ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-০৪

0
220

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ_০৪
#_আরজু_আরমানী

দুপুর বারোটা। টিফিন পিরিয়ড চলছে। ক্যান্টিনে যে যার মতো করে খাচ্ছে। আজ আমার তেমন খাওয়ার ইচ্ছে নেই। আজকের টাকাটা বাঁচিয়ে রাখবো আমার একটা ফুলদানী কিনতে হবে তার জন্য। তিশা এসে আমাকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে বললো,

” আজ সকালে কোচিংয়ে আসলি না কেন?”

” বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”

আমার কথা শুনে তিশা হো হো করে হেসে উঠলো। আমি বুঝলাম না ও কেন হাসছে? রোদের তাপটা আজ একটু বেশিই মনে হচ্ছে। চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে। ব্যাগের ভিতর থাকা ফোনটা কেপে উঠলো। দ্রুত ফোন বের করলাম। আন নন একটা নাম্বার থেকে কল আসছে। ইদানীং এসব আন নন নাম্বার থেকে একটু বেশিই কল -টল আসছে। ফোন রিসিভ হতেই একটা পুরুষের কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম। তার কন্ঠও অপরিচিত। আগে কখনো হয়তো কথা বলিনি। আর যদি বলেও থাকি তা মনে পরছে না। লোকটা আমাকে অনুনয়ের সুরে বললো,

” মিস রাত্রি প্লিজ ফোনটা কাটবেন না। আপনার সাথে আমার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে।”

আমি অবাক হলাম। চিনিনা জানিনা লোকটা বলছে গুরুত্বপূর্ণ কথা তাও আবার আমার সাথে। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা? আর লোকটাই বা কে ? আমি হালকা স্বরে বললাম,

” আপনাকে তো চিনিনা। ”

” আপনার স্কুলের পাশে যে রেস্টুরেন্টটা আছে এখানে আমি আছি। আপনি আর তিশা প্লিজ এখানে একটু আসুন। ”

” আচ্ছা।”

তিশাকে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করলাম। ও রাজি হলো যাওয়ার জন্য। দুজনেই হাঁটা শুরু করলাম। পাঁচ মিনিটের মতো লাগবে ওখানে পৌঁছাতে। আমরা এখানে চলে এসেছি। কিন্তু লোকটাকে তো চিনিনা। তাকে এবার খুজবো কি করে? আমি ফোন বের করলাম তাকে কল করার জন্য তখনি একজন আমাদের কর্নারের একটা টেবিলে ডাকলো। ওনাকে এখানে দেখে প্রচন্ড রকমের অবাক হলাম। তিনি এখানে কেন? আর আমাদেরই বা এখানে কেনো ডাকলেন? তারা তো কাল চলে গেছিলো। তো আবার এই নতুন নাটকের কারন কি? তবে কি তাকে মা পাঠিয়েছে? না না এই লোকটার সাথে কোনো কথা বলা যাবেনা। তিশার হাত ধরে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে নিলেই তিনি আমাদের আটকালেন। আকুল আবেদনের সঙ্গে বললেন,

” প্লিজ শুধু পাঁচ মিনিট সময় চাইছি। এর বেশি এক মিনিটও নিবোনা আমি। প্লিজ।”

কেনো জানিনা ওনার কথা বিশ্বাস হলো। আমার টেবিলে বসলাম। ওনাকে দ্রুত ওনার কথা শেষ করতে বললাম। তিনি খপ করেই তিশার হাত ধরে ফেললেন। আমি কিছু বলতে যাবো তখনই তিনি বললেন,

” প্লিজ আপনি কোনো সিনক্রিয়েট করিয়েন না। আপনি ওই টেবিলটাতে যান। আমি তিশার সাথে একা কথা বলতে চাই।”

মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ইচ্ছে করছে কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেই। রাগের তোড়ে চিৎকার করে বললাম,

” বলদা তুই আমার বোনের হাত ছাড়। নয়তো কালকের মতো ট্রিপল নাইনে ফোন করে তোর বারোটা বাজিয়ে ছাড়বো।”

কথা বলতে বলতে আমি ফোন বের করে ফেলেছি। নাম্বারটা মাত্রাই লিখেছি। ডায়াল আর করতে পারিনি। তার আগেই উনি তিশার হাতটা ছেড়ে দিলেন। আমি তিশার হাত ধরে দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে পরলাম। স্কুলে চলে এসেছি। হাত- পা সব কাঁপছে। কি একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পরেছিলাম। তিশা আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আমি ওকে বললাম,

” কিরে ভয় পেয়েছিস?”

ও আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

” উহু, তোর সাহস দেখে অবাক হয়েছি।”

—————-

বিকালে এশা আপুদের বাসায় আসলাম। তার সাথে পুরো ঘটনাটা শেয়ার করলাম। তিনি আমার কথা শুনে বললেন,

” রাত্রি, আমি জানিনা মামি তোকে এতো তাড়াতাড়ি কেনো বিয়ে দিতে চাইছেন? তার কিসের এতো তাড়া? আর মামা কেনো কোনো কথা বলছেনা। কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। ”

” হয়তো এটাই আমার ভাগ্য। ”

” হ্যাঁ। আমরা ভাগ্যে বিশ্বাস করি। কিন্তুু আমরা কর্মও করি। ভাগ্যের উপর আমরা সব ছেড়ে দিতে পারিনা। তুইও ছাড়বিনা। কাজ করবি। দেখবি তোর ভাগ্য বদলাবে।”

সত্যি সেদিন এশা আপুর কথা শুনেছিলাম। পড়াশোনার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এস. এস. সি. তে আমি এ+ পেলাম। তার মধ্যে কত সমন্ধ এসেছিলো। কিন্তু বারবার তা ভেঙে গেছিলো। কোনো সমন্ধই ঠিক হচ্ছিলো না। মায়ের লাঞ্ছনা – গঞ্জনা কম শুনিনি। তবুও আশা ছিলো। দিনশেষে কেউ আসবে আমার একান্ত নিজের মানুষ হয়ে। ঢাকার নামিদামী কলেজে ভর্তি হতে গেলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। তার জন্য আবার কোচিং করতে হয়। আমার বন্ধুরা সবাই ভর্তি হয়েছে। তিশাও ভর্তি হয়েছে।আমি এখনো ভর্তি হতে পারিনি। বাসায় কাউকে বলতে পারিনি। তাসকিন এবার ক্লাস ফোরে পড়ে। মেহেরিমাকে প্লেতে ভর্তি করানো হয়েছে। তিহা ক্লাস নাইনে উঠেছে। নিরব ভাইয়া আর নিলয় ভাইয়া ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাহমিদ ভাইয়া মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা জবে ঢুকেছে। তামিম ভাইয়া চুয়েটে চান্স পেয়েছে। এশা আপু অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। এবার সে থার্ড ইয়ারে থাকতো। তবে তার একবছর গ্যাপ গিয়েছে। আয়মান ভাইয়া এইচ. এইচ. সি. পরীক্ষা দিয়ে এখন মেডিকেল ভর্তির জন্য কোচিং করছে। সবাই তাদের জীবন গড়ায় ব্যাস্ত। আমার মনে হয় আর ভালো কলেজে ভর্তি হওয়া হলো না। কোনো একটা বেনামী কলেজে ভর্তি হতে হবে।

—————

জুন মাস। বাইরে রোদের এতো তাপ যে সব ভস্ম হয়ে যাবে। মাথার উপর সিলিং ফ্যান চলছে। তার বাতাসও গরম বের হচ্ছে। মাঝে মাঝে ফ্যানটা খট খট করে আওয়াজ করছে। কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো। আমি আবার একটা ফুলদানী কিনেছি। নীল রঙের। তবে এটা টিফিনের টাকায় না। টিউশনি করানোর টাকায়। তিনটা টিউশনি করি। বিকাল চারটা থেকে আটটা। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে যায়। এ নিয়েও মায়ের অনেক কথা শুনেছি। তবে পাত্তা দেইনি। এখন আর তার কথা আমার গায়ে জ্বলন ধরায় না। সব গা সওয়া হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে টেবিলের ড্রয়ারে টাকা রেখে যায় কে যেন? তার সন্ধান আজো করতে পারিনি। প্রথমে খুঁজতাম না। কারন তখন আমার টাকার দরকার ছিলো। এখন নেই। এই দুমাসে ঔ ব্যাক্তির দু হাজার টাকা জমেছে আমার কাছে। রেখে দিয়েছি। আজ বিকালে সব ভাই-বোনেরা রমনায় ঘুরতে যাবে। আমি যাবোনা বলে দিয়েছি। আমার বিকেলে টিউশনি আছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। দুপুর দুটো বেজেছে। এবার শাওয়ার নিতেই হবে। কিন্তু আজ এতো আলসে কেনো লাগছে তা বুঝতে পারছিনা। শরীরটাকে টেনেটুনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।

——————-

বিকার তিনটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। আমি দাড়িয়ে আছি মীরা ভিলার সামনে। এই বাড়ির কারো নাম মীরা না। তবে বাড়ির নাম যে কেন মীরা সেটা আমি জানিনা। দাড়োয়ানটাকে দেখছি না। ফোন বের করে কল দিলাম মিস শিখার কাছে। উনি আমার ছাত্রীর মা। ভদ্র মহিলা খুব দ্রুত ফোন রিসিভ করলেন। আমি তাকে বললাম,

” ম্যাডাম দারোয়ান নেই। ভিতরে কিভাবে আসবো? ”

” দুই মিনিট। আমি আমার ছেলেকে পাঠাচ্ছি।”

আমি দাড়িয়ে রইলাম। একটা লোককে দেখলাম চাবি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে। তাকে চেনা চেনা লাগলো। কোথাও যেনো দেখেছি এরকম মনে হচ্ছে। সে দরজা খুলে আমাকে দেখে বললো,

” আপনি এখানে কেন এসেছেন? আবার কোন ঝামেলা হয়েছে। ”

হঠাৎই তাকে চিনতে পারলাম। এতো সেই লোক যে আমাকে কোনো একদিন আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। উনি এখানে কেন? ওনার হাতে চাবি কেন? উনিই কি আমার ছাত্রীর ভাই? যে এতো দিন দেশের বাইরে ছিলো। তা যাই হোক আমার কি? আমি তাকে বললাম,

” আমি নেহাকে পড়াতে এসেছি।”
” সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটা। ” তার কন্ঠে অবাকের হওয়ার আভাস পেলাম। আমি তাকে কিছু না বলেই নেহাদের ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। তিনিও আমার পিছু পিছু ঢুকলেন। নেহার রুমে ঢুকলাম। ও টেবিলেই বসা ছিলো। ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

” তোমাদের বাসায় ওই ছেলেটা কে?”

” আমার ভাইয়া। ”

” নাম কি ওনার?”

” আয়ান রহমান সাদ।”

আর কোনো কথা বাড়ালাম না। আমি নেহাকে পড়াতে শুরু করলাম। নেহার অপজিটে একটা ফিল্মি আয়না রাখা। ওখানে হঠাৎ চোখ পরতেই দেখলাম নেহার ভাই ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পড়াতে অসুবিধা হচ্ছে। পরীক্ষার হলে স্যাররা আমার পাশে এসে দাড়ালে আমি আর লিখতে পারতাম না। সেখানে এই লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে। আমি অনেক কষ্টে নেহাকে পড়ানো শেষ করলাম। ওই বাসা থেকে বের হতেই নেহার ভাই সাদ আমায় বললো,

” কিসে পড়েন আপনি?”

” ইন্টারে।”

” এতো ছোট আপনি?”

আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাইনি। ভালো লাগছেনা। চলে এলাম ওখান থেকে। অন্য দুটো টিউশনি করতে গেলাম। আমার টিউশনি আজকের মতো শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত আটটা বেজে পনেরো মিনিট। একটা রিক্সা থামিয়েছি। কিন্তু সে ভাড়া চাইছে অনেক। আজ রিক্সাওয়ালাদের কি হলো কে জানে? সবাই উরাধুরা ভাড়া চাইছে। এখান থেকে মেইন রোডে যেতে বিশ মিনিট সময় লাগবে। সেখান থেকে বাস ধরে বাসায় ফিরতে হবে। হিসাব কষতে কষতে রাস্তায় হাটা দিলাম। সামনে একটা অফ হোয়াইট কালারের গাড়ি এসে থামলো। গাড়ির কাচ খুলে মুখ তুলে চাইলেন সাদ। জানিনা ওনার সমস্যা কি? আমার পথ আটকিয়েছেন কেন? আমি কপাল কুচকে দাঁড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে বললন,

” আজ এই গলির মোড়ে মারামারি হয়েছে। কোনো মেয়ের উচিত হবেনা ওখান দিয়ে একলা যাওয়ার। মাতাল লোকজন আছে।”

এই মাতালদের কথা শুনলেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। একবার এক মাতালের খপ্পরে পরেছিলাম। ওমা সে কি ঘিনঘিনে ব্যাপার – স্যাপার? ওই কাহিনি মনে হলেই গা ঘিনঘিন করে। সাদ গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমি ঢুকে বসলাম। গাড়ি চলছে। আমি বাইরে তাকিয়ে আছি। কেউ কোনো কথা বলছিনা। মেইন রোডে উঠতেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,

” আগের ঠিকানায় যাবো।”

” হ্যাঁ।”

তিনি আবার গাড়ি চালানো শুরু করে দিয়েছে। আমার মাথায় একটা প্রশ্নের উদয় হলো। ” উনি কি আমার বাসা চিনেন?”
আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,

” আমার বাসার ঠিকানা আপনার মনে আছে?”

তিনি সরল কন্ঠে বললেন,

” হ্যাঁ।”

” এতোদিনের কথা কিভাবে মনে রাখলেন?”

” এমনিভাবে।”

গাড়ি থামলো। আমি তাকিয়ে দেখলাম আমার বাড়ির সামনে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নামলাম। তিনি আমাকে বললেন,

” ভালো থাকবেন। ”

” আপনি আসুন না আমার বাড়িতে।”

” সম্পূর্ণ অধিকারে একদিন আসবো।”

তিনি চলে গেলেন। আমি ওনার কথা বুঝলাম না। কোন অধিকারের কথা উনি বলছেন? বাসায় ঢুকেই খেলাম এক বড়সর রকমের ঝটকা।

চলবে