দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-০২

0
868

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#২য়_পর্ব

তবে ছেলেটিকে কোথাও তো দেখেছিলো। ঠিক মনে পড়ছে না চারুর। হঠাৎ ছেলেটি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হেটে চারুর সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের দেখাটা হয়েই গেলো, চারুলতা”

আগুন্তকের শ্রুতিমধুর কন্ঠের কথাটা মস্তিষ্কে ঝংকার তুললো। নিউরনগুলো অস্থির হয়ে উঠলো। চারুর কপাল কুঞ্চিত হলো। মনোযোগ সহকারে ছেলেটির মুখপানে চেয়ে রইলো। মস্তিষ্ককোষে জোর দিতে লাগলো, স্মরণ করা চেষ্টাইয় লিপ্ত হলো ঠিক কোথায় এই আগুন্তককে দেখেছিলো। চারুর প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ হলো, কিন্তু ছেলেটিকে স্মরণ করতে পারছে না সে। চারুর কোমল মুখশ্রীতে চিন্তার বলিরেখা দেখে ছেলেটা স্মিত হাসলো, তারপর বললো,
“আমি শ্রাবণ, কলেজের বৈশাখ অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো। মনে পড়লো”

হ্যা, এবার চারুর সত্যি মনে পড়লো এই আগুন্তক কে! তার পুরো নাম জায়ান শাহরিয়ার শ্রাবণ। এই ব্যক্তিটির সাথে চারুর দেখা হয়েছিলো বড্ড বিচিত্র ভাবে। বছর চারেক আগের কথা, চারুর কলেজে বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিলো। ছেলেটি সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলো। এসেছিলো বললে ভুল হবে, সেই অনুষ্ঠানের স্পোন্সারদের একজন ছিলো। প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে কলেজের অনুষ্ঠানে হাজার বিশেক টাকা খরচ করেছিলো সে। সেই অনুষ্ঠানেই চারুর সাথে তার দেখা হয়। তখন চারু কেবল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়তো। চারু সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ছিলো। অনুষ্ঠানের পর লোকটি তার প্রচুর প্রশংসাও করেছিলো। বলেছিলো যদি কখনো প্রয়োজনীয়তা বোধ করে তবে যেনো শ্রাবণকে স্মরণ করে। চারু শ্রাবণের কথাটাকে আমলে নেয় নি। মস্তিষ্কের এক কোনায় ফেলে রেখেছিলো। অথচ আজ সেই ব্যাক্তি তার সামনে দাঁড়ানো। কে জানতো কিয়ৎক্ষণের পরিচয়ে এই শ্রাবণ নামক ব্যাক্তিটি তার বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে ঘটা করে উপস্থিত হবে! এর মাঝেই মনিরুল সাহেব রাশভারী কন্ঠে কানে এলো,
“চারু মা, এখানে এসে বসো। খামোখা দাঁড় করিয়ে রাখছো তুমি শ্রাবণ বাবাকে”

বড়চাচার আদিক্ষেতায় ঈষৎ বিরক্ত হলো চারু। লোকটি কি তার মানসিক অবস্থাটি অনুমান করতে পারছেন না। নাকি ইচ্ছে করেই করছেন না। গতকালের ক্ষত যে এখন ভরে নি, সেইখানে কিভাবে নতুন কোনো মানুষকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া যাবে! কিন্তু চারু তার বিরক্তি, ক্ষোভ হৃদয়ে চেপে রাখলো, মুখে প্রকাশ করলো না। মুখশ্রী স্বাভাবিক রেখে বসলো চারু। মাথার ঘোমটা এখনো অক্ষত। শ্রাবণ এখনো এক নজরে তাকিয়ে আছে চারুর দিকে। মুখে এক অমলিন হাসি। এদিকে শ্রাবণের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ধ্রুব। তার চোয়াল শক্ত হয়ে রয়েছে। বড়মামা প্রতিবার নিজের কান্ডজ্ঞানহীনতার প্রমাণ দেন অথচ নিজেকে শুধরাবার বিন্দুমাত্র রেশ তার মাঝে নেই। কোথা থেকে এই ছেলেকে তুলে এনেছে কে জানে। তবে ছোটমামার উপর সম্পূর্ণ আস্থা আছে তার। এমন নাট্যলীলা সে একটা বিহিত ঠিক করবে। এর মাঝেই শ্রাবণের সাথে আসা মহিলার একজন বলে উঠলেন,
“ভাই, আমরা এখানে কথা বলি। ছেলে মেয়েকে বরং আলাদা করা বলার ব্যাবস্থা করা হোক”

কথাটা কর্ণপাত হতেই মনিরুল সাহেব বাদ সাধলেন,
“আসলে চারু তো কিঞ্চিত লাজুক, তাই বলছিলাম আলাদা কথা বলার কি প্রয়োজন?”
“কি যে বলেন ভাই, ওরা আলাদা কথা না বললে কিভাবে চলবে? সংসার তো ওরাই করবে”

মনিরুল সাহেবের কপাল কুঞ্চিত হলো। যতদূর তার ধারণা চারুর বিয়ে ভাঙ্গার কথাটা এই পাত্রপক্ষ জানে না। চারুর সাথে একা একা কথা বলার সুযোগ দিলেই সমস্যা, চারু আবেগের বসে সত্যি বলে দিবে। তখন এতো ভালো ছেলেটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে। তিনি সুযোগ হাত ছাড়া করতে চান না। তার ও একটা মেয়ে আছে। চারুর বিয়ে না হলে নিজের মেয়ের বিয়ের পথ খুলবে না। মনিরুল সাহেব গাইগুই করতে লাগলেন। কিন্তু তার কিছু বলার পূর্বেই আহসান সাহেব বলে উঠলেন,
“ভাইজান, বিয়ে তো ছেলে খেলা নয়। চারু মা যদি চায় তবে শ্রাবণ সাহেবের সাথে কথা বলতে তো সমস্যা নেই”

ছোট ভাইয়ের গম্ভীর বাক্যে আর কিছু বলতে পারলেন না মনিরুল সাহেব। জাহানারা বেগমকে ঢেকে বললেন,
“বউ ছাঁদে নিয়ে যাও তাদের”

*****
পড়ন্ত বিকেল, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। তুলোর মতো সাদা মেঘগুলো দলবেধে ঘুরঘুর করছে। আমের মুকুলের তীক্ষ্ণ টক ঘ্রাণ বাতাসে। ফাগুনের মাস চলে। শীতের আমেজ নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা বাতাস অবিন্যস্ত করে দিচ্ছে চারুর সাপের ন্যায় ঢেউ খেলানো চুলগুলো। কিন্তু চারু নির্বিকার। তার উদাসীন চক্ষু তাকিয়ে আছে নীলাম্বরীর কমলা সূর্যের দিকে। পুরান ঢাকার চিকন গলির শেষ বাড়িটি চারুদের। লাল ইটের পুরানো দোতলা বাড়ি। গতবছরের করা চুনকাম অনেকটাই খসে পড়েছে। ফলে লাল ইট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার দাদাজান ইকবাল আহমেদ এই বাড়িটি নির্মান করেছিলেন। তিনি গত হবার পর তার দুই পুত্র তাদের পরিবার সমেত এখানে থাকে। এখানের বাজারে বেশ বড় চালের দোকান আছে আহসান সাহেবদের। ব্যাবসা এখনো দুভাই মিলেই করছে। বলে চারুর জীবনে বড় চাচা-চাচীর প্রচন্ড প্রভাব রয়েছে। তারা যখন তখন নিজেদের আধিপত্য বসায়। মাস চারেক পূর্বে নাহিয়ানের সম্বন্ধ বড়চাচী ই এনেছিলেন। আজো তারা নতুন একজনকে নিয়ে এসেছেন। চারুর মতামতের গুরুত্ব যেনো শূণ্য। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। আকাশ পাতাল ভেঙ্গে কান্না আসছে। কিন্তু একজন ক্ষণ পরিচিত মানুষের সামনে কাঁদতে তার আত্মসম্মান বাদ সাধছে। নিজেকে সুনিপুন ভাবে সামলে নিলো চারু। সম্মুখে বসে থাকে সুদর্শন পুরুষের দিকে কঠিন দৃষ্টি তাক করলো সে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আপনি যেভাবে এসেছেন সেভাবেই ফিরে যান। এই বিয়েতে আমার মত নেই। ক্ষমা করবেন কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না”
“কারণটা জানতে পারি?”

সাবলীল কন্ঠে প্রশ্ন শুধালো শ্রাবণ। তার চাহনীতে মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময় লক্ষ করলো না চারু। বরং সে স্বাভাবিক ভাবেই চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। একজন রমনী তার সম্বন্ধ নাকোচ করে দিচ্ছে অন্তত মুখোভাবের পরিবর্তন আশা করেছিলো সে। চারু দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। খানিকটা ধরা গলা গলায় বললো,
“গতকাল আমার বিবাহ হবার কথা ছিলো। কিন্তু তা হয় নি। একটা দূর্ঘটনা আমার জীবনটাকেই তচনচ করে দিলো। যার সাথে আমার বিয়ের কথা ছিলো, সে গতকাল ইন্তেকাল করেছেন। সবকিছু কেমন পালটে গেলো। আমি তার অপেক্ষায় বসে ছিলাম জানেন। যাই হোক, এই বিয়ে আমি করতে পারবো না। দয়া করে এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন”

শ্রাবণের অপলক চাহনী এখনো চারুতে আবদ্ধ। এক অদ্ভুত নেশাগ্রস্থ চাহনী। ঈষৎ অস্বস্তিও হচ্ছে চারুর। চারু তার মুখোপানে চাইলো না। তার নীলাভ চোখগুলো বেশ বিচিত্র। চারুর ধারণা লোকটা লেন্স পড়েছে। নয়তো চোখের এমন বিচিত্র সৌন্দর্য দেখা যায় না। কালোর মাঝে নীল চোখ ঢেলে দিলে হয়তো এমন চোখের বর্ণ হয়। চারুর চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো, যখন শুনলো শরীর হিম ধরা একটা প্রশ্ন,
“ভালোবাসতেন তাকে?”

প্রশ্নটার উত্তর হ্যা কিংবা না তে দিতে পারলো না চারু। বরং বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো শ্রাবণের দিকে। ভালোবাসা শব্দটির অর্থটি জানা নেই তার। তাই এর উত্তর ও নেই তার নিকট। চারু কিয়ৎকাল চুপ থাকলো, তারপর ধীর স্বরে বললো,
“জানি না”
“যার সাথে বিয়ে হচ্ছিলো তাকে ভালোবাসেন কি না জানেন না?”

চারু উত্তর দিলো না। তাকে পুনরায় নির্বাক দেখে শ্রাবণ স্মিত হাসলো। তারপর বললো,
“দেখুন চারুলতা, জীবন নদীর মত প্রবাহমান। ক্ষণিকের জন্য স্থির হলেও তাতে ঢেউ উঠবেই। আর সময় নামক বিদঘুটে জিনিসটি সব ক্ষত ভুলিয়ে দেয়। আমি বুঝতে পারছি আপনার মনোস্থিতি, তবে আপনি সময় নিতে পারেন। আমার আপত্তি নেই?”
“আমি কেনো? মেয়ের অভাব নেই এই দেশে”
“কথা সত্য, কিন্তু আমার তো সারা দেশের মানুষকে ভালো লাগে নি। লেগেছে আপনাকে। তাই আপনাকেই বিয়েটা করতে চাই চারুলতা”
“আমার নাম চারু, চারুলতা নয়”
“জানি, কিন্তু আমি আপনাকে চারুলতাই ডাকবো। চারুটুকু ঠিক আপনার সাথে যায় না। চারুলতাই মানায়, রবীঠাকুরের চারুলতা”

লোকটা আবার হাসলো। কিন্তু বিরক্ত হলো চারু। লোকটা এতো অসভ্য কেনো? জোর করে কি সম্পর্ক হয়? সুর্য ডুবন্ত। পশ্চিমের দিগন্তে রক্তিম লাল বর্ণ ছেয়ে গেছে। পাখিরা নিজ নিজ নীড়ে ফেরার চেষ্টায় রয়েছে। আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে মোড়ের পুরান মসজিদ থেকে। শ্রাবণ উঠে দাঁড়ালো। বহু দূরে যেতে হবে তাদের। ঢাকা শহরের বিশ্রী জ্যামে পড়লে খবর হয়ে যাবে। শ্রাবণ পা বাড়াতেই চারু পিছন থেকে বলে উঠলো,
“আমাকে বিয়ে করলে ক্ষতি আপনার ই, আমার একজন পাগল প্রেমিক আছে। আমি চাই না নাহিয়ানের মতো অন্য কারোর সাথে করুন পরিনতি হোক”

শ্রাবণের পা থেমে গেলো। অবাক চাহনীতে তাকালো চারুর দিকে। চাহনীতে স্পষ্ট অবিশ্বাসের হাতছানি। চারু গড়গড় করে বলল,
“বিশ্বাস হচ্ছে না? জানি। কিন্তু সত্যি এটাই। আমার পাগলা প্রেমিক আমার বিয়ে হতে দিবে না”

চারুকে অবাক করে শ্রাবণ হাসলো। কিশোরী মেয়ের মনগড়া কথামাত্র, অবশ্য গতকালের করুন ঘটনা যে কোনো যুবতীর মনে গভীরভাবে আঘাত হানবে। সে ভুলভাল বকবে, এটা অস্বাভাবিক নয়। শ্রাবণ স্মিত হেসে বললো,
“বুঝলাম, আযান দিয়েছে। নামায পড়ে নাও”

সে দাঁড়ালো না। সরাসরি নেমে গেলো নিচে। চারু সেখানেই ধপ করে বসে পড়লো। খুব কান্না পাচ্ছে তার। বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথা। বিষাদে ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। অসহনীয় লাগছে সব কিছু। কেনো কেউ বুঝে না তাকে! সে কি কেবল পুতুল?

বিয়ের পাকাপাকি কথা হলো। মনিরুল সাহেবের খুশি দেখে কে। আহসান সাহেবও খানিকটা চিন্তামুক্ত। বিয়ে তো আজ কাল ই হবে না। শ্রাবণ সময় চেয়েছে। তাড়াহুড়ো নেই। মেঘকুঞ্জে শুধু দুটো মানুষ অপ্রসন্ন এই বিয়েতে। একজন চারু এবং অপরজন ধ্রুব। কিন্তু তাদের দিকে কারোর নজর নেই। সবাই শ্রাবণকে আপ্পায়নে ব্যাস্ত। চারু বাধ্য হয়ে নিজ ঘরে চলে গেলো। দম আটকে আসছে তার। নিজের বাবা-মার উপর সুপ্ত অভিমান জমলো। অভিমান তার মতামতের দাম না দেওয়ার। ধ্রুব ও দাঁড়ালো না। হনহন করে বেড়িয়ে পড়লো। এখন নিজের সমস্ত ক্ষোভ উঁড়াবে নিকোটিনের ধোঁয়ায়_____

*****

শ্রাবণ পরিবারকে নিয়ে বাসায় পৌছালো রাত নয়টায়। জ্যাম পেড়িয়ে অবশেষে এলো তারা। ক্লান্ত স্বরে নিজের ফুপুকে বললো সে,
“ফুপু, আমি ঘরে গেলাম। বড্ড ক্লান্ত লাগছে”
“যাও বাপ, জিরিয়ে নাও”

শ্রাবণ ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে নিজ ঘরে প্রবেশ করলো। লাইটটা জ্বালাতেই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো তার। ঘরের সমস্ত কিছু তচনচ হয়ে পড়ে রয়েছে। বালিশ, বই, ফাইল, শো পিচ ছিড়ে ভেঙ্গে ফ্লোরে চরম অবহেলায় পড়ে রয়েছে। যেনো কেউ নিজের ক্ষোভ মিটিয়েছে। তার মধ্যেই নজর গেলো বিছানার উপর। সেখানে…………

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি