দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-০৮

0
419

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষিদ্ধ)
#৮ম_পর্ব

মোস্তফা কামাল বই থেকে মুখ তুলেন, তার চাহনী শীতল। চোয়াল শক্ত। রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“এতো বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময় আমার অনুমতির প্রয়োজন হয় নি তোমার, অথচ ঘরে প্রবেশ করতে আদিক্ষেতা দেখাচ্ছো! আমি তোমার স্পর্ধা দেখে অবাক হচ্ছি”

বাবার তীব্র হুংকারেও শ্রাবণ নির্বিকার। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে সে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,
“ফুপু বলছিলো, আপনি আমাকে খুঁজছেন। যদি জরুরি কোনো কাজ না থাকে আমি কি যেতে পারি?”

শ্রাবণের নির্লিপ্ততা মেজাজ আরোও অধিক খারাপ করে দিলো মোস্তফা কামালের। রাগ চরম শীর্ষে পৌছে গেলো। হাতের কাছের গোলাকৃতি পেপার ওয়েটটি ছুড়ে পারলেন তিনি পুত্রের দিকে। বাবার বদমেজাজী স্বভাবটি অপরিচিত নয় তার। ফলে বা দিকে সরে যায় সে। দ্বিখন্ডিত হয়ে যায় কাচের নির্জীব পেপার ওয়েট টি। হুংকার ছাড়েন মোস্তফা কামাল,
“অপদার্থ কোথাকার, ভাব নিচ্ছো তুমি? একে অপরাধ করেছো অথচ অনুশোচনার ছিটাফোটাও নেই। তোমার মা তো চলে গেছে, একটা অপদার্থ রেখে গেছে আমার জন্য। অসভ্য, বেয়াদব”

মায়ের কথা টানতেই নির্বিকার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে। শান্ত চোখজোড়া জ্বলে উঠে রাগে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাক করে শ্রাবণ নিজের বাবার দিকে। কিন্তু মোস্তফা কামালের তাতে কিছুই যায় আসে না। তিনি তিনি দমলেন না, পুনরায় হুংকার ছাড়লেন,
“কি ভেবে একটা চালের ব্যাপারীর মেয়েকে বিয়ে করার কথা ভাবছো তুমি। তুমি জানো না ওরা কারা? উপরন্তু ঐ মেয়ের তো আশরাফ গনির ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। যে আশরাফ গনি তোমাকে মারার চেষ্টা করতেও দুবার ভাবে নি, সব জেনেও…………”
“হ্যা, সব জেনেই আমি এগিয়েছি। সব জেনেই আমি চারুলতাকে বিয়ে করতে চাই”
“কিন্তু কেনো? মেয়ের কি আকাল ছিলো?”

শ্রাবণ নির্বিকার চিত্তে মাথা চুলকালো, তারপর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো,
“আমার ইচ্ছা”
“তোমার ইচ্ছে তে সব চলে শ্রাবণ?”
“অন্তত আমার জীবনে তাই চলে বাবা, আপনার আপত্তি থাকলে আমার কিছুই করার নেই। আর একটা কথা, আমার আর চারুলতার মাঝে কোনো ঝামেলা চাচ্ছি না। আপনার ব্যাক্তিগত জীবনে আমি কখনো নাক গলাই নি, আশাকরি আপনিও আমার ব্যাক্তিগত জীবনে নাক গলাবেন না”

মোস্তফা কামাল ছেলের উগ্রতায় গজগজ করতে লাগলেন। কিন্তু মুখ থেকে কিছু বের হলো না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তিনি চেয়ারে বসলেন। রাগে প্রেসার বেড়ে যায় তার। শ্রাবণের সাথে ঝগড়া করা আর উলো বনে মুক্তো ছড়ানো একই কথা। ফোঁস করে একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন মোস্তফা কামাল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“শুনলাম আশরাফ গনির ছেলে মারা গেছে। তুমি জানো কিছু এ ব্যাপারে?”
“জানি, কেউ তার গাড়ির ব্রেক কেঁটে দিয়েছে”
“হু, তা এতে তোমার হাত নেই তো?”
“আমি কাঁচা কাজ করি না। যদি আর কিছু প্রশ্ন না থাকে আমি যেতে চাই। প্রচন্ড ক্লান্ত আমি”

মোস্তফা কামাল ছোট করে বলেন “যাও”। শ্রাবণ আর দাঁড়ায় না সেখানে, হনহন করে বেড়িয়ে যায় সে। শ্রাবণ চলে গেলে চশমা খুলে কপালের চামড়া দু আঙ্গুল দিয়ে চেঁপে ধরে মোস্তফা কামাল। যে ছেলে চেয়েও বিয়ের জন্য রাজী করাতে পারে নি সেই ছেলে কি নিজ থেকে তার অনুমতি ছাড়া বিয়ের কথা বলে এসেছে। নিজের বাবাকে অতিথির মতো দাওয়াত দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ছেলের কাজে প্রশ্ন হয়, সে কি আদৌও তার ছেলে? আবার মেজাজ, কথাবার্তা, চালচলনে সেই প্রশ্নটি গুছে যায়। তবে এই চারু নামক মেয়েটাকে প্রচন্ড কৌতুহল হচ্ছে মোস্তফা কামালের। চট করেই ফোনটা কানে ধরলেন, আঙ্গুল দিয়ে ডায়াল করলেনে একটা নাম্বার, হিনহিনে স্বরে বললেন,
“একটা মেয়ের যাবতীয় ডিটেইলস লাগবে”

☘️☘️☘️☘️

গোধলীর সময়, নীলাম্বরীর পশ্চিম কোনায় রক্তিম সূর্য ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাখিরা নিজ নিজ ঘরে ফেরার চেষ্টায় রয়েছে। কোলাহলপূর্ণ দিনের অবশেষে ইতি ঘটবে। নামবে নিকষকৃ্ষ্ণ আঁধার। নীলাম্বরী আকাশে উঠবে রুপালী চাঁদ। সেই চাঁদের আলোর কতো কতো কাহিনী। কারোর লাল ভালোবাসার, কারোর নীল বেদনার, কারোর ধূসর অভিমানের তো কারোর বর্ণহীন জীবনের। চারু নীলাম্বরীর ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে সেই কাহিনী গুলোর কথাই ভাবছিলো। তার পা এখন অনেক ভালো, ব্যাথা নেই। হাটতে কারোর সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এতে মোটেই খুশি নেই চারু। বরং তার মনে হচ্ছে পা টা ভেঙ্গে গেলেই ভালো হতো। অন্তত বিয়েটা কেঁচে যেতো হয়তো। আজ সকালের কথা, তার বড় চাচা মনীরুল সাহেব ফরমান জারি করলেন,
“দেখো চারু মা, জীবন গতিময়। কিছুই থেমে থাকে না। নাহিয়ানের সাথে যা হইছে তাতে আমাদের দোষ নেই। বরং আল্লাহ তোমাকে বাঁচিয়েছে। ছেলেটা ভালো ছিলো না। তার বাপ একটা গু/ন্ডা। তোমার চাচী তো বুঝে নি। গু/ন্ডার ঘরের সম্বন্ধ আনছে। এখন ই না বুঝতেছি, কি ভালো হইছে। আশরাফ সাহেবের এতো শত্রু যে তার শত্রু একটাই তার পোলারে মে/রে দিছে। তুমি বাচ্চা মানুষ, এগুলো নিয়ে ভেবো না। শ্রাবণ ছেলেটা ভালো। তার বাবা একজন নামী বিচারক। এমন ঘরে বউ হবা এটা তো খারাপের কিছু না”
“বাবা ভালো হলেই যে ছেলে ভালো হবে তার কি গ্যারেন্টি? শুনেছি সেও কন্সট্রাকশন বিজনেসে আছে। আশরাফ গনির সাথে একটা রেষারেষিও চলে। সে যে ভালো তার খোঁজ কি নিয়েছেন বড় মামা?”

ফট করেই ফোঁড়ন কাটলো ধ্রুব। ধ্রুবের যুক্তি ফেলে দেবার মতো নয়। কিন্তু তার যুক্তিতে বড় চাচার মুখ চুপসে গেলো। তিনি যে অপ্রসন্ন হলো সেটা ভালো করে মুখে প্রকাশ পেলো। কিন্তু দমলেন না তিনি। গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,
“বিয়ে তো এখন হচ্ছে না, তুমি দেখো। ঘুরো, বুঝো। যদি মনে হয় গলদ আছে আমরা বিয়ে ভেঙ্গে দিবো। কিন্তু তুমি যদি তাকে চেনার চেষ্টাই না করো কিভাবে হবে?”

চারু শুধু ঘাড় নাড়ায়, বড় চাচা মানুষটা সুবিধাবাদী। তিনি সময়ে সময়ে নিজের পক্ষ পালটায়। এই নাহিয়ান আর আশরাফ গনির প্রশংসায় এক কালে পঞ্চমুখ ছিলেন তিনি। কিন্তু আজ তাদের নামের যা তা বলছেন। এমন মানুষকে কি বলা যায়! স্বার্থপর, হয়তো তাই। ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করলো চারু। আযানের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওড়নাটা টেনে নিলো সে। হাতে থাকা ফোনটা বাজছে। আটাশি বারের মতো শ্রাবণ ফোন দিয়েছে। গত সাতাশি বারের মতো এবারো ফোনটা ধরবে না চারু। অহেতুক তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কি কথা বলবে! অগণিত এসএমএস নিয়েছে, একটার ও উত্তর দেয় নি চারু। ইচ্ছে হয় নি। মনটা বড্ড জট লাগিয়ে লেগেছে, নতুন জীবনের লোভ আর অতীতের ভয় মিলে ঘাবড়ে আছে সে। এই জট যে কবে খুলবে!
“নামায পড়বি না?”

চমকে পেছনে তাকায় চারু। পকেটে হাত গুছে ধ্রুব দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখটা শুকনো। ধ্রুবের এই সময়টা দোকানে থাকার কথা। মামাদের সাথে চালের আরোতে কাজ করে সে। ধ্রুব ভাই খুব উচ্চশিক্ষিত নয়, কিন্তু চালের আরোতে কাজ করার মতো ও নন। চাইলেই ভালো চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে, কেনো যায় না কে জানে? চারুর বাবা আহসান তাকে ভালোবাসলেও মনিরুল সাহেব পদে পদে অপমান করে। তবুও সব গিলে ফেলে সে। চারু মাথা নাড়িয়ে বলে,
“এই তো যাচ্ছি”
“আচ্ছা, এই বিয়েতে তুই রাজী?”

হুট করেই প্রশ্নটা ছুড়ে ধ্রুব। প্রথমে অবাক হলেও পরে নিজেকে সামলিয়ে নেয় চারু। স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
“না রাজী হয়ে উপায় আছে?”
“যদি রাজী না থাকিস করতে হবে না বিয়ে, মামাদের আমি বুঝিয়ে দিবো”
“আমার জন্য কেনো অপমানিত হবে ধ্রুব ভাই?”

চারু স্মিত হেসে ফট করেই প্রশ্নটি করে। ধ্রুব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কিছু বলার আগে চারু বলে,
“তুমি চিন্তা করো না, আমি ঠিক নিজেরটা বুঝে নিবো”
“শ্রাবণ ছেলেটাকে আমার ভালো ঠেকছে না চারু। সাবধান”

মিনমিনিয়ে কথাটা বলে ধ্রুব। তার কন্ঠ অন্যরকম ঠেকলো চারুর কাছে। বিষাদের উপস্থিতি টের পেলো সে। চারু উত্তর দিলো না। সে নেমে আসলো ছাঁদ থেকে। ধ্রুব দাঁড়িয়ে থাকলো সেস্থানেই। রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু অদৃশ্য। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেউ দেখতে পায় না।

🍁🍁🍁

নিগূঢ় রাত, গভীর ঘুমে চারু। এমন সময় মাথার কাছের ফোনটা সজোরে বেজে উঠলো। রাতের নিস্তদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিলো বিশ্রী শব্দটা। ধরফরিয়ে উঠলো চারু। ঘুমঘুম চোখে হাতে নিলো ফোন। বাধ্য হয়েই ধরলো সে। হ্যালো বলতেই অপর পাশ থেকে কানে এলো পরিচিত কন্ঠ,
“চারুলতা, একটু নিচে আসবে”

কন্ঠ কাঁপছে। কেমন বিচিত্র শোনালো যেনো। চারু কিছু বলার পূর্বেই ফোন কেটে দিলো। বুকটা কেঁপে উঠলো চারুর। শ্রাবণের কি কিছু হয়েছে। কৌতুহল এবং উদ্বিগ্নতায় আর বসে থাকতে পারলো না চারু। ফোনটা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে লামলো সিড়ি দিয়ে। নিজের কেঁচি গেটটা খুললো খুব সাবধানে। নিকষকৃষ্ণ আঁধারে গলির মাথায় গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। রাত কয়টা বাজে অনুমান করতে পারছে না চারু। শ্রাবণকে দেখতেই ঈষৎ রাগ হলো চারুর। এই রাতে পাগলামি করার কি মানে! চারু তার কাছে গেলো, বিরক্তি ভরে কিছু বলতে যাচ্ছিলো সে। কিন্তু তার পূর্বেই তার চোখ পড়লো…………

চলবে।
মুশফিকা রহমান মৈথি