নতুন কন্ঠে ভালোবাসুক পর্ব-০৯ এবং শেষ পর্ব

0
441

#নতুন_কন্ঠে_ভালোবাসুক
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ৯

সময় বহমান। সে এগিয়ে যায় তাঁর আপন গতিতে। কিন্তু রেখে যায় কিছু বিষাদের ছাপ,কখনো ভালোবাসার। তবুও সবাই এগিয়ে যায় নিজের মতো করে। সবাইকে এক সময় নিজের গতি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় সামনের দিকে! কারণ এর নামই জীবন। জীবনের গল্পটা ভারি অদ্ভুত। কারনে অকারণে মন খারাপ, তো হঠাৎ করে আনন্দ। তাই এমন করেই এগিয়ে গেছে আমাদের সবার জীবন। কেটে গেছে প্রায় এক বছর। এই এক বছরে সুখ নামের ছোট্ট নীড়ে দুঃখ নামের কোন শব্দ আমার জীবনে ধরা দেয়নি। হুটহাট মানুষটার আবদার আমাকে প্রতিবার মুগ্ধ করেছে। কখনো রাতের শহরে দুজন দু’জনকে অনুভব করেছি। কখনো বা বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা হৃদয় মনকে ছুঁয়ে দিয়েছে। কুয়াশা ঘেরা এলোমেলো রাস্তায় দু’জনেই হেঁটে সুখ খুঁজে নিয়েছি। শিশির বিন্দু পায়ে মেখে খুশিতে কেঁদে দিয়েছি। যখন তখন তাঁর ছোট বাচ্চাদের মতো খুনসুটি গুলো আমাকে হাসিয়ে দিয়েছে। খুব করে মনে হয়, আমি কি তাঁকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা দিতে পেরেছি?কোথাও কোন কমতি নেই তো। ভয় হয় আজও যদি কখনো আবার দুঃখেরা আমায় ঘিরে ধরে। তবুও সব ভয় আমি লুকিয়ে রেখে দিয়েছি,আর আবিরকে বুঝতে দেইনি। একদিন কষ্ট গুলো যেমন লুকিয়ে রাখতাম, আজ ভয় গুলোকে রাখি। কিন্তু মনে হয় এই মানুষটার থেকে কখনোই কোন কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। হ্যা ঠিক তাই আমিও পারিনি৷ একদিন ধরে ফেললো। বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে সেদিন বললো।

_ তোমায় এক দুপুরে দেখেছিলাম। যে দুপুরে তোমার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট কিন্তু ঠোঁটে অমায়িক হাসি। ব্যাগ ভর্তি মাসিক বাজার নিয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলে। তোমার মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হলেও কোথাও একটা প্রশান্তি ছিলো তোমার মুখে। এতটা কষ্ট লুকিয়ে কি করে মানুষ হাসতে পারে! সেদিন তোমায় দেখে শিখেছিলাম। আমার সেই প্রথম মনে হয়েছে জীবনকে যদি আর একটা সুযোগ দেই,তা-ও তোমার মতো মানুষের সাথে নাম লিখিয়ে তাহলে খুব একটা মন্দ হবে না। সেদিন থেকেই সুযোগ পেলেই তোমাকে দেখা আমার নিত্য দিনের কাজ হলো। একদিন কথায় কথায় তোমার ভাইকে বললাম। সবার তো সুখের নীড় আছে। তোমার বোনের তো নেই। তোমাদের মনে হয় না তার-ও একটা নিদিষ্ট জায়গা দরকার। যেখানে সে নিজেকে খোলামেলা ভাবে তুলে রাখতে পারবে। যে তোমাদের কথা চিন্তা করে নিজের সবটা উজাড় করে বিলিয়ে দিলো। তোমাদের কি উচিত না তাঁর দিকেও নজর দেওয়া। তোমাদের কি উচিত না এবার একটু কঠিন হওয়া। তোমরা কি চাও না সুখ নামের ছোট্ট শব্দ তাঁর জীবনে ধরা দিক। তারপর হয়তো তোমার ভাইয়ের খেয়াল হলো। আর বাকিটা তো তুমি জানোই। আর এই জানার মাঝে একটা অজানা হচ্ছে, আমি তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছি। হয়তো সেটা প্রকাশ করিনি। আজ করলাম। আমি নিজে যেচেই তোমার দায়িত্ব নিতে চেয়েছি,সেখানে আমিই যদি দায়িত্ব পালন করতে ভুল করি কিভাবে হবে? তাই তোমার ওই অহেতুক ভয় গুলো এবার দূর কর। আল্লাহ না চাইলে কারো ক্ষমতা নেই তোমাকে আমার থেকে দূরে করার। সমাজের কোন অধিকার নেই তোমাকে কটু কথা শোনানোর। শক্তের ভক্ত, নরমের জোম। তাই তুমি যতো নরম থাকবে,সবাই তখন চেপে ধরবে,নিশ্চয়ই পাশের ফ্লাটের কাকি আর তুবার শাশুড়ীকে দেখে তুমি বুঝতে পেরেছো। আজ তুবার শাশুড়ী তোমার প্রসংশা করে। তাই বুঝতে পারছো জীবন যেখানে যে-মন সেখানেই তেমন করে তুলে রাখতে হবে।

সেদিনের পর থেকে আর ভয় নেই। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে নতুন ভয় আমার মনে বাসা বেঁধেছে। এ যেই সেই ভয় নয়,ভয়ানক ভয়। কিভাবে এই ভয় থেকে আমি বেরিয়ে আসবো জানি না। আমার এই ভয়ের কথা না আমি আবির সাথে বলতে পারছি! না অন্য কারো সাথে। কি করবো আমি জানি না। শুধু মনে হয় সমাজের তিব্র ঘৃণা আমি কীভাবে সইবো। সেই ঘৃণা থেকে যদি আবিরও আমায় ঘৃণা করে। এই বুড়ি বয়সে এসে যদি কোন মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়,বেপারটা সমাজের লোক কীভাবে নেবে। সবাই তো কটু কথা শোনাবে। টিটকারি মেরে কথা বলবে। সেই কথা গুলো আমি কীভাবে সইবো।

—————–

অফিস থেকে আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে আবির। আজ যে একটা বিষেস দিন। এই বিষেস দিনে বিষেস মানুষের সাথে আলাদ কিছুটা সময় কাটাবে বলেই এমন সিদ্ধান্ত। জীবন থেকে কীভাবে যেন এক বছর ফুরিয়ে গেলো। ইসস সুখের দিন গুলো কেন এতো জলদি শেষ হয়ে যায়। সত্যি কি তাই। কম তো সময় নয়। বারো মাস,বাহান্ন সপ্তাহ তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কি কম। তবুও মনে হয়,আরো কিছুদিন পর না হয় এক বছর পূর্ণ হতো। আমার কোন তাড়া নেই। তবুও সময় তো আর আমাদের কথা শুনে না! সে চলে তাঁর নিদিষ্ট বেঁধে রাখা সময়ে। কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিলো আবিরের মা। মা’কে দেখে মুচকি হাসলো আবির। আবির ঘরে চলে গেলো। কিন্তু ঘরে মোনা নেই! হয়তো রান্না ঘরে। ফ্রেশ হয়ে অফিসের জামাকাপড় পাল্টে নিলো আবির। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে এগিয়ে গেলো। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে সেখানে না পেয়ে মায়ের ঘরে পা বাড়ালো সে। মায়ের দরজায় কড়া নাড়তেই! তিনি ঘরে আসার অনুমতি দিলেন। আবির ঘরে ঢুকতেই বুঝলো এখানেও মোনা নেই। তাহলে গেলো কই। ছেলের এমন অস্থিরতা দেখে মনোয়ারা বেগম বললেন।

_ এখানে বস কিছু কথা আছে।

মায়ের কথা শুনে আবির পাশে বসলো। ছেলের মাথায় মমতার হাত বুলালেন। ছেলেকে কাছে টেনে কপালে চুমু একে দিলেন। মায়ের হঠাৎ এমন কাজে আবির একটু ভড়কালো। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলো না। ছেলের আরো একটু পাশে এগিয়ে গেলেন মনোয়ারা বেগম। তারপর বললেন।

_ কিছুদিন ধরে মোনা খুব মনমরা হয়ে থাকে। ঘরের কাজ গুলো করেই কেমন জানি চুপচাপ ঘর বন্দী করে রাখে নিজেকে। তুই এলেই নিজেকে এতটা স্বাভাবিক করে রাখে যেন কিছু হয়নি। কিন্তু তুই চলে যেতেই যেই সেই। জিজ্ঞেস করেছি,কিন্তু তেমন কিছু বলেনি। হয়তো ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে কাউকে বলতে পারছে না। ও তো একটু চাপা স্বাভাবের তাই আমি ধরেও ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না। মন খারাপ করে ছাঁদে গিয়ে বসে থাকে এই সময়ে। তুই ফিরে আসার কিছুক্ষণ আগে ঘরে চলে আসে! যেন কিছু হয়নি। আমার ধারনাটা যদি সত্যি হয়! তাহলে সব থেকে বেশি তোকে ওকে সাপোর্ট করতে হবে। কারণ ও ভেতর থেকে ভেঙে যাচ্ছে। তুই ওকে এটাই বুঝাবি, কোন কিছু হওয়ার জন্য নিদিষ্ট সময়ের দরকার নেই। যখন তখন অনেক কিছু ঘটতেই পারে। ওর শরীরের পরিবর্তন হয়তো তোর চোখে পড়েনি,কিন্তু আমার পড়েছে। তুই ছোট না, তাই বুঝতে পারছিস আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। এবার যা ওকে বুঝিয়ে ঘরে নিয়ে আয়। কারণ এই সময় ও যতো হাসিখুশি থাকবে ততোই ভালো।

_ আবির জ্ঞানী মানুষ, মায়ের অল্প কথায় সে সবটা ধরে নিয়েছে এবং বুঝেও নিয়েছে। কিন্তু সে অবাক হলো,এতোদিনেও মেয়েটাকে বোঝাতে ব্যর্থ সে। সমাজের কোন কথাই আবির মাথা ঘামায়নি,আর না ঘামাবে। কিন্তু সেই সমাজের ভয়ে আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারি এমন ভয় নিজের মনে বাসা বেঁধেছে। তবুও আবির ভেঙে পড়বে না। মোনাকে গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তো তাঁর। তাই মোনা যতোবারই ভেঙে যেতে চাইবে! ততোবারই ওকে আবার গড়ে তুলবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ছাঁদে পা রাখলো আবির। ছাঁদের রেলিং ধরে দূর আকাশে তাকিয়ে আছে মোনা। যে কেউ দেখলেই বলবে মোনার মন খারাপ। পাশে গিয়ে দাঁড়ালো আবির। আবিরের উপস্থিতি বুঝতে পারলো না মোনা। কারণ সে ব্যস্ত তাঁর হিসেবের খাতা মিলাতে। আবির নিজেকে স্থীর করে বললো।

_ চাঁদের কি মন খারাপ।

হঠাৎ মানুষটার আগমনে একটু অবাক হলো মোনা। কিন্তু নিজেকে সামলে বললো।

_ চাঁদের মন খারাপ হলে সে মেঘের আড়ালে লুকাতো।

_ তাহলে কি ধরে নিবো,চাঁদের সময় ফুরিয়ে গেছে! এখন আমাবস্যা চলছে। নতুন চাঁদ উঠবে।

আবিরের কথায় মোনা ভয় পেলো। চোখেমুখে ফুটে উঠলো ভয়ের ছাপ। তাহলে কি সেই অনাকাঙ্ক্ষিত দিন চলেই এলো।সমাজের তীর অবশেষে আবিরকেও ছাড়লো না।

মোনার নিরবতা দেখে আবির বললো।

_ তা এই চাঁদ কি নিজে থেকেই নির্বাসন নিচ্ছে।

মোনা চুপ

_ তাঁর নির্বাসন নেওয়ার কোন যুক্তি আছে তাঁর কাছে। সে কি অন্যায় করেছে। আর কি এমন অন্যায় যে সে আকাশের বুক থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছে। সে কি ভুলে গেছে এক আকাশের বুকে একটি চাঁদ থাকে। ঘুরেফিরে সে নতুন করে নতুন ভাবে ফিরে আসে। চাঁদের হয়তো অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছে! যাঁরা চাঁদের গুনোগান সব সময় গায়। কিন্তু এক আকাশের কিন্তু একটা চাঁদ ছাড়া কোন সঙ্গী নেই। তাহলে চাঁদ কেন এই সময় একা ভাবছে নিজেকে। আল্লাহ যাকে পাঠাতে চাইছে! সে এলে যে সমাজের কথায় আমি চাঁদকে ছেড়ে দিবো এমনটা কেন মনে হলো চাঁদের। চাঁদ কি আমায় বেঈমান প্রমাণ করবে পৃথিবীর কাছে। নাকি সে পণ করেছে সমাজের কথা তাঁকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। তাঁকে ভালোবাসা দিতে আমি কি কোথাও কমতি রেখেছি! যে সে আমায় এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ভুলে কেন যাচ্ছে, ওই অংশ তাঁর একার নয় আমারও। তাহলে এই সমাজে নিকৃষ্ট কথার তীরে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে একা ছেড়ে দিবো আমি কেন ভাবছে সে। আগেও ছিলাম,এখনো আছি,ভবিষ্যতেও থাকবো। কেউ চাইলেও থাকবো,না চাইলেও। যে আসতে চাইছে সে আসবে,এবং সমাজের কোন রকম কটু কথা না শুনেই আসবে। সমাজের জানা উচিত, তাঁকে আমরা মানুষ করবো! তাঁকে পৃথিবীতে আনতে তাঁর মায়ের কষ্ট হবে। তাঁর বাবা-র রক্ত ঝড়া ঘামের টাকায় সে বড় হবে। তাঁর মায়ের নির্ঘুম রাতের সাক্ষী সে হবে। তাহলে সমাজ কি বলবে,এই জন্য তাঁর অস্তিত্ব জেনে তুমি ভয়ে সিঁটিয়ে আছো। সে তোমার একার নয়! সে আমার তোমার! সে আমাদের। তাই তাঁর অস্তিত্বকে তুমি অনুভব করো অস্বীকার নয়। তাঁর আসার খবরে তুমি আনন্দিত হয়,কষ্ট নয়। আমি তোমার পাশে ছিলাম। এবার তোমাদের থাকবো। তোমরা শুধু আমার শক্তি হও, দুর্বলতা নয়। নতুন করে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে নিলে দোষ কোথায়৷ একটা নতুন অস্তিত্ব দিয়ে না-হয় আবারও শুরু করো তুমি আমায় ভালোবেসে। নতুন কন্ঠে আমায় ভালোবাসো। আমি তোমার নতুন কন্ঠে ভালোবাসার অপেক্ষায় আছি।

কথা শেষ হতেই আবির চলে যায়। কিন্তু পেছনে নিজের হাতে টান অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে মোনা হাত আঁকড়ে আছে। দুই চোখ ঝাপিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে তাঁর । কিন্তু মুখে তাঁর হাসি। এই হাসির মানে আবির যানে। দুই হাত প্রসারিত করে বুকে টেনে নিলো মোনাকে। মোনা হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।

_ আমি তুমি থেকে আমরা হয়েছি। এবার আমরা থেকে আমাদের হওয়ার দিন শুরু। সে এসে আমাদের নতুন কন্ঠে ভালোবাসুক। তাঁর দিন আমি গুনতে শুরু করলাম। আর ভাববো না সমাজের নিচুস্তর কথা গুলো। আজ থেকে শুধু আমাদের কথা ভাববো। আমাদের সুখের দিন গুলো আরো সুখের করতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবো। ওসব মানুষের কথা মাথা থেকে বের করে দিবো! যাঁদের কথা বিষের থেকেও বিষাক্ত। আমরা না-হয় নতুন করে আবার শুরু করবো।

হেঁসে দিলো আবির। অবশেষে তাঁর বোকা বউটাকে বোঝাতে সক্ষম হলো। শুরু হলো নতুন দিন। নতুন পথের সূচনা। আমরা থাকবো এভাবেই। মোনা আবিরের বুকে মুখ লুকিয়ে গেয়ে উঠলো।

তবুও সুর ফিরে আসুক,
নতুন কন্ঠে ভালোবাসুক।
আপনি নামক তুমিটা,
সারাজীবন ছায়া হয়ে থাকুক।
কোন বৃষ্টির সন্ধ্যায়, দেওয়া তাঁর ডাকনাম ধরে আমায় ডাকুক।
শীতের সকালে চাদরে মুড়িয়ে
বুকে জড়িয়ে রাখুক।
ভুলগুলো সব শুধরে দিয়ে,
আমায় তাঁর পাশে রাখুক।
সবশেষে বলবো আমি,নতুন কন্ঠে সে আমায় ভালোবাসুক।

সমাপ্তি