দূর দ্বীপবাসিনী পর্ব-০৭

0
460

#দূর_দ্বীপবাসিনী (কপি করা নিষেধ)
#৭ম_পর্ব

চিত্রার উজ্জ্বল মুখখানা নিভে যায়। নিষ্প্রভ স্বরে শুধায়,
“আচ্ছা, আমি তো বুবুর থেকেও সুন্দর। তাহলে বুবুর প্রতি ভালোবাসা আর আমার প্রতি অবজ্ঞা কেনো? এতো ভেদাভেদ কেনো আমাদের মাঝে?”

কিয়ৎকাল চুপ করে রইলো ধ্রুব। চিত্রা তার মুখপানে তাকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। মূহুর্তবাদে মলিন কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার হৃদয় যে সৌন্দর্যে মজে না চিত্রা, এই বাহ্যিক সৌন্দর্য দিয়ে কি করবো?”
“আমার অন্তরটা যে অসুন্দর সেই খোঁজ পেলে কিভাবে? কখনো তো অন্তরের খোঁজ নিতেই চাও নি”

চিত্রা বিদ্রুপের স্বরে বললো কথাটা। সুন্দর পুতুলের মুখে ছেয়ে আসলো নীল বেদনায়। বেদনা মনের মানুষের কাছে মূল্য না পাওয়ার। সেই কিশোরী বয়সে পা দেবার পর থেকেই একজন পুরুষকেই মন দিয়ে বসেছে সে। চিত্রার নিষ্পাপ হৃদয়ের আহবান গুলোকে নিছক আবেগ বলেই অবজ্ঞা করে এসেছে ধ্রুব। কিন্তু কিশোরী চিত্রা থেমে যায় নি, ভালোবাসার মানুষটির জন্য একটু বেহায়া হলে ক্ষতি কি! ভালোবাসা তো মাঝে মাঝে বেহায়াই হয়, আত্মসম্মানের এতো পরোয়া করলে কি ভালোবাসা হয়? তার মতে প্রেম এবং আত্মসম্মান কখনোই এক সাথে চলতে পারে না। একটাকে বিজর্সণ দিতেই হয়। তাই নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়েই সে ভালোবাসছে ধ্রুবকে। নানা ভাবে শতবার বুঝানোর প্রচেষ্টা করেছে সে। অথচ ফলাফল শূন্য, ধ্রুবের অবজ্ঞাই পেয়ে এসেছে সে। এইকারণটাও তার জানা, ধ্রুবের মনোমন্দিরে যে তার ঠায় নেই, সেখানে শুধু একজন নারী নিজের সম্পূর্ণ বিস্তার নিয়ে রাজত্ব করছে। মাঝে মাঝে চারুর প্রতি বড্ড হিংসে হয় চিত্রার। যে মানুষটির মনে ধ্রুবের প্রতি এক বিন্দু প্রণয়ের ছিটাও নেই সেই মানুষটিকে নিয়েই ধ্রুব এর সকল ভাবনা। ধ্রুবের নেত্র শুধু তাকেই দেখে। এই চাহনী কেউ না বুঝলেও চিত্রা ঠিক ই বুঝে। তাইতো যে বুবুকে এতোটা ভালোবাসে সে, সেই বুবুকেই হিংসে করে তখন। পরে নিজেকেই গালমন্দ করে সে। ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করলো চিত্রা। ধীর স্বরে বললো,
“খেয়ে নিও, আমি আসছি”

দরজার দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গেলো সে। পেছনে ফিরে বললো,
“আমি চাই এবার বুবুর বিয়েটা হোক, আর তা শ্রাবণ ভাই এর সাথেই হোক”
“চারুর বিয়ে হয়ে গেলেও আমার হৃদয়ে তার স্থান অক্ষুন্ন থাকবে। সেখানে তোর ঠায় হবে না ইহজীবনেও”

রুঢ় স্বরে কথাটা বললো ধ্রুব। চিত্রা ম্লান হাসি হাসলো, হয়তো নিজের উপর ই বিদ্রুপের হাসি হাসছে। “পাথরে যে ফুল ফুটে না”— কথাটা জানা স্বত্তেও ব্যার্থ প্রচেষ্টা। চিত্রা চলে গেলো। ধ্রুব দরজাটা আটকিয়ে দিলো। মেয়েটা বুঝতে চায় না। এতোটা রুঢ় সে হতে চায় না। চিত্রা কতোটা জেদি তার ধারণা ভালো করেই আছে ধ্রুব এর। বড় মামা জানলে তার পিঠ আর পিঠ থাকবে না। একজন এতিম, পরগাছার সাথে কেউ নিজ মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। তেমনটা হলে কি চারুর প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত করতো না ধ্রুব? করতো ঠিক। শুধু নিজের অবস্থানের কথা মনে আসলেই থেমে যায় সে। ফলে ভালোবাসাটা মনের অন্দরমহলেই সঙ্গোপনে আটকে রেখেছে। চারুর সম্মুখে ভুলবশতও আনে নি। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো ধ্রুবের। ভালোবাসাটা লাগাম ছাড়া হচ্ছে। যদি সত্যি চারুর বিয়ে হয়ে যায় কিভাবে থাকবে সে! প্রথম ভালোবাসা ভুলে থাকা কি এতোই সহজ! রক্ত মাংসের হৃদয়টা অবুঝ, সব জেনেও বুঝতে চায় না________

****

চারুর ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। পায়ের ব্যাথাটা কম। গোসল সেরেই মাথার কাছের জানালাটা খুলে দিলো। ভেজা চুল নিয়ে বসে আছে সে জানালার কাছে। রোদে চুল শুকাতে ভালোই লাগে। সাথে কানে আসছে বাহিরের কোলাহল। মোড়ের দোকানে মানুষের ভিড় দেখা গেলো। পুরান ঢাকার সকালের নাস্তা সারা ঢাকাতেই বিখ্যাত। চারু আনমনেই তার চুলে বিলি কাটছিলো। এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো। তাড়াহুড়ো করে ওড়না ঠিক করলো সে। ধীর গলায় বললো,
“আসো”

চারুকে অবাক করে শ্রাবণ ঢুকলো ঘরে। শ্রাবনকে দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো চারু। নীলাভ চোখের পানে চেয়ে থাকা যায় না। এক অজানা টান অনুভুতি হয়, বড্ড বিচিত্র টান। শ্রাবণ এই প্রথম চারুর ঘরে প্রবেশ করেছে, ছোট একটি ঘর। তাতে একটি সিঙ্গেল বিছানা, একটা আলমারী, একটা ছোট টেবিল এবং একটি ড্রেসিং টেবিল। বেশ এটেসেটে ঢোকানো হয়েছে সব আসবাবপত্র। তবে শ্রাবণের দৃষ্টি কাড়লো দেয়ালের অতি চমৎকার আকাউঁকি। অবাক কন্ঠে শ্রাবণ জিজ্ঞেস করলো,
“এই ড্রয়িং তোমার করা?”

চারু লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে উত্তর দিলো,
“হু”
“তুমি অনেক সুন্দর আঁকো, তা কি জানো”

চারু মাথা নাড়লো, হ্যা সে জানে। শ্রাবণ একটা চেয়ার টেনে চারুর সামনে বসলো। মোলায়েম স্বরে বললো,
“পায়ে কি ব্যাথা কমেছে?”
“জ্বী”
“সকালে নাস্তা করেছো?”
“জ্বী”
“ঔষধ খেয়েছো?”
“জ্বী”
“আমাকে তোমার ভালো লাগে?”
“জ্বী, জ্বী?”

খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো চারু। লজ্জায় শ্যাম গালজোড়া লাল হয়ে উঠলো। শ্রাবণ শব্দ করে হেসে ফেললো চারুর লজ্জায় রাঙ্গা মুখশ্রী দেখে। কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললো,
“এতো জ্বী বলছিলে যে হুট করে দুষ্টুমি করতে মন চাইলো। তাড়া নেই চারুলতা। তুমি সময় নাও, শেষমেষ তুমি আমার ই হবে। আজ উঠছি। রাতে ফোন করবো। বড় চাচা তোমার নম্বর দিয়েছে। ফোনটা ধরো। আসি”

বলেই উঠে দাঁড়ায় শ্রাবণ। তখন পেছন থেকে চারুর ধীর স্বর কর্ণপাত হয়,
“সাবধানে থাকবেন”

চারুর কথাটা শ্রাবণের হৃদয়ে এক অজানা শান্তির লহর বয়ে আনে। পেছনে ফিরে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না চারুলতা, আমি সাবধানে থাকবো”
“আমি কোনো চিন্তা করছি না। ভদ্রতার খাতিরে বলেছি”
“আমি জানি, তবুও ভালো লাগলো। কারণ, থাক কারণটা উঠানোই থাক। অন্য কখনো বলবো”

শ্রাবণ বেড়িয়ে গেলো। চারু তার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। লোকটা অদ্ভূত, আগুন্তকের মতো মনের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছে। আর চারুর সুসজ্জিত চিন্তাভাবনাগুলোকে কেমন এলোমেলো করে দিলো। নাহিয়ানের শোকে মূর্ছা যাওয়া চারুর মনকে পুনরায় জীবিত করার প্রচেষ্টা করছে যেনো সে। এক সপ্তাহ আগেও নাহিয়ানের চিন্তা মন মস্তিষ্ক ঘিরে ছিলো। অথচ এখন চিন্তাগুলো শ্রাবণমুখর হয়ে উঠেছে। মাথা ঝাকালো চারু, এমন চিন্তাকে প্রশ্রয় দিবে না সে। যেই ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই, সেই ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা বোকার কাজ, আরোও একবার সেই শোকের সম্মুখীন হতে চায় না সে। আরোও একবার নিজের জন্য কারোর জীবনের গতিপথের ইতি টানাতে চায় না চারু। চারুর প্রজ্জ্বলিত সকালটা কেমন উদাসীন হয়ে উঠলো। কালো মেঘ ছেয়ে আসলো মনের প্রাঙ্গনে। এই তো বৃষ্টি থামবে, আর ভেসে যাবে আশার বীজগুলো_____

শ্রাবণ বাসায় এসে পৌছালো ঠিক দশটা নাগাদ। বাসায় প্রবেশ করতেই শান্তার সাথে দেখা হলো তার। শান্তার মুখ থমথমে, ভয়ে পাংশুটে হয়ে আছে। শ্রাবণকে দেখেই ছুটে এলো সে। শান্তার উদ্বিগ্ন চেহারা নজরে পড়তেই বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো শ্রাবণ,
“কি হয়েছে ফুপু?”
“ভাইজান আসছেন, বৈঠক ঘরে বসে আসেন”
“কখন আসছে বাবা?”
“কাল রাতেই। তুমি সময় নষ্ট করো না। তিনি খুব রেগে আসেন”

শ্রাবণ কিয়ৎকাল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মোস্তফা কামালের সাথে শ্রাবণের সম্পর্কটা ঠিক কেমন তা বর্ণনা করা কঠিন। তারা একে অন্যের সাথে তো থাকে কিন্তু কোথাও একটা বিরুপভাব রয়েছে। এই ফাটলটা তৈরি হয়েছে শ্রাবণের মা রুপার মৃত্যুর পর থেকে। বাবা ছেলের উষ্ণ সম্পর্কটা কেমন যেনো শীতল হয়ে গেছে। শ্রাবণ বাবাকে অসম্মান করে না ঠিক, কিন্তু খুব একটা পছন্দও করে না। বাবার প্রতি তার আচারণ অতি বিচিত্র। শ্রাবন মস্তিষ্কে কথাগুলো সাজালো। তারপর পা বাড়ালো বৈঠকঘরের দিকে।

বৈঠক ঘরে ওকালতির বই খুলে বসে রয়েছেন মোস্তফা কামাল। তার হাতে মোটা চুরুট, চোখে সোনালী ফ্রেমের চশমা। মোস্তফা কামাল পেশায় জজ কোর্টের বিচারক। তার ভাব ই বড় বিচিত্র। এই শহরে তার বেশ দাপট। আজ অবধি কত কত মানুষকে কলমের খোঁচায় শুলে চড়িয়েছেন হিসেব নেই। কিন্তু তার হৃদয় কাঁপে না। বরং তার যদি মনে হয় কেউ দোষী, তাকে শাস্তি না দিলে তার শান্তি হয় না। তিনি চান তার ছেলেও তার মতো হোক, কঠোর বজ্রহৃদয়। সেখানেই বাধে গোল। শ্রাবণের সাথে বাবার এই ব্যাপার গুলোই মিলে না। শ্রাবণ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। ধীর গলায় বলে,
“বাবা আসবো?”

মোস্তফা কামাল বই থেকে মুখ তুলেন, তার চাহনী শীতল। চোয়াল শক্ত। রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“এতো বড় সিদ্ধান্ত নেবার সময় আমার অনুমতির প্রয়োজন হয় নি তোমার, অথচ ঘরে প্রবেশ করতে আদিক্ষেতা দেখাচ্ছো…………

চলবে।

মুশফিকা রহমান মৈথি