দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব-০২

0
545

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২

রাজীব সারারাত চয়নিকার মুখের দিকে তাঁকিয়ে রাত পার করে দিলো। চয়নিকা বেঘোরে ঘুমিয়েছে। সারাদিন না খেয়ে রাতে খাওয়ার পর চোখ এমনিতেই বন্ধ হয়ে আসছিল। রাজীবের সঙ্গে আপাতত কথা বলা বন্ধ।ও নির্বাচনের একগাদা কাজকর্ম ফেলে বউয়ের মান ভাঙাতে বাড়িতে ফিরে এসেছে। বিয়ে বিষয়টা চয়নিকার কাছে জঘন্য লেগেছে।ওকে এভাবে অপমান করার কোনো মানে নেই। রাজীব হাজার বার কানে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে চয়নিকা পাত্তা দিচ্ছে না। দিবে কেনো? নিজের বোনের সঙ্গে এমন হলে ঠিকই কোমর বেঁধে চলে যেতো ঝগড়া করতে। চয়নিকা ঠিক করেছে রাজীবকে একটা শিক্ষা দিবে। ভোরের আলো ফুটতেই মির্জা বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেলো। আমেনা বেগম লতাকে রান্না শেখানো জন্য ঘরে গিয়ে খুঁজে পাননি। অনেক খোঁজাখুঁজি চলল কিন্তু তাঁকে পাওয়া গেলো না। হৈমন্তী হাপাতে হাপাতে আরাফাতের রুমের দরজায় গিয়ে কয়েকবার ধাক্কা দিতেই দরজা খুঁলে গেলো। হৈমন্তী উত্তেজনাই কাঁপছে। আরাফাত দরজা ধরে দাঁড়িয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

>বোন কিছুক্ষণ আগে ঘুমিয়েছি এখুনি তোর ডাকতে হলো? সমস্যা কি হৈমী?

> তুমি জানো লতা আপা নিখোঁজ। আম্মা কাঁদছেন। তুমি কি জানতে কোথাও প্রেম ট্রেম আছে কিনা?

আরাফাত হৈমন্তীর কথায় পাত্তা না শুয়ে পড়ে হামি ছেড়ে বলল,

> জানি। শুধু আমি না বড় ভাইয়াও জানে। গতকাল রাতে লতার বিয়ে হয়েছে। লতার সঙ্গে এক ছেলের বহুদিনের প্রেম ছিল ভয়ে বাড়িতে বলতে পারছিল না। আমি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ভয় দূর করে গতকাল রাতে বিয়ে করিয়ে দিয়েছি। যা আম্মাকে বল বাড়িতে কোনো লতাপাতা নেই। একটু শান্তি চাই।

হৈমন্তী কথাটা শুনে থতমত খেয়ে গেলো। আম্মা জানলে কি বলবে কে জানে। হৈমন্তী কিছু একটা ভেবে মায়ের রুমে ফিরে গেলো। আমেনা বেগম মুখটা গম্ভীর করে রেখেছে। হৈমন্তী সাহস জুগিয়ে বলল,

> আম্মা লতা আপার সঙ্গে একটা ছেলেকে দেখা যেতো। আমার মনে হয় ওই ছেলেটার সঙ্গেই…

হৈমন্তী কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই আমেনা বেগম ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

> বড়দের বিষয়ে কথা বলতে কে বলেছে? তুমি যাও এখন।

হৈমন্তী চুপচাপ চলে আসলো। সকাল দশটা নাগাদ লতা নতুন বরকে সঙ্গে নিয়ে আমেনা বেগম কে সালাম করতে আসলো। উনি রাগ করে মুখ ভার করে থাকলেন।যার জন্য নিজের বাড়ির বউকে কষ্ট দিলেন সেই মেয়েটাই এই বাড়ির সম্মান নষ্ট করেছে এটা উনি মানতে পারছেন না। তবে লতা বারবার চয়নিকার কাছে ক্ষমা ছেয়েছে। আমেনা বেগমের মন রক্ষার জন্য এসব করতেই হতো। আমনা বেগম জানেন না লতার বিয়ের পেছনে তাঁর ছেলেদের পুরোটা হাত আছে। উনি ভাবলেন লতা উনার সঙ্গে ছলনা করেছে। লতার উপরে গিয়ে সব রাগ জমা হলো। চয়নিকা আবারও বাড়ির কাজকর্মে হাত লাগিয়েছে তবে সে শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলছে না। আমেনা বেগম বড় বউয়ের পেছনে পেছনে ঘুরছেন মিলমিশ করানোর জন্য। কিন্তু পাত্তা পাচ্ছেন না। রাজীব সকালবেলায় না খেয়ে বেরিয়েছে। দুপুর নাগাদ আমেনা বেগম কাজের মেয়েকে নিয়ে কোথায় একটা গেলেন ফিরলেন সন্ধ্যা নাগাদ। একা ফিরলেন না সঙ্গে নিয়ে আসলেন ছোট্ট একটা বাচ্চা। চয়নিকার চোখেমুখে বিস্ময়। কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে শেষমেশ শাশুড়ির পাশে গিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললেন,

> আম্মা বাচ্চাটা কোথা থেকে পেলেন?
আমেনা বেগম বাচ্চাটাকে চয়নিকার কোলের উপরে দিয়ে বললেন,

> রমেলার গ্রাম থেকে এনেছি। সকালবেলায় মেয়েটার মা মারা গেছে। বাবা থেকেও নেই। বিয়ে হয়েছিল জামাই কোথায় চলে গেছে খোঁজ রাখেনা। বাচ্চাটার দেখাশোনার জন্য ভালো একটা পরিবেশ দরকার। তুমি ওকে লালন পালন করবে। নিজের বাচ্চার মতো। এতিমকে ভালবাসলে আল্লাহ তাঁকে ভালোবাসে বুঝলে?

চয়নিকার এক মূহুর্ত্তের মধ্যেই শাশুড়ির উপরে থাকা রাগ কমে গেলো। মনে মনে ভাবল শাশুড়ির উপরে আর রাগ করা চলবে না। কত সহজেই না মা হওয়ার একটা সুযোগ করে দিলো। চোখে পানি এসে গেলো। তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল,

> আম্মা আপনার ছেলেকে একটা ফোন দিয়ে বলেন না ফিরে আসতে। বাচ্চাটা খুব সুন্দর। উনি দেখলে খুশী হবেন।

আমেনা বেগম চয়নিকার মুখের দিকে তাকিয়ে শান্তি অনুভব করলেন। লতা না চলে গেলে কখনও বুঝতেন না কি ভুল কাজটাই না করতে চলেছিলেন। লতার উপরে থাকা রাগের জন‍্যই হয়তো উনি চয়নিকার প্রতি এতোটা স্নেহশীল হচ্ছেন। আজ যখন এই বাচ্চাটার খবর পেলেন অপেক্ষা করেননি দ্রুত চলে গিয়েছেন। শুধু রক্তের সম্পর্ক হলেই কি আপন হয়? মাঝেমাঝে পরও আপন হয়ে যায়। চয়নিকা পুরোদস্তুর মা বনে গেলো। রাজীব যত কাজই থাকুক নিয়মিত বাড়িতে ফিরছে। না ফিরে উপাই নেই এখনো চয়নিকা ওর সঙ্গে কথা বলছে না। রাজীব বুঝে উঠতে পারছে না যেখানে ওর মা অন‍্যায় করে ক্ষমা পেয়ে গেলো সেখানে ও কি দোষ করলো যে ক্ষমা পাবে না? মোটামুটি বাড়িতে শান্তি ফিরেছে। রাজীব অত‍্যান্ত ভালো মনের একজন মানুষ। রাজনীতির প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু জনগণের জন্য নির্বাচনে নামতে হলো। মির্জ বাড়ির বিপরীত প্রতিপক্ষ ছিল কাজী বাড়ি। কাজী বাড়ির প্রধান দেলোয়ার কাজী মনে মনে একটা ছক তৈরী করে ফেললেন। মির্জ বাড়ির সঙ্গে যদি আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরী করা যায় তবে মির্জা বাড়িকে হারানো যাবে। এই দুই পরিবারের ঝগড়া চলছে বহুদিন ধরে। দেলোয়ার কাজী হুট করে একদিন ঘটক পাঠালেন হৈমন্তী সঙ্গে উনার ছেলের বিয়ে প্রস্তাব নিয়ে। উনার ছেলে মাধ্যমিক ফেল। তবে প্রচুর টাকা পয়সা আছে। কখনও মেয়ের অসুবিধা হবে না। প্রথমে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও হৈমন্তীর বাবা সবাইকে বুঝিয়ে বললেন যদি এই সম্পর্কের জন্য হলেও এতো দিনের ঝগড়া ঝামেলা মিটে যায় তাহলে দোষের কি?তাই মানা করা যাবে না।আরাফাত রাগে ক্ষোভে বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলো। বোনের বিয়ে ও কিছুতেই কাজী বাড়িতে দিবে না। রাজীব পড়েছে দোটানায়। কি করবে বুঝতে পারছে না। তবে হৈমন্তী বেশ খুশী বিয়ে পড়াশোনা করতে হবে না প‍্যারা নেই। এর চেয়ে ভালো কি বা আছে। ফেল করা চিঠি লুকানোর জন্য ভাইয়ার হাতে পায়ে ধরা লাগবে না। হৈমন্তী বিয়ের জন্য প্রস্তুত। চয়নিকা ওর এমন মতিগতি দেখে বিরক্ত হলো। আমেনা বেগম আগে থেকেই ভেবেছিলেন মেয়ের দ্রুত বিয়ে দিতে হবে কিন্তু কাজী বাড়ির বখাটে ছেলেটার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে নিয়ে উনিও বেশ চিন্তিত। বারবার কাজীরা লোক পাঠাতে শুরু করলো। দুই পক্ষের মধ্যে একটা তৃতীয় পক্ষের সৃষ্টি হলো যারা দিনরাত পরিশ্রম করে খবরাখবর আদান প্রদান করতে থাকলো। বিষয়টা রাজনৈতিক পর্যায়ে চলে গেলো। বিয়েটাতে মানা করার উপাই থাকলো না। শেষমেশ দিন ধার্য করা হলো। লোকজন উঠেপড়ে লাগলো বিয়ের আয়োজন করতে। রাজীব দুহাতে টাকা উড়ালো বোনের বিয়েতে। বড় বোনের বিয়েটা হঠাৎ হয়েছিল তাই তেমন কোনো অনুষ্ঠান করা হয়নি এবার কোন খায়েশ অপূর্ণ রাখবে না। পুরো বিয়েতে আরাফাত একবারের জন্যও বাড়িতে আসেনি। দেখতে দেখতে বিয়ে দিন ঘনিয়ে আসলো। কাজী বাড়ি থেকে প্রচুর উপহারসামগ্রী আসলো। মির্জা বাড়ি থেকেও গেলো। কিন্তু বিয়ের দিন ভোরবেলা ঘটলো আরেক অঘটন। দেলোয়ার কাজীর বড় ছেলে রফিককে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। সারা শহর জুড়ে খোঁজা হলো। ফলাফল শূন্য। কাজীদের মাথায় হাত। কিভাবে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। উনার একমাত্র ছেলে ছিল রফিক। ছেলেটা বিয়ে করবেনা বলে পালিয়ে গেছে। দুই পরিবারের মান সম্মান জড়িয়ে আছে এই বিয়ের মধ্যে। এতো আয়োজন এখন যদি বিয়ে না হয়? তাছাড়া কাজীরা এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনা। দেলোয়ার কাজীর ভাই আনোয়ার কাজী বুদ্ধি দিলেন। রফিক পালিয়েছে তাতে কি উনার ছেলে তো আছে। যদিও ছেলে ডাক্তার হঠাৎ বিয়ে মানবে কিনা সন্দেহ আছে তবুও পরিবারের কথা ভেবে নিশ্চয়ই মানবে। দুভাই মিলে ঠিক করলেন ছেলেকে রাজি করাবেন।
☆☆☆☆
ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আবির। ভাইয়ের বিয়েতে এসে নিজেকে বিয়ে করতে হবে বুঝতে পারলে কখনও আসতোন। সামনে ওর বাবা চাচা অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বিয়ে গতকাল ধুমধাম করে গায়ে হলুদ হয়েছে। রফিক পালিয়ে যাওয়ার হলে আগেই যেতে পারতো বিয়ের দিন গভীর রাতে কেনো পালিয়ে গেলো মাথায় আসছে না। আবিরের মুখে বিরক্তি। দেলোয়ার কাজী মুখটা আরও করুন করে বলল,
> বাপ বিয়েটা না করলে মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। বাপ চাচাকে এবারের যাত্রাই বাঁচা। কথা দিচ্ছি জীবনে তোর কাছে কিছু চাইবো না।

আবির রাগ সামলাতে পারলো না ঝাঝালোভাবে বলল,

> পাববো না। জানা নেই চেনা নেই হুট করে কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। এসবের আগে কিছু জিঞ্জাসা করেছো? পেটে শুধু কূটচাল। বিয়ে নিয়ে কিছু একটা প‍্যাচ ছিল তোমাদের তাইনা?। আমি ওসব পারবো না। আমি আজকেই ঢাকা ফিরে যাচ্ছি। বাচ্চা একটা মেয়ে আমার সঙ্গে কিভাবে কি?
আনোয়ার কাজী ভাইকে পরাজিত দেকে নিজে হাত জোর করে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। উনি জানেন ছেলে যখন বলেছে করবে না তখন করবেই না। কিন্তু হাল ছাড়লে তো চলবে না। বিয়ে না হলে কতদিনের পরিকল্পনা সব ব‍্যর্থ। উনি ছলছল চোখে ছেলেকে বললেন,
> বিয়ে না করলে বাপ চাচার কবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। বিষয়টা আর পরিবারিক পর্যায়ে নেই। লোকজন হাসাহাসি করবে তার চাইতে মৃত্যু ভালো। ওরা কতটা আশা করে আছে। দুই পরিবার এবার এক হবে। কি আর করা হলো না।
আবির বুঝতে পারলো ওর বাবা ওকে কৌশলে ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টা করছে কিন্তু সত্যিই বিয়েটা খুব জরুরি। বহুদিনের শত্রুতার অবসান হওয়ার দরকার। বিয়েটা ও করবে। আবির মুখ কঠিন করে বলল,
> বিয়ে করবো আমি তবে শর্ত আছে।
দুভাই যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
> সব শর্তে রাজি তুই শুধু বল কি করতে হবে।
আবির ভেবে চিন্তে উত্তর দিলো,
> দুদিন পরে আমার ফ্লাইট বউ নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এই নিয়ে কোনো ঝামেলা করবে না। আপাতত বউকে এখানেই থাকতে হবে। আর আমার সব সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে যখন যা বলবো সবাইকে তাই শুনতে হবে।

এখন বিয়েটাই আসল আবিরের শর্ত কোনো ব‍্যাপার না। তাছাড়া বিয়ের পরে দেখা যাবে কি হয়। সেই হিসেবে দুজন রাজি হয়ে গেলো। আবিরের সঙ্গে হৈমন্তী বিয়েটা সেদিন হয়ে গেলো। মির্জা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলেও কাজী বাড়িতে বেশ আনন্দঘন পরিবেশ। আমেনা বেগম বেশ খুশী রফিককে জামাই হিসেবে উনার পছন্দ ছিল না কিন্তু না বলতে পারেননি। যখন পাত্র বদলে গেল তখন উনি একটু বেশিই খুশী ছিলেন। রাজীব বোনকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চোখের পানি মুছতে পারলো না তার আগেই শুনলো দেলোয়ার কাজী ওর প্রতিপক্ষ হিসেবে নির্বাচনে নামছে। কাজীরা দুভাই যৌথ পরিবারে বসবাস করে। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের গলাই গলাই ভাব। রাজীবের চোখেমুখে বিস্ময়। বিষয়টা বুঝতে ওর কয়েক সেকেন্ড লাগলো। ওকে ঠকানো হয়েছে। ওর জানা আছে আগামীকাল সকালবেলা ও বাড়ি থেকে কি নির্দেশ আসবে। বোনকে ভালো রাখতে হলে ওকে নির্বাচন থেকে সরে আসতে হবে। কাজীদের পরিকল্পনা সফল। রাজীব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। কাজী বাড়িতেও আনন্দটা স্থায়ী হলো না। কারণ বউ নিয়ে বাড়িতে ফিরে গিয়ে দেখলো রফিক ফিরে এসেছে। ওর হাত পায়ে জখম। কেউ ইচ্ছা করে ওকে বেঁধে রেখেছি। কিন্তু কাউকে সন্দেহ করা যাচ্ছে না। কে ওকে বাঁধতে পারে আর তাঁর উদ্দেশ্য কি হতে পারে বোঝা গেলো না। কাজী বাড়িতে এটা নিয়ে বৈঠক বসলো।

চলবে