দুই দুয়ারী পর্ব-০৬

0
115

দুই দুয়ারী

পর্ব ৬

সকালে ঘুম ভেঙে চোখ খোলার ঠিক পরের মুহূর্তেই আমি মিলির কথা ভাবলাম। ওর সাথে এক্ষুনি একবার দেখা না হলে পাগল হয়ে যাব, এমন মনে হতে লাগল। নিজের ভিতরে এরকম অনুভূতি আবিষ্কার করে নিজেই একটু অবাক হতে থাকি, একজন মানুষের কষ্টের কথা ভেবে আমার এত কষ্ট হবে, এমন বিবেক যে আমার আছে, আমি জানতাম ই না! কোলাহল, চিৎকার চেচামেচির শব্দে শুয়েও থাকতে পারলাম না আর, বাইরে বের হয়ে আসতেই হলো।

সোবহান নামের লোকটা আগের দিনের মতোই বসে পরেছে মাটিতে, পা ছড়িয়ে দিয়ে, নিজামুদ্দিন সাহেব বসেছেন চেয়ারে। আরো কয়েকজন অপরিচিত লোক দাঁড়িয়ে আছে কাঁধ শক্ত করে, একগুঁয়ে ভঙ্গি তাঁদের, বিচার না করে এরা ফিরবে না। ইমাম সাহেব দাঁড়িয়েছেন ওদের থেকে একটু দূরে, আবার আমাকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন, যেন আমাকে চেনেন না।

চেয়ারম্যান সাহেব ও বসেছেন, কিন্তু এই দুর থেকেও আমি তার বসার ভেতর এক ধরণের বিধ্বস্ততা টের পাই, হতাশা টের পাই। পুত্র যখন বাবার সম্মান নস্ট করে, সেই বাবার মাথা হয়তো এমন নিচু দেখায়।

উনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এই বাড়ির দুই নারী, তার স্ত্রী আর আমার তরুণী দাদি। আমি জানি তার আঁচলে ঢাকা চোখে অশ্রু, বিষন্নতায় আমার বুকটা ভরে যায় আবার। আর তার স্ফীত উদরের ভিতর বেড়ে উঠতে থাকা আমার বাবার কথাও ভাবি, অক্ষম রাগে আমি ফেটে পরতে পরতে নিজেকে সামলাই।

নিজামুদ্দিন সাহেব আমাকে দেখে খুব পরিচিত ভঙ্গিতে হাসলেন, হাত নেড়ে ডেকে বললেন, ” আসেন। আপনিও আসেন।”

কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না, আমি ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি একজন লোকের দিকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, ” এই হলো রমিজ, আমাদের শেফালীর স্বামী ”

আমি লজ্জায় রমিজের দিকে তাকাতে পারলাম না, আমি তাকালাম আমার দাদির দিকে, খুনখুন শব্দে কাঁদছে সে।

” জোয়ান মানুষ ” চেয়ারম্যান সাহেব তখন বলছেন, ” রক্ত গরম কইরা একটা ভুল কইরা ফেলছে। আমি তার হয়ে সোবহানের কাছে মাফ চাই, জামাইয়ের কাছে মাফ চাই। ”

” আপনার মাফ আমরা চাইনা ” উদ্ধত একটা ছেলে বলে উঠল, ” নজরুলরে বাইর করেন। ওর সাথে কথা বলি ”

দাদি কেঁদে উঠল জোরে এবার, ভিড় করে থাকা লোকদের গুঞ্জন ছাপিয়ে স্পষ্ট শোনা গেলো সেটা। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, ” মেয়েটার দিকে দেখো। পোয়াতি। তারপর দুই বছরের বাচ্চা আসে আরেকটা। এইবারের মত…. আমি দেখবো আর যেন এরকম কখনো না হয়…

উনার একজন সঙ্গী এবার এগিয়ে এসে শেফালীর স্বামীর কাঁধে হাত রাখলেন, এই লোকটার নাম কলিম, এতদিনে জানা হয়ে গেছে আমার। চেয়ারম্যান সাহেবের প্রতি এর ভক্তি ঈশ্বরের পর্যায়ে পরে, সে বললো, ” আপোষে যদি মিটমাট করা যায়? ”

পরবর্তী আধা ঘন্টায় আমি অবাক বিস্ময় নিয়ে দেখলাম কিভাবে পাশার দান উল্টে গেলো। এক টুকরা জমি আর মোটা অংকের টাকার কথা শুনে সোবহান সাহেব আর তার মেয়ের জামাইয়ের চেহারার রং কিভাবে পাল্টে যেতে থাকলো। উনারা দুইজন যাবার তাড়া দেখাতে শুরু করলেন। নিজামুদ্দিন সাহেব আর অন্য গ্রামবাসিরা মুখ চুন করে ফিরে গেল।

আমার চেয়ারম্যান সাহেবকে ঘৃণা হলো, সোবহান কে ঘৃণা হলো, সবচেয়ে বেশি ঘৃণা হলো শেফালীর স্বামীটিকে। আর নিজেকেও একটু ঘৃণা না করে পারলাম না যখন দেখলাম আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি আমার দাদা নজরুল এই যাত্রায় বেচে গেল বলে।

***

আমি দাঁড়িয়ে আছি মিলির বাড়ির সামনে। ওকে আজকে অন্যরকম দেখছি, উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে আছে সে, চুল বাঁধেনি, আঁচল লুটাচ্ছে মাটিতে। চোখের দৃষ্টি কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে, আমার দিকে তাকাচ্ছেনা। আমার বুকটা টনটন করে উঠলো।

আমাকে দেখে ওর মা হাত ধরে টানছে, ” ওঠ, এই ছেড়ি উইঠা ভিতরে যা। মানুষ আসছে ”

মিলি শুনলোনা, বসে রইলো চুপচাপ। ওর বাবা তখন বের হয়ে এসেছেন ঘর থেকে, উঁচু গলায় বললেন, ” মজা দেখতে আসছ? যাও। এখানে দাঁড়ায় থাকবানা। যাও “।

আমি ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কোথায় যাবো জানিনা, আজ আর গাছের গুড়িতে যেয়ে বসে থাকার মন নেই, অবসাদ লাগছে। কোত্থেকে জালাল এসে হাটছে আমার পাশে পাশে, আমি বললাম, ” স্কুল নাই তোমার? ”

ছেলেটা হাসল, ” কিছু পড়ায় না। দুইদিন না গেলে কিচ্ছু হয়না। আর আজকে মিলিবুর মন খারাপ। এরকম হয় কোন কোন দিন। কাউর সাথে কথা বলেনা তখন। বাবা বলসে কাছে কাছে থাকতে ”

আমি ইমাম আহেবের উপর রাগ করতে পারলাম না আজকে। আমি নাহয় জানতাম না, উনি তো সব জানেন। আর জেনে শুনেও মিলির জন্য ওনার মনে যে স্নেহের সমুদ্র টের পাচ্ছি, গ্রামের একজন অর্ধশিক্ষিত মানুষের জন্য সেটা অনেক বড় মহানুভবতা, নাকি প্রগতিশীলতা বলবো?

” বাবা কোথায়? ”

” মসজিদে। আপনি যান কই? ”

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি, ” চা খাবো।”

এখন আমার হাঁটার অভ্যাস হয়ে গেছে, অনায়াসে মাইলের পরে মাইল হাঁটতে পারি, আর গরুর গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকিনা। চা খেয়ে আবার সেই স্কুল ঘর, আবার সেই বটগাছ। আজ রাতে আমি ওই বাড়িতে ফেরত যাবোনা, অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত বসে থাকবো এইখানে। কিছু খাবোনা সারাদিন, পানি ও না। মিলি কি তবু আসবে না?

আসলোনা। রাতে পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসে রইলাম ভুতের মত, সে আসলোনা। ওদের বাড়ির একটু দূরে ঘন বাঁশের ঝাড়, সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবলাম, কোনভাবে ওকে ডাকা যায় কিনা, অনেক রকম শব্দ করলাম, কেউ বের হলোনা।

সকালের দিকে অবসন্ন পায়ে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির পথ ধরলাম, অনেকটা স্বার্থপরের মতোই। ভেবেছিলাম ওই বাড়ি আর যাবোনা, কিন্তু তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্যকর গোসলখানা আর আমার জন্য বরাদ্দকৃত ছোট বিছানাটা আমাকে টেনে নিয়ে গেলো।

***

উঠোনে বসেছিলেন চেয়ারম্যান সাহেব, এইভাবে তাকেও কখনো দেখিনি। খালি গা, হাতে হাতপাখা, থেকে থেকে নিজের বিশাল ভুঁড়িতে হাত বুলাচ্ছেন। তার পাশে সবসময়ের মত দাঁড়িয়ে আছে কলিম আর আরেকজন সঙ্গী।

আমাকে দেখে ডাকলেন, ” ভাবসিলা আর আসবানা তাই না? আমি বুঝি” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ” নজরুলরে ঢাকায় পাঠাইসি। থাইকা আসুক কয়েকদিন। এখানে সব একটু ঠান্ডা হইলে ফিরুক “।

আমি বসলাম, হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে ফেললাম, ” ওরা রাইফেল পেলো কোথায় চাচা? ”

” যুদ্ধের পরে জমা দেয় নাই ” উনার কণ্ঠ বিষন্ন শুনালো, ” একটাই ছেলে আমার। আদরে আদরে মাথায় তুলসি। এখন আর আমার নাগালে নাই। আমারেই শাসায়। কি পাপ যে করসিলাম ”

আমি উঠে পরি। আমার কিছু ভালো লাগছেনা। মার কথা মনে পড়ছে খুব।

***

আরো সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমি কিছু বন্ধু জুটিয়ে ফেললাম। এক রাতে অচেনা পথ দিয়ে একা একা হাটছিলাম উদভ্রান্ত পথিকের মত, পুরো গ্রামটা এখনো চিনে উঠতে পারিনি তাই পথ হারিয়ে ফেললাম। টিমটিমে আলো দেখে এক বাড়িতে প্রবেশ করি সাহায্যের আশায়, সেখানে চলছিল তাসের আড্ডা।

বয়স এদের আমার কাছাকাছি, কিন্তু পড়াশোনা করছেনা কেউই। স্বাভাবিক অবস্থায় এধরণের লোকদের সাথে আমি হয়তো কথা ও বলতাম না। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক অপ্রাকৃতিক একটা ঘটনা আমাকে উদার এবং নিরহংকারী করে দিয়েছে, নতুন আমাকে আমার বেশ ভালোই লাগে।

গত কিছুদিন ধরে রোজ নিয়ম করে এখানে আসি বিকেলে, হাসি ঠাট্টাও করি মাঝে মাঝে। ঠিক আমার শহুরে বন্ধুদের মত এদের মধ্যেও নারীদের নিয়ে আগ্রহ আর তৃষ্ণার কোন শেষ নেই। আমার ভীষণ হাসি পায় ভেবে যে, পঞ্চাশ কেন, আমি যদি পাঁচশো বছর আগের পৃথিবীতেও হাজির হতাম, পুরুষেরা এমনই থাকতো হয়তো!

প্রতিদিন আড্ডা দিয়ে আমি অবধারিতভাবে মিলির বাড়ির সামনে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। ওর সাথে দেখা না হলেও কেন যেন আমার খুব ভালোই লাগতে থাকে। যখন আমি ফিরে যাই, কারো জন্য অপেক্ষায় আছি, এই আনন্দেই আমার মুখে হাসি লেগে থাকে।

অবশেষে দশদিন পরে আমি ওর দেখা পেলাম।

***

বিকালে একটু বৃষ্টি হয়েছিলো, বাতাসটা তখনও একটু ভেজা ভেজা। সোদা মাটির গন্ধকে আমি ভালোবাসতে শিখে ফেলেছি এখন, সেই পাগল করা সুবাসের মধ্যে আমি ওকে দেখলাম। চাঁদের আলোয়, পুকুর পাড়ে।

আমাকে দেখে হাসলো ও, দেখে আমার একটু কান্না পাবার মত হলো, লজ্জায় আমি দ্রুত অন্যদিকে তাকালাম।

” অনেকদিন দেখিনাই আপনাকে ” সে বললো, কি দ্বিধাহীন এই মেয়েটা, শহরে থেকে পড়াশোনা করলে হয়তো অনেক বড় কিছুই করতে পারতো।

” আমি প্রতিদিন এসেছি মিলি, তুমি আসোনি ”

হঠাৎ বিষন্নতায় ছেয়ে গেলো মুখটা, ” আমার মাঝে মাঝে এমন হয়। ওইখান থেকে ছাড়া পাবার পরে থেকে… ” বলতে বলতে কি ভেবে বিষন্নতাটা মুছে ফেলে হাসলো, ” আপনে ভালো আছেন? ”

আমি বসে পরলাম, ” মিলি? ”

” বলেন? ”

” তোমার খুব কষ্ট? ”

সমুদ্রের মত চোখ তুলে তাকালো এবার, ” ও। সব শুনছেন তাই না? ঘিন্না করলে চলে যান। আমার কোন কষ্ট নাই ”

আমি প্রগলভ বোধ করি, ” চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো। ঘিন্না মানে? ”

প্রথমে ভীষণ অবাক হয়ে তারপর খিলখিল করে হেসে ফেললো, ” আপনার কথা আমার বিশ্বাস হয়। ”

” হয়? ”

জবাব নেই, আমি আবার বললাম, ” মিলি তুমি জানো প্রেম কি? ”

” হিহিহিহি। জানি তো। গ্রামের কত ছেলে আমাকে পটাইতে চাইতো জানেন? তারপর তো… ”

” তারপর কিছুনা।” আমি বললাম, ” তারপরে আমি। বাকি সব ভুলে যাও “।

” আপনি খাওয়া দাওয়া করেন না মনে হয়। শুকায় গেসেন। এখন আমি ভালো আছি, কালকে রান্না করবো। আসবেন খাইতে? ”

” হু ” বলে আমি দুরুত্ব একটু কমাই, ফিসফিস করে বলি, ” মিলি, তোমার হাত ধরবো? ”

উত্তর না পেয়ে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। কি নরম, পেলব হাত, আমার কি ইচ্ছে করছে, নিজেই বুঝতে পারছিলাম না।

” মিলি ? ” না বুঝতে পেরে ডাকি, কয়েকবার, ” মিলি? মিলি? ”

ও অন্যদিকে তাকিয়েছিল, একটু পরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ” আমি এত অপমান হইছি, জানেন, এমন ও গেছে দিনের পরে দিন শইলে কাপড় ছিলোনা। ভাবছিলাম আর কোনোদিন লজ্জা পাবোনা। আজকে এত লজ্জা লাগে কেন?…. ” মাথা নিচু করে ও একটু হাসলো।

বাকিটা রাত আমরা বসে রইলাম , সুন্দর একটা সকালের প্রত্যাশায়।

চলবে।