দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-১৭+১৮

0
261

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ১৭+১৮
নীলাভ্র জহির

জোসনা বেগম আজ সকাল থেকে দাওয়ায় পাটি বিছিয়ে শুয়ে আছেন। তাকে দেখে মোটেও অসুস্থ মনে হচ্ছে না। একটু বারবার পান খেয়ে পান এর পিক ফেলে তার পাশের জায়গাটা লাল করে ফেলেছেন। চোখ বড় বড় করে এদিক সেদিক তাকাচ্ছেন। কখনোবা রুবিনা কিংবা নাজমাকে পাশে ডেকে গল্পগুজব করছেন। কিন্তু বলছেন তার কোমরে ব্যথা। শরীরে অস্বস্তি হচ্ছে। এক বালতি কাপড়-চোপড় বারান্দায় বের করে রেখেছেন ধোয়ার জন্য।
চিত্রা কি করবে বুঝতে পারছে না। এই অবস্থায় এতগুলো কাপড় ধোয়া তার হয়তো উচিত হবে না। কিন্তু জোসনা বেগমকে সরাসরি কিছু বলতে পারছে না চিত্রা। সংসারের টুকিটাকি কাজ শেষ করে সে দাওয়ায় শাশুড়ির পাশে এসে বসলো।
আজকের দিনটা রৌদ্রোজ্জ্বল। গাছের পাতায় ঝলমল করছে রোদ। উঠোনে খেলা করছে পাশের বাড়ির দুটো বাচ্চা। ওদের খেলা করতে দেখে চিত্রার কেমন মন উচাটন হয়ে যায়। একদিন তার বাচ্চা ঐ উঠানে খেলা করবে। চোখের সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য ভেসে ওঠে চিত্রার। একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে দৌড়ে খেলা করতে দেখছে সে।
জোসনা বেগম বললেন, গরুর খড় কাইটা দিছো।
হ আম্মা। কাইটা দিসি।
বেলা হইয়া গেছে। আমার কাপড় গুলা এখন ধুইয়া দিতা। শুকাইতে সময় লাগবে তো। গা গোসল দিয়া আবার কি গায়ে দিমু।
চিত্রা ইতস্তত করতে করতে বলে ফেলল, কাপড় ধোয়া কি ঠিক হইবো আম্মা।
ঠিক হইবো? বুঝলাম না তোমার কথা।
না আম্মা কইতেছিলাম যে এই অবস্থায় কাপড় ধোওয়া কি ঠিক হইব। পেটের উপর চাপ পড়ব না?

কথাটা বলতে গিয়ে লজ্জায় ঠোঁট কাঁপছিল চিত্রার। সে শ্বাশুড়ির দিকে তাকাতে পারেনি। উঠোনের বাচ্চা দুটির দিকে তাকিয়ে আপন মনের কথাটা বলে ফেলেছিল। কিন্তু জোসনা বেগম ফ্যালফ্যাল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে বিস্ময়। তিনি বললেন, এগুলো আবার কেমন কথা কইতাছো। তোমার কি আট মাসের পেট হইছে যে প্যাটে চাপ পড়ব। কাপড় ধুইতে পারবা না। আমরা যখন পোয়াতি ছিলাম বড় বড় কলসিতে কইরা ওই মাদবর মিয়ার বাড়ি থাইকা পানি আনছি। তোমার তো সেইটা করতে হইতাছে না। বাড়িত টিউবয়েল পাইছো। আমরা ঢেঁকিতে বারা বানসি। মনে মনে ধানের কাম করছি। তোমারে তো সেই সব করতে দেই নাই বাপু। কাপড়ও ধুইতে কইতাম না। বিয়ের পর তোমারে কোনদিনও কইছি আমার একটা কাপড় একটু ধুইয়ে দাও? কই নাই। আজ আমার একটু মাজায় ব্যথা। ব্যথার জন্য উঠবার পারতাছিনা। কিন্তু কাপড়গুলো ময়লা হইয়া গেছে। নামাজ কালাম পড়মু। এজন্যেই তোমারে কইতাছি একটু ধুইয়া দিতে। আজকালকার পোলাপাইন কত রকমের কথা. তোমার ধুইতে মন না চাইলে দেও, না চাইলে রাইখা দেও। মাজার ব্যাথা যেদিন সারবে সেইদিন ধুমু।

চিত্রা কোনো প্রতিউত্তর করতে পারল না। কথাটা তো সত্যিই, তার শাশুড়ি কোনদিনও তাকে নিজের একটা ব্লাউজ পর্যন্ত ধুয়ে দিতে বলেনি। আজ উনি অসুস্থ বলেই ধুতে দিয়েছেন। চিত্রার উচিত কাপড়গুলো ধুয়ে শুকাতে দেয়া। এক বালতি কাপড় নিয়ে সে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিল।
ঘাটের পাশে টংয়ের উপর বসে আছে রুবিনা। পাশের বাড়ির দুজন ভাবি ও মেয়েদের সঙ্গে সে গল্প করছে। গাছ থেকে পেয়ারা পেরে ছোট ছোট করে কুচি করে লবণ মরিচ দিয়ে মেখে খাচ্ছে সবাই মিলে। চিত্রাকে দেখে বললো ভাবী এইখানে আসো।
চিত্রা দাঁড়ালো তাদের পাশে। কয়েক টুকরা পেয়ারা মুখে দিতেই তৃপ্তির স্বাদ পেল সে। বলল , দারুন মজাতো খাইতে।
রুবিনা বলল, হ ভাবি। খাও । তোমার এখন ভালো ভালো খাবার খাইতে হইবো।
কথাটা বলেই মুখ টিপে হাসলো রুবিনা। দখিনা হাওয়া গায়ে লাগছে। গাছের ছায়ায় টং এর উপর বসে চিত্রা বেশ কয়েক টুকরা পেয়ারা খেয়ে ফেলল। এক ভাবী বলল, ভাবি তোমার একখান কতা কইতাম। এত তাড়াতাড়ি পোলা মাইয়া নিলা কিল্লাইগা। বিয়া তো সবে হইছে। অন্তত একটা বছর পরে নিবার পারতা।
চিত্রা চুপ করে রইলো।
ভাবি আবারও বললো, খেলাধুলা যে ভালোই হইছে সেটা তো বুঝাই যাইতাছে।
মুখ টিপে হাসলো সবাই। লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো চিত্রা। কিন্তু সবার সামনে নিজেদের অপমান সইতে পারল না। বলল, আপনার ভাইয়ের খুব ছোট পোলা মাইয়ার শখ। ছোট ছোট পোলাপান দেখলে নাকি হের খুব ভালো লাগে। প্রথমদিকেই আমারে কইছিল সে তাড়াতাড়ি পোলার বাপ হতে চাই। পোলারে সে অনেক আদর করবো। এইজন্য আমি আর ওষুধ দাওয়াই খাই নাই।

আরেকজন ভাবি মুচকি হেসে বললেন, এটা তো ভালো কথা। কিন্তু একটা কথা কইয়া রাখি মনে রাইখো। নতুন বিয়া করছো। শইল্যের জোয়ার এখনো কমে নাই। পুরুষ মানুষ কিন্তু যখন-তখন শইল্যের উপরে লাফায়া পড়ব। পোলার কথা ভাইব। যখন তখন ঐ কাম করতে দিওনা।
চিত্রার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। এই কথাটা উনি সত্যি বলেছেন। তার পেটে এখন রূপকের সন্তান। সন্তানের কথা ভেবেও অন্তত এখন চিত্রাকে কিছুদিন ছাড় দেয়া উচিত ছিল রূপকের। কিন্তু রূপকের আচার-আচরণে কখনোই মনে হয় না চিত্রা সন্তানসম্ভবা। প্রায় প্রতি রাতেই চিত্রার শরীরকে কাছে টেনে খেলায় মেতে ওঠে। পুরুষ মানুষ মানেই হয়তো শরীর শরীর খেলা। তাদের কাছেই স্ত্রী মানে শুধু ভোগের পণ্য। স্ত্রীদের যে বিশ্রামের প্রয়োজন আছে সেটা তারা মুহূর্তের জন্য মনে করে না। এই দিক থেকে দুনিয়ার প্রত্যেকটা পুরুষ মানুষ হয়তো এক। মেয়েদেরকে তারা মানুষ মনে করে না’।
চিত্রা টং থেকে উঠতে উঠতে বলল আমি যাই কাপড়গুলো ধুয়ে দেই।
এতগুলা কাপড় ধুইতে নিছো কি জন্য । গোসলের পরে দুইটা কাপড় ধুয়ে দিবা । কাপড় ধুইতে গেলে শরীর নাজেহাল হইয়ে যায় ।
আম্মায় ধুইতে দিল । ওনার শরীলটা ভালো নাই ।
ভাবি রুবিনাকে বললেন, কিরে রুবিনা। তোর মায়ের কাপড় দুটো তো ধুয়ে দিতে পারোস। তোর ভাবিরে এ অবস্থায় এতগুলা কাপড় ধুতে দিছে।
রুবিনা বলল, আমি কাপড় ধুলে আম্মার পছন্দ হয় না। কয় আমার ধোয়া কাপড় নাকি সাফ হয়না?
সাফ হইলে হইব না হইলে হইব না। তোর ভাবিরে এত কাপড় ধুইতে দিস না। তুইও যা ওরে একটু সহযোগিতা কর।

তারপরও ঠায় বসে রইল রুবিনা। চিত্রা মনে মনে আশা করলো রবিনা হয়তো এই কথা শুনে তাকে সহযোগিতা করতে উঠে আসবে। তাই সাহস করে পুকুর ঘাটে নেমে সবগুলো কাপড় সাবান পানিতে ভিজিয়ে রাখলো। কিন্তু একটা একটা করে ধীরে ধীরে সব কাপড় ধোয়া হয়ে গেলেও রুবিনার আসার কোন নাম গন্ধ নেই। চিত্রা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে রুবিনার দিকে তাকায়। দেখতে পেলেও টং এর উপর শুধু ভাবীরা বসে আছে রুবিনা নেই। ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল চিত্রার। সব কাপড় ধোয়া শেষ করে সে আরো একবার তাকালো। রুবিনা এখনও নেই। কাজ করার ভয়ে নিশ্চয়ই পালিয়েছে এখান থেকে। অন্যের কাছে কোন কিছু আশা করা বৃথা। চিত্রা এক বালতি ভেজা কাপড় শুকাতে দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। জোসনা বেগম দাওয়ায় নেই। চিত্রা কোন দিকে না তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। শরীরটা খুব নাজেহাল হয়ে গেছে। পুকুর ঘাটে কাঠফাটা রোদ। সেই রোদে এতগুলো কাপড় কাচতে গিয়ে খুব পরিশ্রম হয়েছে তার। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে ঘুম চলে এসেছে চোখে। ঘুম ভেঙে গেল জোসনা বেগম এর ডাকে। তিনি বললেন, মাজার ব্যাথায় কিছুই তুলতে পারতাছিনা। ও বউ, গরু গুলারে একটু পানি দিয়ে আসো না।

চিত্রা ধীরে ধীরে উঠে পড়ল। দুই বালতি পানি নিয়ে এসে দিল গরুকে খেতে। তারপর কাপড় নিয়ে গোসল করতে চলল সে।
গোসল করার সময় ঘাটে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। এই যেমন আজ দেখা হলো পাশের বাড়ির রুনা ভাবির সঙ্গে । ভাবী অনেক ফেনা তুলে গা ঘষছেন। পরনে শুধু একটা পেটিকোট যেটা বেঁধে রেখেছেন বুকে। তার সাদা ধবধবে গায়ে সাবানের ফেনা গুলো চিকচিক করছে।
চিত্রা গোসল করতে নামল।
ভাবী বললেন, বমি টমি করিস না?
ভাত খাওয়ার সময় বমি হয়। খাইতে পারি না ভালো কইরা।
আয়রন ট্যাবলেট খাইতেছস?
না,
তোর শাশুড়ি তোরে কয় নাই এখন আয়রন ট্যাবলেট খাইতে হইবো?
চিত্রা তাকিয়ে রইল মহিলার দিকে। আয়রন ট্যাবলেট এর কথা কেউই তাকে বলেনি। তার বিভ্রান্তি চোখ দেখে মহিলা বললেন, কিলিনিকে যাস। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আপা কিছু আয়রন ট্যাবলেট দিয়ে দিব।
টাকা নিব না?
না, সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। কোন টাকা নিব না। আয়রন ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দিয়ে দিব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আমিতো স্বাস্থ্যকেন্দ্র চিনিনা।
রুবিনা অথবা নাজমারে নিয়ে যাবি।
আচ্ছা, দেখি।

রাত্রিবেলা রূপকের কাছে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার কথাটা বলল চিত্রা। রূপক তাকে আশ্বস্ত করে বলল আমি রুবিনারে কইয়া দিমু। ও তোমারে নিয়া যাইবো।

পরপর আরো দুদিন চিত্রার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাওয়া হলো না। জোসনা বেগম এর শরীর খারাপ। তিনি মাজার ব্যাথায় নড়াচড়া করতে পারছেন না। ঘরের সব কাজ চিত্রাকে করতে হচ্ছে। দুদিন পর জোসনা বেগমের শরীর কিছুটা ভালো হলে চিত্রাকে তিনি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আপা চিত্রাকে আয়রন ও ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট দিলেন ঠিকই। সঙ্গে বলে দিলেন খাওয়া দাওয়া করবেন ঠিকমতো। বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাবেন। মাছ মাংস ডিম দুধ শাকসবজি খাবেন বেশি করে। আপনার হাসবেন্ড কে বলবেন এখন আপনার বেশি বেশি ভালো খাবার খাওয়া দরকার।
চিত্রা মাথা দুলিয়ে বলল আচ্ছা ঠিক আছে আপা।
আর বাসার কোন ভারী কাজ করবেন না। ছোট ছোট কাজগুলো করবেন। একটানা কাজ করবেন না। অল্প করে কাজ করবেন, একটু বিশ্রাম নেবেন আবার একটু কাজ করবেন।
চিত্রা কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইল, ভারী কাম কোনগুলা?
মহিলা হেসে বললেন, ভারী কাজ কোনগুলো বুঝেন না আপা? এই ধরুন বাড়িতে বেশি মানুষের ভাত রান্না হয় । আপনি ভাতের হাড়ি চুলা থেকে নামাবেন না। আবার ধরুন পানির কলস, পানির বালতি এগুলো তুলবেন না। ধানের গামলা একদমই তোলা যাবে না। যে কাজগুলো করতে বেশি ভর লাগে সেগুলো করা যাবে না। ছোট ছোট কাজগুলো করতে পারবেন।
চিত্রা জানতে চাইল, গরুকে পানি দেওয়া যাইবো না?
আপনি যদি এক মগ করে কয়েক মগ পানি দেন তাহলে দেয়া যাবে। কিন্তু আপনি যদি একসঙ্গে একটা বড় বালতি ভরে গরুকে পানি দিতে চান তাহলে তো সেটা করা যাবে না।
চিত্রার মুখটা শঙ্কায় কালো হয়ে গেল। সে জানতে চাইলো, ধরেন আমি ভুল কইরা একটা বালতি তুইলা ফেলছি। তাইলে কি হইব?
এই ভুল তো করা যাবে না আপা। আপনাকে সব সময় মাথায় রাখতে হবে আপনার পেটে একটা সন্তান আছে। কোন রকমের রিস্কি কাজ আপনাকে একদমই করা যাবে না।
ধরেন যদি কইরা ফালাই তখন কি হইব?
বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
বুক কেঁপে উঠল চিত্রার। সে তো বালতি ভরে গরুকে পানি দিয়েছে। এমনকি বাড়ির সব ভারী ভারী কাজ তাকে করতে হয়েছে। যদি তার বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে! ভয়ে ও আতংকে তার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল।
মহিলা বললেন, কি হয়েছে আপা? কোনো সমস্যা? আপনাকে কি ভারী কাজ করতে হয়?
হুম।
মুখ গম্ভীর চিত্রার।
মহিলা বললেন, আর করবেন না।
পোলার যদি কোনো ক্ষতি হইয়া থাকে?
হলে হয়ে যেত ‘এতক্ষণে। তারপরও আপনি এখন থেকে খুব সতর্ক থাকবেন। দিনে দুই ঘন্টা শুয়ে বিশ্রাম নেবেন। বেশি কাজ করবেন না।
জি আপা। আমার জন্য দোয়া রাইখেন।
অবশ্যই আপা।
আর একটা কথা জিগাই। আমি তো আইজ সকালেও দুই বালতি পানি তুলছি। আমার পোলার কিছু হইব না তো?
হতেও পারে। সেটা তো বলা যাচ্ছে না। আপনি বাসায় গিয়ে সারাদিন শুয়ে থাকুন। প্রয়োজন ছাড়া উঠবেন না।
– শুইয়া থাকলে কি হইব?
এতে রিস্কটা কম থাকবে। আগামী কয়েকদিন আপনি শুয়ে বসেই থাকুন। যদি এরমধ্যে খারাপ কিছু না ঘটে তাহলে আর টেনশন থাকবে না। তবে এরপরে আর কখনো এ ধরনের কাজ করবেন না।

চিত্রা বাড়ির পথে রওনা দিলো। রুবিনাও তার সঙ্গে ছিল, কথাগুলো রুবিনাও শুনেছে। সে নিশ্চয় জোসনা বেগমকে ভালো করে সবকিছু ব্যাখ্যা করবে। দুশ্চিন্তায় মরার দশা হল চিত্রার। তার বাচ্চাটার কিছু হয়ে গেলে সে মরেই যাবে।

গর্ভের শিশুর দুশ্চিন্তায় চিত্রার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সে নিজের মনের অবস্থা কাউকে বোঝাতে পারছে না। সবাইকে বোঝার মানুষ থাকে না। যেমন চিত্রার নেই। বাড়িতে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল চিত্রা। কিছুক্ষণ পর জোসনা বেগম এসে তাকে একটা কাজের কথা বললেন। কিন্তু চিত্রা বিছানা ছাড়িনি। সে ঠিক করেছে আগামী দুইদিন শুয়ে থাকবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর জোসনা বেগমের গলা শোনা গেল,তোমার একটা কাম করতে কইছিলাম বউ।
চিত্রা উত্তর দিল, এখন পারুম না আম্মা। ডাক্তার আপায় কইছে আমার একটু বিশ্রাম নিতে।
কতক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়? সে দুপুর থাইকা শুইয়া রইছো। এখনো ওইটা একটু হাঁটাহাঁটি করো। দুনিয়াটার আলো-বাতাস দেখো। কাম কাজ না করলে শরীরে নুনা ধরবো।
আম্মা দেখ ডাক্তার আপা কইছে আগামী কয়েকদিন আমারে বিছানায় রেস্ট নিতে। জরুরী দরকার ছাড়া উড়তে মানা করছে।
এটা আবার কেমন কথা? এমন কথা তো জীবনেও শুনি নাই বাবু। পোলাপাইন তো আমারও হইছে। সবারই হয়। সারাদিন কে বিছানায় শুইয়া থাকে?
আম্মা আমার একটু সমস্যা আছে। রুবিনা আমার সঙ্গে গেছিল। ওরে জিজ্ঞেস করেন, ও কইবো।
হইছে । আজকালকার মাইয়াগো কত যে সমস্যা।

বিড়বিড় করতে করতে জোসনা বেগম সেখান থেকে চলে গেলেন। এরপর তিনি হয়তো রুবিনা সঙ্গে নিয়ে কথা বলেছিলেন। চিত্রা আশা করেছিল জোসনা বেগম তাকে বুঝবে। নিজের মেয়ের মত পরম আদর-স্নেহে ভরিয়ে রাখবে তাকে। কিন্তু সবকিছু জানার পর হিতের বিপরীত হলো। তিনি আরো ভয়ঙ্কর রেগে গেলেন। ঘরের কাজ করতে করতে সমস্ত রাগ করতে লাগলেন জিনিসপত্রের উপর। সবকিছু জোরে জোরে ফেলতে লাগলেন আর মুখে বললেন, গোবর পোড়া কপাল রে। মাজায় ব্যথা হওয়ার আর টাইম পাইলো না। সারা জীবন সংসার কইরা আইলাম। এই দুই দিনের জন্য কেন আমার এই মরার অসুখ হইলো। জমিদারের বেটি রে কাম করতে কইছিলাম। কেন যে করতে কইছিলাম? বহুৎ বড় ভুল কইরা ফেলছি। কাম কাজ করলে কি হয়? শরীর ভালো থাকে। তার কামের কথা কইয়া নাকি আমি তার সর্বনাশ কইরা দিছি। আরে কিছুই হইব না। স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মানুষজন একটু বেশি কথা কয়?
পাশের বাড়ির একজন মহিলা জানতে চাইলেন কি হইছে ভাবি।
আরে আর কইও না। রূপকের বউর একটু কাম করতে কইছিলাম। এই কাম করনের লাইগা নাকি তার শরীর খারাপ হইয়া গেছে। ডাক্তার নাকি তারে কইছে সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতে। কোন কাম কাজ না করতে।
মহিলা বললেন ডাক্তার এই কথা জীবনেও কইবো না। কাম কাজ করলেতো শরীরের আরো উপকার হয়। তোমার বউ এগুলা কইতাছে কারণ সে খালি সুযোগ খুজতাছে। তারে দেখলেই বোঝা যায় দুনিয়ার আইলশা। ঘরের কাজ কামে মন নাই।

চিত্রার বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল। নিজের পরিস্থিতিতে সে কখনো কাউকে বোঝাতে পারবে না। তাকে বোঝার মতো কেউ নেই। একমাত্র রূপক তাকে বুঝতে পারে।

রূপক বাড়ি ফিরলে চিত্রা সব কথা তাকে খুলে বলল। রূপক বললো আচ্ছা ঠিক আছে আমি আম্মারে বুঝাই কমু।
চিত্রার খুব বলতে ইচ্ছা করছিল তাতে আমার অশান্তি আরো বাড়ব। কিন্তু স্বামীর সামনে শাশুড়ির বদনাম করতে ইচ্ছে করলো না। তাই বিষয়টাকে এড়িয়ে গেল চিত্রা।

পাখি ডাকা এক নতুন ভোরের সূচনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ঘরের বাইরে বের হয়েছে চিত্রা। সবেমাত্র অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এই আলোয় হাঁটতে খুব ভালো লাগে। বাড়ির সামনের কাঁচা রাস্তায় কয়েক মিনিট চিত্র হাঁটাহাঁটি করে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। জোসনা বেগম আড়চোখে তাকে দেখছে। গরু গুলোকে গোয়াল ঘর থেকে বের করেছিলেন উনি। চিত্রা নিজেও গোয়াল ঘরে গিয়ে দুটো গরুর রশি ধরে বাইরে বের করার চেষ্টা করলো। এমন সময় একটা গরুর গুতা খেয়ে রীতিমতো পড়ে যাওয়ার জোগাড় হল তার। জোসনা বেগম এর তাতে কোনো সহানুভূতি হলো না। বরং তিনি আরো ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, তোমারে এইখানে আইতে কে কইছে? মরতে আইছিলা? পেটের মধ্যে একটা গুতা লাগলে তখন কইতা আম্মা লাগাই দিছে। এইখান থাইকা যাও।
চিত্রার মন খারাপ হয়ে গেল। রান্নাঘরে এসে ভাতের পাতিল ধুয়ে পানিসহ চুলায় তুলে দিলো চিত্রা। ভাতের চাল ধুতে গেছে এমন সময় আবারো শোনা গেল জোসনা বেগমের গলা, আবার ওইখানে গিয়ে কি করতাছো ? রাইখা দাও। কাম আমি করমু। তোমার কিছু করা লাগবো না। ঘরে গিয়া শুইয়া থাকো।

চিত্রা জোসনা বেগমের কথায় ভ্রুক্ষেপ করলো না। সে স্পষ্ট বুঝা গেছে শ্বাশুড়ীর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হবে। কানের ভেতর রাখতে গেলে কষ্ট হবে তার। উনার প্রত্যেকটা কথা হৃদয়টাকে পুড়িয়ে বের হয়। এই বাড়ির বউ হয়ে থাকতে চাইলে আরো অনেক বেশি সহ্য ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে তাকে।

চিত্রা চুলার পাড়ে বসে ভাত জাল দিতে লাগলো। জোসনা বেগম এসে বললেন যাও ঘরে যাও। কাম কাজ কিছু করতে হইবো না। তোমার ডাক্তার কইছে সারাদিন শুয়ে থাকতে। তুমি শুইয়া থাকো। পারলে আমার পোলারে ও সারাদিন ধইরা রাখ।

চিত্রা কোন প্রত্যুত্তর’ করল না। জোসনা বেগম তাকে এক প্রকার জোর করে রান্না ঘর থেকে বের করে দিলেন। অগত্যা বাধ্য হয়েই চিত্রা নিজের ঘরে চলে এলো।

আজ চিত্রার সারাটা দিন কাটলো শাশুড়ির খিটিরমিটির কথাবার্তা শুনে। শাশুড়ি তাকে কোনো কিছুতে হাত দিতে দিচ্ছিলেন না। পরে রূপকের কাছে জানতে পারল গতরাতে রূপক তার মায়ের সঙ্গে চিত্রাকে নিয়ে কথা বলেছিল। রূপক নিজেই অনুরোধ করেছিল যাতে মা চিত্রাকে কোন কাজ করতে না দেন। এ কারণেই তার ওপর প্রচণ্ড রেগে আছেন জোসনা বেগম। বিষয়টাকে নিয়ে চিত্রাহার মাথা ধামাল না। সবকিছু যত বেশি এড়িয়ে যেতে পারবে ততোই সুখে থাকতে পারবে সে।

তখন মধ্যরাত। চিত্রাকে একবার বাইরে যেতে হবে। এ বাড়ির পায়খানা (টয়লেট) ঘর থেকে অনেক দূরে। এখন রাত্রিবেলা বেশ কয়েকবার চিত্রাকে বাইরে যেতে হয় চিত্রার রূপককে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। রূপক ঘুমের ঘোরে ডুবে গেছে। বলল, দরজা খোলা রাইখা যাও। আমি জাইগা আছি। ভয় পাইও না।
আপনিও চলেন আমার লগে। একা একা যাইতে ডর লাগে।
আচ্ছা, তুমি যাও আমি দুয়ারে দাঁড়াইয়া আছি।

চিত্রা বাইরে বেরিয়ে এলো। সারাদিন পরিশ্রম করে রূপক বাসায় ফেরার পর রাত্রিবেলা তাঁর ঘুম ভাঙ্গাতে ও চিত্রার ভালো লাগেনা। মনে সাহস করে সে এগিয়ে গেল পুকুর ঘাটের দিকে। বদনায় পানি নেই। হাতের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে সামনে এগোচ্ছিল চিত্রা। হঠাৎ কি মনে করে এসে পুকুর ঘাটের চারিদিকে ও বাড়ির আশেপাশে একবার লাইট দিয়ে পরখ করলো। তার মনে হলো পিছনের বাগানে কেউ একজন দৌড়ে পালিয়ে গেল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেছে সে। এত রাতে এখানে কারো থাকার কথা নয়। দৌড়ানো মানেই তো বিষয়টা সন্দেহজনক। চিত্রা ঘাট থেকে পানি নিয়ে পায়খানায় গেল। পায়খানা থেকে বের হয়ে ঘরে যেতে যেতে টর্চ বন্ধ করে ফেলল। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৌতুহল তার সমস্ত ভয় দূর করে দিয়েছে। কেন যেন মনে হলো সে রুবিনার ওড়না রং দেখেছে। এত রাতে বাগানে রুবিনার দৌড়াদৌড়ি করার কথা নয়। একদিকে তার মনে ভয় অন্যদিকে কৌতুহল। চিত্রা লাইট বন্ধ রেখে গুটি গুটি পায়ে। চিত্রা লাইট বন্ধ রেখে গুটিগুটি পায়ে পিছন দিকটা এসে দাঁড়ালো। কোন সাড়াশব্দ নেই। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। অনেকক্ষণ পর শোনা গেল পাতার মর্মর শব্দ। খসখস আওয়াজ তুলে কেউ একজন যেন হেঁটে যাচ্ছে। তবে আওয়াজটা এমন সে খুব সতর্কভাবে হাঁটছে যেন শব্দ না হয়। সেদিকে লাইট জ্বালালো চিত্রা। দেখতে পেল গ্রামের পরিচিত এক ছেলেকে। লাইটের আলো ধরতেই দৌড়ে ছেলেটা দ্রুত আড়াল হয়ে গেল। চিত্রা দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। তার মনে হচ্ছিল গাছের আড়াল থেকে হয়তো রুবিনা বের হয়ে আসবে। কিন্তু রুবিনাকে আসতে দেখতে না পেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হতাশ হয়ে চিত্রা ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখলো বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে রূপক। রূপককে কথাটা বলবে কিনা চিত্রা বুঝতে পারল না। তবে বাগানে রুবিনার উড়নার মত কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল সে। এখন তার মনটা উসখুস করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে রুবিনা ঐ ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
ঘরে থাকতে না পেরে চিত্রার ঘর থেকে বেরিয়ে রুবিনার ঘরের দরজায় এসে টোকা দিল। দরজা ভেজানো। খোলা মাত্রই দেখল ভিতরে কেউ নেই। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বিছানার উপরে বসে রইল চিত্রা। রুবিনার এখনো ফেরার কোনো নাম নেই। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর দরজা খোলার আওয়াজ হলো। ঘরের ভেতর চিত্রাকে বসে থাকতে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠল রুবিনা। চিৎকার করতে করতে ও নিজেকে সামলে নিল। তারপর দৌড়ে এসে চিত্রার পা দুটো জড়িয়ে ধরল, ভাবি তুমি কাউরে কিছু কইও না। আমি ভাবছিলাম তুমি আম্মারে জাগাইছ। আইসা দেখি সবাই ঘুমে। তুমি কাউরে কিছু কও নাই। দোহাই লাগে তুমি কাউরে কিছু কইওনা। তুমি যা কইবা আমি তাই শুনুন ভাবি। আমার ভুল হইয়া গেছে।

চিত্রার কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। সে রুবিনার হাত ধরে বলল, তোমার সম্মান মানে আমার সম্মান। আমি তোমার সম্মান নষ্ট করতে চাই না বোন। তোমার গা কাঁপতাছে। উইঠা বস। আমার পা ছাইরা দাও।

না, ভাবি। আপনি আগে কোন কাউরে কিছু কইবেন না।
কাউরে কিছু কমু না। তুমি উঠো। শান্ত হইয়া বস। এখন আমার ওই পোলার ব্যাপারে বিস্তারিত কও।

ওরে তো আপনি চেনেন। ওর নাম শিমুল।
হ, তার লগে তোমার কি ব্যাপার সেইটা কও।
ওর লগে আমার সম্পর্ক চলে। অনেকদিনের রিলেশন। আইজ রাইতে আমি ওর লগে দেখা করতে চাই নাই। শিমুল খুব জোর করতে ছিল। কইসিলো আজ দেখা না করলে আমার লগে রাগ করবো। ও রাগ করলে আমি সইতে পারিনা। আমার অনেক কষ্ট হয়। তাই ঘরের বাহির হইছিলাম।
তোমাদের রিলেশন কেমন?
কেমন মানে?
ও তোমারে ভালোবাসে?
হুম ।
রিলেশন কতদূর গড়াইছে? খালি দেখা করছ নাকি দেখা কইরা অন্য কিছু করছ?
রুবিনা চুপ করে রইলো। তার মাথাটা নিচু করা। থুতনি বুকের সঙ্গে লাগানো। দ্রুত ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
চিত্রা বলল আমি কাউকে কিছু কমুনা। তোমার ভাইরেও কমু না। আমারই শুধু কও সম্পর্ক কতদূর?
রবিনা লাজুক শ্বরে আমতা আমতা করে বলল, মেইন জিনিস টা বাদে বাকি সব হইয়া গেছে।
বুকে হাত দিছে?
রবিনা আসতে করে মাথা নাড়ালো, হু ।
ওই জিনিস বাদ দিয়া সব হইয়া গেছে?
হ ভাবি।
প্রতিদিন দেখা করলে মেলামেশা করো?
মাঝে মাঝে দেখা করি। যেদিন দেখা করি সেদিনই কাছে আসে।
ওকি তোমারে বিয়া করব?
ও তো বলে করব।
ওর লগে যদি তোমার বিয়ে না হয়?
না, হইলে আমি তো কিছুই করতে পারুম না। আমি ওরে বিশ্বাস করি। শিমুল ভালো ছেলে। আমি আপনার লগে ওরে কথা বলাইয়া দিমু ভাবি।
তোমার ভাইয়ের এক মাইয়ার লগে প্রেম ছিল। আমি শুনছি। তার লগে তোমার ভাইয়ের বিয়া হয় নাই। তোমার ভাই কিন্তু ভালো ছেলে । তোমারও তো এমন হইতে পারে। বিয়া না হইলে কি এই স্মৃতিগুলো ভুলতে পারবা।
কি আর করবো ভাবি? ভালোবাসি ওরে । প্রেম যখন করি কাছে পাইতে তো মন চাইবো। আপনি তো সবই বুঝেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন ঘুমাইয়া পড়ো। কালকে তোমার লগে কথা কমু। তোমার ভাই আবার জাইগা গেলে আমারে খুজবো।
ভাবী আপনি কিন্তু কাউরে কিছু কইবেন না।
আরে পাগলি আমি তো কইছি কমু না। আমারে বিশ্বাস করো। টেনশন কইরো না। এখন মেলা রাইত। ঘুমাইয়া পড়ো।

চিত্রা তার নিজের ঘরে চলে এলো। বেরিয়ে আসার সময় শুনতে পেল রুবিনার দরজা আটকে দেয়ার শব্দ। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে অনেক রাত পার হয়ে গেল। আর কিছুতেই ঘুম এলো না তার নীরব দুটি চোখে।

চলবে..