দুই দুয়ারী পর্ব-০৫

0
108

#দুই দুয়ারী

পর্ব ৫

সকালে আবার সেই চায়ের দোকানে চেয়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছি, দোকানি আজ বেশ আন্তরিক। মনে হয় আমার পরনের পোশাকের জন্য অথবা এরা সবাইকে এমনি আপন করে নেয়, তাই। আমারো আজকে সেইদিনের অস্থিরতাটা নেই, যা আছে টা বিষন্নতা, সীমাহীন বিষন্নতা। বাবাকে আর বিশেষ করে মাকে একটাবার শুধু দেখার জন্য আকুলতা। তবু নির্লিপ্ত মুখে চায়ে চুমুক দিচ্ছি, যেন কোন এক অচিনপুরে একলা হারিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা হরহামেশাই হচ্ছে।

” কালকে আবার ঝামেলা হইসিলো ” দোকানি গলা নিচু করে বলল, ” ইমাম সাহেব শুনছেন নাকি কিছু? ”

” নাহ ” ইমাম সাহেব আড়মোড়া ভেঙে বললেন, ” কি হইসে? ”

” সোবহানের মেয়ে বাড়ি আসছে, টা জানেন তো? সেই নজরুল গিয়া হাজির। আমি বলি কি, তোর এত বাপের বাড়ি আসার শখ কেন? জানোস তো ঝামেলা আসে? ”

আমি কান খাড়া করলাম। নজরুল? কি করেছে সে? সেদিনের নিষ্ঠুর হাসি আর দলবল নিয়ে আমাকে বিদ্রুপ করার কথা মনে পরল, জানতে চাইলাম, ” কেমন ঝামেলা? ”

ইমাম সাহেব হাস্লেন, ‘ ঐ মিয়া, ছোট ভাই কিন্তু সেই বাড়িতে থাকে, উনাদের আপনার লোক। কথাবার্তা বুইঝা শুইনা বইলেন”

সত্যিই আমি উনাদের আপনার লোক, কতটা আপনার তা ইমাম সাহেব জানেন না, কল্পনাও করতে পারেন না, আমি হাসি চাপলাম , তবে কৌতূহলটা গেলনা।

” এখানে থাকলে এমনেই জানব একদিন” বলে দোকানি চুপ করে গেল।

আজকে আমার আর গাছের গুড়ি ধরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছেনা, ওনাদের কথাবার্তা শোনার পরে কেন যেন দাদির জন্য মন টানছে। এই এক সপ্তাহে একদিন ও তার সাথে দেখা হয়নি। অবশ্য আমি কেবল রাতে ঘুমাতে গিয়েছি ওখানে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্কুল ঘরের মাথে কাটিয়েছি। আমি উঠে পরলাম।

কত বয়স হবে মেয়েটার? কোনোভাবেই কুড়ির বেশি নয়, আরো কম ও হতে পারে । অথচ তার একটি সন্তান ইতিমধ্যে ঘরময় দুষ্টুমি ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে, তার উদর স্ফীত হয়ে আছে আরেকটি সন্তানের সম্ভাবনায়। আমি অবাক হয়ে আমার দাদির দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের সময়ে এই বয়সী মেয়েরা হেসে খেলে বেড়ায়, অদ্ভুত বিষন্নতায় আক্রান্ত হলাম আমি।

মেয়েটা আমার সামনে পরে লজ্জা পেয়ে গেল, আঁচল টেনে পেট ঢাকতে চাইছে, আমি এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে শুকনো মরিচের ঝাঁপি কেড়ে নেই, ” আপনি বসেন। কি করতে হবে বলেন আমাকে? ”

লজ্জায় আমার তরুণী দাদির মুখখানা শুকনো মরিচের মতোই লাল দেখায়, কোনোমতে বলে, ” কিছু লাগবোনা ”

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কোন এক সোবহান এর মেয়েকে নিয়ে গতকাল কি ঝামেলা হয়েছিলো, আমি ওর পায়ের কাছে বসে পড়ি মাটিতে, ” নজরুল ভাই কোথায়? ”

” আসেন কোথাও। আমি বলতে পারিনা ” অন্যমনস্ক, দুঃখী একটা কণ্ঠ।

আমি হেসে বললাম, ” জানেন আমি ভবিষ্যত বলতে পারি? আপনার আরেকটা ছেলে হবে। তারপর আরেকটা। তিনটা ছেলে। ”

অবাক হয়ে তাকাচ্ছে মেয়েটা, ” আমি শুনছি আপনি গাছের গোড়ায় বইসে ধ্যান করেন। সত্যিই তিনটা ছেলে হবে আমার?”

” হ্যাঁ। সত্যিই ”

***

” আমি এই গ্রামে থাকবো কিছুদিনের জন্য” চেয়ারম্যান সাহেবকে বললাম সেদিন সন্ধ্যায়, ” আর এভাবে আপনার বাড়িতে ততদিন বিনা পয়সায় থাকা খাওয়া আমার জন্য খুব লজ্জার। কোন কাজের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন? ”

উনাকে বেশ চিন্তিত মনে হল, ” তোমাকে দেইখে শিক্ষিত মনে হয়। বাপজানের পড়াশুনা কি? ”

আমি একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করছিলাম, দ্বিতীয় বর্ষ শেষ করে তৃতীয় বর্ষ শুরু করার কথা ছিল শীঘ্রই, এতো কথা না বলে বললাম, বি এ পাশ করেছি।

” তাহলে আমার ছোট ছেলেটারে পড়াও ” উনি ঘোষণা করলেন, ” লজিং থাকো। ওর পড়াশোনায় মন আছে, পড়ায়া মজা পাবা “।

আমি রাজি হয়ে গেলাম।

দুপুরে আমার ছাত্রকে নিয়ে বসতে শুরু করলাম। সপ্তম শ্রেণীর গণিত বুঝাই আর মনে মনে ভাবি, কি হবে একে পড়িয়ে? পঞ্চাশ বছর পরের পৃথিবীতে এই ছেলেটির কোন অস্তিত্ব নেই, কেউ বছরেও একবার মনে করেনা।

***

প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে এখন চায়ের দোকানটায় যাই, তারপর যাই স্কুলে, আমার প্ৰিয় গাছটা দেখতে। গাছের গোড়ায় দীর্ঘসময় বসে থাকার কারণে এবং দাঁড়ি গোঁফ ব্লেড বা ছুরি দিয়ে কামাবার অক্ষমতার কারণে আমাকে অনেকেই মুনি ঋষি টাইপ কেউ ভাবতে শুরু করে। আমার মজাই লাগে।

শুধু মিলি, কেন যেন মনে হয় সে আমার ভেতরটা দেখতে পায় আর মনে মনে আমাকে নিয়ে হাসে। সন্ধ্যা মেলাবার আগে আগে, যখন সে জানে আমি এখন চলে যাবো, প্রায়ই জালালের হাত ধরে চলে আসে। আর যেদিন সে আসেনা, আমি রাত বিরাতে তাদের পুকুর পাড়ে হাজির হই। আমরা গল্প করি, এই অচেনা জায়গায় ওকে আমার একমাত্র বন্ধু মনে হয়।

” সোবহান চাচার মেয়ে শেফালী ” সে বলল এরকম এক রাতে, ” নজরুল বিয়া করতে চাইছিলো ওরে, কিন্তু শেফালী খুব জিদ্দি, বৌ আসে এমন ঘরে সে যাবেইনা। ”

” বৌ ছিল তখন নজরুলর? ” আমি আকাশ থেকে পরি , আমার অল্প বয়সী দাদির সরল দুঃখী চেহারা আবার চোখে ভাসে।

” হ্যাঁ ছিল তো ” সে খিলখিল করে হাসে, ” আপনি কিছু জানেন না। ওনার মেয়ে মানুষের দোষ আছে ”

” কিসের দোষ ? ”

আমার অবাক কণ্ঠ শুনে ও আবার সুরেলা গলায় হাসে, ” আপনি এতো বোকা। ঢাকার মানুষ সবাই এমন বোকা নাকি? ”

পরে গম্ভীর হয়ে বলল, ” চেয়ারম্যান চাচা নিজেই এক দিনের মধ্যে শেফালীরে বিয়ে দিয়ে বিদায় করলেন, নিজের ছেলের থেকে বাচাইতে”

” এখন সে বাড়ি আসছে আর নজরুল ঝামেলা করতেসে, তাই না? ”

” হমম। আমার বান্ধবী লাগে তো, বলসে আমাকে। নজরুল বলসে একবার হইলেও যাওয়া লাগবে, নাইলে সমস্যা হবে। ”

” একবারের জন্য কি? ”

হাসতে হাসতে ভেঙে পরছে সে, ” সেটাও আমি বইলে দেব? ”

ওকে বুঝাতে পারিনা, জীবনের জটিলতা সম্পর্কে আমার ধারণা শূন্যের কোঠায়। বাইশ বছর এই যুগে খুব বেশি বয়স না।

জীবনের জটিলতা সম্পর্কে না জানলেও প্রেম সম্পর্কে আমার ধারণা ভালোই, সেই ধারণা থেকে বলতে পারি, আমি বেশ প্রেমে পরে গেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠে সব কিছুর আগে আমার এই মেয়েটির কথা মনে পরে, রাতে তো ভাবতে ভাবতে টের ই পাইনা কখন ঘুমিয়ে যাই। যখন দেখা হয়, বুঁকের গুড়গুড় শব্দ কোনরকমে আড়াল করে রাখি, আবার ফিরে এলে মনে হয়, এই শব্দ ওর শোনার দরকার ছিল!

একদিন এমন হলো, আমি গাছের নিচে চোখ বন্ধ করে বসে থেকে শুধু ওর জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। ওইদিন ভুলেই গিয়েছিলাম ২০২৩ এর কথা, মা বাবার কথাও।

মাঝে মাঝে মনে পরে আধুনিক থেকে আধুনিকতর পোশাক পরা তরুণীদের নিয়ে আমার আর আমার বন্ধুমহলের অযাচিত আগ্রহের কথা। আমার বন্ধুরা জানলে আমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করতো নিশ্চিত।

তবে গ্রাম জীবনের জটিলতা সম্পর্কে আমার আরো একটু ধারণা হলো। কয়েকদিন পরে।

***

চায়ের দোকানে অলস বসে আছি, যদিও মাথার ভেতরে চিন্তা চলছে ঝড়ের গতিতেই। ভাবছি, এখানে যদি থেকেই যেতে হয় তাহলে কি করবো? এই গ্রামে সারাজীবন থাকবো না নিশ্চই? আচ্ছা আমি মিলিকে বিয়ে করে ওকে নিয়ে যদি ঢাকায় চলে যাই? ভেবে আমার পুলক হয়, কিন্তু রক্তের সম্পর্কের লোকগুলিকে ফেলে চলে যাব? কি করবো একা একা?

এই সময় রোদ কেটে ছায়া পরলো আমার উপর , তাকিয়ে দেখি বিশালদেহী এক ভদ্রলোক আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তার বপুখানা সূর্যর আলোকে বাঁধা দিয়েছে আমার গায়ে পরতে।

” গ্রামে আসছো এক মাস, থাকতেও চাও শুনছি, একটা দিন আইসা আমাকে সালাম দিয়া গেলানা” ভদ্রলোক বললেন। ওনার সাথেও আমি দুজন লোক দেখলাম, কি আশ্চর্য! এই গ্রামে সবাই দলবল নিয়ে চলাফেরা করে নাকি?

আমাকে বসে থাকতে দেখে দোকানি ইশারা করছেন, আমি বুঝলাম ইনি হয়তো কোন গুরুত্বপূর্ণ লোক, আমার উচিত দাঁড়িয়ে ওনাকে সম্মান জানানো। আমি ঝামেলা না বাড়িয়ে উঠে দাড়াই, লোকটা আমার ঘাড়ে হাত রাখলো, ” আসো আজকে বিকালে একবার। মিটিং আসে। তোমার মত শক্ত সামর্থ জোয়ান মানুষ, নজরুলের লুঙ্গির নিচে না থাইকা ওরে ঠেকাও। ”

লুঙ্গির কথায় আমার হাসি পেয়েছে। বলতে নেই, নজরুলের লুঙ্গি পরে আমি রাতে ঘুমাই।

***

অনেকটা কৌতূহলের বশে আমি বিকেলে ওই মিটিংয়ে হাজির হলাম। ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছি, ওনার নাম নিজামুদ্দিন, নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন, জিততে পারেননি। লোক সমাগম দেখে আমি একটু অবাকই হলাম, তার সমর্থনকারীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয় তো! আর সেই সমর্থণকারীদের ভেতর মিলির বাবা আর ইমাম সাহেবকে আবিষ্কার করে বেশ চমকে উঠেছিলাম।

আমি একটু হেসে ভদ্রতা করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু ইমাম সাহেব আমাকে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন, যেন আমাকে চেনেন না। তার বদলে অন্য একটা লোক উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ” এ এখানে কি করে? এ তো নজরুলের লোক “।

আমি কারো লোক নই, বিশেষ করে নজরুলের তো নই ই। বরং তার চরিত্রের ঘৃণ্য একটি দিক অতি সম্প্রতি আমি জানতে পেরেছি, নিজের দাদা হিসেবে যেই শ্রদ্ধাটুকু তার প্রতি আমার ছিল, সেখানে যথেষ্ট বড় ফাটল ধরেছে এখন।

নিজামুদ্দিন সাহেব বললেন, ” আরে বসো মিয়া। সে নতুন মানুষ, কার লোক এখনো বলা যায়না।বরং আজকে আমরা এইখানে কেন আসছি, তাই নিয়া কথা বলি ”

এক ভদ্রলোক শুরু থেকেই মাটিতে পা মেলে বসে কাঁদছিলেন, তিনি মুখ খুললেন, ” আমি কিছু জানিনা। আপনে বিচার করেন, নাইলে আমি নিজেই কিছু করবো “।

আমি পাশে বসে থাকা কম বয়সী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করি, ” কিসের বিচার? কি হয়েছে? ”

” গতকাল সারারাত নজরুল শেফালীর ঘরে ছিল। সোবহান চাচা, চাচি, শেফালীর ভাতার সব বাইরে। ”

আমি আঁতকে উঠি, ” কি যা তা বলছেন? আর ওনারা কেউ কিছু বলল না কেন? ”

” ওর চ্যালারা বাইরে এদের ধইরা রাখসে। তাদের কাছে রাইফেল আসে, মাথার উপর রাইফেল থাকলে আপনিও….

খুব জঘন্য অপমানজনক একটা কথা সে বলল তারপর, কিন্তু আমার তা গায়ে মাখার মত অবস্থা নেই। আমার মাথা ঘুরছে ভোঁ ভোঁ করে। লজ্জায় অপমানে আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে, এই আমার পরিবারের ইতিহাস? ছিঃ! ছিঃ।

তবু আশায় বুক বেঁধে বললাম, ” কোথাও ভুল হচ্ছে না তো? ”

লোকটা সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মাটিতে থুথু ফেললো এক গাদা, এরপর আমার সাথে কথা বলে লাভ নেই, এই ভঙ্গী করে দূরে সরে গেলো একটু। আমি তাকালাম নিজামুদ্দিন সাহেবের দিকে। সেকি! ওনার মুখে হাসি! আমার গা শিরশির করে উঠল। এখানে হাসির মত কি কিছু হয়েছে?আমার কেন যেন মনে হলো, ঘটনার ভয়াবহতায় ইনি অখুশি হননি, বরং চেয়ারম্যান সাহেবের উপর প্রতিশোধ নেবার এক সুবর্ণ সুযোগের সম্ভাবনায় আনন্দিত হয়ে উঠেছেন!

” সোবহান তুমি বলো ” মোলায়েম কণ্ঠে বললেন উনি, ” কি হইলে তুমি খুশি হও? ”

” ওরে ন্যাঙটা কইরে বাজারে ঘুরান ” অন্য একটা লোক বলে উঠল, অপরিচিত এই লোকটার গলায় অনেক ক্ষোভ, ” তারপরে গ্রাম থেকে বাইর করেন। আর যেন এইখানে না দেখি ”

সন্তুষ্টির হাসি নিজামুদ্দিন সাহেবের চোখে মুখে, আগের চেয়েও মোলায়েম আর নরম গলায় বললেন, ” আহ হা। তুমি বলো কেন লাল মিয়া? মেয়ের বাপরে বলতে দাও”

আরেকজন বলল, ” মাইরা ফেলি হারামজাদারে? ”

আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। উনি আমার দাদা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো তার স্ত্রীর গর্ভে আমার বাবা লালিত হচ্ছেন… লোকটা মরে গেলে তার ভবিষ্যত কি হবে? আমাদের ধানমন্ডির বাড়ি, লাল টয়োটা গাড়ি? আমি? আমাদের কি হবে?

শুনতে পাই ইমাম সাহেব কথা বলছেন, ” আমি বলি কি একবার চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে আগে কথা বলি? উনি তো ভালো মানুষ। দেখি উনি কোন ব্যবস্থা নেয় কিনা? ”

আমি নিশ্চিত নিজামুদ্দিন সাহেব এই কথায় খুশি হননি, কিন্তু আরো কয়েকজন একমত হবার কারণে হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। আমিও হাপ ছেড়ে বাঁচলাম সেদিনকার মত। খুব দ্রুত আমাকে কিছু করতে হবে, আমার পরিবারের ভবিষ্যত আমাকেই নির্ধারণ করতে হবে। খুব সম্ভবত এই কারণেই আমার এখানে আসা।

***

” এতো অন্ধকার কইরা বাড়ি ফিরলে খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা হয় ” খাবার দিতে আসা মহিলাটি বললো আমাকে। আমি লজ্জা পেলাম, এনারা আলো থাকতে থাকতে খেয়ে ফেলেন, রাতে আমার জন্য মোমবাতি বা হারিকেনের তেল বাড়তি খরচ তো বটেই। এমনিতেও সূর্য ডুবলেই ঘুমিয়ে পরার অভ্যাস এখনো করতে পারিনি, মাঝে মাঝেই রাতে আলো জ্বালাই, এরা হয়তো সেটা নিয়ে আলোচনা করে।

খাবার তখনও শেষ হয়নি, এই প্রথম বারের মত নজরুল (ভাই ) আমার ঘরে এলো। মোমবাতির স্বল্প আলোয় তার হাসিটাও আমার কাছে নিজামুদ্দিন সাহেবের মত ধুর্ত মনে হয়। আমার দাদির কথা ভাবি, বাবা চাচাদের কথা ভাবি, আর আমার প্রচন্ড রাগ হতে থাকে।

” ছোট ভাই বিভিন্ন জায়গায় আসা যাওয়া করতেসেন তাইলে ইদানিং ” হেসে বলল, আমি বুঝলাম আজ বিকেলে বিপক্ষদলের সাথে আমার দেখা করার বিষয়টি তার অজানা নয়।

আমি জবাব দিলাম না, সে হাসছে খিক খিক শব্দে।আমি বেশ ভালো আকৃতির শক্ত গড়নওয়ালা মানুষ, মাসে পাঁচ হাজার টাকায় জিমে ভর্তি। আমি চাইলে এই লোকটাকে পিটিয়ে মাটিতে শুইয়ে দিতে পারি, আমার হাত নিশপিশ করছে।

” আপনার তো ওই মিলির সাথেও খুব ভাব হইসে শুনতে পাই ” বলে হা হা করে বিশ্রী নিষ্ঠুর হাসি হাসল, ” ওর কাহিনী মনে হয় কেউ বলেনাই আপনারে? ”

আমি চমকে তাকালাম, কিসের কাহিনী?

” ওরে তো ক্যাম্পে নিসিলো। হেহে। চার মাস ছিল। দেখেন না কেমন বেলাজের মত ঘুইরা বেড়ায়? ভয়ডর নাই? ভয়ডর থাকবো কেন? কে তাকাইবো ওর দিকে? ”

পৃথিবীর আর কোন কিছু আমার মনে রইলোনা। মিলির বিষন্ন সুন্দর মুখটা চোখের সামনে ভাসতে লাগল, আর তার রিনিঝিনি শব্দের হাসি। অথচ ওই হাসির আড়ালে কি কষ্ট লুকিয়ে ছিল আমি বুঝতেই পারলাম না? কত বড় স্বার্থপর আমি, আমি কি আসলেই মানুষ?

একটু আগেই বলছিলাম, জিমে গিয়ে নিয়মিত শারীরিক কসরত করা পেটানো শরীর আমার, সেই আমি বালিশে শুয়ে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম বাচ্চা মেয়ের মত । আমার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? মিলি, তোমার ভয় করেছিল তখন? অনেক কষ্ট পেয়েছিলে? তোমার মন খারাপ করে? আমি সব ঠিক করে দিব, দেখো? যত কষ্ট পেয়েছো, তার হাজার হাজার গুন আনন্দ তোমার পায়ের কাছে এনে দিব আমি… আর কিছু না, এই জন্যই হয়তো আমার এখানে আসা।

চলবে।