দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-২৩+২৪

0
250

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ২৩+২৪
নীলাভ্র জহির

সন্ধ্যা পেরোতেই পুরো গ্রামজুড়ে নিস্তব্ধ অন্ধকার নেমে এসেছে। জোসনা বেগম ঘরের সব কাজ শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় বাড়িতে অপরিচিত কারো গলা শোনা গেল। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। মহিলাটাকে ওনার চেনা চেনা লাগছে। খুব সম্ভবত কখনো দেখা হয়েছিল। কিন্তু সঠিক চিনতে পারছেন না। দুইজন মহিলা এসেছেন। একজন মধ্যবয়সি ও অন্য একজন সদ্য যৌবনা।
জোসনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কে গো? চিনবার পারলাম না।
মহিলা উত্তর দিলেন, আমি পূর্ব পাড়ার রমিজ মিয়ার ও আমার ছেলের বউ। রমিজ মিয়ারে চিনেন না?
– নাম শুনছি। বসেন ।
দাওয়ায় দুটো মোড়া এগিয়ে দিলেন জোসনা বেগম। পূর্ব পাড়ার নাম শুনে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে চিত্রা। সে মাথায় ঘোমটা টেনে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। দখিনা বাতাস লাগছে বারান্দায়। টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেন। সেই আলোয় মহিলা দু’জনের মুখের দিকে তাকিয়ে তার আন্দাজ সঠিক হল। ওনারা শিমুলের মা ও ভাবি। শিমুলের চেহারার সঙ্গে মহিলার চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে। চিত্রা এগিয়ে এসে মহিলাকে সালাম জানালেন।
মহিলা একপলক চিত্রার দিকে তাকিয়ে জোসনা বেগমের কাছে জানতে চাইলেন, আপনার মাইয়া ?
জোসনা বেগম বললেন, উনি আমার ছেলের বউ। তা ভাবি কী দরকারে আইছেন? এর আগে তো কোনদিনও এইদিকে আসেন নাই মনে হয়। আপনার লগে আমার সাক্ষাতও হয় নাই।
– মাঝেমধ্যে দরকার হইলে এদিকে আসি। দরকার না হইলে আসা হয়না।
– তা বইন কী দরকারে আইসেন?
– কমু। কওনের লাইগাই তো আইছি। আপনার পোলা-মাইয়া কয়জন?
– বাইচা আছে দুই জন। এক পোলা এক মাইয়া।
– মাইয়া কই?
– আছে বাড়িতে। কি ব্যাপার কন তো বুবু?
– আপনার মাইয়াডারে একটু দেখতে আইছি।
– আমার মাইয়ারে? জোসনা বেগম একপলক চিত্রার দিকে তাকালেন। অনেকদিন হয়ে গেল কোন বিয়ের প্রস্তাব আসেনি তার মেয়ের। মহিলার কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বিয়ের জন্য দেখতে এসেছেন। নয়তো পূর্বপাড়া থেকে তার বাড়িতে আসার কোনো মানেই হয় না। ইতস্তত করে তিনি বললেন, বউ রুবিনারে আইতে কও তো।

চিত্রা রুবিনাকে ডাকতে গেল। তার ঘরেই রয়েছে রুবিনা। শিমুলের মায়ের উপস্থিতি তার হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিয়েছে। চিত্রার সাজসজ্জার স্যুটকেস থেকে ফেস পাউডার বের করে দ্রুত রুবিনার গালে মাখিয়ে দিলো সে। চুল আঁচড়ে খুব সুন্দর ভাবে বেণি করে দিল। আর কোনো সাজসজ্জা আপাতত প্রয়োজন নেই। মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা টেনে দিলো রুবিনা। তারপর রুবিনাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল দাওয়ায়।
রমিজ মিয়ার স্ত্রী বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে রুবিনার দিকে তাকিয়ে রইলেন। হারিকেনের টিমটিমে আলোয় হলুদাভ ও লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে ওঠা রুবিনাকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে। তথাপি তাদের মনঃপুত হয়েছে কিনা সেটা আন্দাজ করতে পারছে না চিত্রা। মহিলা জোসনা বেগম কে বললেন, আপনার বাপের বাড়ি কোনখানে?
– বইন আমার বাপের বাড়ি দুই গ্রাম পরেই। এখন শুধু ভাইয়েরা রইছে।
– আপনেগো তো গঞ্জে কাপড়ের দোকান?
– হ, বোইন। ওর বাপের বহু বছরের ব্যবসা। সবাই তো এক নামে চিনে। আমার বিবাহের পর যখন বাজারে কোন কাপড়ের দোকান ছিল না তখন সে কাপড়ের দোকান দিছে। সেই দোকান আজকে মেলা বড় হইছে। এখন আমার পোলায় বসে। পোলা আবার বাপের চাইতেও ব্যবসাপাতি ভালো বুঝে। আপনেরা একটু বসেন আমি পান লইয়া আসি।
চিত্রা সঙ্গে সঙ্গে বললো, আম্মা আপনি বসেন। আমি নিয়া আসতেছি।
– রুবিনা বলল, মা আমিও ভাবীর লগে যাইতাছি।
জ্যোৎস্না বেগমের ঘরে বাক্সের ওপর পানের বাটা রাখা। অন্য একটা হারিকেন হাতে নিয়ে রুবিনা ও চিত্রা সেই পানের বাটা থেকে পান সাজাতে লাগলো। বিয়ের পর পর জোসনা বেগমের একদিনের ঝাড়ি খেয়ে চিত্রার বেজায় জ্ঞান হয়েছে। সে এখন পিরিচে করে পান সাজিয়ে একদিকে সুপারি ও চুন দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে পরিবেশন করে। রুবিনা বলল, ভাবি জানো আমার খুব টেনশন হইতেছে।
– টেনশন কইরো না।
ওর মায়ের যদি আমাকে ভালো না লাগে?
– কেন? লাগবো না কেন? আমার ননদিনী কি দেখতে শুনতে খারাপ নাকি। সে তো সিনেমার নায়িকা গো মত সুন্দর।
— মজা কইরো না ভাবি। আসলেই আমার চিন্তা হইতেছে।
– ধুর পাগলী। এত চিন্তা কইরা লাভ হইব। যা হওনের তাই হইব। মহিলা তোমারে পছন্দ করলেও – বিয়া হইবো না করলেও বিয়া হইবো।
– সেটাই যেন হয় ভাবি। তোমার কথায় মনে অনেক শান্তি পাই।
রুবিনা চিত্রাকে জাপ্টে ধরলো। ভালো লাগলো চিত্রার। এই বাড়িতে এখন তার আরও একজন আপন মানুষ হয়েছে , সে হল রুবিনা।

শিমুলের মা পান মুখে দিয়ে বললেন, নিজের পোলার লাইগা নিজেই কথা কইতাছি। কি আর কমু বইন? ছেলেআমার আপনার মাইয়ারে খুব পছন্দ করে। ঢাকায় গেছে এক সপ্তাহ হইল । ঢাকায় গিয়াই নাকি চাকরি হইয়া গেছে। ভালো চাকরি। বেতন তের হাজার ট্যাকা। এখন পোলায় আমার কইতাছে আপনার পোলায় নাকি বইনের বিয়ের কথাবার্তা কইতাছে। পাত্র খুঁজতাছে। এই কথা শুইনা পোলা আমার খুব চিন্তায় পইড়া গেছে। তাই আইলাম আরকি কথাবার্তা কইতে। পোলার কথা সে এই মাইয়া ছাড়া আর কোনওদিন অন্য কাউরে বিয়ে করব না। এখন কি করমু কন? আমার দুই পোলার বিয়া হইছে । এই পোলা সবথেকে ছোট। ওর বিয়া শাদীরচিন্তাভাবনা এখন ছিল না। ভাবছিলাম ব্যবসা-বাণিজ্য করব। আরও মেলা পরে বিয়ে-শাদীর চিন্তা ভাবনা করুম। ওর ভাইয়েরা তো বিয়ার কথা শুনলেই ক্ষেইপা যায়। কিন্তু পোলা আমার আপনার মাইয়ার লাইগা ঢাকায় চইলা গেছে। পোলা মাইয়া মানুষ করা বড় কষ্টের বুঝছেন।

জোসনা বেগম সব কথা নীরবে শুনলেন। বললেন, ওর বাপ বাড়িতে আসুক। আমি কথাবার্তা কইয়া দেখি। আমাগো তো এখন মাইয়া বিয়া দেওনের কোন ইচ্ছা নাই। মাইয়ার বয়স আর কতই হইবো। তাও আমি ওর বাপের কাছে কথাটা কইয়া দেখি।
– আমার পোলারে আপনার পোলায় চিনব। তার কাছে জিগায়া দেইখেন। দুই গ্রামের মানুষ ওরে খারাপ কইতে পারবো না। ছেলে আমার মানুষ ভালো। বয়স কম, এখন একটু ঘুইরা বেড়াই আর কি? চাকরি যখন হইছে এখন সংসারে গিট্টু দিব। পোলা বিগড়াইয়া যাওনের আগে আমিও বিয়ে দিয়ে দিতে চাইতেছি। বড় ভাইদেরকে আমারই রাজি করাইতে হইব। এখন আপনি আগে কথাবার্তা কন। আমার পোলারে দেখেন তারপর।

জোসনা বেগম উনাদেরকে ভাত খেয়ে যেতে অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু খেলেন না তারা। অনেকক্ষণ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলে উনারা চলে গেলেন। জোসনা বেগম ডেকে নিলেন রুবিনাকে। জিজ্ঞেস করলেন, ওই পোলার লগে তুই কথাবার্তা কস নি?
রুবিনা মাথা নিচু করে রইল।
– তোর ভাই তোরে আরেক জায়গায় বিয়া দিতে চায় এইডা ক্যামনে জানলো? আর তোর বিয়ে-শাদী নিয়ে আমরা তো কোনো আলাপই করি নাই।
চুপ করে রইলো রুবিনা। তবে তার মনে হলো সে শিমুলকে পছন্দ করে এটা মাকে জানান দেয়া দরকার। তাহলে কাজটা খুব দ্রুত হয়ে যাবে।
এসব ভেবে রুবিনা বলল, শিমুল আমারে পছন্দ করে। ঐদিন রাতে ভাইয়ারে দেখলাম ভাবীর লগে আমার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা কইতাছে। সেই জন্য আমি ওরে কইছিলাম সে যদি আমারে বিয়া করতে চায় তাইলে যেন একটা কাম জোগাড় কইরা লইয়া বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দেয়।
জোসনা বেগম চিত্রার দিকে তাকালেন, হ্যাঁগো বউ রূপক তোমারে কইসিলো বিয়ার কথা?
চিত্রা ইতস্তত করতে করতে বলল, হ মা। ওইদিনের ঘটনার পর উনি আমারে কইতে ছিল মানুষের নজর পড়ছে। রুবিনা বড় হইছে তো। ভালো একটা পোলা খোঁজ কইরা ওরে বিয়া দিয়ে দিব।
– পোলাতো আমার লগে এটা নিয়ে কথা কইল না। এই কথা তুই ওই ছেলেরেও কইরা দিছোস? তুইও তাইলে ওই পোলারে বিয়া করতে চাস?
রুবিনা মাথা নিচু করে রইল। চিত্রা রুবিনাকে বলল, তুমি ঘরে যাও।
রবিনা ঘরে চলে যেতেই শাশুড়ি মায়ের পাশে দাওয়ায় বসে পড়ল চিত্রা । যথাসম্ভব নরম গলায় বলল, আম্মা একটা কথা কইতাম। রুবিনা শিমুলরে পছন্দ করে সেটা আমি আগে থেকে জানি। কথাটা আমার কানে আইছিল। ও নাকি সাবিনা গো বাড়িতে গিয়া দুইদিন কার লগে মোবাইলে কথা কইছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম শিমুলের লগে কথা কয়। এইডা নিয়া আমি রুবিনার লগে আর কথাবার্তা কই নাই। সেদিন আপনার পোলা যখন আমারে কইলো বিয়া দিতে হইব, আমি তখন ওরে কইছিলাম আরকি যে তোমার ভাইয়া তোমার বিয়ের কথা ভাবতাছে। সে নিজেও শিমুলরে বিয়া করতে চায় সেজন্য কথাটা শিমুলের কাছে কইয়া দিছে।
ও- সাবিনা গো বাড়িতে গিয়ে মোবাইলে কথা কয়?
– হ মা ।
– ওরে কইবা আর যেন কোনদিনও ওই বাড়িতে গিয়ে মোবাইলে কথা না কয়?
চিত্রার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, পোলার ব্যাপারে একটু চিন্তা ভাবনা কইরা দেখেন। পরে আবার মাইয়া উল্টাপাল্টা কোন কাম করে কিনা।
– আমার মাইয়ারে নিয়া তোমারে ভাবতে হইব না। উল্টাপাল্টা কাম করনের মত পোলা মাইয়া আমি জন্ম দেই নাই।
চিত্রা মনে মনে হাসলো। যার ভালোর জন্য কথা বলতে যায় সেই তাকে ভুল বোঝে। কিন্তু সেই হাসিটুকু মুখে ফোটাতে পারল না। কারণ এর সঙ্গে তার নিজের সম্মান ও জড়িয়ে আছে। নিঃশব্দে সে উঠে পড়ল শাশুড়ি মায়ের পাশ থেকে।
জোসনা বেগম বললেন, পোলাডারে আমি দেখছি দেখছি লাগে। শিমুল নাম না? লম্বা কইরা? শুকনা কইরা। ঢাকা শহরে কিসের কাম করে আমরা কেমনে জানমু? মাইয়ারে তো আমি ঢাকা শহরে পাঠামু না। মাইয়ারে নিজের গ্রামে বিয়া দিমু। যেন মন চাইলে যখন তখন যাইয়া দেইখা আসবার পারি। আর চাকরি করা ছেলে আমার পছন্দ না। ব্যবসা-বাণিজ্য করব। সংসারে আয় উন্নতি হইবো। একটা গেরস্থ ছেলে দেইখা মাইয়ারে বিয়া দিমু।

চিন্তায় পড়ে গেল চিত্রা। তার মানে তিনি সরাসরি শিমুলকে না করে দিচ্ছেন। প্রথমত শিমুল গেরস্থ ছেলে নয়। দ্বিতীয়তঃ সে ঢাকায় থাকবে। এই ছেলের সঙ্গে মা কিছুতেই মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হবেন না। এই বিয়েটা আয়োজন করতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হবে তাদেরকে।

রূপক বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই চিত্রা তার হাতটা খপ করে ধরলো। বলল, আপনারে একটা কথা কইতে চাই। আপনি রাখবেন তো?
কও ।
আম্মা কিন্তু আপনার লগে কথা কইব। রুবিনা একটা পোলারে পছন্দ করে। তার নাম শিমুল। আপনি ওরে চিনেন।
পূর্ব পাড়ার শিমুল? লম্বা কইরা পোলাটা?
হ, আপনার বোন তার লগে মোবাইলে কথা কয়।
ও মোবাইল কই পাইল?
সাবিনার মোবাইল দিয়া কথা কয়। ওরা দুজন দুজনরে পছন্দ করে। কথা হইতেছে, ঐদিন রাতে আমি আপনেরে কইসিলাম না যে রুবিনার বিয়ের ব্যাপারটা চিন্তা কইরা দেখতে। কথাটা রবিনা শুইনা ফেলছে। সে শিমুলরে কইছে যে আপনি নাকি ওরে অন্য জায়গায় বিয়া দিবেন। বিয়ার কথাবার্তা চলতাছে। তার জন্য শিমুল ঢাকায় চইলা গেছে। একটা চাকরি শুরু করছে। আজকের শিমুলের মায়ে আইছিল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।
কিছুক্ষণ গম্ভীর মুখে থেকে রূপক বলল, ওই ছেলের লগে রুবিনার রিলেশন আছে?
হ,
আম্মায় কি কইলো?
আম্মা তাদেরকে কিছু কয় নাই। আমারে কইলো গেরস্থ ছেলের লগে বিয়া দিব। চাকরি করা ছেলের লগে বিয়া দিব না।
– চাকরি করাই তো ভালো। মাস শেষে বেতন পাইবো। বউরে ভালো-মন্দ কিইনা খাওয়াইতে পারব। ব্যবসা কইরা দুনিয়ার টেনশন মাথায় লইয়া না নিজের মধ্যে শান্তি আছে না সংসারে শান্তি আছে।
-আপনি একটু আম্মারে বুঝাইয়া কন।
– মনে হইতাছে রুবিনা নিজেই তোমারে পা ধইরা কইছে ভাবি আমার বিয়েটা দিয়ে দাও।
চিত্রা মুচকি হেসে বলল, আম্মারে আবার এইটা কইহেন না। রুবিনা আমার বোইনের মতো। সে এখন আমার খুব কাছের একজন মানুষ হইয়া গেছে। নিজে থাইকা আমারে কইসে ভাবি আমি ওই পোলারে বিয়া করতে চাই। আপনি একটু ভাইয়ারে রাজি করান। আমি কেমনে ওরে ফিরাইয়া দেই আপনে কন?
-এই তাহলে আসল কথা। একথা তুমি আমারে আগে কইলা না কেন?
– আগে কওনের সুযোগ পাই নাই। আমি চাইছিলাম আগে তারা আমাগো মাইয়াকে দেইখা ভালো-মন্দ একটা কিছু কইয়া যাক তারপর কমু।
– বুঝছি । খুব দায়িত্ববান ভাবী হইয়া গেছ।
– আপনি কি কষ্ট পাইছেন? রাগ করছেন আমার উপর?
– না, রাগ করি নাই। রুবিনা আমার একমাত্র বইন । ওরে ছোট থাইকা আমি খুব আদর করি। ও নিজে থাইকা কাউরে বিয়া করতে চায়, সেইটা যখন তোমারে কইছে। আমার উচিত সেটা একটু ভাইবা দেখা। আমি দেখতাছি।

চিত্রার ইচ্ছা করলো আনন্দে একটা লাফ দিতে। কিন্তু সেই আনন্দ আপাতত সংযত করতে হলো। রূপককে যেহেতু ম্যানেজ করা গেছে তারমানে বাকি কাজটা আর করতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। রূপক নিশ্চয়ই জোসনা বেগমকে রাজি করাতে পারবেন। তবুও দুশ্চিন্তা। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভালোভাবে হবে তো?

আজ পাত্রপক্ষ রুবিনাকে দেখতে আসবে। রূপকের প্রচেষ্টায় বিয়েতে সম্মতি দিয়েছেন জোসনা বেগম। সকাল থেকেই চলছে রান্নাবান্নার আয়োজন। একটা বড়োসড়ো দেশী মোরগ জবাই করা হয়েছে। মাছ ধরতে বড় জাল নিয়ে পুকুরে নামল রূপক।
আজ সে দোকানে যায়নি। প্রথমবার জাল ফেলে ছোট ছোট কয়েকটা বাটা মাছ উঠে এলো। চিত্রা হাসতে হাসতে বললো এইগুলা খাওয়াইবেন রুবিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন রে?
আরে না। বড় মাছ পামু।
বড় মাছ থাকলেতো পাইবেন। মাছ ছাড়ছিলেন পুকুরে?
মেলা আগে একবার পোনা ছাড়ছিলাম। রুই কাতলা, তেলাপিয়া। অবশ্য খাইছি অনেক। তারপরও মনে হইতাছে দুই-চারটা মাচ পামু।
কপাল ভালো হইলে পাইবেন।
চিত্রা একটা বালতি নিয়ে পুকুরের চারপাশে ঘুরছে আর রূপকের মাছধরা দেখছে। পুকুরে বড় জাল ফেলে যখন রূপক টেনে টেনে তোলে তার খুব উত্তেজিত বোধ হয়। কয়টা মাছ উঠেছে সেটা দেখার জন্য মনটা আকুপাকু করে। সে দৌড়ে এসে যখন জালের সামনে উপর হয়ে বসে দেখে একটাও মাছ ওঠেনি। ময়লা আবর্জনা উঠে এসেছে একগাদা। সেইসঙ্গে কিছু বাজে বাঁশের কঞ্চি। খিলখিল করে হেসে উঠল চিত্রা।
রূপক বলল তুমি হাসতাছো বউ। দেইখো আমি বড় মাছ পামু।
হ, দেখতাছি তো। কত বড় বড় মাছ পাইছেন আপনি।

কথাটা বলেই একটা বড় বাঁশের কঞ্চির উপরে তুলে ধরল চিত্রা। কঞ্চির দিকে তাকিয়ে সে খুব জোরে জোরে হেসে উঠলো। তার বাঁধভাঙা এই খল খল হাসির শব্দে রূপকের বুকের ভিতর কেমন যেন ধুকপুক ধুকপুক করছে। এই মেয়েটা যখন হাসে তার বুকের আকাশ-পাতাল সবকিছু কাঁপিয়ে দেয়। জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড ভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছা করে মেয়েটাকে।
রূপক বলল, তুমি ঘাটে নাইমো না। অনেক পিছল। উপরে গিয়া খাড়াও। মাছ পাইলে আমি দিয়ে আসমু।
চিত্রা বালতিটা রূপকের কাছে রেখে উপরে উঠে এল। লুঙ্গি ছোট করে বেধে আরো একবার পুকুরে জাল ফেলল রূপক। চিত্রাকে অবাক করে দিয়ে এবার জালে একটা বড় মাছ উঠলো। একটা বড় কাতলা মাছ। বেশ বড় একটা মাথা। খুশিতে চকচক করে উঠলো চিত্রার মুখখানা। রূপক আনন্দে চিৎকার করে বলল, বড়মাছ পাইছি বউ। কাতলা মাছ।
তারপর জোরে জোরে তার মাকে ডাকতে লাগলো, মা ও মা। দেইখা যাও কত বড় মাছ পাইছি। কই দেইখা যাও?
জোসনা বেগম ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলেন। রান্না ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তবুও ছেলের আনন্দমুখর গলা শুনে আর ভেতরে থাকতে পারেননি। মাছ দেখে তিনি হাসতে হাসতে বললেন, রুবিনার কপালটা মনে হইতেছে ভালই হইবো। প্রথম সাক্ষাতেই হের শ্বশুরবাড়ির লোকজন বড় মাছের মাথা খাইবো।
রূপক মাছটা জাল থেকে বের করতে করতে বলল, মাছের মাথাটা আমার পোলারে খাওয়াইও।
তোর পোলা কই?
পোলা তো আমার বউয়ের প্যাটে। আমার বউরে দিও তাইলে আমার পোলার খাওয়া হইবো।

জোসনা বেগম আড়চোখে চিত্রার দিকে তাকালেন। সেই চোখে রাগ কিংবা বিস্ময় কোনটই ফুটে উঠল না। তার দৃষ্টি পুরোপুরি অনুভূতিহীন। চিত্রা কোনো ভ্রুক্ষেপ করলো না। কেবল মুচকি হাসলো।
আবারো বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন জোসনা বেগম। চিত্রা বলল আম্মার সামনে এমন করলেন ক্যান?
কইছি তো কি হইছে?
আমার বুঝি শরম করে না?
ওরে আমার শরম রে। পোলার মা হইতেছ এখনো শরম রাখলে হইব। দুইদিন পর পোলার বউ আইবো বাড়িতে।
চুপ থাকেন তো। সারাক্ষণ মশকরা। মাছটা বালতির মধ্যে রাখেন। আমি লইয়া বাড়িতে যাই। কুইটা ধুইয়া রান্নার আয়োজন করতে হইবো।

চিত্রা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো একটা বেশ উৎসব উৎসব ভাব। পাশের বাড়ি থেকে চাচি এসেছেন। নারকেল কোড়াচ্ছেন তিনি। নারকেল দিয়ে পুলি পিঠা ভাজা হবে। আতপ চাল আর খেজুর গুড় দিয়ে বানানো হয়েছে ক্ষীর। এ বাড়ির সবাই মানুষকে খাওয়াতে খুব পছন্দ করে। আর মেয়ের বাড়ির পাত্রপক্ষ মানে তো আরও বিশেষ কিছু। রান্না ঘরের পাশে বটি ছাই নিয়ে বসলেন এক দাদি। তিনি মাছ কাটবেন। চিত্রা দাওয়ায় হেলান দিয়ে দাড়াল। তার এখন কোন একটা কাজ করা কর্তব্য। কিন্তু জোসনা বেগম এখন পর্যন্ত তাকে কোনো কাজ করতে দেয় না। যদিও গত কয়েকদিন ধরে তার আচরণে মোটেও মনে হয়নি যে তিনি রেগে আছেন। তবুও চিত্রা রান্না ঘরের আশেপাশে এলেই তিনি বলেন, তোমার কিছু করতে হইবো না।
বাজারের ব্যাগ এর পাশেই পলিথিনে অনাদরে পড়ে রয়েছে এক বিরা পান। চিত্রা পান নিয়ে গেল ধোয়ার জন্য। গামলা ভরে পানি নিয়ে খল খল করে পান ধুয়ে রাখলো। শাশুড়ীর ঘরের মাচা থেকে নিয়ে এলো সুপারি। টুলের ওপর বসে ধীরে ধীরে সুপারি কাটতে লাগল সে। কিছুক্ষণ পরে আবার ও রূপকের উচ্ছ্বসিত কন্ঠ শুনতে পেল, মা দেইখা যাও। চিত্রা কই গেলা? এই দেখো আবার একখান পাইছি।
এতগুলো মানুষের সামনে থেকে উঠে যেতে চিত্রার লজ্জা লাগছিল। তাই বসে বসে সুপারি কাটতেই মনোযোগ দিয়ে রাখল সে। মোরগের মাংস কষানোর কড়া সুঘ্রান আসছে। ঘ্রাণে খিদে পেয়ে যাচ্ছে চিত্রার। কিন্তু লজ্জায় বলতে পারল না।
রূপক মাছ নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। বলল, যা পাইছি তাতেই ম্যালা হইবো। এবার একখান বড় কার্ফু মাছ পাইছি। ছোট ছোট কিছু পুটি মাছ ধরছে। এগুলা কড়া কইরা ভাজি কইরো।
মাছের বালতিটা রান্নাঘরের পাশে রেখে রূপক পুকুর ঘাটের দিকে চলল গোসল করতে। চিত্রাকে বলল আমার লুঙ্গি টা দিয়ে যাও তো?
মনে মনে এমন একটা সুযোগ খুঁজছিল চিত্রা। সে সুপারি রেখে ঘরে গেল লুঙ্গি ও গামছা নিতে। মাচার একপাশ থেকে নিল তার গোসল করা সুগন্ধি সাবান। অনেকক্ষণ ধরে তার স্বামী পুকুরে মাছ ধরেছে। গায়ে পানি ও কাদার গন্ধ। এখন তাকে সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে দিতে পারলে ভালো হয়। চিত্রা গামছা ও সাবান নিয়ে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়ালো। রূপকের গোসল করা প্রায় শেষ। উঠে এসে গামছাটা হাত থেকে নিতে লাগল সে।
চিত্রা বলল, খাড়ান । আগে উইঠেন না। সাবান মাখেন।
আরে সাবান লাগাইতে হইব না।
একটু মাখেন।
আমি সাবান মাখলে তুমি খুশি হইবা?
হ,
তাইলে তো দেখি মাখাই লাগে। দেও সাবান টা দেও।

চিত্রা হাসিমুখে সাবান এগিয়ে দিল রূপকের দিকে। গায় বেশি করে ফেনা তুলে দুই হাত দিয়ে রূপক কচলাতে থাকল। মন ভরে সেই দৃশ্য উপভোগ করতে লাগল চিত্রা। তার মনে হচ্ছে আজকের দিনটা ভীষণ সুন্দর। সবার মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে দুই পরিবার মোটামুটি রাজি এই বিয়েতে। আজকে আনুষ্ঠানিকভাবে রুবিনা কে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। তারপর নিশ্চয়ই বিয়ের দিন তারিখ নিয়ে পাকা কথা হবে। সবকিছু ভালোভাবে শেষ হবে কিনা সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা থাকা সত্ত্বেও আজকের দিনটা চিত্রার কাছে একটি বিশেষ দিন। আজকের দিনের সব কিছুই সুন্দর।

মেহমানরা আসতে আসতে বিকেল গড়িয়ে গেল। জোসনা বেগম পোলাওয়ের চাল ধুয়ে রেখেছেন। মেহমান আসার পর তিনি সেটা রান্না করবেন বলে। আগেভাগে পোলাও রান্না করে রাখলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। খেতে ভালো লাগবে না। কিন্তু তারা ভীষণ দেরী করে এলেন।
সবাইকে অভ্যর্থনা জানিয়ে আঙিনার মাঝখানে গোল করে রাখা চেয়ারে বসতে দেয়া হলো। কাচের জগ ভর্তি করে এক জগ শরবত বানিয়েছে চিত্রা। শরবতের জগ ও গ্লাস টেবিলের মাঝখানে এনে রাখলো। ধীরে ধীরে সবার হাতে শরবত তুলে দিয়ে সালাম জানাচ্ছিল চিত্রা। মুরুব্বী এসেছেন বেশ কয়েকজন। অল্প বয়সী মেহমান খুব কমই এসেছেন বলা যায়। শিমুলের ভাই ও ভাবিরা আছেন। ভাবিদেরকে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল চিত্রা।
রূপক লেগে পড়ল সবাইকে নাস্তা দিতে। চিত্রার বিয়ের সময় কেনা একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পড়ানো হয়েছে রুবিনাকে। নিজের সাজসজ্জা নিজেই করেছে রুবিনা। গালে ফেস পাউডার লাগিয়ে গাল দুটো লাল টকটকে বানিয়ে ফেলেছে। ঠোঁটে দিয়েছে লাল লিপিস্টিক।
তাকে নিয়ে যাওয়া হল সবার সামনে। ভয়েই রুবিনার আত্মা শুকিয়ে কাঠ। কী যে হবে, সেই ভাবনায় আচ্ছন্ন মনে ব্যকুল সে।
একজন মুরুব্বি জানতে চাইলেন,
তোমার নাম কি মা?
রুবিনা ভয় ভয় গলায় উত্তর দিল। অন্য একজন জানতে চাইলেন তার পড়াশোনা কতদূর, কোন কোন কাজ করতে পারে, রান্নাবান্না জানে কিনা, হাদিস কোরআন পড়া আছে কিনা ইত্যাদি।
হাদিস-কোরআনের প্রসঙ্গ আসতেই অন্য একজন মুরুব্বী বললেন, সূরা কদর পইড়া শুনাইতে কও।
রুবিনা মনে মনে সূরা পড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে শিমুলের বড় ভাই বললেন, থাউক পড়া লাগব না। তার জানাশোনা তার মধ্যে থাকবো। সূরা কিরাত তার নামাজে লাগবো। আমরা শুইনা কি করমু?
উত্তরটা ভালো লাগলো রুবিনার। মনে মনে বড় ভাইয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা জেগে উঠলো। মুচকি হাসি চেপে রাখলো রুবিনা। মুরুব্বী হয়তো শিমুলের ভাইয়ের কথায় খানিকটা দমে গেলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে গম্ভীর মুখে বসে রইলেন তিনি। ভাবটা এমন যে আজকালকার পোলাপান কে তিনি এই কারণেই পছন্দ করেন না। মুরব্বিদের মুখের উপর কথা বলার কারনে।
তখন আর একজন বললেন, তাইলে আর জিজ্ঞেস করার কি আছে। আর কোন কিছু জানার দরকার নাই। এখন আপনি তাইলে ঘরে যান।
রুবিনা কি করবে বুঝতে পারলো না। স্থিরভাবে বসে রইল। শিমুলের বড় ভাই চিত্রাকে ইশারা করে বললেন, নিয়া যান।
ঘরের ভেতর যেতে যেতে রুবিনার মনে হচ্ছিল এই পথ যেন অনন্তকাল ধরে জ্বলছে। কারণ সেই মুহূর্তে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সবার চোখ তখন তার হাটা চলা নিয়ে কথা বলছিলো নিশ্চয়ই। অনেকটা আরষ্ঠ বোধ করছিল রুবিনা। তাকে নিয়ে কে কী ভাবছে সেসব তাকে চিন্তিত করছে। শেষ পর্যন্ত সবার সম্মতিতে বিয়েটা ভালোভাবে হবে তো? শিমুলের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সে পড়ে রয়েছে সূদুর ঢাকা শহরে। সবকিছু কিভাবে হবে কে জানে? মনে কেবলই অজানা আশঙ্কা।

রুবিনা ঘরে চলে গেলে দু একজন মুরুব্বী বলাবলি করছিল মাইয়া ভালো আছে। ভদ্র, শিক্ষিতা। নামাজী ও মনে হয়। এখন যেহেতু পোলা আগে থেইকা মাইয়ারে পছন্দ করে, আমাদের তো এখানে আর কিছুই বলার ছিল না। তারপরও সমাজের একটা নিয়ম আছে। আমরা দেখতে আইছি। মাশাল্লাহ মাইয়া পছন্দ হইছে আমার। বাকিদের যা মতামত থাকুক না কেন বিয়ে তো দিতেই হইবো। নয়তো আমাগো নাতি আবার খুব কষ্ট পাইব মনে। তয় আমার মনে হয় কারোই মাইয়ারে অপছন্দ হয় নাই।

মুরুব্বী কথাটা বলে সবার মতামতের জন্য প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকালেন। মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন সবাই। তখন মুরুব্বী বললেন, তাইলে এখন আপনারা একদিন আমাদের বাড়িতে আসেন। আমাদের পোলা যেহেতু ঢাকায় আছে। দুই দিনের ছুটি লইয়া পোলারে আইতে কই। আপনারা পোলারে দেখেন। একটা আলাপ পরিচয় হোক। তারপর যেহেতু পোলায় চাকরি করে, যে দিন আইবো তারপরের দিন বিয়ে-শাদির একটা ব্যবস্থা করা যায়। এখন আপনাগো কি মতামত?
মুরুব্বী তাকালেন রূপকের বাবার দিকে। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা তিনি। মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন। এই দিন হয়ত প্রত্যেকটা বাবাকেই দেখতে একই রকম লাগে। খানিকটা মুষড়ে পড়েছেন তিনি। জোসনা বেগম দূরে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। লম্বা ঘোমটা টেনে দিয়ে মুখে আঁচল গুঁজে তিনি চোখ পিটপিট করে খেয়াল করছেন কি কি বলছেন? তিনি সেখান থেকে মৃদু স্বরে বললেন, আমাগো কোন আপত্তি নাই।
তখন মুরুব্বী উত্তর দিলেন, আলহামদুলিল্লাহ । তাইলে আমরা পোলারে আইতে কই?

সবার মুখে ফুটে উঠল হাসি। কারন বিয়ে মোটামুটি পাকা হয়ে গেল। শিমুল যেদিন আসবে তার পরের দিন পড়িয়ে দেয়া হবে বিয়ে। বিয়ের সব আয়োজন তাহলে এখন থেকেই শুরু করতে হবে। দিনক্ষণ নির্ভর করছে এখন পুরোটাই শিমুলের ওপর।
জোসনা বেগম খাবারের আপ্যায়নে লেগে গেলেন। মেহমানদের সামনে যে বড় টেবিলটা বসানো হয়েছে সেখানেই দেয়া হল খাবার। রূপক নিজহাতে পরিবেশন করছে। পানির জগ দৌড়াদৌড়ি করে এনে দিচ্ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। রূপকের চাচাতো ভাইয়েরা এনে দিচ্ছে তরকারির বাটি। খাবারের আয়োজন দেখে মুরুব্বিদের চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি। আয়োজনের কোন কমতি রাখেননি রূপকের পরিবার। খাবার খেয়ে পান মুখে দিয়ে যে যার মত আরাম করে বসলেন। কেউবা হাঁটতে গেলেন বাইরে। কেউ আবার রূপকের বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তাদের ঘরের ভিতরে গিয়ে বসলেন। পুরুষ লোকদের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে চিত্রার ঘরের ভেতর জোসনা বেগম মহিলা অতিথিদেরকে খেতে দিলেন। তাদেরকে আপ্যায়ন করছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে সবার জোরাজুরি থাকা সত্বেও তিনি কিছুই মুখে দিতে পারছিলেন না। মেয়ে হারানোর শোকে যেন আজ থেকেই তিনি মুষরে পড়েছেন। সকলে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে এই এই দেখে তার চোখ ছল ছল করছে। অন্যদিকে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। এক ধরনের হাহাকার গ্রাস করেছে। এই শূন্যতা কিসের তিনি বুঝতে পারছেন না। জগতের শুধুমাত্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতাই এই অনুভূতি উপলব্ধি করবেন।

চলবে..