দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-৩৫+৩৬(শেষ পর্ব)

0
784

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ৩৫+৩৬
নীলাভ্রজহির

বাড়ির কাজ প্রায় শেষের দিকে। ধানের ক্ষেত সবুজ থেকে সোনালী রং ধারণ করেছে। এ বছর বেশ ভালো ফলন হয়েছে ধানের। কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন ধান ঘরে উঠবে। নতুন ঘরে নতুন ধান। সুখের সীমানা নেই জোসনা বেগম ও তার স্বামীর। ঘরের রংটা শেষ হলেই রুবিনাকে বাড়িতে নিয়ে আসবেন। মনে অশান্তি থাকলেও চিত্রা রুবিনার অপেক্ষায় আছে। রুবিনা বাড়িতে এলে তার একটা কথা বলার মানুষ হবে। এ বাড়িতে তার সঙ্গে কেউ তেমন একটা কথা বলে না।
বেশ কয়েকদিন ধরে রূপকের মনটা সারাক্ষণ ফুরফুরে থাকে। নতুন বাড়ি করার আনন্দেই নিশ্চয়ই। বাড়িতে মেয়ে জামাই আসবে, নতুন ঘরে ওঠার সময় মিলাদ করে নতুন ধান ঘরে তোলার উৎসব হবে। এত আনন্দের ভিড়ে একমাত্র চিত্রাই কষ্টে রয়েছে। তবে তার কষ্টটুকু একান্তই তার নিজের। জ্যোৎস্না কিংবা রুপক কারোরই তার দিকে তাকানোর সময় নেই।

চিত্রা নিজের ঘরের বারান্দায় বসে চুল আচড়াচ্ছে। বাড়িতে কাউকে প্রবেশ করতে দেখে মাথায় আঁচল টেনে নিল চিত্রা। একজন মহিলা ও সঙ্গে দুজন মেয়ে এসেছে। চিত্রা মহিলাকে সালাম জানাল। তিনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় বেরিয়ে এলেন জোসনা বেগম। বেশ ব্যস্ত হয়ে বললেন, আরে আপা আপনে। গরিবের বাড়িতে রানী সাহেবের পা পড়ছে।
বেশ ব্যস্ত হয়ে জোসনা বেগম চেয়ার বের করে দিলেন। বারান্দায় চেয়ারে বসলো মহিলা ও তার দুই মেয়ে। মেয়ে দুটো বেশ কৌতুহলী চোখে চিত্রার দিকে তাকাচ্ছে। জোসনা বেগম চিত্রার কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, তুমি ঘরে যাও।
চিত্রা নিজের ঘরে যেতে যেতে আড়চোখে মহিলাদেরকে দেখছিল।
জোসনা মেয়েটাকে বললেন, মা মৌসুমী কেমন আছো?
মৌসুমি মিষ্টি হেসে উত্তর দিলো, জি চাচি ভালো আছি। আপনি তো এখন আমাদের বাড়িতে যান না।
ঘরের কাম চলতাছে। তো অনেক ব্যস্ত থাকি।
সেজন্য আমরাই দেখতে আসলাম আপনাকে। উনি কে?
চিত্রার দিকে ইশারা করেছিল মৌসুমী। চিত্রা ততক্ষণে ঘরের ভেতর প্রবেশ করেছে। তাই জোসনা বেগমের দেয়া উত্তরটা শুনতে পায়নি। শুনলে হয়তো তখনই তার ইচ্ছে করতো মাটির নিচে ঢুকে যেতে।
জোসনা বললেন, পরে কমুনে।
তারপর ফিসফিস করে বললেন, মাথার ছিট খারাপ। পাগলী।
দেইখা তো এরকম মনে হইল না।
জোসনা বেগম সেটার উত্তর না দিয়ে মৌসুমির মাকে বলল, আপা ঘরে আসেন। প্রথমবার আইসেন আমাগো বাড়িত। গরিবের ঘরবাড়ি।
কি যে কন না আপনি?
তাছাড়া আর কি? ভেতরে বসেন। আমি একটু নাস্তা পানির ব্যবস্থা করি।
এত ব্যস্ত হইবেন না আপা। বসেন আপনার লগে গল্প করি।
আরে প্রথমবার আইছেন। নাস্তা পানি দেই। একটু বসেন। মা তোমরাও আসো ভিতরে।

জোসনা বেগমের অনুরোধে মৌসুমী তার মাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে বসল। তড়িঘড়ি করে বিস্কুট চানাচুর, মুড়ি মাখার ব্যবস্থা করলেন জোসনা। মৌসুমী ওর ছোটবোন কে বলল বলল,চল আমরা একটু ঘুইরা দেখি।
সঙ্গে সঙ্গে বাঁধা দিয়ে জোস্না বললেন, আমি লইয়া যামু। নাস্তা খাইয়া লও, তারপর।

হাতের মুঠোয় মুড়ি নিয়ে কুরকুর করে চিবোতে লাগলো মৌসুমী। তার কৌতুহলী চোখ বারবার এদিক-সেদিক ঘুরছে। ঘর থেকেই সে বাড়ির উঠোনে চিত্রাকে দেখতে পেল। চিত্রা নিশ্চয়ই উনার মেয়ে নয় সেটা তো নিশ্চিত। নিজের মেয়ে পাগল হলেও কেউ অন্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করে না। অথচ জোসনা বেগম চিত্রাকে নিয়ে যারপরনাই লজ্জিত। হয়তো নিকট কোন আত্মীয় হবে। তাই বিষয়টা নিয়ে সে আর কোন মাথা ঘামাল না।

নাস্তা খাওয়া শেষ হলে জোসনা বেগম তাদেরকে নতুন করা ঘর গুলো দেখাতে লাগলো। ঘরের বেশ প্রশংসা করলেন মৌসুমীর মা। জোসনা বেগম নিজের ছেলের প্রশংসা করতে ভুললেন না। তার পরিশ্রমী ছেলে নিজের চেষ্টায় দোকানটাকে অনেক বড় করেছে, অনেক জায়গা জমি কিনেছে, বাড়িটাও করল। সেসব সুনাম করতে তিনি এক বিন্দু দেরি করলেন না। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন মৌসুমীর মা। কথায় কথায় একটা সময়ে এসে তিনি বেশ আবেগী কন্ঠে বলে উঠলেন, কিন্তু আমার পোলার কপালটা খুব খারাপ। আমার নিস্পাপ পোলাটা কিসের শাস্তি পাইতাছে আল্লাহই জানে।
মৌসুমির কৌতুহলী প্রশ্ন – কেন কি হইছে?
জোসনা বেগম বেশ করুণ গলায় দুঃখ মিশিয়ে বললেন, দুঃখের কথা আর কি কমু রে মা। ওইযে পাগল মাইয়াডারে দেখলা ওইটা আমার পোলার বউ ।
চমকে উঠল মৌসুমী। বিস্ফারিত চোখে সে তার মায়ের দিকে তাকালো । অবিশ্বাসের সুরে বলল, রূপক ভাই বিয়া করছে ?
জোসনা বেগম বিষয়টাকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন, সেই দুঃখের ইতিহাসটাই তোমারে কই শোনো। আমার পোলার এক বন্ধু আছে। স্কুলে এক লগে পড়ছিল। এই মাইয়া তার বোন হয়। আমার পোলার কাছে সবকিছু গোপন কইরা আমার পোলারে ভুলাইয়া ভালাইয়া বিয়া পড়াইয়া দিছে। বিয়ার পরে আস্তে আস্তে জানতে পারলাম মাইয়ার সব ইতিহাস। মাইয়ার মাথায় দোষ আছে। ওর বাপ টাও পাগলা। সেজন্য ফুপুর বাসায় থাকতো। ফুফাতো ভাইয়ের কান্ধে বোঝা হইলে যা হয়। আমার পোলাটারে বলির পাঠা বানাইলো। সবচাইতে বড় দুঃখের ইতিহাস হইল মাইয়াডার আগেও একবার বিয়া হইছিল। পাগল বইলা সেইখানেও সংসার করতে পারে নাই। কিন্তু আমার পোলার বন্ধু এই কথাটা একদমই গোপন রাখছে। আমার পোলার মনটা বড় ভালো। সে বিবেক কইরা মাইয়াডারে তাড়াইয়া দেয় নাই। মাইয়াডা পোয়াতি হইছে। পেটের বাচ্চাটার কথা চিন্তা কইরা আমরা ওরে তাড়াইয়া দেই নাই। এখন ভাবতাছি পোলাডারে আবার বিয়া দিমু। আমার এত ভাল পোলার কষ্ট তো আমি সইতে পারিনা। আর এই মাইয়াডার বাচ্চাটা হইয়া গেলে ওরে রাইখা আসবো। আমার পোলা কইছে ওই মাইয়ার যত খাবার খরচ ভরণপোষণ টাকাপয়সা সে যথেষ্ট ওরে সাহায্য করবো। আপনি কন এমন ভালো পোলা কি আজকালকার দুনিয়ায় আছে? যারা বেইমানি কইরা আমার পোলারে ফাঁসাইছে, আমার পোলা সেই মাইয়ার ভালোর কথা চিন্তা করতাসে। পাগল মাইয়া লইয়া তো সংসার করন যায়না।

মৌসুমী স্থির চোখে তার মায়ের দিকে তাকালো। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে চোখে একটাই প্রশ্ন, তার মা আগে এই বিষয়টা জানতো কিনা? জেনে শুনে কেন তাকে বারবার তিনি রূপকের কথা বলতেন? রুপকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকতেন। তার উৎসাহেই রূপকের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল মৌসুমী। কিন্তু এই মুহুর্তে তার বুকটা বিতৃষ্ণায় ভরে গেল। মায়ের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। মৌসুমী দাঁতে দাঁত চেপে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করল।
মৌসুমির মা জোসনা বেগমকে বললেন, আপা কষ্ট পাইয়েন না। যারাই এমন করছে আল্লাহ তার বিচার করব। রূপকের মত একটা পোলার লগে এইরকম করাটা ঠিক হয় নাই।
– আমার সাদামাটা পোলাডারে পাইয়া ছাগল বানাইছে গো আপা। পোলাটা আমার কত মানুষের উপকার করে। বিয়ের পর থাইকা কি যে অশান্তির মধ্যে আছে। আমি মা হইয়া ওর অশান্তি একদম সহ্য করবার পারতাছিনা। সেইজন্য ভাবতেছি পোলাডারে বিয়া করামু। একটা ভালো মাইয়া খুজতাছি।
– মাইয়া পাইয়া যাইবেন আপা। আপনেগো মতো ভালো মানুষের লগে নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালো কাউরে মিলাইয়া দিব।
– দোয়া কইরেন। সে কষ্ট কইরা কি সুন্দর বাড়িটা করল!
মৌসুমীর মা-ও জোসনা বেগম তখন রূপকের সুনাম করতে ব্যস্ত। তখন মৌসুমীর দৃষ্টি উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রার দিকে। চিত্রা বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে। দৃষ্টিতে যথেষ্ট কৌতূহল এবং শঙ্কা। মৌসুমী চোখ পিটপিট করে চিত্রা কে দেখতে লাগলো। চোখাচোখি হলো তাদের। মেয়েটার দৃষ্টি দেখে তার মোটেও পাগল মনে হচ্ছে না।

মৌসুমী তার মাকে বলল, মা চলো এখন বাড়ি যাই।
জোসনা বললেন আরে, এত তাড়াতাড়ি কিসের যাওয়া? রান্নাবান্না করি, ভাত খাইয়া তারপর যাইও।
না, চাচী। বাড়ি গিয়ে আমাকে পড়তে বসতে হবে। সামনে পরীক্ষা।
জ্যোৎস্না আর কোন উত্তর দিতে পারলেন না। আর কিছুক্ষন গল্প করে তারা বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জোসনা বেগম এসে চিত্রাকে বললেন, তোমারে কইছিলাম ঘরে যাইতে। বাইরে খাড়ায় আছো কেন?
চিত্রা স্থির চোখে জোসনার দিকে তাকাল। জ্যোৎস্না বললেন, চুপ কইরা আছো কেন? মানুষের সামনে আমারে বেইজ্জতি না করলে তোমার হয়না? এখানে খাড়াইয়া রইছ কি জন্য? রাস্তা দিয়ে কি তোমার ভাতার যাইতাছে? ভাতাররে দেখার জন্য খাড়ায় আছো।
মা এইসব কি কইতাছেন?
তো কি কমু? বাড়িত মেহমান আইছে আমার। তোমারে কইছিলাম ঘরে গিয়া বইসা থাকো। তুমি কি জন্য এখানে খাড়াইয়া রইছ আমারে বুজাও?
আমিতো আপনার মেহমানের সামনে যাই নাই।
সামনে যাও নাই? তারা তোমাকে দেখে নাই ওইখান থেইকা?
তারা দেখলে কি হইবো মা? আপনি কি ওই মাইয়ার লগে ছেলের বিয়ে দিতে চাইতেছেন নাকি?
হ, চাইতেছি। তাতে তোমার কি? তোমারে যে এই বাড়িত থাকতে দিছি সেইটা তোমার সৌভাগ্য মনে কইরা চুপচাপ থাকবা।
সেজন্য আমারে কইলেন ঘরে গিয়ে থাকতে। ওই মাইয়া কি জানে আমি আপনার পোলার বউ?
হ, জানে। লগে এইডাও জানে আমার পোলা তোমারে ছাইড়া দিবো। ছাড়াছাড়ি হইয়া গেলে আমি ওই মাইয়ার লগে আমার পোলার বিয়া দিমু।
আচ্ছা, আম্মা। দিয়েন। আপনের চান্দের টুকরা পোলার জন্য এমন চাঁদের টুকরা মাইয়ায় তো আপনি চাইছিলেন। বিয়া দিয়া মা ও পোলা খুব সুখে থাইকেন। আমি চইলা যামু বাড়ি থাইকা।
চইলা গিয়া আমারে উদ্ধার করো।
করব আম্মা। আর কয়টা দিন ধৈর্য ধরেন। ডেলিভারি টা হোক। ডেলিভারির পর পোলারে রাইখা আমি বাপের বাড়ি চইলা যামু। পোলারে বিয়া দিয়েন। নাতি, পোলা , বউ লইয়া সুখে থাইকেন।

জ্যোৎস্না রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন। আর কোন উত্তর দিতে পারলেন না। চিত্রা অন্য দিকে তাকালো। তার চোখে পানি আসছে। ভেজা চোখ সে আর কাউকে দেখাতে চায় না। দেখাতেও হলো না। তার পাশ থেকে সরে গেছেন জোসনা বেগম। চিত্রার ইচ্ছে করলো হাউমাউ করে কাঁদতে। বুকের পাথর ঠেলে বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে এখন সে সংবরণ করতে শিখেছে। কান্নাটা একটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এলো। আর ঝাপসা হয়ে আসা চোখে সে দেখতে পেলো আকাশে উড়ছে একটা বড় চিল। তার খুব চিল হতে ইচ্ছা করছে। সে যদি পারত পাখির মত উড়ে যেতে। তবে কবেই উড়ে যেত রূপকের কাঁধের বোঝা নামিয়ে দিয়ে।

বাড়ি ফিরেই মৌসুমী একটা মেসেজ পাঠিয়েছে রূপক কে, সেখানে বাংলায় লেখা- চিটার। এরপর সে কলব্যাক করলেও রিসিভ করেনি মৌসুমী। হঠাৎ তার আবার কি হলো? তাই দোকান থেকে ফেরার সময় রূপক মৌসুমীর সঙ্গে দেখা করল। মৌসুমীর চোখে-মুখে ভয়াবহ ক্রোধ।
রাগত স্বরে মৌসুমী বলল, কি করতে আইছেন? আর জীবনেও কোনদিন আমার সামনে আসবেন না।
কি করছি আমি? আমার লগে কিসের এত রাগ করলেন হঠাৎ আমি বুঝলাম না।
আজ আপনার বাড়ি গেছিলাম। আপনার বউরে দেইখা আইছি।
ইতস্ততবোধ করল রূপক। কি বলবে বুঝতে পারল না। মৌসুমী বলল, চরিত্রের ঠিক নাই। ঘরে বউ রাইখা আরেকটা মাইয়ার লগে কথা কইতে শরম করে না?
– শরম করব ক্যান? আমি তো আর আপনের লগে প্রেম করিনা।
– বেহায়া লোক আর একটাও কথা কইবেন না। যেইটা করেন সেটার নাম কি? ইটিশ পিটিশ? মাইয়া মানসের লগে কথা কইতে খুব মজা লাগে?
রূপক রেগে বলল, আমি কি আপনারে কইছিলাম আমার লগে ইটিশ-পিটিশ করেন? আপনি নিজেই তো আমার কাছে আইছেন।
– বড় ভুল করছি। আপনার মায়ে সত্যগোপন কইরা পোলার নাম এমন কইরা আমার মায়ে কাছে কথা শুনাইছে, আমার মা আপনার লাইগা পাগল হইয়া গেছিল।
– সেগুলা শুইনা আপনে গইলা গেছেন।
– আপনের মত লোকের কোন লজ্জা শরম কিছু নাই। নিজে দোষ কইরা আবার বড় বড় কথা। আর কোনদিন আমার সামনে আসবেন না। নির্লজ্জ কোথাকার। আর আপনার মায়ে একটা মহা শয়তান মহিলা। সে কয় আমার পোলার বউ পাগল। পাগল দেইখা তার আগের সংসারটা টিকে নাই। আপনের বাড়ি থাইকা বাইর হইয়া পাশের বাড়ির এক মহিলা রে জিগাইছিলাম আপনার বউ পাগল কিনা। সে কয়, এমন ভালো একটা মানুষরে পাগল কইলে পাপ হইব। তারপর আরো দুই জনরে জিগাইছিলাম আপনার বউ পাগল নাকি না। সবাই শুনে হা কইরা তাকাইয়া কয়,এমন তো কোনদিন শুনি নাই। পাগল হইব কেন? সে তো খুব ভালো মাইয়া। ভদ্র, লক্ষী, আচার-আচরণ ভালো। এই বউডারে পাগল কইতে আপনার মায়ের বিবেক একটু বাধলো না?

– আমার মায়েরে নিয়া কিছু কইবেন না। ওই মাইয়ার আচার-আচরণ এখন ভালো ঠেকে না। পাগলামি করে। সেজন্য আমার মায়ে এই কথা কইছে।
– আর আগের বিয়ার কথা কি কইবেন? আমি মানুষরে জিগাইছিলাম ওনার নাকি আগেও বিয়া হইছিল? সবাই কইছে, আরে না। ওনার মত ভালো মাইয়াই হয়না। রূপকের লগেই পরথম বিয়া হইছে। আপনের মায়ে ক্যামনে এত বড় মিছা কথাটা বানাইল?
– ওর আগে বিয়ে হইছিল এইটা সত্যি। আমি আর আমার মা ছাড়া কেউ জানেনা। আমার ওর বাড়ির পাশের এক লোকে কইছে। উনি বিয়াতে উপস্থিত আছিল। ওর ভাইয়ে সত্য গোপন কইরা ওরে আমার কাছে বিয়া দিছে।
– ভালোই করছে। তারাও চিটার আপনারাও চিটার। তারা যত বড় প্রতারক আপনারা তার চাইতে বড় প্রতারক। উনার ভাইয়ে আগের বিয়ার কথা গোপন রাইখা আপনার কাছে বিয়া দিছে। আর আপনে এমন প্রতারক যে ঘরে বউ রাইখা আমার লগে মোবাইলে কথা কন। আর আমার কথা শুইনা এমন ভাব ধরেন যে আমার প্রেমে পইরা গেছেন। আমি যখন যা কই সেই কথাই শুনেন। তাল মিলান। নির্লজ্জ বেইমান কোথাকার।

রূপক নিজের রাগ সংবরণ করতে পারল না। কিন্তু রাগে কিছু বলতেও পারল না। কেবল গজ গজ করে কাঁপতে লাগলো।
মৌসুমী বলল, আপনার মায়ে এত সুনাম গায় আপনার। শোনেন আপনার মতো দশটা রূপক’রে আমি নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাই। আপনার মত শত শত পোলা আমার পিছনে লাইন ধইরা পইড়া আছে। আর আপনার মায়ে ভাবছে আপনার মত বিয়াইত্তা পোলারে আমি বিয়া করমু। ঘরে পোয়াতি বউ। পোয়াতি বউয়ের লগে এইরকম দুই নাম্বারি করতে আপনার বিবেকে বাধে না?
রূপক কোন উত্তর দিল না। তার ইচ্ছে করছিল মৌসুমীর গালে কষে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিতে। কিন্তু পারল না। কারণ তারা কথা বলছিল মৌসুমীর বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ওর ছোটবোন। তাই আর কোন কথা না বাড়িয়ে অন্ধকারে পিছু হটল রূপক। কাঁচা রাস্তা ধরে সোজা বাড়ির পথে রওনা দিল। হাত নিশপিশ করছে। ইচ্ছে করছে বাড়িতে গিয়ে চিত্রাকে মেরে রক্তাক্ত করে দিতে। প্রচন্ড রাগে গজরাতে গজরাতে সে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। কিন্তু যতোই বাড়ির পথে এগিয়ে আসছিল ততই যেন মৌসুমীর কথাগুলো তার বিবেকের কাঠগড়ায় নিজেকে আসামি রূপে দাঁড় করাতে লাগল। একটা কথা বারবার মাথায় ভেসে বেড়াতে লাগলো, তারা যদি প্রতারক হয় আপনারা তার চাইতে বড় প্রতারক। তারা মাইয়ার বিয়ার কথা গোপন রাইখা বিয়া দিছে। আর আপনি ঘরে বউ রাইখা আর একটা মাইয়ার লগে ইটিশ-পিটিশ করতাছেন। এই একটা বাক্য যেন রূপকের সমস্ত সত্তাকে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই তো। সে নিজেও তো একজন প্রতারক। সে মৌসুমীর প্ররোচনায় পড়ে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল। অথচ নিজে বিবাহিত। তবে রূপকের ধারণা ছিল মৌসুমী জেনেশুনে তার কাছে এগিয়ে আসতে চাইছ। তাই রূপক নিজে থেকে কখনো স্ত্রীর কথা তোলেনি। মৌসুমির প্রতি তার কোন দূর্বলতা নেই। ক্ষনিকের ভালোলাগা, সে কেবল মৌসুমীর কথায় তাল মিলিয়ে যাচ্ছিল। তবুও তো এটা প্রতারণা। মৌসুমীর সঙ্গে প্রতারণা। তৎক্ষণাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল রূপক। হঠাৎ তার মাথায় একটা কথা জেগে উঠলো, চিত্রার সঙ্গেও প্রতারণা করছিল সে!
ঘন অন্ধকারের মাঝে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে তার ভীষণ অপরাধী বলে মনে হল। চিত্রা না হয় অন্যায় করে ফেলেছে। সত্য গোপন করে হয়তো সে অপরাধী। কিন্তু তাই বলে চিত্রাকে ঠকিয়ে অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখাটা অন্যায়। সে নিজেও তো চিত্রার সঙ্গে প্রতারণা করল। নিজের দিকে তাকাতে ঘৃনা হচ্ছিল রূপকের। মৌসুমিকে বিয়ে করা কিংবা দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে রূপকের মাথায় কিছু আসেনি। তবে কিছুদিন তার ভেতর যেন অন্য কেউ এসে ভর করেছিল। স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সে নিজেকে মেলে দিয়েছিল।
রূপক ঘরে ফিরল না। অনেকটা সময় বাড়ির বাইরে বসে রইল। ঘন অন্ধকারে বসে বসে তার অনুশোচনা হচ্ছিল। কিভাবে সে এতটা প্রতারক হতে পারে সেই যন্ত্রণা দগ্ধ করছিল তাকে। যখন অনেক রাত বেড়ে গেল তখন ঘরে ফিরল সে। লাইট জ্বালিয়ে দেখল চিত্রা ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেকদিন সে চিত্রার দিকে তাকায় না। আজ এক মুহূর্তের জন্য তাকাতেই তার মনে হলো চিত্রা একদম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখের নিচটা হয়ে গেছে অনেক কালো। গায়ের রং তো আগের থেকে অনেক চাপা হয়েছে। রোগা পটকা শরীরের মাঝে ছোট্ট একটা পেট উঁকি দিচ্ছে। এই পেটে তার সন্তান আছে। সন্তানের জন্য হলেও চিত্রার এখন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করা উচিত। অথচ চিত্রা কি খায় না খায় রূপক সেসব কখনো খেয়াল করেনা। নিশ্চয়ই খাওয়া-দাওয়া করে না চিত্রা। অবহেলা অনাদরে মেয়েটার চেহারাটা শেষ। তার সন্তানও হয়তো ঠিক ভাবে বেড়ে উঠছে না। রূপকের আজ খুব মানসিক পীড়া হচ্ছে। সে নিজেও ভাত খেতে ভুলে গেল। অনেক রাত অব্দি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করল। ঘুম এলো না তার।

পরদিন সকালে জোসনা বেগম রূপককে বললেন, কাল মৌসুমী আর ওর মা আইছিল। ঘর দেইখা তোর অনেক প্রশংসা করছে। মৌসুমির মা অনেকটাই রাজি। কাইল সব কইয়া দিছি। এখন তুই মৌসুমীর লগে বেশি বেশি কইরা কথা কবি। তাইলে দেখবি মাইয়া তোর জন্য পাগল হইয়া যাইবো । তুই বউ ছাইরা দিলেই ওরে ঘরে তুলতে পারবি।
রূপক স্থির গলায় জোসনাকে বলল, এতদিন যা করছো আমি কিছু কই নাই। এখন একটু বেশি হইয়া যাইতাছে। তুমি আর ওদের বাড়িত যাইবা না।
কেন যামু না?
আমি যাইতে মানা করছি। আর কোনদিনও যাওয়ার দরকার নাই।
মুখটা অন্ধকার করে ফেললো জোসনা বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন।
রূপক বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বলল, আর একখান কথা, চিত্রারে একটু ভালোমতো খাওন দিও।

আজ নিশ্চিত পাঠকদের মনে কিঞ্চিৎ সুখ সুখ লাগবে। দেখি সুখের মাত্র মন্তব্যে কতটুকু প্রকাশ পায়।

জোসনা বেগমের মেজাজ উত্তপ্ত। রুপক তাকে নির্দেশ দিয়ে গেছে চিত্রাকে ভালোমতো খাবার দিতে। সে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আমি কি ওরে খাওন দেই না নাকি? জমিদারের বেটিরে কি আমি না খাওয়াইয়া রাখছি?
একটা বড় গামলায় পাতিলের সব ভাত ও তরকারি ঢেলে দিয়ে তিনি গামলাটা নিয়ে এসে চিত্রার ঘরের দরজায় রেখে চেঁচিয়ে বললেন, খাইয়া লও। আমার পোলার মাথাটা তো আগেই খাইছো। সেই জন্য তোমার কোন দোষ তার চোখে পড়ে না। তুমি তার আদরের সোহাগী বউ। তোমার লাইগা আইজ আমারে কথা শুনাইছে। মায়েরে কথা শুনাইছে। কত্ত সাহস হইয়া গ্যাছে পোলার। পোলাপাইন মানুষ কইরা কোন লাভ নাই।
চিত্রা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। ঘর্মাক্ত জোসনা বেগমের মুখ যেন বহ্নিশিখা।
তিনি বললেন, এখন আমার সামনে বইসা সবগুলি ভাত খাইবা। একটা দানাও যেন গামলার মধ্যে না থাকে। সব খাইতে না পারলে খবর আছে।

চিত্রা দেখল গামলা ভর্তি ভাত। অস্বস্তির সঙ্গে সে বলল, কি হইছে আম্মা?
– নতুন কইরা কিছু হওয়ার বাকি রাখছো। বিয়াইত্তা মাইয়া। চরিত্রের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। আমার পুলাডারে কেমনে তুমি জাদু কইরা রাখছো।
– আম্মা আপনি এতদিন যা ইচ্ছা কইছেন আমি সহ্য করছি। কিন্তু আমার চরিত্র লইয়া কিছু কইবেন না।
– না, তুমি তো রাজা-বাদশার বেটি। তোমার চরিত্র নিয়ে কিছু কওন যাইবো না। তওবা তওবা। তোমার পা ধইরা সালাম করোন লাগবো। পাও দুইটা আগাইয়া দেও সালাম করি।
– এমন করতাছেন ক্যান কইবেন? আমি কি করছি?
– মহারানী কিছু করেন নাই। এখন ভাত খাইয়া আমারে উদ্ধার করেন।
– এতগুলো ভাত খামু ক্যামনে আমি?
– আমার পোলায় কইছে তোমারে বেশি কইরা খাওন দিতে। তাই বেশী কইরা দিতাছি।
চিত্রা চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে রইল। জোসনা বেগমের আচরণ আজকাল বড্ড বেশি উদ্ভট হয়ে গেছে। একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না তাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চিত্রা বলল, আমারে আপনে পছন্দ করেন না সেইটা আমি জানি। আর কয়টা দিন সহ্য করেন। আপনেরা মা আর পোলা মিইলা মাইয়া পছন্দ কইরা ফেলছেন। আমি কোনো বাধা দিমু না। আমার প্যাটের বাচ্চাটারে জন্মাইতে দেন। তারপর আপনাগো মুক্তি দিয়া আমি চইলা যামু। তখন আপনের পছন্দের মাইয়ারে দিয়া তারে বিয়া দিয়েন।
– তুমি তো তারে যাদু-টোনা কইরা রাখছো। তোমার মতো মায়াবিনি বউ রাইখা সে আর কারো দিকে তাকাইবো? তার চোখ দুইটা তো তুমি কানা কইরা রাখছ।
– আপনার কথা কিছু বুঝবার পারতাছিনা। আমি ক্যান তার চোখ কানা কইরা রাখমু? আমি আপনার পুলারে কোন যাদু টোনা করি নাই।
– তোমার লগে তর্ক করার সময় আমার নাই। ভাতের গামলা রাইখা গেলাম। খাইয়া লইবা। সবকিছু খাইতেই তো আইছো।
জোসনা বেগম উঠে চলে গেলেন। ভাতের গামলা টেবিলের উপর তুলে রাখলো চিত্রা। মানসিক অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছে। চিত্রা ভেবেছিল মা মরা মেয়েটা এ বাড়িতে এসে একজন মা পাবে। সুখ টুকু তার কপালে সয়নি। কিংবা হতে পারে সব মেয়ে মা হওয়ার ক্ষমতা রাখেনা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্য, শাশুড়ি হলেই মা হওয়া যায়না।

সারাদিন দোকানে খুব বিমর্ষ অবস্থায় কাটাল রূপক। কিছুই ভালো লাগছে না। চিত্রার সঙ্গে তার এখন শতবর্ষের দূরত্ব। এই দূরত্ব চাইলেও ঘুচানো সম্ভব না। নিজেকে তার ভীষণ একা একা লাগছে। অসহায় মনে হচ্ছে। কোথায় গেলে একটু শান্তি পাবে সে?

অস্থিরতায় রূপক বারবার এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল। বাজারে দেখা হল মিস্ত্রিদের সঙ্গে। আগামীকাল থেকে তারা রং করার কাজ শুরু করবে। রংয়ের ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করার এক পর্যায়ে রূপকের চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি নান্দনিক সুন্দর বাড়ি। মনটা তার ভালো হতে শুরু করল। একটা দৃশ্য কল্পনা করেই মুখে হাসি ফুটল তার। সে সমাধান পেয়ে গেছে।
মনে মনে ভাবল, নতুন ঘরে উঠবো। আমার বউডার লগে সব মিটমাট কইরা লই। সে যদি কোন ভুল কইরা থাকে তো করছে। মাইয়া হিসেবে চিত্রা খারাপ না। মৌসুমী কইলো এলাকার সবাই নাকি তার সুনাম করছে। অনেক ভদ্র একটা মাইয়া। সে ভুল করলে করছে। এখন তো সে আমার বউ। সে আমারে মন প্রাণ উজাড় কইরা ভালোবাসে। তার লগে সব মীমাংসা কইরা নেয়া উচিৎ আমার।
সমাধানের কথা ভেবেই রূপক মানসিক শান্তি পেলো। অযথা নিজেকে কষ্ট দিয়ে কি লাভ? সে চিত্রার সঙ্গে যে প্রতারণা করে চলছিল, তারও শাস্তি হওয়া উচিৎ। চিত্রা দোষী হলে সেও দোষী। সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে হবে। মনে মনে হাসতে হাসতে রূপক বলল, নতুন কইরাই শুরু করমু। নতুন ঘরে নতুন রং। ঘরে নতুন একখান খাট বানামু। ওই খাটে বউরে লইয়া ঘুমামু৷ মেলাদিন হইয়া গেল বউটারে জরাইয়া ধরি না, সোহাগ করি না। আগে প্রত্যেকদিন রাতে বউরে জড়াইয়া ঘুমাইতাম। কতই না সুখের ছিল দিনগুলান! বউটা মনে অনেক কষ্ট পাইতাছে। নতুন খাটে শুইয়া তারে জরাইয়া ধইরা ঘুমাইলেই সব মীমাংসা হইয়া যাইবো। বউ আমার আশায় বইসা রইছে আমি জানি। আমি একবার তার কাছে গেলেই সব ঠিক হইয়া যাইবো।

সমাধান পেয়ে যেতেই রূপকের মনে হল সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশি মনে হাঁটতে হাঁটতে সে গেল পাশের ফার্নিচারের দোকানে। একটা বইতে বিভিন্ন ডিজাইন করা খাটের নকশা থেকে সে একটা নকশা পছন্দ করলো। তার মায়ের ঘরের খাটের জন্য পছন্দ করলো আরেকটা নকশা। মনে মনে ঠিক করল সেগুন কাঠের খাট বানাবে। আর ডাইনিং টেবিল বানাবে বাগানের মেহগনি গাছের কাঠ দিয়ে। ওই টেবিলে সে তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বসে ভাত খাবে। নিজের বসার জন্য রাজকীয় একটা চেয়ার বানাতে হবে। আহা, এ যেন স্বপ্ন দৃশ্য। ভাবতেই তার মনটা বড্ড ফুরফুরে হয়ে উঠলো।

ফুরফুরে মন নিয়েই বাড়ি ফিরল রূপক। তবে মনেমনে ভেবে রেখেছে এখনই চিত্রাকে কিছু বুঝতে দেবে না। আর দিন কয়েকের অপেক্ষা। তারপর নতুন ঘরে উঠেই সবকিছুর নতুন সূচনা হবে। এখন চিত্রাকে বুঝতে দিলে সেদিনের আনন্দটা মাটি হয়ে যাবে। এসব সাত পাঁচ ভেবে রূপক বাড়ি ফিরল।
জোসনা বেগমকে দেখতে না পেয়ে সে গম্ভীর মুখে চিত্রাকে বলল, খাওন দেও।
চিত্রা ভাতের গামলা নিয়ে এসে রূপকের সামনে রেখে বলল, আমি কি গরু?নাকি রাস্তার কুত্তা? রাস্তার কুত্তার লগেও মানুষ এমন করে না।
– কি হইছে?
– আপনে আম্মারে কইছেন আমারে বেশি কইরা খাওন দিতে। উনি এইটা আমার ঘরে দিয়া গেছে। আর কইছে একটা দানাও যেন পইড়া না থাকে। সব খাইয়া তারে উদ্ধার করতে কইছে। আমি এক গামলা ভাত খামু? আমারে উনি দুই চক্ষে সহ্য করতে পারে না। তার ওপর আপনে ক্যান ওনারে কইছেন আমারে বেশি কইরা খাওন দিতে? আপনেরা আমারে এতিম ভাইবা দয়া দেখাইতাছেন।
রূপকের ফুরফুরে মনটা মুহুর্তেই বিষাদে ভরে গেল। সে বলল, চুপ করো। অল্প দুইটা খাইয়া ভাতের গামলা আম্মার ঘরে রাইখা আসলেই হইত।
– সহজ সমাধান দিলেন। দুনিয়াটা এত সহজ হইলে কামই হইত। আমার লগে উনি সারাক্ষণ কুত্তার মত করেন। কিন্তু আপনে ক্যান কইছেন আমারে খাওন দিতে? আমার জন্য তো আপনার কোন ভালবাসা মহব্বত কিছুই নাই। আমার তো খাওন দরকার নাই। এতগুলা দিন সবাই সবার মত খাইয়া লইছেন। আমি মানুষটা খাইছি না মরছি কেউ তো খোঁজ নেন নাই। আইজ এত দরদ দেখাইছেন ক্যান?

রূপক বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। পরিস্থিতি সামাল দিতে সে বলল, মা কই?
– জানিনা।
গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রইল চিত্রা। তার অন্ধকার মুখখানা রূপকের কাছে কালবৈশাখী ঝড়ের আকাশের মতো লাগছে। এই আকাশে ফু দিয়ে স্বচ্ছ ধবধবে সাদা করে দিতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ রূপকের মনে হল, তার বউটা ভীষণ সুন্দরী। রাগ করে গাল ফুলিয়ে থাকলেও তাকে অসম্ভব সুন্দর দেখায়।
রূপক কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো। মনে মনে ভাবল, এখন কিছু বলবো না। বাড়ির রং করা শেষ হোক। নতুন খাট ঘরে উঠবে। তারপর বউয়ের সঙ্গে সব ঝগড়া মিটমাট করে নেবে সে। তাই নির্বিকার ভঙ্গিতে সে কেবল চিত্রার দিকে তাকিয়ে রইল।
রূপকের জন্য খাবার বেড়ে দিলো চিত্রা। রূপকের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিল তুমি খাও নাই? কিন্তু সংকোচে সেটা জিজ্ঞেস করতে পারলো না। এতদিনের জমানো ঝগড়া হুট করেই মিলনে পর্ববসিত করাটা অত সহজ নয়। লজ্জা করছে। ক্ষমা চাইবে কিভাবে সেটা ভেবে রূপক মাথা নিচু করে বসে রইল। চিত্রা ভাতের প্লেট এগিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে যায়।
রূপক চুপচাপ ভাত খেতে শুরু করে। বুক ফেটে কান্না আসছিল চিত্রার। একটা মানুষ এত স্বার্থপর কি করে হতে পারে? তাকে একটি বারের জন্যও খেতে বসতে বলছে না।
চিত্রা অভিমানের সুরে বলল, আমারে লইয়া টেনশন কইরেন না। আপনি ওই মাইয়ারে বিয়া করতে পারেন। আমি কোন ঝামেলা করমু না।
রূপক নির্বিকার ভঙ্গিতে ভাত খাচ্ছে। চিত্রার চোখে জল চলে এলো। সে বলল, আম্মা ঐ মাইয়ারে খুবই পছন্দ করেন। আমারে উনি একদমই সহ্য করতে পারতেছেন না। ঘরের রংটা হইয়া গেলেই আপনি ওই মাইয়ার ঘরে তুলেন। আমারে নিয়া ভাবতে হইব না। যতদিন আমার পোলা দুনিয়াতে আসে নাই আমি বাপের বাড়ি গিয়া থাকব।
রূপক মাথা তুলে বলল, বিয়ে করার অনুমতি দিতাছো?
চিত্রার বুক ফেটে যাচ্ছিল কষ্টে। তবুও শত কষ্টে সে বুকে পাথর চেপে বললো, হ অনুমতি দিলাম। বিয়া কইরা আপনি সুখী হন। আপনার মাও সুখী হোক । আমি বাপের বাড়িত চইলা যাই। আপনার পোলা হইয়া গেলে তারে পাঠাইয়া দিমু।
– তুমি আর আইবা না ?
চিত্রা অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল লুকালো, না। আর আইসা কি হইব? আমি বান্দি হইয়া পইড়া থাকতে চাই না।
– বাপের বাড়িতে থাকবা আজীবন?
-সেইটা নিয়া আপনার ভাবতে হইব না। আপনে আমারে ছাইড়া দেন। আমি তো খারাপ মাইয়া। বেইমান। খারাপ মাইয়াগো থাকার জায়গার অভাব হয় না।
কথাটা বলেই চিত্রা দৌড়ে নিজের ঘরে চলে এলো। কারণ কিছুতেই আর নিজের কান্না সংবরণ করা যাচ্ছিল না। এই অশ্রু সে রূপক’কে দেখাতে চায় না।

কান্নার পালা একসময় শেষ হলো। চিত্রা তার সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছে। আর অপমানিতে হতে চায় না সে। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল চিত্রা। তারপর পাশের বাড়ির সাবিনার কাছে এসে শিমুলকে কল দিলো। ওর ধরা গলা শুনেই শিমুল জানতে চাইলো, কি হইছে ভাবী?
– তুমি তো আমার ভাই হও। বইনের একটা উপকার করবা?
– কন ভাবী। আপনের জন্য কিছু করতে পারলে জীবনটা সার্থক হইয়া যাইবো।
– আগে কথা দেও এই কথা তুমি কাউরে কইবা না। তোমার বউরেও না।
অগত্যা বাধ্য হয়েই শিমুল চিত্রাকে কথা দিলো, আচ্ছা কাউরে কমু না। আপনে কন কি উপকার করতে হইব?
– আমার মনে হয় সংসারটা টিকবো না।
– কি কন ভাবী? আপনের মতো ভালা একজন মাইয়ার..
– সবই কপাল রে ভাই। তুমি খালি এই বইনের একটা উপকার কইরো। একদিন কইছিলা তোমার ওইখানে পোলা মাইয়া সবাই কামের জন্য যায়?
– হ।
– আমারে একখান কাম জোগাড় কইরা দিতে পারবা? তুমি না আমার ভাই হও?
– ভাবী এগুলা আপনে কি কন? আমি আইজ ভাইয়ের লগে কথা কমু। আপনের সংসার টিকবো না ক্যান? কি হইছে আমারে কন।
– এত কথা কওনের সময় নাই। আমার ডেলিভারি হইয়া গেলেই আমি ঢাকায় চইলা যামু। তুমি আমারে একটু ঠাই দিও ভাই। এই বোইনটারে একটু ঠাই দিও।
– আমরা এই সপ্তাহেই গেরামে আসতাছি ভাবী। আইসা আপনের কাছ থাইকা সব কথা শুনমু।
– দেখা হইবো না আমাগো। আমি ঠিক করছি তোমার ভাইয়ের নতুন বিল্ডিং ঘরে আমি উঠমু না। যেদিন রং করা শ্যাষ হইবো, আমি ওইদিনই বাপের বাড়িত চইলা যামু। ওর নতুন ঘর দিছে এক মাইয়ার জন্য। মাইয়ার নাম মৌসুমী। আমার আম্মা ওই মাইয়ারেই ঘরে তুলবো। আমি একটা রাইতও ওর নতুন ঘরে থাকমু না।
– ভাবী মাথা ঠাণ্ডা করেন।
– অনেক সহ্য করছি রে ভাই। আর সহ্য হয় না। বাপের বাড়ি থাইকা আর আসমু না। পোলা হইলে পাঠাইয়া দিমু। আমি চইলা যামু ঢাকায়। তুমি আমারে একটু ঠাই দিবা ভাই?
– আচ্ছা ভাবী আপনে চিন্তা কইরেন না। আপনের কথা শুইনা আমার মাথা ঘুইরা গেল। যাই কইরেন ভাবী, চিন্তা ভাবনা কইরা কইরেন।
চিত্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, বাচাইলা রে ভাই। এই বোইনটার জন্য দোয়া কইরো। দরকার হইলে তোমারে আমি কল দিমু। কল ধইরো। রুবিনারে ভালো রাইখো। ওর কপালটা যেন আমার মতো না হয় সেই দোয়া করি।
– ভাবী আমি রুবিনারে কথাটা কইতে চাই। কি হইছে আপনেগো শুনতে চাই।
– বাড়ি আইলেই জানতে পারবা। তয় আমারে ভুল বুইঝো না ভাই। তোমার এই বোইনটা অনেক দুঃখী।

বাড়ির রং করা শেষ। আকাশী, হালকা গোলাপী রংয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে রূপকদের নতুন বাড়িটা। চকচক করছে অসংখ্য পুরনো টিনের বাড়ির মাঝখানে। গাছপালায় ঘেরা বাড়িটা দেখলে যে কারও ঈর্ষা জাগবে। রংয়ের ঘ্রাণ এখনো ফুরায় নি। রূপকের মা মেয়ে ও জামাইকে দাওয়াত করেছেন। বাড়িতে মিলাদ দিয়ে এতিম মিসকিনদের খাইয়ে তারপর নতুন ঘরে উঠবেন তারা। এদিকে ধানের ক্ষেতে সোনালী হয়ে ওঠা ধানও কাটার সময় হয়ে গেছে। দু একদিনের মধ্যেই উঠানে ধান উঠবে। নতুন ধানের গন্ধে ম ম করবে পুরো বাড়ি।
রূপক একটা নতুন খাট এনে ঘরে তুললো। সেগুন কাঠ দিয়ে বানানো বক্স খাট। তার ঘরটাকে এখন ভারী অপূর্ব দেখাচ্ছে। আগামীকাল রুবিনা ও শিমুল আসবে। বিকেলে মিলাদ হবে। রাতে নতুন ঘরে ঘুমাবে তারা। আগামীকাল চিত্রার সঙ্গে সব ঝামেলা মিটমাট করে নেবে। সারাদিন ধরে রূপক ভেবে চলেছে কীভাবে ক্ষমা চাইবে তার স্ত্রীর কাছে? এই বোকা বোকা স্বামীটা ক্ষমা চাওয়ার কোনো ভাষা জানে না। চিত্রাকে একবার জড়িয়ে ধরলেই হবে। তাহলেই আর কিছু বলতে হবেনা মুখ ফুটে।
দূর্ভাগা রূপক জানতেও পারবে না চিত্রা তাকে সেই সুযোগ দেবে না। এত অবহেলা, অত্যাচার সহ্য করতে করতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তার। চিত্রা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামীকাল সকালেই সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বাপের বাড়িতে। সোহরাব উদ্দীনের ভাঙা বাড়িতেই কিছুদিন থাকতে হবে। যতদিন তার সোনামণি পৃথিবীর আলো না দেখছে, ততদিন। বাচ্চাটা দুনিয়াতে এলেই তাকে বাপের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে সে নিজের মতো জীবন বেছে নেবে। কিন্তু আজকাল তার খুব ভয় হয়। সন্তানের মায়া খুব করে জাগে তার হৃদয়ে। এই সন্তানকে ছেড়ে কি করে থাকবে সে? নতুন মা তার এই কলিজার টুকরো সন্তানকে আদর স্নেহ করবে তো? সৎ মা কখনো নিজের মা হতে পারে না। তার সন্তানের ভাগ্যটাও তার মতো খারাপ হবে। এতিমের মতো বড় হবে সে-ও।
ঘুমানোর আগে চিত্রা রূপককে বলল, আমি কাইল বাপের বাড়িত চইলা যামু। আপনে যখন খুশি বিয়া করতে পারেন। ওই মৌসুমীরে ঘরে তুলেন। আমার কোনো আপত্তি নাই।
রূপক মুচকি হেসে বলল, আইচ্ছা ঠিক আছে।
– আপনে সত্যি সত্যি বিয়া করবেন?
রূপক দুষ্টুমি করে বলল, হ। তুমি আপত্তি না করলে বিয়া তো করাই যায়।
– আমি কাইল চইলা যামু।
– আমি রাইখা আসমু নে।
– রাইখা আসা লাগবো না।
চিত্রার গলা ধরে এলো। এত সহজেই তাকে চলে যেতে দিচ্ছে রূপক? কষ্টে চিত্রার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাচ্ছে। রূপক বিয়ে করবে এ কথাটা তার মুখ থেকে শোনার চাইতে জঘন্য কিছু হতে পারেনা। বালিশ ভিজছে নোনা জলে। এতকিছুর পর চিত্রার কষ্ট হয় নিজের সন্তানের জন্য। এসব স্বার্থপর মানুষদের ভীড়ে সে নিজের সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছে।
সারা রাত এপাশ ওপাশ করে দুর্ভাবনায় চিত্রার ঘুম এলো না। ভোররাতে সে সিদ্ধান্ত নিলো, রূপক আমারে ছাইড়া দিলেও আমি আমার বাচ্চাটারে ওরে দিমু না। ওরে লগে নিয়াই ঢাকায় যামু। যেইখানেই যামু, ও আমার লগেই থাকবো। ওরে আমি এতিম হইতে দিমু না। আমার মতো দুঃখে বড় হইতে দিমু না। অবশেষে এসব ভেবে স্বস্তির সঙ্গে ঘুম নেমে এলো চোখে।
ভোরের আলো ফুটছে সবেমাত্র। কোমরের পেছনে সুক্ষ্ম ব্যথা নিয়ে চিত্রার ঘুম ভেঙে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বাড়ছিল ব্যথার তীব্রতাও। চিত্রার আর বুঝতে বাকি রইল না এটা কীসের ব্যথা? তার সন্তানের পৃথিবীতে আসার সময় হয়েছে। কিন্তু তার যে আজকে বাড়ি চলে যাওয়ার কথা! এ বাড়িতে সন্তানের জন্ম হলে কিছুতেই তাকে সঙ্গে নেয়া যাবে না। রেখে যেতে হবে। ভাগ্য তাকে এ কোন পরীক্ষায় ফেলল?
কাঁদছে চিত্রা। প্রসব বেদনায় নয়, এই বাড়িতেই তার সন্তানকে রেখে যেতে হবে সেই ভাবনায়। জোসনা বেগম ছোটাছুটি করে ধাত্রী ডেকে আনলেন। উত্তেজনায় ছটফট করছে রূপক। আজকেই তারা নতুন ঘরে উঠবে, আর আজকেই তার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে চলেছে! সে সত্যিই সৌভাগ্যবান। এ বছর ধানও হয়েছে ভালো।
ব্যথার তীব্রতায় চিত্রার চিৎকার শোনা যাচ্ছিল উঠান থেকে। জোসনা দরজায় গিয়ে বারবার বলছেন, আস্তে চিল্লাও। আমরাও পোলা মাইয়্যা জন্ম দিছি।
ঘর্মাক্ত চিত্রার কানে জোসনার গলা বিষের মতো লাগে। সে মুক্তি চায় এই যন্ত্রণা থেকে। এই বেদনা থেকে, শোক থেকে। তার ভেতর থেকে হু হু করে কান্না আসে।
রুবিনা ও শিমুল এসে পৌঁছেছে ততক্ষণে। ভাবী প্রসব বেদনায় ছটফট করছে শুনে রুবিনাও ছটফট করে। এদিক ওদিক ছুটে যায় আর আল্লাহকে ডাকে। কতক্ষণে ভাবীর কষ্ট দূর হবে!
ধাত্রী দরজা খুলে রক্তমাখা এসুকটা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে বের হয়ে আসে। শিশুটির কান্না আকাশ কহ প্রতিধ্বনিত হয়। সদ্যজাত শিশুর মুখটা দেখেই রূপকের আত্মা ফেটে হু হু করে কান্না আসে। ওই পবিত্র শিশুটি তার নিজের সন্তান! এ যেন দুনিয়ার সবচাইতে সেরা সুখ। সন্তানের মুখ দেখার চাইতে সুখের আর কিছুই হতে পারে না।
বাচ্চাকে রেখে এক দৌড়ে চিত্রার কাছে ছুটে গেল রূপক। এমন পবিত্র সুখটুকু যে এনে দিয়েছে, তার পা ধরে ক্ষমা চাইবে। চিত্রাকে আর একমুহূর্তও দূরে রাখবে না। প্রয়োজনে হাত পা ধরে বলবে, বউ আমারে মাফ কইরা দেও। আর কোনোদিনও তোমারে কষ্ট দিমু না।

রূপক দৌড়ে এসে চিত্রার পাশে বসল। ক্লান্ত, ঘমার্ক্ত চিত্রার মুখে কোনো কষ্টের ছাপ নেই। সে সন্তান জন্ম দেয়ার আনন্দে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। রূপক চিত্রাকে ডাক দিলো। ওর হাত ধরে নাড়া দিলো। কোনো সাড়া নেই। ধাত্রী এসে ধাক্কাধাক্কি করতে লাগল। খিঁচুনিতে মাইয়াডা খুব কষ্ট পাইছে- কথাটা শেষ করার আগেই তিনি বুঝে গেলেন, চিত্রা আর নেই। সন্তানকে ভূমিষ্ঠ করেই তার প্রাণপাখিটা বিদায় নিয়েছে এই স্বার্থপর পৃথিবী ছেড়ে।

রূপক স্থির হয়ে গেল, যেন পাথরের মূর্তি।
রুবিনার গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস কম্পিত হতে লাগল। পুরো গ্রামবাসী অবাক চোখে দেখল রুবিনার কান্না। কেউ কেউ বলে বসল, মা মরলেও কেউ এত কান্দে না!

সবাই চলে গেল যার যার মতো। লাশ দাফন হলো। বারান্দায় বসে ধরা গলায় রুবিনা বলে উঠল, সে যা করছে সেইটা তো মায়ের চাইতেও বেশি। আমার মা-ও আমার জন্য এইটা করতো না।
জোসনা বেগমের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে রুবিনা অকপটে স্বীকার করে তার কুকর্মের কথা। বলে, মা গো। ভাবী আমারে বাচাইছে শুধু না, সে আমাগো সম্মান বাচাইছে। এই কথাটা সে আমার ভাইরেও কয় নাই। এমন একটা মানুষ তুমি এই গেরামে আর একটাও পাইবা না।

স্থবির হয়ে যান জোসনা বেগম। যে মানুষটা তার পরিবারের সম্মান বাঁচানোর জন্য এতকিছু করেছে, তাকে অবহেলায় তিলে তিলে শেষ করে দিয়েছেন তিনি!

অনুশোচনার কড়াল গ্রাস আঁকড়ে ধরল জোসনা বেগমকে। কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্ত সারাজীবন অনুশোচনা করলেও হয়তো শেষ হয়না। এটা হয়ত তেমনই একটা অন্যায়। কাঠের মতো স্তব্ধ হয়ে জোসনা বেগম রূপক’কে দেখেন। তার চোখ ফেটে অশ্রু গড়ায় না। কেবল আত্মা ফাটে।

রূপকের সমস্ত পৃথিবীটা টলছে, প্রিয়তমা স্ত্রী’র কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু পেলো না সে। ভেবেছিল নতুন ঘরে উঠে নতুন জীবন শুরু করবে তারা। এটা তো এক অর্থে নতুন জীবনই। চিত্রা নতুন জীবন পেলো, তাকেও দিয়ে গেল পাহাড়সম কষ্টের, অনুশোচনার একটা নতুন জীবন!

মাঠভর্তি সোনালী উজ্জ্বল ধান, নতুন রং করা বাড়ি, সেগুন কাঠের উজ্জ্বল খাট, বংশের নতুন প্রদীপ, সবকিছু বৃথা পড়ে রইল। সবই রইল, শুধু ম্লান হয়ে গেল ভেতরের শান্তি। এতকিছুর ভেতরেও সবকিছু জুড়ে শুন্যতা। জীবন সবসময় ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেয় না।

>>শেষটায় কান্নায় আমার নিজেরই গলা ধরে আসছিলো। এমনটিই হচ্ছ। কেউ বেঁচে থাকে তবে ভেতরটা যাদের মরে যায়! বেঁচে থাকার ইচ্ছেরা মরে যায়।
পুরো গল্প জুড়ে সবাইকে বেশ অপেক্ষা আর অপেক্ষায় রেখেছিলাম। চিত্রা যেমন নিজে মুক্তি নিয়েছে তেমনই সবাইকে গল্পের অপেক্ষা থেকে মুক্তি দিলাম। এটা গল্প হলেও গল্প নয়। এটি আমাদের চারপাশে সমাজের হাজারটা চিত্রার মনে লুকিয়ে থাকা আর্তনাদ। প্রতিটি মেয়ের সংসার ভাঙার পেছনে আরেকটি মেয়ে কিংবা শাশুড়ির এমন দৃশ্য অদৃশ্য নির্যাতনের হাত থাকে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ে (মহিলারা) অন্য মেয়েদের শত্রু হয়।
যেখানে আবার শশুর নামক পুরুষটি থাকে হয় নির্বিকার নয়তো মেরুদন্ডহীন অথবা রূপক।
সকলের জন্য শুভকামনা, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আপনাদের অপেক্ষমান রাখা ক্ষুদে নীলাভ্র জহির

সমাপ্ত