ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-০৩

0
237

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ০৩
#_আরজু_আরমানী

বাবা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন। তার চাহনি কে আমি পাত্তা দিলাম না। তিনি আর কোন কথা বললেন না। হয়তো তার কথা বলার মতো কোনো শব্দ ছিলোনা। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চলে গেলেন আমার রুম থেকে। বাবার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম। আমার আর চুল আচড়ানো হলোনা। বারান্দায় গিয়ে দাড়ালাম। একটার পর একটা গাড়ি চলছে। কেউ কারো জন্য চিন্তা করছেনা। কারো দিকে কারো তাকানোর সময় নেই। আমার জীবনটা এই গাড়িগুলোর মতো। আমার দিকে কারো তাকানোর সময় নেই। রুম থেকে ফোন বাজার শব্দ পেয়ে রুমে ছুটলাম। ফোন রিসিভ করে কানে চাপালাম। অপর প্রান্তের থেকে নিরব ভাইয়া বললো,

” আমাদের বাসায় একটু আয় তো, খুব দ্রুত।”

সচরাচর নিরব ভাইয়া আমাকে ডাকেনা খুব সমস্যা না হলে। তাই আমিও কোনোকিছু চিন্তা না করে তার বাসায় ছুটলাম। তাদের বাসার সামনের কলিংবেল বাজতেই দরজা খুললো সে। আমি তাকে বললাম,

” কি সমস্যা ভাইয়া?”

” পূর্ব কর্নারের রুমটায় যা।”

আমি তার কথার মাথা- মুন্ডু কিছুই বুজলাম না। তবু সেদিকে গেলাম। ওখানে গিয়েই আরেক দফা ঝটকা খেলাম। আমার মা, বাবা, কাকা, ফুপিরা, ফুপারা সবাই এখানে বসা। তাদের সাথে আরো কয়েকজন লোক যাদের কে আমি চিনিনা। আমার পরনে সিম্পল ঘরোয়া ড্রেস। ওড়না কোনোরকমে মাথায় আছে। এলোমেলো চুলগুলো বুঝা যাচ্ছে। আমি কিছু না বুঝে ওখানে দাড়িয়ে আছি। তখন অপরিচিতদের মধ্যে থেকে একটা মাঝবয়সী মহিলা বলে উঠলো,

” তাহিরা তোর মেয়েকে সিম্পলভাবেই ভালোলাগে। আমার ছেলেরও নিশ্চয়ই ভালোলাগবে।”

মহিলার কথায় বুঝলাম আমাকে নতুনভাবে বিয়ে দেয়ার চিন্তা- ভাবনা চলছে।
এই কথাটা বলে উনি ওনার ছেলের দিকে তাকালেন। সাথে সাথে আমিও তাকালাম। ছেলেটা মাশাল্লাহ দেখতে সুন্দর। তবে তার চাহনি সুন্দর নয়। সে আমাকে দেখতে এসে তিশার দিকে তাকিয়ে আছে। মহিলার কথা শুনে ছেলেটা বললো,

” হ্যাঁ।”

তাদের কথায় আমার পরিবার খুবই খুশি। মনে হচ্ছে তারা রাজী। কত সুন্দর সিস্টেম তাইনা? আমার বিয়ে দিচ্ছে অথচ আমার মতামতের কোনো প্রয়োজন মনে করছে না। আমার অস্তিত্বের কোনো দাম নেই। যেই ছেলেটা বিয়ে করতে এসেছে, তার থেকে সবাই মতামত নিচ্ছে। তার আমাকে কেমন লেগেছে? আমার কোনো পছন্দের দাম নেই। কারন আমিতো মেয়ে। আমার কথা বলার কোনো অধিকার নেই। সে ছেলে তার প্রাধান্য বেশি। হাতে থাকা ফোনটা টিপে তিনটা ডিজিট ডায়াল করলাম। তাদের কথার আড়ালে এসে পরলাম। ফোন রিসিভ হতেই তাদেরকে সব বলে আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলাম। এবার নিশ্চিন্তে বসে বসে পপকর্ন খাচ্ছি। তখন মেহেরিমা এসে বললো,

” তোমার বিয়েতে আমি নাচ করবো।”

আমি ওর গাল টিপে বললাম,

” আমিও নাচবো।”

কিছু সময় অতিবাহিত হতে না হতেই কলিংবেল বাঝলো। তাসকিন দৌড়ে এসে দরজা খুলতেই দুজন পুলিশ ঘরে প্রবেশ করলেন। তাসকিন দৌড়ে এসে এ খবর মাকে বললো। সবাই তা শুনে মাথায় হাত দিলো। পুলিশরা এসে ওই রুমটায় ডুকে বললো,

” গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি এখানে বাল্যবিবাহ হচ্ছে। ”

ওনাদের কথায় সবাই খুব আহত হলো। আমার মা তাদেরকে বললো,

” না না অফিসার কিসব বলছেন, আমরা সবাই এখানে ফ্যামিলির মানুষ। আপনাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। ”

আমার বাবা আর কাকাও একই কথা বললেন। পুলিশরা অনেক জেরা করে কোনো সঠিক তথ্য না পেয়ে চলে গেলেন। তখনি সেই মাঝবয়সী মহিলা কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলেন,

” এভাবে পুলিশ এনে আমাদের অপমান না করালেও পারতি তাহিরা। তোর মেয়েকে নেয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। চল সন্জু চল। এ বাড়িতে সমন্ধ করার কোনো দরকার নেই।”

মহিলা তার ছেলেকে টেনে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক যেতে চাইছিলেন না। যাওয়ার সময়ও তিনি তিশার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন। আমার ঠোঁটের কোনে গোপন হাসি ফুটলো। তারা চলে যেতেই আমার মা সেদিনের মতো চেচিয়ে উঠলেন। সেই ব্যাক্তিকে কত গালাগাল করলেন যে, ফোন করেছিলো পুলিশকে। তিনি বাসায় ফিরে গেলেন। আমি বাসায় আসার সময় নিরব ভাইয়াকে বললাম,

” আপনাকে প্রচন্ড বিশ্বাস করতাম নিরব ভাইয়া। এক লহমায় সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে গেলো। তবে ভালোই হলো একটা বিষয় যে, আপন ভাই ছাড়া এখন আর আমি কোনো ভাইকে বিশ্বাস করতে পারবোনা। কোনো ভাই আর ভাই নয়, সবাই স্বার্থের টানে দৌড়ায়। যেমন আপনি।”

চলে এলাম বাসায়। রাত এগারোটা। ডাইনিং টেবিলে গেলাম রাতের খাবার খেতে। মা- বাবা, কাকা, তাসকিন সবাই খেতে বসেছে। আমি একটা চেয়ার টেনে বসতেই আমার মা তাহিরা বেগম বললেন,

” রায়হান আমি কি খাবার খাবো নাকি উঠে যাবো?”

তার এই কথার সারমর্ম বুঝতে আমার সময় লাগলো না। আমি চলে এলাম নিজের রুমে। আমি তার সাথে কখনোই খেতে বসিনি। ছোটবেলা সে আমাকে খাইয়ে দিয়েছিলো কিনা সেটা আমার মনে নেই। যখন আমি প্রাইমারিতে পড়তাম তখন অনেক বাচ্চার মা তাদের সাথে স্কুলে আসতো। টিফিন পিরিয়ডে তাদের নিজ হাতে খাইয়ে দিতো। তাদের নিয়ে হাওয়াই মিঠা খেতো। তখন আমার ইচ্ছে হতো, আমার মা যদি এরকম খাইয়ে দিতো আমায়। আমাকে হাত ধরে হাওয়াই মিঠা খাইয়ে দিতো। আমাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যেতো। বড় হবার সাথে সাথে আমি বুঝতে পেরেছি, সবাই ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বাঁচে না। সবার কপালে ভালোবাসা থাকেনা। একঘন্টা পর আবার ডাইনিয়ে গেলাম। ওখানে কোনো খাবার নেই। রান্নাঘরে গেলাম। দেখলাম লতিফা খালা সব খাবার ময়লার পাত্রে ফেলছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

” এগুলো কেনো ফেলে দিচ্ছেন?”
” সব কিছু ধুইয়া ঘুমামু তাই।”
” সবার খাওয়া কিন্তু শেষ হয়নাই খালা।”
” আমি এখন ঘুমামু কেডা খাইলো আর না খাইলো তা দেখার সময় নেই আমার।”

তার কথাও ঠিক। তিনি কেনো দেখবেন এসব? আমি ফ্রিজ খুললাম। ওখানে তাসকিনের জন্য রাখা এক বাটি জর্দা। ওটাকে খেয়ে নিলাম ক্ষুদার তাড়নায়। খাবার পর খেয়াল হলো এটা নিয়ে সকালে আরেক ঝামেলা হবে। তবুও পেট ঠান্ডা তো মাথা ঠান্ডা। সকালের টা সকালে দেখা যাবে।

————–

” বিয়ে তো এজন্যই হচ্ছে না। যাকে তাকে যা ইচ্ছে বলে আসো।”

স্কুলে যাবার জন্য বের হওয়ার সময় মায়ের কথা শুনে কান্না পেলো। তখন ভাইয়ের কথা শুনে মনটা আনন্দে নেচে উঠলো

” মা তুমি একটু চুপ করো। যাত্রা খারাপ কইরোনা।”

বাসা থেকে নামতেই তাহমিদ ভাইয়ার সাথে দেখা হলো। তিনি মনে হয় ভার্সিটিতে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন,

” সবার মতো কি আমাকেও অবিশ্বাস করছিস রাত্রি? ”

গাড়িতে উঠতে উঠতে তাকে বললাম,

” আপনিও সবার দলেই পরেন। আলাদা নয় আপনারা। একই খুড়ে মাথা ছাঁচানো লোক।”

গাড়ি চলতে শুরু করলো। তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দেইনি। স্কুলের কাছে আসতেই সেই লোকটাকে দেখলাম। যে গতকাল আমায় সাহায্য করেছিলো। তাকে একটা ধন্যবাদ দেয়া উচিত বলে মনে করে গাড়ি থামিয়ে তার সামনে গিয়ে দাড়ালাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন,

” আপনি কে? আর এভাবে আমার সামনে দাড়িয়ে আছেন কেন?”

লোকটা কি ভুলে গেলো উনি আমায় কাল বাড়ি পৌঁছে দিলো? তার বয়স তো খু্ব কম মনে হচ্ছে। তবে ভুলে যাওয়া রোগটা হলো কিভাবে? আমি তাকে বললাম,

” কাল আমাকে বাড়ি নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। আমি সেই।”

তিনি কিছুক্ষন মাথা চুলকে বললেন,

” তা আজ আবার কি হয়েছে আপনার?”
” না কিছু না”
” যান নিজের কাজে।”

মুখ ভেঙচি কেটে চলে এলাম। লোকটা কেমন যেনো? ধুর আমার যাওয়াটাই ঠিক হলোনা। আমি নিজের স্কুলে চলে এলাম।

চলবে………