তোর নেশায় মত্ত পর্ব-০১

0
2569

#তোর_নেশায়_মত্ত
#লেখনিতে-আবরার আহমেদ শুভ্র
#সূচনাপর্ব

– এমন শ্যামবর্ণ মেয়েকে আমি আমার ছেলের বউ হিসেবে মানতে পারবো না মি.মাহবুব! তারছে আপনার ছোট মেয়েকেই আমার পছন্দ হয়েছে!! তাকে আমার ছেলের বউ বানিয়ে নিতে চাই আমি।

হবু শাশুড়ির এমন কথা শোনে মাথা নিচু করে নির্বাক হয়ে বসে রইল মিহিয়া। এমন কথা সে একের অধিকবারও শোনেছে, তাই সয়ে গেছে! কিন্তু চোখেরজল! সে যেন মিহিয়ার সাথেই সন্ধি করেছে আজ!! চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সে অবাধ্য জল গুলো। কিন্তু এমনটা তো কখনও হয়নি। কিন্তু কেন! এর মাঝেই মিহিয়ার বাবা মাহবুব সাহেব বলে উঠলেন,

– কি বলছেন আপা এসব? আপনার ছেলেই তো আমাকে বলেছে সে মিহুকে পছন্দ করে তাহলে!

– ও তো ছোট! আর এই বয়সী ছেলেরা এমন কথা বলবেই তাতে কান দিতে নেই! আর আমার ছেলে তো সবসময় মায়ের কথায় শোনে। ঠিক না রিয়ান বাবা!

মিহিয়ার হবু বর রিয়ানও ওর মায়ের কথায় সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো।। তার কথায় মাহবুব আলম চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

– এমনভাবে করছো যেন ভাজা মাছ উল্টো করে খেতে পারো না! আমার মেয়েটাকে নিয়ে এমন খেলা না খেললেও পারতে রিয়ান। এর ফল তো তুমি অবশ্যই পাবে! আর সেটা আজ হোক বা কাল!…… বলেই মিহিয়ার বাবা রাগে ক্ষোভে হন হন করে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

মাহবুব আলম নিজ রুমে এসে মাথানিচু করে বসে রইলেন। আজ তার একটি সিদ্ধান্তে তার ছোট্ট মিহুর জীবন তছনছ হয়ে গেলো। সেদিন যদি রোকেয়াকে তার ঘরে না আনতো তার মেয়ের মা হিসেবে তাহলে আজ কতই না সুখে থাকতো তার মেয়েটি। তিনি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখেরজল মুছলেন। কি করবেন তিনি! রোকেয়া যে তাকে এমন জালে ফাঁসাবে সেটা তিনি কখনও কল্পনায় করতে পারেন নি। তার সকল সম্পত্তির অর্ধেকাংশ নিজের নামে নিয়ে নিয়েছে। বাকিটা তো তিনি নিজেই এতিমখানায় দান করেছিলেন। এতো সম্পত্তি তার লাগতো না কারণ বর্তমান সম্পত্তি দিয়ে তার আরও ১৪ বংশ চলতে পারবে। কিন্তু এসব যে সে নিজের নামে করে নিবে তা জানতো কে?

মিহিয়ার বাবা যাওয়া মাত্রই মিহিয়ার ছোট বোন মানে সৎবোন রুশাকে বউ সাজিয়ে নিয়ে এসেছে তার ছোটমা মিসেস রোকেয়া। সে তো এটাই চেয়েছিল যেন রিয়ান রুশাকে বিয়ে করুক। অবশ্য রুশা মিহিয়ার চেয়ে রূপের দিক দিয়ে অনেক বেশিই সুন্দরী দেখতে। তাতে যে কেউ ওর প্রতি আকৃষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। অার রোকেয়া সে তো মাহবুব আলমের দ্বিতীয়পক্ষ তাই মিহিয়া তাকে ছোটমা বলে ডাকে। এর মাঝেই রিয়ানের মা বলে উঠলো,

– তো মিসেস মাহবুব আমরা আজই আকদটি সেরে ফেলতে চাই, কি বলেন আপনি?

– হা অবশ্যই, শুভ কাজে দেরি না করাই ভালো।

তাদের এ হেন কথাবার্তায় যেন মিহিয়ার হৃদয়টা যেন ফেঁটে যাচ্ছে। তাই সে সইতে না পেরে দৌড়ে সেখান থেকে রুমে চলে গেলো।
______________

রুমে এসে দড়জা বন্ধ করে মেঝেতে বসেই জড়োসড়ো হয়ে কান্না নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলো। আজ তার চোখেরজল যেন বাধ ভেঙেছে। সে কখনও ভাবতেই পারেনি তার ছোটমা তার সাথে এমনটা করবে।

মিহিয়ার ৮ বছর বয়সেই সে তার মাকে হারিয়ে ফেলেছিলো কোনো একটি মেলায়। সেদিন তার বাবা অনেক খোঁজাখুঁজির পরও মিহিয়ার মাকে পাইনি আর। তাই তো তিনি তার বড়ভাইদের কথা মতো মিহিয়ার দেখাশোনার জন্যই রোকেয়াকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো সেই সিদ্ধান্তই তার আদুরে মেয়েটির জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে! মিহিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো,

– কেন মা আমায় একা ফেলে চলে গেলে? শোনছো না তুমি তোমার এই ছোট্ট মিহুটির বুকফাঁটা আর্তনাদ! কেউই আমাকে আর ভালোবাসে না শুধু বাবাই ছাড়া।

নিঃশব্দে কান্না করতে করতে চোখগুলো ফুলে উঠলো মিহিয়ার। সে দ্রুত ওয়াশরুমে গেলো। মুখে পানির ঝাড়াঝাপটা দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে কিচেনে গেলো। অতিথিদের জন্য নাস্তা বানিয়ে তাদের দিতে এগিয়ে যেতেই রুশার খালা রোনইয়া মিহিয়ার হাত থেকে ট্রেটি ছিনিয়ে নিয়ে দু একটা নিরামিষ বাক্য শোনিয়ে চলে গেলো।

মিহিয়া মুচকি হেসে দড়জার আড়ালে গিয়ে দাড়ালো। দেখতে পেলো তারই হবু বর তার ছোট বোনকে রিং পড়াচ্ছে। কতই না খুশি হয়েছে মেয়েটি! মিহিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সেখান থেকে রুমে চলে এলো।

দিন দুয়েক চলে গেলো এমন করেই। কিন্তু মিহিয়ার প্রতি অত্যাচার তো আর থামছে না। ভার্সিটির ক্লাস শেষ হতে না হতেই বাড়ী হাজির হতে হয়। এই সময় সকলে আড্ডা দেয় ভার্সিটিতে আর সে দৌড়ে বাড়ীর যাওয়ার উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে দেরী হলেই তার খাওয়া বন্ধ সেদিনের জন্য তার সাথে গরম কুন্তীর ছেক!! মুখবুঝে সহ্য করে সে। এছাড়া আর নেই কোনো উপায়। কোথায় যাবে সে? কার কাছে যাবে? নেই কোনো চেনা পরিচিত আত্মীয়! ওর আপন বলতে একমাত্র তার ফুফি ও ২ ফুফাতো বোন রিয়াপু আর তনিমাপু। তারাই তাকে ভীষণ রকম ভালোবাসে। তবে তারা থাকে ঢাকাশহরের বাইরে। যেখানে যাওয়া একদমই সম্ভব নয় মিহিয়ার কাছে। কিন্তু তার বাবা! তার বাবার প্রতি তার একরাশ অভিমান জমা হয়ে আছে। কারণ, তার প্রতি এমন অত্যাচারে তার বাবা কিচ্ছুটিই বলেন না রোকেয়া বেগমকে। কেমনেই বা বলবেন! মিহিয়া তো আর জানে না কেন মাহবুব আলম রোকেয়া বেগমকে কিছুই বলেন না।
_______________

মিহিয়ার আজ তার বেস্টফ্রেন্ড ছায়ার সাথে একটা কনসার্টে যাওয়ার কথা। কারণ, সেখানে তার ফেভারিট সিঙ্গার এএসএ আসবে! মানে আহান সার্ফারাজ আদ্র! হাজারও মেয়ের ক্রাশ! মিহিয়ারও ক্রাশ বলা চলে! যার একটুকরো চাহনীতে যে কোনো মেয়েরই হার্টবিট মিস হয়প যায়! মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর হিসেবে যার নামডাক সেই আজ আসবে উত্তরার সেই কনসার্ট এ! সেখানে ভীড় করেছে হাজারো মেয়ে। মিহিয়া আর ছায়াও সেখানে উপস্থিত হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। আহান সার্ফারাজ আদ্রও পৌঁছেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। অবশ্য কনসার্ট শুরু হতে এখনও সময় আছে। জাস্ট আদ্রের কণ্ঠ শোনতে বিমোহিত মনে সেখানে বসে আছে মেয়েরা।

বেশ অনেক্ষণ হলো কনসার্ট শুরু হয়েছে। আদ্রও গান গাইছে যেটা মিহিয়া প্রতিনিয়ত শোনে! ‘দিল কো কারার আয়া’ মিহিয়ার ফেভারিট একটা গান। মিহিয়াও মনে মনে খুশি হয়েছে এটা ভেবে যে তার ক্রাশ তারই ফেভারিট গানটি গাইছে, তাতে সেও মনে মনে সুর মেলাচ্ছ।

Dua Bhi Lage Na Mujhe
Dawa Bhi Lage Na Mujhe
Jab Se Dil Ko Mere Tu Laga Hai…

Neend Raaton Ki Meri
Chahat Baaton Ki Meri
Chain Ko Bhi Mere Tune
Yun Thaga Hai…..

গানটা এতোটাই সুন্দর করে গাইছে যেন তার ভাষা নেই সেটাকে এক্সপ্লেইন করা। প্রতিটি লাইন যেন সে নিজ আবেগ দিয়েই গেয়েছে। এতোটা ইমপ্রেসিভ ছিলো সেই গানের সুর যে, যে কেউই তার প্রেমে পড়তে বাদ্য।

গান শেষ হওয়া মাত্রই চারদিক থেকে হৈহুল্লুড় শুরু হয়ে গেলো।

মিহিয়া আর ছায়া সেখান থেকে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় সকলকে অবাক করে দিয়ে আদ্র একগুচ্ছ কালো গোলাপ নিয়ে মিহিয়ার সামনে হাটুগেঁড়ে বসে বলতে লাগল,

– মিহু উইল ইউ মেরী মি? কেন আই হেভ ইউ?

আদ্রের এমন প্রপোজালে সকলের খালি একটাই আবদার মিহিয়ার প্রতি সেটা হলো ‘একসেপ্ট হিম’। কিন্তু মিহিয়া কিছুই না বলে ছায়ার হাত ধরে নিয়ে বেড়িয়ে এলো কনসার্ট থেকে। আদ্রের এই প্রপোজের লাইভ দেখানো হচ্ছিলো। তাই মিহিয়া কিছু বলতে পারনে নি। কারণ, সে জানে আজ তার উপর কি বয়ে যেতে পারে।

মিহিয়াকে এমন করে বেড়িয়ে আসতে দেখে ছায়া জিজ্ঞেস করলো,

– মিহু কি হয়েছে? তুই ওনাকে একসেপ্ট করিস নি কেন?

– কেন করি নি সেটা তুই বুঝতে পেরেও কেন এমন প্রশ্ন করছিস?

– কিন্তু, ওনার প্রপোজাল…

– প্লীজ, আমাকে এটা নিয়ে আর বলিস না। আজ থেকে হয়তো বাসার বাহিরে আসা বন্ধ করে দিবে।

– কিচ্ছু হবে না, দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে।

– হুম।

কথা বলতে বলতে মিহিয়ার বাসার সামনে আসতেই দেখতে পেলো রোকেয়া বেগমকে। হয়তো কুন্তী হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে শুকনো ঢুক গিলে ছায়াকে বিদায় দিয়ে বাসার দিকে এগিয়ে গেলো।
______________

আদ্র সেখান থেকে উঠে সোজা গাড়ী নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে চলে এলো বাসায়। আর আসার পরথেকেই একটা কথা বিড়বিড় করছে,

– শ্যামাপাখি, তুমি আমাকে রিজেক্ট করলেও তুমি শুধুই আমার। আর কারো হতে দিবো না তোমাকে। ‘মিহু-আদ্র’ কে কেউ আলাদা করতে পারবে না। মিহু শুধুই আদ্রের। আই নিড ইউ এট এনি কস্ট।

#চলবে_