তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব-০৩

0
382

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(০৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

নজরাত রুপকথা আর রাদ এর দিকে বেশ কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দৌড়ে চলে যায় ঘরে। শ্বাশুড়ি মায়ের রুমের দরজায় কড়াঘাত করে বলে,
—“আসবো মা?
সাজেদা চৌধুরী দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
—“বৌমা ভিতরে এসো।
নজরাত ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে সাজেদা চৌধুরী বললেন,
—“বৌমা তোমাকে বলেছি তো আমার রুমে আসতে পারমিশন নিতে হবে না।
নজরাত খাটের এক কোনায় দাঁড়ায়, কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে বললো,
—“আপনার সাথে কিছু কথা ছিল মা।
—“বসো, বসে বলো কি বলবে?
নজরাত বিছানায় বসে, দৃষ্টি নত রেখে বললো,
—“আপনি উনাদের সম্পর্কটা কেন মেনে নেননি মা? আমার মনে হচ্ছে তারা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে মা! আমি তাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে না আসলে তারা অনেক সুখী হতে পারতো!

সাজেদা চৌধুরী কিছুক্ষণ মৌন র‌ইলেন। তারপর বললেন,
–“পঞ্চাশ উর্ধ্বে গিয়ে ঠেকেছে বয়স। ঠিক বেঠিক বুঝি আমি। ঐ মেয়ের ব্যপারে সমস্ত খবর নিয়েছিলাম আমি। মেয়েটা একদম ই ভালো নয়। ছেলে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকে! কিন্তু আফসোস আমার ছেলেটাকে সে কথা বুঝাতে অক্ষম আমি। জানি না ঐ মেয়ে কি বশ করেছে!

এতটুকু বলে থেমে গেলেন সাজেদা চৌধুরী। হাতে থাকা তসবিহ গুনতে শুরু করলেন। সাজেদা চৌধুরী খুবই ধার্মিক মানুষ।তাই সবসময় চেয়েছেন ছেলের জন্য একজন ধার্মিক ব‌উ নিয়ে আসবেন। কিন্তু ঝামেলা সৃষ্টি করে রুপকথা। হঠাৎ তার আবির্ভাব ঘটে রাদ শাহমাত এর জীবনে। কোন একটি কারণে রাদ শাহমাত ভীষণ ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে রুপকথা নামের মেয়েটির উপর। হয়তো রাহা ও জানে সেই কারণ। ভাইয়ার সাথে সাথে রাহা ও চেয়েছে রুপকথা যেন এ বাড়ির বউ হয়ে আসুক। কিন্তু সাজেদা চৌধুরী তা হতে দেননি।রাগ করে ভাইয়ের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন যখন রাদ শাহমাত বলেছিল রুপকথা ছাড়া আর কাউকে সে বিয়ে করবে না! তারপর মাকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয় বিয়েটা করতে।

নজরাত উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে রান্না ঘরে ঢুকে।এ বাসার হেল্পিং হ্যান্ড মণি রান্নার যোগার যন্ত করছেন। নজরাত কাছে গিয়ে বললো,
—“আপা আমাকে বলুন কি করতে হবে?
মণি সবজি কাটছিলেন, হাত থামিয়ে বললেন,
—“ফ্রিজ থেকে কাঁচা মরিচের প্যাকেট টা দিন তো কষ্ট করে ভাবী, আনতে ভুইলা গেছি।
নজরাত ফ্রিজের কাছে আসতেই ফোন বাজতে শুরু করে। দৌড়ে ডাইনিং টেবিল থেকে ফোনটা নিল।স্ক্রিনে ভাইয়া নামটা দেখে ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো।তার একমাত্র ভাই রূপক যে কিনা ইতালি থাকে। আজকে এক সপ্তাহ পর কল করলো। কাজের চাপে কল করার সময় পায় না। নজরাত কল রিসিভ করে সালাম দিয়ে কথা বলতে শুরু করে। কথা বলতে বলতে পায়চারি করছে রুমে। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে যায়! সামনে থাকা মেয়েটি রাহা।রাহা তার ভাইকে ধরে সবে রুমে ঢুকেছে তখনি নজরাত এর সাথে ধাক্কা লেগে যায়। নজরাত সরি বলার পরেও রাহা রুক্ষ গলায় বললো,
—” চোখ দুটো কি হাতে নিয়ে ঘুরে বেরাও নাকি?যত্তসব ফাউল মানুষ!
তারপর ধীরে ধীরে রাদ কে ধরে নিয়ে তার রুমের দিকে গেল। রুপকথা গার্ডেন থেকেই চলে যায়, এ বাসায় ঢুকে সাজেদা চৌধুরীর মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস নেই তাই।

তাছাড়া রাদ তখন রুপকথা কে ঐভাবে বলার কারণ রাহা।রাহা মিথ্যা কথা বলে তার ভাইকে।বলে রুপকথা রাদ এর জন্য র’ক্তের ব্যবস্থা করেছে। তাইতো রাদ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ওভাবে বলেছে রুপকথা কে।

ফোনের ওপাশে থাকা রূপক সবটা শুনে রে’গে বললো,
—” কে এই মহিলা?এই মহিলা তোর সাথে এরকম আচরণ কেন করলো বোনু?
নজরাত খানিকটা হাসার চেষ্টা করে বললো,
—” ও আমার ননদ রাহা।ও মহিলা নুয় ভাইয়া, আসলে বয়স কম তো তাই একটু র’ক্ত গরম একটুতেই রে’গে যায়।যাই হোক ভাইয়া এসব বাদ দাও এখন বলো তুমি দেশে আসবে কবে? কত্ত গুলো দিন তোমায় দেখি না বলো?
—” একদিন হুট করে এসে চমকে দিব ইনশা আল্লাহ।
—” তাই না?
—” হুম দেখিস।
_______

মাগরিবের পর, নজরাত কফি বানিয়ে রাদ কে দিল।এই একটা কাজ সবচেয়ে ভালো করতে পারে সে।বাকি রান্না বান্না যদিও মাঝে মাঝে করে তবে ইউটিউব ভিডিও দেখে করে।

রাদ সোফায় বসে ল্যাপটবে কাজ করছিল তখন পাশে কফির মগ রেখে বেলকনিতে চলে এলো নজরাত।কপির মগে চুমুক দিতে দিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আজকে আকাশটা কেমন রক্তিম হয়ে আছে। তবে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। ক্যামেরায় বন্দী করার মতো দৃশ্য “সুবহান আল্লাহ” ।

রাদ কফির মগে চুমুক দিতে এক অন্যরকম স্বাদ অনুভব করলো।যা ভীষণ ভালো লাগলো তার।এর আগে বোধ হয় এরকম স্বাদ পায়নি কখনো।
এর মাঝে রাদ এর ফোনে কল আসে। রুপকথা কল করেছে।কল রিসিভ করে কুশল বিনিময় শেষে রাদ বায়না ধরে বললো,
—” একটা কবিতা বলো না রুপ? তোমার লেখা কবিতা গুলো তোমার মুখে শুনতে বড্ড বেশি ইচ্ছে করছে!
কলের ওপাশ থেকে কাশির শব্দ শুনা গেল! হঠাৎ কাশি শুরু হলো কেন? এতক্ষণ তো ভালোই ছিল।রাদ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
—” রুপ তুমি ঠিক আছো? হঠাৎ কাশি শুরু হলো কেন?
রুপকথা তাড়াহুড়ো করে বললো,
—” রাদ আমার ভীষণ খারাপ লাগছে! তোমাকে পরে কল করবো বাই।
এই বলে কেটে দিল কল।রাদ মন খারাপ করে কফি খাওয়াতে মনোযোগ দিল।

একটু পর নজরাত আকাশের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে আনমনে গেয়ে উঠে,,,
কোরআন মধুরও বানী

প্রতিটি হরফে দশ দশ নেকি আছে
আমলে জমা হয়
প্রতিটি হরফে দশ দশ নেকি আছে
আমলে জমা হয়

পাপের খাতা হতে
পাপ যায় তোমার হেটে
নেকিতে হয় বোঝায়

এ এমন বরকতময়
মেলে সবারী দাওয়ায়

শোনো মুমিন মুসলমান
পড়ে দেখনা কোরআন
কত শান্তি পাওয়া যায়

কোরআন মধুরও বানী
আমি যখনই শুনি
আমার মন ভরে যাই

কোরআন মধুরও বানী…

এতো মিষ্টি কন্ঠস্বর শুনতে শুনতে রাদ সোফায় শরীর এলিয়ে দেয়।তার মনখারাপ নিমিষেই দূর হয়ে যায়। কিন্তু এই প্রশান্তির বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। নজরাত অর্ধেক গজল গেয়ে থেমে গেল, তার মনে পড়লো সে তো এই রুমে একা নয়।পাছে যদি রাদ রাগ করে তাই চুপ হয়ে যায়‌।
কিন্তু রাদ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এই ভেবে যে নজরাত হয়তো আবার গাইবে। কিন্তু না সে আশায় বালি। নজরাত আর গাইলো না বেলকনি থেকে এসে কফির মগ গুলো নিয়ে চলে গেল।

রাদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নজরাত এর যাওয়ার পানে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বলতে পারলো না আরেকটি গজল গাওয়ার কথা। সেই অধিকার যে তার নেই।
_______

রাদ সুস্থ হয়ে উঠতেই অফিসে যাওয়া শুরু করে।তার অনুপস্থিতিতে অনেক কাজ জমেছে অফিসে সেগুলো এখন দিন রাত এক করে করতে হচ্ছে। খাওয়া দাওয়া ব্যপারে ভীষণ উদাসিন হয়ে পড়ছে। সাজেদা চৌধুরী আফসোস করে বললেন,
—” ছেলেটা নিজে থেকে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, আমি বললে দুই একটা বলে।
নজরাত তখন শ্বাশুড়ি মাকে শান্তনা দিতে কোরআন এর আয়াতের ব্যাখ্যা দিয়ে বললো,
—“আপনি যাকে ভালোবাসেন, ইচ্ছা করলেই তাকে হেদায়াত করতে পারবেন না। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকেই হেদায়াত দান করে থাকেন”
( সূরা-কাসাসঃ৫৬)

সাজেদা চৌধুরী চোখে পানি নিয়ে বললেন,
—“বৌমা আমার একটা কথা রাখবে?
—” জ্বি মা এভাবে বলছেন কেন?কি করতে হবে বলুন?
—” ছেলেটা খাওয়া দাওয়ায় বড্ড অনিয়ম করছে। তুমি ওর জন্য লান্স নিয়ে যাবে?

নজরাত জানে বড্ড কঠিন কাজটা তার শ্বাশুড়ি মা দিলেন। কিন্তু না করার মতো অভদ্র আচরণ করতে পারবে না সে তাই বললো, জ্বি আচ্ছা।
_____

পূর্ন পর্দায় নিজেকে ঢেকে অফিসে আসে নজরাত। একজন এমপ্লয়ে কে পরিচয় দিতে লোকটা খুব আন্তরিকতার সাথে নজরাত কে রাদ এর অফিস কক্ষে নিয়ে বসালো। বললো,
—” ম্যাম অপেক্ষা করুন প্লিজ।স্যার মিটিং শেষ করে চলে আসবেন।
—” জ্বি, ধন্যবাদ আপনাকে।

লোকটা বিদায় নিয়ে চলে গেলে,নজরাত উঠে দাঁড়ায়।কক্ষ টা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। খুব সুন্দর করে সাজানো রুমটা।থাই গ্লাসের কাছে আসতে ভীষণ ভালো লাগলো।থাই গ্লাস গলিয়ে আসেপাশের দৃশ্য গুলো খুব সুন্দর। হঠাৎ কক্ষের একপাশে নজর পড়ল।কাছে এগিয়ে এসে দেখে বুঝলো মেয়েদের কসমেটিক প্যাকিং করা। উপরের কিছু লেখা দেখে বুঝলো হোম ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে এগুলো!…..

#চলবে….ইনশা আল্লাহ।