তোর অনুরাগে পর্ব-১৭(অন্তিম পর্ব)

0
502

#তোর অনুরাগে
#তানজিলা_খাতুন_তানু
#পর্ব_১৭
#অন্তিম_পার্ট

____________

নূপুর আদ্রিকার সাথে দেখা করতে এসেছে। আদ্রিকা চুপচাপ বসে আছে, নুপূর তীক্ষ্ণ স্বরে বললোঃ আদ্রি কেন এইরকম করছিস। তোর জন্য আমাদের সকলের জীবনটা থমকে গেছে ‌,,আমি নতুন করে জীবন সাজাতে পারিনি।আমাকে বল না কেন আমি তোর জন্য সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবো। বল না। তোর দাদাভাই বলে দিয়েছে তুই ঠিক না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করবে না। আমি আর কতদিন এইভাবে থাকবো। সকলেই আমাকে আমার পরিবার কে উলটো পাল্টা কথা বলছে। রাগ অভিমান মনে নিয়েও কিছু বলতে পারছিনা।

নূপূর নিজের মনের সমস্ত অভিযোগগুলো আদ্রির সামনে প্রকাশ করে চলে যায়।

শুরু হয় একটা নতুন সকাল..

আদ্রির মা ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে আদ্রিকে দেখে চমকে উঠলো। চোখে অশ্রু নিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুললো,তার মেয়ে স্বাভাবিক আচরন করছে এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে।

অর্কঃ বোনু তুই সত্যি আগের মতো হয়ে উঠছিস।

আদ্রিঃ আমার ভুল ভেঙ্গে গেছে‌ আমার অধিকার নেয় আমার জন্য কারোর জীবনটা থামিয়ে রাখার।

অর্ক আদ্রিকে জড়িয়ে ধরে,কপালে চুমু দিলো। তার বোনটা আবার আগের মতো হয়ে যাবে এর থেকে খুশির খবর আর কি হতে পারে।

আদ্রিঃ দাভাই আজকে সকলের আমাদের বাড়িতে ইনভাইট কর সকলকে চমকে দেবো।

অর্ক আদ্রির কথা মতো কাজ করলো। হুট করেই সকলকে ইনভাইট করাতে সবাই অবাক হলো। সবার মনে একটাই প্রশ্ন কি হলো আবার।

আহসানের মনটা খুঁত খুঁত করছে। আদ্রির কিছু হয়নি তো।

আহসানঃ অর্ক হুট করেই আসতে বললি কারন কি?

অর্কঃ সবার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। একটু অপেক্ষা কর।

আহসানঃ আচ্ছা আমি একটু আদ্রির কাছে যায়।

অর্ক আর বারন করলো না। আহসান দরজায় হাত দিতেই দরজাটা খুলে যায়, আহসান অবাক হয় এর আগে আদ্রির সাথে দেখা করতে পারেনি আজকে দরজা খোলা আছে কারনটা কি?

আহসান ভেতরে গিয়ে চমকে উঠলো। আদ্রি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছছে। আহসানের আদ্রিকে একটা পরী মনে হচ্ছে।

আহসানঃ মায়াবতী।

আদ্রি আহসানের গলার স্বর শুনে সামনে তাকিয়ে দেখলো আহসান এসেছে। আহসান দৌড়ে গিয়ে আদ্রিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।

আদ্রিঃ আমার হাড়গোড় আস্ত থাকবে না এইভাবে চেপে ধরলে।

আহসানঃ আমার সাথে মিশিয়ে রাখবো,যাতে না হারিয়ে যেতে পারো।

আদ্রিঃ কথা দিলাম আর হারিয়ে যাবো না।

আহসান আদ্রিকে ছেড়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিল।

সকলেই আদ্রিকে পেয়ে খুব খুশি। সকলেই আদ্রির সাথে কথা বললেও নূপুর পারছে না। কালকে অনেকগুলো কথা শুনিয়েছিলো আদ্রিকে অপরাধবোধে ভুগছে।

আদ্রিঃ আমি চাই,সামনের সপ্তাহেই দাভাই আর নুপূরের বিয়েটা হয়ে যাক।

সকলেই আদ্রির সাথে সহমত হয়। আদ্রি রান্নাঘরে গেলে নুপূর ও উঠে চলে যায়।

নুপূরঃ সরি আদ্রি কালকে রাগের মাথায় উল্টো পাল্টা কথা বলেছি।

আদ্রিঃ দ্যাখ নুপূর তুই তো একটাও কথা ভুল বলিসনি। সত্যি তো আমার জন্য তোর জীবনটা থেমে ছিলো।

নূপুরঃ রেগে আছিস আমার উপরে।

আদ্রিঃ না রে। এই গুলো একটু দিয়ে আয় না।

নুপূর আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। আদ্রি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

আহসানঃ আদ্রি তোমার হুট করেই নিজেকে সামলে নেবার কারন কি নুপূর।

আদ্রি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো আহসান দাঁড়িয়ে আছে।

আদ্রিঃ তুমি।

আহসানঃ হূম বলো।

আদ্রিঃ হ্যা।

আহসানঃ রাগ করে আছো ওর উপরে।

আদ্রিঃ না একটু অভিমান জমে আছে। আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করে না এনে,নিজের জীবনে আমার জন্য হওয়া ক্ষতিগুলোকে তুলে ধরেছে। এটা আশা করিনি।তবে এটাও তো ঠিক ওর জীবন ওর ভাবার অধিকার আছে।

আহসানঃ পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয় আদ্রি।

আদ্রিঃ সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি।

আহসানঃ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

আদ্রিঃ হুম।

আদ্রি আর আহসান ফিরে আসে আড্ডার আসরে।

নুপূরঃ আমি চাই আমাদের সাথে আদ্রির বিয়েটাও হোক।

আদ্রি আহসান প্রথমে না বললেও পরে রাজি হয়ে যায়।

অর্কঃ আদ্রি তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

আদ্রি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই অর্ক দরজার দিকে ইশারা করলো। আদ্রি দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো।

সকলেই মানুষটিকে দেখে চমকে উঠেছে। মানুষটা কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার। রাহাত রায়জাদা ..

রাহাতঃ আদ্রি মামনি.

আদ্রি আর নিজেকে সামলাতে পারেনা,দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

আদ্রিঃ সরি বাবাই। আমি তোমাকে অনেক কথা শুনিয়েছি। আমাকে মাফ করে দাও।

রাহাতঃ মা কি তার ছেলের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে।

আদ্রি কান্নার মাঝেই হেসে ফেললো।

সকলেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদ্রি রাহাতকে জড়িয়ে ধরে আছে।যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।

আনিকাঃ এটা কি হলো বাবাই কে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে। আর এই যে মশাই মেয়েকে পেয়ে বউকে ভুলে গেলেন।

আদ্রিঃ বাবাই দেখো মম কি হিংসুটে হয়ে গেছে।

আনিকাঃ ওই একদম হিংসুটে বলবি না। তোর জন্য বুড়ো বয়সে লুকিয়ে প্রেম করতে হয়েছে।

আদ্রি চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললোঃ মম তুমি আমার বাবাইকে বুড়ো বললে। এটা কিন্তু ঠিক না। তুমি বুড়ি হয়ে গেছো কিন্তু আমার বাবাই নয়।

আনিকা রেগে মেগে আগুন হয়ে তাকালো আদ্রির দিকে। আদ্রি আর আনিকার কথা শুনে অর্ক,আহান আর রাহাত মুচকি হেসে চলেছে। আর বাকিরা গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে।

আহসান আহানকে খোঁচা দিয়ে বললোঃ ভাই কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বল না সবটা।

রাহাত এক ধমক দিয়ে বললোঃ এই আহসান বড়োদের সামনে ফিসফিস করে কথা বলতে নেয় জানো না।

আহসান কাঁচুমাচু হয়ে বললোঃ সরি স্যার।

রাহাতঃ আরে স্যার বলছো কেন শশুড় মশাই হয় আমি তোমার।

আহসান চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো রাহাতের দিকে।

আদ্রিঃ তোমার সকলেই কনফিউজড তাই তো।

সকলেই মাথা নাড়লো।

আদ্রিঃ তোমরা সকলেই জানো আমার ড্যাড অর্থাৎ মিষ্টার রায়হান আমি হবার পরেই মারা যায়। এমনাবস্থায় নানু মমের বিয়ে দিতে চাই কিন্তু মম্ রাজি থাকে না। পরে আমার শরীরে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক রক্তের প্রয়োজন হয় আর সব রক্ত বাবাই দেয়,একটা শর্তে মমকে বিয়ে করতে হবে।মম আর বাবাই এর বিয়ে হয় আর আমিও সুস্থ হয়ে উঠি কিন্তু বাবাই অসুস্থ হয়ে পড়ে আর উচ্চ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হয় আর মমও যায় তখন আমার বয়স ১০। মম আর বাবাই কে না পেয়ে আমার মনে একটা রাগ জন্ম নিতে থাকে,আর এই সবটার বৃদ্ধি করতো আমার দাদু। সময় পেরিয়ে গেলেও আমি আর বাবাই কে মেনে নিতে পারিনি।
আর আমার কারনেই মম আর বাবাই আলাদা হয়ে যায়।

সবকিছু শুনে সকলেই স্বব্ধ হয়ে যায়। আনিকার চোখে পানি ভর্তি। রাহাত ও মাথা নীচূ করে বসে আছে।

অর্কঃ বোনু তুই এতগুলো কথা জানলি কিভাবে?

আদ্রিঃ দাদু মারা যাবার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলো।

অর্ক,রাহাত,আনিকা আবারো চমকে উঠলো।

আনিকাঃ তাহলে এতদিন?

আদ্রিঃ আমি নিজেকে সবকিছুর জন্য দায়ী মনে করতাম আর তোমাদের উপরে অভিমান হয়েছিলো তাই আর কিছুই বলিনি। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাদের উপরে নজর রাখতাম,আমার খুব ভালো লাগতো এইসব।

রাহাতঃ দুষ্টু মেয়ে। আমরা কতটা কষ্ট পেয়েছি জানো।

আদ্রিঃ সরি মাফ করে দাও আর করবো না।

রাহাত আদ্রিকে জড়িয়ে ধরলো। সকলের মুখেই হাসি।

পরেরদিন..

মাহিরঃ আমাকে কেন আস্তে বললে ।

মারিয়াঃ আমার বিয়ের কথা চলছে।

মাহিরঃ ভালো তো বিয়ে করে নাও।

মারিয়াঃ আর আমার ভালোবাসা।

মাহির অবাক চোখে মারিয়ার দিকে তাকালো।

মারিয়াঃ হ্যা আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তোমাকেই চাই।

মাহিরঃ এটা সম্ভব না। আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তোমার পরিবার কখনোই আমাকে মেনে নেবে না।

মারিয়াঃ থাকবো তো আমি। তাই আমার সিদ্ধান্তটাই আসল।

মাহিরঃ কিন্তু।

মারিয়াঃ আমি যদি তোমার না হয় তাহলে কারোর হবো না কথাটা মনে রেখো।

মারিয়া চলে যায়। মাহির কি করবে বুঝতে পারছে না।

২বছর পর….

অনেককিছুই বদলে গেছে।

নুপূর আর অর্কের ছেলে হয়েছে। নুপূরের সাথে আদ্রির মন টানাটানিটা আর নেয়। আগের মত সম্পর্কটা হয়ে গেছে।

সাদ্দাম আর মাহিয়ার বিয়ে হয়েছে,,সুখে সংসার করছে।

মারিয়া আর মাহিরের পরিবার প্রথমে না মানলেও মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু মেনে নেয়। মারিয়া সবকিছু মানিয়ে নিচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষটা তার পাশে আছে আর কি লাগবে।

আহান আর সানার এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। বোন আর বন্ধুর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে ওদের চারহাত এক করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আহসান।

রাহাত আর আনিকা একসাথেই আছে। ওদের আর লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে হয় না।🤭🤭

_________________

“শহরে আবারো একটা মাফিয়ার পর্দা ফাঁস। কে বা কারা এই কাজটা করেছে সেটা কখনো জানা যায়নি। তবে যে বা যারা এই কাজটা করেছে, তারা সমাজের রক্ষক বলেই আন্দাজ করা হচ্ছে।”

সারাদেশ জুড়ে একটাই খবর। কে করেছে কেউ জানে না। নিউজটা দেখে বাঁকা হাসলো আহসান।

বাড়ি ফিরে রুমেতে আদ্রিকে না দেখতে পেয়ে বেলকনিতে গিয়ে দেখলো আদ্রি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

আহসানঃ কি ব্যাপার আমার আদ্রিরানির মন খারাপ কেন?

আদ্রিঃ মন খারাপ নয় মনটা খুব ভালো।তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।

আহসান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। আদ্রি আহসানের হাতটা নিজের পেটের ওপরে রাখলো। আহসান চমকে উঠে আদ্রির দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালো।

আদ্রিঃ মিস্টার আপনি বাবা হতে চলেছেন আর আমি মা।

আহসান আদ্রিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু দিলো।

আদ্রিঃ এখন তো সবজায়গাতেই একটাই নিউজ।

আহসানঃ হুম দেখলাম।

আহসান আদ্রির পেটের উপর হাত রেখে বললোঃ আমাদের অনাগত সন্তানকে স্পর্শ করে বললাম,সমাজের বুকে রক্ষক হয়ে থাকবো। সমস্ত মুখোশধারীকে সমাজের সামনে প্রকাশ করবো। আন্যায়ের প্রতিবাদ করে সমাজকে একটা সুস্থ জীবন দান করবো।

আদ্রিঃ আমার কথা রাখার জন্য এতকিছু কেন করছো।

আহসানঃ আমি #তোর_অনুরাগে পরেছি তাই।

আদ্রি আহসানকে আর কিছুই বললো না।দাভাই তাকে ভুল মানুষের হাতে তুলে দেয়নি তার প্রমান বার বার পেয়েছে আর আজও পেলো।আদ্রি আহসানের হাতটা জড়িয়ে ধরলো।

আহসানঃ একসাথে সারাজীবন থাকবো ইনশাআল্লাহ্।

আদ্রিঃ আমিও কথা দিলাম থাকবো ইনশাআল্লাহ্।

‌ ~ সমাপ্ত ~