দৃষ্টির অগোচরে সে পর্ব-২৮ এবং শেষ পর্ব

0
929

#দৃষ্টির_অগোচরে_সে
#কলামে_লাবণ্য_ইয়াসমিন
#অন্তিম_পর্ব

কুসুমের চিৎকার শুনে হৃদয় আর দীলারা বেগম ছুটে গেলো তনুজার রুমে। রুমের দরজা খোলা আছে আর তনুজা বিছানায় শুয়ে আছে। ওর মাথাটা বাইরের দিকে ঝুলে আছে পাশে হাত থেকে রক্ত টপটপ করে মেঝেত পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। হৃদয় তাড়াতাড়ি এসে ওর পাশে বসে চেক করলো এখনো বেঁচে আছে কিনা। দীলারা বেগম উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। উনি বারবার বলছেন ভাইজানকে আমি কি জবাব দিবো। হৃদয় চেক করে বুঝলো এখনো বেঁচে আছে। হাত কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে মেয়েটা। হৃদয়ের ইচ্ছা করছে ওর হাতটা আরও একটু কেটে দিতে,বাজে একটা মেয়ে। জীবনটা একেবারে তামা তামা করে দিলো। ওকে হসপিটালে না নিলেও হবে। এইটুকু কাঁটলে কেউ মরে না। তনুজা রক্ত দেখতে পারেনা তাই ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। হৃদয় ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। সব কিছুতেই এমন বাড়াবাড়ি করার কি আছে। কথা গুলো ভেবে হৃদয় চুপ করে ওর মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। হৃদয়ের মা ওর দিকে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

> কিরে ওকে হসপিটালে নিতে হবে না?

> আম্মু আমার শক্তি নেই ওকে তুলে বাইরে নিয়ে যাবো মতো। তুমি আর কুসুম পারলে নিয়ে যাও। আমি বরং বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেই কি বলো?(সামান্য হেসে)

> বাজে বকবি না। আমি আর কুসুম কেমন করে ওকে নিয়ে যাবো শুনি? (রেগে)

> আমি ও পারবো না তোমার যা ইচ্ছা করো। আমি চলে গেলাম।আর ওকে কে বলেছিল এই সব নাটক করতে। ওর মাথায় আবারও কিছু খারাপ চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে আমি বুঝেছি। ওর কিছুই হয়নি। সামান্য একটু কেটেছে। (রেগে)

> হৃদয় তুই মুখ বন্ধ করবি?আমি দেখছি কি করা যায়।

>ওকে যা পারো করো।

হৃদয় ওখান থেকে নিজের রুমে চলে আসলো। ও চলে যেতেই দীলারা বেগম ডাক্তার কে ফোন দিলো বাড়িতে আসার জন্য। হৃদয় রুমে আসতেই হৃদীতা ওর গলা জড়িয়ে ধরলো। হৃদয়ের মুড খারাপ তাই ও হৃদীতার দিকে বিরক্ত হয়ে তাঁকিয়ে আছে। হৃদীতা ওর গলাই ঝুলতে ঝুলতে মিষ্টি করে হেসে বলল,

> আমার মাথায় দারুণ একটা বুদ্ধি এসেছে।

> কি বুদ্ধি?( ভ্রু কুচকে)

> তোমাকে এখন বলবো না। তুমি বরং বিয়ের জন্য সাজুগুজু করো যাও। আসো আমি সাজিয়ে দেই। ওই ফেসিয়াল করবে? চলো পার্লারে যায়। (হাসি দিয়ে )

> আমাকে রাগান্বিত কেনো করছো? আমি বিয়ে করবো না। আমি রাগ করে বলেছিলাম তখন বিয়ে করবো। আর তুমি জানো তনুজা কি করেছে? সে সুইসাইড করার জন্য হাত কেটেছে।সব কপাল আমার। (রাগ করে)

> চিন্তা করো না। আমি ম্যানেজ করে নিবো বললাম তো।

> কি করবে শুনি?

> বলবো না।

> তুমি যাও এখন। আমাকে একটু একা থাকতে দাও। (মন খারাপ করে)

হৃদয়কে এমন করাতে দেখে হৃদীতা মুখ ভার করে জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো। হৃদয় ওর দিকে তাঁকিয়ে মনে মনে কীছু একটা ভেবে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাধে মুখ রাখলো। তারপর ফিসফিস করে বলল,

> সরি।

> হুম।

> কি হুম?

> কিছু না।

> রাতে কিন্তু চমৎকার করে সাজবে আমি দেখবো।

> তনুজা কে দেখবেন আমাকে দেখতে হবে না। (হৃদয়ের হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে)

> ওকে না আমি তোমাকে দেখবো। নড়াচড়া করো কেনো এতো? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক। (ধমক দিয়ে )

> তাহলে বারবার ওর কথা কেনো বলছেন?

> মজা করেছি। বউ থাকতে আমি অন্য মেয়েকে কেনো বিয়ে করতে যাবো শুনি? দুবছর যার জন্য আমি পাগল হয়ে উঠেছিলাম হঠাৎ তাঁকে ফিরে পেয়েও হারিয়ে ফেলবো এমন বোকা তো আমি নয়। ভালোবাসলেই হয়না তাকে আগলে রাখতে জানতে হয়। তোমাকে কিছুই করতে হবে না আমি একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছি বুঝলে?

> কী করেছেন? (হৃদয়ের দিকে ফিরে)

> একটু পরেই উকিল আসবে নোটিশ নিয়ে। তখন বুঝবে কি হয়।

> নিজের মায়ের বিরুদ্ধে আপনি উকিল ঠিক করেছেন? এটা কিন্তু ঠিক না।

> তো কোনটা ঠিক আমার বউকে রেখে অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করবো এটা ঠিক?

> ঠিক ভুল বুঝিনা। আপনি আমার এটা বুঝি।

> তাহলে চুপ করেই থাকেন। আমি আসছি বাইরে একটু কাজ আছে আর শুনো আলমারিতে তোমার জন্য একটা শাড়ি আছে পড়ে নিয়ে নিচে আসবে ওকে?

> ওকে।

হৃদয় ওকে রেখে বাইরে চলে আসলো। হঠাৎ ওর একটু বাইরে যাবার প্রয়োজন আছে। অন্যদিকে দীলারা বেগম ডাক্তার ডেকে তনুজার চিকিৎসা করিয়েছেন। ও এখন মোটামুটি সুস্থ। দীলারা বেগম ওর জ্ঞান ফিরতেই রেগে প্রশ্ন করেছেন এমন কাজ ও কি জন্য করেছে। এর উত্তরে ও বলেছে ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য ও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। হৃদয় কে ও প্রচণ্ড ভালোবাসে। ভালোবাসা জন্য ও সব করতে পারে। দীলারা বেগম প্রচণ্ড খুশি এমন মেয়েকেই উনি চেয়েছিলেন ছেলের জন্য। হৃদয় কে যে নিজের থেকেও ভালোবাসবে। তন্ময়া রাগ করে ঘরে বসে আছে ওর সব কিছু অসহ্য লাগছে। ও আবার বিদেশে ফিরে যাবার পরিকল্পনা করেছে। দীলারা বেগম নিজ হাতে তনুজাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। বাড়িতে টুকটাক মেহমান এসেছে। তনুজার বাবা মা আর আশেপাশের কিছু পরিচিত লোকজন। হৃদয় এখনো বাড়িতে ফিরে আসেনি কিন্তু সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। অন্যদিকে হৃদীতা সুন্দর করে হৃদয়ের আনা শাড়ি টা পড়ে সেজেগুজে বাইরে আসলো। ও শিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতেই দিলারা বেগম ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ভাবছেন এই মেয়েটা না গতকাল চলে গিয়েছিল তাহলে আবার ফিরে আসলো কখন? হৃদয় বা কোথায় আছে কে জানে। উনি দ্রুত এগিয়ে এসে হৃদীতার সামনে দাঁড়ালেন,

> তুমি চলে গিয়েছিল আবার কেনো আসলে?

> আমার স্বামীর বাড়িতে আসার যথেষ্ট রাইট আমার আছে আম্মু। আর আপনার ছেলে আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। আপনি তো আগে এমন ছিলেন না তাহলে হঠাৎ এমন খারাপ শাশুড়ির মতো অভিনয় কেনো করছেন বলতে পারেন? (কান্না করে)

> একদম চুপ থাকবে। আমি তোমার কোনো কথায় শুনতে চাই না। এখুনি তুমি এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে।

কথাটা বলেই উনি হৃদীতার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে বাইরে বের করে দিতে চাইলেন কিন্তু তার আগেই উনাদের পরিবারিক উকিল সাহেব এসে হাজির হলেন। উনাকে দেখে দীলারা বেগম হৃদীতার হাত ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলেন,

> কি হয়েছে হঠাৎ আপনি?

> আপনাকে একটা নোটিশ দেওয়ার ছিল। আপনার পুত্র হৃদয়ের সম্পত্তির মালিকানা উনার স্ত্রী হৃদীতার নামে করা হয়েছে। আর এমনিতে ও উনার নামে আগে থেকেই অর্ধের ছিল আর বাকিটা আপনার ছেলে কয়েকদিন আগে লিখে দিয়েছেন। এখন সব কিছুর মালিক উনি।

উকিল সাহেব একটা দলিল দীলারা বেগমের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। উনি চলে যেতেই দীলারা বেগম ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। উনি বসে পড়তেই তনুজা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলে উঠলো,

> ফুপি আমি এই বিয়েটা করতে পারবো না। আমি এখুনি চলে যাচ্ছি। (রেগে)

> মানে কি তনু? কেনো করবি না?

> কি জন্য করবো? এতে আমার কি লাভ হবে? তোমার ছেলের কি আছে যেটা দেখে আমি ওকে বিয়ে করবো। ওকে বিয়ে করলে আমাকে রাস্তায় নামতে হবে। আর কখনও তো ও আমাকে ভালোবাসতেও পারবে না তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

> তনু মা তুই তো আমাকে ছেলেকে ভালোবাসিস তাই না?( অনুরোধ করে)

> অর্থ না থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাই। আমাকে মাফ করো ফুপি।

ওর কথা শুনে দীলারা বেগম মাথায় হাত দিলেন কি ভুলটাই না উনি করতে চলেছিলেন। আর একটুর জন্য হৃদয়ের জীবন না নষ্ট হতে চলেছিল। তনুজা বিয়ের ওড়নাটা খুলে রেখে বাইরে চলে আসতে গেলো কিন্তু পারলো না হৃদয় এসে হাজির। ও হাসিমুখে বিয়ের টুপি হাতে ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো।

> আরে তনু এইতো আমি এসে গিয়েছি। বিয়ে করবি না আমাকে?

> তুমি এক নাম্বারের একটা প্রতারক। চালাকি করে নিজের সব কিছু ওই কাজের মেয়েটার নামে লিখে দিয়েছো। আমি তোমাকে ছাড়বো না পুলিশে দিবো। (হুমকি দিয়ে )

> তাইনাকি? তোমাকে পুলিশ ডাকতে হবে না আমি নিজেই ডেকেছি। আমাদের পরিবারে ঝামেলা লাগিয়ে আমার আম্মুকে ঠাকানোর জন্য তোমাকে ওরা এখুনি নিয়ে যাবে অপেক্ষা করো। আর ওই যে অনেক বছর আগে সজীব নামের এক ভদ্রলোক খুন হয়েছিলেন ওটার রহস্য টাও ফাঁস হয়েছে বুঝলে?

> মানে? (ভয় পেয়ে)

> মানে আবার কি তুমি নিজের বয়ফ্রেন্ডকে ফুসলিয়ে হৃদীতার নামে বদনাম করতে চেয়েছিলে। যাতে তোমার নাম না উঠে তাই রিয়ার নাম বলিয়েছিলে ওকে দিয়ে। তোমার বয়ফ্রেন্ড যখন তোমার উদ্দেশ্য বুঝতে পারে তখন তুমি ওকে কৌশলে খুন করে দিলে। যাইহোক অনেক দিনের পরিকল্পনা তোমার সব বিফলে গেলে। সব কিছু এখন পরিষ্কার।( রেগে)

> আমি তোমাকে ছাড়বো না।

তনুজা ওর দিকে তেড়ে আসলো কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ এসে ওকে ধরে ফেলল। দীলারা বেগম অবাক হয়ে দেখছে কি হচ্ছে উনার বুঝতে কয়েক মূহুর্ত লাগলো।নিজের ভুল উনি বুঝতে পারলেন। হৃদীতা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তন্ময়া এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল,

> অবশেষ সব ঠিক হলো। কাজী তো আছেই চলো আবার নতুন করে তোমাদের বিয়েটা করিয়ে দেই কেমন হবে?( হাসি দিয়ে )

> একদম বাজে হবে। দুবার হয়ে গেছে এবার কিন্তু লোকে খারাপ বলবে। (লজ্জা পেয়ে)

> দূর লোকের কথায় কি যায় আসে। লোকে তো কত কিছুই বলে। তাই বলে কি থেমে থাকতে হবে?

দীলারা বেগম হৃদীতার কাছে ক্ষমা চাইলেন ভুলের জন্য তারপর তন্ময়ার বায়নাতে ওদের আবার নতুন করে বিয়ে পড়ানো হলো। গভীর রাত হৃদীতা সেই পুরাতন বাসর ঘরে বসে আছে। পুরাতন বাসরে নতুন ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। চারদিকে তার সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে। হৃদয় চুপচাপ রুমে এসে দরজা বন্ধ করে হৃদীতার পাশে গিয়ে বসে ওর ঘোমটা উঠিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হৃদীতা লজ্জা পেয়ে চোখ নিচু করে বলল,

> ঘুমাবেন না?

> আবার ও পালানোর ইচ্ছা আছে নাকি?( ভ্রু কুচকে)

> ভয় নেই আমি আর কখনও কোথাও যাবো না। আপনার কাছেই থাকবো। আপনার বুকেই আমার সব সুখ।

> ছাদে যাবে?

> না ছাদে নয়। অন্যকোথাও যাবো। আসুন আমার সাথে।

হৃদীতা হৃদয়ের হাত ধরে বারান্দায় এসে ওর চোখে হাত দিয়ে বলল চোখ বন্ধ করুন। হৃদয় চোখ বন্ধ করে একটূ পরে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো ওরা সেই নদীতে একটা নৌকার উপর দাঁড়িয়ে আছে। হৃদীতা ওকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখলো। হৃদয় ওকে দুহাতে আকড়ে ধরলো। নৌকা টা ছুটে চলেছে উজানে টানে। হৃদীতা হৃদয়ের বুকে নিজের সুখ খুঁজে নিয়েছে। ও যে মানুষ নয় একজন পরী কথাটা হৃদয় ছাড়া কার কেউ জানেনা। হয়তো কখনও কেউ জানতেও পারবে না। ও মানুষের দৃষ্টির অগোচরেই থাকবে সারাজীবন। হৃদীতা সেদিন নিজের মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিল ও নিজের প্রথম সন্তানকে নিজের মায়ের হাতে তুলে দিবে। এটাই ওর মুক্তির একমাত্র পথ ছিল। হৃদীতা হৃদয়ের জন্য সব করতে পারে। কথাটা ভেবে ও হৃদয় কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

(সমাপ্ত)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।