তোমার নামে হৃদয় পর্ব-১৯+২০+২১+২২

0
276

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (১৯)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
গত এক সপ্তাহে ক্যাম্পাসে একা একাই ক্লাসের সময়গুলো পার করছি। তন্ময় অসুস্থ শরীর নিয়ে এখনো আসেনি। হয়তো আন্টি চাচ্ছেন না সে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ক্যাম্পাসের মুখো হোক। অপরদিকে দোলার খবর জানি না। গত কয়েকদিনে কেন জানি না সে আমার খোঁজ খবর পর্যন্ত নেয়নি। আমার প্রতি তার এতো কিসের অভিযোগ যে এক নিমিষে তিন বছরের বন্ধুত্ব কয়েক সেকেন্ডে নষ্ট করে দিল? সাদিবের সাথে আমার সম্পর্কটা বাকি সব দম্পতির মতো স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এখন আর সেও প্রিয়ন্তির কথা মনে করতে চায় না। সাদিবের সাথের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে গিয়ে এদিকে আমার বাদ বাকি সব কয়টা সম্পর্কের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে হচ্ছে।

ছোট বেলা থেকে আমি একটু ডানপিটে স্বভাবের।যেখানেই যাই সেখানেই অনায়াসে দু’চারটে বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে ফেলতে পারি। প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম তখন একেবারে সঙ্গীহীন হয়েই এসেছিলাম৷ সব বন্ধুবান্ধব অন্য সব ভার্সিটি গুলোতে এডমিশন নিয়েছিল। কেবল আমি ব্যতিক্রম ছিলাম। আমার সাথে আমার কোনো বন্ধুবান্ধব এখানে চান্স পায়নি। প্রথম দু’দিন বেশ বিরক্তিকর কাটলেও পরবর্তী দিন অর্থ্যাৎ ঠিক তৃতীয় দিনে সাক্ষাৎ হয়ে যায় দোলার সাথে। দোলা আর আমি দু’জন সম্পূর্ণ দু’প্রান্তের মানুষ। মেয়েটা শুরুতে ততটা মিশুক ছিল না, ভীষণ চাপা স্বভাবের। সহজে কোনো কথা কারোর সাথে ভাগ করতে জানে না। দোলার মা এবং বড় বোন প্রায় বলত, ” আমরা ভেবেছি এ মেয়ে কিভাবে চারটে বছর সেখানে কাটাবে এতোটা একা একা থাকে না মেয়েটা! কিন্তু পরে তোমার কথা ওকে বলতে শুনে সিউর হলাম যাক মেয়েটা তাহলে মানুষের সাথে মিশতেও জানে! ”

শুনে ভীষণ আশ্চর্য লাগত দোলার মতো বিপরীত প্রান্তের মেয়েটার সাথেও শেষমেশ আমার বন্ধুত্বটা হয়েই গেল। দুজন বিপরীত হওয়ার দরুন হয়তো চুম্বকের মতো একজন অন্যজনের সাথে আঠার মতো চিপকে থাকতাম। সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে আবার এ নিয়ে রীতিমতো হাঙ্গামা লাগিয়ে ফেলত।

এক বুক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে আসতে নিচ্ছিলাম ক্যাম্পাস থেকে। ভাবছি সামনের দিন থেকে আর আসবো না। এসে একেবারে পরীক্ষাগুলো দিয়ে যাবো। এমন সময় দোলার কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাকে দেখে অভিমানে মনটা ভার হয়ে যেতে চাইল। যতই ঝগড়াঝাটি করি না কেন যাদের সাথে আমাদের আত্মিক সম্পর্ক তাদের সাথে বিচ্ছেদে তো কষ্ট থাকবেই। বিচ্ছেদ যে কেবল প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে হয় এমনটাও না, বিচ্ছেদ বন্ধুত্বের মাঝেও হয়। অন্তত আমার কাছে তো বন্ধুত্বের বিচ্ছেদটাই সবচেয়ে বেশি বেদনাদায়ক মনে হয়।

” কিরে আমার সাথে কথা না বলেই চলে যাবি? ” দোলার মুখে হাসি। বোঝা গেছে সেও চায় আমরা পুনরায় এক সাথে এগিয়ে যাই।

অভিমানের সাথে বললাম, ” বাহ্ রে তুই তো আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে থাকছিস। কথা বলার সুযোগ দিচ্ছিস কোথায়? ”

” আমি তো দেখতে চাচ্ছিলাম আসলে ম্যাম কি নিজে থেকে আসেন নাকি! অথচ ম্যাম দেখি উল্টো রেগে এটম বোমা হয়ে আছেন। ”

” হইছে! প্রতিবার আমাকে কেন তোর মান ভাঙাতে হবে? তুই একবারও পারিস না আমার মান ভাঙাতে? নাকি তোর কাছে আমার কোনো দাম নেই? ”

” এখন আসছি তো চল এবার। ”

” কোথায় যাবো? ”

” তোর বিচার আছে। ”

” সর যাবো না। তোরা সব কয়টা পঁচা। ”

” পঁচা আমরা নাকি তুই? না জানিয়ে বিয়ে করছিস এখন এর শাস্তি ভোগ করবি না? আয় বলছি! ” হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। যেতে যেতে দু’জন নানান কথা বলার ছলে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। বেশিরভাগ কথার কেন্দ্রবিন্দু ছিল তন্ময়কে ঘিরে। তন্ময়ের কথা ভেবে আমারও খারাপ লাগে কিন্তু তাতে কি করার! পরিস্থিতি দু’জনকে দু’দিকে যেতে বাধ্য করেছে। অথচ কয়েকমাস আগেও আমাদের গন্তব্য একদিকে ছিল।
.

.
রাত নয়টা নাগাদ সাদিব বিষন্ন মনে বাড়ি ফিরেছে। ক্লান্তিতে কিনা জানা নেই! মাঝে মাঝে তো মধ্যরাতে উঠেও তাকে হসপিটালে দৌড় লাগাতে হয়। ডাক্তারদের এই একটাই সমস্যা। রাত নেই দিন নেই, ক্লান্তি, অবসাদ তাদের ঘিরে ধরতে পারে না। হুটহাট চলে যেতে হয় রোগীর চিকিৎসা করতে। তাই তো কখন কোন সময় বাসায় থাকবে সে বিষয়ে সঠিক বলা এক প্রকার মুশকিলআসান।

কিন্তু এসেই হঠাৎ কি হলো জানি না। কোনো কথা নেই বার্তা নেই সরাসরি, ” তুমি আমাকে মিথ্যে কেন বলেছিলে? ” বলে উত্তরের আশায় জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে রইল।

” কি মিথ্যে বলেছি? ”

সাদিব উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল। বলল, ” এই যে তুমি বলেছিলে তন্ময় তোমার ফ্রেন্ড। ”

” হ্যাঁ! এতে মিথ্যে কথার কি আছে? ”

” শুধুই কি ফ্রেন্ড? নাকি ওর সাথে তোমার অন্য কোনো সম্পর্ক আছে? ”

সাদিবের কথার ধরণ শুনে বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। অন্যদিনের সাদিবের সাথে আজকের সাদিবের মিল খুঁজতে চেষ্টা চালালাম। মিলের চেয়ে বরং অমিলটাই পরিলক্ষিত হলো। তন্ময়ের ব্যাপারে তার কৌতুহল যেন একটু বেশি। আমাকে কি সে তাহলে তন্ময়ের সাথে সন্দেহ সূচক সম্পর্কের তালিকায় ফেলছে? মনে মনে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। সিন্ধান্ত নিলাম তাকে সবটা জানিয়ে দেবো। তাতে যা হওয়ার হোক। না জানালেও যে খুব একটা ভালো হবে সেই লক্ষণ দেখছি না। তারচে পরে অন্য কারোর মুখে শুনে যদি ভুল বুঝে?

ভেবে চিন্তে বললাম, ” অনেকটা ছিল বলা যায়! ”

” ছিল? ” সাদিবের কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ ফেল। পুনরায় বলল, ” তাহলে এখন কি হয়েছে? ”

” তোমার কাছে কিছু লুকিয়ে লাভ নেই। আজ হোক কিংবা কাল হোক একদিন না একদিন তুমি এ ব্যাপারে জানতেই। তাই তোমাকে সবটা বলবো বলে সিন্ধান্ত নিয়েছি। ”

” সিন্ধান্ত নিয়েছিলে নাকি এখন আমি বলায় বলছো? ”

” যেমনটা তুমি ভাববে তেমনটাই। তোমার আমার প্রতি এর আগে কখন আগ্রহ জন্মেনি নয়তো যেচে গিয়ে সবটা আগেই ক্লিয়ার করে দিতাম। ”

সাদিবের গলা তুলনামূলকভাবে গম্ভীর শোনাল। বলল, ” এখন যখন জানতে চাইছি তখন কোনো প্রকার ভণিতা ছাড়াই বলে ফেল। আশা করি কিছু লুকোবে না….

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২০)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
শেক্সপিয়র বলেছিলেন, “একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না, কারণ এখানে আবেগ আছে, দৈহিক আকাঙ্খা আছে। ” ঠিক একই কথা বলেছেন আইরিশ কবি অস্কাস ওয়াইল্ড যে, ” নারী এবং পুরুষের মাঝে কেবলই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকা অসম্ভব। যা থাকতে পারে তা হলো আকাঙ্খা, দুর্বলতা, ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা।”।

হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, “ছেলে আর মেয়ে বন্ধু হতে পারে কিন্ত তারা অবশ্যই প্রেমে পড়বে। হয়তো খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ভুল সময়ে। কিংবা খুবই দেরিতে, আর না হয় সব সময়ের জন্য। তবে প্রেমে তারা পড়বেই। শুধুই সুযোগের অপেক্ষা।”

সত্যি বলতে, ছেলে ও মেয়েতে শুধুমাত্র বন্ধুত্ব অসম্ভব ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ। কেননা, শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হলে প্রকৃতি নিজের অস্তিত্ব হারাবে। চুম্বক আর লোহা কখনোই পাশাপাশি থাকতে পারে না আকৃষ্ট করবেই। যদি কেউ তা এড়িয়ে যায় তবে সে ভণ্ডামি করছে নয়তো ধোকা দিচ্ছে। আগুনের পাশে মোম রাখা হলে উত্তাপে মোম গলবেই। ছেলে ও মেয়ে বন্ধুত্ব হতে পারে, কিন্তু একসময় প্রেমে বা অবৈধ সম্পর্কে রুপ নিবে, আর এটাই স্বাভাবিক। কথাগুলো এক সময় বিশ্বাস করতাম না। ভাবতাম অনেক বন্ধুই তো জীবনে বানিয়েছি, কই কিছুই তো দেখলাম না আজ পর্যন্ত। ফ্রেন্ড সার্কেলে অনেককে দেখেছি সমবয়সী রিলেশনশিপে জড়িয়ে পড়তে। ভাবতাম এরা এতো বোকা! কি করে যে নিজের বন্ধুর সাথে প্রেম ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে! আর কিভাবে যে সারাজীবন এক সাথে কাটাতে পারবে? জামাই জামাই একটা ব্যাপার থাকাও তো উচিত নাকি! সমবয়সীর মধ্যে এ বোধ আসে কিভাবে দূর! মোট কথায় এসব কিছুকে কখনো আমি সিরিয়াসলি নেই নি। বরঞ্চ পায়ে ঠেলে দিয়েছি। আমার এমন সব বিরূপ মন্তব্যে বন্ধুমহলে নানান কথা উঠত। তারা প্রায়ই বলত নিজের সাথে যেদিন ঘটবে সেদিন বুঝবি কেমন মজা লাগে। তন্ময় আমার জীবনে আসার আগ পর্যন্ত সবটা এমন ঠিকঠাক চলছিল। তন্ময় ছিল ক্লাসের ফাস্ট বয়। ছেলেটা যেমন পড়াশোনায় ভালো তেমনই নম্র ভদ্র। মোটকথায় ওকে নাম্বারিং করতে দিলে আমি চোখ বন্ধ করে একশততে পঁচানব্বই দেব। পুরো একটা বছর তন্ময়ের সাথে আমি কোনো কথা বলিনি। বলা যায় আগ্রহ হয়নি। সমস্যাটা বিঁধল এক বছর পরেই একদিন হঠাৎ করে সে নিজে থেকেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এসেছিল। সেদিনের পর থেকে একে একে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব তারপর বন্ধুত্বটা কখন প্রণয়ে রূপ ধারণ করেছে বুঝতেই পারিনি৷ তন্ময়ের মধ্যে জানো একটা অজানা ব্যাপার ছিল, যা প্রতিনিয়ত আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার ক্ষমতা তৈরি করেছিল।

আমার কাছে তন্ময়ের প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় হলো সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। এ ব্যতিত তাকে আমি কখনো অন্য নজরে দেখিনি কিংবা বলা যায় দেখতে চাইনি। তন্ময় এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে জানতো। অথচ এমন ভাবনার মাঝেও তন্ময়ের সাথে মিশতে গিয়ে তার প্রতি দিনকে দিন আমি দূর্বল হতে শুরু করি। তন্ময়কে বুঝতে দিতাম না।
কারণ তন্ময়ের মুখে বহুবার শুনেছি তন্ময়ের মা তন্ময়ের সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক মেনে নেবেন না। কথায় আছে মানুষের বুক ফাটে তো মুখ ফাটে না। তন্ময়ের ব্যাপারে যেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সরাসরি কিছু বলত না আমাকে। নানান কলাকৌশলে বোঝাতে চাইত সে আমাকে পছন্দ করে। আমি বুঝতাম তবে ভাবতাম সেটা হয়তো আমার মনের ভুল। ”

” তারমানে তুমি বলতে চাইছো তন্ময় তোমাকে কখনো কিছুই জানায়নি? ” সাদিবের কণ্ঠ থমথমে শোনাল। এতোক্ষণে কথাগুলো আনমনে বলছিলাম একবারের জন্যেও বিপরীত প্রান্তের লোকটির দিকে খেয়াল হয়নি।

আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সাদিব বলল, ” থামলে কেন? বল! ”

সামান্য দম নিয়ে বলতে লাগলাম, ” হুম বলছি! সেদিন ছিলো বসন্ত বরণ। কলেজ প্রাঙ্গণে কপোত-কপোতীদের ভীড় জমেছিল। পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালে সিঁদুর লাল কৃষ্ণচূড়া থোকায় থোকায় বাতাসের সাথে দুলছিল। অন্য সব কপোত-কপোতীদের মতো আমরাও নতুন রঙে সেজেছিলাম। তফাৎ শুধু আমরা নরমাল পোষাকে আর তারা শাড়ি পাঞ্জাবি। তন্ময় আমাকে দেখে সবার সামনে কণ্ঠে আক্ষেপ মিশিয়ে বলেছিল, ” আমি ভেবেছি তুইও শাড়ি পড়বি অন্য সবার মতো। হতাশ করে দিতে পারলি আমারে! ” আমিও অবাক হওয়ার ভাণ করে টিপ্পনী কেঁটে সায় দিয়েছিলাম। বুঝতে পারিনি তার কণ্ঠের আবেগে কতটুকু সত্যতা লুকিয়ে ছিল। পরে সবার অগোচরে ডেকে নিয়ে তার মনে এতোদিন ধরে জমিয়ে রাখা কথাগুলো বলেছিল৷ প্রথমে তাকে বোঝাই এ ব্যাপারে কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারিনি কারণ আমি নিজেও চাইতাম সে আমার হোক৷ কিন্তু পরিবার এবং ভবিষ্যতের দিকটি বিবেচনা করে গোপনীয়তা বজায় রাখতে চেয়েছিলাম। বলেছিলাম পরিবার থেকে মেনে না নিলে দু’জন সম্পর্ক থেকে সরে দাঁড়াবো। দরকার পড়লে আমরা আজীবন বন্ধুই থেকে যাবো। তারপর থেকে দু’জন সবার সামনে একে অপরের বন্ধু হলেও অগোচরে আমরা প্রেমিক যুগল ছিলাম। যেদিন তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল সেদিন ঠিক দুপুরের দিকে তন্ময়ের সাথে আমার প্রণয়ের শেষ আলাপন ছিল। বুঝতে পারিনি সেটাই হবে আমাদের প্রণয়ের সমাপ্তি। পরিণয়ে আর কখনোই রূপ নেবে না। ”

” যদি বুঝতে তাহলে কি করতে? ”

ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বললাম, ” সবটা নিয়তি ছিল। নিয়তির ওপর কারোর হাত থাকে না। ”

” কেন পালানোর চেষ্টাও করতে না? ” সাদিবের কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক শোনাল।

” প্রশ্নই আসে না। কারণ আমি চাইলেও তন্ময় পালানোর মতো ছেলে না। ওর মধ্যে সৎ সাহস আছে। ”

” বাসায় জানতো তন্ময়ের ব্যাপারে? ”

” জানানোর সুযোগ হয়নি। তার আগেই যে গাটছাড়া বেঁধে ফেলেছি। ”

” ধরো তুমি আগে থেকেই জানতে তোমার সাথে সেদিন আমার বিয়েটা হবে। তখনও জানাতে না? ” সাদিব কৌতুহলী চাহনিতে চেয়ে আছে আমার উত্তরের অপেক্ষায়।

” কোন মুখে বলতাম? ”

” কোন মুখে বলতে মানে? বাকিরা যেভাবে জানায় ঠিক সেভাবে জানাতে! ”

সাদিবের মুখে অবোধ বালকের মতো প্রশ্ন শুনে না হেসে পারলাম না। আমাকে হাসতে দেখে সাদিবের ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। ” হাসছো কেন? ”

” হাসবো না? তুমি বুঝতে পারনি আমার কথা। আমি বলতে চেয়েছি তন্ময় তখন বেকার। আর একটা বেকার ছেলের হাতে কোনো বাবা মাই তাদের মেয়েকে তুলে দেবে না। ”

নিজের সবচেয়ে গোপনীয় কথাগুলো সাদিবের সাথে শেয়ার করে ফেলেছি। আচ্ছা একজন ছেলের কাছে কেমন লাগে যখন সে শুনে বিয়ের আগে তার বউয়ের অন্য কারোর সাথে সম্পর্ক ছিল? সে কি আদৌও কথাগুলো স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেবে? নাকি ভুল বুঝে উল্টো বিবাহিত সম্পর্কের ইতি টানবে? সমাজে এমন তো অনেক ঘটনা আছে যারা অতীতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে সন্দেহর সৃষ্টি করে এবং পরবর্তীতে নিজেদের বিবাহিত জীবনের বিচ্ছেদ ঘটায়! সাদিব ও কি তাই করবে? সাদিবের চেহারার দিকে তাকিয়ে এ মুহুর্তে তাই ভাবছি। অপেক্ষা করছি কখন সে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করবে।

” আমার কেন জানি এ মুহুর্তে নিজেকে সব কিছুর জন্য দোষী মনে হচ্ছে। ”

সাদিবের কথায় অবাক হওয়া ভুলে গেছি। বরঞ্চ তার পরিবর্তে একরাশ বিস্ময় আমাকে ঘিরে ধরেছে। কিছু না বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সাদিবের দিকে। সে পুনরায় আক্ষেপের সাথে বলল,” এই-যে আমার জন্য তোমার আর তন্ময়ের সম্পর্কে পূর্ণতা পেল না! ”

সাদিবের আক্ষেপে মৃদু হাসলাম। ” ঐ যে বললাম ভাগ্যে ছিল না। ভাগ্যটা আল্লাহ তায়ালা আগে থেকেই তোমার সাথে জুড়ে রেখেছে তাই আর তাকে পাইনি। ”
.

.
নিস্তব্ধতায় মোড়া রাত। দু’জনের মাঝে পিনপতন নীরবতা। কারোর চোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। দু’জন বিছানার দু’প্রান্তে শুয়ে আছি। আমার কথাগুলো সাদিবের ওপর কিরূপ প্রভাব ফেলছে জানি না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারছি সাদিব আমার কথায় আহত হয়েছে। ভীষণ ভাবে আহত হয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো তার মনটা ভেঙে গেছে। প্রথমবার প্রিয়ন্তির বিশ্বাসঘাতকতা তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলেও পরক্ষণে আমাকে পেয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। তার জীবনের চক্র যে বড্ড অদ্ভুত। কি নেই তার এ জীবনে? এত ভালো এক পেশাকে নিজের জন্য বেঁচে নিয়েছে। সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, কম বয়সে সুখ্যাতি, এত জনই বা পারে অর্জন করতে! অথচ তার একান্ত ব্যক্তিগত বলতে কোনো মানুষ নেই।

তার এভাবে চুপচাপ পড়ে থাকাটা, আমার হৃদয়েও যে ভাঙনের জোয়ার এনেছে, সে কি সেটা একটিবারও উপলব্ধি করতে পারছে না? যদি বুঝেই থাকে এতো স্বার্থপরতা কিসের জন্য?

কয়েক প্রহরের নীরবতা ভেঙ্গে সাদিব মুখ খুলল,
” একটা কথা জানতে চাইবো। বলবে প্লিজ! ”

সাদিব আমার সাথে কথা বলেনি মাত্র এক ঘন্টা হয়েছে। অথচ এই এক ঘন্টা আমার কাছে কয়েক প্রহরের সমান মনে হয়েছে। তাই সম্মতি জানাতেও দেরি করিনি।

” আচ্ছা তন্ময় যদি তোমাকে বলে আমাকে ছেড়ে তার কাছে চলে যাও, তুমি কি চলে যাবে? ”

সাদিবের চোখে চোখ রাখলাম। চোখের ভাষা কখনো মিথ্যে হতে পারে না। মানুষ মুখে যা বলতে পারে না সেটা নাকি তার চোখ বলে দেয়। সাদিবও নাহয় আমার চোখ দেখে বুঝে নিক আমি ঠিক কি চাই!

চলবে…….

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২১)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
গিটারে টুংটাং শব্দের ঝঙ্কার তুলছে পুরো হলরুম জুড়ে। কেউ অতি-আবেগের সাথে অনুপম রায়ের কণ্ঠে গাওয়া সেই চিরপরিচিত সুরের গানটি গাইছে__

” আমাকে আমার মতো থাকতে দাও
আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি।।
যেটা ছিলো না ছিলো না,সেটা না পাওয়াই থাক
সব পেলে নষ্ট জীবন।

তোমার এই দুনিয়ার ঝাপসা আলোর
কিছু সন্ধ্যার গুঁড়ো হওয়া কাঁচের মতো,
যদি উড়ে যেতে চাও তবে গা ভাসিয়ে দাও
দূরবীনে চোখ রাখবো, না, না, না
না, না, না, না, না, না। ”

হলরুমের বাহিরে যাতায়াতের সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী আবার কৌতুহলী চোখে চেয়ে দেখতে এসেছে কণ্ঠের উত্তরাধিকারকে। গলার স্বরে বোঝাই যাচ্ছে লোকটি ভীষণ আবেগ মেখে গলা ছেড়ে গাইছে। সবার মাঝে কয়েকজনের কাছে কণ্ঠটি সুপরিচিত তো বটেই সাথে কিছুটা অবাকও ঠেকল। যখন দেখল গানের মালিক তন্ময় নামক ক্লাসের সেই শান্ত ছেলেটি। হাতে নতুন করে সাদা ব্যান্ডেজ মোড়ানো। সদ্য আঘাতের চিহ্ন যে বোঝাই যাচ্ছে। চোখের নেত্রপল্লব বন্ধ অবস্থায় অতি আবেগের সহিত তন্ময় এক মনে গাইছে।

তন্ময়ের কণ্ঠে,” কখনো আকাশ বেয়ে চুপ করে
যদি নেমে আসে ভালোবাসা খুব ভোরে,
চোখ ভাঙা ঘুমে তুমি খুঁজো না আমায়
আশে-পাশে আমি আর নেই। ” গানের এই চরণ গুলো আমার মনে গভীর ভাবে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। গায়ের সকল লোম সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কেন জানি না, তার গানের এই চরণের মাঝে আমি নিজেকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারছি। যা কিনা আমার জন্য একেবারে অন্যায় এবং অনৈতিক। তাই তো এখন থেকে যতটা সম্ভব তন্ময়কে এড়িয়ে যাওয়ার সিন্ধান্তে উপনীত হয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করতে উদ্ব্যত হয়েছিলাম মাত্র, ওমনি ছেলেটি গান গাওয়া ছেড়ে পেছন থেকে ঠিকই ডেকে বসল,

” কিরে চলে যাচ্ছিস যে? ”

চেহারার অভিব্যক্তি লুকানোর ব্যর্থ প্রয়াস থেকে বললাম, ” একটু লাইব্রেরিতে যাওয়ার ছিল। এখানে আসার পরই মনে পড়ল। ”

তন্ময় কি বুঝল কে জানে! আমার ভাব বিনিময়ে ছেলেটি হাসল। যে হাসিতে অন্য দিনের তুলনায় প্রফুল্লতা দেখতে পাই নি। গিটারটিকে নিজের আসল মালিকের হাতে তুলে দিয়ে তন্ময় বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ” চল এক সাথে যাওয়া যাক! কতদিন আমাদের দেখা হয়নি বলতো! ”

” না কোনো ব্যাপার না। তুই থাক বরং! ” বলে বেরিয়ে আসতে নিলে তন্ময়ও পেছন পেছন বেরিয়ে এসে বলল,
” এড়িয়ে যাচ্ছিস আমাকে? ঠিক কোন কারণে জানতে পারি কি? ”

” তোকে এড়ানোর মতো কোনো কারণ আছে বলে তো আমার জানা নেই, তাই নিজে নিজে অযথা কারণ দাঁড় করাস না। ”

আমার কথায় তন্ময়ের ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো। ” তুই অনেকটা বদলে গেছিস তামান্না। তুই এখন আর আগের মতো নেই। কি হতো যদি আগের মতো থাকতিস? খুব কি বেশি চাওয়া হয়ে যেত আমার? ”
.

.
বাসার সাজসজ্জা দেখা মনে হচ্ছে, যেন এ বাড়িটার বিয়ে লাগছে সেই সাথে বাড়িটাকে বিয়ের কনের ন্যায় নতুন সজ্জায় রূপ দান করা হচ্ছে। শ্বাশুড়ি মায়ের দিকে খেয়াল হতে দেখলাম উনার চোখমুখে উচ্ছাস যেন ঠিকরে পড়তে চাইছে। এ বাড়িতে আসার পর এর আগে উনাকে এতোটা প্রফুল্ল দেখিনি। অবাক হলাম ভীষণ ভাবে যখন তিনি আমাকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ” তামান্না তুমি চলে এসেছো? মা তুমি কি একটু ভেতরটা গিয়ে দেখবে? আসলে একসাথে এতো দিকে সামলে উঠতে পারছি না। ”

মানুষ বড়ই আদুরে প্রাণী। তাই আদরের ভাষায় কিছু করতে বললে সে কথা ফেলে দেওয়ার মতো বোকামি সে করবে না। শ্বাশুড়ি মায়ের আহ্লাদে ভরা কণ্ঠ শুনে তাই আমিও আর না করতে পারিনি। সাথে সাথে উনার ডাকে সায় জানিয়ে ভেতরের দিকে চললাম। আসল ব্যপারটা তখনও জানতে পারিনি। সাদিয়ার রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলাম মেয়েটাকে আসার পর থেকে দেখছি না, ঘরে বসে এতো সময় কি করছে! কৌতুহলের সহিত সাদিয়ার রুমের দিকে উঁকি দিতে দেখলাম, মেয়েটা গোমড়া মুখে রুমের এক কোণায় বসে আছে। আমার দেখা হাসিখুশি মানুষের তালিকায় সাদিয়া একজন। ও বাসায় না থাকলেও সেদিন বাসার পরিবেশ কেমন মিইয়ে থাকে। সারাক্ষণ খুশিতে মেতে থাকা মেয়েটা বাসার উৎসবমুখর দিনে মুখ ভার করে বসে থাকবে তা তো হতে পারে না। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম সাদিয়ার রুমের দিকে। ইচ্ছে ছিল পেছন সাইড থেকে গিয়ে ভয় দেখানোর।

পেছন থেকে ” ভাউউউ! ” শব্দ উচ্চারণ করে মৃদু ধাক্কা দিতে সাদিয়া ফিরে তাকালো। আমার উপস্থিতিতে সাদিয়ার মুখে অন্য দিনের মতো হাসি ফুটল না। উল্টো উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটা হু হু করে কেঁদে দিল। সাদিয়ার এহেন কান্ডের সাথে আগে থেকে পরিচিত ছিলাম না বিধায় অনেকটা চমকে গেলাম। গুটি কয়েক সেকেন্ড কাঁধ জড়িয়ে থাকার পর তাকে সোজা করে চিবুকে হাত চোয়ালাম।

“সেকি ননদিনী! কাঁদছো কেন? ”

ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে সাদিয়ার হেঁচকি উঠে গেছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল, ” ভাবী আমি এ বিয়ে করবো না! ”

এতোক্ষণে সাদিয়ার কথায় বুঝতে পারলাম বাসায় কি হতে চলছে। কিন্তু বাবা মা হুটহাট সাদিয়ার বিয়ের সিন্ধান্ত নেবে সে বিষয় যেন ভাবনাতীত। নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো তো একটা কারণ আছেই। অথচ মায়ের চোখে মুখের অবস্থা দেখে ভেবেছিলাম মায়ের বাপের বাড়ি থেকে হয়তো কেউ বেড়াতে আসবে।

সাদিয়াকে আপাতত শান্ত করাটা জরুরি মনে করে বললাম, ” আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার? না করলে না করবে, এতে এতো কাঁদতে হয় নাকি বোকা মেয়ে! ”

সাদিয়া কান্না থামিয়ে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। কিয়ৎক্ষণ সময় নিরব থেকে বলল, ” ভাবী তুমি কি আমার একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে প্লিজ? ”

স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললাম, ” কি বল! ”

আমার হাত ধরে অনুনয় করে বলল, ” আমাকে কি তুমি একটু পালাতে সাহায্য করবে? বিশ্বাস কর আমি আমি তোমার কাছে সারাজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। ”

সাদিয়ার অন্যায় আবদার শুনে সাথে সাথে ওর হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম। ” এসব তুমি কি বলছো সাদিয়া? বিয়ে না করলে না করবে, বাসায় সোজাসুজি জানাবে যে বিয়েটা তুমি করবে না। সরাসরি পালানোর চিন্তা মাথায় কেন আনছো? ”

” ভাবি আমার হাতে এ মুহুর্তে পালানো ছাড়া কোনো উপায়ও তো নেই৷ ” সাদিয়ার বোকাসোকা ভাবনায় মেজাজটা ভীষণ খারাপ হল। মন চাইছে এ মুহুর্তে নিজেই কোথাও পালিয়ে যাই তাও আবার একা একা। এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা! যেখানে সবাই শুধু পালানো ছাড়া কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে পারে না আমার বুঝে আসে না। প্রথমে প্রিয়ন্তি ভেগেছে, তারপর তন্ময়ের ব্যাপারে সব শুনে গতরাতে সাদিব আমাকে তন্ময়ের সাথে পালাতে বলেছে। এদিকে এখানে তার আদরের ছোটবোন আবার কার সাথে পালাবার কথা ভাবছে। হায় আল্লাহ! এ কাদের পাল্লায় এনে তুমি ফেললে আমায়….

চলবে……

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]

#তোমার_নামে_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা (২২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সাদিয়ার নেওয়া সিন্ধান্তের পিটে কিছু বলতে নিচ্ছিলাম সেসময় মা এসে দু’জনকে তাড়া দিয়ে বলতে শুরু করলেন, ” কই হলো তোদের? ” এটুকু বলে তিনি থেমে গিয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনার তাকানো দেখে সাদিয়া আমার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। কোথাও তিনি সাদিয়ার বলা কথাগুলো শুনতে পাননি তো আবার! তাহলে নির্ঘাত একটা কেলেঙ্কারি কান্ড ঘটে যাবে।

আমাদের অযথা আশঙ্কায় পানি ঢেলে তিনি কিঞ্চিৎ রাগের সাথে বললেন, ” তামান্না তোমাকে না আমি একটা কাজ দিয়েছিলাম? এই একটা কাজও তুমি ঠিকভাবে করতে পারলে না? বলি এরকম ছোটখাটো কাজই যদি না সামাল দিতে পারো তাহলে প্রথম দিন এসে কোন স্পর্ধায় আমার সংসারের হাল ধরতে গিয়েছিলে? তোমার মামনি কিছু শিখিয়ে পাঠায়নি তোমায়? ”

” মা আমি তো করতে যাচ্ছিলাম কিন্তু…..

তিনি হাত ডান হাত তুলে থামানোর মতো করে বললেন, ” ব্যস! কোনো কৈফিয়ত শুনতে চাই না। তুমি তোমার কাজে যাও। ওকে আমি দেখছি.। ”

কথাটা বলে মা সাদিয়ার দিকে কঠোর চোখে তাকালেন। আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে তিনি সাদিয়ার সাথে কি নিয়ে কথা বললেন তা আমার জানা নেই। তবে আমি বেরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে সাদিয়ার করুণ চাহুনি দেখে তার প্রতি আমার ভীষণ মায়া লাগল। সাদিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভাবছি কিছু তো একটা গন্ডগোল আছে। নয়তো হুট করে বাবা মায়ের এমন সিন্ধান্ত নেওয়া কেন? সবটা জানতে হলে আমাকে পাত্রপক্ষ যাওয়া অর্থ্যাৎ সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু আমি যে অধৈর্যশীল তাতে করে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করার আগেই না মরে ভুত হয়ে যাই! কি হতে পারে ভাবতে গিয়ে তনিমার কথা মনে পড়ে গেল। আচ্ছা তনিমাকে কি একটা ফোন দেবো? ও কি জানে সাদিয়ার ব্যাপারে কিছু? কিংবা জানলেও কি বলবে আমায়? এদিকে মা এতো বড় একটা কথা বললেন যেটা হজম করার মতো হজম শক্তিও নেই আমার। আল্লাহ কোথায় যাই! দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে বললাম, হয় তুমি আমায় কথা হজমের ক্ষমতা দেও নয়তো ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে দেও। বলে ফোনটা ব্যাগ থেকে তুলে নিতে মনে হলো, না থাক! আল্লাহ তুমি আপাতত আমাকে ধৈর্য বাড়িয়ে দেও। আমি বরং কাজ সেরে রয়ে সয়ে সবটা শুনবো। তাই সবশেষে কাজেই মনোযোগ দিলাম।
.

.
সামিরা কঠোর দৃষ্টিতে সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। সাদিয়ার কাছে মনে হচ্ছে তার মা তাকে এই এক জোড়া চোখের দ্বারা বুঝি ভস্মীভূত করে শান্ত হবেন! তামান্না চলে যেতে তিনি সাদিয়াকে শাসাতে শুরু করলেন। ” ওর সাথে এতো কি নিয়ে কথা বলছিলি? ”

সাদিয়া মনে মনে ঠিক যে ভয়টা পাচ্ছিল তাই যেন সামিরা উচ্চারণ করলেন। ভয়ের সাথে সাথে কণ্ঠ জুড়ে জড়তা এসে ভর করল সাদিয়ার। ” কককইই, কি বলেছি? ”

” সাদিয়া তুই আমার পেট থেকে হয়েছিস নাকি আমি তোর পেট থেকে হয়েছি? তুই কি ভাবছিস তোর মতলব আমি বুঝি না? ভালোয় ভালোয় বলছি চুপচাপ রাজি হয়ে যা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে। ”

সামিরার থমকের কাছে পরাজিত হয়ে সাদিয়া শব্দ করে কেঁদে দিল। ” মা আমি এ বিয়েটা করতে পারবো না প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর! ”

সাদিয়ার কান্নায় সামিরা গললো কিনা জানা গেল না তবে কণ্ঠস্বর খানিকটা ক্ষীণ শোনালো, ” কেন পারবি না? এতো কিসের সমস্যা তোর বিয়ে করতে? ”

সাদিয়া ভেতরে ভেতরে কথা সাজিয়ে নিল। যতটা সম্ভব খুব সাবধানতা অবলম্বন করার চেষ্টা করল। যদিও জানে না তাতে সামিরার মন কতখানি গলবে। তবে চেষ্টা করতে বাঁধা কিসের! বলল, ” মা আমি এখনো আমার পড়াশোনা কমপ্লিট করি নাই। যেখানে ভাইয়া ডাক্তার সেখানে আমি তো মাত্র অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ি। অন্তত পক্ষে আর দুইটা বছর আমাকে সময় দেও! ”

সন্দিহান হয়ে সামিরা বললেন, ” ও এই ব্যাপার? নাকি অন্য কোনো মতলব আছে? ”

” না মা, অন্য কিসের মতলব থাকবে? কোনো মতলব টতলব নেই বিশ্বাস কর! ”

সামিরা কিছু একটা ভাবলেন। মা হয়ে তিনি যা বুঝলেন তাতে মেয়ের হাবভাব তার কাছে মোটেও সুবিধার ঠেকছে না। দুইদিন আগে লোকমুখে যা শুনেছেন তা যদি সত্যি না হয়ে থাকে তাহলে সাদিয়ার এতো আপত্তি কিসের! এদিকে মেয়ের চালাকি ধরতে হলেও তাকে নিরবে থেকে সবটা জানতে হবে। একে তো এ সময়টা সাদিয়ার আবেগের বয়স তার ওপর বেশি জোর জবরদস্তি করলে শেষে উল্টো পাল্টা কিছু না করে বসে। ছেলেকে তো মনের মতো পাত্রী দেখে বিয়ে করাতে পারলেন না। তাই মেয়েকে নিয়ে কোনো প্রকার ঝুঁকি নিতে তিনি রাজি নন৷

” আচ্ছা ব্যাপার না। দেখতে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। তুই আজকে শুধু তাদের সামনে যাস, তারপরেরটা পরে দেখা যাবে। ”

” কিন্তু যদি তারা আমাকে পছন্দ করে বসে? ” মনের কথা চেপে না রেখে সাদিয়া সরাসরি বলল।

” আপাতত তারা দেখুক। তুমি ফেলনা নও যে বিনা কথাবার্তায় তাদের হাতে তোমাকে তুলে দেবো। সবটা বাচবিচার করে তবেই সিন্ধান্ত নেওয়া হবে। নিজের বাবা মা আর ভাইয়ের ওপর এতটুকু ভরসা রাখ। ” বলে তিনি চলে যেতে উদ্ব্যত হলেন। পরক্ষণে ফিরে এসে সাবধান করে গেলেন, ” আর বাহিরে কারোর কাছ থেকে একদম আজেবাজে পরামর্শ নেবে না বলে দিলাম। ”
.

.
দুপুরের পর পর বাবা আর সাদিব বাসায় চলে এসেছে। সচরাচর কেউ এই সময়ে বাসায় আসে না। বাবা আসেন দুপুরের লান্স সেরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় বেরিয়ে পড়েন। অন্যদিকে সাদিবের আসার যাওয়ায় কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। সবার উপস্থিতি দেখে বুঝলাম আসলে আমি ছাড়া বাসার বাকি সবাই জানতো সাদিয়াকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার ব্যাপারে। আমাকে কেউ একটিবার জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না। ভেবে একটু কষ্টই পেলাম। যাকগে সে ব্যাপারে না ভাবি। না জানালে না জানাক! জানালেও অবশ্য লাভ হতো না হয়তো এতে তাদের লোকসানের আশঙ্কাই বেশি ছিল! তারচে বরং ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে কিচেনে গিয়ে একবার সব কিছুতে চোখ বুলিয়ে আসি, দেখি সব ঠিক আছে কিনা। এ পরিবারের কেউ আমাকে কিছু না ভাবুক আমার তো অন্তত এ পরিবারের ব্যাপারে একটু হলেও দায়িত্ব আছে!
.
.
পাত্রপক্ষ আসার আগে বাসায় আরেক মেহমানের আগমন ঘটল। একজন প্রৌঢ় মহিলা, সাথে উনার মেয়ে। সম্পর্কে প্রৌঢ় মহিলাটি আমার ফুপু শ্বাশুড়ি এবং মেয়েটি আমার আরেক ননদ। সাদিবের বিয়েতে উনাকে দেখিনি তাই শুরুতে উনাকে সেভাবে চিনতে পারিনি। উনাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিতে উনি সালামের জবাব দিয়ে আমার উপর থেকে নিচ সবটা একবার চোখ বুলিয়ে দেখলেন। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ” সামিরা এ কি আমার সাদিবের বউ নাকি? ”

মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে মেয়েটা বিস্মিত চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। অতঃপর তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বলল, ” আরে মা তুমি ও না কি বলো না বলো এসব? ও কেন সাদিব ভাইয়ার বউ হতে যাবে? নিশ্চয়ই মামি তোমার সাথে মজা করছে। ও এ বাড়ির বউ হওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। সাদিব ভাইয়ার চয়েস এতো খারাপ না! ”

মেয়েটার মুখের ওপর এভাবে বলা কথাটা আমার গায়ে এসে একদম কাঁটার মতো বিঁধল যেন। মানুষ অপমান করে ঠিক আছে তাই বলে সামনাসামনি মুখের ওপর এভাবে অপমান করবে? আচ্ছা মেয়ে তো! কথাটা বলার সময় যেভাবে নাক তুলেছে তাতে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ মেয়ে ভীষণ দেমাগি মেয়ে। সামনের যতদিন ওরা এ বাড়িতে থাকছে তাতে করে আমার জন্য দিনগুলো নিশ্চয়ই খুব একটা ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না। ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম, ‘আজ খালি আমার কিছু হও না তুমি চান্দু! সাদিবের ফুপাতো বোন দেখে বেঁচে গেলে নাহলে দেখতে আমাকে খারাপ বলার শোধ তোমার থেকে কিভাবে নিতাম!’

মা বললেন, ” সেসব এখন থাক। তার আগে যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। অনেক দূরের পথ জার্নি করে এসেছো। কিছুক্ষণ বাদে তো আবার মেহমান চলে আসবে। ”

মেয়েটি বলল, ” কে আসবে? ”

” সাদিয়াকে আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। ”

” সেকি মামি, এতো তাড়াহুড়ো কেন করছো? সবে তো সাদিব ভাইয়া বিয়ে করল, আর ওরই বা বয়স কতটুকু হয়েছে এতো তাড়া কিসের? ”

ফুপু শ্বাশুড়ি নিজের মেয়েকে কথার জবাবে বললেন, ” সেসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। সবাই তো আর তোর মতো আইবুড়ো থাকতে চায় না। ”

” থাকতে কই চাইলাম। যাকে বিয়ে করতে চেয়েছি তাকে তো এনে দিতে পারলে না। এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল? ” মেয়েটি নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে আমার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে ভিড় ভিড় করে কথাগুলো বলে ভেতরের দিকে চলে গেল।

মেয়েটি চলে যেতে ফুপু শ্বাশুড়ি আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ” ওর কথায় তুমি কিছু মনে কর না কেমন? তোমার ননদ হয় তো তাই একটু মজা করেছে। ”

‘ হ্যাঁ, আমি তো বাচ্চা তাই কোনটা খোঁচা মারা কথা আর কোনটা হাসি ঠাট্টা কিছুই বুঝি না। বুঝিয়ে দিয়ে ভারী উপকার করলেন। ‘ ভেতরে এ কথা আওড়ালেও ওপর দিয়ে মৃদু হেসে উনাকে বললাম, ” না ঠিক আছে। আমি বুঝতে পেরেছি। ”
.

.
সেদিন পাত্রপক্ষ আসতে তুলনামূলক ভাবে দেরিই করল। তাদের কথা ছিল বিকেলের মধ্যে আসবে অথচ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পরমুহূর্তে তারা সাদিয়াকে দেখতে হাজির হয়েছে। সাদিবের ফুপাত বোন অবিবাহিত হওয়ার দরুণ মা তাকে চেয়েও বলতে পারেননি সাদিয়াকে আনার ব্যাপারে। এদিকে পাত্রীর ভাবি হওয়ার সুবাদে আমাকে পাঠানো হয়েছে পাত্রীর সাথে। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতে অবাধ্য চোখ গেল সাদিবের দিকে। দেখতে পেলাম লোকটা মুখ ভার অবস্থায় মাথা নিচু করে রেখেছে। এর আবার কি হলো? বাসায় ফেরার পর তো বেশ ভালোই দেখলাম। হয়তো বোনের বিয়ে হয়ে যাবে সেটা ভেবেই মন খারাপ! পরক্ষণে পাত্রের আসনে বসা ছেলেটিকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। সাদিবের মুখ ভার করে বসে থাকার কারণ আমার এতোক্ষণে আর বুঝতে বাকি রইল না। আমার অবস্থা সে বুঝতে পারল কিনা জানা না গেলেও আমার উপস্থিতি টের পেতে সাদিব আর আমি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম……!

চলবে……