দোটানা ২ পর্ব-২৪

0
449

#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_২৪

আরুশি আয়ান সায়ান দুজনের সাথেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে,এদিকে দুই ভাইয়ের শান্তি উড়াল দিয়েছে।প্রথমতো আরুশির বলা কঢ়া কথাগুলো আর দ্বিতীয়ত আরুশির ওদের সাথে আর কথাই না বলা দুজনেরই নিশ্বাস নেওয়া যেনো মুশকিল করে দিয়েছে।আরুশি ওদের দিকে তাকাচ্ছেও না।দুজন অনেকবার আরুশির সাথে কথা বলতে চাইলেও আরুশি কথা বলে নি।দুজনের নাওয়া খাওয়া হলো বন্ধ এতে।ভিতরে নেই শান্তির একটু ছোঁয়া,আরুশি আজ অফিস যায় নি,তাই আয়ানও যায় নি,এই প্রথম বিনা কারনে অফিস বাদ দিয়েছে আয়ান নয়তো বিনা কারনে অফিসেই বসে থাকা তার কাজ,সেই আয়ান আজ কাজ কর্ম ফেলে আছে আরুশির ধ্যানে,নতুন জব নিয়ে অনেক সিরিয়াস হলেও আজকে সায়ানেরও সে সিরিয়াসনেস হালকা হয়ে গেছে আরুশির চিন্তায়।মন দুজনেরই খা খা করছে।দুজনকে বাড়িতে দেখে আরুশি রুম থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।অবশেষে আরুশির দূরত্ব আর সহ্য করতে না পেরে দুজনই ওর রুমের দিকে এগুলো,দুজন দুদিক থেকে এগিয়ে এলে একে ওপরের উপর দৃষ্টি গেলো।দুজন ওকে অন্যের মতলব বুঝতে সক্ষম হলো।

এই সায়ান আরুশির রাগ ভাঙাতে যাচ্ছে আমি শিওর।

এই আয়ানকে আমার আগে আরুশির রাগ আমি ভাঙাতে দিবো না।

অতঃপর দুজন ছোটতে শুরু করলে আয়ান সায়ানের একটু আগে এসেই আরুশির রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো,সায়ান একটুর জন্য বাইরে রয়ে যাওয়ায় সিট বলে উঠলো।আয়ান হুট করে রুমে ঢোকায় চমকে উঠলো আরুশি।ও বিছানায় আধশোয়া হয়ে পায়ে পা তুলে টিভি দেখছিলো আর চিপস খাচ্ছিলো,আয়ান হুট করে ঢোকলে চমকে উঠা থেকে আরুশির হাতের নাড়ায় অনেকটা চিপস পরে গেলো আশেপাশে।আরুশি বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

আপনি এখানে কি করছেন?

তুমি রাগ করে আছো কেনো?কথা কেনো বলছো না আমার সাথে?

আমি বলি নি? আমি আপনাদের দুই ভাইয়ের কারো সাথেই কথা বলবো না।

দেখো আমি তো সায়ানের মতো না।

ওর থেকে কমও না আপনি।

আমি ওর মতো কি করলাম? আমি তো যথেষ্ট শান্তশিষ্ট আর আমার কেরেক্টারেও কোনো গন্ডগোল নেই।ওয়েট ওয়েট তুমি আমাকে নিয়ে ডাউট করছো না তো!যে ওই দিন ওই মেয়ের সাথে আমার কিছু হয়েছিলো কি না?তেমন কিছুই হয় নি আরুশি সেদিন।বিশ্বাস করো,আমি এরপর নিজের মেডিক্যাল চেকআপ করাই যে সেদিন আদোও কিছু হয়েছিলো কি না তখন জানতে পারি এমন কিছুই হয় নি আই এম স্টিল ভার্জিন,তুমি বিশ্বাস না করলে আমি এখনই রিপোর্ট দেখাবো তোমাকে,রিপোর্টগুলো আমার কাছে এখনও আছে।আর একটা ছেলের অজ্ঞান অবস্থায় এমনটা কেমনে হতে পারে তুমি বলো?

স্টপ ইট, এসব কি বলছেন আপনি!যত্তোসব। আপনি আমায় এসব আমায় কেনো বলছেন?ডিজগাস্টিং।

সরি,আমি ভাবলাম তুমি আমাকে সায়ানের মতো মনে করে রাগ করেছো।

আপনার কোনো মেয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক থাকলে বা কিছু হলে আমার কি? আমি কেনো রাগ করবো তা নিয়ে?

সত্যিই আমার কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্ক থাকলে তোমার খারাপ লাগবে না?

একদম না।

কথাটা শুনে আয়ানের মন ব্যাথীত হলো।নিজেকে সামলে আবার বললো।

তবে রাগ কেনো করেছো?

কা…..

আরুশি কারন বলতে যাবে তখনি সায়ান দরজায় ডাকতে শুরু করে,এতোসময় বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো কিন্তু একটু সময় গেলে তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলো।

আরুশি,আরুশি কি করছো?ওই আয়ান তোমার সাথে কোনোরকম জোরজবরদস্তি করছে না তো?তুমি ভয় পেয়ো না আমি আছি,তুমি দরজা খুলো আজ ওকে আমি দেখাবো সায়ান কি জিনিস।

তখনি আরুশি স্বাভাবিক ভাবে দরজা খুললো।

আসেন আপনারই কমতি ছিলো,এই তো জনাব আয়ানও আছেন,শুরু করেন দুজন দেখি কার গায়ে কতো জোর।

আয়ান সায়ান একে অপরের দিকে তাকালো কিন্তু কোনো কথা বললো না ঝটপট চোখ সরিয়ে ফেললো।এবার আরুশি বললো।

আপনারা দুজন কখনোই শুধরাবেন না আমি জানি,এখন তো প্রায়ই আপনারা দুজনের ঝগড়ার কারন আমি হই,তাই আমি ডিসিশন নিয়েছি আমি আপনাদের পাশেও থাকবো না কথাও বলবো না আপনাদের সাথে এটাই ভালো হবে।কারন আমি দুই ভাইয়ের লড়াইয়ের কারন হতে চাই না।

লড়াই তো আমি শুরু করি না।ওই আয়ান করে।

হুম তুই তো ভাজা মাছ কাকে বলে তাও জানিস না।

আর তুই তো……

স্টপ ইট,আবারও শুরু করেছেন দুজন!যান আমার রুম থেকে বেরিয়ে ঝগড়া করুন।আমাকে শান্তিতে থাকতে দিন।

সরি আরুশি। দুজনই একসাথে বলে উঠলো।

দেখেন এসব সরি দিয়ে আমার কোনো কাজ নেই।

আমি সত্যিই অনুতপ্ত আরুশি।আয়ান বললো।

আমিও অনুতপ্ত আরুশি।বললো সায়ান।

অনুতপ্ত হয়ে হবে কি?শুধরাবেন তো না দুজন।ঝগড়া তো আর বাদ দিবেন না আমাকে নিয়ে।

চেষ্টা করবো।আবারও সায়ান বললো।

আমিও।আয়ান বললো।

সত্যি।

হুম…. বললো দুজনই।

ওকে দুজন চলেন আমার সাথে কথাটা বলে আরুশি দুজনের দুই হাত ধরে নিচের দিকে নিয়ে যায়,দুজনও তার সাথে যায়,নিচে গিয়ে সবাইকে ডেকে আনে সেখানে আরুশি তারপর বলতে শুরু করে।

উনারা দুজন বলেছেন আজ থেকে ঝগড়া না করার চেষ্টা করবেন।তাই আমি চাই সুন্দর একটা সম্পর্কের শুরু উনাদের কোলাকুলি দিয়ে হোক।সো দুজন কোলাকুলি করেন আর বলেন যে আজ থেকে কখনো ঝগড়া করবেন না দুজন।একে ওপরকে সরি বলেন।

কোলাকুলি তো আমরা দুজন ঈদেও কখনো করি নি তবে আজ কিভাবে করবো।মিন মিন করে বললো আয়ান।

কি হলো দুজন কোলাকুলি করেন।

ধুর আরুশি আর মানুষ পেলো কোলাকুলি করানোর জন্য।ধিমি স্বরে বললো সায়ান।

তারপর দুজন এগিয়ে গিয়ে একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে না চাইতেও।সবার চোখ বড় আকার ধারন করেছে অবাকত্বে।দুই প্রাণের দুশমন কোলাকুলি করছে ভাবাও দুষ্কর। আরুশি বললো।এবার সরি বলেন একে ওপরকে।

সায়ান বড় করে বললো সরি আর আস্তে করে আয়ানের কান বরাবর বললো ইউ ব্লা/ডি আয়ান ছাড়বোনা তোকে আমাকে সরি বলাস।

সরি কথাটা জোরে বলে আয়ানও আস্তে করে সায়ানের কানে বললো।

তুই কি মনে করেছিস ফালতু সায়ান আমি তোকে ছেড়ে দিবো?সরি কাকে বলে তা যদি তোকে না শিখেয়েছি তবে আমিও আয়ান না।কথাটা বলে আয়ান সায়ানের হাত খামছে ধরলো সবার অগোচরে, সায়ানও আয়ানের হাত খামছে ধরলো সমতালে।মুহুর্তটা আর কারো চোখে না গেলেও নিধীর চোখে ঠিকই গেলো।

যাহ,ভেবেছিলাম আরুশির চক্করে হয়তো দুজন অবশেষে শুধরে গেলো,কিন্তু না এটা হয়তো কখনো হবার নয়,আমার তো আরও ভয় করছে এদের মধ্যে না আবার বেচারি আমার মেয়েটা ফেঁসে যায়।এই দুজনের মধ্যে আমি নিহান নিরবের কান্ডের আভাস পাচ্ছি। আরুশি না আবার দোটানায় পরে।

আয়ান বাবা মায়েদের কাছে একটা প্রস্তাব রেখেছে আরুশিকে নিয়ে,তবে প্রস্তাবটা সবারই ভালো লেগেছে কারন উনারাও তাই ভাবছিলেন।

নিধীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে আরুশি আর নিধী ওর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। তখনি রুমে প্রবেশ করলো নিহান,আরুশির জন্য অনেকগুলো চকলেট নিয়ে আসলো। আরুশি অনেক খুশি হয়ে চকলেটগুলো নিয়ে বাচ্চাদের মতো ওগুলা খেতে শুরু করলো।নিহান নিধী দুজনই হাসলো এতে,আরুশি যেনো ঠিক একদম ওদের আরুশিরই প্রতিচ্ছবি।আরুশিও চকলেট পেলে অনেক খুশি হতো।নিহান আরুশির মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো হেসে বললো।

পাগলি মেয়ে আমার।

মা আরুশি তুমি এখন আমাদের মেয়ে।তোমার সাথে আমাদের পরিচয় আছে।আর আমরা কখনো চাই না আমাদের মেয়ে আমাদেরই অফিসে পিয়নের জব করুক।আমরা চাইছি আয়ানের সাথে তুমি আমাদের কোম্পানির দেখাশোনা করো।আয়ান নিজেই প্রস্তাবটা রেখেছে।

হুম ভালো।কিন্তু বাবা আমার কাছে কোনো পদ ছোট বড় কোনো আসে যায় না,যোগ্যতাই আসল । তাই পিয়নের পোস্টে আমার কোনো সমস্যা নেই।আর এসব বিজনেস নিয়ে আমার কৌতুহল একদমই নেই।এসব ভালো লাগে না আমার।আমি তো শুধু জীবিকার তাগিদে চাকরি নিয়েছিলাম নয়তো কখনো চাকরি করার কোনো আগ্রহ ছিলো না আমার।প্লিজ বাবা এটা নিয়ে জোরাজুরি করো না আমায়।আমি ঘরে থাকতে চাই সবসময় তোমাদের সাথে।জীবন উপভোগ করতে চাই।এসব কাজের পাল্লায় পরে কি লাভ বলো আমার?আমি তো পিয়নের জবটাও ছেড়ে দিবো।

হ্যাঁ নিহান মেয়েটা আমার ঠিক বলেছে।আমার মেয়ে এসব কাজ করে কি করবে।জীবন একটাই ওকে উপভোগ করতে দাও।ও যথেষ্ট যোগ্য কখনো প্রয়োজন পরলে নিজেরটা নিজে সামলে নিতে পারবে।কিন্তু এখন ওর এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।ও যখন আমাদের সাথে সমসময় থাকতে চায় তবে তাই হবে।

কিন্তু…..

কোনো কিন্তু না।নিধী আরুশি দুজনই একসাথে বললো।

ওকে তবে মা মেয়ের কথাই রাখলাম অবশেষে। হেসে বললো নিহান।

আজ নিহান নিধী আর কথা নিরবের ২৭ তম বিবাহবার্ষিকী। বাড়িতে হরেক রকম লাইটিং আর ফুলের সাজসজ্জা শোভা পেয়েছে।সব ধরনের সাজগোজের দিকটা আরুশিই দেখেছে।মেহমান সব চলে আসতে শুরু করেছেন।এদিকে আরুশি দুই মা কে নিজের সাথে করে নিয়ে গেলো আর তারপর দুজনকে নিজের হাতে সাজালো।আজকের থীম নীল।মানে সবাই নীল রঙের কাপড় পরবে। আরুশির মতামতে সবাই সায় মেলালো।এদিকে আমাদের আয়ান সায়ান দুজনই আরুশির জন্য শাড়ি কিনেছে নীল রঙের।এখন সমস্যা হলো দুজনই একই ধরনের ও দেখতে হুবহু একই নীল রঙের দুটো শাড়ি এনে ওর রুমে রেখে দিয়েছে।যেহেতু দুজনের পছন্দ এক তাই এমন ভুল হওয়া ওদের ক্ষেত্রে বড় কিছু না।আরুশি মায়েদের সাজিয়ে ওদের নিধীর রুমে বসিয়ে নিজে রেডি হতে রুমে গেলো আর যাওয়ার আগে বলে গেলো মায়েরা যেনো ওর বাবাদের সামনে না যায় ও নিজে যতোক্ষণ না উনাদের বাবাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে।বাবাদেরও আরুশি মানা করে এলো বিষয়টা,দুজনই হাসলো আরুশির এমন কান্ড দেখে।কিন্তু রুমে গিয়ে আরুশি পরলো দোটানায়।ওর টেবিলের উপর একটা বক্স রাখা উপরে আয়ান লেখা।অপরপাশের বিছানার একপাশে এইক ধরনের আর একটা বক্স রাখা ওটার উপরে সায়ান লেখা।আরুশি কিছু বুঝতে পারলো না।কিন্তু এইটুকু বুঝলো আয়ান সায়ান বাক্স দুটিতে ওর জন্য কিছু রেখে গেছে।আর নিশ্চয়ই একে অন্যের বাক্স দেখে নি নইলে এখানে হয়তো একটা বাক্স থাকতো আর নইলে একটাও না,দুজন একে ওপরের টা নষ্ট করতে চাইতো।আরুশি দুজনের বাক্স খুলে হতবাক,এই ধরনের দুইটা শাড়ি।তাও দুইটাতে দুইটা চিরকুট।দুইটাতেই একই জিনিস লিখা।

শাড়িটা আজ তুমি পরলে অনেক খুশি হবো।

আরুশি দুই শাড়ি দুই হাতে নিয়ে আয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে রইলো।

একই ধরনের দুইটা শাড়ি,একই সময়ে একইসাথে কিভাবে পরতে পারে একজন।এ কেমন দোটানায় পরলো বেচারি আরুশি ভেবেই হতভম্ব হচ্ছে।

চলবে………