দোটানা ২ পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
1040

#দোটানা ২
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_৩৩(শেষ পর্ব)

বিয়ের পরদিন বিকেলে সায়ান রুমে ঢুকেই সায়শাকে ফুঁপিয়ে কান্না করতে দেখে বিচলিত হয়ে ওর পাশে গিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো।

কি হয়েছে সায়শা?

আমি আপনাদের ধোঁকা দিয়েছি।

ধোঁকা দিয়েছো মানে!

আসলে বাবা মারা যাওয়ার দু’মাস আগে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিলো,শোয়েবের সাথে ভালোই সংসার চলছিলো আমার।কিন্তু বিয়ের ৬ মাস পর হঠাৎ একদিন শোয়েব অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসে আর আমাকে ঘর থেকে মেরে বের করে দেয়।শোয়েব আমার সাথে ধোঁকাবাজি করে আমাকে দিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করায় আমার তা জানাই ছিলো না,আমাকে ডিবোর্স দেওয়ার কয়েকদিন পূর্বে আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে আমার সব প্রোপার্টি আমার সৎ মায়ের নামে করে নেয়।আসলে ও আমার সৎ মায়ের আপন বোনের ছেলে ছিলো,মারা যাওয়ার আগে বাবা বেশ অর্ধেকটা সম্পত্তি আমার নামে করে দিয়ে যান,মা ভালো করেই জানতো বাবা অতি শিগ্রই মারা যাবে কারন ডাক্তারেরা আশা ছেড়ে দিয়েছিলো তাই বাবাকে কি না কি বুঝিয়ে হুটহাট করে নিজের বোনের ছেলের সাথে আমার বিয়ে দেয়।উনার আসল উদ্দেশ্য ছিলো বাবার আমাকে দিয়ে দেওয়া সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়া,তার ২৫% শোয়েবকে দিবে তাই শোয়েব এমনটা করেছিলো।অতঃপর আমি আবার বাড়ি ফিরে আসি।মা আমাকে রাখতে চান নি তবুও আমি কাজের লোকের মতো সেই বাড়িতে পরে থাকতাম কারন আমার যাওয়ার আর কোনো জায়গা ছিলো না তাই বাবার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বাকি জীবন পার করতে চাইছিলাম।আমি ভেবেছি বিষয়টা হয়তো আশেপাশের লোকজন আপনার পরিবারকে জানিয়েছে,কারন উনারা বলেছিলেন উনারা না কি আমার বিষয়ে সবকিছু আশপাশ থেকে জেনে গেছেন,কিন্তু একটু আগে আরুশি আপুর সাথে দু-চারটে কথা হলে বুঝতে সক্ষম হলাম উনারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না।আমি আরুশি আপুকে সব বলেছি,আরুশি আপু এতে নারায হন নি কিন্তু এটা তো ধোঁকা, বাকি সবাই কি মেনে নিবে তা?আর আপনি কি আমায় মেনে নিবেন?দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিবেন না,আমি আপনার ঘরে আপনার চাকরানী হয়ে পরে থাকবো আপনার পায়ের নিচে একটু জায়গা করে দিয়েন আমার,প্লিজ আমায় বার করবেন না।আমি আসল সত্য আগে জানলে কখনো এখানে আসতাম না কিন্তু এখন তো বিয়ে হয়ে গেছে।আমি আপনার পায়ে পরছি।

কথাগুলো বলে সায়শা সায়ানের পায়ে পরতে গেলে ওকে টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো সায়ান,সায়শা হেঁচকি টেনে কাঁদতে লাগলো সজোড়ে সায়ানকে আঁকড়ে ধরে, সায়ান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।

তুমি কি করে ভাবলে আমি তোমাকে বের করে দেবো! এখানে তো তোমার কোনো দোষ নেই,তুমি তো পীরিত, অবহেলিত,অসহায় একজন।তোমার অবস্থা সম্পর্কে জানার পর তো আমার মনে তোমার জন্য সম্মান আরও বেড়ে গেলো,কি করে কেউ পারে এতো কিছু সয়ে যেতে?হয়তো আল্লাহ নারীকে এক অদম্য শক্তি উপহারে দেন সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার মতো।তুমি আর কখনো এসব নিয়ে মন ছোটো করবে না।আরুশি যেমন বিষয়টা শুনে উল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া করে নি আমার ঘরের কেউ এমনটা করবে না।চৌধুরী বাড়ির লোকজন কেমন তা তুমি ওদের সাথে থেকে বুঝে যাবে।আর আমারও এ বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই।

কিন্তু আপনি যে আমার জীবনের প্রথম পুরুষ না।

তবে কি হয়েছে? তুমিও তো আমার জীবনের প্রথম নারী নও,বরং তোমার আগে আমার জীবনে কতো নারী এসেছে তা আমার নিজেরও হিসেব নেই,তোমার সাথে যা হয়েছে এসবে তো তোমার কোনো হাত ছিলো না।কিন্তু আমি যাই করেছি সব তো ভেবেচিন্তে, স্বজ্ঞানে করেছি।তবে তুমি আমার টা হাসিমুখে মেনে নিলে আমি কেনো তোমার সত্য মেনে নিবো না বলো।হয়তো আমরা দুজন একে ওপরের জীবনে প্রথম স্থানে ছিলাম না তবে আমাদের জীবনের শেষাংশে আমরা দুজনই না হয় থেকে যাবো।

সায়শাকে বুক থেকে উঠিয়ে ওর চোখের জল মুছে আলতো হেসে বললো সায়ান কথাগুলো।অতি সুখে এবার আরও দুফোঁটা জল গড়ালো সায়শার চোখ দিয়ে।নিজেকে আজ অনেক ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে সায়ানের মতো কারো স্ত্রী হতে পেরে।

দেখতে দেখতে কাটলো আরও চার মাস।আয়ান সায়ানের মধ্যে এখন আর আগের মতো ঝগড়া হয় না।বরং সায়ানও অফিস জয়েন করেছে আর দুজন মিলেই এখন ওদের অফিস সামলাচ্ছে।

আজ শুক্রবার আয়ান সায়ান বাগানের দোলনায় বসে কিসব যেনো কাজ করছিলো ল্যাপ্টপে আর টুক টাক কথাও বলছিলো দুজন।সায়ান ফাজলামো করে বললো।

কি রে আয়ান,বিয়ের তো আড়াই বছর হতে চললো তোর,এমন তো নয় এখনও ভার্জিন রয়ে গেছিস।তবে বাপ কেনো হচ্ছিস না?না কি কোনো সমস্যা আছে তোর?বল?

ফালতু সায়ান শুধু শুধু মার খাওয়ার ব্যবস্থা কেনো করছিস?তোর কি মনে হয় আয়ান চৌধুরীর কোনো সমস্যা থাকতে পারে?ওই তো তোর চক্করে বাচ্চা নেই নি আমরা।

আমি কি তোদের বলেছি যে বাচ্চা নিস না।

না তা বলিস নি তবে জানিস তো আমরা স্বামী স্ত্রীর মন কতোটা বড়।মজার ছলে আয়ানও কথাটা বললো।

ফালতু মন বড় তোদের,দুইটাই ইমোশনাল ফুল,তোর জায়গায় হলে এতোদিনে ৬ বাচ্চার বাবা হয়ে যেতাম।

ভাবিস না এতো।তোকে সেটেল করে দেয়ার পরই আমাদের বাচ্চার প্লেনিং শুরু হয়ে গেছিলো,খুব জলদি চাচ্চু হওয়ার খবরটাও শুনতে পাবি দেখে নিস।

কথাটা বলতে না বলতে একজন কাজের লোক একটা খাম নিয়ে আয়ানের সামনে এলো।

আয়ান সাহেব একজন লোক এসে এটা দিয়ে গেলো বললো আপনাকে দিতে।

খামটা হাতে নিলো আয়ান,হাসপাতাল থেকে এসেছে।

কি হয়েছে আয়ান?

আরে গতকাল আরুশি আমাকে নিয়ে হঠাৎ ডাক্তারে গিয়ে কি জানি টেস্ট করালো বললো না আমায় কিছু,রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়ায় আনতেও চাইলো না বললো আমার নামে পাঠিয়ে দিতে।কাল থেকে টেনশনে আছি ওর না জানি কি হয়েছে।বললো না আমায় কিছু,ডাক্তারকেও মানা করলো বলতে।বললো স্যারপ্রাইজ আছে,পাগলিটার মাথায় না জানি কি সব ধান্দা চলতে থাকে।ও আছে বলেই জীবনটা আমার এতো রঙিন।

কথাগুলো বলে খামটা খুলে রিপোর্টে চোখ বুলাতেই বাকরুদ্ধ হলো আয়ান।এতো সুখ কোথায় রাখবে সে।অবশেষে আরুশি আর আয়ানের ভালোবাসার অংশ আসতে চলেছে পৃথিবীতে, ভেবেই শরীরে আচমকা এক শিহরণ দিয়ে গেলো।

তখন আরুশি এলো আয়ানের জন্য কফি নিয়ে সাথে সায়শাও এসেছে সায়ানের জন্য কফি নিয়ে। আয়ান অতি খুশিতে কফির মগ ছুঁড়ে ফেলে আরুশিকে টান দিয়ে কোলে নিয়ে ঘোরাতে লাগলো আর চিৎকার করে বলতে লাগলো।

আমরা মা-বাবা হতে চলেছি আরুশি।আমাদের অংশ আসছে পৃথিবীতে,অবশেষে কেউ আমাদের বাবা মা বলে ডাকবে কথাটা ভেবে আমার কতো আনন্দ লাগছে আমি বলতে পারবো না।

আরে আরে করছো কি তুমি।হা হা।তুমিও না।

আয়ান আরুশিকে নামিয়ে এবার ওকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো।

ধন্যবাদ আরুশি তুমি জানো না তুমি আমাকে কতো বড় সুখ পাইয়ে দিয়েছো।আই লাভ ইউ সুইটহার্ট।

আই লাভ ইউ টু।কিন্তু অতি খুশিতে তুমি এতোটাই মাতোহারা হয়ে গেছো যে স্থান কাল কিছু দেখছো না।আশেপাশের লোক দেখছে আমার লজ্জা করছে না বুঝি।

আয়ান অতি খুশিতে আসলেই এতো কিছু খেয়াল করে নি।এবার আরুশিকে ছেড়ে আশপাশে খেয়াল করলে দেখলো কাজের লোক মাহবুব আর সায়শা মুখ টিপে হাসছে,আয়ান মাথা চুলকিয়ে মৃদু হেসে আরুশির হাত ধরে ঘরের দিকে হাঁটা শুরু করলো।

সায়ান মুখে একফালি হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তবে চোখ বেয়ে পরলো তার দুফোঁটা জল।খেয়াল করলো তা সায়শা,সায়শা যেনো বুঝতে পারলো সায়ানের মনের অবস্থা।

বাড়িতে বিষয়টা জানানোর পর খুশির জোয়ার আসলো,সবাই আরুশি কোলে নিবে না মাথায় উঠাবে ভেবে পাচ্ছে না,আরুশি সবার পাগলামি দেখছে আর হাসছে।আয়ান তো কি করবে ভেবে পাচ্ছে না,আজকেই নিজেদের রুম পুরো ১২ মাসের জন্য নিচে একটা রুমে শিফট করলো যাতে আরুশির সিঁড়ি চড়তে না হয়।খুশিতে আরুশির চোখে জল চলে এলো।এতোগুলো রক্তের বন্ধন থাকা সত্ত্বেও জীবনের ১৯ টা বছর সে অবহেলিত অনাথের এক জীবনযাপন করলো। তবে সবশেষে সুখ ওর কপালে স্থায়ী হলো এটাই ওর জন্য অনেক বড় পাওনা।রুমের বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে সায়ান,চোখ বেয়ে জল পরছে তাঁর নিঃশ্বব্দে,সায়শার উপস্থিতি পাশে আন্দাজ করতে পারলে ঝটপট চোখ মুছলো সায়ান,তবে বিষয়টা অগোচরে গেলো না সায়শার।শান্ত স্বরে বললো।

আরুশিকে এখনও ভালোবাসেন তাইনা?

মরার আগ অব্দি বাসবো।

আরুশি সত্যিই ভাগ্যবতী।ও অনেক ভালো তাই ওর কপালে আল্লাহ ভালো জিনিস রেখেছেন।আপনিও অনেক ভালো আর আপনার জীবনও অনেক ভালো হোক দোয়া করি।আল্লাহ যেনো আপনার মনে শান্তি দেন।

অবশ্যই আমার ভবিষ্যত ভালো হবে সায়শা কারন তুমি আমার জীবনে আছো।আমি ভাগ্যবান যে তোমার মতো কাউকে জীবনসাথী হিসেবে পেয়েছি।যতোটা সত্য আমি আরুশিকে ভালোবাসি ততোটাই সত্য যে আমি আর ওকে পাবো না।বরং ওর কথা চিন্তা করাও এখন আমার জন্য পাপ।আজ আজকে তোমার কাছে প্রতিঙ্গা করলাম আর কখনো নিজে থেকে আরুশিকে নিয়ে ভাবতে যাবো না।আমি জানি নিজের সাথে আমি তোমাকেও কষ্ট দিচ্ছি। তবে সেই কষ্টের ক্ষণ বেশি সময় আর স্থায়ী হবে না তুমি দেখে নিও।জানো আজ আমি অনেক খুশি যে ওরা নিজেদের জীবনে আর একদাপ এগিয়ে গেছে।

অতঃপর সায়ান নিজের সব খেয়াল সায়শার উপর লাগানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো, ওকে নিয়ে ঘুরতে যায়,ওর সাথে সময় কাটায়, সব দিক থেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে সায়ান সায়শার সাথে আর তাতে যেনো তার তেমন কোনো কষ্ট হচ্ছে না।কারন সায়শা শুধু দেখতে আরুশির মতো না স্বভাবগুলোও যেনো একই,কথা বলার ধরণ এক।এমনকি আরুশির মতো ফাজলামো আর দুষ্টুমিও করে,নিজের সাথে এতো খারাপ কিছু হয়ে গেছে তা কখনো আন্দাজ করতে দেও না কাউকে।এমনভাবে থাকে যেনো কিছুই হয় নি,ওকে দেখে সায়ান নিজের অবস্থা কাটিয়ে উঠার প্রেরণা পায়।এদিকে আস্তে আস্তে আরুশির গর্ভে বেড়ে উঠছে আয়ান আরুশির ভালোবাসার অংশ, নিজের ভিতরে এক অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে আন্দাজ করতে পারে আরুশি।মা হবার অনুভুতি যে কতোটা ভালোলাগার হয় তা হয়তো ভাষায় বলা দূরুহ।প্রেগন্যান্সিতে মুড সুয়িং নিয়ে আরুশি আয়ানকে অনেক প্যারা দেয়।আর আয়ান সব হাসিমুখে মানিয়ে নেয়, আরুশির পরিচর্যায় কোনো কমতি রাখছে না আয়ান।

আরুশির পেটে হাত রেখেছে আয়ান উপর থেকে আরুশি তার হাত ধরে আছে।

এই যে আমার মিনি দুই এ্যারোগেন্ট,ইনি হলেন তোমাদের পাপা।

তখনি আরুশির পেটে বাচ্চার লাথি অনুভব করে আয়ান,চোখে জ্বল ভরে আসে ওর খুশিতে।

আরুশি ওটা আমাদের বাবুর লাথি ছিলো।

আরুশি আলতো হেসে মাথা নাড়ালো। আয়ান এগিয়ে এসে আরুশির পেটে চুমু খেলো।

অনেক ভালোবাসো না এই দুই জনকে।

হ্যাঁ বাসি,নিজের প্রাণের থেকেও বেশি,তবে তোমার থেকে বেশি না হয়তো।বাবা হিসেবে সন্তানদের প্রতি আমার আলাদা এক ভালোবাসা থাকবেই তবে ভালোবাসার পরিমাণ ধরতে গেলে যে সেখানে তোমার জন্য পরিমাণটা বেশি বেড়িয়ে আসবে।ভালোবাসি প্রিয়সী তোমায়।

আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি আয়ান।

আয়ান আরুশিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।

দেখতে দেখতে আরুশির প্রেগন্যান্সির দিনগুলো কেঁটে গেলো।আরুশির কোল জুরে আসলো দুইটা রাজপুত্র,দুজন জমজ দেখতে হুবহু, নাম রাখা হলো আরিয়ান আর আরুশ,আয়ান আর বাকি সবাই চাইছিলো বাড়িতে প্রথম মেয়ে সন্তান আসুক,ওরা ঘরে লক্ষি চাইছিলো তবে আল্লাহ ছেলে দেওয়াতেও নারায না কেউ।এদিকে সায়ান সায়শার সম্পর্কের সৌন্দর্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সায়ান এখন সায়শাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবে ভাবতে শুরু করেছে।সায়শার সাথে সময় কাটাতে ভালোই লাগে ওর।ভাবছে নিজেদের সম্পর্ককে একটা নতুন রুপ দান করবে সায়ান।সায়শা আরুশির অনেক দেখবাল করে।আর আরিয়ান আরুশকে অনেক ভালোবাসে।সায়ানের কোনো যেনো মনে হয় আরিয়ান আরুশকে দেখে সায়শার মনে একটা টান পরে নিরাশতার টান।কখনো কিছুই পায় নি সে না পেলো মা বাবার ভালোবাসা, না পেলো স্ত্রীর মর্যাদা আর না পেলো মা হবার সুখ।সায়শার জন্য সহানুভূতি হয় না সায়ানের মায়া হয় বড্ড। বুকে যে আচমকা টান অনুভব করে সায়শাকে নিয়ে।

আজ আয়ান অফিস যায় নি।স্ত্রী সন্তান নিয়ে বাইরে বেড়াতে গেছে,সায়ান অফিস গেছে,সায়শা ভাবলো আজকে সায়ানের দুপুরের খাবার ও নিয়ে যাবে সেই ভেবে সায়ানের দেওয়া একটা শাড়ি পরে ওর জন্য খাবার নিয়ে অফিস গেলো,সায়ানের কেবিনে নক না করেই ঢুকে পরে সায়শা যেহেতু ওর স্বামীর কেবিন অধিকারত্ব নিয়ে ঢুকে যায় সে,তখন সায়ান একটা মেয়ের সাথে বিজনেস নিয়ে মিটিং করছিলো,ও সায়ানেরই একটা ফ্রেন্ড নাম দিশা,বিজনেস ডিল নিয়ে অনেক বছর পর দেখা ওদের,দিশার কাছে তার স্ট্যাটাস আর টাকার গরমই সব,তাছাড়া ও একসময় সায়ানকে পছন্দও করতো।সায়শা কেবিনে নক না করে ঢুকে যাওয়ায় বিষয়টা ভালো ঠেকে নি দিশার কাছে।

এই মেয়ে বসের কেবিনে নক করে ঢুকতে হয় জানো না?

সায়শা কিছু বলার আগে সায়ান বলে উঠলো।

ও আমার স্ত্রী, ওর নক করার প্রয়োজন নেই।

ওহ তবে এই তোর স্ত্রী সায়ান।আমি শুনেছি আমাদের কয়েকটা ফ্রেন্ডের কাছ থেকে তুই না কি অনাথ অসহায় একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিস,তাহলে এই সে?কি যে করলি তুই সায়ান!তুইও অবশেষে এমন অনাথ অবলা একটা মেয়ের পাল্লায় পরলি,দুনিয়াতে কি মেয়েদের কমতি পরেছিলো?তুই জানিস না এসব অনাথ অসহায়দের কোনো স্ট্যাটাস থাকে না।

সাট আপ দিশা।অনেক বলেছিস আর না।ও আমার স্ত্রী। আর ও অনাথ অসহায় হতে পারে এর মানে এটা নয় ও অমানুষ।অমানুষ তো তারা যারা টাকার গরমে অন্যদের জ্বালিয়ে মারতে চায়।আসল কথা তো তোর মতোই অধমদেরই কোনো ক্লাস থাকে না।

ওই তুচ্ছ একটা মেয়ের জন্য তুই আমার উপর চেচাচ্ছিস সায়ান!

ভাগ্য ভালো চেচাচ্ছি তোকে প্রাণে মারি নি।তুই একটা মেয়ে বলে তোর সম্মান করছি আজ,এখনি বেড়িয়ে যা আমার অফিস থেকে তোকে যেনো আমার চোখের সামনে আর না দেখি।নয়তো ভুলে যাবে তুই একটা মেয়ে আর কখনো আমার ফ্রেন্ড ছিলি।
দিশা হনহনিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।সায়শা কিছু বললো না আর সেখানে দাঁড়ালোও না,চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে আসলো সেখান থেকে, সায়ানকে কিছু বলার সুযোগটাও দিলো না।সায়ানও ওর পিছন আসলো।সায়শা বাড়ি এসে রুমের বিছানায় বসে মুখ চেঁপে কান্না করছে,তখনি রুমের দরজা লাগিয়ে সায়শার পাশে আসলো সায়ান।

সায়শা দিশার হয়ে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।ও এমনই অধম। প্লিজ ওভাবে কেঁদো না।

আপনি কেনো ক্ষমা চাইছেন আমার কাছে?দিশা আপু কি মিথ্যে বলেছেন?সত্যিই তো আমার কোনো ক্লাস নেই আপনার পাশে দাঁড়ানোর,আমার কোনো স্ট্যাটাস নেই।আমি স্বার্থপর নিজেরটা ভাবতে গিয়ে আপনার জীবন নষ্ট করে দিলাম।

এবার সায়ান সায়শার পাশে বসে ওর হাত ধরলো অতঃপর বললো।

একদম না,তুমি আমার জীবন নষ্ট করো নি বরং আমার জীবন সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছো।আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছো, ভালোবাসতে শিখিয়েছো।কে কি বললো আমার তাতে কোনো আসে যায় না সায়শা,আমার তো জানা আছে তুমি আমার জন্য কি।

আমি কি আপনার জন্য?

আমার ভালোবাসা,আমার ভালো থাকার শেষ সম্বল।

সত্যিই আপনি আমাকে ভালোবাসেন!

ভালোবাসি।

কথাটা শুনে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো সায়শা সায়ানকে আর কান্নারত অবস্থায় ফুঁপিয়ে বলে উঠলো।

আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি,অনেক।জীবনের শেষ নিশ্বাস অব্দি আপনার সাথে থাকতে চাই।

অতঃপর সায়ান সায়শাকে ছাড়িয়ে ওর চোখের জল মুছে দিয়ে ওর কপালে নিজের অধর ছুঁয়ালো,তারপর পবিত্রভাবেই নিজেদের জীবনের একটা সুন্দর সূচনা করলো ওরা।সায়শার অতীতের বিষয়ে সবাইকে অনেক আগেই জানালো সায়শা নিজে থেকেই তবে কেউ তাতে উল্টা কোনো প্রতিক্রিয়া করে নি বরং সায়শাকে সাহস জুটিয়েছে ওর সমর্থনে থেকেছে।

দুদিন পর সায়ান সায়শাকে নিয়ে হানিমুনে গ্রিস চলে গেলো,সেখানে প্রায় ১ মাসের মতো থেকে আসলো ওরা।চার মাস কেটে গেলো।আজ হুট করে সবাই জানতে পারলো সায়শা মা হতে চলেছে। বাড়িতে পরলো আবার খুশির হৈ-হুল্লোড়। সায়ানের খুশির যে আজ ঠিকানা নেই।আজ যে সে সত্য অর্থে খুশি।আয়ানের মতো সায়ানও যেনো দিশেহারা হয়ে গেছে খবরটা শুনে,কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।দুদিন পর সায়শাকে নিয়ে সায়ান একটা জায়গায় গেলো,সায়শার চোখ কালো কাপড়ে বাঁধা।সায়ান সায়শাকে নিজেকে তুমি বলে আর নাম ধরে ডাকার অনুমতি দিয়েছে অনেক আগেই।

কি করছো সায়ান কোথায় নিয়ে আসলে তুমি আমায়?আর চোখ খুলতে দিচ্ছো না কেনো?

এই তো হৃদহরণী শেষ তোমার অপেক্ষা, এবার চোখ খুলো।

চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে চমকালো সায়শা,এটা ওর বাবার রেখে যাওয়া জমিন যেখানে একটা বড় অনাথ আশ্রম করা হয়েছে আর নাম দেওয়া হয়েছে সায়শার স্বপ্নের জাহান। সায়শার চোখে জ্বল ঝলকে এলো,অশ্রশিক্ত নয়নে অবাকত্ব নিয়ে তাকালো সায়ানের দিকে,সায়ান আলতো হেসে ওর চোখের জল মুছে দিলো অতঃপর বলতে লাগলো।

অবাক হয়ো না ময়নাপাখি,এসব কিছুই তোমার। তোমার মায়ের কবল থেকে তোমার ভাগের সম্পত্তি অনেক কিছু করার পর হাতাতে পারলাম অতঃপর তোমার জায়গাতে তোমার সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে সেই টাকাতে অনাথ আশ্রম বানিয়েছি যাতে তোমার মতো আর কোনো অনাথকে পিরীত হতে না হয়।হয়তো নিজের টাকায় তোমাকে এমন কিছু গিফ্ট করতে পারতাম তবে সেই খুশিটা এর থেকে বেশি হতো না তোমার কাছে আর আমার তোমার অধিক খুশিটাই প্রিয়।

তবে মায়ের কাছ থেকে এসব আনলে কি করে তুমি?

আরে সুইটহার্ট, ক্ষমতা থাকলে সব হয়।আমি ক্ষমতা খাটানো ছেড়ে দিলেও যেখানে প্রয়োজন সেখানে ঠিকই খাটাই,যে যেমন তার সাথে তেমনই করা শ্রেয়।আমি চাইলে তোমার সৎ মা বোনকে যোগ্য শাস্তি দিতে পারতাম তবে আমি তা করি নি কারন আল্লাহর দেওয়া সাজা দেখার মজাই আলাদা হয়।জানো তোমার বোনকে তোমার মা অনেক বড় ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছিলো,কিন্তু ঘরটাতে মানুষ থাকে না অমানুষ থাকে তা দেখে দেয় নি।বিয়ের পর থেকে তোমার বোনের সাথে অনেক অমানুষিক নির্যাতন চালায় ওরা।স্বামী পরকীয়ায় লিপ্ত ছিলো,অনেক মারধর করে তোমার বোনকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় ওরা এমনকি ট্রিক করে তোমার বোনের ভাগের সম্পত্তির অংশ ওর স্বামী হাতিয়ে নেয়,বর্তমানে তোমার মা বোন কাঙাল।কোনো মতে পেট চালায় দুজন।আর তোমার ওর লুচ্চা স্বামী কয়েকদিন আগে এক্সিডেন্টে দুই পা হারায় সে,স্ত্রী ফেলে চলে গেছে,বাড়িতে পরে থাকে এখন আগাছার মতোই।

কি!ওরা সবাই এতোটা কষ্টে আছে!

তুমি প্লিজ মা আর সাথিকে একটা ভালো ব্যবস্থা করে দাও থাকা খাওয়ার।

দেখো এতো ভালোমানুষি দেখিয়ো না তো।ওরা ওদের কর্মফল পেয়েছে।এতে আমাদের কি? আমি তাতে খুশিই আছি।

আমি কখনো চাই নি ওরা কষ্টে থাকুক,যতোই হোক ওরা আমারই মা বোন,আমি কখনো ওদের পর ভাবি নি।প্লিজ আমার আর আমাদের অনাগত সন্তানের জন্য হলেও মেনে যাও।

তুমিও না।ইমোশনাল ব্লেকমেইল করে ছাড়লে আমায়।ওকে ঠিক আছে আমি ওদের একটা কাজ পাইয়ে দিবো ভালো দেখে এর থেকে বেশি কিছু করতে পারবো না।

ধন্যবাদ আপনাকে।

ধন্যবাদ না…… বলো ভালোবাসি।

ভালোবাসি। আর আমাদের বেবিও তোমাকে অনেক ভালোবাসে।

আমিও আমার বেবি আর বেবির মাকে অনেক ভালোবাসি।

সায়শার প্রেগন্যান্সির দিনগুলোরও সমাপ্তি ঘটলো,সায়ান সায়শার অনেক খেয়াল রাখলো এই দিনগুলোতে।চোখে চোখে রেখেছে সায়শাকে।সায়ানও নিজেদের রুম নিচে নিয়ে চলে যায় সায়শার নিরাপত্তার জন্য।অবশেষে সায়শারও কোল আলো করে আসলো দুজন কন্যা সন্তান সায়াশা আর সায়ানশি।দুই দুইটা জমজ মেয়ের বাবা হয়ে অনেক খুশি সায়ান।এই দুজনও দেখতে হুবহু।

সবাই অনেক খুশি, সুখে শান্তিতে কাঁটতে থাকলো ওদের দিন,নেই কোনো দোটানা ওদের কারো মধ্যে। কেঁটে গেলো আরও চারটে বছর,প্রাঙ্গনে চেয়ার টেনে একপাশে বসেছে নিহান নিধী ওপর পাশে নিরব কথা।নিজেদের কাঙ্ক্ষিত মানুষদের কাঁদে মাথা রেখে ছেলে মেয়ে আর নাতি নাতনীদের খেলা দেখছে ওরা।আয়ান আরুশি আর সায়ান সায়শা বাচ্চাদের নিয়ে বল খেলছে প্রাঙ্গনে সাথে যায়ানও আছে।বাচ্চাগুলোর মধ্যে আলাদা একটা বিষয় লক্ষ্য করলো সবাই।আরিয়ান সায়ানশির সাথে বেশিরভাগ সময় খেলা করে ঠিক তেমনি আরুশ সায়াশার সাথে থাকে বেশিরভাগ সময়।সবাই নিশ্চিত হলো এবার আর কোনো দোটানা হবে না।কিন্তু হঠাৎ পাশের বাসার দুই মেয়ে আসলো একসাথে ওদের বাড়িতে,ওরা নতুন বাড়ি বানিয়ে এসেছে চৌধুরী বাড়ির রাস্তার বিপরীর পাশে।আজ এক সপ্তাহ ওরা এখানে শিফ্ট হয়েছে আর আসছে থেকে ওই দুই মেয়ে চৌধুরী বাড়িতে ঘন ঘন আসা যাওয়া করে।কেউ তার কারন জানে না।কথা হলো ওরা দুই বোন,একজন অনার্স ফাস্ট ইয়ারে পড়ে আর অন্যজন ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে।ওদের এমন ঘন ঘন এখানে আসা সবার মনেই কেমন সন্দেহের যোগান দিচ্ছে। ওদের ভাবসাবও কেমন যেনো ভালো ঠেকছে না কারো কাছেই।আজকে দুজন এসে বললো।

আমরাও খেলবো তোমাদের সাথে।তখন কেউ কিছু বলার আগে যায়ান বলে উঠলো।

তোমাদের এখানে খেলাতে রাখা হবে না যত্তোসব, কথাটা বলে ভিতরে চলে গেলো সে।

যায়ান গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করে ভাইয়েদের সাথে নিজেদের বিজনেস দেখছে,আয়ান সায়ান এতোদিনে নিজেদের নিজস্ব আলাদা বিজনেস করে নিয়েছে যায়ানও সে প্লান করছে।বর্তমানে যায়ানের প্রতিক্রিয়া ভালো ঠেকলো না আরুশির কাছে এমনকি কারো কাছেই।আরুশি ওর সাথে ছোটে এসে আটকালো ওকে।

দাঁড়া যায়ান কি চলছে এসব?বল তো?

কি চলবে আপু?

ওই মেয়েগুলোর সাথে তোর কি?

আরে আপু তোমাকে কি বলবো বলো।না জানি এই দুই বোনের মতলব কি যখন তখন আমার আগ পিছন ঘুরঘুর করে অসহ্য।

কথাটা বলে যায়ান তার রুমে চলে গেলো ততোক্ষণে সবাই ঘরে চলে আসলো,নিধী আরুশিকে জিজ্ঞেস করলো।

কি হয়েছে আরুশি?

আর কি হবে গো মা।তোমাকে ডিসাইড করতে হবে যে তুমি ছেলে বউ কাকে বানাবে মিতালি না মিথিলাকে,কারন তোমার ছেলে মিতালি আর মিথিলাকে নিয়ে দোটানায় পরতে চলেছে।হা হা হা।

কথাটা শুনে সবাই একস্বরেই বলে উঠলো,আবারও দোটানা………..

একসাথেই হেসে দিলো সব…………..
সমাপ্ত