দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-০৩

0
727

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৩য়_পর্ব

শ্রাবণ ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে নিজ ঘরে প্রবেশ করলো। লাইটটা জ্বালাতেই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো তার। ঘরের সমস্ত কিছু তচনচ হয়ে পড়ে রয়েছে। বালিশ, বই, ফাইল, শো পিচ ছিড়ে ভেঙ্গে ফ্লোরে চরম অবহেলায় পড়ে রয়েছে। যেনো কেউ নিজের ক্ষোভ মিটিয়েছে। তার মধ্যেই নজর গেলো বিছানার উপর। সেখানে একটা ছোট চিরকুট। শ্রাবণ সাবধানতার সাথেই চিরকুটটি হাতে নেয়। তাতে লেখা,
“সাবধান, এটা প্রথম এবং শেষ ওয়ার্নিং”

ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে শ্রাবণের। চোখ যায় বিছানার পাশের জানালাটির দিকে। থাই গ্লাসটি ভাঙ্গা, জানালার গ্রিলের লোহা খুলে রয়েছে। শ্রাবণের বুঝতে বাকি রইলো না মানুষটি ঘরে কিভাবে প্রবেশ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কে এই কাজ গুলো করেছে! কিসের ওয়ার্নিং! কি থেকে সাবধান হবার ইঙ্গিত দিচ্ছে সে! এর মাঝেই তার ফুফাতো বোন আফিয়ার প্রবেশ ঘটে ঘরে। ঘরের লন্ডভন্ড অবস্থা দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। না চাইতেও মুখ থেকে বেড়িয়ে যায় অস্পষ্ট স্বর।

বনানী থানার অসি ফররুখ আহমেদ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন চিরকুটটির দিকে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, সাথে চিন্তার প্রবল বলিরেখা। সাব ইন্সপেক্টর রহমান মনোযোগ সহকারে উলটে পালটে দেখছে ঘরের প্রতিটা জিনিস। ভাঙ্গা অংশগুলো আঙ্গুলের ছাপের জন্য প্লাস্টিকের ব্যাগে পুড়ছেন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্রাবণ। ঠিক তার উল্টো পাশে তার ফুপু শান্তা এবং ফুপাতো বোন আফিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আফিয়ার চিৎকারে সবাই জোড়ো হয় এই রুমে। শান্তা বেগম দ্রুত পুলিশে খবর দেয়। এতেই শ্রাবণের মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হচ্ছে। এতো আদিক্ষেতার প্রয়োজন ছিলো না। ফররুখ হাতের চিরকুটটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“আপনার কি কারোর উপর সন্দেহ আছে শ্রাবণ সাহেব? আই মিন টু সে কোনো শত্রুতা কারোর সাথে”

ফররুখের প্রশ্নে নিজের বিরক্তি গিলে নেয় শ্রাবণ, তারপর দুহাত বুকের কাছে বেঁধে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“দেখুন এই ব্যাবসায় মিত্র নামক শব্দটা নেই বললেই চলে। সকলেই শত্রু। কাকে ছেড়ে কার নাম বলি বলুন। বাংলাদেশে এই কন্সট্রাকশন বিজনেস কেমন তা তো জানেন ই।”
“তবুও, থাকে না অনুমান। বর্তমানে কারোর সাথে মতোভেদ, রেষারেষি বা দ্বন্দ”

এবার কিয়ৎক্ষণ মৌনতা পালন করলো শ্রাবণ। কপালে বিরক্তির সাথে চিন্তার সুতীক্ষ্ণ রেখাও প্রতীয়মান হলো। অনেক ভেবে বললো,
“গনি সাহেব, আশরাফ গনি। বর্তমানে তার সাথেই একটা রেষারেষি চলছে। কোল্ড ওয়ার বলতে পারেন। কিছু সময় পূর্বে একটা কমার্শিয়াল প্লট নিয়ে উনার সাথে বেশ বেধেছিলো। ব্যাংকের জমি, নিলাম উঠেছে। আমি জিতেছিও। কিন্তু তিনি আমাকে প্লটটা নিতে দিবেন না। আবার চড়া দাম ও দিবেন না। এই নিয়ে বেশ একটা দ্বন্দ তৈরি হয়। এর আগেও আমাদের কোম্পানি অনেকগুলো প্রজেক্ট উনার নাকের ঢগা থেকে নিয়ে নেয়। হতেই পারে উনি আমার উপর ক্ষিপ্ত। কিন্তু কথা সেটা না। এতো বিজ্ঞ মানুষ এমন ছেলেমানুষী করবে বলে মনে হয় না।“
“সে তো আমিও বুঝেছি। খুব কাঁচা হাতের কাজ বুঝলেন। নিতান্ত ভয় দেখানোর ব্যার্থ চেষ্টা। আচ্ছা, আরেকটি প্রশ্ন? আপনি বললেন আপনারা কেউ ই বাড়ি ছিলেন না। সবাই বাহিরে গিয়েছিলেন। এসে এই অবস্থা। কোথায় গেছিলেন জানতে পারি কি?”

কথাটায় স্মিত হাসে শ্রাবণ। তারপর বলে,
“নিজের বউ দেখতে গিয়েছিলাম”
“ওহ, কংগ্রেচুলেশন, জেনে ভালো লাগলো। তা বিয়ে কবে?”
“দেরি আছে, মাত্র তো পরিবারকে রাজী করিয়েছি। কন্যাকে রাজী করানো বাকি। আমার বউ রাজী হলেই বিয়ে”

শ্রাবণের কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না ফররুখ। জোরপুর্বক হাসি একে বললো,
“তাহলে থাকুন, আমরা আসছি। কিছু জানলেই জানাবো”
“অফিসার একটা রিকুয়েস্ট, আমি চাই না এটা জানাজানি হোক। বাবা সিলেট গিয়েছেন। উনি জানতে পারলে অহেতুক ঝামেলা হবে। আপনি তো বাবাকে চিনেন ই”
“জ্বী”

বলেই সেখান থেকে প্রস্থান নিলো ফররুখ এবং রহমান। ফররুখের মুখ খিঁচিয়ে এসেছে। মোস্তফা কামালের ক্ষমতার জোর তার ভালো করেই জানা। তার ছেলেকে কেউ ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে ব্যাপারটা মোটেও তার মনোপুত হবে না। ফররুখরা চলে গেলে শ্রাবণ নিজ ফুপু শান্তা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমরা নিজ নিজ ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও, আর হাসনাত কাকাকে বলো এসব পরিষ্কার করে দিতে”

সবাই এক এক করে বেড়িয়ে যেতে নিলে শ্রাবণ পেছন থেকে বলে উঠে,
“আর ফুপু, এবাড়িতে পুলিশ এসেছে বাবার কানে যাতে না যায়। বিষয়টা মাথায় রেখো”

শ্রাবণের শীতল কন্ঠের কথাটি গায়ে হিম ধরিয়ে দিলো। শুকনো ঢোক গিললো শান্তা। নিজ মেয়ে আফিয়ার হাতখানা ছোট করে টান দিলো সে। তারপর ঘর থেকে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে গেলো তারা।

***
মেঘকুঞ্জের বসার ঘরে বৈঠক বসেছে। বৈঠকের প্রধান বিষয় চারুর বিয়ে। আহসান সাহেব শ্রাবণের পরিবারবর্গের কাছে নিবেদন জানায় যেনো বিয়েটা মাস ছয়েক বাদেই হয়। ভাইয়ের এমন কাজে মনিরুল সাহেব হতাশ হয়েছেন। মেয়ের বয়স তেইশ পার হচ্ছে অথচ তার ভাই এর কোনো মাথা ব্যাথা নেই। এতো ভালো একটা সম্বন্ধ আসার পর কোথায় উঠে পড়ে বিয়ে দিবে তা নয়। ছয় মাসের সময় নিয়েছে। সব দেখেও চুপ করে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই হিনহিনে স্বরে বললেন,
“তোমার কি বয়স বাড়ার সাথে সাথে ভীমরতি হচ্ছে? ছয়মাসের অহেতুক সময়টা না নিলে চলতো না?”
“ভাইজান, আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমার মেয়ের একদিন আগে বিয়ে ভেঙ্গেছে। নাহিয়ানের দূর্ঘটনা না ঘটলে আজ মেয়েটা বিবাহিত হতো। আর আপনি কিনা পরদিন ই একটা ছেলে তুলে এনেছেন। আপনার সম্মান করি বলেই কিন্তু আমি কিছু বলি নি। ছয়মাস সময়টাও খুব স্বল্প। সব ভুলে পুনরায় এগিয়ে যাবার জন্য চারুর সময় লাগবে”
“রাখো তোমার সময়, পাড়ায় চারুকে নিয়ে কি কি কথা হয় জানো না তুমি? আমারো একটা মেয়ে আছে। চারুর বিয়ে না হলে চৈতির জন্য ভালো পাত্র পাবো না। বুঝো না কেনো? বাড়ির বড় মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হলে অন্যগুলোর ও সুবিধা হয়”

এবার আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলেন না আহসান সাহেব। তীব্র প্রতিবাদী স্বরে বললেন,
“থামেন ভাইজান, মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গছে বলে যার তার গলায় মেয়েকে ঝুলায়ে দিবো না। আগে ছেলের পরিবারের সম্পর্কে নিশ্চিত হবো তারপর। তাই ছয়মাসের সময় নিয়েছি। আর মেয়েটা আমার আমাকেই বুঝতে দেন”

আহসান সাহেবের এমন উগ্র ব্যাবহারে বেশ চটে উঠলেন মনীরুল সাহেব। এর মাঝেই ধ্রুব চাঁপা স্বরে বলে উঠে,
“ছোট মামা উচিত বলেছেন, মেয়ে তো আমাদের ফেলনা নয়”
“তুমি থামো, আহম্মক কোথাকার! তুমি কি বুঝো? যাও নিজের চড়কায় তেল দাও গে যাও”

মনীরুল সাহেবের তীক্ষ্ণ স্বর উপর অবধি শোনা যাচ্ছে। একটা সময় বিরক্ত হয়ে নিজ ঘরের দরজাটা ভিজিয়ে দিলো চারু। বড় চাচা এমন ই, গায়ে মানে না আপনি মোড়ল প্রকৃতির মানুষ। তার কাছে অনুভূতির মূল্য নেই। এতো স্বার্থপর কেনো এই মানুষটা বুঝে পায় না চারু। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বইটা মেলে বসে সে। কালকে কলেজ যাবে। যতই হোক নিজেকে থামিয়ে রাখবে না সে। এদিকে মনীরুল সাহেবের অকথ্য ভাষার মুখবুজে সহ্য করতে লাগলো ধ্রুব। এগুলো নতুন না, পরগাছাদের এমন কথা শুনতেই হয়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম______

সকাল ১১টা,
সূর্যের প্রবল রশ্নি মুখশ্রীতে আছড়ে পড়ছে চারুর। নীল অম্বরে এক কোনে মন খারাপের মেলা বসেছে। থমথমে আবহাওয়া, মাঝে মাঝে ক্ষীণ বায়ুতে গাছের শুকনো পাতাগুলো নড়ছে। কিন্তু তা ক্ষণিকের জন্য, বাকি সময়টা ভ্যাপসা গরম। চারু দ্রুত পা চালাচ্ছে যেনো গরম কম লাগে, জোরে হাটার ফলে ঘাড় বেয়ে ঘামের রেখা গড়িয়ে পড়ছে। একটু থেমে ঠোঁটের উপরের জমা ঘাম মুছে নিলো সে। এর মাঝেই পেছন থেকে ডাক কানে আছে। হাটা থামিয়ে পেছনে ফিরতে তার বান্ধবী পলি ছুটে আসে। হাপাতে হাপাতে বলে,
“কখন থেকে ডাকছি, একেবারের ট্রেনের বেগে হাটছিস। থামছিস ও না। ধ্যান কই তোর?”
“ওহ, শুনতে পাই নি রে”

ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসির প্রলেপ টেনে উত্তর দিলো চারু। পলি এবার একটু থামলো তারপর বললো,
“যাক, মাহমুদ স্যারের ক্লাস হবে না। এটা বলার জন্যই ডাকছিলাম”
“তাহলে আজকে আসলাম কেনো? বাড়ি থাকলেই ভালো হতো”
“আরে ব্যাপার না, চল ক্যান্টিন যাই। একটু ঠান্ডা কিছু খেয়ে একসাথে বাড়ি যাবো। বাড়ি যেয়েও কি করবি? এর থেকে একটু সময় কলেজ থাক। দেখবি ভালো লাগবে”

চারু ম্লান হাসি হাসলো। সত্যি বাড়ি যেয়েও কিছু হবে না। ক্যান্টিনে যেতেই ছোট ছেলেটা বরফ দেওয়া কোকের গ্লাস নিয়ে আসলো। মৃদু স্বরে বললো,
“নেন আফা”

চারু অবাক চাহনীতে চাইলো তার দিকে। সে তো মাত্র আসলো, কিছুই অর্ডার করে নি। অবাক কন্ঠে শুধালো,
“কে পাঠালো?”
“ম্যানেজার কাকু”
“আচ্ছা, এই নাও চল্লিশ টাকা আরেকটা দিও”
“আপনের টাকা দেওয়া শেষ”

ছোট ছেলের উজ্জ্বল মুখের বলা কথাটা শুনতেই স্তব্ধ হয়ে গেলো চারু। সেই লোকটা আবার এই কাজ করছে, এসব করে কি প্রমাণ করতে চায় সে। সাহস থাকলে সামনে আসুক। অহেতুক কেনো তাকে বিরক্ত করে যাচ্ছে! পলি খানিকটা বিদ্রুপের স্বরে বললো,
“তোর রোমিও তোকে অনেক ভালোবাসে রে, কি কেয়ার! ইশ আমারো যদি এমন কেউ থাকতো”

পলি কথা শেষ করার আগেই চারু উঠে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ স্বরে বিরক্তিমাখা কন্ঠে বললো,
“আমি বাড়ি যাচ্ছি। তোর ইচ্ছে থাকলে তুই কোক খা বসে বসে”

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে পড়লো সে। এই সময় কলেজের প্রাঙ্গনে রিক্সা পাওয়া ভার। তাই দ্রুত পায়ে হাটতে লাগলো চারু। মেইন গেটেই রিক্সা পাবে। মেইন গেটে যেতেই একটা কালো গাড়ি জোরে ব্রেক কষলো তার সামলে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠে চারু। আর একটু হলে ভয়ে প্রাণপাখি খাঁচা ছাড়া হতো। একেই মেজাজ খারাপ উপরন্তু একজনের এমন গা ছাড়া কাজে ক্ষেপে উঠলো সে। তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,
“চোখ কোথায় থাকে? টাকা আছে বলেই একটা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছেন, একটু হলেই তো আমার গায়ে উঠিয়ে দিতেন। এ্যাড়া জানে কোন জায়গার”

চারুর অগ্নিবাক্য শেষ হতেই গাড়ি থেকে বের হয় শ্রাবণ। ভুবন ভুলানো হাসি মুখে অক্ষত রেখে বলে,
“আসলে চোখটা চোখের জায়গায় ই আছে, শুধু আপনার সাথে দেখা করবার উচাটনে মনটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে……………

চলবে।

মুশফিকা রহমান মৈথি