দ্বিধা চক্র পর্ব-০৪

0
195

#দ্বিধা_চক্র
পর্ব ৪

নিলয় বাসায় ফিরতেই দেখে ঘটক বসে আছে ড্রইংরুমে। শরীর খুব কাহিল হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে গোসল করে একটা ঘুম দিতে। কিন্তু ঘটক হাসি মুখে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিলয় ঘটকের পাশে বসলো।
চারটে ছবি বের করে ঘটক বলল, একটার চেয়ে একটা মেয়ে সুন্দরী, আপনার পছন্দ হবেই হবে।
ছবি না দেখেই নিলয় বলল, সবগুলো রাজশাহী কলেজের ?
-জ্বি না, একটা রাজশাহী কলেজের বাকি তিনজন ভার্সিটির। কিন্তু প্রতিটা মেয়ে দেখেন কত সুন্দরী!
নিলয় বিরক্ত মুখে ছবিগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো, একটাকেও মনে ধরলো না। আর কেউ নেই?
-কি বলেন, আপনার একটাকেও ভালো লাগলো না?
-না, সবকটা কেমন জানি।
ঘটক ধীর কণ্ঠে বলল, কিছু মনে করবেন না। কাউকে মনে বসিয়ে রেখেছেন কি?
নিলয় চমকে তাকালো। না না, মোটেও না, কাকে মনে বসাবো। আমি এসব মন, হৃদয়, ভালোবাসায় বিশ্বাসী নই। হলে তো প্রেমই করতাম, আপনার কাছে পাত্রী খুঁজতাম?
-তা ঠিক, আমার কাছে আপনার চাহিদা অনুযায়ী এই কটা মেয়েই আছে আপাতত। একটু সময় দিন খুঁজে দিবো। আচ্ছা, আরেকটা মেয়ে আছে, একটু দেখুন তো।
নিলয় মেয়েটির ছবি দেখলো। আহামরি কিছু নয় তবে অনেকটাই অবনির চেহারার সাথে মিল আছে।
-কে এই মেয়ে?
-সিপাইপাড়া থাকে। বাবার কাঁচাটাকা অঢেল। একমাত্র মেয়ে তো একটু দেমাগ বেশি। আপনার আম্মাকে বলেছিলাম, তিনি দেমাগি মেয়ে শুনে মানা করে দিলেন।
নিলয়ের কানে কোনো কথা পৌছলো না, মেয়েটার ছবির দিকে চেয়ে ভাবলো, এই মেয়েকে বিয়ে করলে অবনির উচিৎ শিক্ষা হবে। ওর দেখা উচিত নিলয় কতোটা যোগ্য। বলল, ওর পরিবারে কথা বলুন।
-আচ্ছা, তা না হয় বললাম। আগামী শুক্রবারেই দেখা করাতে পারবো না। ওইদিন অন্যপাত্র যাবে। আপনাদের সামনের সপ্তাহে নিয়ে যাবো।
-না না এতো দেরী করতে চাইছি না, আপনি ব্যবস্থা করুন।
ঘটক একটু ভেবে বলল, আচ্ছা দেখি কি করা যায়।
ঘটককে নাস্তা দেয়া হলেও নিলয় উঠে গেল না। বসে রইলো। এটা সেটা কথা শেষে জিজ্ঞেস করলো, কাজিহাটার মেয়েটা কি যেন নাম ‘অবনি’, ওর বিয়ে সাদির কি খবর?
ঘটক একটু ট্যারা চোখে তাকালো তারপর চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে বলল, আপাতত কোনো পাত্র দেখা হচ্ছে না। মেয়ে মানা করে দিয়েছে। বলেছে, সামনে পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষে বিয়ে করবে।
নিলয় মনে মনে হেসে উঠলো। নিলয়ের ঠোঁটে মিটমিট হাসি ঘটকের চোখ এড়ালো না।

শুক্রবার দুপুরে ঘটক জানালো বিকালে কন্যা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে নিজ বাসভবনে। যথাসময়ে পরিবারসমেত উপস্থিত থাকতে। ঘটক সাথে করেই নিয়ে যাবে।
নিলয় গাড়ি ভাড়া করলো। নিলয়ের মা যাবে না সাফ জানিয়ে দিলেন। নিলয়ের নানান প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে বাতের ব্যাথা বেড়েছে বলে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মায়ের কাছ থেকে পাত্রীর নাম শুনে নদী চেঁচিয়ে পুরো বাসা মাথায় তুললো।
-এই মেয়ে কোনোভাবেই আমাদের পরিবারের বউ হয়ে আসতে পারবে না।
নিলয় বলল, বউ হলে আমার হবে, তুই চিল্লাচ্ছিস কেন?
– চিল্লাবোনা মানে! কলেজের কারো সাথে যে মেয়ের ভালো সম্পর্ক নেই, নাক উঁচু করে চলে, আস্ত একটা বেয়াদব, এমন মেয়েকেই তোর পছন্দ হলো?
-কেন, বাবা যে পাত্রী দেখিয়েছিল সে কি খুব ভালো ছিল?
-বাবার কোন পাত্রীর কথা বলছিস?
ঘটক বলল, কাজি হাটায় থাকে। আপনার সেদিন পরীক্ষা ছিল বলে যান নি।
-কাজিহাটার মেয়েটা কে, কেমন, তা আমি জানি না। তাই সেই মেয়ের প্রসঙ্গ বাদ। কিন্তু সপ্তর্শিকে আমি চিনি। সে মোটেও মিলেমিশে থাকার মেয়ে নয়। ওকে পাত্রী হিসাবে দেখতে গেলে আমি তোর সব কাপড়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেবো।
নিলয় রাশেদ সাহেবের উদ্দশ্যে বলল, বাবা, তুমি নদীকে কিছু বলছো না কেন?
-কি বলবো, তোর মায়ের পছন্দ হচ্ছে না, নদী পছন্দ করছে না অথচ তুই এই মেয়েকেই দেখতে যেতে চাইছিস। তোর সমস্যা কি?
-একবার দেখতে গেলে কি হবে? হতে পারে মেয়েটা বাইরে কাটখোট্টা কিন্তু মনের দিক থেকে অতি নরম।
নদী দুই হাত নাচিয়ে বলল, আহা হা হা! আসছে আমাদের হিন্দি সিরিয়ালের নায়ক! মনের দিক থেকে নরম মেয়ে! এতোই নরম যে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো নরম, হেহ!
ঘটক মিনমিন করে বলল, আজ তাহলে বাদ দেই পাত্রী দেখা?
নিলয় বলল, আপনি চুপ করুন। আজ অবশ্যই যাবো। বাবা, কেউ যাক না যাক তুমি আমার সাথে যাবে। শেষবার বড় গলা করে ভালো পরিবারের ভালো মেয়ে বলে আমাদের নিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু কি হলো! বেয়াদবের মতো মানা করে দিলো।
রাশেদ সাহেব বললেন, তোর সবকথা ঘুরেফিরে ওই মেয়েতেই গিয়ে ঠেকে কেন?
-কারণ সেই মেয়ে তোমার ছেলেকে অপমান করেছে।

পারিবারিক কোন্দলের মাঝে ঘটক নিজেকে গলায় ফাঁস লাগা অবস্থায় দেখতে পেল। বিয়ে ভালো হলে আল্লাহর ইচ্ছে, খারাপ হলে সব শা*লা ওই ঘটকের দোষ। এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে যেন ।

হৈচৈ শেষে ঠিক হলো রাশেদ সাহেব এবং নিলয় মিলে আজ কনে দেখতে যাবে।
নদী মাঝখানে দাঁড়িয়ে বলল, না না, আমিও যাবো।
নিলয় বিরক্ত হয়ে বলল, এতোক্ষন ঝগড়া করে এখন তুই কেন যাবি?
আমি পুরোপুরি পরোখ করে দেখবো পাত্রীকে। আমার সামনে সপ্তর্শিকে হাঁটতে হবে, চুল খুলে দেখাতে হবে, গান শুনাতে হবে, গাজরের হালুয়ার রেসিপি বলতে হবে।
-ওই একটা জিনিস ছাড়া আর কিছু কি তুই রাঁধতে পারিস যে অন্যকে জিজ্ঞেস করবি?
-পাত্রের বোন হিসাবে আমার পূর্ণ অধিকার আছে সাওয়াল জবাব করার।
-তুই আমার বিয়ে ভাঙার প্ল্যান করছিস।
-অবশ্যই! তুই এতো গাধা কেন রে….? আমি এই বিয়ে যেভাবেই হোক ভাঙবই।
-তোকে আমি নিবো না সাথে।
-তাহলে ঘরে ফিরে দেখবি তোর সব জামাকাপড় ছাই হয়ে গেছে।
-বাবা, তুমি নদীকে কিছু বলছো না কেন?
রাশেদ সাহেব ছেলে মেয়ের চুল ছেড়াছেড়ির মাঝে শান্ত গলায় বললেন, নদী মা, একবার দেখতে গেলেই বিয়ে হয়ে যায় না। শেষের টায় যে গেলাম বিয়ে হলো? উল্টো তোর ভাইকে বাতিলের খাতায় ফেলে দিলো।
-বাবা! নিলয় আহত মনে চেঁচিয়ে উঠলো। তোমরা আমার ভালো চাও না?
নদী ফোঁস ফোঁস করে বলল, ভালো চাই বলেই সাথে যাচ্ছি। কারণ আমরা মিলেমিশে থাকা একটা সুখী পরিবার।

নদী তৈরী হয়ে বের হলে নিলয় গাড়িতে ওঠার ইশারা করলো।
রাশেদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, এখান থেকে এখানে যেতে গাড়ি ভাড়া করেছিস?
-বাবা, একটা ভালো পরিবারে যাচ্ছি। সব সেজেগুজে মটরে চড়লে ব্যাপারটা কেমন দেখায় না?
নদী গাড়িতে বসে বিড়বিড় করে গান ধরলো, বড় লোকের বেটি লো… দেমাগ ভরা মন……এমন মেয়েরে বিয়ে করতে ফকির হলো নিউটন….
নিলয় দাঁত কিটমিট করে বলল, নিউটন আবার কে?
নদী মুখ বাঁকালো, ছন্দ মেলানো বুঝিস? সব কিছু বুঝতে মাথায় আপেল পড়া জরুরী নয়। অর্থ বুঝলেই হলো রে ডাংকি!

মিষ্টির দোকানে নেমে নিলয় বেছে বেছে রসকদম, কমলাভোগ, দধিয়া নিলো। দোকানী প্যাকেট করার সময় আনমনে ভাবতে লাগলো, কি করছে এসব? কেন পুরো পরিবারের বিপক্ষে মেয়ে দেখতে যাচ্ছে? মেয়েটাকে যেখানে সে চিনেই না, নামটা পর্যন্ত মনে নেই। অবনিকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে? অবনি তো এসবের কিছুই জানে না। বাবা, নদী, মা সবাইকে উপেক্ষা করে নিলয় কি হাসিল করবে? কার জন্যে?
পাগলামি হচ্ছে, চরম পাগলামি!
মিষ্টির দাম চুকিয়ে প্যাকেটগুলো বাবার হাতে দিয়ে বলল, নদীকে নিয়ে বাসায় চলে যাও বাবা। আমরা যাচ্ছি না মেয়ে দেখতে।
রাশেদ সাহেব হা হয়ে বললেন, এতোক্ষণ যুদ্ধ করে হঠাৎ মত পাল্টালি কেন? একটা পরিবারকে কথা দিয়ে এভাবে না যাওয়া মানে তাদের অপমান করা।
ঘটক তড়িঘড়ি উত্তর দিল, না না কোনো অসুবিধা নেই। আরো একটি পাত্রপক্ষ আজ যাওয়ার কথা ছিল। আমি তাদের নিয়ে যাবো। তারা অধীর আগ্রহী। আপনাদের মতো তলোয়ার যুদ্ধ করে না। ঘটক গাড়ি থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় দিলো।
রাশেদ সাহেব বললেন, বের যখন হয়েছি চল তোর হামিদ আঙ্কেলের ভাতিজিকে দেখে আসি।
– না বাবা, কাউকে দেখতে হবে না। তোমরা বাসায় যাও।
-আহা, মিষ্টি আছে সাথে, চল দেখে আসি। সেই তো কদিন পর দেখতে যাবো।
– না, আর কাউকে দেখবো না আমি। আমার কিছু ভালো লাগছে না।
নদী হেসে বলল, সন্ন্যাস জীবন বেছে নিবি নাকি?
নিলয় ঠোঁট কামড়ে কি যেন ভাবলো। নদীর কথার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
– এই ভাইয়া!
– হু…, যা বাসায় যা।
রাশেদ সাহেব এবং নদী অবাক চোখে চেয়ে রইলো এলোমেলো পায়ে সামনে হেটে যাওয়া নিলয়ের দিকে ।

চলবে।