তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব-০২

0
426

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০২)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

রাহা ফোনে কলের উপর কল করে যাচ্ছে রুপকথা কে। কিন্তু রুপকথা কল রিসিভ করছে না। রিসিভ করবে কিভাবে?সে তো বন্ধুদের নিয়ে পার্টিতে ব্যস্ত হয়ে আছে। এদিকে দুশ্চিন্তায় নাজেহাল অবস্থা রাহা’র। একমাত্র ভাইয়ের এতো যন্ত্রনা উপলব্ধি করে নেত্রজোরা দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। রুপকথা কে কল করার কারণ রুপকথার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ যা তার ভাইয়া রাদ শাহমাত এর ও এক‌ই গ্রুপ।
ইতিমধ্যে কয়েকটি ব্লাড ব্যাংকে খবর নেওয়া হয়ে গেছে কিন্তু কোথাও ও নেগেটিভ রক্ত পাওয়া যায় নি।
______
দুজন লোক সাথে নিয়ে নজরাত হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে হসপিটালে।এসেই ঢিমে যাওয়া গলায় বললো,
—“রাহা র’ক্তের যোগার হয়েছে?
রোষপূর্ন চাহনিতে রাহা বললো,
—“হলে তো জানতেই পারতে!

এমন পরিস্থিতিতেও রাহা’র ব্যবহারে রুক্ষতা প্রকাশ পেল।নজরাত বুঝেও আমলে নিল না। কারণ এখন রাগ অভিমানের সময় নয়।তাই দম ফেলে বললো,
—“ডাক্তার কে ব্লাড দেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলো!
হতবিহ্বল মুখশ্রী করে রাহা বললো,
—“তুমি দেবে ব্লাড?
—“না, আমার ব্লাডের সাথে উনার ব্লাস ম্যাচিং করে না।
দুজন লোক কে দেখিয়ে বললো,
—“উনারা ব্লাড দিতে ইচ্ছুক, তুমি ব্যবস্থা করো।

রাহা লোক গুলোর দিকে বিনয়ের চোখে তাকিয়ে বললো,
—“আপনাদের কি বলে ধন্যবাদ দিব আমার ঠিক জানা নেই। আমার সাথে আসুন প্লিজ?
তারপর ডাক্তারের কাছে চলে গেল রাহা, সাথে লোক দুজন‌ও।

নজরাত তাচ্ছিল্যের সাথে মুচকি হাসলো শুধু। পরক্ষনেই তার শ্বাশুড়ি মায়ের কথা মনে পড়ে।দ্রুত পায়ে কেবিনের সামনে আসে। যেখানে রাদ শাহমাত কে এডমিট করা হয়েছে।এদিক ওদিক খুঁজে কোণার দিকে নজর দিতে দেখলো সাজেদা চৌধুরী বসে আছেন।নজরাত দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পাশে বসলো। কাঁদে হাত রেখে মা বলে ডাকে। সাজেদা চৌধুরী পাশে ফিরতেই নজরাত এর দেখা পেয়ে কিছুটা শব্দ করেই কেঁদে উঠলো। মনে হলো এতোক্ষণ কান্না করার মানুষ খুঁজছিলেন তিনি। নজরাত শ্বাশুড়ি মাকে শান্তনা দিয়ে বললো,
—“আল্লাহ ভরসা মা। ইনশা আল্লাহ আপনার ছেলেকে সুস্থ করে দিবেন আল্লাহ তা’আলা।
আল্লাহ বলেন, অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের।[১]

নিজের চোখে পানি রেখে শ্বাশুড়ি মাকে শান্তনা বানী শুনিয়ে চলেছে নজরাত। নিজের কষ্টটা কাউকে দেখাতে পাচ্ছে না সে।
এর মাঝে ফোনে কল আসলে দেখে সাজ্জাদ হোসেন কল করেছেন। তিনি কতবার চেয়েছিলেন হসপিটালে আসার জন্য কিন্তু নজরাত আসতে নিষেধ করেছে।রাত হয়ে যাচ্ছে একা একা বাসায় ফিরতে হবে সে কথা ভেবেই নিষেধ করেছে সে। এখন বাসায় থেকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন তিনি। হয়তো ভোরের আলো ফুটতেই হসপিটালে ছুটবেন।
_______

ঘড়ির কাঁটায় রাত দুইটা চৌদ্দ মিনিট বাজে।
কেবিনের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে নজরাত। দরজার গ্লাস গলিয়ে তাকিয়ে আছে তার স্বামী নামক মানুষটার দিকে। নাটক সিনেমার মতো করে রোগীর কাছে তার প্রেমিকা বা স্ত্রীকে এলাউ করে না ডাক্তার। তাই বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সে।একদিনে মানুষটা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে।শ্যাম বর্ণের গায়ের রঙটা আরো যেন চাঁপা পরে গেছে। হবে নাই বা কেন? মাথায়,হাতে পায়ে যেভাবে আ’ঘাত পেয়েছে এরপরেও যে রাদ শাহমাত বেঁচে আছে এই অনেক শুকরিয়া।

সাজেদা চৌধুরী হসপিটালে থাকতে চাইলে নজরাত তাকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়।রাহা হসপিটালের ফিনেল এর গন্ধ বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না বলে সেও চলে যায় মায়ের সাথে। এখন একাই আছে নজরাত। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে তার।তাই একটা চেয়ারে গিয়ে বসলো। সারাদিন একটুও বিশ্রাম নেওয়া হয়নি তাই ভীষণ খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতে।সময় গুলো যেন থমকে গেছে, কিছুতেই যাচ্ছে না। কিছু সময় তাসবিহ পড়লো কিছু সময় ফোনের নোট প্যাডে কিছু লিখলো। এমনি করে ঘড়ির কাঁটা গিয়ে তিনটায় পৌঁছালো।

নজরাত কেবিনের কাছে গিয়ে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল রাদ শাহমাত এর পানে।তাকে ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে তাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে সে।
নজরাত অযু করে এগিয়ে গেল।এশার নামায যেখানে আদায় করেছিল সেখানে। ভালো দিকগুলোর মধ্যে এই একটা ভালো দিক হসপিটালে নামাযের জন্য আলাদা রুম করা হয় “আলহামদুলিল্লাহ”।

নজরাত তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ে। নামায শেষে প্রাণ ভরে স্বামীর জন্য দো’আ করে।রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি সল্লাম বলেন-
“প্রতিরাতে শেষ তৃতীয়াংশে ১ম আসমানে এসে আল্লাহ বলেন-
কে আমাকে ডাকবে??
আমি সাড়া দিব যা চাইবে তাই দিব![২]
______

সকালের আলো ফুটতে সাজ্জাদ হোসেন চলে আসেন হসপিটালে। তাঁকে রাদ শাহমাত এর কাছে রেখে বাসায় যায় নজরাত। ঘন্টা খানেক এর মধ্যে রাদ এর জন্য স্যুপ তৈরি করে নিয়ে আসে। ভিতরে ঢুকার পারমিশন নেই বলে নার্স কে খাইয়ে দেওয়ার জন্য দেয়।
নার্স রাদ কে স্যুপ খাইয়ে বাহিরে এসে বললো,
—“আপনি কি রুপকথা?প্যাসেন্ট তার নাম করছে!
নামটা শুনতেই অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় নজরাত। আড়ালে চোখের পানি মুছে বললো,
—“উনি এখানে নেই।
—“অহ আচ্ছা।

এর সপ্তাহ খানেক পর রাদ কে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেয়া হয়।রাহা বাসায় নার্স নিয়োগ করতে চাইলে সাজেদা চৌধুরীর কঠোর নিষেধাজ্ঞায় দমিয়ে যায় রাহা। এরপর থেকে নজরাত সেবা যত্ন শুরু করে রাদ এর। পায়ে ইনজুরি হ‌ওয়ার কারণে একা একা চলাফেরা করতে কষ্ট হয় রাদ এর। তখন নজরাত সাহায্য করে যদিও এতে ভীষণ বিরক্ত হয় রাদ। কিন্তু মুখে প্রকাশ করে না।
________
রাদ কে নিয়ে বাগানে এসেছে নজরাত। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে বেঞ্চে বসে বসে ফোন স্ক্রল করছে রাদ।নজরাত তখন বাগানের বিভিন্ন ফুল গুলো মুগ্ধ হয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে চকিতে পিছনে ফিরে তাকাতে দেখতে পায় রুপকথা এসেছে! মেয়েটা দেখতে ভীষণ সুন্দরী। পোশাকের দিক দিয়ে দামী দামী থ্রিপিস পড়লেও শালীনতা বজায় রেখেই চলে।দেখতেও ভারী মিষ্টি, ঠোঁটের কোণে ছোট্ট কালো কুচকুচে তিল আছে যা যে কাউকেই আকর্ষন করবে। লম্বায় অনুমানিক পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি হবে, গায়ের রঙ ফর্সা খানিকটা লম্বা মুখশ্রী। চুল গুলো কাদ অব্দি স্ট্রেট।

রুপকথা কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করে নজরাত মনে মনে বললো,
—“মেয়েটা আসলেই একটা রুপকথার গল্পের মতো রাজকন্যা।তাই হয়তো রাদ শাহমাত মেয়েটাকে এত্ত পছন্দ করেন, হয়তো ভালো ও বাসেন।

এদিকে রুপকথা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে রাদ কে!রাদ হকচকায় বলে,
—“রুপ? কি করছো? আমার শরীরের ইনজুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি এখনো।
রুপকথা রাদ কে ছেড়ে কানে হাত রেখে বললো,
-“ওহ সরি সরি। আমি এতদিন পর তোমাকে পেয়ে আবেগের বশে সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম রাদ সরি। আসলে আমি…
রাদ মুচকি হেসে বললো,
—“ইটস ওকে। তুমি দূর থেকেও যে আমাকে সাহায্য করেছো! এতেই আমি ভীষণ খুশি রুপ।
রুপকথা বুঝতে পারলো না কি সাহায্য করেছে সে?তাই মেকি হাসি দিয়ে বললো,
—“কিসের সাহায্যের কথা বলছো তুমি?
—“আমি সব দেখেছি রুপ। তুমি তোমার পেইজে কিভাবে সাহায্য চেয়ে পোস্ট করেছো! এবং আমার জন্য ইমিডিয়েটলি র’ক্তের ব্যবস্থা করেছো!

একটার পর একটা কথা শুনে রুপকথার বিষ্ময় আকাশ সম। কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করছে না। আবারো জোর পূর্বক হেসে বললো,
—“আমি তোমার জন্য করবো না তো কে করবে শুনি?আর এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি এভাবে বলো না প্লিজ রাদ?জানো তোমার এক্সিডেন্ট এর কথা শুনে নিজেকে সামলাতে অনেক কষ্ট হয়েছে আমার। নিজেকে কেমন পাগল পাগল মনে হয়েছে।

রাদ রুপকথার হাতে হাত রেখে বললো,
—“আমি জানি রুপ তোমাকে এক্সপ্লেইন করতে হবে না।

কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে সবটা অবলোকন করলো নজরাত। না চাইতেই নেত্রজোড়ায় পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেল তার।ভাবছে সে কি অজান্তেই দুটো ভালোবাসার মানুষের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে চলে এসেছে?……
_____
রেফারেন্স:-
[১][সূরা বাক্বারাঃ১৫৫]
[২](বুখারি-১১৪৫)
______
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।