দ্বিতীয় পুরুষ পর্ব-২৫+২৬

0
251

#দ্বিতীয় পুরুষ
পর্ব ২৫+২৬
নীলাভ্র জহির

রুবিনার বিয়ে নিয়ে পুরো বাড়ি জুড়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার আমেজ। তবে শেষ বেলায় ঝামেলা হল যৌতুক নিয়ে। মুরুব্বীরা যৌতুক হিসেবে দাবি করলেন ঘরের সব আসবাবপত্র এবং নগদ এক লক্ষ টাকা। সেইসাথে ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করার একটা ব্যাপার তো রয়েছেই। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল জোসনা বেগম ও তার স্বামীর। এত টাকা যৌতুক দিয়ে কিছুতেই তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন না। ছেলেকে তিনি বিনা যৌতুকেনল বিয়ে করিয়ে এনেছেন। শুধুমাত্র একটা সাইকেল চেয়েছিলেন সেটাও পাননি। মেয়েকে তিনি কিছুতেই এত টাকা যৌতুক দিতে পারবেন না। দেয়ার সক্ষমতা নেই এমন নয়। তিনি চাইলেই জমা-জমি কিছু বিক্রি করে টাকা দিতে পারবেন মেয়েকে। বাড়ির বাগানের গাছ কেটে ঘরের আসবাবপত্র বানিয়ে দিতে পারবেন। আসবাবপত্র তো দেয়াই যায়। কিন্তু তাই বলে নগদ এক লক্ষ টাকা দাবি করাটা নিতান্তই অমূলক। মুরুব্বিদের দাবি তাদের ছেলে দেখতে-শুনতে বেশ ভালো। ঢাকায় ভালো বেতনে চাকরি করে। তাই তাদের দাবি-দাওয়া বেশ বড়। এটা নিয়ে বাড়িজুড়ে বেশ একটা কোন্দল বেধে গেল। জোসনা বেগম ও রুপক আলোচনা করছেন তারা কিছুতেই এই যৌতুক দিতে রাজি হবেন না। এতে হয় বিয়ে হবে না হয় না হবে। কিন্তু কথাটা কানে যেতেই ভেঙে পড়ল রুবিনা। এটা কিছুতেই হতে পারে না। কথা ছিল বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা হবে, বিয়ের কথা পাকা হবে। কিন্তু যৌতুকের ব্যাপারটা নিয়ে তো কোনো কথা হয়নি। হঠাৎ করে এই পরোক্ষভাবে এই জিনিসটা চলে আসলো কিভাবে? রুবিনা চাইলেও এই মুহূর্তে শিমুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না। কাজেই তাকে চুপ করে থাকতে হলো।

চিত্রা ঘরে ঢুকে রুবিনার পাশে এসে বসে। মৃদু স্বরে বলল, শিমুল এটা কি করলো? তোমার লগে প্রেম করার সময় সেতো যৌতুক চায় নাই। বিয়ার সময় কেন যৌতুক চাইব?
– ট্যাকা শিমুল চায়নায় ভাবি। আমার মনে হয় ওর বাড়ির লোকজন চাইতাছে। পোলা বিয়া করার লাইগা পাগল হইয়া গেছে তো। তাই শিক্ষা দিতাছে ওর বাড়ির মানুষজন।
– যাই করো না কেন তোমার শিমুলের লগে কথা কওন দরকার।
– এখন কেমনে কথা কমু?
– পরে কইবা । তারা যা কওয়ার কইয়া যাক। তারপর কি করা যায় আমরা দেখতাছি?
– আমার খুব চিন্তা হইতেছে ভাবি।

রুবিনা খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলল। চিত্রা ওকে আশ্বস্ত করে বলল চিন্তা কইরো না। এতদুর আইসা সবকিছু শ্যাষ হইয়া যাইতে পারেনা। একটু ধৈর্য ধরো।
পাত্রপক্ষ তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করলে রূপকের বাবা বললেন, আমি ঘরের আসবাবপত্র দিমু। আর নিজে দিল খুশি কইরা যা দিতে মন চায় দিমু। কিন্তু কোন টাকা পয়সা দিতে পারমু না। এতে যদি আপনারা রাজি থাকেন তাইএ যোগাযোগ কইরেন আর নয়তো করতে হইবো না। আমার মাইয়া আমার ঘরে থাকুক। তারে বিয়া দেওয়ার জন্য আমার এত তাড়াহুড়া নাই।

এই কথা শুনে ফিরে গেল পাত্রপক্ষ। বাবার মুখের উপর রূপক কিছু বলার সুযোগ পেল না। সে বলতে চেয়েছিল কিছু টাকা-পয়সা হলেও তারা দেবে। কারণ তার একমাত্র আদরের বোন ভালোবাসে ওই ছেলেকে। বাবার কথা বলার পর সেখানে আর কোন কিছু বলার অবকাশ রইল না। পাত্রপক্ষ ফিরে গেলে অন্ধকার হয়ে গেল রুবিনার মুখ। সত্যি তো তাদের কোন দায় পড়েনি। তার পরিবার কেনই বা তার কথা চিন্তা করবে। কেউ তো জানেনা কতটা দায়বদ্ধতা নিয়ে বসে আছে রুবিনা। শিমুলকে না পেলে বেঁচে থাকার কথা চিন্তাও করতে পারছে না।

রুবিনাকে রূপকের মোবাইলটা এনে দিল চিত্রা । শিমুলকে কল দিয়ে বিষয়টা জানান রুবিনা। শিমুল তাকে আশ্বস্ত করেছে। সে কোন যৌতুক নিবে না। এমনকি ঘরের ফার্নিচার পর্যন্ত না। নেয়ার মত একমাত্র রুবিনাকেই নিয়ে যাবে।

তার এই কথা মুরুব্বিদের কাছে কতটা গুরুত্ব পেল সেটা বোঝার উপায় নেই। কারণ দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেল। কোনরকম খবর এলো না ওই বাড়ি থেকে। এদিকে রুবিনার বাবা-মা ভুলেই গিয়েছেন যে তার মেয়েকে কেউ দেখতে এসেছিল। ওই বাড়িতে বিয়ে না দিলেও তাদের চলবে। যাদের এত বেশি চাহিদা থাকে, এমন লোভী পরিবারে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। ভীষণ মুষড়ে পড়েছে রুবিনা। ধীরে ধীরে সে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সারাদিন বিছানাতে শুয়ে শুয়ে কাটছে তার। চরম হতাশা ঘিরে ধরেছে তার জীবনে। এই মুহূর্তে মৃত্যুই একমাত্র সমাধান তার কাছে। কিন্তু মৃত্যুটাও কখনো এত সহজ নয়। কখনো কখনো বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়া টা অনেক কঠিন।

চিত্রা ঘরে ঢুকে দেখল চোখমুখ ফোলা রুবিনার। মেয়েটা যে অনেক কান্নাকাটি করেছে সেটা তাকে দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে। চিত্রা বলল, তুমি কাইন্দ না বইন। আমি আজ শিমুলের লগে কথা কমু। সে যদি নিজের পরিবাররে রাজি করতে না পারে তাইলে তোমারে যেন ঢাকায় লইয়া যায়। পলাইয়া বিয়া করবা তোমরা। এছাড়া আর কোন উপায় তো দেখিনা।
হ, ভাবি। সেইটাই করতে হইবো। তুমি শিমুলরে কইবা বাড়িতে রাজি না হইলে আমারে যেন তাড়াতাড়ি জানাইয়া দেয়। আমি আর এইভাবে থাকবার পারতাছিনা। মনে হইতাছে কখন জানি দম বন্ধ হইয়া মইরা যামু।

সুযোগ বুঝে সাবিনার ফোন থেকে শিমুলকে আবারো কল দিলো চিত্রা। যতটুকু সম্ভব অনুরোধ করলো শিমুলকে। তারা যা করেছে ভালোবেসে আবেগের বশে করে ফেলেছে। সেই আবেগ এখন চরম বাস্তবতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের। এই বাস্তবতার মুখোমুখি তাদেরকে হতেই হবে। নয়তো ঝরে যাবে একটা জীবন। আর নষ্ট হয়ে যাবে দুইটি পরিবারের সম্মান। পুরো গ্রামবাসীর কাছে তারা কতটা অসম্মানিত হবে সেসব আরো একবার শিমুলকে বুঝিয়ে বলল চিত্রা। তবে শিমুলের কন্ঠ শুনে সে বুঝতে পারলো ছেলেটা ভীষণ মানসিক চাপে রয়েছে। একদিকে তার কোনো চাকরি হয়নি। অন্যদিকে বাসায় রাজি করানোর প্রেসার।

সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে। পশ্চিম আকাশে লাল আভা যেন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত আকাশ জুড়ে। লাল রঙে ছেয়ে গেছে পৃথিবীর আলো। জোসনা বেগম ধীরে ধীরে তার হাঁস মুরগি গুলোকে ঘরে তুলছেন। ভ্যাপসা গরমে জানালা খুলে দিয়ে বসে রয়েছে চিত্রা। বাড়ির সামনে সাইকেলের ক্রিংক্রিং আওয়াজ শোনা গেল। চিত্রা জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলে দেখল সাইকেলের পেছনে থেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একজন যুবক নামছে। যুবককে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। শিমুল এসেছে। ধক ধক করছে চিত্রার বুক। এই সন্ধ্যাবেলায় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সরাসরি তাদের বাড়িতে শিমুল কেন এসেছে?
চিত্রা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। শিমুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করছেন জোসনা বেগম। স্বাভাবিক কথাবার্তা। শিমুল চিত্রাকে বলল কেমন আছেন ভাবী?
ভালো আছি।
জোসনা বেগম দাওয়ায় একটা চেয়ার বের করে দিলেন। চেয়ারে বসতে বসতে শিমুল বলল, আমি রুবিনার লগে দুইটা কথা কইতে আইছি। ওরে একটু ডাইকা দেন। বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছেন জোসনা বেগম। এই ছেলেটা কি কথা বলতে চায় তার মেয়ের সঙ্গে। উনার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পাছে লোকজন নানান কথা ছড়ায়। তিনি ভীত সন্ত্রস্ত্র মুখে তাকিয়ে আছেন।
রুবিনা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।
শিমুল বলল, কেমন আছ রুবিনা?
রুবিনা মাথা নিচু করে রইল। মায়ের সামনে কথা বলতে সে লজ্জা পাচ্ছে।
শিমুল রুবিনাকে সাক্ষী রেখে জোসনা বেগম কে বলল, আন্টি আমি আপনার মেয়েকে পছন্দ করি। আমি ওরে বিয়ে করতে চাই। আমি ঢাকা থাইকা আইছি। এখনও বাড়ি যাইনি। আগে রুবিনার লগে দুইটা কথা কইয়া তারপর যামু। রুবিনা শুনো। আমি বাড়িত গিয়ে সবার লগে কথা কমু। কোন রকম টাকা পয়সা ছাড়াই এই বিয়েতে রাজী হইতে হবে। ওদেরকে যেমনে পারি আমি ম্যানেজ করুম। কিন্তু তুমিও তোমার বাপ মায়েরে ম্যানেজ কইরা রাইখো। আমি জানি তুমিও আমারে পছন্দ করো।
জোসনা বেগম এর সামনে কথাগুলো শুনতে রুবিনার খুব লজ্জা লাগছিল। মাথা নিচু করে রইল রুবিনা। জোসনা বেগম বললেন দেখো বাবা। তোমরা এমনে কথা কইলে তো হইবো না। সমাজের একখান নিয়ম কানুন আছে। তারপরও তুমি যদি তোমার বাপ মায়েরে ম্যানেজ করতে পারো। তাইলে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু বাবা বিয়ার পরে তোমার বাপ মা আমার মাইয়ারে জ্বালাইবো সেইটা তো হইবো না।
জ্বালাইতে পারবনা আন্টি। বিয়া কইরা আমি ওরে নিয়া ঢাকায় চইলা যামু। আর আপনার মেয়ে রে দেইখা রাখার দায়িত্ব আপনি আমারে দিবেন। ওর কোন অসুবিধা হইলে আপনি আমারে কইবেন।
সেইটাই। তোমার মুখের দিকে তাকাইয়া আমি রাজি হইছি। আমি তোমার পরিবারকে দেখতাছি না। এখন আমারে বিশ্বাস তোমারে রাখতে হইবো।

জ্যোৎস্না বেগমের নরম গলায় বলা কথাগুলো শুনে ভীষণ অবাক হলো রুবিনা ও চিত্রা। মেয়ের পছন্দকে এভাবে তিনি সম্মান জানাবেন এটা তারা কল্পনাও করেনি। জোসনা বেগম মুড়ি চানাচুর মাখিয়ে শিমুলের জন্য নিয়ে আসলেন। এই সুযোগে শিমুল রুবিনার কাছাকাছি এসে বললো, বাড়িত যামু। গিয়ে সবাইরে কমু আমি তোমারে বিয়া করতে আইছি। দুই দিনের মধ্যে তোমার লগে আমার বিয়া দিতে হইব। যদি না দেয় আমি ঢাকায় চইলা যামু আর কোনোদিন বাড়িতে আর আসমু না। আমার কথা শুইনা সবাই নিশ্চয়ই রাজী হইবো বিয়া দিতে। তাও যদি রাজি না হয় দুইদিন পর ঢাকায় যাওয়ার সময় আমি তোমারে লইয়া যামু। যে কাউরে দিয়া তোমারে খবর দিবার পারি। তুমি রেডি থাইকো।
রুবিনা ছলছল চোখে শিমুলের দিকে তাকালো। তার হাতটা খপ করে ধরে ভরসা দিল শিমুল। ছলছল চোখে তাকিয়ে রুবিনা দেখতে পেল এই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বীর পুরুষকে। এই বীর পুরুষ তার প্রেমিক। তার ভালোবাসার মানুষ। তার জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত একজন। যাকে ভালোবেসে কোনো ভুল করেনি। এই মুহূর্তে সমস্ত দুঃখ কষ্ট ধুয়ে মুছে ম্লান হয়ে গেল। রুবিনার হাত ছেড়ে দিয়ে আবারও চেয়ারে গিয়ে বসলো শিমুল। জোসনা বেগম ছোট বাটিতে করে নিয়ে এসেছেন মুড়ি চানাচুর। সামান্য মুড়ি মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটছিল রুবিনা ও চিত্রা। তবে এই উৎকণ্ঠা আর বেশিদিন রইল না। একদিন পরেই সাইকেল নিয়ে শিমুল ও শিমুলের বড় ভাই এলো। শিমুলের মুখে বিজয়ীর হাসি। শিমুলের এই বড় ভাইকে প্রথমদিন দেখে খুব ভাল লেগেছিল রুবিনার। ভাই বাসায় ঢুকে হাসিমুখে জানতে চাইলেন, কেমন আছেন আপা?
জ্বী ভাইয়া ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
রুবিনার দুশ্চিন্তা কমে গিয়েছিল। কারণ ও শিমুলের হাসি মুখ দেখেই সে বুঝতে পেরেছে বিয়েতে রাজি হয়েছে তার পরিবার। তবে নতুন কোনো শর্ত জুড়ে দিয়েছে কিনা সেটা জানতে তার আর দেরি করতে ইচ্ছা করছিল না।
শিমুলের বড় ভাই জোসনা বেগমকে ডেকে নিয়ে বসলেন। বিনয়ের সঙ্গে তিনি জানালেন শুরু থেকেই যৌতুক নেয়ার কোনো ইচ্ছা ওনার ছিল না। পুরোটাই মুরুব্বি মহলের ইচ্ছা। তবে শিমুলের বাবা-মা ও বড় ভাই মুরুব্বীদের কথার বাইরে গিয়ে কোনো রকম যৌতুক ছাড়া ছেলেকে বিয়ে দেবেন। এতে হয়তো মুরুব্বিদের মনঃক্ষুন্ন হবে তবে তাতে কিছু করার নেই। শিমুল যেহেতু এই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তাই ভাইয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেবে শিমুলের পরিবার। জোসনা বেগমের কাছে বিনয়ের সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিল শিমুলের ভাই। জোসনা বেগম বিস্কুট চানাচুর ও পান-সুপারি দিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। হাসি ফুটে উঠেছে রুবিনার মুখে। বিয়েটা হয়ে গেলেই সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান হয়।

সেদিন রাতেই রূপক ও তার বাবা প্রথমবারের মতো শিমুল দের বাড়িতে গেল। পরের দিন বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। কারণ শিমুলের হাতে ছুটি নেই। ঘরোয়াভাবে বিয়ে হবে। শুধুমাত্র কাছের আত্মীয় স্বজনদেরকে দাওয়াত করে বিয়ে পরিয়ে দেয়া হবে। ধুমধাম করে আয়োজন করার কোনো ইচ্ছে নেই শিমুলের পরিবারের। অথচ শুরুতে তাদের দাবি ছিল অনেক বড় আয়োজন করে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।
পরদিন সকালে শিমুল বাজার থেকে ভাবিদেরকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের কেনাকাটা করে ফেলল। বিকেল বেলা রওনা দিলো তারা। শিমুলদের নিয়ে আসা শাড়ি ও সাজ-সজ্জার সামগ্রী দিয়ে রুবিনাকে সুন্দর করে বউ সাজানো হলো। ওভারি থেকে মাত্র একজন মুরুব্বী এসেছেন। বাকিরা যে রাগ করে আসেন নি সেটা ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। তবে সবমিলিয়ে মেহমান এসেছেন প্রায় বিশ জনের মত। তাদের সবাইকে সাধ্যমত আপ্যায়ন করল রূপকের পরিবার। খাওয়া শেষে কিছু মেহমান বাড়িতে ফিরে গেলেন। মাত্র কয়েকজন আত্মীয় স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের আসরে বসলো শিমুল ও রুবিনার পরিবার।
কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই বিয়েটা নির্বিঘ্নে সেরে গেল। বিয়ে পড়ানোর পর নিজের ঘরে বসে সবকিছুকে স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছিল রুবিনার। সন্ধ্যা পেরোলেই তাকে বিদায় দিয়ে দেয়া হবে। সে ভেবেছিল শিমুলকে আদতে জীবনে পাবে না সে। শেষ পর্যন্ত তাদের বিয়েটা হয়ে যাবে এটা এখন পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আজকে খুব ব্যস্ত দিন কেটেছে চিত্রার। এখনো অতিথিদেরকে সেবাযত্নে ব্যস্ত রয়েছে সে। রুবিনা এক ফাঁকে চিত্রাকে কাছে ডেকে নিয়ে এসে কান্না করে ফেলল। চিত্রা কে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবি তুমি আমার জন্য যা করছ তা নিজের বোনের জন্যও কেউ করেনা। তোমার এই ঋণ আমি কোনদিনও শোধ করতে পারুম না।
ঋণের কথা কেন কইতাছো? তোমার সম্মান মানে তো আমার সম্মান। তোমার পরিবার আমার পরিবার।
তুমি বড় ভালো মানুষ গো ভাবি। তোমার মত মানুষ হয় না।
রুবিনা চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। চিত্রার নিজেরও কান্না পেয়ে গেল। তথাপি চোখের জল মুছে সে ননদ কে বলল, তোমারে আজকে খুব সুন্দর লাগতাছে। লাল টুকটুকে বউ।
অনেক ধুমধাম কইরা বিয়া করনের শখ আছিল গো ভাবি। তাই বিয়েটা যে হইছে এটাই আমার কাছে অনেক। আমিতো ভাবছিলাম শেষপর্যন্ত বিয়েটা আর হইব না।
এগুলো আর কইও না। সাবধানে থাইকো। নিজের দিকে খেয়াল রাখবা। আর গোপন কথা যতটুকু সম্ভব গোপন রাখতে চেষ্টা করবা। কেউ যেন কোনদিন ওই কথা জানতে না পারে।
কেউ জানবোনা ভাবি। যে কথা আমার তোমারে কওন দরকার ছিল তুমি আমারে কইতাছো। তুমি যে একটা কত বড় ভাল মানুষ এটাই তার প্রমান।
হইছে হইছে। এখন চোখের জল মুছো। ভালোবাসার মানুষরে পাইছো। হাসিখুশি থাকো। সুখে জীবন গড়ো।
রুবিনা মুচকি হাসলো। সত্যিই আজ তার সুখের দিন। শেষ পর্যন্ত শিমুল কে আপন করে পেয়েছে। এই সুখ যেন তার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে আসে। চিত্রার বুকে মাথা রেখে পরম মমতায় সে বলল, তুমি আসলেই আমার বইন। আমার বড় বইন।

আজকের পর্ব বড় করে দিয়েছি। রমজানে অফিস, ঘুম ইত্যাদি টাইমিং খুবই এলোমেলো। তাই একদিন পর পর গল্প দেই।
প্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষীরা নেক্সট না লিখে অবশ্যই সুন্দর এক‌টি অনুভূতি প্রকাশ করে যাবেন মন্তব্যের ঘরে। আর ভুলত্রুটি ধরে দেবেন।

শ্বশুর বাড়িতে এসেই রুবিনার শরীর খারাপ হয়ে গেল। সারাদিনের ধকল শেষে প্রচন্ড মাথা ঘোরাতে লাগল তার। ভাবীরা তাকে আয়োজন করে বাসর ঘরে বসিয়ে রেখেছে। তার শরীর খারাপ লাগার কথা কাউকে বলাও যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে দাঁত মুখ শক্ত করে সবকিছু সহ্য করতে হচ্ছে। অসুস্থতার কথা বললেই আবার ডাক্তার ডাকা হবে। ডাক্তার এলেই হবে বিপদ।
সবাই চলে গেলে শিমুলকে সবটা খুলে বলল রুবিনা। চাকরিতে জয়েন করতে হবে এই অজুহাত দিয়ে একদিন পরেই রুবিনা কে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শিমুল। বিদায়বেলায় বাবার বাড়িতে আরো একবার এসেছিল সে। চিত্রার গলা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না। রূপক ও জোসনা বেগম অবাক হয়ে দেখছিলেন। তাদেরকে জড়িয়ে ধরে ও এতটা মায়া কিংবা মহব্বতের সঙ্গে কান্না করে নি রুবিনা। অথচ ভাবির গলা জড়িয়ে ধরে এমনভাবে কাঁদতে লাগল যেন ভাবির সঙ্গে তার জন্ম জন্মান্তরের আত্মার সম্পর্ক।

রুবিনা ঢাকায় চলে গেলে চিত্রার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কয়েকটা দিন বিষন্ন হয়ে রইল সে। গত কিছুদিনেই রুবিনার সঙ্গে তার বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে উঠেছিল। দিনের বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে কাটাত তারা। রুবিনা চলে যাওয়ায় কোথায় একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তবে সেই শূন্যতাকে কল্যাণ ভেবে নেয়ার চেষ্টা করল। কারণ এই মুহূর্তে রুবিনার জন্য বিয়ে করাটাই সব থেকে বেশি জরুরি ছিল। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সর্বশেষ তাদের বিয়েটা যে হয়েছে এতেই খুশি চিত্রা।

মেয়ে চলে যাওয়ায় জোসনা বেগম যেন ভীষণ একা হয়ে পড়লেন। এই মুহূর্তে চিত্রাকে নিজের মেয়ের মতো বুকে টেনে নেয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প দেখতে পেলেন না। তিনি মাঝে মাঝে চিত্রাকে ডেকে পাশে বসান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাংসারিক গল্প করার চেষ্টা করেন। বিষয়টা চিত্রার খুব ভালো লাগে। শাশুড়ির শুন্য বুকটাকে সে নিজেও দখল করে নেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো।

সকালবেলা জোসনা বেগম চিত্রাকে বললেন, আইজ একবার বাজারে যামু। দোকানে ঘুইরা আসি। কাম কাজ শ্যাষ কইরা রেডি হও।
খুশিতে চিত্রার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। এই প্রথম সে নিজেদের দোকানটা দেখতে যাবে। তার স্বামীর দোকান। তার শশুরের সম্পদ। এই দোকান দিয়েই তাদের সংসারটা চলছে।

বিকেলবেলা জোসনা বেগমের সঙ্গে বাজারে যেতে যেতে তার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হল। তার ধারণা ছিল বাজারে শুধু পুরুষ মানুষরাই যায়। কিন্তু এখন দেখছে পুরো ব্যাপারটাই ভিন্ন। দলবেঁধে মেয়েরাও যায় বাজারে কেনাকাটা করতে। পথে যেতে যেতে পরিচিত অনেকের সঙ্গেই দেখা হল। ছোট ছোট মেয়েরা প্রাইভেট কিংবা কোচিং করতে যাচ্ছে। পরিচিত মহিলারা যাচ্ছে বাজার-সদাই করতে। কুন্দনপুর বাজার আগে তার কখনো ঘুরে দেখা হয়নি। বাজারে প্রবেশ করার পর বুঝতে পারলো বেশ আধুনিক বাজার। ইটপাথরের বড় বড় ঘরের ভেতর কাঁচ দিয়ে সুন্দরভাবে সুসজ্জিত দোকান গুলো দেখে মনে হতেই পারে কোনো শহরে চলে এসেছি। দোকানে দোকানে বসে কম্পিউটার চালাচ্ছে ছেলেরা। হিন্দি কিংবা রক মিউজিকের তালে তালে মূখরিত হয়ে উঠেছে রাস্তাঘাট। চিত্রা জানে এইসব দোকানে ছেলেরা মোবাইলের মেমোরিতে ভিডিও কিংবা ছবি ডাউনলোড দিতে আসে। বড় বড় বেশ কয়েকটা মার্কেট চোখে পড়ল। একদিকে কাপড়ের দোকান তো অন্যদিকে কসমেটিক্স। চিত্রা জোসনা বেগম কে বলল, বাজারে তো দেখি অনেক কাপড়ের দোকান।
জোসনা বেগম গর্বের সঙ্গে বললেন, হ। এগুলা দুই দিন আগেই হইল। এই বাজারে আমাগো দোকানটায় ছিল সবার পরথম। আমার বিয়ের পর কুন্দনপুর বাজারে কোন কাপড়ের দোকানে ছিল না। ম্যালা দূর থাইকা কাপড়-চোপড় মানুষ কিনা আনতো। তোমার শ্বশুর পরথম কাপড়ের দোকান দিছে এইখানে। ছোট দোকান দিছিল কিন্তু মেলা বেচাকেনা হইত। আস্তে আস্তে আমরাও দোকানটা বড় করছি। কিন্তু এখন আর আগের মতো বেচাকেনা নাই। বাজারে কতশত দোকান হইয়া গেছে। মানুষজন হরেক রকমের জিনিস কিনতে হরেক রকমের দোকানে যায়। এখন তো কেউ আবার উপজেলা থাইকা কিইনা আনে।

দোকানের সামনে এসে রূপকের সঙ্গে দেখা হতেই মুচকি হাসল চিত্রা। সব সময় রূপককে সে তার স্বামী রুপে দেখেছে। এই প্রথম একজন ব্যবসায়ী রূপে দেখে একটু ভিন্ন অনুভূতি হল। দোকানে বসে রূপক বেচাকেনা করছে। তারা আসার পর দুজন কাস্টমার এসেছে দোকানে। এরই ফাঁকে জোসনা বেগমের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছে রূপক। একটা ছোট্ট ছেলেকে সে কিছু খাবার ও চা নিয়ে আসার অর্ডার দিল। মুহূর্তেই দৌড়ে গিয়ে পাশের দোকান থেকে সিঙ্গারা, পিয়াজু ও চা নিয়ে এলো ছেলেটি। ততক্ষণে কাস্টমার বিদায় হলো।
রূপক চিত্রাকে বলল, প্রথমবার আইছো। কেমন লাগতাছে?
আপনার দোকানটা বড়ই সুন্দর।
সুন্দর কইরা গুছাইয়া রাখছি না? সিঙ্গারা খাও। মা, কও বাজারে কি কাম?
কাম আছে। নাক ফুলের পাথর পইরা গেছে অনেকদিন হইল। ঠিক করতে দিমু। আমি দুই গজ কাপড়ও নিমু।
দুই গজ কেন তোমার যত মন চায় নিয়ে যাও । তোমার কোন কালারটা পছন্দ বাইছা নেও।

জোসনা বেগম থরে থরে সাজানো কাপড় গুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের পছন্দসই কাপড়টা খুঁজতে লাগলেন। রূপক উঠে এসে চিত্রাকে বলল আসো তোমারে আমার দর্জির মেশিন দেখাই।
মেশিনে বসে কিছুক্ষণ চালিয়ে চিত্রাকে দেখালো রূপক। পিছনে সাজিয়ে রাখা বেশ কিছু নতুন ডিজাইনের জামা। রূপক বলল এগুলো সব আমি সেলাই করছি। কেমন হইছে?
ভালো।
তোমার একটা সেলাই কইরা দিমু?
কি যে কন? আমার কি জামা পরার বয়স আছে? অহন তো শাড়ী আর মেক্সি পরার দিন।
হ, তোমারে দুইটা ম্যাক্সি বানাইয়া দিতে হইব। তুমি একটা কাম করো। কিছু প্রিন্টের কাপড় পছন্দ কইরা দেও। এইখান থেকে পছন্দ করো।

নিজের স্বামীর দোকান থেকে কাপড় পছন্দ করতে তার এক ধরনের গর্ব বোধ হচ্ছিল। সিঙ্গারা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। রূপক বারবার বলার কারণে চিত্রা সিঙ্গারা নিয়ে খেতে শুরু করল। এমন সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া একজন পথচারী দোকানের দিকে তাকায়। লোকটা চিত্রার পূর্বপরিচিত। তার বাপের বাড়ির পাশেই ওনার বাড়ি। লোকটা চিত্রাকে দেখে বলে উঠলেন আরে আমাগো চিত্রা যে। এইখানে কি করো?
সে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। চিত্রা হাসিমুখে বলল, কেমন আছেন চাচা?
ভালো আছি। কাপড় কিনতে আইছো?
চাচা এটাতো আমার স্বামীর দোকান। ইনি আমার শাশুড়ি আম্মা।
তোমার স্বামী কাপড়ের দোকান করে? তার না বাজারে শুটকির দোকান?
মুহূর্তেই মুখটা শুকিয়ে গেল চিত্রার। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। হঠাৎ মনে পড়ল তার প্রথম বিয়ের সময় এই লোকটা উপস্থিত ছিলেন। শঙ্কায় চিত্রার মুখ শুকিয়ে গেল। সে চেষ্টা করল সহজ ভাবে হেসে বিষয়টাকে সহজ করে দিতে। কিন্তু সবকিছু এতটা সহজ ছিল না।
জোসনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাপের এলাকার মানুষ?
চিত্রা মাথা ঝাকালো। তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না।
রূপক ওনাকে সালাম দিয়ে এসে দাঁড়াল চিত্রার পাশে। বলল, চাচা ভালো আছেন? আপনি আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকার মানুষ। আর আমার দোকানে আইসা আপনি খাড়াইয়া আছেন। বসেন তো। চা খান।

রূপক ছোট ছেলেটাকে আবারো চা ও সিঙ্গারা আনতে পাঠালো। ক্রমশ পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে চিত্রার। কারণ এই লোকটা তার প্রথম স্বামীকে দেখেছে। কী যে হবে!
চিত্রা সহজ স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করল, চাচি কেমন আছে?
কিন্তু মুরুব্বী আর কথার উত্তর দিচ্ছেন না। তিনি হতভম্বের মত রূপকের দিকে তাকিয়ে আছেন। সম্ভবত তিনি পূর্বে দেখা মানুষটার সঙ্গে রূপককে মেলানোর চেষ্টা করছেন। সেটা করতে পারছেন না বলেই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন তিনি। রূপক আবারও হাসিমুখে বলল, চাচা আপনি বসেন। চা আনতে পাঠাইছি।
লোকটা হতভম্ব অবস্থাতেই বসে পড়লেন। শুকনো হাসি দিয়ে চিত্রাকে বললেন, তো ভালোই আছ তাইলে? তোমার বাপের লগে দেখা হয়েছিল দুইদিন আগে। শুকায়ে গেছে।
আব্বারে কইয়েন আমার বাড়িতে আইতে। কিছুদিন আগে একবার খবর পাঠাইছিলাম। তাও আসে নাই। কইবেন চিত্রা আপনেরে দেখতে চাইছে।
আচ্ছা।
চা ও সিংগারা চলে এলো। রূপক বলল, চাচা চা খান। আমার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য নাই। তাই শ্বশুরের এলাকার কাউরে চিনি না। আপনি কি কোন কামে আইছেন এই বাজারে?
হ, একটা কামে আইছি।
মেলা দূর-দূরান্ত থাইকা লোকজন এই বাজারে আসে। যাইহোক মাঝেমধ্যে আসলে আইসেন আমার লগে দেখা করতে। পরিচয় যখন হইল।
হ, সেইটাই। পরিচয় যখন হইল, আসবো নে।

চিত্রার মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। চাচা গ্রামে গিয়ে চিত্রা কিংবা তার স্বামীর ব্যাপারেও ভিন্ন কিছু বলবে কিনা সেই দুশ্চিন্তা কাবু করে ফেলল চিত্রাকে। তার গ্রামের লোকজন কিছুই জানেনা। এই লোকটা যদি গিয়ে সবকিছু নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয়, তাহলে তো বিপদে পড়তে হবে। পুরো গ্রামবাসীকে সে জানিয়ে দেবে চিত্রার আগের বিয়ের কথা, রূপকের কথা। চাচার সঙ্গে একাকী কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তখনই দোকানে চলে এল চিত্রার শ্বশুরমশাই। শশুরের সামনে লোকটার সঙ্গে একাকী কথা বলার সুযোগ পেলো না চিত্রা। তিনি এসে জোসনা বেগমকে বললেন, বউরে লই মোস্তফার দোকানে যাইও। যাইতে কইছে তোমারে।
জোসনা বেগম তাগাদা দিয়ে তাকে বললেন, চলো বৌমা। কাম সাইরা আসি। সন্ধ্যা হইয়া যাইতাছে।
চিত্রা তার গ্রামের লোকটিকে বলল, চাচা ভালো থাইকেন। চাচিরে আমার সালাম দিয়েন।
লোকটা হতভম্ব হয়ে সিঙ্গারা খাচ্ছেন। তার অদ্ভুত দৃষ্টি চিত্রার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিল।
লোকটা যদি রূপককে কিছু বলে দেয়? এই এক দুশ্চিন্তা মগ্ন করে ফেলল চিত্রাকে। লোকটা বিদায় না নেয়া পর্যন্ত চিত্রা কাপড় পছন্দ করার অজুহাতে দোকানে বসে রইল। তিনি চলে যাওয়ার পর মনটা কিছুটা শান্ত হল। কিন্তু তবুও এক ধরনের অজানা আশঙ্কায় চিত্রার আর কোন কিছুই ভালো লাগছে না। জোসনা বেগমের সঙ্গে জুয়েলারির দোকানে এসেও তার দুশ্চিন্তা কিছুতেই কমলো না। বাজারের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। জোসনা বেগম চুলায় ভাত বসিয়েছেন। চিত্রার খুব অস্থির লাগছে। কেন যেন মনে হচ্ছে তার জীবনে কোনো বিপদ নেমে আসতে যাচ্ছে। এতদিন এই ভয়টা তার মনে ছিল না। আজ বিকেলের পর থেকেই ভয়টা দানা বেঁধেছে মনে। চিত্রা নিবিড়ভাবে প্রার্থনা করতে লাগল যেন তাঁর জীবনে বিপদাপদ গুলো কেটে যায়।

রূপক বাড়ি ফিরল রাত্রিবেলা। ভয়ে ভয়ে তার সঙ্গে কথা বলল চিত্রা। রূপকের কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক। তারমানে বিপদের আশংকা নেই। চিত্রা শংকায় ম্লান।
দেখতে দেখতে কেটে গেল কয়েকটা দিন। চিত্রার ভয়টা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে সে। রূপক স্বাভাবিক আচরণ করছে তার সঙ্গে। সবকিছু যেন এভাবেই থাকে। তার জীবন থেকে রূপক হারিয়ে গেলে কি নিয়ে বাঁচবে সে?

চলবে..