দুই_হৃদয়ে_সন্ধি পর্ব-১৪+১৫

0
83

#দুই_হৃদয়ে_সন্ধি
#পর্বঃ১৪
#Nova_Rahman

‘রাত তখন ১১ টা বেজে ৪০ মিনিট। গভীর রাতের আঁধারে আচ্ছাদিত জনবহুল শরহটা। এই নিশুতি রাতে কেউ কেউ গভীর ঘুমে বিভোর। আবার তো কেউ কেউ রাত জেগে পার্টি করতে ব্যস্ত।’

__রিক হাওলাদার আর উনার স্ত্রী চৈতালি হাওলাদার এক ঘন্টা যাবত একিই সুরে একটা কথায় বলে যাচ্ছেন। তাতান চৌধুরীকে সপরিবারে এই হাওলাদার বাড়িতে আজকে রাত্রি যাপন করতে হবে। এদিক সেদিক একটুও না বললে চলবে না। থাকতে হবে মানে থাকতেই হবে।
লম্বা চওড়া বলিষ্ট দেহের অধিকারি তাতান চৌধুরীও আঁটসাঁট বেধে লেগেছেন। নাছোড় বান্দা তিনিও মেয়ের বিয়ের আগে, কিছুতেই মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে থাকবে না। না মানে, ১৪৪ ধারায় না। এদিক সেদিক একটুও হ্যাঁ না।__

“চৈতালি হাওলাদার স্বামীর এমন ব্যর্থতা দেখে বিরক্ত হলেন। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখন স্বামীর উপরেই তাক করা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে স্বামীকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো। তাকাল দেখলো আর বিড়বিড় করে বলল, আপনি আসলেই অকর্মা আমড়া কাঠের ঢেকি এসপি সাহেব। আপনার ধারা কিছুই হবে না।”

‘চৈতালি হাওলাদার এবার স্বামীর থেকে চোখ ফিরিয়ে মুখ ঘোরালো। দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সুদূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহানারা চৌধুরীর দিকে। চৈতালি হাওলাদার দ্রুত এসে তার হাত দু’খানা দিয়ে জাহানারা চৌধুরীর হাত দু’খানা দৃঢ়মুষ্টি করে ধরলো।’

‘অনুনয় করে বলল, আপা একটা রাতের ব্যাপারেই তো। থেকে যান না। রাত তো ঢের হলো। এই এতো রাতে ছেলে মেয়ে দুইটাকে নিয়ে, বাড়ি ফিরা ঠিক হবে বলে মনে হয়।’
_কি অনুনয় সুরে বলা কথা ব্যথাতুর হদয়স্থল চৈতালি হাওলাদারের। যেনো কোনো এক আগাম বিপদ সংকেত উপলব্ধি করতে পেরে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে সারা শরীর। তাই তো এতো আকুতি মিনতি করা।”

‘জাহানারা চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বন্দী হাত দুটো মুক্তি করলেন চৈতালি হাওলাদারের দৃঢ়মুষ্টি থেকে। চৈতালি হাওলাদারের কথার প্রতিত্তোরে জাহানারা চৌধুরী ম্লান হেঁসে, স্থুল কন্ঠ খাঁদে নামিয়ে বলল, না আপা, এ হয় না। দয়া করে এমন অনুনয় আবদার করবেন না। শুকনো মুখে ফিরে দিতে বড্ড পড়ান পোড়ে।’

‘কিছু সময় অতিবাহিত হলো। এখনও দুই পরিবারের মধ্যে থাকা না থাকা নিয়ে তুমুল কথা কাটাকাটি হচ্ছে। তুমুল কথা-কাটাকাটির হুলুস্থুল পরিবেশে ডয়িং রুমে মধ্যিখানে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে রোদ। সোফার উপর ক্লান্ত শরীর-খানা এলিয়ে দিয়ে নিরব দর্শকের মতো দেখে গেলো সবকিছু। ’

‘তরু আড়চোখে তাকাল রোদের দিকে, কি অদ্ভুত! শান্ত বিরল তার চক্ষু চাহনি। কিন্তু এই সেই চাহনিতে তরুকে আঁটকে রাখার বিন্দু মাত্র প্রয়াস নেই। তরু আবাক হয়ে বলল, আপনি বড়ো অদ্ভুত প্রকৃতির মানব, ডাক্তার সাহেব। আমি চলে যাবো, অথচ আপনার চোখে তার কোনো অস্থিরতা দেখতে পারছি না। কোনো উতলা নেই। অথচ দিনশেষে আপনি একটা কথায় বলেন, আমি আপনার এক জনমের তৃষ্ণা। আপনাকে বুঝা বড়ো দায়। আপনাকে বুঝতে গেলে হয়তো আমার মনে বিতৃষ্ণা চলে আসবে। তবুও আপনাকে বুঝা হয়ে উঠবে না।’

__কথা-কাটাকাটি এক পর্যায়ে রিক হাওলাদার ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন সোফার এক পাশে। তাতান চৌধুরী দপাদপ পা ফেলে রিক হাওলাদারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মিহি কন্ঠে বলল, চল এগিয়ে দিয়ে আসবি। নত মাথা তুলে উপর তাকাল রিক হাওলাদার। দু’হাতে বর করে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালেন তিনি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হেঁটে চললো দরজার দিকে।
চৈতালি হাওলাদারও বলবার জন্য আর কিছু খোঁজে পেলো না। অপরাপর হয়ে দাড়িয়ে রইল ঘরের এক কোনে।__

’তরু ফের তাকাল রোদের পানে। রোদের দৃষ্টি এখনও শান্ত বিরল। তরু চলে যাওয়ার কোনো অস্থিরতা নেই রোদের মধ্যে। সপ্তদশীর মন ভেঙ্গে তখন একাকার । সেই দায় বার কে নিবে। তরু আর ভাবলো না। তরু এক পা দু’পা করে শেষবারে মতো রোদের সামনে এসে দাড়াল। ম্লান হেসে, মিহি কন্ঠে তিনটি শব্দ উচ্চারণ করে বলল, আসি ডাক্তার সাহেব। ব্যথায় অশান্ত হৃদয়কে আর একটু অশান্ত করার জন্য তরু এতটুকু কথায় যথেষ্ট ছিল।’

“রোদ সেই আগের মতোই বসে রয়েছে। রোদের থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে, তরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়ালো সামনের দিকে। তরু চলে যেতেই রোদ চোখ তুলে তাকাল সামনের দিকে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনও তরুর দিকেই তাক করা। সেই শান্ত বিরল চক্ষু চাহনিতে বর করেছে একরাশ হিংস্রতা। চোখের নিচের পাপড়িগুলো ফুলে গেছে। মিশ্রণ শরীরের রং পরিবর্তন করে রক্তজবার লাল রং ধারণ করেছে। এই বুঝি চোখের পাপড়িগুলো থেকে লাল রং খসে পড়বে। কি মাধুর্য তার চোখমুখে। রাগে ঠকঠক করে কাঁপছে ওষ্ঠদ্বয়। রেগেমেগে হিংস্র হয়ে গেলেও যে কাউকে এতো সুন্দর লাগে। সেটা রোদকে না দেখলে বুঝায় যেতো না।”

‘এক বুক হতাশা নিয়ে হাওলাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো তরু। গাড়ির কাছে আসতেই তরু অনুভব করলো মৃদু বাতাস বহিছে। দখিনা বাতাস। দখিনার মৃদু বাতাস কখন কখনও বড়সড় রূপ নিয়ে তরুর শরীরকে শিহরিত করে যাচ্ছে। অবাধ্য চুলগুলোকে বারংবার উড়িয়ে দিচ্ছে। তরু খুব ইচ্ছে করলো দু’হাত মেলে দিয়ে বাতাসকে নিজের গায়ে মেকে নিতে। এতে যদি রোদের শরীরের ছোয়া পাওয়া যায়।’

‘তরুর তার চোখ সরাল। অদূরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,

__শোনো বাতাস, তুমি আমার কাছে আসার আগে। আমার ডাক্তার সাহেবের গা গেসে এসো৷ আমার মনকে শান্ত করার আগে আমার ডাক্তার সাহেবের মনকে শান্ত করো। আমাকে ভালোবাসার আগে, আমার ডাক্তার সাহেবকে ভালোবেসো। আমি স্বাদরে গ্রহণ করে নিবো তোমাকে। সারা অঙ্গে মেখে নিবো তোমার ঐ ঝলসানো বাতাসকে।
মলিন মুখে বিদায় নিলো চৌধুরীর বাড়ির সবাই। পিছনে ফেলে এসেছে আরো তিনটি হতাশ হওয়া মন। তাতান চৌধুরী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার এ বিষয়ে কিছু করার ছিলো না। শো শো শব্দ করে, গভীর রাতে হাইওয়ের রাস্তার ওপর দিয়ে দ্রুত বেগে যাচ্ছে যান্ত্রিক চার চাকার গাড়িটা। তরু জানালার দিকে মুখ তাক করে তাকাল। এই নিস্তব্ধ শান্ত পরিবেশে গাড়ির চাকার দমকে শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজ তরুর কানে ভয়ংকর ঠেকলো।

বন্ধুকে বিদায় দিয়ে ভীতুস্থু নয়নে মাথা নত করে বাসায় প্রবেশ করলো রিক হাওলাদার। নিভু নিভু লাইটে ডয়িং রুমের থমথমে পরিবেশ। রোদ মাথা তুললো। সামনে তাকাল। আপাদমস্তক বাবাকে পর্যবেক্ষণ করলো। সামনে থাকা ট্রি টেবিল থেকে কাচের গ্লাসটা হাত নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে ফেললো। কয়েক টুকরো কাচ গেঁথে গেলো হাতে। রোদের হাত বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এমন দৃশ্য দেখে চৈতালি হাওলাদার ভয় পেয়ে, উত্তেজিত গলায় ছেলে শুধাল,
কি করছিস বাপ। এমন করিস না। তোর হাত থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এমন হুটহাট কেনো রেগে যাস। আমার ভয় হয় তখন। আমরা তো চেষ্টা করলাম তরুকে রাখার। কিন্তু তারা তো থাকতে নারাজ পোষণ করলো। আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তার পরেই তো তরু সারাজীবনের জন্য তোর হয়ে যাবে।

মায়ের কথায় রোদ যেনো আরো রেগে গেলো। ভাঙ্গা গ্লাসটা হাতের মধ্যে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। চোখ মুখ রাগে রক্ত লাল হয়ে পড়েছে। চৈতালি হাওলাদার ভয়ে আর কথা বাড়ালো না। রিক হাওলাদার হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল স্ত্রীকে। রোদ আলতো হেসে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়াল। মায়ের দিকে তাকাল আর বলল, ভয় পেয়ো না আম্মু। আমাকে যারা ভয় পায়, আমি তাদের পছন্দ করি না। কেউ আমাকে ভয় পেলে, আমার রাগ তার প্রতি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। রোদ আর কথা বাড়ালো না। চলে গেলো উপরের তলায় নিজের কক্ষে।

রিক হাওলাদার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ছেলেটা কেনো যে এমন সাইকো হলো। হুট করেই রেগে গিয়ে সব ভুলে যায়। চৈতালি হাওলাদার পিছন থেকে এসে স্বামীর কাধে হাত রাখলো। স্বামীকে শান্তনা দিয়ে বলল, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। তরু আসলেই রোদ একদম স্বাভাবিক হয়ে যাবে। স্ত্রীর কথা আলতো হেসে জবাব দিলো,,তাই যেনো হয়।

রোদ কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো। ক্ষিপ্ত মস্তিষ্ক আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়লো নরম বিছানায়। হাতটা বিছানায় রাখা মাত্রই টান অনুভব করলো রোদ। হাতটা তুলে চোখের সামনে এনে ধরলো সে। রক্তমাখা কাচের টুকরো গুলো চকচক করছে। মনে হলো কোনো এক শিল্পীর অমূল্য শিল্পকর্ম। রোদ হাসলো। ক্লান্ত শরীরটা টেনেটুনে নিয়ে উঠে বসলো। রোদ ওষুধের বক্সটা নিয়ে এসে হাতে ব্যান্ডিজ করলো। পাশের টেবিলে বক্সটা রেখে আবার শরীর এলিয়ে দিলো নরম বিছানায়।

দু’হাতে কপাল ঠেকিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো রোদ। চোখ বন্ধ করতেই যেনো তরু এসে হানা দিচ্ছে মনে। তারপরেও ঘুমানোর চেষ্টা করলো রোদ। তরু বাসায় এসেই ফোন নিয়ে কল দিলো রোদের নাম্বারে। রোদ তখন ঘুমে বিভোর। দুইবার রিং হয়ে কেটে গেলো কল। তরু ফের কল করলো। বার বার ফোনের এমব কর্কশ শব্দে রোদের ঘুম হালকা হয়ে গেলো। রোদ হাত দিয়ে বিছানার এপিঠ ওপিঠ খুঁজে, ফোনটা হাতে নিলো। ঘুমে অচেতন মন নিয়ে কল রিসিভ করলো রোদ। ফোন কানে নিয়ে রোদ স্থুল কন্ঠে শুধালো, কে বলছেন? এতো রাতে কিসের দরকার।

রোদের ঘুম ঘুম কন্ঠে বলা কথাখানি শুনে তরু ছলকে উঠলো। বিমোহিত হয়ে শুধালো,
আমি, আমি তরু।

তরুর কথাখানি কর্ণগোচরে পৌঁছাতেই রোদ হম্বিতম্বি করে উঠে বসলো শুয়া থেকে। এক আকাশ সমান বিস্মিত মন নিয়ে রোদ শুধাল,

তুমি! এতো রাতে কী? হঠাৎ এতো রাতে ফোন করলে যে মেয়ে। আবেশিত মন কি রোদের সান্নিধ্যে আসতে চাচ্ছে। বলো তাহলে। এই রোদ সদা প্রস্তুত তোমাকে একটুখানি ছুয়ে দিতে। বলো কি দেবে আমায়, তোমাকে একটুখানি ছুঁতে।

তরু থমকালো, হাসলো একটু লজ্জা পেয়ে মিহি কন্ঠে বলল,
আমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার এতো ইচ্ছে ডাক্তার সাহেব। তাহলে আসুন ছুঁয়ে দিন আমাকে। নিয়ে যান আপনার মনের কোনো এক অজানা শহরে। যেখানে সবসময় রাত্রি নামবে। ভালোবাসা হবে রাতে আঁধারে। সাক্ষী থাকবে শুধু রাতে আঁধারে, আকাশে ঝুলে থাকা কলঙ্কময়ী সেই চাঁদটা।
ভালো হবে না বলুন।

তরু কথা শোনে রোদ হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। রোদ বুঝলো, সপ্তদশীর মন আবেগে টইটুম্বুর। আবেগরা হয়তো বেসামাল হয়ে পড়েছে।

রোদ আলতো হেঁসে তরুকে শুধালো,

আমি ছুঁয়ে দিলে অকালেই ঝরে যাবে,
গলে যাবে যে বরফ গলে না।

তখন কি করবে মেয়ে? রোদ ছুঁয়ে দিলে তো কলঙ্ক লেগে যাবে। তোমার এতো ঝলসানো রূপে কলঙ্কের দাগটা বড্ড বেমানান লাগবে। এখন তুমি বলো আমি কি করবো। কলঙ্ক লাগাবো নাকি দূরে থাকবো। আমার তো লোভী মন। বড্ড লোভ হয় তোমাকে ছুঁয়ে দিতে। একদম গভীর থেকে গভীরও ভাবে।

তরু চমকাল। লজ্জায় ছলকে উঠলো আবেশিত মন। মনোস্থীর করে, কঠিন কন্ঠে রোদকে শুধালো, আপনি চরম লেভেলের অসভ্য লোক।

রোদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, একদম ঠিক বলেছো তরু। আমি শুধু অসভ্য নই। একদম চরম লেভেলের অসভ্য। তোমাকে দেখলে শুধু অসভ্য না, আমার মনটা অভদ্র হয়ে পড়ে। এক্ষেবারে ইয়াম্মি ইয়াম্মি টাইমে চলে যেতে ইচ্ছে করে। এখন বলো এই অভদ্র মনকে কেমনে বুঝাবো। তুমি বিহীন একটা রাত।

লজ্জায় তরুর কান গরম হয়ে গেলো। লজ্জায় তরুর কন্ঠরোধ। এমন লজ্জাকর পরিস্থিতিতে তরু লজ্জা কমাতে, তড়িঘড়ি করে কল কেটে দিলো। রোদ হাসলো। হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিলো বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ। তরু দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে রেখে লজ্জা কমারনোর বৃথা চেষ্টা করছে।

আবার এ রাতে যেনো দুই হৃদয়ের সন্ধি হলো। দুই হৃদয়ের সন্ধি যেনো ভালোবাসার তৃতীয় প্রহর শেষ করলো। আজকে এই দু হৃদয়ের সন্ধির সাক্ষী হলো আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘ আর ঐ মস্ত বড়ো চাঁদটা।

চলবে____ইনশাআল্লাহ

#দুই_হৃদয়ে_সন্ধি
#পর্বঃ১৬
#Nova_Rahman

তরু গালে হাত দিয়ে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে, এক মনে দেখে যাচ্ছে রোদকে। রোদ খুব সুন্দর করে ছোট ছোট লোকমা দিয়ে খাবার খাচ্ছে। তরু শান্তির একখানা শ্বাস নিলো। রোদের থেকে চোখ সরিয়ে অদূরে তাকাল। কাঁচের গ্লাস বেধ করে অদূরে দেখা মিললো কিছু ভিন্ন জাতের পাখি। তরু দেখলো আর তাদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করলো। ঠিক তার পাশেই, বিশাল বড়ো গাছের নিচে, সান বাঁধানো বসার জায়াগায়, এপ্রোন পড়া অনেক ছেলে মেয়েকে আড্ডা দিতে দেখা যাচ্ছে। তরু মুগ্ধ নয়নে তা পর্যবেক্ষণ করলো।___

‘বন্ধুদের নিয়ে দুপুরে খাবার খাওয়ার জন্য ক্যান্টিনে আসলো নীহারিকা। আসার সময় রোদকে অনেক খুজেছে। কিন্তু হঠাৎ করে রোদ কোথায় চলে গেলো তা ঠাওর করতে পারলো না নীহারিকা। রোদকে না পেয়ে অন্যথায় একাই আসতে হলো নিজেকে। ক্যান্টিনের মধ্যিইখানে টেবিল থেকে একদল ছেলে মেয়ে খাবার খেয়ে উঠে গেছে। নীহারিকা তার ফ্রেন্ডদের নিয়ে সেখানটাই গিয়ে বসলো। পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে টেবিলটা পরিষ্কার করলো। নোংরা টিস্যু গুলো ফেলতে গিয়ে, নীহারিকার চোখ গেলো ক্যান্টিনের কর্ণারে বসে থাকা রোদের দিকে। নীহারিকা ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল। দ্রুত পা ফেলে রোদের সামনে গিয়ে দাড়ালো।’

‘কারো পায়ের শব্দ এসে নিজের নিকটে থামতেই, তরু চকিতে পেছন ফিরে তাকাল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলো ব্যাক্তিটির। তরুর ক্রুদ্ধ দৃষ্টি এখন তার উপরেই নিবদ্ধ। চোখে মুখে রুষ্টতার ছাপ স্পষ্ট। তরু কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইলো। বিরক্ত লাগছে। তরুর কাছে এই নীহারিকাকে মহা-মারী ভাইরাসের মতো লাগে। বিনা কারণে, বিনা নিমন্ত্রণে যেখানে সেখানে চলে আসে। তরু আর তাকাল না। চোখ ঘুরিয়ে অন্যথায় তাকাল।’

‘রোদের কোনো হেলদোল নেই। রোদ খুব তৃপ্তী করে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। রোদের এমন খামখেয়ালি দেখে নীহারিকার রাগ লাগলো। রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর নিয়ে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেললো। আকস্মিক নীহারিকা তার হাত দু’টোকে টেবিলে উপর সজোরে রাখলো। দু’হাতে টেবিলে ভর দিয়ে, রোদের দিকে দৃষ্টি তাক করলো।’
__রোদ খাবার রেখে চোখ তুলে তাকাল সামনে থাকা ব্যক্তিটির দিকে। ক্ষুব্ধ নয়নে আগুনের ঝলক বের হবে হবে এমন অবস্থা। রোদ ভ্রু কুঁচকে নীহারিকাকে প্রশ্ন করলো__
কি ব্যাপার! কী সমস্যা তোর? যখন তখন, সময়ে অসময়ে আমার প্রেমে ভিলেন হয়ে ডুকে পড়িস। আমাকে প্রেম করতে বাঁধা প্রধান করিস। তোর এই অসুখের সমাধান কী? তারাতারি সমাধান বের কর। না হলে দেখা যাবে, ভবিষ্যতে তুই আমার বাসর ঘরে ভিলেন হয়ে বসে আছিস। ভালোবাসার রোমাঞ্চকর মুহূর্তে বাঁধা প্রধান করছি। বউকে ভালোবাসি এই ব্যাপারটাকে তাল থেকে তিল বানিয়ে। বউকে ধ/র্ষ/ন করার অপরাধে মামলা টুকে দিয়েছিস। দেখ এমন হলে হবে না। তুই তোর রাস্তা দেখ আর আমাকে শান্তিতে থাকতে দে। রোদ একদমে কথা গুলো বলে থামলো। আশেপাশে সবার দৃষ্টি এখন রোদের দিকে সীমাবদ্ধ। রোদের তাতে কিছু যায় আসে না।

ঐ দিকে, রোদের কথা শোনে নীহারিকা হতবিহ্বল হয়ে। পড়ে। এ সে কোন রোদকে দেখছে। রোদ ভালোবাসায় পাগল হয়ে এমন নি/র্ল/জ্জ হয়ে গেছে। যদিও মেডিকেল স্টুডেন্ট দের আদোতেও লজ্জা শরম থাকে না। তারপরেও নীহারিকার কেমন জানি অদ্ভুত লাগলো। নীহারিকা এবার ক্ষুব্ধ হয়ে রোদকে কঠিন কন্ঠে শুধালো___
দেখ রোদ। সম্পর্কে তুই আমার বয়ফ্রেন্ড । আর আমি তোর গার্লফ্রেন্ড। আমরা দু’জন দু’জনকে ভালোবাসি। আমরা দু’জন দু’জনকে কতোবার ভালোবাসি কথাটি বলেছি। আমরা এক সাথে কতো সাঁঝ বেলায় বসে গল্প করেছি। আমাদের কতো স্মৃতি রয়েছে। আমাদের রিলেশনশিপের আজকে এক বছর পূর্ণ হলো। আর তুই সব কিছু ভুলে গিয়ে এই রাস্তার মেয়েটাকে আপন করে নিয়েছিস। কেনো রোদ? কেনো?
এই থার্ডক্লাস মেয়েটার মধ্যে কি আছে। যা আমার মধ্যে নেই। প্লিজ আন্সার মি রোদ।

পাশেই থাকা পানি গ্লাসটা হাতে নিয়ে,রোদ ঢগ ঢগ করে এক গ্লাস পানি শেষ করে ফেলে। তরু ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে রোদের দিকে। তরু আজকে কিছু বলবে না। যা বলার আজকে রোদকেই বলতে হবে। আজকে রোদকেই সব কিছু ক্লিয়ার করতে হবে। তরু বসে রইলো। আর রোদকে দেখতে লাগলো।

রোদ পানির গ্লাসটা রেখে চোখ ঘুরালো নীহারিকার দিকে। রক্ত চক্ষু নিয়ে, আঙ্গুল উচিয়ে নীহারিকাকে শাসিয়ে বলল,
ছোট লোক না। ভাবি বল তরুকে। রোদের বউ হয় তরু। সম্মান দিয়ে কথা বল। না হলে তোর অবস্থা আমি কি করবো। সেটা আমি নিজেও জানিনা। সাবধান নীহারিকা, একটু সাবধান। কথাবার্তা বুঝেশুনে বলবি। তুই আমার ফ্রেন্ড বলে যে আমি তোকে ছেড়ে দিবো। সেটা কখনোই ভুল করেও ভাববি না। আমি আমার মা বাবাকেও ছাড় দেয়, তবে ছেড় দেয় না। সেখানে তুমি কে বলো?

__আর রইলো গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ডের কথা। সেটা তো আমি দয়া করেছিলাম তোর উপর। মনে ছিল, আমি রোদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, তুই তিন তালা ছাঁদের উপর থেকে লাফ দিতে চেয়েছিলি। আমি কিন্তু দেখতে চেয়েছিলাম, তুই কেমনে লাফ দিস। কিন্তু কি করবো বল,ভাগ্য খারাপ হলে যা হয় আরকি। তাতান স্যারের অনুরোধ ঐদিন আমি তোর হ্যা তে হ্যাঁ বলে ছিলাম। এটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত। আর বাকি রইলো তোর সাথে বসে গল্প করার কথা। সে-তো মেডিকেলের অনেক মেয়েই রোদের সাথে সময় কাটাতে চাই। রাতে হোক বা দিনে। কিন্তু সেই সুযোগ কি আর সবাই পায়। তুই না হয় সিরিয়ালটা সবার আগে পেয়ে গেলি। সেটা রোদের ফ্রেন্ড বলে কথা। সেই ভাগ্য কি আর সবার হয়।__

রোদের কথা শোনে নীহারিকা হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। লজ্জায় এদিক সেদিক মুখ লুকানোর চেষ্টা করছে। জুনিয়র সিনিয়র ক্লাসমেট সবাই ক্যান্টিনে নীহারিকার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। লজ্জায় নীহারিকার মরন দশা অবস্থা।

রোদ উঠে এলো চেয়ার ছেড়ে। এ পা দু পা করে নীহারিকার পাশে এসে দাঁড়াল। নীহারিকার দুই বাহুতে হাত রেখে সামনে ফিরালো। রোদ এবার নীহারিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল__
শোন নীহু, ভালোবাসা জোর করে হয় না। ভালোবাসা হয় মন থেকে। দুই হৃদয়ে সন্ধিতে। একটা হৃদয় যখন অন্য একটা হৃদয়ে সাথে সন্ধি করে। তখন সেখানে ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা থেকেই জীবনের পথ চলা। এখন তুই যদি জোর করে ভালোবাসা আদায় করতে চাস। তাহলে সেটাকে আমি কিছুতেই ভালোবাসা বলবো না। তুই যখন কাউকে মন থেকে ভালোবাসবি, তখন তার ভালো থাকা ভালো লাগাটাও কে প্রাধান্য দিবি। এভাবে সার্থপরের মতো নিজের ভালো থাকা টাকে ভালোবাসা বলে না। সব দিক বিবেচনা করেই ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসতে হয়। তারও তো কাউকে ভালো লাগতে পারে। সেও তো কাউকে ভালোবাসতে পারে। শুধু তোর দিক দেখলেই তো হবে না।

নীহারিকা আর কিছু বলল না। মাথা নতজানু করে দাড়িয়ে আছে। নীহারিকা এবার নত মাথা তুলে সামনে তাকালো। রোদের দিক আঙ্গুল তাক করে, রোকে শাসিয়ে বলল,
আমি তোকে ছাড়বো না রোদ। এই অপমানে প্রতিশোধ আমি নিবোই নিবো। দরকার হলে তোর প্রিয় জিনিসটা তোর থেকে দূরে সরিয়ে দিবো।

নীহারিকা কথার বিপরীতে রোদ শরীর দুলিয়ে হাসল। রোদের এমন খামখেয়ালি পনা হাসি দেখে নীহারিকার গা জ্বলে উঠলো। নীহারিকা ক্যান্টিনে আর বসে না থেকে, বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ালো। নীহারিকাকে চলে যেতে দেখে, রোদ গলা স্বর উচ্চ করে বলল,__

শোন নীহারিকা, এখন আমাকে আর মরে যাওয়ার ব্ল্যাকমেইল করে কোনো লাভ নেই। আমি তোর নামে থানায় মামলা ঠুকে দিয়ে এসেছি। তুই এখন মরে পেত্নী হয়ে গেলেও, আমাকে কেউ দোষারোপ করতে পারবে না। এখন তোর মারার ইচ্ছে হলে তুই মরে যা। দাফন কাফনের কাজ বাকিটা আমরা দেখে নিবো। নীহারিকা রাগে দপা দপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো।

রোদ দৃষ্টি ঘুরালো। চেয়ারে বসে থাকা তরুর দিকে দৃষ্টি তাক করলো। রোদ ভ্রু নাচিয়ে তরুকে জিজ্ঞেস করলো__
কি ব্যাপার ম্যাডাম। মন খারাপ? এতো গুলো সত্য যেনে কি রোদের প্রতি ভালোবাসা কমে গেছে। দেখো তরু, আমি চাইনি তোমার কাছ থেকে এসব লুকাতে। কিন্তু পরিস্থিতি আমার হাতে ছিলো না। মানুষ স্বভাবতই পরিবর্তনশীল। তার সাথে মানুষের কর্ম। ভবিষ্যতে তুমি অনেক সত্যির সামনা-সামনি হবে। তবে সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা রাখতে হবে।

রোদের কথার প্রতিত্তোরে তরু মুখে কিছু বলল না। শুধু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো।

রোদ হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো তরুর দিকে। তরুও মুচকি হেসে রোদের হাতে হাত রেখে উঠে এলো চেয়ার ছেড়ে। রোদকে চলে যেতে দেখে, পাশ থেকে জুনিয়র একটা মেয়ে দ্রুত পা ফেলে একদম রোদের সামনে এসে দাড়াল। রোদ ভ্রু কুঁচকে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো__
কি ব্যাপার পথ আঁটকে দাঁড়ালে কেনো? কিছু বলবে? রোদের প্রশ্নের প্রতিত্তোরে মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো।
রোদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
ঠিক আছে। কি বলবে তারাতারি বলো। আমি শুনছি। রোদের অনুমতি পেয়ে, মেয়েটি উৎসাহিত কন্ঠে বলল__,
রোদ ভাইয়া,আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি। মানে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। মেয়েটি তরুর দিকে ইশারা করে বলল,
যখন তোমার পাশের ঐ মেয়েটার টাইম শেষ হয়ে যাবে। তখন তুমি আমাকে তোমার গার্লফ্রেন্ড বানিয়ো। প্লিজ।
মেয়েটির কথা শোনে তরু হতভম্ব হয়ে কথা বলতে ভুলে গেছে। এমন লাজ লজ্জাহীম মেয়েও পৃথিবীতে আছে। তরু ভেবে পেলো না। তবে, এটা মেডিকেলের ক্যান্টিন না হয়ে স্কুল হলে। তরু এতোক্ষণে মেয়েটি চুল ছিঁড়ে দিতো।

রোদ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে ছিল মেয়েটির দিকে। সাহস আছে বলতে হবে। জুনিয়র হয়ে রোদকে প্রপোজ করে। রোদ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে, দাঁতে দাঁত চিপে বলল,
শোনো মেয়ে,
আমার পাশে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির সময় এই ইহজন্মেও ফুরবে না। মৃত্যুও যদি তরুকে আমার পাশ থেকে আলাদা করে ফেলে। তাহলে আমার মৃত্যুর পরেও আমি তরুকেই চাইবো আমার পাশে। নতুন রূপে নতুন ভাবে।

শোনো মেয়ে,
তরু কোনো খেলনার পুতুল না। আমি যে থাকে ছুড়ে ফেলে দিবো। তরু আমার গার্লফ্রেন্ড না। আমি যে তার সাথে সময় কাটিয়ে ব্রেকআপ করে ফেলবো। তরু হচ্ছে আমার বউ। আমার হৃদয়ের রানী। যাকে হারালে আমি নিজেই হারিয়ে যাবো। নেক্স টাইম বুঝে শুনে কথা বলবে।
রোদের এমন কথা শুনে জুনিয়র মেয়েটি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
আপনি বিয়ে করে ফেলেছেন রোদ ভাইয়া।
রোদ দুষ্ট হেসে বলল,
শুধু বিয়ে না। আমরা বাসরও করে ফেলেছি। এখন শুধু প্রতিদিন রাতে বাচ্চা নেওয়ার প্রসেসিং চলে। সুখবর আসলে তোমাদের সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবো। ওখেইই!

তরু আর দাড়ালো না। বিরক্ত লাগছে খুব। দপাদপ পা ফেলে তরু বেরিয়ে আসলো ক্যান্টিন থেকে। তরুকে চলে যেতে দেখে রোদও গেলো তরুর পিছন পিছন। রোদ চলে যেতেই, ক্যান্টিনে উপস্থিত কিছু মেয়ে, একদল হয়ে রোদকে নিয়ে ঝগড়া করছে। কেউ বলছে আমি রোদকে ভালোবাসি তো আবার অন্য কেউ সেখানে বা হাত ঢুকিয়ে বলছে। আমিও রোদকে ভালোবাসি।
উদয় তার ফোনটা বের করে ভিডিও ক্যামেরা অন করলো। উদয়ের মতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্য হচ্ছে মেয়েদের চুলোচুলি দেখা। এতো সুন্দর মূহুর্তটাকে ক্যামেরা বন্ধি না করতে পারলে এ জীবন বৃথা যাবে। মেডিকেল স্টুডেন্টদের মাথার তার ছিড়ে পড়াশোনা করে। আর এই মেয়েগুলোর মাথার তার ছিঁড়েছে রোদকে দেখে।

তরু ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে একটা পার্কে আসে। পার্কটা অবশ্য মেডিকেলের ঠিক পাশেই। পার্কের ভিতরে একটা সুন্দর পুকুর আছে। শান বাধানো ঘাট। ঠিক তার পাশেই শিমুল তুলর গাছ। শিমুলের লালা ফুল ভেসে বেড়াচ্ছে পুকুরে পানিতে। পুকুরে পানিটাকে কেমন রক্ত লাল লাগছে। তরু হাসলো, মনোমুগ্ধকর নয়নে তা পর্যবেক্ষণ করলো। এই ভ্যাবসা গরমে মানুষ ক্লান্তি দূর করতে এই পুকুর পাড়ে আসে। তরু আসলো অশান্ত মনকে শান্ত করতে।

রোদ দৌড়ে এসে তরুর পাশে খালি জায়টায় বসে পড়লো। রোদ গিটার আনতে রুমে গিয়েছিলো। যার জন্য আসতে একটু দেরি হলো। রোদ আসার সময় ফুলের দোকান থেকে তরুর জন্য একটা বকুল ফুলের মালা নিয়ে আসলো।
তরু আড়চোখে একবার রোদকে দেখলো। ঘেমে একাকার পড়নের শার্ট। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা। তরু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না। ঘামে জবুথুবু ছেলেটাকে তরুর কাছে মারাত্মক সুন্দর লাগছে। তরু দৃষ্টি ঘুরালো। অদূরে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
আপনি আস্তো একটা নেশা ডাক্তার সাহেব। আপনাকে দেখলেই আমার কেমন মাতাল মাতাল লাগে।

রোদ এবার সোজা হয়ে বসে তরুর দিকে দৃষ্টি তাক করলো। তরুকে বিড়বিড় করতে দেখে রোদ ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো__
কি হলো তরু! একা একা কী বিড়বিড় করছো? রোদের কথায় তরু দৃষ্টি ঘুরিয়ে রোদের দিকে তাকালো। মাথা নাড়ি না বললো।
রোদ আর কিছু বলল না। তরুর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, বকুলের মালাটা পড়িয়ে দিলো তরুর হাতে। বকুলের মালা দেখে তরু চোখ খুশিতে ঝলকে উঠে। তরু আলতো হেসে মিহি কন্ঠে রোদকে ধন্যবাদ জানালো।

রোদ হতাশ হয়ে তরুকে শুধালো__
এইভাবে আলতো না হেসে, রোদের মতোও তো হাসতে পারতে। এইভাবে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট না করে। একটা চুমুও তো দিতে পারতে। ধন্যবাদের থেকে চুমুতে একটা বড়লোকি ব্যাপার স্যাপার কাজ করে।

তরু দাঁত কটমট করে রোদকে শাসিয়ে বলল,
চুপ করুন অসভ্য লোক। আপনার সব জায়গাতেই চুমু আর চুমু। এতো চুমু খাওয়ার এনার্জি আসে কোত্থেকে? আগে বিয়েটা হোক। তারপর আপনাকে চুমুর উপরেই রাখবো। দরকার হলে মহিলা কলেজে আপনাকেে দান করে দিয়ে আসবো। তখন দেখবো কতো চুমু খেতে পারেন আপনি। আস্তো খবিশ কোথাকার!

আর রইলো রোদের মতো কেনো হাসলাম না? এই গরমে এমনিতেই জীনব তেজপাতা। এখন যদি আরো রোদের মতে হাসতে বলেন। তাহলে তো জিন্দেগী কবরের নিচে চলে যাবে। তখন আপনি আমাকে কোথায় পাবেন? রোদের মতো হাসা বন্ধ করুন। আর আপনি রোদ একটু উত্তপ্ত কম হোন। আপনার ঝলসানো রোদে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আপাকেই তো নিতে পারছি না। যা উত্তাপ আপনার।

তরুর কথার প্রতিত্তোরে রোদ হাসলো। মিহি কন্ঠ কাঁদে নামিয়ে বলল,
তোমাকে ভালোবাসার ছাদরে ঝলসে দেওয়ার জন্যই তো রোদ এসেছে।
রোদের কথা শুনে তরু ভ্রু কুঁচকে তাকাল রোদের দিকে। রোদ আলতো হেসে তরুকে বলল, গান শুনবে?
প্রতিত্তোরে তরু মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল।

রোদ গিটারের টুংটাং আওয়াজে গান গায়তে লাগলো____

‘ বকুলের মালা শুকাবে’
‘রেখে দেবো তার শুরভী’

‘দিন গিয়ে রাতে লুকাবে’
’ মুছো না’কো আমার এ ছবি’

‘ আমি মিনতি করে গেলাম’
‘তুমি চোখের আরাল হও’

‘কাছে কি বা দূরে রও’
’ মনে রেখ আমিও ছিলাম ’
‘এই মন তেমাকে দিলাম।’

রোদের আবেশিত কন্ঠে গান শুনে, তরু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো তার ডাক্তার সাহেবের পানে। উতালপাতাল বাতাসে তরুর এলোমেলো চুল গুলো আচড়ে পড়ছে চোখে মুখে। তরু যেনো এবার বিরক্ত হলো না। সময় আর মূহুর্তটাকে উপভোগ করলো চোখ বন্ধ করে।

চলবে__ইনশাআল্লাহ