দৃষ্টির অলক্ষ্যে পর্ব-১২+১৩

0
440

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ১২
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘আর সে হলো ত,,,’

কথা সম্পূর্ণ করতে পারলো হুমায়রা। তার আগেই হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে উপস্থিত হয় তামান্না। কোমরে হাত রেখে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে সে।কম্পান্বিত,থরথরানি স্বরে বিবৃত করল,

‘স্যরি, স্যরি! অনেক লেট করে ফেললাম না? আরে ইয়ার রাস্তায় এতো পরিমাণে জ্যাম আর কি বলবো। তোরা নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিস?’

তূবা তামান্নাকে আশস্ত করল,

‘ইট’স ওকে। তুই আগে বসে রিল্যাক্স হয়ে নে।’

তামান্না হুমায়রার পাশের চেয়ারটা টেনে বসলো। তূবা পুনরায় হুমায়রার পানে নেত্রপাত করল।

‘তুই কি যেন বলছিলি?’

কথার মোড় ঘুরিয়ে নেয় হুমায়রা। নিষ্প্রাণ হেসে বলে,

‘তোর মেয়ের শরীরটা ভালো? কত দিন হলো দেখি না। নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে।’

সূঁচালো দৃষ্টিতে কিছু সময় হুমায়রার দিকে চেয়ে রয় তূবা। অতঃপর বুঝতে পারলো হুমায়রা তামান্নার সামনে কিছু বলতে চায় না। তূবাও আর এই মুহূর্তে ঘাটালো না। হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেলল,

‘এই তো আলহামদুলিল্লাহ।’

‘তোর মেয়ে কেমন আছে, তামান্না?’

অধর প্রসারিত করে তামান্না জবাব দিলো,

‘আমার রাজকন্যাও ভালো আছে। তাড়াতাড়ি লেমন মিন্ট অর্ডার কর।গলা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেলো।’

চুটিয়ে গল্প করছে তিনজন। ভার্সিটি জীবনের বিভিন্ন স্মরনীয় ঘটনার স্মৃতিচারন করছে আর হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে তিনজন। এই মুহুর্তে তিনজন কে দেখলে যে কেউ বলবে সদ্য ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়া ফ্রেশার। এতোকিছুর মাঝেও শুধু দুজনের মাঝে অস্থিরতা, চাপল্য বিরাজমান। একজন ছটফট করছে কিছু বলার জন্য আরেকজন কিছু শোনার জন্য। দৃষ্টির অলক্ষ্যে থেকে তার সুখের সংসারে অ’গ্নি ব’র্ষন করা মানুষটার মুখোমুখি হতে চায় সে। কি এমন ক্ষ’তি করেছে তার জানতে চাইবে সে। তূবা যখন নিজের ভাবনায় বিভোর ঠিক তখন হুমায়রার হাতে ধাক্কায় আধখাওয়া লেমন মিন্ট ছিটকে গিয়ে তামান্নার উপর পড়ে। হুমায়রা দাঁতে জিভ কেটে বলে,

‘স্যরি ইয়ার! খেয়াল করিনি। ওয়েট আমি ক্লিন করে দিচ্ছি।’

‘আরে এভাবে বলছিস কেন? আমি ওয়াশরুমে ক্লিন করে আসতেছি।’

তামান্না চলে যেতেই হুমায়রা তূবার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। মৃদুস্বরে বলল,

‘এখন না বললে হয়তো আর বলতে পারবো না। এখন যার নাম বলবো তা শোনার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে নে। তার আগে বলে নিচ্ছি, আমাদের ক্ষ’তি কিন্তু আমাদের কাছের মানুষরাই করে থাকে। এইযে তোর জীবনে এতো ঝড়ঝাপটা, ফয়সাল ভাইয়ের তোকে করা অবহেলা, সেদিনের সেই নিকৃষ্ট কথা এসবের পেছনে আর কেউ না তামান্না আছে।’

শেষোক্তে বাচ্যে তামান্নার নাম শুনে তৎক্ষনাৎ হুমায়রার হাতের মুঠো থেকে তার হাত দুটো ছাড়িয়ে নেয় তূবা।

‘আর ইউ ক্রেজি অর কিডিং উইথ মি? তুই কি বলছিস তোর মাথা ঠিক আছে?’

কন্ঠনালী কাঁপছে তার। মস্তিষ্ক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো হুমায়রার পানে ।

‘বললাম না আমাদের ক্ষতি আমাদের আপন মানুষরাই করে থাকে। তবে দৃষ্টির অলক্ষ্যে। এদের তুই কখনো সন্দেহের কাতারে ফেলবিই না। এর সুযোগটাই এরা নেয়। তোর মনে আছে আমরা যখন দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, বসন্ত বরণ ফেস্টিভ্যালে তোকে আমাদের দুই ইয়ার সিনিয়র আশিক ভাই প্রপোজ করেছিল?’

স্তম্ভিত, নিশ্চল, স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তূবা। হুমায়রার কথার প্রেক্ষিতে মাথা দুলায় সে।

‘আশিক ভাইকে তামান্না পছন্দ করতো। তামান্নাও সেদিন প্ল্যান করেছিলো উনাকে প্রেম নিবেদন করবে। তার আগেই উনি তোকে প্রপোজ করে। সেদিন ও ফুলের বুকে ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে বলেছিল,
তোর জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছাড়বে। তোকে কোনোদিন কারো ভালোবাসা পেতে দিবে না। ভালোবাসার অভাবে, হীনতায় তোকে ধুঁকে ধুঁকে মা’র’বে। আমি সেদিন বুঝিনি ও তোকে এভাবে তিলে তিলে শে’ষ করার ফন্দি এঁটেছে। আমি সাময়িক রাগ ভেবেছিলাম। যা সময়ের সাথে সাথে বিলীন হয়ে যাবে। এসব বলে বন্ধুত্বের মাঝে ফাঁটল ধরাতে চাইনি। কিন্তু সেটাই আমার ভুল হয়েছে। যখন ও তোকে ওর ভাইয়ের বউ বানানোর জন্য তোরজোর শুরু করলো আমার তখনই এসব বলে দেওয়া উচিৎ ছিলো। তাহলে আজ আর তোকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো না।’

হুমায়রার প্রতিটা বাচ্য যেন তূবার গাত্রে তীরের ন্যায় আ’ঘা’ত হানলো।সমস্ত কায়া অসাড় হয়ে এলো। কাজল কালো আঁখি জোড়ায় ভিড় জমায় অশ্রুকণা । আর মর্মদেশে হচ্ছে অদৃশ্য র’ক্ত ক্ষরণ। সামান্য এই কারনে এতোগুলো বছর তাকে নীরবে আ’ঘা’ত করে গেছে তামান্না? সে তো আশিকের প্রপোজাল একসেপ্ট করেনি তাহলে? এভাবে নিজের ক্রোধানলের পাবকে তাকে একটু একটু ভস্ম করবে বলে নিজের ভাইয়ের বউ করেছে? আর কিছু ভাবতে পারছে না সে।গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।যদি একটু হালকা হওয়া যায়। নিষ্প্রাণ, নির্জীব আর অনুভূতিশূণ্য লোচনে চেয়ে রইলো হুমায়রার পানে।

সামনের দিকে তাকিয়ে হুমায়রা নিম্নস্বরে বলে,

‘স্বাভাবিক হয়ে নে। তামান্না আসছে।বুঝতে দিস না।’

দু’হাতে নিজের মুখ ঢাকল তূবা।ঢুক গিলে শুষ্ক, জলশূন্য গলাটা ভিজিয়ে নিলো। অপলক, অনিমেষ চোখে তাকিয়ে রইলো শূন্যে।

হাসিমুখে এসে বসল তামান্না। তারপর তূবার নিস্তেজ, ধীরূজ আনন পানে চেয়ে আঁতকে উঠল। ডরালু,ত্রস্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

‘কি হয়েছে তোর?’

এবার তূবা নেত্রপাত করল তামান্নার পানে। নির্জীব সেই চাহনি। মুখোশের আড়ালে থাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ।

‘তোর ভাইকে নিয়ে কথা হচ্ছিল।’ হুমায়রার মুখ নিঃসৃত নিগদ কর্ণগোচর হতেই মিইয়ে গেলো তামান্না। নতস্বরে বলে,

‘কি ভাবলি?’

‘ডিভোর্স।’ ভণিতা বিহীন, নিঃসঙ্কোচ বাচ্য তূবার। চকিত হয় তামান্না। তূবার মুখ থেকে এমন শুনবে কল্পনাতীত তার।

‘তুই কি বলছিস এসব?’

নেতিয়ে পড়া দেহটা চেয়ারে এলিয়ে দিলো। ধীরূজ চক্ষুদ্বয় বুঁজে বলল,

‘মা বলেছে, আমি যা সিদ্ধান্ত নিবো তা তিনি মেনে নিবেন। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি চরিত্রহীনা। আমার মেয়ে তোর ভাইয়ের মেয়ে না।তো আমার সাথে কেন তোর ভাই সংসার করবে? সংসার করা থেকে মাচ বেটার বিচ্ছেদ। তোর ভাই আর আমার সম্পর্ক শেষ। সেই সম্পর্কের সুতো আর টানবি না। তোর আর আমার মাঝে শুধু বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। আর কিছুই না। তোর ভাই আর আমার নামে মাত্র সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা হয়তো এইটুকুই ছিলো। বিচ্ছেদই তার শেষ গন্তব্য।’

‘ডিভোর্স’ নামক শব্দটা শোনার পরই সামনে বসা থাকা দুই নারীর অধর কোণে ফুটে উঠলো রহস্যময় হাসি। হয়তো সেই হাসির পিছনে লুকিয়ে আরো বড় রহস্য।

_______________________

লাঞ্চ টাইম! তনয়া নাযীফাহ’র সম্মুখে এসে দাঁড়ালো,

‘আজ তো তোমার বার্থডে। বোন হিসেবে আমার তরফ থেকে তোমাকে একটা ট্রিট দিবো। না করো না কিন্তু। বোন হিসেবে বলছি নট অফিস কলিগ।’

এই অমায়িক মানুষটার ভিন্নরকম আবদার ফেলতে পারলো না নাযীফাহ। বিভিন্নভাবে এই মানুষটা তাকে সাহায্য করেছে। অফিস ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই আবারও সেদিনের মতো পিয়ন এসে বলল, নাযীফাহ’র নামে একটা পার্সেল এসেছে।

হতবিহ্বল হয়ে যায় নাযীফাহ। সে তো কোনো অর্ডার করেনি তাহলে?

তনয়া টেনে নিয়ে যায় সেখানে। পার্সেল রিসিভ করে।র‌্যাপিং পেপার খুলতেই দেখল, সিঁদুর লাল রঙের পাড়ের একটা সাদা শাড়ি, দুই মুঠ লাল রেশমি চুড়ি, একটা আর্টিফিশিয়াল গাজরা। সাথে ভাঁজ একটা চিরকুট। তনয়া ইশারা করল চিরকুট পড়ার জন্য। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা তুলে নিলো নাযীফাহ।

‘হ্যাপি বার্থডে গর্জিয়াস লেডি। উইশ ইউ বি ভেরি হ্যাপি ইন এভরি টাইম এন্ড এভরি মোমেন্ট। ইউ আর দ্য কিউটেস্ট, প্রিটিয়েস্ট ওমেইন আই হেভ এভার সীন।

সাদা মানে স্নিগ্ধশীতল।আর লাল বি’পদ সংকেত। আপনাকে দেখলে আমার যেমন চক্ষু শীতল হয়, ঠিক তেমনি বক্ষপিঞ্জরে ঝড়ের পূর্বাভাস পাই আমি। প্রকান্ড ঝড়ে লন্ড ভন্ড হয়ে যায় আমার অন্তর্দেশ। এটা কি বি’পদ নয়? আমি তো আপনার চক্ষু জোড়ায় নিজের সর্বনাশ দেখি। একটু একটু করে আমার অস্তিত্বের বিলীন হচ্ছে। এটা বি’পদ নয় বলেন? কোনো একদিন আপনি এই শাড়ি পরিধান করে, দু’হাতে দুই মুঠ চুড়ি আর খোঁপায় গাজরা গেঁথে আমার সামনে এসে দাঁড়াবেন আর আমি আপনাকে দু’চোখ ভরে দেখবো। শরতের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়ায় পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা যখন দূর নীলিমায় ভেসে বেড়াবে, বায়ুর প্রকোপে শুভ্র কাশফুল যখন ঢেউ খেলবে তখন আমি আপনার আঙ্গুলের ভাঁজে আঙ্গুল গলিয়ে হাঁটবো। জীবনের অর্ধপূর্ণ খাতাটা পূর্ণ হবে সেদিন। মুখে থাকবে প্রাপ্তি আর পরিতৃপ্তির হাসি। সুখ নামক শব্দটায় ছেয়ে যাবে আমার চারপাশ। অস্তমিত সূর্যটা যখন পশ্চিমাকাশে লাল আভা ছড়াবে সেই সময় আমি যদি আপনার ললাটে আমার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ছুঁইয়ে দেই আপনি কি রাগ করবেন?’

চিরকুট পড়ে চমকিত, থমকিত নাযীফাহ। ঠিক কি কেমন প্রতিক্রিয়া জানাবে বুঝতে পারছে না। স্তম্ভিত, হতবিহ্বল, অবরুদ্ধ সে। তাকেও কেউ এভাবে ভালোবাসে, নিজের করে চায়? বিশ্বাস করতে পারছে না সে। নাকি ভুল করে অন্যকারোর উপহার তার কাছে চলে এসেছে?

‘বোঝাই যায় কোনো এক পা গ ল প্রেমিক। কি সুন্দর মনোবাসনা, চিন্তা করেছো একবার? সেই মানুষটাকে একেবারে নিজের করে পেলে তুমি ভাগ্যবতী।’ তনয়ার কথায় বিস্মিত চোখে তাকায় নাযীফাহ। আসলেই কি তাই?

___________________

‘তোরা তো জানিসই একটা সময় মিলন ভাই আমাকে খুব পছন্দ করতো। বাবা এসব প্রেম ভালোবাসা পছন্দ না বলে আমি সাড়া দেইনি। এখন ভাবছি উনার সাথে ডেটে যাবো। আমি তো চরিত্র খা’রা’পই তাই না?’

‘কি বলছিস তুই? উনি তো মনে হয় বিবাহিত।’

‘তো? আমিও তো বিবাহিত। একটা মেয়ে আছে আমার। উনার বউ বউয়ের জায়গায় আর আমি আমার জায়গায়। ডেটের কথা বউকে কে বলতে যায়?’

‘দেখ এসব কিন্তু ঠিক না।’

‘আমার জীবনটাই বেঠিক। সবকিছু ঠিকঠাক চললে রুম ডেটেও যাবো।’

‘ভেবে দেখ।’

‘গোপন শ’ত্রুর সামনে নিজের কুকীর্তির কথা বলতেও দম লাগে তাই নারে?’

অডিও ক্লিপ আর শুনলো না ফয়সাল। আর শুনতে ইচ্ছে হল না তার। বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে মোবাইলটা। নিজের চুল গুলো টেনে ধরে সে। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরুচ্ছে। রাগে সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। রাগে, ক্ষোভে, ক্রোধে চেহেরার আদল বদলে গেলো। বিছানা থেকে মোবাইল নিলো সে। কল করলো কোনো এক নাম্বারে। ওপাশ থেকে কল কেটে দিলো। একটা মেসেজ পাঠিয়ে পুনরায় কল দিলো সে। দুইবার রিং হওয়ার এবার কল রিসিভ হলো। তার অগ্নিঝরা কন্ঠনালী দিয়ে স্ফুরিত হলো,

‘তুমি যদি ভেবে থাকো এর সাথে ওর সাথে ডেটে আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো, ডিভোর্সের জন্য এগিয়ে আসবো তাহলে তুমি ভুল। আমি তোমাকে নিয়েই সংসার করবো। আমি তোমাকে ছাড়ছি না।আমার তোমাকেই লাগবে। তোমাকেই প্রয়োজন। নিজের মানুষকে নিজের কাছে রাখার ক্ষমতা ফয়সালের আছে।’

#চলবে

#দৃষ্টির_অলক্ষ্যে
#পর্বঃ১৩
#রূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)

‘সব ক্ষমতাই আছে। শুধু নেই সত্য মিথ্যা তফাৎ করার ক্ষমতা। তুমি শুধু জানো মানুষের কথা শুনে বিয়ে করা বউকে অবিশ্বাস করতে।’

দাঁত দাঁত পিষে ফয়সাল উচ্চারণ করলো,

‘তার খেসারতই তো দিচ্ছি। সত্য হউক আর মিথ্যা এতোকিছু শোনার পরও কখনো ভাবিনি ডিভোর্সের কথা। অথচ তুমি অকপটে ডিভোর্সের কথা ঠিকই বললে। তুমি যদি নিজেকে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম মানুষটাও প্রমাণ করো আমি তবুও তোমাকে ছাড়বোনা। দরকার হলে সারাজীবন দূরে দূরে থাকবো তারপরও না। ফয়সালের স্ত্রী হয়েই বাঁচতে হবে। বললাম না, সম্পর্কের পরিণতি শেষ পর্যায়ে গেলে বিধবার থান কিনে রাখবে।’

মেজাজ আসমান ছুঁলো তূবার। মাথায় র’ক্ত চড়ে গেছে। চোখমুখে দেখা দিলো কাঠিন্যভাব।

‘এই একটা কথা বার বার বলে কি বোঝাতে চাও?’

ওপাশ থেকে কোনো উত্তর পেলো না। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে তার। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বুঝতে পারলো ফয়সাল কল কে’টে দিয়েছে। মোবাইল স্ক্রিনের দিকে ক্রদ্ধভাবে তাকিয়ে রইলো সে।

জানালার পর্দা সরিয়ে তারা বিহীন আকাশ পানে চেয়ে রইলো তূবা। সবকিছু জানার পর বক্ষঃস্থলে আলোড়ন হচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। কাছের মানুষ গুলোই পিঠে ছু’ড়ি বসায়। প্রকাশ্য শ’ত্রু থেকে গোপন শ’ত্রু
ভয়ঙ্কর, বিপজ্জনক হয়।

গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন ফারিয়ার মুখে অকস্মাৎ বাবাই শব্দ শুনে তড়িৎ গতিতে মেয়ে শিয়রের কাছে এসে বসে তূবা। পরম যত্নে, পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ফারিয়া বিড়বিড় করে বাবাই, বাবাই করে যাচ্ছে। ঘুমন্ত, নিদ্রামগ্ন কন্যার আনন পানে চেয়ে রইলো অপলক, অনিমেষ। অতঃপর আপন মনে আওড়ালো,

‘ফয়সাল যদি জানে পা গ ল পা গ ল হয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসবে মেয়ের কাছে। ওর শাস্তি প্রাপ্য। আমাকে এতোগুলো বছর নিদারুণ যন্ত্রণা দেওয়ার ফল এবার ও ভোগ করবে।’

ভাবনার মাঝে আবারও মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে আননোন নাম্বার ভাসতে দেখে কপাল কুঁচকায় সে। রিসিভ করে কানে ধরতেই শ্রবণগোচর হলো হুয়ায়রার কন্ঠস্বর,

‘কি করছিস?

আলতো হাসলো তূবা।

‘মেয়েকে ঘুম পাড়াই।’

হুমায়রা আমতা আমতা করল,

‘তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারিসনি? আমার মনে হয়েছে তোকে বলার দরকার আমি বলেছি। একটা ব্যপার তুই ডিপলি ভেবে দেখ, তোকে ফয়সাল ভাই এর অফিসে কে যেতে বলেছিল? আর সেদিনই ব্যপারটা ঘটলো। এগুলো প্রি-প্ল্যানড না? তোর সাথে লোকটা কে ছিলো? ওখানেই বা কেন গিয়েছিলি?’

লম্বা একটা শ্বাস ফেলে তূবা। হতাশার সুর টানে সে।

‘আমাদের গ্রুপের মেহেদী। বিয়ের পর তো কারো সাথে যোগাযোগ হয়না। সেদিন অফিস থেকে বেরুনোর পর যখন রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন ওর সাথে দেখা। ও হোটেল ওয়াশিংটন লি. কর্মরত আছে। ওর কর্মস্থল দেখানোর জন্য জোর করে নিয়ে যায়। সেটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।অবশ্য ভালোই হয়েছে এতো বছর ধরে আমার মনে জমে থাকা হাজারো প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি। যদি এই কথা গুলো কখনো ওর কানে যায় ওর মনের অবস্থা কি হবে? সব সময় ছেলেটা আমাদেরকে নিজের বোন মনে করেছে আর আজ?’

‘তুই সত্যি ডিভোর্স দিবি?’

তূবা দুর্বোধ্য হাসলো। মেয়ের পাশে শুয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নিলো। ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে ধীর গলায় বলে,

‘হুম।’

__________________

দিন গড়াতে গড়াতে মাসের কৌঠায় পৌছাঁলো। নাযীফাহ’র চাকরি কনফার্মড হয়েছে মাঝে মাঝে পাঠানো গিফটের মালিক কে সে আজও চিনতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে মুঠোফোনে পাঠানো আবেগময়ী বার্তায় দূর্বল হয়ে পড়ছে সে। মানুষটাকে তার দেখতে বড্ড ইচ্ছে করে। যে মানুষ এতো সুন্দর করে মনের সকল বাসনা কলমের কালিতে ফুটিয়ে তুলতে সে মানুষটার মনমানসিকতা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর? বার্তা পাঠানোর সাথে সাথে সে সেই নাম্বারে কল দেয় কিন্তু মোবাইল বন্ধ। মনে মনে পণ করেছিলো ছোট ছোট উপহার গুলো আর সে গ্রহন করবে না। কিন্তু ডেলিভারি বয় আসার সাথে সাথে তার মন আকুপাকু করে কি আছে দেখার। সে কি আড়ালে থাকা মানুষটার প্রেমে পড়ে গেলো? না দেখেও কাউকে ভালোবাসা যায়?

সময় গড়ানোর সাথে সাথে সব পাল্টে গেলেও নিজের মতামত থেকে তূবাকে কেউ টলাতে পারেনি। সেদিনের পর রাশেদা খাতুন ফোন করেছিল। অসহায় আর বিষন্ন স্বরে প্রশ্ন করেছিলেন?

‘তুই সত্যি এই সম্পর্কটা শেষ করে দিবি?’

অপ্রত্যাশিতভাবে শ্বাশুড়ির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে থমকে যায় তূবা। নিদারুণ যন্ত্রণায় বক্ষঃস্থল মোচড় দিয়ে উঠে। গলা কাঁপতে শুরু করে। শুকিয়ে যাওয়া কন্ঠনালী ঢুক গিলে ভিজিয়ে নিলো সে।নত স্বরে জবাব দিলো,

‘জ্বি।’

তূবার উত্তর শুনে নিজের কর্ণে কিয়ৎকাল মোবাইল চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন। অতঃপর ঠাস করে মোবাইল কে’টে দিলেন। শ্বাশুড়ির রোদনের নিনাদ কর্ণগোচর হতেই মনটা বিষিয়ে গেলো তার। সে এমনটা তো চায়নি। তারপরও কেন এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো তাকে। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল সে।

হাজার বার এই বাড়িতে এসেছে ফয়সাল। উসকোখুসকো চুল, চোখের নিচে কালি, সুঠাম আর বলিষ্ঠ দেহ জরাজীর্ণ হয়ে যাওয়া দেখে মনোয়ারা বেগমও মেয়েকে বলেছিলেন,

‘একটা সময় আমিও বলেছিলাম ফিরে আয়।করতে হবে না সংসার। এখন এই আমি বলছি ফিরে যা তুই। এভাবে চলতে থাকলে ছেলেটা ম’রে যাবে। তুই কি ফয়সালের পরিবর্তনটা দেখতে পাচ্ছিস না? আমি তো শ্বাশুড়ি আমারই যদি এমন লাগে না জানি ওর মায়ের কেমন লাগে রোজ ছেলেকে এমন অবস্থায় দেখতে। ফিরে যা মা। এভাবে আর জেদ ধরে থাকিস না। যা হয়েছে ভুলে যা। ছেলেটাকে এভাবে দেখলে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে।

‘তুই তো বলেছিলি, ফয়সাল ভাই তোকে ভালোবাসে।আমরা না দেখলেও তুই বুঝিস।তাহলে আজ কেন এমন করছিস?’

মা আর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো তূবা।

‘আমরা যন্ত্রণা কেউ দেখেনি মা। ওরটা সবাই দেখছে। আমি গুমরে গুমরে ম’রে’ছি রোজ। ও প্রকাশ করছে আমি করতে পারেনি। তাই এতো মায়া হচ্ছে তোমার। আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।’

বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। আচমকা তার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চেয়ার ধরে তড়িৎ গতিতে। মনোয়ারা বেগম তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে আসলেন। দূর্বল গলায় তূবা বলল,

‘মা, নিশ্চয়ই প্রেসার ফল করেছে। আমাকে তাড়াতাড়ি স্যালাইন গুলে দাও। ইদানিং বড্ড ক্লান্ত লাগে আমার।’

____________________

মাঝরাস্তায় এসে গাড়ি থেমে গেলো তাহমিদের।ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতেই বলল টায়ার পাংচার। ঘড়ির দিকে তাকালো এক পলক। অফিস টাইম শুরু হওয়ার বেশি সময় নেই।গাড়ি থেকে নেমে বাসের জন্য দাঁড়াল সে। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর বাস এলো। চট করে উঠে পড়লো বাসে। কিন্তু বাসে উঠার পর বুঝতে পারলো বড় ভুল করে ফেলেছে এতো ভিড়। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকাতেই নজরে নাযীফাহ’র চেহেরা। চোখেমুখে কেমন বিরক্তি ভাব জেঁকে বসেছে। বার বার পিছনের দিকে তাকাচ্ছে । নাযীফাহ এখনো তাকে খেয়াল করেনি। আরো অনেক পুরুষ মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। চোখমুখ কুঁচকে আবারও পিছনের দিকে ফিরলো সে। আশানুরূপ কিছু না দেখে সামনের দিকে তাকালো। তাহমিদের চোখে চোখ পড়ে। হঠাৎ করে তাহমিদ কে দেখেই যেন তার চক্ষু জোড়ায় একরাশ অসহায়ত্ব ভর করে। এবার আর বুঝতে বাকি রইলো না কি হচ্ছে। তাহমিদ ঠেলে পিছনের দিকে যেতে লাগল। মেজাজ গরম হয়ে গেছে তার। আশেপাশের মানুষ চড়া গলায় বলছে,

‘আরে মিয়া ঠেলে কই যান? পিছনে জায়গা আছে নাকি?’

কোনো জবাব না দিয়ে তাহমিদ সোজা গিয়ে নাযীফাহ’র হাত ধরে। আঁতকে ওঠে নাযীফাহ।

‘বাস থামান। একেবারে সাইডে রাখবেন।’

‘এটা স্টপেজ নাকি? আপনার কথা মতো বাস থামবে?’

‘আমি বাস থামানোর কথা বলাতে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন আর একটা মেয়েকে যে জা নো য়া র গুলো ভিড়ের অযুহাতে হ্যারেস করছে দেখতে পাচ্ছেন না? এই বাস থামাইতে বলছি না? যে ওকে বাজে ভাবে স্পর্শ করেছো নিজের মা অথবা বোনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো এভাবে স্পর্শ করলে ঠিক কতটা মজা পায়।’

আর কোনো কথা বললো না কেউ।

‘পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নিজেকে প্রটেক্ট করতে না পারলে উঠেন কেন? স্পর্শ করার সাথে সাথে ঠাসিয়ে চ’ড় দিতে পারলেন না? ঢাকা শহরে চলতে হলে এভাবে সাহস নিয়ে চলতে হয়। নামুন গাড়ি থেকে। আর এই যে আপনাকে বলছি, বাসে জায়গা না থাকলে মহিলাদের বাসে উঠান কেন? এসব বাজে ছোঁয়ায় মেয়েরা ঠিক কতটা মানসিক ভাবে আ’ঘা’ত প্রাপ্ত হয় জানেন?’

বাস থেকে নেমে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো নাযীফাহ। তাহমিদের ভীষণ রাগ হচ্ছে। মেয়েটা আগেই প্রতিবাদ কেন করলো না? রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,

‘পানি হবে?’

পানির বোতলটা বের করে দিতেই ঢকঢক করে পানি খেয়ে পুনশ্চ জিজ্ঞেস করলো,

‘এমন বাজ পরিস্থিতি কি রোজ হয়?’

‘মাঝে মাঝে হয়। সব সময় তো ভিড় হয় না।’

‘প্রতিবাদ করতে পারেন না?’

বিষন্ন হাসলো নাযীফাহ।

‘করেছিলাম একবার। উল্টো আমাকেই সবাই এটাসেটা বলেছে। এতো খুঁত খুঁতে হলে বাসে চড়ি কেন? বাবাকে কেন প্রাইভেট কার কিনে দিতে বলি না কেন হেনতেন। মেয়েদের পুরুষরা ভোগ্য পন্য মনে করে।’

‘আপনি আর বাসে চড়বেন না। প্রয়োজন হলে অফিসের কাছাকাছি বাসা নিবেন।’

আপন মনে বিড়বিড় করলো,

‘আপনাকে অন্য কোনো পুরুষ ছুঁয়ে দিলে আমার সহ্য হবে না। তূবার ঝামেলাটা শেষ হউক আপনাকে একেবারে নিজের করে নিবো। পাঁচ বছর আগে থেকে তো একটা সফট কর্নার ছিলোই, আর এখন? রোজ আপনাকে চোখের সামনে দেখে পুরোপুরি এডিক্টেড আমি। এই নে শা কখনো কা’ ট ‘বে না।’

____________________________

‘আমায় ডেকেছিলে?’

যুবকের কথায় ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় মানুষটা। বাঁকা হেসে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় তার দিকে। কাগজটায় একবার নজর বুলিয়ে বলল,

‘ কি দরকার আর এসব করার? এলাকার সবাই এখন ওকে খারাপ জানে। মেয়েটা লজ্জায় গ্রামে আসে না। এবারও তুমি তার সম্মান নিয়ে টানাটানি করবে? মেয়েটার চোখের পানির প্রতি ফোঁটার মূল্য তোমাকে চুকাতে হবে। প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে৷ তোমার পাপকর্ম গুলো যখন ফল হয়ে আসবে সহ্য করতে পারবে তো?’

‘আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। যে কাজ করতে দিয়েছি সেটা কর। আর ঠিকঠাক ভাবে না হলে তার ফল ভোগ করবে তোর মা?’

রাগান্বিত চোখে দাঁত কিড়মিড় করে সেখান থেকে প্রস্থান করলো যুবক।

‘কাউকে সুখী হতে দিবো না। আমার জীবনে সুখ নেই তো তোদের জীবনেও নেই।’

_______________

নতজানু হয়ে বসে আছে ফয়সাল। কুঁচকানো শার্ট, এলোমেলো চুল, চোখের নিচে কালো দাগ।

মনোয়ারা বেগম অসহায় ভঙ্গিতে চেয়ে রইলেন জামাতার দিকে। শ্বাশুড়ির দিকে তাকালো ফয়সাল। ধরা গলায় বলল,

‘একটু এখানে আসার জন্য বলুন না তূবাকে। আমি একটা নজর দেখেই চলে যাবো।’

‘বলেছি তো, মেয়েটা কি যে করে কিছুই বুঝতেছি না।’

কিয়ৎকাল বাদে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয় তূবা। হাত ভাঁজ করে বলে,

‘ফারিয়ার জন্মদিনে ইতি ঘটবে সবকিছুর। তোমার পথ আলাদা আর আমার পথ আলাদা।’

#চলবে

বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।