দীর্ঘ রজনী পর্ব-০২

0
460

গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২
,
,
,
,

কলিং বেলের শব্দে সাদের মা অনিলা রহমান তড়িঘড়ি করে এসে দরজা খুলে দিল। তিনি জানেন সন্ধ্যায় এই সময়টায় তার ক*লি*জা*র টুকরোটা ঘরে ফেরে।

দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। দরজা খুলতেই মায়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের কপালে আলতো করে চুমু এঁকে বললো,,, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে মা।

অনিলা রহমান ছেলের মুখের আদলে দুহাত গ*লি*য়ে সন্দিহান গলায় বললো,, চেহারা দেখে সেটা মোটেও মনে হচ্ছে না। কিন্তু যখন বলেছিস ক্লান্ত নিশ্চয়ই ক্লান্ত হবি। তুই সোফায় বস আমি তোর জন্য পানি নিয়ে আসছি।

সাদ মায়ের কাঁধ জড়িয়ে ঘরের ভেতরে যেতে যেতে বললো, তোমার ভাইজি জ্বা*লা*য় ক্লান্ত হচ্ছি ভীষণ। তাই তো তোমার চোখে পড়ছে না মা। নিজের ভাইঝি বলে কথা।পাজিটা জ্বা*লি*য়ে মা*র*লো।

অনিলা রহমান ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। ছেলের কথার মর্মার্থ বুঝতে তার বাকি রইলো না।এই তিন বছরে সাজির প্রতি সাদের ব্যাবহার আর কেয়ার গুলোর সাথে তিনি খুব বেশি পরিচিত। পানি গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললো, জ্বা*লা*য় দেখেই তো হাতে এতো এতো শপিং ব্যাগ। তা আমার ভাইঝি কি এমন জ্বা*লা*তন করলো যে আমার ছেলে এতোটা ক্লান্ত হয়ে গেছে?

সাদ পানির গ্লাস টেবিলে রেখে অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,, আমার জন্য প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে তোমার ভাইঝি। দেখেছো কত বড় সাহস মা? ইচ্ছে তো করেছিলো দুইটা থা*প্প*ড় দেই। কিন্তু পিচ্চিটার চেহারা দেখেই মা*র*তে পারলাম না। আচ্ছা মা তোমার ভাইঝি কি আমাকে কখনো বুঝবেনা?

অনিলা রহমান হেসে সাদের দিকে তাকিয়ে বলল,, বুঝার জন্য কখনো বুঝতে দিয়েছিস? সব সময় ধমকে ধমকে কথা বলিস। মেয়েটা ভ*য়ে সিটিয়ে যায়। তাই আজ তোকে অন্যের ঘাড়ে চা*পাতে চাইছিল বুঝলি!

সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, বুঝতে দিবো কেন? সে বুঝে নিতে পারে না? পিচ্চি তো তাই বুঝতে পারছে না এখন। তুমি বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটু বড় করে দাও মা। তাহলে বলার আগেই বুঝে নিবে।

অনিলা রহমান মৃদু হাসলো। তিনি জানে সাদ সাজিকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু কখনো সাজিকে বুঝতেই দেয়নি। সাদ তার মায়ের কাছে খোলা বইয়ের মতো হলেও। বাইরের জগতের কাছে সে অতিশয় চাপা স্বভাবের।কর্ম ক্ষেত্রে যথেষ্ট গম্ভীর,আত্মীয়-স্বজনের কাছে দায়িত্বশীল। ছেলেটা পুরোই তার বাবার স্বভাবের হয়েছে। মন উজাড় করে ভালোবাসা দেখাতে জানতো না সাদের বাবা। সাদও তার বাবার মতো,তাইতো সাজি আজ ওবদি সাদের ভালোবাসা বুঝতে পারেনি।
সাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, সে নাহয় পরে দেখা যাবে। আগে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।

সাদ ফট করে উঠে শপিং ব্যাগ গুলো মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে টাইয়ের নট ঢিলে করতে করতে বললো,ধরো তুমি তোমার ভাইঝির জন্য যেই তিনটা বোরখা কিনেছো সেই গুলো। আর হ্যা!! তাড়াতাড়ি রেডি হও। এইগুলো দিয়ে আসতে হবে না! যাও যাও!

সাজির জন্য পছন্দ করে কেনা সকল জিনিস গুলোর ভার সব সময় মায়ের কাঁধে তুলে দেয় সাদ। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না । অনিলা রহমান প্রথম প্রথম চমকালেও এখন এইটা নিত্য নতুন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাইতো বিনা বাক্যে ব্যাগ গুলো হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো।

সাদ হেলতে দুলতে রুমে ঢুকে সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেলো।
*
*
*

সাজিঁ এক বুক হতাশা নিয়ে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থনীতি বিষয়টা অপশনাল হলেও তার ধারণা এইটাই মেইন বিষয়। তা না হলে এতো কঠিন হবে কেন? এক সপ্তাহ পর এইচএসসি পরীক্ষা অথচ এই বিষয়ে তার প্রস্তুতি একদম বা*জে। সাজিঁ ভেবেই রেখেছে ফেইল করলে তার জন্য এই জ*ঘন্য বিষয়টাই দায়ী থাকবে। হিসাববিজ্ঞানের বিশদআয় বিবরণীর চাইতে অর্থনীতি কঠিন। বিশদআয় বিবরণী রপ্ত করতে পারলেও অর্থনীতির তত্ব গুলো তার মাথার পাঁচ হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে। রাগে দুঃখে বইয়ের উপর আঁকিবুঁকি করে দুই আ*ছা*ড় মে*রে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, দুই মাথা মোটা ঝগড়া করবি!আর এই ঝগড়া তত্ব বলে চালিয়ে দিবি! আবার সেটা আমাকে পড়তেও হবে! সব গুলো অর্থনীতিবিদ এক একটা হা*রা*মী*র বাচ্চা। পড়বোই না! ধুর!!

দরজার সাথে হেলান দিয়ে বুকে দুহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। মিনিট পনেরো আগে এই বাড়িতে এসেছে। মামুনির সাথে কথা বলে সাজির পড়া দেখার বাহানায় উপরে এসেছিল। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সাজিঁর বকা গুলোই শুনছিলো আর হাসছিলো। সাদ বুঝতে পারে না এই মেয়ের মধ্যে কি এমন আছে যা তাকে বার বার পুলোকিত করে!

কেন সাতাশ বছর বয়সকালে এই এক পিচ্চিকেই মনে ধরতে হলো তার?
কই অনেক মেয়েকেই তো দেখেছে সে , অনেকেই প্রনয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। কারো জন্য তো এমন অনূভুতি হয়নি। না কারো প্রতি কোনো মায়া, না মোহ জন্মে ছিল, আর ভালোবাসা তো দূর দূরান্তেও ছিল না। তাহলে কেন এই সদ্য উনিশে পা দেওয়া পিচ্চি মেয়েটার প্রতি তার সকল মৌহ, মায়া,ভালোবাসা উপচে পড়ছে?
কেন বার বার নিজেকে বিলিন করতেই এই মেয়ের দার গ্রস্থ হচ্ছে? নিজের করা এহেন প্রশ্নে নিজেই হাসলো সাদ।

পকেটে দুহাত গুঁজে পা ফেলে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে গলা ঝেড়ে বলল,, কি সমস্যা?

সাদের গলা শুনতেই চমকে উঠে তড়িঘড়ি করে দাঁড়াল সাজিঁ। হঠাৎ এমন হওয়াতে ভয় পেয়ে গেছে। চোখ মুখ বিবর্ণ রং ধারন করেছে । সাজিঁর কল্পনাতেও ছিল না সাদ ভাই এই সময় হানা দিবে। অবশ্য বছর তিন আগেও সাজির কল্পনায় ছিল না সাদ এই ভাবে তার জিবনে ভয়ংকর ব্যাক্তি হিসেবে টপকাবে। এখন সাজিঁর মনে হচ্ছে সাদ নামের অর্থ কল্পনাতীত। যা হুট হাট চমকে দিবে। অবশ্য এটাকে ঠিক চমকানো বলে না, হার্ট অ্যা*টা*ক বলা যায়। এই সাদ ভাই নামের ব্যাক্তির জন্যই একদিন সাজিঁ হার্ট অ্যা*টা*ক করে ফেলবে বলে ধারণা করছে।

সকল ভাবনার অবসান ঘটিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। অতঃপর আমতা আমতা করে বলল,, কোনো সমস্যা নেই।

সাদ সাজিঁর দিক থেকে চোখ সরিয়ে বললো,, সমস্যা নেই দেখে অর্থনীতিবিদের গুষ্টি উদ্ধার করছিস। সমস্যা হলে মনে হয় এক একটাকে ক*ব*র খুঁড়ে বের করতি!

সাদের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই চমকে তাকালো সাজিঁ। ভয়ে ভয়ে বুকের ভেতরটা কুঁ*ক*ড়ে উঠছে। নির্ঘাত আজ দুই একটা থা*প্প*ড় পড়বে গালে। সাদ ভাইয়ের হাত তার গাল থেকেও বড়। নিশ্চয়ই থা*প্প*ড়ের সাথে চোয়াল ঝুলে পড়বে! চোয়াল ছাড়া মানুষ বাঁ*চে ? বাঁচলেও কেমন দেখাবে তাকে?

সাজির চিন্তা ভাবনাকে আকাশ সমান উচ্চতা থেকে ফে*লে দিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো সাদ। মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই রেগে আছে নাকি স্বভাবিক আছে। অর্থনীতি বইটা সামনে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে বললো,, তোকে বসতে বলার জন্য কি হাইকোর্টে আপিল করতে হবে?নাকি ওবায়দুল কাদের কে দিয়ে ইনভাইট করাতে হবে?

সাদের শান্ত শীতল কথা শুনতেই ঝড়ের গতিতে বসে পড়লো সাজি। ফলশ্রুতিতে টেবিলের সাথে হাঁটু সংঘর্ষে প্রচন্ড ব্যা*থ্যা পেলো। দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে রইলো। চোখ জোড়া ঠিকই টলমল করছে। সাদ না থাকলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো এতক্ষনে। কিন্তু এখন দাঁতে দাঁত চেপে সয্য করাই শ্রেয়।

সাদ দম ধরে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। সাজিঁ ঠিক কতটা ব্যাথ্যা পেয়েছে সে ঠিকই অনুমান করতে পারছে। কিন্তু বসে আছে সাজিঁর রিয়েকশন দেখার জন্য। কয়েক সেকেন্ড পর বই বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, ব্যাথ্যা পেয়েছিস বললেই হয়! আমি বাঘ না ভাল্লুক যে সব সময় দম ধরে থাকিস। বান্ধুবীর প্রেমের প্রস্তাবের বিষয়ে তো মুখে খৈই ফুটে তাহলে এখন কি হলো? ইচ্ছে তো করছে থা*প্প*ড় মে*রে দাঁত ফেলে দেই। ইডিয়েট একটা।

সাদের ধমকে ঠোঁট চেপে কেঁদে উঠে সাজিঁ। কথায় কথায় ধমক দিলে ভয় পাবেই বা না কেন? একটা দিন ভালো করে কথা বলেছে সে? সব সময়‌ থা*প্প*ড় মে*রে দাঁত ফেলে দিচ্ছে । আলগোছে চোখের পানি মুছে নিলো সাজি।

সাদ উঠে রুমের বাইরে চলে গেল।

সাদ যেতেই সাজি হাঁটু ধরে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। ঘরের এমন কোনো আসবাবপত্র নেই যার সাথে সাজির পায়ের আঙ্গুল আর হাঁটুর সংঘর্ষ হয়নি। এই দুঃখেই তার কান্না পাচ্ছে বেশী। তাই সব চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত কান্নায় মনোযোগ দিলো।

বাইরে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে সাদ। মামুনীর ঘর থেকে স্প্রে আনতেই বেরিয়েছিল। ফিরে এসে সাজিঁর কান্নার শব্দ শুনে আর পা বাড়ালো না, থমকে গেছে দু’পা। সাদ জানে এখন সাজিঁর সামনে যাওয়া মানেই কঠিন অ*সুখ বাঁধিয়ে ফেলা।এই মেয়ের কান্না সাদের জন্য ভ’য়ং’ক’র। নাক মুখ লাল করে ঠোঁট কাঁপিয়ে কান্নাটাই সাদের অ*সুখের কারণ। অদ্ভুত ভ’য়ং’ক’র অ*সুখ। চিকিৎসাশাস্ত্রে এই অ*সুখের ঔষধ নেই। আপাতত বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাই তার জন্য মঙ্গল।

চলবে,,,,!

(ভুল গুলো সুধরে দিবেন 😊।)