুঝতে পারল ঈশা এসব ভালো ভাবে নেয়না। তখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করলো। কিন্তু প্রেয়সীর প্রতি অধিকার পাবার লোভটা কয়জন সামলাতে পারে? ‘অধিকার’ বড় ভয়ংকর নেশা। একবার এই নেশা ধরলে তা যে কোন কিছুর বিনিময়ে হাসিল করতে মন উঠে পড়ে লাগে। ইভানের ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছিলো। সে একদিন খুব জত্ন করে প্রেয়সীকে নিজের মনের অব্যক্ত কথা প্রকাশ করার জন্য নিয়ে গেলো সবার থেকে অনেক দূরে। কিন্তু সেদিন ঈশা তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে সে ইভান কে কোনদিন ভালই বাসেনি। ইভানের কথাটা শুনে কষ্ট হয়েছিলো ঠিকই কিন্তু আবার নিজেকে সামলে নিয়েছিল। প্রেয়সীর সুখের মাঝেই নিজের সব সুখ খুজে নিতে চেয়েছিল। সুখি দেখতে চেয়েছিল ভালবাসার মানুষটাকে জাকে সে নিজের জিবনের থেকেও বেশী ভালোবাসে। খুব শান্ত ভাবে বলেছিল
–ভালবাসতে হবে না আমাকে। শুধু আমাকে আমার মতো করে ভালবাসতে দিস। বাধা দিস না আমাকে।

ঈশা সেই কথার কোন উত্তর দেয়নি সেদিন। শুধু করুন চোখে তাকিয়ে ছিল। তার সেই দৃষ্টির মানে ইভান এখনো বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু এটা বুঝে গেছে যে ঈশা তাকে ভালোবাসে না। কোনদিন বাসেনি। ইভানের ভাবনার মাঝেই তার দাদি ঈশার মাথায় হাত রেখে হাসি মুখে বললেন
–ছোট বেলা থেকে তুমি আমার কাছে সব বলতে। সব আবদার করতে। কিন্তু আমার এই নাতিকে ভালোবাসো সেটা তো কখনও বলনি। তবে কি জানো দাদু ভাই আমি খুব খুশি হয়েছি। তোমাদের দুজনকে সত্যিই অনেক মানায়।

কথাটা কানে আসতেই ঈশা ওড়না শক্ত করে খামচে ধরে। ইভান সেটা খেয়াল করে।
–ঈশা তোমার অনেক সাহস। সারা বাড়ি ভর্তি লোকজন। সবার সামনে দাড়িয়ে বলেছ যে তুমি ইভান কে ভালোবাসো আর তাকেই বিয়ে করতে চাও। আমি হলে জিবনেও বলতে পারতাম না।

ঈশা সুমির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল। এই মুহূর্তে খুনসুটি পূর্ণ পরিবেশটা ঈশার কাছে গুমোট লাগছে। কারও কথার সাথেই তাল মেলাতে পারছে না। কারন তার জিবনের সেই তিক্ত সময়ের স্মৃতি চারন হচ্ছে। সে এই দিনটার কথা জীবন থেকে ভুলে যেতে চায়। কিন্তু সবাই তার বলা সেই বাক্য গুলো বার বার আওড়ায় ‘আমি ইভান কে ভালবাসি আর তাকেই বিয়ে করতে চাই।‘ কিন্তু কেউ তো জানেনা কি পরিস্থিতে পড়ে সে ওই ঘৃণা ভরা বাক্য উচ্চারন করেছিলো। এটা তো শুধু দুজন মানুষ জানে। সে আর ইভান। ইভান চোখ তুলে ঈশার দিকে তাকাল। তার অবস্থা বুঝতে পেরে পরিস্থিতি সামলাতে বলল
–আমার ক্ষুদা পেয়েছে।

–ঈশা ইভান কে খেতে দে মা।

ছেলের কথা শুনে অপর পাশ থেকে কাজে ব্যস্ত ইভানের মা ঈশাকে উদ্দেশ্য করে বললেন কথাটা। ঈশা আর দেরি না করে উঠে গেলো। সেও চেয়েছিল এমন একটা সুযোগের। আর সেটাও যেন ঠিক মিলে গেলো। ইভান সৃষ্টিকে সুমির কোলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সামনে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবল এই ভাবেই অনেক পরিস্থিতি থেকে ঈশাকে সে রক্ষা করেছে কিন্তু সেটা যে আর কেউ জানে না। আর বুঝতেও দেয়নি কাউকে। নিজের লুকান দীর্ঘশ্বাস টা এবার বড় করে ছেড়ে টেবিলে গিয়ে বসলো সে। প্লেট নিয়ে ঈশার দিকে একবার তাকাল। ঈশার মুখো ভঙ্গি বলে দিচ্ছে তার মনের অবস্থা। ইভান চায়না আর ঈশাকে এই পরিস্থিতে ফেলতে। তাই ঈশা খাবার বাড়তে গেলেই তার হাত ধরে ফেলে। তার দিকে না তাকিয়েই বলে
–আমি নিজেই খেতে পারব। তুই যা।

–কি বলছ এসব? নিজেই তো এই শিকল পায়ে পরেছিলাম। তাহলে কিভাবে মুক্তি পাব এই বন্ধন থেকে।

ঈশার কথা সোজা গিয়ে ইভানের বুকে আঘাত করলো। মুহূর্তেই মনে হল ভিতরটা ক্ষত বিক্ষত করে দিলো। এক হাতে শক্ত করে টেবিলটা ধরল। সমস্ত রাগ যেন উপচে বেরিয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে ঈশার হাত ছেড়ে দিয়ে তার দিকে না তাকিয়েই গলা তুলে বলল
–তোর সামনে পরিক্ষা আর পড়ালেখা না করে তুই আড্ডা দিচ্ছিস? এখনি সোজা বাসায় যা। সোজা গিয়ে পড়তে বসবি। আর এই বাসায় জেন তোকে না দেখি। মনে থাকে যেন? নাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।

ঈশা অবাক চোখে ইভানের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই মানুষটার রুপ বদলায়। অবশ্য এটা আর নতুন কি? ঈশা তো এটা আগেও দেখেছে। কিভাবে মুহূর্তেই একটা মানুষ পুরো গেম বদলে দিতে পারে।

চলবে…………