নতুন কন্ঠে ভালোবাসুক পর্ব-০৭

0
266

#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৭

মানুষটা এক প্রকার আমাকে আগলে ঘরে নিয়ে এলো। কিন্তু কিছুতেই আমার কান্না থামছেই না। আমাকে নিয়ে কেমন বিচ্ছিরি একটা বেপার হলো। মা মেয়ের মাঝে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হলো,সাথে ভাই বোনের মাঝে। আমার শাশুড়ী যতোই আমার হয়ে প্রতিবাদ করুক, নিশ্চয়ই মনে মনে তিনিও কষ্ট পেয়েছেন। আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে আবির আমাকে বুকে টেনে নিলো। চোখের জল মুছে দিয়ে থুতনি তুলে ধরলো।

_ কি হয়েছে কাঁদছো কেন?

_ আমার জন্য—
আমি কিছু বলতে পারলাম না,আবারও বুক ভাসিয়ে কেঁদে দিলাম।

_ দেখো দেখি আবারও কাঁদছে। এই তুমি কবে থেকে এতো ছিচকাঁদুনি হলে। বিয়ের আগে তো শুনেছি যাকে বিয়ে করছি সে কান্না আঁটকে রাখার চ্যাম্পিয়ান! কিন্তু বিয়ের পর দেখি সব পাল্টে গেছে। আচ্ছা বউ কী কোন ভাবে বদলে গেছে। আমি ভাই আমার পুরাতন বউ চাই। বউ বদলে গেলে বউ কিডনাপের কেসফাইল করতে হবে।

মানুষটার কথা শুনে আমি হেঁসে দিলাম। মানুষটা এমন কেন,সব কিছুতেই তাঁর বাচ্চামো। আমার মন খারাপ করার কোন চান্স নেই। আমাকে হাসতে দেখে আবির বললো।

_ ওই চাঁদপানা মুখে হাসি মানায়,বিষাদ না। একটা কথা বলবো মোনা।

_ হুম

_ এখানে নয়,চলো বেলকনিতে যা-ই।

তারপর আমার হাত ধরে বেলকনিতে নিয়ে গেলো। আকাশে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জোছনা নেই। চাঁদের বয়স হয়তো দুই তিনদিন তাই। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারের কোন ভাব নেই। চাঁদের চারিদিকে ঘিরে আছে অসক্য তারা। বারান্দায় রাখা শিউলি ফুলের গাছ থেকে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। এই শিউলি ফুলের গাছটা আমাকে বিয়ের পরের দিন আবির এনে দিয়েছে। যখন এনেছিলো তখন গাছে কলি ছিলো দুই তিনটা। সেই কলি থেকেই হয়তো ফুল ফুটেছে, যাঁর জন্য এতো সুন্দর মিষ্টি গন্ধ। আমাকে আবির সামনে দাঁড় করিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। ওর প্রতিটা নিশ্বাস আমার ঘাড়ে আছড়ে পড়ছে। প্রতিটা নিশ্বাসের শব্দ আমাকে শিহরিত করে তুলছে। ওর হাতটা যখন আস্তে আস্তে আমার হাতের বাঁধনে মিলিয়ে দিলো,তখন মনে হলো পৃথিবীতে আমার মতো সুখি হয়তো কেউ নেই। হাতের মুঠোয় হাত নিতেই আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো।

_ সেদিন তোমার একবারের জন্যও মনে হয়নি,এতো কেন অগোছালো ছিলো আমার ঘরটা। কারণটা আমি বলছি। সবাই তো সুন্দর পরিপাটি ঘরে নিজের স্ত্রীকে এনে রাখে! সবাই কি আর পরিপাটি ঘরের মতো নিজের স্ত্রীকে রাখতে পারে। তাই আমি ইচ্ছে করে এমন অগোছালো ঘরে তোমায় এনেছি। আমাদের শুরুটা অগোছালো দিয়ে করেছি! দু’জনে মিলেই সবটা গুছিয়ে নিবো বলে। এলোমেলো সব পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখার দায়িত্ব শুধু তোমার নয় আমারও। আমরা একে অপরের পরিপুরুক। কেউ কখনোই কাউকে ছাড়া পূর্ণ হতে পারি না, আর পারবোও না। তাই সেই মানুষটাকে যদি কেউ একটু ভেতর থেকে এলোমেলো করতে আসে! আমি তাঁকে আঘাত করতেও দ্বিতীয়বার ভাববো না। হ্যা যদি তুমি ভুল করো! সেটা শুধরে দেওয়ার চেষ্টা যদি কেউ করে সেটা আলাদা। কিন্তু সেটাও তাঁকে করতে হবে শান্ত ভাবে। কারণ বুঝিয়ে পাগল ষাঁড়কে বসে আনা যায়। আর তুমি তো মানুষ। আর সব থেকে বড় কথা হচ্ছে। কেউ কি জানে রোজ তাঁর একটা ফোন কলের অপেক্ষায় কেউ ছটফট করে। তাঁর মুখে তুমি শোনার জন্য অধির আগ্রহ নিয়ে বসে থাকে। নিজের ঠিক করে রাখা ডাকনামে তাঁকে বারবার অবাধ্য মনটা ডাকতে চাইছে। এই অধমের কপালে কবে সেই সুখের মুহূর্তোটা আসবে সে কী সেটা বলতে পারবে?

আমি লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যাই এমন অবস্থা আমার। আমি কোন রকম মাথা নিচু করে উত্তর দিলাম।

_ জানি না

_ তাহলে একটা ছোট্ট ভালোবাসার পরশ দেয়ার অনুমতি দেওয়া হোক আমায়।

এবারের কথায় আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কোনমতে ছুটে এলাম। কিছুটা পথ এসে পিছন ফিরে বললাম।

_ কাল থেকে যখন তখন একটা ফোন যেতে পারে! সে যেন রিসিভ করে। তাঁর ঠিক করে রাখা ডাকনাম ধরে সে আমায় ডাকতে পারে,আমি অনুমতি দিলাম। রইলো বাকি তুমি আর ভালোবাসার ছোঁয়া। তোলা থাকুক কিছু! আগামী দিনের জন্য। কারণ সবুরে মেওয়া ফলে।

আমি আর দাঁড়াতে পারিনি দৌড়ে চলে এসেছি। মানুষটা এমন ভাবে লজ্জা দিতে পারে,আমি জানতাম না। লজ্জা মুখে ফুটে উঠলেও মনের কোথাও একটা ভালোলাগা সৃষ্টি হলো, নতুন করে নতুন ভাবে। তাহলে কি এভাবেই সুখের নীড় ধরা দিলো আমায়।

——————–

ঘন্টা দুই হয়েছে আমি আমাদের বাড়িতে এসেছি। অবশ্য আমি একা না,আবির আমার শাশুড়ীও এসেছে। কারণ আগামীকাল আমার ভাইয়ের গায়ে হলুদ,পরশু বিয়ে। সব কিছু তো আগে থেকেই ঠিক ছিলো! শুধু আমার জন্য মোহন বেঁকে বসে ছিলো। যেহেতু আমার বিয়েটা হয়েই গেছে, তাই মায়ের আদরের বড় জামাই নিজের একমাত্র শালাবাবুর বিয়ের সব কিছু ঠিক করে ফেললো। মানুষটা আমায় সারপ্রাইজ দিতে কিছু বলেনি, ভাবা যায়। সকালে যখন বললো আমাকে কিছুদিনে জন্য এবাড়িতে আসার কথা! আমি জানতে চাইলে বললো দরকার আছে। ভেবেছিলাম হয়তো মায়ের শরীরটা খারাপ তাই। কিন্তু এখানে এসে তো দেখি উল্টোটা, তবুও আমি খুশি। আমার একা পালন করা দায়িত্ব গুলোর ভার এতো বছর পর কেউ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আবিরের সাথে আমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক স্বামী স্ত্রীর মতোই প্রায় হয়ে গেছে,অবশ্য একটু ফাঁকা এখনো রয়ে গেছে। আবির বলেছে সেটাও এক সময় দূর হয়ে যাবে। তাঁর কোন অভিযোগ নেই আমার দূরে থাকা নিয়ে। তাঁর কথা হলো দু’টো শরীর এক হলেই যে মানুষ দুটো এক হবে এমন না। তাঁর থেকে ভালে আগে দুটো মন কাছাকাছি আসুক,তারপর না-হয় শরীর। ভালোবাসা দিয়ে আগে বিশ্বাস, ভরসা জয় করতে হয়। তারপর না হয় অন্য কিছু । কিন্তু কোথাও একটা ভয় আমার এখনো হয়! আমার এখনো মনে হয় সমাজের লোক আমাকে নিয়ে সামনে না হলেও পিছু হাসছে। আমি জানি সামনে এমন কিছু হলে আবির তাঁদের দাঁত ভেঙে দিতে সক্ষম। সেটা কোন গুসি দিয়ে নয় কথার জালে। এরকম অনেক মানুষকেই আবির কথার জালে জব্দ করেছে। এইতো কিছুদিন আগের কথা। আমাদের পাশের ফ্লাটের কাকিমা নুন ধার নিতে এলেন। আমার শাশুড়ী মা সেটা দিলেনও। কিন্তু তিনি নুন নেওয়া রেখে আমার মুখের চামড়া টেনে বললো।

_ বউমা,তোমার মুখের স্কিন তো অনেক খারাপ হয়ে গেছে!খসখস করছে ত্বক। আর হবেই না কেন বয়স কি আর কম নাকি? একটু নিজের যত্ন নিও,বলা তো যায় না পরুষ মানুষের মন কখন ঘুরে যায়। তাই বলি কী আমার মেয়ে পার্লারে কাজ করে,তুমি চাইলে আমি ওকে বলে দিবো! তুমি গিয়ে মাঝে মাঝেই ফ্যাসিয়াল করে এসো। এতে তোমার ত্বক জ্বলজ্বল করবে, স্বামীও নিজের আয়ত্তের মাঝে থাকবে।

আবির বাড়িতেই ছিলো,কোথা থেকে ঈগলের মতো এসে টুপ করে আমার গালে গাল ঘসে দিলো। আমি তো আকাশ থেকে টুপ করে পড়ার মতো অবাক। কাকি মা তো হা করে তাকিয়ে রইলো আমাদের দিকে। আবির উনার ওই হা করা মুখ আরো হা করাতে আমাকে চুমু খেয়ে বসলো। এবার আর আমি বসে থাকতে পারলাম না। পড়ে যা-ই যা-ই একটা অবস্থা। আমাকে আবির ধরে কাকিকে বললো।

_ কই কাকি,ওর স্কিন তো একদম ফ্রেশ। গালও ঘসে দিলাম কোন খসখস আওয়াজ হলো না। আপনি শুনেছেন, কই আমি তো এতো কাছ থেকে শুনতে পেলাম না। ফ্রি-তে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আর নুন নেওয়া হলে মুখের হা’টা বন্ধ করুন মাছি ঢুকে যাবে তো? তখন দেখা যাবে মোনাকে পার্লারে নেওয়ার বদলে আপনাকে ডায়রিয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো আমাকে। আপনার ছেলে তো আপনার সাথে থাকে না! তাই সেই গুরুদায়িত্ব তো আমার কাঁধেই পড়বে। দেখুন কাকি নতুন বিয়ে করেছি,এই মুহূর্তে এসব ঝামেলায় আমাকে জড়াবেন না,বুঝতেই পারছেন বেপারটা কতো সিরিয়াস।

আবিরের কথায় কাকি মুখ হা করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। আর আমার শাশুড়ী হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে সোফায় বসে। আবিরও তাঁর মা’কে জড়িয়ে ধরে হেঁসে যাচ্ছে। আর বোকা আমি তখনো বোঝার চেষ্টা করছি আসলে কি হচ্ছে আর কি হলো?

সেদিনের কথা ভাবলে আমি এখনো শিহরিত হই। মানুষটার লজ্জা শরমের বালাই নেই। কিভাবে কাকিমার সামনে গালে টুক করে চুমু খেয়ে বসলো। আল্লাহ তাঁহাকে দিয়ে কোন বিশ্বাস নেই! যখন তখন কিছু ঘটিয়ে ফেলবে। এসব ভাবছি আর আনমনে হাসছি।

_ কি গো আপু,কি ভেবে এভাবে হাসছো।

হঠাৎ সোনালির কথা শুনে মুখ তুলে তাকালাম। ওকে বুকে জড়িয়ে নিতেই রূপালি চলে এলো। দুইবোনকে দেখে চোখের তৃষ্ণা মিটালাম। ভাইবোনের সম্পর্কটা এতোটা নিখুঁত ভাবে আল্লাহ তৈরি করেছেন, যাঁর প্রসংশা সবাই করে। ওরা তিনজন আমার শরীরের একটা অংশ, যা ছাড়া আমি অচল। তারপর তিনবোন বিছানার কোণে বসলাম। বসে পড়তেই, সোনালি আবারও প্রশ্ন করলো।

_ কই আপু বললে না, তখন আনমনে হাসছিলে কেন?

_ তেমন কিছু না, এমনই।

_ আপু হাসছিলো,তা-ও আনমনে সিরিয়াসলি সোনালি।

_ হ্যা সত্যি বলছি আপু হাসছিলো। সেই হাসিতে আপুকে খুব সুন্দর লাগছিলো। আপুকে হাসলে ঠিক রানীদের মতো লাগে। কিন্তু বোকা আপুটা আমাদের হাসতেই চায় না।

_ ঠিক বলেছিস সোনালি। তা আপু বলো না হাসছিলে কেন?

_ আরে তেমন কিছু না।
হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। আমি ফোনটা ধরতেই ওরা আমার থেকে কেঁড়ে নিলো ফোনটা। ফোনের স্কিনে আবির নামটা জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু না ওরা আমায় ফোনটা রিসিভ করতে দিলো, না ওরা রিসিভ করলো। এক সময় ফোনটা বাজতে বাজতেই কেটে গেলো। ফোন কেটে যেতেই রূপালি হেঁসে বললো।

_ দুলাভাই তো ভাইয়ার ঘরে,এতো কাছে থেকেও ফোন করছে। কি মিস করছে আপুকে ভাবতে পারিস সোনালি।

_ হুম সেটাই তো দেখছি।

_ধুর কি বলিস না তোরা।
আমি ফোনটা কেঁড়ে নিয়ে ওদের ফেলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। দরজার কাছে আসতেই আবির হুরমুর করে ঘরে ঢুকলো। আমাকে সামনে দেখে ! কোন দিকবিদিক না তাকিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

_ কই থাকো বলো তো মুন,তোমায় না দেখে আমার জান যায় যায়। তুমি জানো না সবার ভিরে আমার তোমায় দরকার। ফোন দিলাম ধরলে না কেন? এই জন্যই তো আমায় ছুটে আসতে হলো। একটু আগে যে নাস্তাটা পাঠিয়েছি,খেয়েছো সেটা।

_ না মানে আসলে।
আমি লজ্জায় কথা বলতে পারলাম না। খাটের কোণে ওরা দুইবোন বসা। আমাকে এভাবে দেখে কি ভাবছে হায় আল্লাহ। আর মানুষটা এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছে,আমি ছুটতেও পারছি না।

_ না মানে কি?

_ ওরা দেখছে

_ কারা দেখছে।

_ সোনালি রূপালি খাটের উপরে,মানে আমার পিছনে।

_ কিহহ

এই কথা বলেই আবির ছিটকে দূরে সরে গেলো। পিছনে ওদের দেখে আবির নিজেও লজ্জা পেলো। আসলে ও হয়তো ভাবতে পারেনি এমন কিছুর মুখোমুখি হবে। আমাদের এমন নাজেহাল অবস্থা দেখে সোনালি রূপালি বলে উঠলো।

_ বিশ্বাস করেন দুলাভাই আমরা কিচ্ছু দেখেনি। কিরে রূপালি বল, আমরা কিছু দেখেছি।

_ একদম হ্যা,না মানে না। আমরা কিছু দেখিনি। শুধু মনে হলো চোখর সামনে কোন রোমান্টিক মুভি দেখলাম! যেখানে নায়ক দৌড়ে এসে নাইকাকে জড়িয়ে ধরলো৷ কি সিন মাইরি,অসাধারণ। জীবনেও ভোলার নয়। শুধু একটু কিস করলেই সিনটা মাখোমাখো হয়ে যেতো! বিশ্বাস করেন দুলাভাই এটারি কমতি ছিলো। বাকি সব ঠিকঠাক। তাই আরকি আমরা কিচ্ছু দেখিনি। যদি এখন কিস করেন তাহলে কিছু দেখতাম আরকি

এই কথা বলেই ওরা দু’জন ভো দৌড়। আর আমি আর আবির বোকার মতো হা করে রইলাম।

চলবে,,,