তোর নেশায় মত্ত পর্ব-০২

0
1643

#তোর_নেশায়_মত্ত
#লেখনীতে – আবরার আহমেদ শুভ্র
পর্ব- ০২

সময় চলছে তার আপন গতিতে। সেদিনের পর থেকে সপ্তাহ খানেক হতে চলল মিহিয়ার কোনো খোঁজই পাচ্ছে না আদ্র। এমন কোনো মাধ্যম নেই যেখানে খোঁজ নেই নি। শেষে মিহিয়াদের বাসার সিসি ক্যামেরা হ্যাক করতেই তার স্বস্থির নিঃশ্বাস পড়লো। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে, মিহিয়া রুমে বিছানার এক কোণে বসে আছে।

আদ্র মুচকি হাসি দিয়ে মনে মনে বলছে,

– মিহুপাখি! তোমার খোঁজ অবশেষে পেলাম। আজ থেকে পুণরায় তোমার প্রতি নজর রাখবো আমি। একেবারে সিক্রেট নজর। কেউই বুঝবে না শুধু আমি ছাড়া। আর তোর প্রতি করা প্রতিটা অন্যায়ের শাস্তি তো আমি মিসেস রোকেয়া উম, মিসেস মাহবুবকে দিবোই। সাথে তোমার প্রাণপ্রিয় পিতাজানকেও!! সবকিছুর মূল খলনায়ক তো উনিই। আমি যা জানি ওনার সম্পর্কে তার সামান্য পরিমাণও তুমি জানো না মিহুপাখি!

আনমনে মোবাইলটা হাতে নিয়ে মিহিয়ার প্রতিটা ছবি খুব যত্নসহকারে দেখছে আদ্র। তার শ্যামাপাখিটা আসলেই মায়াবতী! অসম্ভব মায়াবী! কাজলকালো আঁখিযুগলের পানে তাকিয়ে যেন হাজারটা বছর পার করে দিতে পারবে। মোবাইল অফ করে পাশে রেখে দিয়ে মিহিয়াকে নিয়ে ভাবনার জগতে পাড়ি জমালো আদ্র।

ভাবছে সেদিনের কথা…..

ফ্ল্যাশব্যাক —

বছর দুয়েক আগের কথা!
সেদিন আদ্র তার ফুফির বাসায় যাচ্ছিলো হঠাৎ করে মাঝরাস্তায় য্যামে পড়ে একটা বিশ্রী পরিস্থিতির মুখে পড়েছিল সে। সামনের মোড়ে তাকাতে একটা ফুচকার দোকানে চোখ আটকে গেলো আদ্রের। আর সেদিনই! হা সেদিনই সে তার মায়াবীনির দেখা পেয়েছিল! যেদিন প্রথম তার পাথরহৃদয়ে ফুল ফোঁটেছিল! কি দারুণ করে হাসতে পারে মেয়েটি! একেবারে চঞ্চল প্রকৃতির! প্রকৃতি নিজ হাতেই যেন বানিয়েছে তাকে একটু নিপুণ শৈল্পিকতায় মোড়িয়ে! মিহিয়ার প্রাণবন্ত হাসিতেই মুগ্ধ হয়েছিল আদ্র সেদিন! হাসার সময় মুখের টোলপড়া মুহুর্তটাই যেন থমকে গিয়েছিল সে! কি দারুণ হাসি! মনের গহীনে ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিলো একেবারে।

হঠাৎ ভাবনার মাঝে পথেই ব্যাঘাত ঘটিয়ে পাশে থাকা মোবাইলটা বেজে উঠলো। চমকে উঠে সে মোবাইল হাতে নিতে একরাশ বিরক্ততা ভর করলো চোখেমুখে। কানে দিতেই ওপাশ থেকে নাকটানা নেকামো কণ্ঠে আওয়াজ এলো,,

– আদ্র তুমি জানো না তোমায় আমি কতোটা ভালোবাসি!

-তো!

-তো মানে! তুমি কেন ওই মিডলক্লাস মেয়েটাকে প্রপোজ করেছো? যেটা পুরো লাইভ ছিলো! পুরো বিডি দেখেছে সেটা!!

-নান অফ ইউর বিজনেস! নিতু অন্য কোনো প্রয়োজনে ফোন দিয়ে থাকলে বলতে পারো। অযথা তো আমার সময় অপচয় করিও না। ইউ নো আই ডোন্ট লাইক ইট!

-আদ্র! আমার কথাটা তোমার অযথা মনে হচ্ছে? অন্তত আমার এই কথাটা তো শোনো। আমি তোমাকে…..

বাকি কথাটা বলার আগেই লাইন কেটে দিলো আদ্র। সে জানে নিতু ওকে কি বলবে। আলাইনা নিতু! আদ্রের মামাতো কাজিন। বেশ কয়েকদিন ধরে মেয়েটা ওকে জালিয়ে মারছে। চরিত্র মোটেও ভালো না এই মেয়ের। সারাটা রাত নাইট ক্লাবেই কাটাই! আবার সে আসছে ভালোবাসার কথা বলতে! সেইমলেস গার্ল! নিজেই মিডলক্লাস আবার মিহুকে বলে কিনা মিডলক্লাস! আগে নিজের কথা ভাব। রাগে আদ্র হনহন করে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
____________

আদ্রের লাইন কাটা মাত্রই নিতু মোবাইলটাকে দিলো একটা ঢিল। সাথে সাথে মোবাইলটার প্রাণ সোজা দেহ থেকে বেড়িয়ে আসমানের পথে ওড়াল দিলো..!! নিতুর মেজাজ এখন বেশ তুঙ্গে। নিতু শুধু চাই আদ্রের সাথে কয়েকমাস খুব ক্লোজলী মিশে নিজেকে সেলিব্রেটি হিসেবে তৈরী করতে। তারপর ওকে বিয়ে করতে পারলেই ওর সকল প্রপার্টি হাতে মুঠোয়! সে দাঁতেদাঁত কটমট করে মনে মনে আওড়াতে লাগল,

-তোমাকে যদি আমি আমার না করতে পারি তাহলে অন্য কেউকেই তোমার হতে দিবো না মিস্টার আহান সার্ফারাজ আদ্র! ইউ আর অনলি মাইন!! নো নো ইউর প্রপার্টিজ অনলি মাইন! হা হা হা…. বলে রহস্যময়ী একটা হাসি দিয়ে বেড়িয়ে রুম থেকে।
_____________

সেদিন মিহিয়া বাসায় ঢোকা মাত্রই কুন্তী দিয়ে অসহ্য পরিমাণ মেরেছিল রোকেয়া বেগম। এমন জঘন্যভাবে মারতে তার একটুকু বুক কাঁপেনি। মা হয়েও কষ্ট হয় নি তার! বরং মিহিয়াকে মেরে সেদিন চরম শান্তি নিয়ে ঘুম দিয়েছিল রোকেয়া বেগম। দাগ এখনো পিঠে বেশ চকচক করছে। পানি লাগলেই অসহ্য জ্বালাতন হয়! সেদিন চোখেরজলও শুকিয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। এভাবে
প্রতিটা দিন মিহিয়ার উপর চরম অত্যাচার করেছিল সে। শান্তিতে একবেলা ঘুমোতে আর খেতেও দেয় নি। সব মিলিয়ে বেহাল দশায় ছিলো মিহিয়া। রোকেয়া বেগমের সাথে তো তার মেয়ে রুশাও ছিলো। সেও কম অত্যাচার করে নি মিহিয়ার প্রতি। মাহবুব আলম শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতেন, কিছুই বলতে পারতেন না। মিহিয়া করুণ চোখে তার দিকে তাকালে তিনি সেখান থেকে চলে আসতেন। পারতেন না মেয়েকে এমন ডাইনী মহিলার হাত থেকে রক্ষা করতে। সেদিনের পর থেকে মিহিয়াকে এক সপ্তাহ বাসার বাইরে বের হতে দেয়নি রোকেয়া বেগম।

তবে এই একসপ্তাহে মিহিয়া বেশ কিছু জিনিষ আন্দাজ করতে পেরেছিলো। আসলে কেন তাকে এতো অত্যাচার করে তার ছোটমা! ক্লু পেলেও কি হবে প্রয়োজন তো তার প্রমাণ! এভিডেন্স! কিন্তু পাবে কোথায় সে? প্রত্যেকবার সেই কথাগুলো চিন্তা করতেই গোলকধাঁধায় পড়ছে সে। তাহলে কি এর পিছনে বড় কোনো রহস্য আছে? আমার মাকে তাহলে..! না না এমন কেন করবে আমার বাবা?

আজ সকালে বেশ সকালে উঠেছে সে। আজ আবার ভার্সিটি যাবে। রোকেয়া নিজেই তাকে বলেছে যাওয়ার জন্য। সাথে রোকেয়া বেগম মিহিয়ার মোবাইলটাও দিলো নিয়ে যাওয়ার জন্য। মিহিয়া বেশ অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। কিন্তু কেন বলল এমন তার ছোটমা! নিশ্চয় কোনো কারণ তো আছেই!
_______________

বেশ কিছুক্ষণ হলো ভার্সিটি এসেছে মিহিয়া। ছায়ার জন্যই অপেক্ষা করছে। এই একসপ্তাহে একটিবারও কথা হয় ছায়ার সাথে তার। আধঘণ্টা বলেও এখনও আসছে না ছায়া। তাই সে ক্যাম্পাসে তার প্রিয় জায়গায় যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলো। বেশ নিরিবিলি জায়গাটা! চারদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা জায়গাটা। পাশেই কয়েকটা রুম খালি পড়ে আছে। এইসময় কেউ এই দিকটাতে তেমন আসে না। মিহিয়াও সেই জায়গায় যাচ্ছে। পছন্দের একটা জায়গা। হঠাৎ বা হাতে হ্যাচকা টানে সে খালি রুমেই চলে এলো। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো মিহিয়ার। চোখমুখ কুঁচকে শার্ট খামছে ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু সময় যাওয়ার পরও যখন কোনো সাড়া পেলো না তখন সে আপনাআপনি তার খামছে ধরে রাখা শার্টটা ছেড়ে দিলো। চোখ খুলে সামনে তাকানো মাত্রই দুকদম পিছিয়ে গেলো সে। কারণ তার সামনে সয়ং আদ্র দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মিহিয়ার প্রাণ যায় যায় অবস্থা! কয়েকদিন আগেও তার সবচেয়ে পছন্দের মানুষের তালিকায় ছিলো আর আজ সে তার যমের তালিকায়। ভয়ে একদম হাতের মুষ্টি করে দাড়িয়ে রইল সে। তাকে এমন ভয় পেতে দেখে আদ্র মুচকি হেসে বলল,

-শ্যামাপাখি! ভয় পেয়ো না। তোমার কোনো ক্ষতি আমি করবো না।

আদ্রের কথায় যেন ভরসা পেল মিহিয়া। চোখ তুলে তাকলো সে আদ্রের পানে। ভাঙা ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-ত্ ত্ তাহলে ক্ কেন আমার পিছু নিয়ে ছ্ ছেন?

-রিল্যাক্স! এতো ভয় পেয়ো না মিহুপাখি। উমম্ তোমার পিছু নেয়ার কারণ, তোমায় বড্ড বেশি ভালোবাসি তাই!.

-প্লীজ এসব কথা বলবেন না। আমায় যেতে দিন।

-উফস্ তোমায় ধরেছি তো যেতে দেয়ার জন্যে নয়। তোমায় ধরেছি…

আদ্রের কথায় শেষ হওয়ার আগেই মিহিয়া চেঁচিয়ে রেগে বলে উঠলো,

-কেন ধরেছেন আমায় মিস্টার আদ্র? টেল মি হোয়াই ডিড ইউ গেট মি হেয়ার?

-তোমায় নিয়ে একান্ত সময় কাটানোর জন্য। ভালোবাসায় ভরিয়ে দেয়ার জন্য তোমার এই তিক্তময় জীবনটা।

-আমাস তিক্তময় জীবনটা আমি সামলাতে পারবো। ইট’স নান ইউর বিজনেস। সো মেসার ইউর ওয়ে! বলে হন হন করে সেখান থেকে বেড়িয়ে গেলো মিহিয়া।

আদ্র ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে মিহিয়ার যাওয়ার দিকে। মিহিয়া তার চোখের আড়াল হতেই মুচকি হেসে মনে মনে বলতে লাগল,

-জীবনের যে কোনো মূল্যে তোমাকে আমার করে নেবো মিহুপাখি! আপোষে হোক বা চুক্তি! যেকোনোভাবেই। আই নিড ইউ ইন মাই লাইফ ফরেভার! মিসেস মিহিয়া সার্ফারাজ! মাই চ্যালেঞ্জ স্টার্টেড রাইট নাও!..বলেই

মুচকি হাসি দিয়ে আদ্র তার কাজে চলে গেলো। বেশ শান্তিতে কাটবে আজকের সময়টা আদ্রের। প্রিয়সির দেখা নিয়েই যাচ্ছে খুশি মনে। তবে চঞ্চল মেয়েটার জীবনটাকে যারা এমনভাবে হেলে পরিণত করেছে তাদের কিছুতেই ছাড়বে না আদ্র।

#চলবে