দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-৩৩+৩৪

0
310

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ৩৩+৩৪
নীলাভ্র জহির

আজ চিত্রার সঙ্গে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। পুকুরঘাটে পা পিছলে গিয়েছে তার। তবে মাটিতে না পড়ে সরাসরি পানিতে গিয়ে পড়ার কারণে খুব একটা আঘাত পায়নি। তবুও দুশ্চিন্তা থেকেই যায় । তাইতো শরীরে আঘাত না লাগলেও জোসনা বেগম এই ঘটনার পর থেকেই তাকে মানসিকভাবে আঘাত করে যাচ্ছেন। ঘরে শুয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছে চিত্রা।
জোসনা খবর পাঠিয়ে রূপককে বাড়িতে আসতে বলেছিলেন। রূপক আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রলাপ বকতে শুরু করলেন, এই মাইয়ারে দিয়া সংসার হইবো না। আমি তোরে আগেই কইছি। আমরাও পোলাপাইন পেটে ধরেছি। পোলা পেটে আসার পর থাইকা মনে করতাম আমি আর আমি নাই। একটা দম ছাড়লেও অনেক সতর্ক হইয়া দম ছাড়তাম। ওই মাইয়া কেমনে পুকুরঘাটে পিছলাইয়া গেল। যেইখানে পিছলা ঐখান দিয়ে ওরে কেন পা দিতে হইব? শুকনা জায়গায় পা দিতে পারল না? আর আমি কই তুই যদি পুকুর ঘাটে গোসল করতে নাই পারস তোরে পুকুরে নামতে কইছে কিডা? তুই কলের পানি দিয়া গোসল করতে পারোস না? আমারে যদি কইতি আম্মা আমারে এক বালতি পানি তুইলা দেন আমি তো ঠিকই এক বালতি পানি উঠাইয়া দিতাম। সব কাম করতে পারতাছি আর এক বালতি পানি তুইলা দিতে পারতাম না? তোরে তো আমি রাজ রানীর মত কইরা রাখছি। সবার ঘরে গিয়া দেখ বউরে দিয়া গু মুত পর্যন্ত ধোয়ায়। আমিতো তোরে কত আরামে রাখছি, রানীর মতন। এই সংসারে আমি এতগুলো বছর ধইরা খাটতাছি। তারপরও তোরে কোনদিন কই না যে বৌমা এই কামটা আমারে কইরা দেও। তারপরও তুই কেন পুকুর ঘাটে গোসল করবি। তুই কেন পা পিছলাইয়া পরবি? আজ যদি আমার নাতির কিছু হইয়া যায়, তখন কি হইব? আমার পোলায় তো তার সাত খুন মাফ কইরা দেয়।

রূপক স্থির চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ-মুখে ভর করেছে কাঠিন্য।
জোসনা বললেন, আমি কিন্তু আর সহ্য করুম না। পোয়াতি মাইয়া একটু হুস কইরা চলাফেরা করে না। আমি ওরে দিয়া সংসারের একটা কাম করাই না। আমি তারে সবসময় রেস্টে থাকতে কই। তাও সে পইড়া যায়।
রুপক জোসনা কে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি চুপ করো। আমি দেখতেছি।
তুই কি দেখবি সেটা আমার জানা আছে। একটা কথা আইজ আমি পরিষ্কার কইরা কইতাছি, এই মাইয়ারে দিয়া সংসার হইবো না। সংসারে তার কোন মন নাই। সারাডা ক্ষণ খালি উড়ু উড়ু করে। তুই দেইখা লইস আমার কথা।

রূপক নিজের ঘরে এসে দরজা ধরে দাঁড়াল। চোখের জল মুছছে আঁচলে। ভেজা গলায় বলল, আমি অনেক সতর্ক হইয়া ছিলাম। তারপরও কেমনে পইড়া গেছি আমি জানিনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রূপক, আমার মায়ে তোমার উপর খুব রাগ করছে।
জানি। উনি আমারে একেবারে সহ্য করবার পারতাছে না।
স্বাভাবিক। তোমার চালচলন ইদানিং খুবই খারাপ হইয়া গেছে। এমন করলে কেমনে হইব?
আপনেরও কি তেমন মনে হইতাছে?
কি?
আমারে সহ্য করবার পারতেছেন না?
রূপক চুপ করে রইলো। আবারও চোখের জল মুছল চিত্রা। রুপক শক্তভাবেই দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
চিত্রা বলল, কয়টা দিন থাইকা আম্মা খালি সারাটা দিন একই কথা কয়। আমারে দিয়া সংসার হইবো না। সারাদিন আমারে শুনায় আমি আপনার যোগ্য না। আপনিও কি তাই মনে করেন?
কোন উত্তর নেই রূপকের। সে স্থবির। দুপুরের কাঠফাটা রোদ্দুরে গরমের তীব্রতা যেন আরো বেড়ে গেছে। কুলকুল করে ঘাম ছিল সে। শার্টের বোতাম খুলে শার্টটা দরজার উপরে রেখে সে চেয়ারের ওপর এসে বসলো। তার ঘাড় বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। জানালা দিয়ে কোন বাতাসও আসছে না।
চিত্রা বলল, আপনি আমারে কইয়া দেন। আপনারও যদি আমারে খুব অসহ্য লাগে, আমারে যদি আপনার যোগ্য মনে না হয়, তাইলে কন। আমি আপনারে শান্তি দিয়া চইলা যামু।
কই যাইবা?
যেইখানে দুইচোখ যায়। ভয় পাইয়েন না। আপনার পোলারে নিয়া যমুনা। পোলা জন্ম দিয়া তারপর যামু। কয়টা মাস তো কাইটাই গেছে। আর তো কয়টা দিন। কষ্ট কইরা পইড়া থাকমু। পোলা জন্ম দিয়া আপনার কাছে রাইখা আমি চইলা যামু। জীবনে আর আমার মুখ দেখামু না।
চুপ করে রইল রূপক।
চিত্রে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ছোট থাইকা অনেক কষ্ট কইরা বড় হইছি। আমার জীবনে কষ্ট বইলা কিছু নাই। সব সইয়া গেছে। নিজেরে মনে হইতাছে আপনার কান্দের বোঝা। গলার কাঁটা হইয়া বিনছি। কাটা বমি কইরা ফেলতেও পারতাছেন না, গিলতেও পারতাছেন না।
– এইসব কথা বাদ দাও। মন মেজাজ ভালো নাই। শুইয়া রেস্ট নাও। এখন থাইকা একটু সাবধান হইয়া চলাফেরা কইরো। গোসল দেয়ার আগে আমার মারে কইও তোমারে পানি তুইলা দিব। আর পুকুর ঘাটে নাইমো না।
– পানি তো তুইলা দিব। কিন্তু মন থাইকা তো দিবোনা। তিনি আমার উপর খুব রাগ কইরা আছেন। তিনি আমারে দেখবার পারেন না। তারপর কেমনে উনারে কমু আমারে পানি তুইলা দেন?
– আমার মা তোমারে দেখতে পারে না এটা মিছা কথা। তোমার আচার আচরণের জন্য তিনি একটু রাগ করছেন। আর কিছু না।
– সেজন্য সারাদিন আমারে শুনান আমি আপনার যোগ্য না।
– এসব কথা কানে নিও না। তুমি আমার যোগ্য না হইলেও এখন তো তুমি আমার স্ত্রী। তোমারে তো আর ফেইলা দিতে পারব না।
– পারবেন না কেন? আপনার মায়ের আচার-আচরণ তো কইয়া দেয় তিনি আমারে ফেলাই দিবেন।
– তোমারে বিয়া রাইতেই একটা কথা কইছিলাম। আমার মায়ের মাথাটা একটু গরম। কখন কি কয় তার কোনো ঠিক নাই। তুমি সহ্য কইরা যাও। মার লগে কোন তর্কে যাইওনা।

চিত্রা চুপ করে রইলো। রূপকের সঙ্গে আর কোনো কথা হয় না তার। ভরদুপুরে কাঠফাটা রোদে ঘর থেকে বের হয়ে যায় রূপক। সে কোথায় যায় তা জানতে ইচ্ছে করলেও চিত্রা কোন প্রশ্ন করে না। কেবল বিছানায় শুয়ে শাড়ির আঁচলে চোখের জল মুছে। আর মনে মনে ভাবে তার জীবনে কি তবে কষ্টগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়ে গেল? ঠিক এই কারণেই কি শুরু থেকেই তার মনে শঙ্কা ছিল এত সুখ তার কপালে সইবে না?

জোসনা বেগম এখন আর রান্নার পর চিত্রাকে খেতে ডাকেন না। রূপক দোকানে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়া করে ভাত খেয়ে দোকানে চলে যায়। চিত্রা খেয়েছে কিনা তা কেউ জানতেও চায় না। চিত্রার মন খারাপ হয়। অসহায় লাগে নিজেকে। কিছু খেতে ইচ্ছা করে না। তবুও সে জোর করে একটু খাবার মুখে দেয়। কারণ দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। আশে পাশের বাড়ির মানুষজন বলাবলি করছে গর্ভাবস্থায় মেয়েরা মোটা হয় আর চিত্রা শুকিয়ে যাচ্ছে। চিত্রার বাচ্চা অসুস্থ হবে, অপুষ্টিতে ভুগবে, এই ধরনের নানান কথা শোনায় তাকে। মানুষের কথা শুনে তারও খুব ভয় জাগে মনে। ইচ্ছে করে এখন থেকে ভালো মতো খাবার খাবে। সবাই তাকে বুদ্ধি দেয় দিনে বেশ কয়েকবার করে খাবার খেতে। কিন্তু তার কোন খাবারের রুচি নেই। দুইবার খাবার মুখে দিলে একবার ফেলে দিতে হয়। কারণ খাবার কেবল চিবিয়ে গেলেই হয় না, গিলতেও হয়। তার গলা দিয়ে খাবার নামে না।

স্বামী-স্ত্রী কেবল পাশাপাশি শুয়ে থাকে। চোখে ঘুম এলে দুজনে ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন বহুবছর একজন আরেকজনকে স্পর্শ করে না। কেউ কারো দিকে তাকায় না পর্যন্ত। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথাও হয়না তাদের। ক্রমাগত মনের দূরত্ব কেবল বেড়েই চলছে। একই ঘরে থাকলেই মানুষ আপন হয় না। পাশাপাশি ঘুমালেও দুজনের মাঝে আকাশ সম দূরত্ব থাকতে পারে।

এদিকে মঞ্জু মিয়ার মেয়ে মৌসুমী জামার ডিজাইন বলে দেয়ার অজুহাতে বেশ কয়েকবার রূপকের দোকানে এসেছে। সে রূপকের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে কথা বলে। তার হাসিতে যেন মুক্তা ঝরে। সাদা সাদা দাঁত যেন স্বচ্ছ পাথর। প্রাণখোলা হাসি হাসতে হাসতে বলে, ভাইয়া আমার কিন্তু গলায় এই ডিজাইন টা দিতে হবে। জামার হাতা কিন্তু থ্রি-কোয়ার্টার দিয়েন।
রূপক হাসার চেষ্টা করে উত্তর দেয়, ঠিক আছে। জামার মাপ তো দিয়া যান নাই। একটা জামা দিয়ে যাইয়েন।
মৌসুমী বলে, আচ্ছা ঠিক আছে। কাল কলেজ যাওয়ার সময় একটা জামা নিয়া আসবো।

পরের দিন কলেজ যাওয়ার সময় সে আবার রূপকের দোকানে আসলো। তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে সে রূপকের দোকানে রাখে। তারপর মুচকি হেসে বলল , ব্যাগটা খুইলা দেইখেন। মা পিঠা বানাই ছিল। বাটিতে কইরা কয়টা পিঠা দিছে।
রূপক আন্তরিকতার সহিত ধন্যবাদ জানায়। মুচকি হেসে চলে যায় মৌসুমী। কিন্তু রূপকের মনে যন্ত্রণা হয়। এই মেয়েটাকে মা তার পিছনে নিশ্চয়ই লেলিয়ে দিয়েছে। নয়তো তার প্রতি মেয়েটার এত দরদ কেন? কেন সে বারবার আসে তার দোকানে? আর কেনই বা হেসে হেসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে এত সুন্দর করে কথা বলে? মা চায় এই মেয়েটাকে পুত্রবধূ করতে। কিন্তু চিত্রার প্রতি মন উঠে গেলেও রূপক এতো সহজেই আর কাউকে মন দিতে পারবে না। আজকাল চিত্রার জন্য তার কষ্ট হয়। মন চায় সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলতে। কিন্তু কিসের যেন একটা দেয়াল মাঝখানে দুজনকে দুই পৃথিবীতে রেখেছে। সে চাইলেও সেই দেয়াল ভেঙে চিত্রার কাছে যেতে পারে না। সবকিছুর আগে তার মনে হয় চিত্রা বেইমান। চিত্রা তাকে ঠকিয়েছে। চিত্রার প্রতি আগের মতো মায়া কিংবা প্রেমটা ঠিক আসে না। ঘরে কিংবা দোকানে কোথাও এসে একটু শান্তি পায় না রূপক। সারাক্ষণ তার মনে অশান্তি। এই অশান্তি থেকে সে বের হয়ে আসতে চায়। কিন্তু কিভাবে সেটা সম্ভব রূপক জানেনা?

এমন অশান্তির একদিনে হঠাৎ তার ফোনে একটা রং নাম্বার থেকে কল এলো। দোকানে কাজ করছিল রূপক। ফোন ধরতেই শুনতে পেল একটা মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠস্বর, হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম। কে বলছিলেন?
একটা মিষ্টি হাসির শব্দ শোনা গেল। রিন রিন করে কানে বাজতে লাগল সেই হাসি।
আমি মৌসুমী।
রূপক ভীষণ অবাক হল। জানতে চাইল, আমার নাম্বার কই পাইছেন?
– দর্জি মিয়া খালি কি ইন্দুরের মতো কাপড় কাটাকুটি করলেই হইবো। নাকি মাথায় একটু জ্ঞান বুদ্ধি ও থাকতে হইবো।
বলেই আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল মেয়েটি। রুপক ইতঃস্তত বোধ করতে করতে বলল, আমার কি জ্ঞান বুদ্ধি কম?
– কম না হইলে কেমনে আপনি এই কথা আমাকে জিজ্ঞাস করেন। দোকানের রিসিট এর মধ্যেই তো ফোন নাম্বার দিয়ে রাখছেন। প্রোপাইটর মোহাম্মদ রূপক মিয়া। মোবাইল নাম্বার জিরো ওয়ান সেভেন এইট।
বলতে বলতে মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। তার বলার ধরন শুনে হাসি পেয়ে গেল রূপকের। রূপক নিজেও হেসে ফেলল শব্দ করে।
মৌসুমী বলল, শুনেন এইবার কামের কথায় আসি। আমার জামাটা কি সেলাই করা হইছে?
হ্যাঁ, হইছে। আপনি এসে নিয়ে যাইয়েন।
– আপনি বাড়িত আসার সময় নিয়ে আইসেন। আমাগো বাড়িতে দিয়ে যাইয়েন জামাটা। আমাগো বাড়ির সামনে দিয়েই তো রোজ বাড়িতে যান।
রূপক ইতস্তত করে বলল, আপনি বুঝি রোজ আমারে দেখেন?
– তা কেন দেখতে যামু। আমার কিসের ঠেকা পড়ছে। আপনার বাড়ি থাইকা বাজারে যাওয়ার রাস্তা তো এই একটাই। আপনি যে এই রাস্তা দিয়ে না গিয়া আকাশ দিয়ে উইড়া উইড়া যাইবেন না সেইটা বুঝার জন্য তো আর ওকালতি পাস করুন লাগেনা।

মেয়েটি আবারো খিল খিল করে হেসে উঠল। তার উত্তর শুনে রূপকের এতটাই ভাল লাগল যে বিমোহিত হয়ে অনেকক্ষণ সে কথা বলতে পারল না। মৃদু হেসে রূপক বলল, আসলে আমার জ্ঞান বুদ্ধি কম মনে হইতাছে।
– আপনার মা কয় আপনার অনেক জ্ঞান বুদ্ধি। আমার মনে হইতেছে কি জানেন? কাপড় কাটতে কাটতে ভুল কইরা একটু জ্ঞান বুদ্ধি ও কাইটা ফেলছেন।

মৌসুমী আবারও হেসে উঠলো। আবারো হেসে ফেলল রূপক। মেয়েটি এত চমৎকার করে কথা বলে। এত সুন্দর করে উত্তর দেয় প্রত্যেকটা কথার। এমন বুদ্ধিমতি মেয়ে কখনোই দেখেনি রূপক। তার হাসির রিমঝিম শব্দ অনেকক্ষণ মনের ভেতর বাজনা বাজে। মাথার ভেতর ঘুরতে থাকে সেই হাসি। আর তার সঙ্গে কথা বলার সময় মনটাই ভালো হয়ে যায়।
মৌসুমী বলল, আইজ জামাটা নিয়ে আইসেন। আপনি তো কোনদিনও আমাগো বাড়িতে আসেন নাই। আজকে আইসা একটু পানি খাইয়া যাইয়েন।
– শুধু পানি খাওয়াইবেন?
– আরো কিছু খাইতে চান নাকি?
– যদি খাইতে চাই?
– সস্তা জিনিস চাইলে পাইবেন। দামি জিনিস চাইলে পাইবেন না।
– কেন?
– দামি জিনিসের জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হয়। দামি জিনিস দামি মানুষরে খাওয়াইতে হয়।
রূপক মুচকি হেসে বলল দামি মানুষ হইতে হইলে কি করতে হইবো?
যারা দামি মানুষ তারা এর উত্তর জানে। আর যারা দামি মানুষ না তারা চাইলেও দামি হইতে পারেনা।
তাই নাকি। তাইলে তো আমি দামি মানুষ হইতে পারলাম না। একটু চেষ্টা কইরা কি দেখন যাবে না?
চেষ্টা করতে পারেন। ক্ষতি নাই। জামাটা নিয়ে আইসেন। জামা ভালো হইলে আপনারে শিখাইয়া দিমু নে।
কি শিখাইবেন?
দামি মানুষ কেমনে হইতে হয়।
কথাটা বলেই খিল খিল করে হেসে উঠল মৌসুমী। রুপক বলল, আপনি অনেক সুন্দর কইরা কথা কন।
এই ডায়ালগ অনেক শুনছি। নতুন কিছু থাকলে ঝাড়েন।
হেসে ফেললো রূপক, এই কথা কি দামি মানুষরা কইছে?
না, এগুলো আমি সস্তা মানুষের কথা। দামি মানুষ এইগুলা কয়না।
তারা কি কয়?
কইলাম তো জামাটা নিয়ে আইসেন। জামা ভালো হইলে শিখাইয়া দিমু নে। এখন রাখি।

মৌসুমী কল কেটে দিল। হাসি পাচ্ছে রূপকের। কোন এক অজানা কারণে তার মনটা আজকে ভীষণ ভাল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের ট্রমা কেটে গেছে। অকারণেই তার হাসি পাচ্ছে। কাজ করতে করতে মুখে সারাক্ষণ হাসির রেশ লেগে রইল। আজকে একটা জামা সেলাই করতে গিয়ে গুন গুন করে গান গাইতে লাগল রূপক। দোকানের ছেলেটা জানতে চাইল কিগো রূপক ভাই, আজ মনে এত খুশি?
আজকে কেন জানি মনটা বড়ই ভালো লাগতাছে।
আপনারে খুশি দেখলে আমারও ভালো লাগে ভাই।
রূপক আবার গুন গুন করে গান ধরল। মৌসুমির জামাটা হ্যাঙ্গার থেকে নিচে নামিয়ে সে ভালো করে দেখতে লাগল আসলেই জামাটা সুন্দর হয়েছে কিনা। জামায় কোন খুত থাকা যাবে না। নিখুঁত হতে হবে।

আজকে সন্ধ্যার পরপরই রূপক দোকান থেকে বের হলো। মৌসুমির জামাটা সঙ্গে নিয়েছে। তার বাবা বাজার করে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরেছে। তারও আজ দোকানে মন বসলো না। বেচাকেনা খুব একটা নেই। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার ধারে হওয়া নতুন বাড়ির গেটে রূপক ডাক দিল। দরজা খুলে দিল মৌসুমী ও তার ছোট বোন। পরনে থ্রিপিস ও মাথায় ওড়না দেয়া মৌসুমীর মুখটা লাইটের আলোয় চিকচিক করছে। মনে হচ্ছে গালে ফেস পাউডার মেখে রেখেছে। যেন রূপকের অপেক্ষাতেই ছিল তারা।

মৌসুমী বলল, ভিতরে আসেন।
নতুন বাড়ি। চমৎকার রং করার কারণে বেশ আকর্ষণীয় লাগছে। বাড়ির বারান্দার মেঝে পাকা করা। তার ওপরে কাঠ দিয়ে বানানো লম্বা সোফা। সোফার ওপর কোন ফর্ম নেই। শক্ত সোফা। সেখানে রূপক কে বসতে দেয়া হলো। বারান্দার একদিকে একটা বড় খাবার টেবিল। টেবিলের ওপর পানির জগ ও গ্লাস। সৌরবিদ্যুতের আলো জ্বলছে। বারান্দা থেকে ঘরের ভিতরে তাকালে একটা সুন্দর কাঠের খাট চোখে পড়ল। সম্ভবত ডিজাইন করা বক্স খাট।
মঞ্জু মিয়ার স্ত্রী আসতেই রূপক তাকে সালাম জানালো। মহিলা বললেন, কেমন আছেন বাবা?
জি আছি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
ভালোই আছি।
চাচাজান বাড়িত নাই?
তিনি এখনো ফিরেন নাই। তা আপনার আব্বা আম্মা ভালো আছে?
হ, চাচি ভালো আছে।
আপনার আম্মারে কালকে আসতে কইয়েন। উনিত দুই দিন হইলো আসেনা।
আপনি তো একদিনও আমাগো বাড়িতে আইলেন না।
যামু। সারাদিন অনেক কাম কাজ থাকে। সময়ই পাই না। আর আপনার চাচাজান বাড়িতে থাকলে কোথাও বের হইতে পারি না।

মৌসুমী একটা ট্রেতে করে নাস্তা পানি নিয়ে এসে রাখল টেবিলে। তারপর রূপককে ডেকে বললো ভাইয়া নাস্তা খাইতে আসেন।
মহিলা বললেন যান বাবা নাস্তা খাইয়া লন।
চাচী এইসব কোন দরকার আছিল না।

রূপক বাড়িতে ঢোকার সময়ই মৌসুমীর হাতে জামার ব্যাগটা দিয়ে দিয়েছিল। নাস্তার প্লেট টেবিলে রেখেই মৌসুমী ঘরে গিয়ে নতুন জামা পরে ফেলল। তারপর জামাটা দেখতে দেখতে মাকে এসে দেখাতে লাগলো, মা দেখতো জামা কি ভালো হইছে। আমারে কেমন লাগতাছে?
সুন্দর লাগতাছে। তোর গায়ে ফুটছে।
আমারে সব জামাতেই সুন্দর লাগে।
মৌসুমীর ছোট বোন বলল, তোরে একটুও ভালো লাগতেছে না আপু।
তুই তো সেইটাই কইবি। তোরে বানাইয়া দেয় নাই সেইজন্য।
দুই বোন মিলে খুনসুটি শুরু করে দিল। মঞ্জু মিয়ার স্ত্রী চোখ রাঙ্গালেন। নাস্তার টেবিলের পাশে চেয়ার ধরে দাঁড়াল মৌসুমী। রূপক নাস্তা খাওয়া শুরু করেছে। সে বলল, শরবত কেমন হইছে?
ভালো। চিনি একটু বেশি হইছে।
সবাই কয় আমি অনেক মিষ্টি একটা মাইয়া। আমি যেইটাই ধরি সেইটাই মিষ্টি হইয়া যায়।
মৌসুমির মা খানিকটা রেগে বললেন, তুই ঘরে যা তো।
মৌসুমী হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে চলে গেল ঘরে।

মৌসুমির মা জামার সেলাইয়ের টাকাটা রূপকের হাতে এনে দিলেন। নাস্তা শেষ করে রূপক বলল, আজকে আমি যাই। মৌসুমী তখন ঘরে। আর বের হলো না। রূপকের ইচ্ছা করছিল মৌসুমীর সঙ্গে একটু কথা বলতে। সে কয়েকবার ঘরের দিকে তাকালেও মৌসুমীকে দেখতে পেল না।
রাস্তায় এসে মৌসুমীর নাম্বারে কল দিল রূপক। একবার রিং হতেই কলটা রিসিভ হল। খিলখিল হাসির শব্দ শোনা গেল ওপাশ থেকে।

হাসির ঝংকার শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো রূপক। এমন প্রাণখোলা হাসির শব্দ শুনতে ও ভালো লাগে। হাসি থামিয়ে মৌসুমী বলল, জামা তো ভালো হয় নাই।
কি কন? জামা ভালো হয় নাই? নাকি যেইটা শিখাইতে চাইছিলেন শিখানোর ভয়ে এই কথা কইতাছেন?
হেসে মৌসুমী বলল, আপনি তো দেখি একটু চালাকও আছেন। একেবারে বোকাও না।
রূপক হাসতে হাসতে বলল, পুরুষ মানুষ যতই চালাক হোক মাইয়া মানুষের কাছে তারা আজীবন বোকাই।
তাই নাকি। এটা কোন মাইয়া মানুষ আপনারে কইসে?
কেউ করে নাই। কিছু কিছু জিনিস কওন লাগে না। তা আপনি তো কইলেন আপনি যেইটা হাত দিয়ে ধরেন সেইটাই মিষ্টি হইয়া যায়। চানাচুর মিষ্টি লাগলো না কেন? চানাচুর টা তো খুবই ঝাল লাগলো।
আরে বোকা, চানাচুর তো আমি হাত দিয়ে ধরি নাই। ওইটা আমার ছোটবোন প্যাকেট থাইকা আপনারে খাইতে দিসে।
ও আচ্ছা। আপনি তো মিছা কথাও কইতে পারেন দেখছি।
হ, মানুষের মন পাওনের লাইগা মিছা কথা কইলে কিছু হয় না।
দামী মানুষ হইতে হইলে মিছা কথাও কইতে হইবো নাকি?
এত অধৈর্য হলে চলে? সময় হইলে শিখাইয়া দিমু নে। এখন রাখি। আমার মায়ে শুনলে মাইর একটাও মাটিত পরবো না।

মৌসুমী কল কেটে দিল। ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরল রূপক। ঘরে ঢুকেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। চিত্রা বিছানায় শুয়ে আছে। সারাক্ষণ শুয়ে থাকা ছাড়া কি তার আর কোন কাজ নেই নাকি? আজকাল খুব অসহ্য লাগে চিত্রাকে। কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তাকে দেখলেও মেজাজটা কেমন বিগড়ে যায়।
রূপক শার্ট খুলে রেখে আবারো ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। বারান্দায় বসে দখিনা বাতাস খেতে খেতে গান গাইতে লাগল সে। চিত্রা বিছানায় শুয়ে টের পায় আজ রূপকের মনটা বড় ভালো। অথচ এই ভালো থাকায় চিত্রা থাকতে পারল না। তার আফসোস হয়। চিত্রা ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে বসলো। তাকে দেখে গান বন্ধ করলো রূপক। মোবাইলে একটা বাংলা সিনেমা বের করে সেটা দেখতে লাগলো।
জোসনা বেগম বললেন, কিরে ভাত খাবি এখন?
না, মা । নাস্তা খাইয়া আইছি।
আমি তাইলে ভাত খাইয়া লই।
জোসনা বেগম খাবারের আয়োজন করে তার স্বামীকে নিয়ে খেতে বসলেন। চিত্রকে ডাকলেন না। বারান্দার একদিকে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ভাত খাচ্ছেন জোসনা। আর বারান্দার অন্যদিকে বসে রুপক সিনেমা দেখছে। রূপকের বেশ কাছাকাছি বসে চিত্রা দেয়ালে হেলান দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে যে এই বাড়িতে আছে তা যেন কারো মনেই নেই। সামনে বসা রূপক একটিবারের জন্যও তার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন মনে করছে না। আবার জোসনা বেগম একাই খাবার খাচ্ছেন। চিত্রাকে একটিবার খেতে ডাকার অবকাশ নেই। নিজেকে ভীষণ আবর্জনার মত মনে হলো চিত্রার। এ বাড়িতে কেউ তাকে সামান্যতম মূল্যায়ন করেনা। সে সবার কাছে নর্দমার কীটের মতো। কিংবা বৃক্ষের ওপর বেড়ে ওঠা আগাছার মত। থাকলেও যন্ত্রনা, না থাকলে কিছুই যায় আসে না।
চিত্রা হাল ছেড়ে দিয়ে ঘরের ভেতরে এসে বসলো।
ভাত খাওয়া হলে রূপক তার বাবা-মাকে কাছে ডেকে বলল, আব্বা একটা কথা চিন্তা করতাছি। বাড়িটা ফাঁকা কইরা ফেলমু। আয় উন্নতি মেলা করছি। একটা বিল্ডিং বাড়ি না হইলে কেমন জানি লাগে। এখন একটা বাড়ি করাই যায় কি কন আব্বা?
জোসনা বললেন, বইনের বিয়ার আগে বাড়ি করলি না কেন? বাড়িঘর ভাল হইলে আরো ভালো কইরা মাইয়ারে বিয়া দিতে পারতাম।
রূপকের বাবা বললেন, তোমার মাইয়া ওই পোলার সঙ্গে কথাবার্তা কইতো। সে নিজেই চাইছে ওই পোলারে বিয়া করতে। এইখানে আরো ভালো ঘর তুমি আশা কেমনে কর?
মুখ বাকা করলেন জোসনা বেগম। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, কি জানি বাবা আমার পোলা-মাইয়া দুইটার কপালই খারাপ। পুলাডা আমার এত ভালো , গিরামের সবচাইতে যোগ্য পোলা। অথচ এমন ঘরে তার বিয়া হইলো, একটা বদনাও পাইলাম না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জোসনা বেগম। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আবারও বললেন, মাইয়াডার কপালেও তাই। আমার মাইয়া ভালোই সুন্দর আছিল। আমাগো টাকা-পয়সাও যতটুকু হওয়ার ভালই আছে। তাও তো ভালো ঘরে মাইয়া দিবার পারলাম না। কপালে ছিল!
রূপক বলল, এইসব কথা কইয়া লাভ নাই মা। রুবিনা সুখে আছে সেটা দেখলে ভাই হিসেবে আমি শান্তি পামু। এইটাই বড় কথা। এখন বাড়িটা পাকা করতে চাইতাছি। তিনডা ঘর করমু। একটা রুম আমার, একটা তোমাগো আর একটায় জিনিসপত্র রাখবা, মেহমান আইলে ওই রুমে থাকবো। রুবিনা যখন জামাই নিয়ে বেড়াইতে আসবো, থাকতে পারবো। তিনটা ঘরেই হইয়া যাইব। কি কন আব্বা?
তোর আবার পোলা মাইয়া হইলে তার জন্য একটা ঘর লাগবোনা?
পোলা মাইয়া বড় হইতে হইতে তখন আরেকটা ঘর করা যাইবো। তাগো কথা এখনই চিন্তা কইরা টাকা পয়সা খরচ করার দরকার কি । আমি চাইতেছি বাড়ি করলে করার মত কইরা করমু। গ্রামের লোকজন সবাই তাকায় থাকবো। সুন্দর কইরা কালার করমু। সামনে বারান্দা দিমু, একটা সুন্দর গেট বানামু। মা কি কও?
জ্যোৎস্না উৎসুক হয়ে বললেন, তুই যা ভালো বুঝিস। এতদিন তোর বাপ যাই রোজগার করছে তোদেরকে মানুষ কইরা একটু সংসারে উন্নতি করছি। দোকানটা বড় করছি, জায়গা জমি কিনছি। পাকা বাড়ি আমরা বহু আগেই করতে পারতাম। তাইলে এখন আর এত ভাল কইরা চলতে পারতাম না।
এখন তো জমা-জমি অনেক হইছে। এখনই বাড়ি করার উপযুক্ত সময় ।
হাতে তো নগদ টাকা পয়সার নাই । দক্ষিণ পাড়ার দুইটা জমি বিক্রি কইরা বাড়ির কাম শুরু কইরা দেই। কি কন আব্বা?

রূপকের বাবা মাথা নাড়লেন, ঠিক আছে। আমি তাইলে খদ্দের দেখি।
রূপকের বাবা উঠে গেলে জোসনা বেগম বললেন, ঘর কোন পাশে দিবি?
রাস্তার ধার দিয়ে। মঞ্জু চাচার বাড়ি টা এত সুন্দর হইছে মা, রাস্তা থাইকা দেখা যায়। খুব ভালো লাগে। ভিতরের ঘরগুলাও সেইরম সুন্দর। বারান্দায় খাওয়ার জায়গা করছে, ডাইনিং টেবিল চেয়ার। খাইতে বসলেই একটা রাজা রাজার মত লাগে। যদি এইরকম রাজার মত নাই থাকতে পারলাম তাইলে এত টাকা পয়সা কামাই কইরা কী লাভ?
হ, ঠিক কইছস। তুই মঞ্জু ভাইয়ের বাড়িত কবে গেলি?
আজ গেছিলাম। জামা দিয়ে আসছি। চাচি এত যত্ন কইরা নাস্তা পানি খাওয়াইলো। বিশ টাকা কম চাইছিলাম, কম দিবেনা উনি। বেশি কইরা দিল।
জ্যোৎস্না হেসে বললেন, ওরা মানুষ ভালো। মাইয়ার লগে দেখা হইছে?
হ,
জোসনার নিশ্চয়ই আরও কিছু জানতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু লজ্জায় তিনি কোন প্রশ্ন করতে পারলেন না। কেবল ছেলের চোখের দিকে উৎসুক মুখে তাকিয়ে রইলেন। রূপক সেটা বুঝতে পেরেও বিষয়টা এড়িয়ে গেল। কারণ তার দরজার পাশেই চৌকিতে চিত্রা শুয়ে আছে। সে নিশ্চয়ই সব কথা শুনতে পারছে। তাই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য রূপক বলল, আমাগো বাগানে কয়টা গাছ বড় হইছে না মা? মেহগনি আর আমের গাছ?
হ, মোটাসোটা হইছে।
গাছ কাইটা ঘরের ফার্নিচার বানামু। বিল্ডিং ঘরের ভিতরে ফার্নিচার না থাকলে ভালো লাগবো না। বক্স খাট বানামু।
জোসনা মুচকি হেসে বললেন, পোলার আমার কত শখ জাগছে। মঞ্জু ভাইয়ের বাড়িতে দেইখা তোর হাউশ হইছে?
রূপক বলল, হাউশ না মা। আব্বা সারা জীবন খাটাখাটি করছে। তুমিও কম করো নাই। এখন একটু ভালো কইরা না থাকলে কিসের আর জীবন?
তুই কিন্তু বিয়া করলে ঘরের ফার্নিচার সব পাবি।
আমারে এসব কইবা না।
কেন কমুনা? শশুর বাড়ি থাইকা সবকিছু পাইতি। অন্য ঘরে বিয়ে দিলে ঘর ভইরা জিনিসপাতি দিতো।

এমন সময় চিত্রা দরজায় এসে দাঁড়ালো। নরম স্বরে বলল, আপনি নিজের মাইয়ারে কি দিছেন আম্মা? ঘরের ফার্নিচার আর এক লাখ টাকা চাইছিল, আপনিতো মুখের উপর না কইরা দিছিলেন। কইছেন বিয়া হইলে হোক, না হইলে না হউক। এমন লোভীর ঘরে মাইয়া বিয়া দিবেন না। আবার ছেলের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টাটা করতাছেন?

জোসনা বেগম চমকে উঠলেন। খুব ঠান্ডা স্বরে কথাগুলো বলে গেলেও কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগলো। তার কথায় কোন উত্তাপ ছিল না। সে ঝগড়ার উদ্দেশ্যে কথাটা বলেনি। তবুও সহ্য করতে পারলেন না জোসনা বেগম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আমার পোলা-মাইয়া লাখে একটা। কেউই অযোগ্য না। তারা সব দিক দিয়া নাম্বার ওয়ান। এমন মাইয়া আমি টাকা পয়সা দিয়ে বিয়ে দিমু?
তো অন্য ঘরে পোলার বিয়া দিলে আপনি কি কানা বোবা মাইয়া নিয়ে আসতেন নাকি? নাকি ল্যাংড়া মাইয়া নিয়া আসতেন? না, ঠিকই আছে। ল্যাংড়া মাইয়ারে বিয়া কইরা আনলে তো টাকা পয়সা নিবেন ই ।

জোসনা বেগম কটমট করে রেগে রূপকের দিকে তাকালেন, দেখছস? শুনছস তোর বউয়ের কথা? আমার লগে কেমন কইরা কথা কইতাছে।
রূপক বলল, তুমি আমাগো মা ছেলের মধ্যে কথা কইতাছো কেন?
সত্য কথা কারও মাঝখানে কইলে কিছু হয় না। উনি বিয়ার পর থেইকা আল্লাহর প্রত্যেকটা দিন আমারে এই একটা কথা শোনান। অন্য ঘরে বিয়া দিলে ঘর ভইরা জিনিস দিত, পোলারে রাজা-বাদশা বানাইয়া দিত। মানুষের জিনিসের এত লোভ কেন? নিজে তো মাইয়া বিয়ার সময়ে টাকা দিতেই রাজি হইলেন না। নিজের বেলায় উল্টা হইবো কেন?
ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন জোসনা বেগম। তার মুখের উপর কেউ কখনো এভাবে কথা বলেনি। তাই এমন কটু কথা তার জন্য মেনে নেয়াটা কষ্টকর ছিল। তিনি রূপকের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কত বড় বেয়াদব দেখছোস? আমার লগে কিভাবে কথা কয়? তোরে আগেই কইছিলাম। আমরা মানুষ চিনতে ভুল করছি। যারে বেশি মাথায় তুলছি সে এখন আমাগো মাথায় উইঠা নাচতাছে।
চিত্রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সত্যি বলতে তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। আজকে সে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। জোসনা বেগমের অন্যায় সে অনেক সহ্য করেছে। ভবিষ্যতেও সহ্য করতে হবে। কিন্তু যৌতুক নিয়ে তাকে সবসময় খোটা দেয়া টা আজ আর নিতে পারছিল না। তাই যৌক্তিক কথাটা সে না বলে থাকতে পারেনি।
রুপক বলল, তুমি আমার মায়ের লগে এমনে কথা কও কেন? ভদ্রতা শিখ নাই?
চিত্রা উত্তর না দিয়ে আবারও নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। সে জানে রুপক এখন তাকে নানান কথা শোনাবে। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো রূপক তাকে আর কিছুই বলল না। বরং মায়ের হাত ধরে নরম সুরে বলল, মা তুমি এখন ঘরে গিয়া ঘুমাও। আব্বারে কইও জমিজমার ব্যাপারে একটু কথা কইতে। আমরা সুন্দর একখান বাড়ি করমু। পুরা গ্রামের লোকজন তাকাইয়া থাকবো আমাগো বাড়ির দিকে।

জোসনা বেগম ফড়াৎ করে উঠে পড়লেন। বললেন, বাড়ি তো করমু। তারপর তোরে আমি আবার বিয়া দিমু। আমি যে মাইয়ারে পছন্দ করছি তার লগে বিয়া দিমু। দেখমু কে কি করতে পারে?

রাগে গজগজ করতে করতে জোসনা নিজের ঘরে চলে গেলেন। রুপক স্থির হয়ে বসে রইল। চিত্রা দরজা ধরে দাঁড়িয়ে তাকে বলল, আপনারে নাকি আবার বিয়া দিব। আপনি কি আবার বিয়া করবেন?
নিরুত্তর রইল রূপক। চিত্রা বলল, বিয়া করার শখ জাগল আমারে কইয়েন। চইলা যামু। বেহায়ার মত পইরা পইরা সতীনের ঘর করার ইচ্ছা আমার নাই। বাঁচলে বাঁচব, মরলে মরবো। যেদিকে চোখ যায় চইলা যামু। আপনার পোলাডারে জন্ম দেয়া পর্যন্ত বিয়া কইরেন না। আল্লাহর ওয়াস্তে কয়টা দিন আমারে একটু থাকতে দেন।

রূপক রেগে বলল, এত কথা কও কেন? আমি কি একবারও কইছি আমি বিয়া করমু? মায়ের কথা শুইনা তুমিও লাফাইতাছ। আগে ভাবছিলাম তোমার জ্ঞান বুদ্ধি ভাল। এখন দেখরাছি আমার মা যে বোকা, তুমি তার থেকে আরো বোকা। সব হাঁদারাম রে নিয়া আমি ঘর করতেছি।

রুপক বারান্দা থেকে উঠে বাইরে চলে গেল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। তার মনে অশান্তির আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। রূপকের শেষ রাগের ঝাপটায় সেই আগুনে যেন আবার নতুন করে কেরোসিন তেল পড়লো। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে।

এ দিনের ঘটনার পর থেকে জোসনা বেগমের সঙ্গে চিত্রার সম্পর্কটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। তিনি একটি বারের জন্যও চিত্রার সঙ্গে কথা বলছেন না। কোন জরুরী বিষয় চিত্রা জানতে চাইলেও তিনি চুপ করে থাকেন। চিত্রা হতাশ হয়ে নিজের ঘরে থাকে। শরীরটা তার ভীষণ দুর্বল। ধীরে ধীরে শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়া তেমন একটা হয় না বললেই চলে। জোসনা বেগম রান্না করে একা একা খেয়ে ফেলেন। রান্নাঘরে খাবার থাকে ঠিকই তবে চিত্রার রুচি হয় না খেতে। তার জন্য মাছের টুকরা কিংবা মাংশের পিস কিছুই রাখা হয় না। জোসনা সবই স্বামী এবং ছেলের পাতে তুলে দেন। মুরগি রান্না হলে কয়েক টুকরা আলু এবং একগাদা ঝোল পড়ে থাকে পাতিলে তলায়। ডাল ভর্তা আর শাক ভাজি রান্না হলে তার জন্য থাকে শুধু ডাল এবং ভর্তা। সে খেতে এসে দেখে শাক ভাজি একটুও অবশিষ্ট নেই। বাড়তি খাবার চোখে দেখে না বললেই চলে। তার শরীরটা বড় অনাদরে পড়ে গেছে। চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরে। গর্ভাবস্থার তুলনায় তার পেটটাও খুব একটা বড় হয়নি। চিত্রার মাঝে মাঝে ভয় হয়, খাবারের অভাবে তার বাচ্চাটা হয়তো বড় হচ্ছে না।

মনের ভিতরেও তীব্র অশান্তি। রূপকের সঙ্গে ভালো মতো কথা হয়না। স্পর্শ তো বহু দূরের কথা। দুজন দুজনের থেকে চলে এসেছে যোজন যোজন দূরত্বে। এখন আর কেউ বিয়ে নিয়ে কথা বলে না, জোসনা বেগম তাকে কথা শোনায় না যৌতুক নিয়ে। তবে এসবের মাঝেও শান্তি জিনিসটা একেবারেই হারিয়ে গেছে।

নতুন মাসের শুরুতেই ঘর পাকা করার কাজ শুরু হলো। উঠোনে নিয়ে আসা হয়েছে সারি সারি লাল রঙ্গা ইট। ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়েছে চিকচিকে বালি। রাস্তার ধারে ঘরের ভিত্তি দিয়ে ধীরে ধীরে একটু একটু করে বেড়ে উঠছে তিনটা ইটের ঘর। মিস্ত্রিরা কাজ নিয়ে হুলুস্থুল করে। ভীষণ ব্যস্ত জোসনা বেগম। সারাদিন কাজ তদারকি করা আর রান্নাবান্না করে মিস্ত্রিদের খাওয়ানো। প্রায় প্রতিদিন একবার করে বাড়ীতে কাজ দেখতে আসে রূপক। খুব একটা দরকার না হলে চিত্রার সঙ্গে তাঁর কথা হয়না। প্রতিদিনের মত আজকেও সে এসেছে কাজ দেখতে। উপুড় হয়ে বসে মিস্ত্রিদের ইটের গাঁথুনি তোলা দেখছিল।

চিত্রা বাটাতে করে পান এনেছে। পানের বাটা হাতে নিয়ে রূপক মিস্ত্রিদের বলল, ভাইয়েরা পান খাইয়া লন।
তার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলো চিত্রা। পান খেয়ে রূপকের মুখটা টকটকে লাল হয়ে উঠলো। টুস করে পানের পিক ফেলল মাটিতে। এমন সময় বেজে উঠল রূপকের ফোন। মিসড কল এসেছে।
রূপক কল ব্যাগ দিয়ে বলল, তা ম্যাডামের কলেজ শেষ হইল?
ওপাশ থেকে কি বলল বোঝা গেল না। রূপক বলল, আপনি আমারে আগে কইবেন না? আমিতো দোকানে নাই। বাড়িতে আইয়া পরছি। কইছিলাম না বাড়িত ঘরের কাজ করতাছি। কাম দেখতে আইছি। সন্ধ্যার দিকে আপনাগো বাড়িতে আসমু নাকি একবার? অবশ্য বাড়িত গিয়া লাভ নাই। চাচীর লাইগা তো আপনি আমার সামনে আসেন না। কথাবার্তাও হয়না।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে রূপক আবারো বললো, আপনি তাইলে এক কাম করেন। বিকেলের দিকে বাজারে আসেন। চা খাওয়ামু নে। আচ্ছা যান মিষ্টি মিষ্টিও খাওয়ামু।
তারপর শব্দ করে হাসতে লাগল রূপক। হাসি থামিয়ে বললো, আপনি এত সুন্দর কইরা কথা কও না আমি কি উত্তর দিব ভুইলা যাই। আচ্ছা, ঠিক আছে, বাড়ি থেকে বাইর হইলে আমারে একটা মিস কল দিয়েন।

রূপক ফোনটা পকেটে রেখে দিল। তারপর একদলা পিক ফেলল মাটিতে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে চিত্রার মনে সন্দেহ জাগে। কলেজে পড়া ম্যাডামের সঙ্গে রূপকের এত কিসের কথা? সে কি শুধু রূপকের কাস্টমার নাকি অন্য কিছু? তাতে তার কিবা আসে যায়। কত লোকের সঙ্গেই তো রূপককে যোগাযোগ রাখতে হয়। অযথা কাউকে সন্দেহ করা ঠিক না।
আপন-মনে কথাটা বলে চিত্রা সেখান থেকে সরে এলো। দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল রূপক কে। পান চিবোতে চিবোতে রূপক হেঁটে হেঁটে দেখছে তার স্বপ্নের ঘর। মিস্ত্রিরা একটার পর একটা ইট দিয়ে গাঁথছে সেই ঘরের ভিত। এই ঘরটাকে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর রং করা হবে। রঙিন ঘরে তোলা হবে নতুন নতুন আসবাবপত্র। কিন্তু সেই ঘরে কি শান্তি থাকবে? একটা সুন্দর ঘর হলেই কি তার জীবনটা বদলে যাবে? আবারো কি আগের মত সুন্দর হবে তাদের সম্পর্কটা? চিত্রার খুব জানতে ইচ্ছে করে। শত শত প্রশ্ন তাঁর মনে ঘুরপাক খায়। এত সুন্দর বাড়ি করে কি লাভ যদি ঘরের মানুষের মনে শান্তি না থাকে। জ্যোৎস্না তার সঙ্গে কথা বলেন না। রুপক তাকে এখন আর ভালোবাসে না। এই ঘরে সে কেবলই একজন আগাছা। মাঝে মাঝে তার খুব দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে। অনেক দূরে, ওই দূর আকাশের তারা গুলোর মতন।

এরই ফাঁকে একদিন রুবিনা ফোন করে বাড়িতে সুখবর জানিয়েছে। মা হতে যাচ্ছে রুবিনা। সেটা শুনে জোসনা বেগম ও রূপকের সে কি আনন্দ। তিন কেজি জিলাপি কিনে রুবিনার শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়েছে রূপক। জোসনা বেগম রুবিনাকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। শ্বশুরবাড়িতে পোয়াতি মেয়ের কেমন আদর যত্ন হয়, তিনি রিস্ক নিতে চাননা। পোয়াতি মেয়েকে নিজেই আদর যত্ন করে আগলে রাখতে চান। সেজন্য ঘরের কাজে আরো বেশি তোড়জোড় শুরু হলো। যত তাড়াতাড়ি বাড়ির কাজটা শেষ হবে তিনি মেয়েকে তত তাড়াতাড়ি নিজের কাছে আনতে পারবেন। চিত্রা এই ঘটনায় মনে মনে হাসে আর আফসোস হয়। ভাবে, দুনিয়ার মানুষ বড়ই নির্বোধ। যে মহিলা ছেলের পোয়াতি বউয়ের জন্য এক পিস মাছ রাখেন না, তিনিই আবার নিজের পোয়াতি মেয়েকে আদর যত্নে রাখার জন্য বাড়িতে নিয়ে আসতে চান। হায়রে পৃথিবীর অদ্ভুত নিয়ম।

চলবে..